তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৫)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পাঁচ

গুলশান এক নম্বরের গোল চত্বর থেকে কিছু দূরে একটি বিপনি বিতানে সেলস্ গার্লের কাজ করে বৈশাখী। কেবল ছয়টা বাজে, সামনে দুই ঘন্টা একটু বেশিই ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। কারন এসময় অফিস ছুটির পর কাষ্টমার বেশিই আসে, তারপরেই ছুটি হয় ওর। “স্যার আপনাকে কিভাবে সাহায্যে করতে পারি?” কাষ্টমারের উদ্দেশ্যে বলে বৈশাখী। কাষ্টমারটি একটা ব্রান্ডের শাওয়ার জেল খুঁজছিল। সেটা তাদের কালেকশনে নেই বলে দুঃখ প্রকাশ করে সে। তবে জানায়, আরেকটা ব্রান্ডের শাওয়ার জেল আছে, জোড়ায় কিনলে ষাট টাকা ছাড়। কাষ্টমার লাগবে না বলে অন্যদিকে চলে যায়।

দোকানের ভিতর বাইরে একটুও ময়লা নেই, ঝকঝকে মসৃন টাইলসের উপর লাইটের আলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। পুরো শপিংমলটাই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। ওদের দোকানটাই মোটামুটি সব কিছুই পাওয়া যায়, তরিতরকারী থেকে একদম কাপড় চোপড় পর্যন্ত সব কিছু পাওয়া যায়্ এখানে; সবকিছু থরে থরে করে সাজানো আছে। চাকা লাগানো ঝুড়ি নিয়ে্ বাজার করে কাষ্টমারগুলো। ওয়েষ্টার্ণ ধাঁচের কাপড় পড়ে তরুন তরুনীরা দোকানগুলোতে ঢুকছে আর বের হচ্ছে। কিছু মহিলা তার ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে শপিং করতে এসেছে, তাদের মধ্যে কিছু বিদেশীও আছে। বিদেশীগুলোকে দেখে চাইনিজ আর ইউরোপিয়ান মনে হয়।

বৈশাখীর বাবা গ্রামের স্কুলের একজন সাধারন শিক্ষক ছিলেন, বাংলা-ইতিহাস বিষয়ে পড়াতেন। বৈশাখীরা দুই ভাইবোন। ওর বড় ভাই রফিক মাষ্টার্স শেষ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর ও মাষ্টার্সে ভর্তি হওয়া্র চিন্তা করে, কিন্তু ভর্তি হওয়া হয়ে উঠে না আর। ওর বাবা মারা গিয়েছেন বছরদুয়েক হল, আর মা বৈশাখীর জন্মের সময়ই মারা যান। বাবা বেঁচে থাকলে সেলস গার্লের চাকরি কি মেনে নিতেন, ভাবে বৈশাখী। সর্বদা নীতিবান বাবার যোগ্য সন্তান হচ্ছে ওর বড় ভাই রফিক। বৈশাখী এত নীতি মানে না, আবার ঘৃ্নাও করে না।

সবার জীবনেই কিছু দুঃখের কথা থাকে। বৈশাখীর জীবনেও কিছু ঘটনা আছে যা যেমন দুঃখের তেমন করুনও বটে। দীপক নামে একটা ছেলের সাথে গভীর সম্পর্ক ছিল তার, সে তখন অনার্স তৃ্তীয় বর্ষের ছাত্রী। দীপককে সে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করত, সে বিশ্বাসের মর্যাদা রাখেনি দীপক।

সেই দিনের কথা কখনোই ভুলতে পারবে না বৈশাখী। সেদিন বিকেলে হঠাৎই দীপক ওর হোস্টেলে এসে উপস্থিত; এসেই বলে,

-জলদি রেডি হয়ে বাইরে এস, আমি রাস্তার মোড়ে ওয়েট করছি।

বৈশাখী অবাক হয় এই আকস্মিকতায়।বলে,

-কেন? হঠাৎ?

