কাজী হাসান

পিঙ্ক স্লিপ

পিঙ্ক স্লিপ
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page
Source: Internet

এম বি এম কর্পোরেশান।

নেটওয়ার্ক ডিপার্টমেন্টে “পটল্যাক স্প্রেড” হচ্ছে। ব্যাপারটা প্রতি কোয়ার্টারে এক বার করে হয়। সবাই নিজের নিজের দেশের একটা করে  খাবার আইটেম নিয়ে আসে। তার পরে সবাই মিলে খাওয়া। অন্য দেশের খাওয়া মুখে দিয়ে টেস্ট করা। ভাল লাগলে আর একটু নেওয়া। আর সাথে কিছু হৈ চৈ করা আর কি!

অনেক দেশের  বিভিন্ন ধরণের মানুষ এম বি এম কর্পোরেশানে  কাজ করে। সারা পৃথিবী জুড়ে কম্পিউটারের ব্যাবসা। এমেরিকা আর অন্যান্য দেশ  মিলিয়ে ষাট হাজার কর্মচারী। নর্থ ক্যারোলিনার ফ্রাঙ্কলিনটন শহরে হেড  অফিস। শুধু  সেখানেই চার হাজার মানুষ কাজ করে। চারটা আট তলা বিল্ডিং নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাস।

আইটি ডিভিশনে কর্মচারীর সংখ্যা শ তিনেক। সফটওয়ের, হার্ডওয়ের আর নেটওয়ার্ক নিয়ে বড় ডিপার্টমেন্ট  তিনটা। প্রতিটা ডিপার্টমেন্টে ১০-১৫ জনের টিম অনেক গুলো করে। সফটওয়ের আর হার্ডওয়েরে বেশীর ভাগ মানুষ ইন্ডিয়া থেকে আসা। কিন্তু নেটওয়ার্কে বেশীর ভাগ স্থানীয়  এমেরিকান সাদা, কালো আর হিসপ্যানিক। সাথে কিছু চাইনিস, ফিলিপিনো, কোরিয়ান, নাইজেরিয়ান আর অন্য কিছু দেশের মানুষও আছে। আর আছে এক জন বাংলাদেশের বাঙালি; এনামুর রহমান।

খাওয়া, দাওয়া আর গল্প গুজব বেশ চলছে। আইটির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জন হেনরি অনুষ্ঠানে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে গ্রোসারি স্টোর থেকে কেনা একটা বিশাল  কেক। অবশ্য এসেই বলেছে, তার নিজের হাতে কিছু একটা বানিয়ে আনার খুব একটা ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ইউরোপে আগ্নেয়গিরির এ্যাশ স্মোকের জন্যে তার ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। মাত্র তিন ঘণ্টা আগে সে  শহরে এসে পৌঁচেছে।

যাই হোক এর মধ্যেই জন হেনরি দুটো চমকপ্রদ ঘোষণা দিয়েছে। প্রথমটা হল, আজকে সব চেয়ে বেশী যে খেতে পারবে, তাকে তিন শ ডলারের একটা এমেরিকান এক্সপ্রেসের গিফট সার্টিফিকেট দেয়া হবে। আর পরেরটা হল, আগামী শুক্রবার সে সবার জন্যে লাঞ্চ কিনবে। কথাগুলো শুনে সবাই মহা খুশী। খাওয়া চলতে লাগলো মহা উৎসাহে।

বাঙালি ছেলে এনামুর তেমন খাদ্য রসিক মানুষ না।  তার পরেও অন্যদের সাথে তাল মিলিয়ে এটা সেটা মুখে দিচ্ছিল। চোখ পড়ল শেষের টেবিলে রাখা একটা আইটেমের দিকে। দেখা মাত্র চোখ, মন ভরে গেল। গোলাপি রঙের ঘন ঝোল, কুঁচি কুঁচি করে কাটা আলু, পেঁয়াজ, অদ্ভুত ভাবে  চতুর্ভুজ করে কাঁটা নরম নরম মাংসের টুকরা। জিহ্বায় পানি চলে আসলো সাথে সাথেই।  মনে হচ্ছে পাখির মাংস। আহা ! এনামুর পাখির মাংস খায়না  আজ কতদিন। এক সময় কত না প্রিয় ছিল !!

