ফকির ইলিয়াস

‘প্রেম চিরন্তন নয়’: কবি শহীদ কাদরী

‘প্রেম চিরন্তন নয়’: কবি শহীদ কাদরী
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

বাংলানিউজের সঙ্গে কথপোকথন
‘প্রেম চিরন্তন নয়’: কবি শহীদ কাদরী

——————————————
লিংকপঞ্চাশ দশকের কবি শহীদ কাদরী। বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি। তাঁর কবিতা প্রজন্মের মননের প্রতীক। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪২ সালে। ১৪ আগস্ট ছিল তাঁর জন্মদিন। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রবাসে জীবন-যাপন করছেন তিনি। বর্তমানে নিউ ইয়র্কে অভিবাসী।

 

কেমন আছেন ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ খ্যাত কবি শহীদ কাদরী? এটা জানতেই সম্প্রতি কবির জন্মদিনকে সামনে রেখে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে তাঁর সঙ্গে কথা বলেন ফকির ইলিয়াস।

ফকির ইলিয়াস : ১৪ আগস্ট আপনার জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার অনুভূতি কি ?

শহীদ কাদরী : আমি জন্মদিনকে বড় করে দেখি না। আমার জন্ম কলকাতায়। সেখানে জন্মদিন ঘটা করে পালিত হয়। আমি তা করি নি। অবশ্য কিছু ফ্যাক্টর কাজ করেছে।

আমার প্রায় আট বছর বয়সে বাবা দেহরক্ষা করেন। ঢাকায় এলাম ১০ বছর বয়সে। বাসায় জন্মদিন উদযাপিত হয়নি। জন্মদিনে নিজেদের মাঝেই আনন্দ ভাগ করে নিতাম।

আমরা জানি জন্মদিন ঔপনিবেশিক সভ্যতা থেকে পাওয়া। কিন্তু এটাও জানি, কলকাতায়ও একসময় বড়দিন খুব ঘটা করে উদযাপন করা হতো।

ফকির ইলিয়াস : এই সময়ে এসে একজন কবির জন্মদিনকে কেমন দেখছেন ?

শহীদ কাদরী : জন্মদিন মানেই অন্ধকারের দিকে আরেক ধাপ এগিয়ে যাওয়া। বয়স একটি বছর বেড়ে গেল! প্রতিটি জন্মদিন আমাদেরকে মৃত্যুর কাছাকাছি নিয়ে যায়।

ফকির ইলিয়াস : আপনি কী মিস করেন বাংলাদেশকে ?

শহীদ কাদরী : প্রতিটি মুহূর্তে মিস করি। এটা ভাষায় বোঝানো যাবে না। তুমিতো জানো, ২০০০ সালে বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে ফিরে যাবার পুরো প্রস্তুতি আমি নিই। ঐ বছর ডিসেম্বরে চাকুরি ছেড়ে দেবো- এমন নোটিশও দিই। কিন্তু বিধি বাম। অক্টোবর মাসেই আমি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে স্থানান্তরিত হই। ডাক্তার জানিয়ে দেন, আমার দুটো কিডনিই কাজ করছে না। তারপর পাল্টে যায় সব পরিকল্পনা।

ফকির ইলিয়াস : আপনি মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থের জনক। এতো কম লিখেও আপনি এতো জনপ্রিয় কেন ? আপনি কীভাবে এতো উজ্জ্বল হয়ে আছেন আপনার পাঠকের কাছে ?

শহীদ কাদরী : আমি মনে করতাম ঢাকা থেকে কেউ চট্টগ্রাম চলে গেলেই লোকে তাকে ভুলে যায়। ১৯৭৮ সালে দেশ ছেড়ে আসি। তখনই মনে হয়েছিল, সব শেষ ! বিদেশে এসে আমি বাংলা বই পর্যন্ত পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। বই পাবার সুযোগও ছিল কম।

তাছাড়া, আমি বিদেশে এসে বাঁচতে চেয়েছি এমন একজন মানুষ হিসেবে, যে কোনোদিন লেখালেখি করেনি। বাঁচতে চেয়েছিলাম সাধারণ মানুষের মতো। নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টায় ব্যাপৃত ছিলাম। কিন্তু পারি নি।

একসময় আমার ঘনিষ্ঠ কিছু বন্ধু-বান্ধব আমাকে আবার মাঠে নামালেন। কবিতার মাঠে। এখন তোমরাই আমাকে বলো, তরুণ প্রজন্ম আমার কবিতা পড়ে। ওরা আমার কবিতা নিয়ে ভাবে। বিদেশে বসে আমি আশ্চর্যান্বিত হই ! আমাকে প্রজন্ম মনে রেখেছে !
আপ্লুত হই ! শুনে খুব ভালো লাগে। নতুন করে প্রাণ পাই।

ফকির ইলিয়াস : আপনার এই যে ফিরে আসা ……

শহীদ কাদরী : হ্যাঁ, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত বললেন আমাকে একটা বই করতেই হবে। বোস্টনের বদিউজ্জামান নাসিম এরকম আমার বন্ধুরা আমাকে প্রাণিত করলেন। তারপরই আমার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ – `আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও` বেরুলো।

ফকির ইলিয়াস : একজন কবি কিংবা লেখকের জীবনের শক্তি কি ?