-তুমি প্রতিবার অভিযোগ কর, আমার কোন আত্নীয়ের সাথে পরিচয় করে দেই না; আজ দিব চল।

বৈশাখী খুশি হয়। বলে,

-তাই নাকি? কে সেই আত্নীয়?

-আছে। আমার এক খালা থাকে গুলশানে, উনার মেয়ের আজ জন্মদিন। আমাকে ডেকেছে, তুমিও চল।

-আমি গেলে খালা কিছু বলবে নাতো?

-নাহ। খালা অনেক ভাল মানুষ।

বৈশাখী আর কথা বলে না। ভিতরে ভিতরে খুশিই হয় ও, দীপক ওর পরিবারের কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে সেজন্যে। কিন্তু বৈশাখী আন্দাজও করতে পারেনি দীপকের উদ্দেশ্য। খুব সুন্দর করে সেজেগুজে বের হয় সে। বিকেল থেকে রাত সাতটা পর্যন্ত এদিক ওদিক ঘুরে দীপকের খালার বাসায় গিয়েছিল বৈশাখী। দরজা খুলেছিল মাঝ বয়েসি এক মহিলা। বৈশাখী তাকেই খালা ভেবে ভুল করেছিল। দীপক ওকে একটা ঘরে বিছানার উপর বসতে দেয়।

-তুমি এখানে বস, খালা তো জরুরী কাজে বেড়াতে গিয়েছে; খালাত ভাইবোনগুলোও বাসায় নেই।

-তাহলে যিনি দরজা খুলে দিলেন উনি কে?

-ও উনি? উনাকে তো ছেলেমেয়েদের দেখাশুনার জন্যে রাখা হয়েছে। খালা খালু তো সারাদিন ব্যস্ত থাকে তো তাই।

-ও আচ্ছা।

-তুমি বস, আমি একটা গিফট কিনে নিয়ে আসি। জন্মদিনে আসলাম, গিফট নিতে ভুলে গিয়েছি।

-উফ, আগে বলবে তো; আমিও একদম ভুলে গিয়েছি। আমিও যাই, এখানে একা বসে থেকে কি করব?

-নাহ তুমি বস লক্ষীটি, আমি যাব আর আসব।

বৈশাখীর কিছুতেই একা থাকতে ইচ্ছে করছে না। তবু যেতে দেয় দীপককে, তাড়াতাড়ি আসবার জন্যে বলে দেয় বারবার করে। দীপক চলে যাওয়ার পর বৈশাখী ঘরের চারপাশে মনযোগ দেয়, সবকিছুই সাজানো গোছানো। সে ঘরে একটা নগ্ন নারীর মূর্তি দেখতে পায়, দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ছবির বিষয়বস্তুও নগ্ন নারী; উর্ধাঙ্গ পুরোপুরি নগ্ন আর নিম্নাগ্ন ঢেকে রাখতে ব্যস্ত নারীটি। বৈশাখী অবাক হয়, বাসায় ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে কিভাবে এ ধরনের জিনিস রাখা সম্ভব। টেবিলের উপর থেকে একটা ম্যাগাজিন হাতে নেয়, পৃষ্ঠা উল্টাতেই নগ্ন নারীর শরীর ভেসে উঠে; এমনভাবে বসে আছে যে দুই উরু যোনী ঢেকে রেখেছে আর হাত দিয়ে দুই বুক। বৈশাখী এবার উফ শব্দ করে ছুঁড়ে ফেলে দেয় ম্যাগাজিনটা টেবিলের উপর। খালার বাড়ি বলে এ কোথায় নিয়ে এল দীপক? আশ্চর্য !