পাশেই দাঁড়ানো ছিল কোরিয়ান ডং লি।  মাস খানেক আগে কাজে জয়েন্ট করেছে। কথা বার্তায় কোরিয়ান একসেন্ট প্রকট। এনামুর জানতে চাইলো কিসের মাংস। উত্তরে বলল, “ডাক”। এনামুর আর দেরী করল না, ডাক মানে হাঁসের মাংস। গপাগপ খেতে লাগলো  “ডাকের” মাংস। আনন্দে আর ঝালে চোখে পানি চলে আসলো। চিন্তা করতে লাগলো কবে যেন শেষ হাসের মাংস খেয়েছে। এক সময় মা খিচুরির সাথে হাঁসের মাংস রাঁধত………।

এনামুরের গো গ্রাসে খাওয়া দেখে  এগিয়ে আসলো নাইজেরিয়ার কুমো, জানতে চাইলো কি খাও এনামুর। মুখ ভর্তি খাওয়া নিয়ে উত্তর দিল, “ ডাক, ডাক”। ডং এর মধ্যে অন্য দিকে চলে গেছে। কুমো ডেকে নিয়ে আসলো তাকে। আবার সে উত্তর দিল, ডাক মীট। কুমো জানতে চাইলো, তোমার ডাক শব্দ করে কি করে। উত্তরে ডং লি বলল, রুফ রুফ মানে কুকুরের ভেউ ভেউ। এমামুর আর কুমোর বুঝতে বাকি রইল না, ব্যাপারটা আসলে কি হয়েছে। ডং লি আসলে বলতে চেয়েছে “ডগ”। কিন্তু তার কোরিয়ান একসেন্টের কারণে তা উচ্চারিত হয়েছে , “ ডাক” হিসেবে। ওদের আসলে ‘গ’ টা ‘ক’ হয়ে উচ্চারণ হয়। আর যায় কোথায়? সাথে সাথে আরম্ভ হয়ে গেল এনামুরের ওয়াক ওয়াক……বমি। এ কি  করল সে। এত স্বাদ করে কিনা কুকুরের মাংস খেল! ওয়াক ওয়াক ওয়াক!!!

কম্পিউটার শিল্পে এম বি এম কর্পোরেশানকে অনেকটা পথিকৃৎ বলা যায়। সত্তরের দশকে কয়েক বন্ধু মিলে শখ করে এই ব্যাবসার সূচনা করেছিল। তার পরে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি। কোম্পানি ফুলে ফেঁপে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছে; স্টক ভাল দামে বিক্রি হয়েছে। প্রতি বছরই দাম বেড়ে চলেছে।

এম বি এম কর্পোরেশান প্রথমে কম্পিউটার বানানোর কাজ দিয়ে আরম্ভ হয়েছিল। আয় রোজগার যখন রমরমা, তখন ব্যাঙ্ক, শিপ বিল্ডিং থেকে আরম্ভ করে অনেক ধরনের ব্যাবসাতেই এম বি এম কর্পোরেশান ঢুকেছে। অনেকটা এতো টাকা হয়েছে, তা দিয়ে কি করা যায়, সে রকম একটা অবস্থা। সবাইকে দিয়ে তো আর সব কাজ হয় না। বেশীর ভাগ লাভজনক ব্যাবসাতেই অল্প কিছু দিনের মধ্যে কত ক্ষতি হচ্ছে, তার অঙ্ক কষা চলতে লাগল।

