মনে করতে পারি, রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম : বন্যা
লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায় যে মতবাদ বিশ্বাস করতেন, সেসব প্রকাশ করার জন্য আবারও ফিরে আসবেন বলে জানিয়েছেন তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন প্রত্যয়ই ব্যক্ত করেছেন তিনি।
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর এই প্রথম কোনো গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন বন্যা। গতকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ৩টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস রেডিওর নিউজ আওয়ার অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকারটি দেন তিনি। পাঠকের জন্য পুরো সাক্ষাৎকারটির ভাষান্তর করা হলো।
সাক্ষাৎকারের শুরুতে বন্যা বলেন, ‘কোনো একভাবে ঘটনাটি সম্পর্কে আমার স্মৃতি পুরোপুরি অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। আমি জানি না, এটা ৩০ মিনিট ছিল, নাকি পাঁচ মিনিট। কিন্তু আমি মনে করতে পারছি, অভিজিৎ আর আমি বইমেলা থেকে বের হয়ে হাঁটছিলাম। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না যে তখন কয়টা বাজে, তবে সাড়ে ৮টা বা তার কিছু পর হবে।’
এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ সম্পর্কে শ্রোতাদের কিছুটা ধারণা দেন উপস্থাপক। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে। এমনকি দেশটিতে ধর্মান্ধতা বেড়েই চলেছে। দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান লেখক অভিজিৎ রায়কে সেখানে (বাংলাদেশে) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অভিজিৎ রায় একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার ছিলেন। স্বাধীন মত প্রকাশের জন্য বেশ কয়েকবার তাঁকে হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এর পর অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের বিচার চেয়ে করা বক্তব্য প্রচার করা হয়।
তার পরই উপস্থাপক বন্যাকে পরিচয় করিয়ে দেন শ্রোতাদের সামনে। বলেন, ওই ঘটনায় বন্যা নিজেও গুরুতর আহত হন এবং এখন তিনি কিছুটা সুস্থ। এর পর বন্যাকে মাইক্রোফোন দেন অনুষ্ঠানের উপস্থাপক।
বন্যা বলেন, ‘আমরা মেলার অন্যদিকটায় যাইনি। সেখানে শিশুদের বইয়ের স্টল ছিল। অভিজিৎ সেখানে যাওয়ার জন্য চাপাচাপি করছিল। তাই আমরা রাস্তা পার হয়ে অন্যপাশে গেলাম। মাত্র কয়েকটি বইয়ের স্টল ঘুরলাম। আমি দু-একটা বইও কিনলাম। এর পর আমরা ওই দিকটা থেকে বের হয়ে এলাম। আমাদের গাড়িটা বইমেলার কাছ পর্যন্ত আসবে, এ জন্য আমরা একটু পাশে অপেক্ষা করছিলাম। আমরা হাঁটছিলাম যাত্রা শুরু করার জন্য, আমরা বাসায় ফিরব, পরিবারের সঙ্গে রাতের খাবার খাব। দেশে আমরা রাতের খাবার পরিবারের সঙ্গেই খেতাম। আমরা কৌতুক করছিলাম, বলছিলাম, গাড়িতে ওঠার পর আমরা ভান করব যে আমরা খুব ক্ষুধার্ত। আমি তাঁর হাত ধরে ছিলাম, আর এসব কথা বলছিলাম। আর আমি কোনো কিছু মনে করতে পারছি না।’
বন্যা বলেন, ‘এর পর মনে পড়ে, আমি কোনো এক ধরনের বাহনে ছিলাম এবং কেউ একজন আমার সেবা করছিলেন। মনে করতে পারি, আমি রক্তে ভেসে যাচ্ছিলাম। খুব সম্ভবত, তবে নিশ্চিত নই, মনে হচ্ছে অভিজিতের মাথা আমার কোলে ছিল। আমি কাউকে বলছিলাম, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। এতটুকুই আমি মনে করতে পারছি।’
এর পর অভিজিৎ রায় আর রাফিদা আহমেদ বন্যাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং তার পরই জ্ঞান হারান বন্যা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজে অনেকবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তাই টুকরো টুকরো কিছু মনে করতে পারি।’
উপস্থাপক এবার প্রশ্ন শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আপনি কখন বুঝতে পারলেন যে হামলার শিকার হয়েছেন?’
