একটি ইটের পাঁজরে লেখা থাকবে তোমার বাবার নাম-অভিজিৎ রায়
গত এক সপ্তাহ ফোন-কম্পিউটার-ইন্টারনেট থেকে দূরে ছিলাম। ছিলাম আনন্দে, সমুদ্রের বিশালতার কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে জীবনকে উপলদ্ধি করতে। ভাবছিলাম ফিরেই সেই আনন্দের ভাগ নেবো। আজ সকালে বন্দরে নোঙ্গর করলো জাহাজ আর আমি মুঠোফোন চালু করতেই অজস্র নোটিফিকেশন, তার মধ্যে একটি ঠাস করে চোখে পড়ে- ‘সেজান দেশে আসবেন না, অভিজিৎ কে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে।
আমি খবর দেখি, চিৎকার করে তৃষ্ণাকে ডাকি। ও সব শুনে স্তব্দ হয়ে বসে থাকে। আর আমি ডুকরে কেঁদে উঠি। ছোট ছেলে বলে ‘বাবা কেন কাঁদে?” তৃষ্ণা ওকে বুঝানোর চেষ্টা করে, বলে একজন লেখক, আমাদের বন্ধু কে মেরে ফেলেছে। ও বাংলায় লিখতো, ধর্ম নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে যা বাংলাদেশের অনেকে পছন্দ করতো না’। ছোট ছেলে বলে, “দেন হোয়াই ডিড হি রাইট ফর দোজ স্টুপিড পিউপল?” ছোট্ট মানুষের কী ছোট্ট কিন্তু বিশাল প্রশ্ন! কেনো লিখতো অভিজিৎ, আমরা কেন লিখি? কেন মুক্তমনা হবার জন্যে এই লেখা জরুরী?
এই প্রশ্নের উত্তরে মধ্য দিয়েই অভিজিতের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ‘যায় যায় দিন’-এ কলাম লিখেছিলাম ‘সহনশীলতা বনাম আত্নঘাতী উগ্রতা” শিরোনামে। সেখানে এই উগ্রতার পরিনাম কি, সহনশীলতা কেন জরুরী তা নিয়ে লিখেছিলাম। সেটা পড়ে অভিজিৎ ইমেইল করেছিলেন ভালোলাগা জানিয়ে। আরও জানাতে যে ‘মুক্তমনা’ নামের ওয়েবসাইট শুরু করেছেন যেখানে একটা পাতায় আমার সব কলাম আপলোড করেছেন। সেখানে যেনো লিখি। তারপর আরও জানা, আরও কথা। অভিজিতের স্ত্রী বন্যা আবার তৃষ্ণার ছোটবেলার বান্ধবী, সেই ভিকারুননেসা নুন স্কুল থেকে, তা বের হয়ে গেল। ওদের মধ্যে আরও কথা হয়। ওরা থাকে আটলান্টায়, আমাদের থেকে মাত্র চার ঘন্টা দূরে। ওহ! কি লিখতে চাইছি আর এইসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছে!
অভিজিৎ কলমযোদ্ধা ছিলেন, সহযোদ্ধাও। ‘সহনশীলতা বনাম আত্নঘাতী উগ্রতা’ কলামে লিখেছিলাম যখন ফরাসি রসায়নবিদ ল্যাভয়শিয়ে কে গিলোটিনে হত্যা করা হয় বিপ্লবীদের দিয়ে গীর্জার ধর্ম-পন্ডিতদের পরোক্ষ নির্দেশে এবং যোগসাজশে তখন আরেক পন্ডিত জোসেফ লুই ল্যাগ্রাঞ্জে বলেছিলেন ‘এই মাথাটি কাটতে ওদের মাত্র এক পলক লেগেছে, অথচ হয়তো একশ বছরেও এমন একটি মাথার জন্ম হবে না।‘ হ্যা, মাত্র দু মিনিটে অভিজিৎ কে কাপুরুষের মতো পেছন থেকে কুপিয়ে মেরেছে নরপিশাচেরা অথচ আরেকজন অভিজিৎ তৈরি হতে হয়তো আগামি এক যুগ পার হয়ে যাবে। অভিজিৎ মেধাবী ছিলেন, বুয়েটে পড়া ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন। কিন্তু তা তো অনেকেই আছেন। মেধাবী হওয়া আর সেই সঙ্গে মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়া তো এক কথা না। আবার মুক্তচিন্তার অধিকারী হওয়া আর তা প্রকাশ করার সৎ সাহস থাকা এক কথা না। অভিজিৎ ধীরে ধীরে নিজেকে একটি মুক্তচিন্তার প্রতিষ্ঠানের মতো বানিয়ে ফেলছিলেন। আর তা সহ্য করতে পারছিল না এইসব মধ্যযুগীয় বর্বরেরা।
মানুষের অগ্রগামী চিন্তার সঙ্গে পশ্চাৎপদ চিন্তার সংঘাত তো নতুন নয়। হাজার হাজার বছর আগে সক্রেটিস কে হত্যা করা হয়েছিল, গ্যালিলিও এবং কোপার্কেনিকাস কেও হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল, ইবনে সিনা কে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল নিজ ভূমি থেকে। কিন্তু লক্ষ্য করুন সেই হাজার হাজার বছর আগেও অন্তত প্রহসনের বিচার করে তারপরে হত্যা করেছিল বা শাস্তি দিয়েছিল। কিন্তু অভিজিৎ কে মারা হলো কাপুরুষের মতো অন্ধকারে, পেছন থেকে। আমরা কি মধ্যযুগের আগেরও আগের চেয়ে অধোপতনে যাচ্ছি না?