কাঁটায় কাঁটায় পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট কেটে গেছে, দীপক এখনো আসে নাই। চিন্তায় পড়ে যায় বৈশাখী, সারা বাড়িটাই কোন সাড়াশব্দ নাই। এমন সময় মেইন দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়, বৈশাখী স্বস্তিবোধ করে। কিন্তু ঘরে কেউ ঢুকে না, বাইরে কথার আওয়াজ শুনা যায়; সে ঘরের বাইরে যাবে কিনা বুঝে উঠতে পারে না। দীপকের উপর রেগে উঠে সে।

বৈশাখী যখন ধৈ্র্যের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে তখন একটা মাঝ বয়েসি লোক ঘরে এসে ঢুকে। লোকটাকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়, দীপকের খালু ভেবে আবারো ভুল করে। লোকটার হাতে গ্লাস, তাতে হলুদ রংয়ের পানীয়। লোকটি কাছাকাছি আসতেই বিদঘুটে গন্ধ নাকে এসে লাগে তার। ওকে আর বলে দিতে হয় না গ্লাসের মধ্যে বস্তুটি আসলে মদ। বৈশাখী এবার শংকিতবোধ করে, দরজার দিকে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করে সে, খপ করে হাতটা ধরে ফেলে লোকটা।

-কি হল কোথায় যাচ্ছ? বস, গল্প কর আমার সাথে।

-না মানে একটু বাইরে যাব।

-দীপকের কাছে যাবে?

-জ্বী।

লোকটি মুচকি হাসি দিয়ে বলে,

-দীপক তো চলে গিয়েছে। তুমি বস, গল্প কর আমার সাথে।

এবার ভয় পায় বৈশাখী, দীপক কেন তাকে একা ফেলে চলে যাবে। ও লোকটির কাছ থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। লোকটি গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে বৈশাখীর কোমড় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। বৈশাখী চিৎকার করে উঠে,

-ছেড়ে দেন আমাকে। ছেড়ে দেন।

-চুপ একদম চুপ। চিৎকার করলে টুটি ছিঁড়ে ফেলব তোর। মাগী কোথাকার।

লোকটা বৈশাখীকে বিছানার দিকে ছুঁড়ে মারে। বিছানার উপর পড়লেও ব্যাথা পায় বৈশাখী। তবু উঠে আবার যেতে থাকে দরজার দিকে, লোকটিও আবার ধরে ফেলে; সালোয়ার ধরে টান দেয়। পড় পড় করে ছিড়তে থাকে সালোয়ার। এবার বৈশাখী লোকটার হাতে কামড় দেয়, লোকটি তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। দরজা খুলে বের হতে সমর্থ হয় বৈশাখী, কিন্তু ওর কপাল খারাপ। ও কোন সিনেমার নায়িকা নয়, ওকে কোন সিনেমার নায়ক বাঁচাতে আসল না। দরজার বাইরেই একটা লোক দাঁড়িয়ে ছিল, ও বের হতেই সজোড়ে চড় মারে তাকে। ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে সে, একটানে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে আবারো চড় মারে তাকে। এবার চোখে অন্ধকার দেখে বৈশাখী, বাধা দেওয়ার আগেই নগ্ন করে ফেলে তাকে ঘরের লোকটা। বৈশাখী মা মা বলে কেঁদে উঠে, এক অজানা লোক সেইদিন তার কুমারীত্ব নষ্ট করে।

দীপককে আর কোনদিন দেখতে পাইনি সে, কেউ বলতেও পারে না তার ঠিকানা। বৈশাখী মাঝে মাঝে ভাবে দীপককে পেলে খুন করবে সে, আবার ভাবে কি লাভ হবে তাতে; তার জীবনটা তো আর ফিরে পাবে না। সেদিনের পর থেকে মরে গিয়েছে বৈশাখী, ইচ্ছে হলেই এখন নিজের শরীরটাকে নিয়ে অন্যকে খেলতে দেয়। যেমন আজ গুলশানের একটা ফ্ল্যাটে যাওয়ার কথা। নতুন একটা ক্লায়েন্ট আসবে, রেটও ভাল বলেছে। দোকান বন্ধ হওয়ার আগে আগে ব্যাগের ছোট্ট আয়নাটা বের করে একটু সেজে নেয় সে, টিপটা ঠিক করে আর ঠোঁটের লিপস্টিকটাও। একাজের জন্যে ও বেশিরভাগ এ সময়টায় বেছে নেয়, ঠিক সন্ধার পর।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৫)

You must be logged in to post a comment Login