প্রজ্ঞা পারমিতার জলতল অথবা এ্যান্ডারসনের চকোলেট
আমার ছোট মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা। যেদিন বাড়িতে এলো, আমার বাগানে সেদিন বেগুন পাতায় টুনটুনিরা বাসা বানাল। ফুটে উঠল বর্ষার শেষে কয়েকটি গাদা ফুল। বড়ো মেয়ে পূর্বা ভয় পেয়ে পালিয়েছিল পালপাড়া। ফিরে এসে বোনের আঙুল ছুয়ে বলল, কী ছোটো, কী ছোটো। সারাক্ষণ এই নতুন বোনটির কাছে বসে রইল। মাঝে মাঝে মাছি তাড়াল। আগডুম বাগডুম খেলল। বোনের পাশেই ঘুমিয়ে পড়ল। আর তুলতুলে প্রজ্ঞা পারমিতা একজন সুখী মানুষের মতো হেসে উঠল খিল খিল করে।
বাসার সামনেই পুকুর। বেশ বড়ো। চারিদিকে নারিকেল গাছ। আর কয়েকটি দীর্ঘতরু– রেইনট্রি । একটি বরই গাছ বুড়ো মানুষের মতো জলের উপর ঝুঁকে আছে। ডালে ডালে অর্কিড। লাল লাল ফুল ফোটে। জলের উপরে ফুলের ছায়া পড়ে।
বড়ো মেয়েটির পিঠে দুটো ফিশিং বল বেঁধে দিলাম একদিন। সারা পুকুর জুড়ে ভেসে ভেসে বেড়াল। কিছদিন পরে ফিশিং বল দুটো খুলে ফেলল ও নিজেই। প্রজ্ঞা পারমিতা জানালা থেকে হাততালি দিল– দিদি। দিদি। দিদি।
দিদি তখন জলে থাকে। জলে ভাসে। ভাবে, সেও এক হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যান্ডারসনের মৎসকুমারী। বলে, বাবা দ্যাখোতো আমার পা দুটি লেজ হয়ে যাচ্ছে কিনা? বলে, মৎসকুমারী হলে তার চুল হবে সোনালী আর ঠোঁটে থাকবে সমুদ্রপাখির গান।
আমি তখন জলে জলে ঘুরে বেড়াই। সকাল থেকে সন্ধ্যে। কখনো অনেক রাত্তিরে। কখনো কচানদীতে, সন্ধ্যা, কালিগঙ্গা, বলেশ্বর, অথবা পানঘুচি নদীতে। কখনোবা সুগন্ধ্যা, কীর্তনখোলা, তেতুলিয়া, পায়রা, কালাবদরে। মাঝে মাঝে আড়িয়াল খাঁতে। মাঝে মাঝে চোখে পড়ে- জল থেকে লাফিয়ে উঠছে ইলিশ। জেলে নৌকায় আচড়ে পড়ছে। কয়েকটা লাফ দিয়ে হয়ে যাচ্ছে নিথর। আহা, ইলিশ। ইলিশের যদি ডানা থাকত!
একদিন ছোটো মেয়েটি টলোমলো পায়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এলো। একা। পেয়ারা গাছের নিচে বিউটির মা কাপড় কাচছে। তার আঁচল নিয়ে খেলল। তাঁর আঁচল মাথায় দিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। একটি শুকনো পেয়ারা পাতা ঘাস থেকে তুলল। নেড়ে চেড়ে দেখল। গুজে দিল পাকা চুলের ভিতর। দোতলার বারান্দায় ইঞ্জিনিয়ার ভাবি চাল বাছছেন। চেচিয়ে বলল, কাকী। কা-কী-ই।
আমার বড়ো মেয়ে পুকুরর পাড় ঘেসে জল ছিটিয়ে থৈ থৈ খেলছে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে। ছিটকে উঠছে জল। ঢেউ খল খল। এর মধ্যে প্রজ্ঞা এসে পড়ল। পাড় থেকে। গড়িয়ে। জলের মধ্যে। ওরা হৈ হৈ করে উঠল- প্রজ্ঞা সাঁতার শিখছে। সাঁতার শিখছে প্রজ্ঞা। জলের মধ্যে ওরা ঘিরে ঘিরে জল নিয়ে নতুন খেলা শুরু করছে।
রাতে ঘরে ফিরে দেখি, আমার স্ত্রী শুয়ে আছে। তার চোখ থেকে ঝরছে জলধারা। পিঠের আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছে পূর্বা অতন্দ্রিলা। ছোটটি নেই। বুকের মধ্যে ধ্বক করে উঠল। বলে উঠলাম, আমার কাটুস কই?
স্ত্রী কেঁদে উঠল শব্দ করে। বলল, আছে। আছে। এই দ্যাখো।
দেখি, বুকের মধ্যে কাদা হয়ে ঘুমিয়ে আছে ছোট মেয়ে প্রজ্ঞা পারমিতা। নিশ্চিন্তে। নিরাপদে। শান্তিতে। আঁচল দিয়ে ঢাকা। ঠোঁট চুক চুক করছে। ঘুমের মধ্যে হেসেও উঠছে মাঝে মাঝে। হাতের মুঠোয় একটি শুকনো পেয়ারা পাতা। পাকা চুল জড়ানো।
ওর মা বলল, বিউটির মা ফিরিয়ে এনেছে।
যদি না থাকত বিউটির মা পেয়ারা গাছের তলায়? যদি না থাকত ইঞ্জিনিয়ার ভাবি দোতলায় বারান্দায়?
একথা আমার ছোট মেয়েটির কিচ্ছু মনে নেই। এখন তার লম্ব চুল। বেনী বাঁধে। হাসে। স্কুলে যায়। বরফের উপর দিয়ে হাঁটে। পরীপাখির দিকে ফিরে গান গায় সমুদ্রপাখিদের মতো– তুম্বালা, তুম্বালা, তুম্বালাইকা।
ওর মনে আছে শুধু দেলোয়ার কাকার কথা। মুদি দোকানী দেলোয়ার কাকার চকোলেটের কথা। সারি সারি কাঁচের বয়ামের ভেতরে কাগজে মোড়ানো চকোলেট। খুব মিষ্টি। বলে, বাবা– চকোলেট না। ক্যান্ডি। ক্যান্ডি। বলো, ক্যান্ডি। য়ু আর নট স্মার্ট, ড্যাড!
বাবা কিচ্ছু জানেও না। জানে না– ও রকম মিষ্টি ক্যান্ডি আর কখনোই সে খায়নি। খেতে পারবে কি আর কখনো?
4 Responses to প্রজ্ঞা পারমিতার জলতল অথবা এ্যান্ডারসনের চকোলেট
You must be logged in to post a comment Login