বন্যা : ঢাকা মেডিকেল কলেজে। আমার মনে হয়, তখন সেখানে অনেক মানুষ ছিল। আমি জ্ঞান হারাচ্ছিলাম।… দুঃখিত … (কথার এ পর্যায়ে গলা ধরে আসে বন্যার)
উপস্থাপক : আমি দুঃখিত, আপনাকে এমন স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য।
বন্যা : হ্যাঁ, এসব স্মৃতির ভেতর দিয়ে যাওয়া বেশ ভয়ের। এখনো আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে।
এর পর বন্যা বলেন, ‘প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারি আমার বুড়ো আঙুল নেই, আমার হাতে কোপানো হয়েছে, আমি রক্তে ভেসে গেছি, অভিজিৎ তখনো বেঁচে ছিল। আমার পাশে একটি স্ট্রেচারে শুয়ে ছিল। চিকিৎসকরা তাঁকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমি বলছিলাম, দয়া করে তাঁর দিকে খেয়াল রাখুন, আমার অবস্থা ভালো, তাঁর চিকিৎসা আগে করুন। আসলে ওই সময়ই প্রথমবারের মতো আমি বুঝতে পারি, কী ঘটেছে।’
যে সময়ের কথা বন্যা বলছিলেন, সে সময়েও বেঁচেছিলেন লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়। বন্যা বলেন, ‘অভিজিৎ তখন কোনো এক ধরনের শব্দ করে চলেছিল, তাঁর জ্ঞান ছিল না। তার পর আমি আর কিছু জানি না। কারণ, তাঁকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়।’
উপস্থাপক : আপনি যখন অভিজিতের সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরলেন, আপনারা কি বুঝতে পেরেছিলেন, আমি বলতে চাইছি, আপনারা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে কিছু হুমকি ছিল, তার বেশ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি (প্রমিনেন্ট ভিউজ) ছিল। আপনারা কি তার সম্ভাব্য হুমকি নিয়ে কথা বলেছিলেন?
বন্যা : হ্যাঁ, আমরা অবশ্যই করেছিলাম। কিন্তু এটা অনেকটা নিজের জিনিসের মতো। আপনি জানেন, অনেক বাংলাদেশিই, যেমন—ড. জাফর ইকবাল এ বিষয়ে একটি লেখা লিখেছেন। আমি এখনো এসব পড়তে পারিনি। কারণ, তেমন অবস্থা এখনো নেই। তাই আমি এখন যা বলছি, তা বন্ধু ও পরিবারের সদস্যদের কাছে শোনা।
বন্যা বলে চলেন, ‘যেকোনো বাংলাদেশিই বোঝে শীর্ষস্থানীয় (প্রমিনেন্ট) লেখক, বুদ্ধিজীবীর বিরুদ্ধে হুমকি থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবে আমরা সতর্ক ছিলাম। আমরা নিজেদের সীমাবদ্ধ করে ফেলেছিলাম, যেখানে-সেখানে যেতাম না।
আমাদের সঙ্গে সব সময়ই একজন গাড়িচালক থাকত। আমরা ভাবতাম, আপনি জানেন, এটা কোনো যুদ্ধক্ষেত্র নয়, টিএসসির মতো একটি এলাকা, আপনি জানেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, এত এত মানুষ, এত এত নিরাপত্তা, এটা খুবই জনবহুল এলাকা—এর মধ্যে এমন ঘটনা ঘটতে পারে না। অভিজিৎ খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। সে বলত, আরে কী হবে? চলো যাই। সত্যি বলতে কি, আমরা ভাবতে পারিনি, এটা সত্যিকারের হুমকিই ছিল।’
উপস্থাপক : আপনি জানেন, চরমপন্থী ব্লগার ফারাবীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একটা পাবলিক প্লেসে ঘটনাটি ঘটেছে, আপনি কোনো উপসংহার টানছেন?