কিন্তু বোর্ড অফ ডিরেক্টার সিদ্ধান্ত নিল, আর যাই হোক বিষয়টা বাইরে জানা জানি হতে দেয়া যাবে না। না হলে, স্টকের দাম কমতে থাকবে। বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাবে, ক্রেডিটারদের থেকে নতুন করে টাকা পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। একাউন্টিং ডিপার্টমেন্ট আর অডিটিং ফার্মকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি দেয়া হল। ভিতরের খবর কোন ভাবেই যেন ফাঁস হয়ে না যায়।

এনামুর বমি করতে করতে বাথরুমের দিকে যেতে লাগল। কিন্তু বেশী দূর যেতে পারলো না। কয়েক কদম যেয়ে পড়ে গেল। মাথা ঘুরতে লাগল। আশে পাশের কথা বার্তা হাসা হাসি বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথেই। কারোর বুঝতে বাকি থাকল না, এনামুরের অবস্থা খারাপ।

বেচারা ডং লি বারে বারে সরি বলতে লাগল। আর বিড় বিড় করে বলতে লাগল, আগে জানলে সে কখনই কুকুরের মাংস রান্না করে আনত না। কুমো, ডংকে সান্ত্বনা  দিল, আসলে এনামুরকে না বললেই হত এটা আসলে কিসের মাংস।

সাড়ে তিন মিনিটের মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স চলে আসল।

এমেরিকায় বিপদে কাছের মানুষকে পাওয়া না গেলেও,  এ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশ ডাকা মাত্রই এসে হাজির হয়।

এনামুর হাসপাতালে মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা কাটালো। বমি করতে করতে ডিহাইড্রেটেড হয়ে পড়েছিল। তেমন সিরিয়াস কিছু না। শরীরে স্যালাইন দেয়া হল। ডাক্তার বলল, সারা রাত অবজারভেশন করে ছেড়ে দেবে।

এনামুরের বউ রঞ্জনা যত না হন্ত দন্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটে আসল, তার থেকে বেশী অস্থির হয়ে আসল ডং লি। সাথে তার বান্ধবী লরা কস্টা। ডং সাথে করে এতো গুলো ফুল নিয়ে এসেছে, সাথে একটা বিশাল বেলুন; লেখা Get Well।  আর বারে বারে সরি সরি বলতে অস্থির করে ফেলল।

লরা কস্টাও  এম বি  এম কর্পোরেশানে কাজ করে। তবে সফটওয়ারে। এনামুরের সাথে হাই হ্যালো বলার পরিচয়। সেও যে  হাসপাতালে তাকে দেখতে আসতে পারে, সেটা এনামুরের চিন্তার বাইরে ছিল। যাই হোক, স্বল্প ভাষীর লরা,  মিষ্টি করে বলল, ইয়াং ম্যান কোন চিন্তা কর না। তুমি দু’দিনের মধ্যে একেবারে ঠিক হয়ে যাবে। একবার ফুড পয়সনিং এ  আমার অবস্থা এর থেকে অনেক বেশী খারাপ হয়েছিল।

চারিদিকে শুনা যাচ্ছে  এম বি এম কর্পোরেশানে বড় ধরণের একটা লে অফ হবে, পিঙ্ক স্লিপ (চাকরিচ্যুত করার নোটিশ) দেয়া হবে। এক সাথে অনেক মানুষ চাকরি খোয়াবে। এখন কোন ঘোষণা আসে নি, কিন্তু গুঞ্জন চলছে খুব। কয়েকটা পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, এম বি এম কর্পোরেশান গত তিন বছর ধরে তাদের লসের কথা কাউকে জানতে দেয় নি। সিকিওরিটি কমিশন অডিট আরম্ভ করেছে। এর মধ্যে বোর্ড অফ ডিরেকটার; সিইও, আর চীফ একাউনটেন্টকে ফায়ার করেছে। বড় ইনভেষ্টাররা বলছে তারা মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের কথায়, এইটা একেবারেই ধোঁকাবাজি। এমেরিকা কোন ভাবে মগের মুল্লুক হয়ে যেতে পারে না।