অভিজিৎ আর বন্যার এই ছবিটি আমার খুব প্রিয়। আভিজিৎ ছিলেন একজন ভালবাসাময়, স্বপ্নময় পারিবারিক মানুষ। সেই নিউ ইয়র্ক বইমেলায় যখন প্রথমবার দেখা হয়েছিল আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত ধরে বলেছিলেন ‘সেজান ভাই, আমি অভিজিৎ’। আর আমি ভেবেছিলাম হয়তো নিউ ইয়র্কে বাস করা কোন প্রবাসী কেউ। ভিড়ের মধ্যে ভাবতেও পারি নি যে এই সেই ‘মুক্তমনা’র অভিজিৎ যার সঙ্গে কতো কথা, কতো ইমেইল লেখা হয়েছে। এই নিয়ে কী ছেলেমানুষী অভিমান ছিল। শেষমেষ রফা হলো যে আমরা ড্রাইভ করে আটলান্টায় বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করবো এই ভুলের। আমাদের সেই আড্ডা আর হবে না!
অভিজিৎ আর বন্যার মেয়ে ‘তৃষা’ আমার ছেলের মতোই কি প্রশ্ন করবে “দেন হোয়াই ডিড হি রাইট ফর দোজ স্টুডিপ পিউপল?” আমি আমার ছেলেকে বুঝিয়ে বলি, বাংলাদেশের সবাই তো আর ঐ রকম না। দেখো কতো মানুষ প্রতিবাদ করছে, মিছিল করছে, ভালবাসা জানাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষই তো সত্যকে জানতে চায়। তারপরও লজ্জিত হই, শুধু লেখার জন্যে একজন কে প্রাণ দিতে হলো? এই লজ্জা, কষ্ট কোথায় রাখি? ‘তৃষা’ কি আমাদের ক্ষমা করবে কোনদিন?
জাহাজ থেকে নেমে তিন ঘন্টা গাড়ি চালিয়ে বাসায় এসেছি কীভাবে বলতে পারবো না। চোখ ভিজে ঝাঁপসা হতে হতে ভুল পথে চলে যাবার মতো হয়েছে। কি লিখছি তাও মনে মনে গোছাতে পারছি না। কেন মরতে হবে একজন মানুষ কে শুধু লেখার জন্যে, চিন্তার ভিন্নতার জন্যে? তার ওপরে ফেসবুকে মানুষের কী নির্মম, ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। যারা এই হত্যাকে কোন রকমের ‘কিন্তু’ ‘আসলে’, ‘হয়তো’ এইসব শব্দরাজি দিয়ে প্রচ্ছন্ন সায় দিচ্ছেন, যৌক্তিকতা দিচ্ছেন তাদের জন্যে আরও করুনা হচ্ছে। দয়া করে কেউ এমন থাকলে বন্ধু তালিকা থেকে বিদায় নিন স্বেচ্ছায়। আমি চোখ বুঁজে শুধু ক্ষমা চাই অভিজিত-বন্যার কন্যা তৃষা’র কাছে। আমাদের তুচ্ছতাকে, দীনতাকে ক্ষমা করো মা। আমরা তোমার বাবার হত্যাকারী। কিন্তু একদিন দেখো একটা একটা জীবন-ইটের আস্তরণে নির্মিত হবে এক অনিবার্য অট্টালিকা যার নাম হবে ‘প্রগতির বাংলাদেশ, মুক্তমনের বাংলাদেশ’।
আর সেই অট্টালিকার একটি ইটের পাঁজরে লেখা থাকবে তোমার বাবার নাম-অভিজিৎ রায়!
You must be logged in to post a comment Login