শহীদ কাদরী : আমি মনে করি কোনো কবি-লেখকের জীবনে কেউ কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। লেখকের জীবনকে নিজেই সংরক্ষণ করে যেতে হয়। লেখককে নিজের আকাশ তৈরি করে নিতে হয়।

ফকির ইলিয়াস : এসময়ের কবিতা বিষয়ে বলুন ।

শহীদ কাদরী : আমাদেরকে একটি বিষয় জানতে হবে, আধুনিক কবিতা কী । আধুনিক মানুষ কে । আধুনিক মানুষ সে-ই যে মধ্যযুগীয় নয়। মধ্যযুগীয় মানুষ কে? যে মানুষ বর্বর ছিল, যে মানুষ বিজ্ঞান বিষয়ে অচেতন ছিল। আমরা আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছি ঠিকই।

কিন্তু দেখতে হবে মার্কেন্টাইল সোসাইটির শিকারে পরিণত হয়েছে সমাজ। অর্থনৈতিক শক্তিগুলো আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলেই মানুষ হিসেবে গ্রাহ্য ! তখন আমার মনে হয় এই পৃথিবী আমাদের ঘর নয়। আমার মতো অনেক কবিই সে কথা আজও তাদের কবিতায় ব্যক্ত করছেন।

আমি ঘরহীন মানুষের আর্তনাদকে আমার কবিতায় ধারণ করতে চেয়েছি। সে সময় এমন কিছু ছিল না, যা আমি ঢাকা শহরে দেখিনি। আমার দেখাকে আমার কবিতায় ব্যবহার করেছি। শামসুর রাহমানের স্মৃতিকথা (স্মৃতির শহর) পড়লেই বোঝা যাবে সে সময়ের ঢাকা শহর কেমন ছিল।

আমার কবিতা আমার অভিজ্ঞতার অংশ। লব্ধ অভিজ্ঞতাই আমাকে সাহায্য করেছে।
একটা কথা বলি, বাংলা ভাষার আধুনিকতাও কিন্তু এক নয়।রবীন্দ্রনাথে যা ছিল না,তিরিশের কবিরা তা যুক্ত করতে চেয়েছেন। আর পরবর্তীকালে আমরা তিরিশের কবিদেরও অতিক্রম করার চেষ্টা করেছি। এবং মনে করি আমরা উত্তীর্ণও হয়েছি।

ফকির ইলিয়াস : প্রেম কী, কেন প্রেম ?

শহীদ কাদরী : আমি মনে করি প্রেম চিরন্তন নয়। অনেক আধুনিক মানুষই তা বিশ্বাস করে না। করতে পারে না। আধুনিক মানুষেরা সবকিছু হারিয়েই তার জীবনের মূল আখ্যানে ফিরে আসে।এই যে অন্বেষণ সেটাই আধুনিক মানুষের মূল চরিত্র। আধুনিক কবিতার আরাধনা।

ফকির ইলিয়াস : বর্তমান সময়ের তরুণ কবিদের কবিতা বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি ?

শহীদ কাদরী : এই সময়ে অনেক তরুণ কবি। আমার কাছে বেশ কিছু তরুণের বই আছে। আমার কবিতাগুলো পড়ে মনে হয়েছে, কবিতা নতুন মোড় নিচ্ছে। অনেকের মাঝেই নতুনত্ব আছে মনে হয়েছে। কারো কারো মাঝে বেশ প্রতিশ্রুতিও আছে।এটা আশার কথা।
ফকির ইলিয়াস : বিশ্ব কবিতার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলা কবিতা কতটুকু এগোতে পারছে ?

শহীদ কাদরী : সাহিত্য তার ভূখণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত থাকে। প্রত্যেক ভাষার কবিরা নিজ ইতিহাস, সংস্কৃতির সাথে যুক্ত। অনেক কিছুই ইংরেজিতে সম্ভব, যা বাংলায় সম্ভব নয়।আবার অনেক কিছুই বাংলা ভাষায় প্রাণবন্ত, যা ইংরেজিতে সম্ভব নয়।

পড়ি , জীবনানন্দ দাশকে –
“ কী কথা তাহার সাথে
তার সাথে “
এই যে বিকিরণ, তা অন্য ভাষায় কি সম্ভব ? না সম্ভব নয়।
আরও একটা কথা বলি। অমলেন্দু বোস। সময়ের শ্রেষ্ঠ সমালোচক। ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বলেছেন, জীবনানন্দ দাশ, ইয়েটস – এর চেয়েও বড় কবি। নিজ ঐতিহ্যই কবিকে সমৃদ্ধ করে। আমরা দেখতে চাইবো, নিজ শৈলীতে ঐ ভাষায় কবিতা কতোটা অগ্রসর হয়েছে।