অন্য সবার মত এনামুরের মনে আতংক চলে আসল। অর্থনীতির যেই অবস্থা,  একবার চাকরি গেলে, চাকরি পাওয়া বেশ কঠিন হবে। চাকরি পেলেও নিশ্চয়ই ভাল বেতন দিবে না। এ দিকে মাত্র কিছু দিন আগে সে একটা বাড়ি কিনেছে। জমানো সব টাকা বাড়ির ডাউন পেমেন্ট দিয়েই শেষ। এ দিকে দুটো গাড়ির পেমেন্ট চলছে। আর বছর দু য়েক বাকি। মেয়েটা দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাচ্ছে। আগামী বছর কলেজ আরম্ভ করবে। মানে খরচ বাড়বে বহু গুন। সাথে সাথে অন্য সব খরচ তো আছেই। চাকরি ছাড়া কিভাবে যে কি  হবে। এনামুর বেশীক্ষণ চিন্তা করতে পারে না।  রঞ্জনার পার্ট টাইম চাকরির থেকে আয় আর তার আনএমপ্লয়মেন্ট ভাতা দিয়ে বেশী কিছু করা যাবে না। মাথাটা ঝিম ঝিম করতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হয় শালা কেন যে এ দেশে এসেছিলাম। দেশে থাকলে বিপদে পাশে দাঁড়ানোর কাউকে না কাউকে পাওয়া যেত।

এনামুর হাসপাতাল থেকে ফিরে, যে দিন কাজে ফিরল; দেখল টেবিলে কিছু ফুল, আর সাথে একটা কার্ড। লেখা  I am glad that you are back… তুমি ফিরে আসাতে আমি খুব খুশি। ইতি, অনেক ভালবাসা সহ লরা।

বাংলাদেশে একই বয়সের ছেলে মেয়েরা শুধু  বিশেষ জনকেই ভালোবাসি কথাটা বলে। ব্যাপারটা মধ্যে লুকোচুরি আর  ভীষণ একটা আমেজ থাকে।  কিন্তু বস্তুবাদী দেশ এমেরিকায় এ রকম কিছু না। কেউ ভালোবাসি বললেই পুলকিত হওয়ার কিছু নেই। কারণে অকারণে এখানে ঠোঁটের আগা থেকে বের হতে থাকে, ভালোবাসি আর ধন্যবাদ। যাই হোক, শোনা যায় বাংলাদেশেও ‘ভালোবাসি’ কথাটা এখন যত্র তত্র ব্যাবহার চালু হয়েছে। এনামুর ব্যাপারটা নিয়ে বেশী কিছু ভাবল না। শুধু ঠিক করল, বিনিময়ে মেয়েটাকে পারলে একবার কিছু একটা গিফট দিতে হবে।

এর পরে এক এক করে অনেকে এসেই এনামুরকে ওয়েলকাম ব্যাক বলে গেল। কেউ হাসল, কেউ রসিকতা করার চেষ্টা করল রুফ রুফ শব্দ করে,  আবার কেউ সাবধান করে গেল ভবিষ্যতে যাতে  একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কিছু না খায়। কুকুর প্রেমী আরেক কলিগ মেরী বলল, তুমি যে কুকুর এতো ভালবাসা তা আমার জানা ছিল না। তোমার পরের জন্ম দিনে আমার একটা কুকুর তোমাকে গিফট করব। অফিসের সবাই জানে মেরীর দসাসই তিনটা জার্মান শেপারড  আছে। তাদের একটা সন্তান সম্ভবা। কথাটা শুনেই এনামুরের শরীরটা গুলিয়ে উঠল। সারা জীবন ধরেই কুকুর থেকে দূরে দূরে থেকেছে। পশুকে কি আর বিশ্বাস করা যায়। একবার বন্ধু শামীমকে কুকুর কামড় দিয়েছিল। বেচারার কি না অবস্থা হয়েছিল। নাভির নীচে উনত্রিশ না ত্রিশটা ইঞ্জেকশান দিতে হয়েছিল। আবার কি না, সে-ই কুকুর!