বন্যা : হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি মনে করি, পুনর্পর্যালোচনার সময় এসেছে, আমরা এখানে একটা ট্রেন্ড, একটা প্যাটার্ন দেখতে পেয়েছি। ড. হুমায়ুন আজাদের ওপর এমন হয়েছে, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দিনকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, তিনি বেঁচে গেছেন। আরেক ব্লগার রাজীবকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আপনি জানেন, আমরা সেখানে মাত্র তিনদিনের জন্য ছিলাম, তারা কত দ্রুত, কী রকম সুসংগঠিতভাবে এমন একটা পাবলিক প্লেসে (এমন ঘটনা ঘটাল)। আমার মনে হয়, এখন পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে যে, আমরা কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি।
উপস্থাপক : আমাকে আপনার স্বামী অভিজিতের ব্যাপারে আরেকটু বলবেন যে, তিনি কী ধরনের বিষয়ে বিশ্বাস করতেন?
বন্যা : আমি খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। তাঁকে যদি একবাক্যে বর্ণনা করতে হয়, তাহলে আমি বলব, অভিজিৎ ছিল বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পরিপূর্ণ একজন নাস্তিক। বিজ্ঞান ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রসারে সে তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছে।
উপস্থাপক : আমরা বিচার করতে পারি না, তাঁকে কেন এবং কারা হত্যা করেছে। তবে আমি যদি ভুল না করি, তবে উদার হিসেবে বাংলাদেশের একটা সুখ্যাতি আছে। আপনি কী মনে করেন…
বন্যা : হ্যাঁ, আমাদেরও তেমনই মনে হতো। আমরা সহব্লগার ছিলাম, সহলেখক ছিলাম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমি কাজ কিছুটা কম করছি। আমি মনে করি, একদিক থেকে সেটা ঠিকই, কিন্তু বছরে বছরে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে।আমি আশির দশকের কথা স্মরণ করতে পারি। আমি একজন নাস্তিক ছিলাম, আমার বয়স ছিল ১৩। এ নিয়ে ভাবার তেমন কিছু ছিল না। আমি বিজ্ঞান, ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম এসব পড়তাম। আমার বন্ধু-বান্ধব, পরিবারে এটা বেশ সাধারণ ব্যাপার ছিল। তাঁরা ভাবত, ঠিক আছে, সে ব্যতিক্রম। কখনো আর কিছু হতো না। ওই সময় আরো বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যাঁরা এমন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। এটা ওই সময় প্রকাশ্যই ছিল। কিন্তু বছরে বছরে পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদ বেশ গভীর শিকড় গেড়েছে।
উপস্থাপক : শারীরিক আঘাত কীভাবে সেরে উঠছেন?
বন্যা : আমি ধীরে ধীরে সেরে উঠছি। আমার মাথায় চারটি জখম রয়েছে, এগুলো বেশ বড়। আমার বুড়ো আঙুল কেটে ফেলা হয়েছে। দুই হাতেও জখম রয়েছে। হাতে অনেকগুলো অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। মাথার জখম সেরে উঠতে আরো সময় লাগবে।
উপস্থাপক : যা ঘটেছে, তাতে কি আপনি ভবিষ্যতে সেই রকম সরব থাকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবেন, আপনি এবং অভিজিৎ আগে যে রকম ছিলেন?
বন্যা : না। অবশ্যই না। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাজ কমিয়ে দিয়েছিলাম। সেটা নিয়ে অভিজিতের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল। তাঁর সব বন্ধুও তা জানে। আমি সরব হওয়ার জন্য এবং সে যা বিশ্বাস করত, তা প্রকাশ করার জন্য ফিরে যাব। যে বিষয়ের জন্য অভিজিৎ প্রাণ দিয়েছে, সে বিষয়ে আমি চুপ থাকব না।
ভাষান্তর : রফিকুল রঞ্জু
You must be logged in to post a comment Login