একটা উদাহরণ দিতে পারি। যেমন ইংরেজ কবিরা ` ডিভোর্স` শব্দটির নানা উপমা,চিত্রকল্প ব্যবহার করে কবিতা লিখছেন। কথা হচ্ছে, বাংলা ভাষায়, বাঙালির ঐতিহ্য তেমন কবিতা গ্রহণ করতে কতোটা প্রস্তুত ? গ্রহণ করবে কি ? তা আমাদের ভাবতে হবে। কারণ আমরা তো জানি, নৌকা, নদী, বৃষ্টি, ঝড়, বৈশাখ এমন অনেক শব্দউপমাকে আমরা ভুলে যেতে পারবো না।

ফকির ইলিয়াস : বাংলা কবিতার অগ্রযাত্রা সম্পর্কে আপনার আশাবাদ …

শহীদ কাদরী : আমি কিছুদিন আগে ড. রফিকউল্লাহ খান সম্পাদিত বাংলা কবিতার এন্থলজিটি পড়লাম। খুবই ভালো একটা সংকলন।

এখানে অনেক কবির কবিতাই আমার কাছে উজ্জ্বল মনে হয়েছে। ঐ সংকলন থেকে কিছু তরুণ কবির কবিতা আগামীতে আমি নিউইয়র্কের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পঠনের ব্যবস্থা করবো। এ সময়ে বিদেশে বসেও অনেক বাঙালি কবি কাব্যচর্চা করছেন। যা খুবই আশা জাগানিয়া। যেমন তুমি কিংবা শামস আল মমীন যে নিয়মিত চর্চা করছো, তা তো বেশ বড় কর্ম। কবি তমিজ উদদীন লোদী দেশে থাকতেই কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। এখন তিনিও নিউ ইয়র্ক অভিবাসী। দেশে – বিদেশে মননশীল কবির সংখ্যা বাড়ছে। এই অগ্রযাত্রা আমাদের কবিতার সেতুবন্ধনকে সুদৃঢ় করবে, সন্দেহ নেই।

ফকির ইলিয়াস : আপনার নতুন কোনো বই কী আসছে ?

শহীদ কাদরী : একটা বই করার ইচ্ছে আছে আমার। প্রস্তুতি চলছে। আমি চাই আমার পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ থাকুক। মনের মাঝে অনেক কথা বাকি আছে, যা কবিতায় বলতে চাই।

ফকির ইলিয়াস : আপনি কী মনে করেন সব কবিতাই জীবনবাদী ? সব কবিতা কবিকে বাঁচিয়ে রাখে ?

শহীদ কাদরী : না , মনে করি না। সব কবিতা টিকে থাকে না। থাকতে পারে না। এই সময়ে অনেক অকবিতা লেখা হচ্ছে। আগেও হয়েছে। কালের বিবেচনায় আমি রবীন্দ্রনাথের পর জীবনানন্দ দাশ ও সুধীন্দ্রনাথ দত্ত কে অনেক বড় কবি মনে করি।

ফকির ইলিয়াস : মৃত্যু নিয়ে কবিতা– কীভাবে দেখেন ?

শহীদ কাদরী : আমি মৃত্যু নিয়ে কবিতা লিখিনি। লিখেছি মৃত্যুকে রোমান্টিক ভাবনার অনুষঙ্গ করে। জীবনের পরিণতি হিসেবে মৃত্যুকে মেনে নিতে হয়। কিন্তু তা আমারও কাম্য না।

বাঁচতে চাই হাজার বছর। কিন্তু দীর্ঘায়ু পেলে একটা সমস্যা হয়। মনে করো, একজন মানুষ দীর্ঘায়ু পেলো। সে প্রেম করলো। বন্ধুত্ব করলো।পরে দেখে তার চারপাশের প্রিয় মানুষগুলো নেই। সে ঠিকই বেঁচে আছে। ফলে সে বিষাদগ্রস্ত হয়। তখন সেও মরতে চায়। সত্য হলো এই, হাজার বছর বাঁচার পরও মানুষের মরার ইচ্ছে হবেই।

ফকির ইলিয়াস : জীবন ও কবিতা, দুটোকে সমান্তরালভাবে কতটুকু দেখেন ?

শহীদ কাদরী : দুটোকে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবেই আমি ধারণ করেছি। আমি মনে করি জীবন অনেক বড়। কবিতার জন্য আমি সবকিছু বিসর্জন দিতে রাজী না। জীবন অনেক জরুরী এবং তা কবিতার চেয়েও।

বাংলাদেশ সময় ১৫২১, আগস্ট ২১, ২০১১

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


5 Responses to ‘প্রেম চিরন্তন নয়’: কবি শহীদ কাদরী

You must be logged in to post a comment Login