বেচারা ডং এসে শপথ করে গেল,  এই জীবনে আর কখন এই কাজ সে করবে না। কুকুরের মাংস সে কখন কাউকে খাওয়ানোর জন্যে নিয়ে আসবে না।

অফিসে সারাক্ষণ ফিস ফিস গুঞ্জন চলছে। ম্যানেজার জাতীয় কাউকে দেখলে, কাজ করার ভান। চলে গেলেই আবার সেই একই আলোচনা। কি হবে কোম্পানির। মুখে না বললেও, সবার ভিতরের আতঙ্কটা বের হয়ে আসে। কাউকে পথে বসতে হবে, কারোর বিয়ে আটকে যাবে, কারোর ডিভোর্স হয়ে যাবে……ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক গল্প।

অনেকে এর মধ্যে  চাকরির চেষ্টা আরম্ভ করে দিয়েছে। ইন্টারভিউ দিচ্ছে। চাকরি হলে এম বি এম কর্পোরেশান আর এক মুহূর্তও না। কিন্তু এটাও ঠিক, এত মানুষের এই ছোট শহরে চাকরি হওয়াটা সম্ভব না। কিছু মানুষ এর মধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, প্রয়োজনে তারা অন্য শহরে চলে যেতে হলে তাই করবে। আগে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে, তার পরে অন্য কথা।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জন হেনরি আইটি  মিটিং জানিয়ে দিল, যা শোনা যাচ্ছে তা হয়ত সত্যি হতে পারে। কোম্পানি একটা বিপদজনক সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। সে চেষ্টা করছে যাতে বেশিরভাগ মানুষের চাকরি বাঁচানো যায়। টপ ম্যানেজমেন্ট বলেছে, একেবারে যাতে সব খরচ কমিয়ে ফেলা হয়। জন হেনরি নিজের থেকে যোগ করল, এই মুহূর্তে  সব চেয়ে বেশী দরকার মনোবল শক্ত রাখা। সবার নিশ্চয়ই জানা আছে, যারা কাজ কর্মে নিয়মিত অবদান রাখবে, পসিটিভ থাকবে তাদেরকেই শুধু রাখা হবে।

এনামুর আর লরার সখ্যতা হতে বেশী দিন লাগল না।  কাজের ফাঁকে ফাঁকে এক জন আরেক জনের কাছ থেকে ঘুরে আসে। দু’ চারটা কথা বলা। মাঝে মাঝে অবশ্য কিছুটা বেশীও কথা হয়। সাথে ফোন, ইমেল আছে। তার পরে খেয়াল রাখতে হয় এই সখ্যতা তাদের কাজের ক্ষতি না করে, কিংবা অন্যরা যাতে বাঁকা চোখে না দেখে। তবে এটা তেমন বড় কোন ব্যাপার না। সহকর্মীদের মধ্যে কথাবার্তা হতেই পারে। কিন্তু এরা দু’ জন দু’ সেকশানের। একই প্রজেক্টের কাজ হওয়ার কথা না।

এ কথা সে কথা হতে হতে দু’ জনের অনেক কথাই হতে লাগল। এনামুর অবাক হয়ে স্বল্পভাষী লরার অনেক কথাই শুনত। কেমন একটা অনাবিল আনন্দ আর ভাল লাগায় মনটা ভরে উঠত। এনামুর ভাবত লরার কথা কি রঞ্জনাকে বলা উচিত? এক সময়ে রঞ্জনার সাহচর্যে হয়ত এ ধরণেরই মনটা ভরে আসত। নি কিসের সাথে কিসের তুলনা করছে। লরা তার বন্ধু, শুধু বন্ধু। তার থেকে এত থেকে এক বিন্দুও সে বেশী কিছু চায় না। রঞ্জনা তার ভালবাসা, তার সন্তানের মা। এই দুই সম্পর্ক একেবারে দুই প্রান্তের।

