বিবর্ণ পাতা থেকে :: ৫
অমিয়া,
বহুকাল পর তোর কাছে লিখতে বসা । লেখার ফুরসত অনেক ; ইচ্ছেও কিছু কম নেই – আলস্যই ফুরসতটুকুকে কেড়ে নেয় । বেশ কাটছে পাহারের ওপরের দিন-রাত্রি । আরামকেদারা আর বিছানা করে করে বেশ পার হয়ে যাচ্ছে । কখনো সখনো আলস্য কাটাতে বইয়ের দ্বারস্ত হতে হয় , তবে তা এমন কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখে না । বইয়ের সর্বোচ্চ ভূমিকা হাঁটুর ওপর শরীরের বোঝার পরেও কিছু বাড়তি বোঝার মতন ।
হুম , আপন দেহটাও একটা বোঝা-বিশেষ এখন । শ্বাসের ব্যামো , দুর্বল হৃদযন্ত্র , বাত জ্বর , … মোটামুটি একটা ব্যামোর কারখানা খুলে বসেছি । স্বপন কুমার দাস নামে এক ডাক্তার ছোকরা প্রতি বিকেলে এসে এসবের কি সব হিসেব কষে যায় । ব্যামোর হিসেব কষা – দেখতে মন্দ লাগে না ; হাস্যকর । তবে ছেলেটাকে মন্দ লাগে না । খুব ডাক্তার-সুলভ গাম্ভীর্য আনার চেষ্টা করে । তবে সুযোগ পেলে গ্রামে ফেলে রাখা পরিবারের গল্পে প্রগলভ হতেও বিশেষ বিলম্ব করে না । এই ছেলেটাকে বিশেষ ভালো লাগার কারন – ওকে দেখলেই আমার কেন যেন মনে হয় , বাঙ্গালীরা এখনও সাদামাটাই রয়ে গেছে ।
গ্রামের সুরেন কাকার কথা মনে আছে তোর ? ডাক্তার সুরেন কাকা ? আমার অসুখ হলে উনাকে ডাকার আগেই উনি চলে আসতেন । হয়তো বাবার কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছেন বা কোনো পড়শির কাছে । যাবার সময় ঔষধের সাথে হোমিওপ্যাথির চিনির বড়িও দিয়ে যেতেন । উনাকে ভালোলাগার এটাই মুখ্য কারন ছিল সে সময় । এই বেচারা আজীবন মানুষের সেবা করে বেড়ালেন আর মারা গেলেন একা একা – বিনা চিকিৎসায় ! বড় অদ্ভুত না আমাদের জীবনটা ?
আসলেই বড় অদ্ভুত আমাদের জীবন । আমাকেই দেখ – আজীবন ছুটলাম নিজের অতীতটাকে মুছে ফেলতে । আর এখন অতীতের স্মৃতিতে জবর কেটে দিনকে সন্ধ্যে অবধি নিয়ে যাই , রাতকে ভোর অবধি ।
স্বপ্নিতার সাথে আমি একদিন ঘুরতে বেরিয়েছিলাম রিকসা করে । তখন আমরা দু’জন দু’ শহরে থাকি । রিকসা ঘন্টা হিসেবে ঠিক করেছিলাম । আমরা ঘুরতে ঘুরতে গুচ্ছগ্রাম ছাড়িয়ে কতদুর চলে গিয়েছিলাম ! কত খুনসুটি – কত সাংকেতিক কথপোকথন আমাদের ! ফিরবার পথে ঠুনকো ধাতুর একটা আংটি পড়িয়ে দিয়েছিলাম ওর অনামিকায় । আংটিটির হয়তো অস্তিত্তও নেই আজ ; আমাদের বন্ধন এখনো আমায় মৃত্যু হতে আগলে রাখে । জানিস ? এখনও যখন বুকে ব্যাথা হয় বা শ্বাসের গতানুগতিক গতিতে কিছু গড়বড় হয় , তখন বেশ ভয় করে স্বপ্নিতার জন্যে । আমি না থাকলে যে ওর বড় কষ্ট হবে ! জানি সবই অর্থহীন ; তবু আমার কাছে এসব ভীষন অর্থ বহন করে । ওসব খুনসুটিই যে আমায় বাঁচিয়ে রাখে !
প্রসূণটা হঠাৎ করেই চলে গেল । জানি না এ বয়সে কি করে মানিয়ে নিচ্ছিস ওকে ছাড়া । কোন মেয়ের বাসায় আছিস এখন , তাও জানি না । চিঠিটার তিনটা প্রতিলিপি করবো ভাবছি । একটা তোর ঠিকানার জন্যে , অপর দু’টো তোর দু’মেয়ের ঠিকানার জন্যে । কিংবা কে জানে হয়তো এ চিঠিটাও পাঠানো হবে না ।
আরামকেদারার হাতলে কাগজ রেখে লিখছি । ডান হাতটা অসার লাগছে । আজ আর লিখতে পারছি না । প্রার্থনা করি , যতটা সম্ভব ভালো থাকিস ।
11 Responses to বিবর্ণ পাতা থেকে :: ৫
You must be logged in to post a comment Login