এ রকম চলার প্রায় বছর খানেক পরে এনামুর একদিন বেশ সকাল সকাল এসে, লরার টেবিলে  কিছু ফুল আর একটা কার্ড রেখে আসল। কার্ডে অনেকটা লরার মত করে লিখল,  I am glad that I have a friend like you… তোমার হাসি মাখা মুখ আমার  সব হতাশা মুছে ফেলে।

নিজের কিউবিকালে এসে এনামুর খুব অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল। সে কি একটু বেশী লিখে ফেলেছে। এখন যদি লরা কিছু মনে করে। যদি মনে করে এনামুর বেশী উৎসাহ দেখাচ্ছে। যদি ভেবে বসে এনামুর ওদের সম্পর্ক অন্য দিকে গড়াতে চাচ্ছে। অবশ্য অফিসের সবাই জানে বউ আর মেয়ের নিয়ে এনামুরের সুখের সংসার। কিন্তু তার পরেও যদি লরা অন্য কিছু ভেবে বসে। ডঙের থেকে এক মুখ দু মুখ করে অনেকেই জানে লরা একা একটা এপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে। তার স্বামী কিংবা বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা কেউ জানে না। এখন যদি লরার মনে হয় এনামুর  কোন ধরণের সুযোগ নিতে চেষ্টা করছে। ছি ছি কি লজ্জা!

১০

লরা কেমন দেখতে ? খুব কি সুন্দরী? লরার দিকে একবার চোখ গেলে, আরেকবার তাকাতে ইচ্ছা করবেই। কেমন গায়ের রঙ?  চট করে বলা মুশকিল। বাবা ছিল শ্বেতাঙ্গ আর মা মেক্সিকো থেকে আসা স্প্যানিশ ভাষী। বাবা মায়ের দুজনের গায়ের রঙ মিলিয়ে অদ্ভুত সুন্দর লাবণ্য মাখা তার চেহারা।

অল্প বয়সে হাই স্কুলে পড়ার সময়ে ভালবেসে ফেলছিল একই ক্লাসের বিলকে। খেলাধুলায় চৌকস, লম্বা, হ্যান্ডসাম বিলের সাথে সম্পর্কে গড়তে অনেক মেয়েরই চেষ্টা ছিল। কিন্তু প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিল লরা। লরা মনে হয়েছিল আকাশের চাঁদ হাতে এসে ধরা দিয়েছে। অন্য মেয়েরা ওদের দিকে ঈর্ষা ভড়া চোখে তাকিয়ে দেখত।

কলেজের প্রথম বছরই ফুটবল খেলতে যেয়ে পা ভাঙল বিল। পা ঠিক হতে মাস ছয়েক লেগে গেল। কিন্তু  পা ভাল হলেও, খেলার ফর্ম নষ্ট হয়ে গেল। কলেজ টিম থেকে বাদ পড়ে গেল।  অবসাদ, বিষণ্ণতায় মন ভরে গেল। তার পরে বিল কলেজে আর বেশী দিন টিকতে পারলো না। পরীক্ষায় পর পর কয়েকবার খারাপ করাতে স্কলারশিপ বাতিল হয়ে গেল।

১১

এনামুরকে অবাক করে দিয়ে লরা ফোন করল। বলল, তোমার গিফটের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তুমি আমাকে আজকে একটা বিশেষ দিনের শুন্যতা থেকে বাঁচিয়েছ। এই জন্যে তোমাকে আমি আজকে লাঞ্চে ট্রিট করতে চাই। লরা, এনামুরকে কোন প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে জানাল, আমাকে এখনই একটা মিটিঙে ছুটতে হবে।

এনামুর ভাবা আরম্ভ করতে লাগল, লরার আজকে কি বিশেষ দিন হতে পারে। হয়ত জন্মদিন। কিন্তু তাই বা কি করে সম্ভব। একবার লরা বলেছিল, সে সিংহ রাশির জাতিকা। একেবারে জন্মগত ফাইটার আর লিডার। সে সময়ে এনামুর কথাটাকে তেমন আমল দেয় নি। যাই হোক এখন তো মাত্র এপ্রিল মাস। সিংহদের জন্মের সময় এখন হয় নি। এর মধ্যে বসের কল আসল।

বস জরুরী একটা কাজ দিয়ে বলল, এইটা এখন করে নিয়ে আস। টাইম সেনসিটিভ ব্যাপার। টপ ম্যানেজমেন্ট এইটার জন্যে অপেক্ষা করছে। এনামুর কাজের মধ্যে ডুব দিল। এনামুরের বের করা হল না, লরার আজকে বিশেষ কি দিন হতে পারে।

১২

চারিদিকে রটে গেছে খুব শিগ্রি পিঙ্ক স্লিপ দেয়া হবে।  অবশ্য অনেকটা অঘোষিত ভাবে দুটো ঘটনা ঘটল। সকালে জন হেনরি বেশ কিছু ম্যানেজার গোত্রীয়দের কনফারেন্স রুমে ডেকে পাঠাল। সাথে সাথে ফিস ফিস আরম্ভ হয়ে গেল। যেই সব ম্যানেজারদের ডাকা হয় নি, তাদের বুঝি আজকে চাকরি যাবে।

জন হেনরি নাটকীয়ভাবে বলতে লাগল, তোমরা সবাই জান কোম্পানি একটা দুঃসময়ের দিয়ে পার হচ্ছে। সেই জন্যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, চল্লিশভাগ লোককে পর্যায়ক্রমে লে অফ (চাকরীচ্যুত) করা হবে। তার সুত্রপাত আজকেই হচ্ছে। মিটিঙে উপস্থিতরা ভাবল, তাদের ডেকে যেহেতু কথাগুলো বলা হচ্ছে, তাদের আপাতত কোন চিন্তা নাই। কিন্তু ওদের অবাক করে দিয়ে জন হেনরি জানাল, এই রুমে উপস্থিত সবাইকে এই মুহূর্তে লে অফ করা হচ্ছে।

ম্যানেজারদের কথা গুলো ঠিক মত বুঝে উঠার আগেই সিকিউরিটির লোকজন রুমে ঢুকল। কাউকেই তাদের অফিস ডেস্কে ফেরত যেতে দেয়া হল না। জন হেনরি বলতে লাগল, তোমরা সবাই, সিকিউরিটির লোকদের সাথে বিল্ডিঙের বাইরে চলে যাও। না হলে প্রয়োজনে পুলিশ ডাকা হবে।

বিশ বছরের পুরোন কর্মচারী কেলি জোন্স চিৎকার করে কেঁদে উঠল, না এ হতে পারে না। আমি এত দিন এখানে কাজ করি। আমাকে সবার আগে এভাবে লেঅফ করে  যেতে পারে না। আমি সিঙ্গেল প্যারেন্ট। আমার তিন বাচ্চা স্কুলে যায়। আমাদের এখন কি হবে?  তার প্রশ্নে সবার চোখ ছল ছল করে উঠল। কিন্তু কেও এগিয়ে আসল না। কেও কিছু বলল না। শুধু একজন সিকউরিটির লোক বলল, এত শব্দ করে কেঁদো না। অনেদের কাজের অসুবিধা হচ্ছে। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। আসলেও কি তাই? সময় কি সব ঠিক করে দিতে পারে? চাকরি হয়ত জোগাড় করে দেয়। কিন্তু যেই স্বপ্ন, বিশ্বাস, আর আশা খুন হয়ে যায়; তাকে কি আর বাঁচিয়ে তুলা যায়? তার পরেও তো মানুষ স্বপ্ন দেখে। কেন দেখে? আর কোন খুন হবে না সেই ভরসায়? সেই ভরসারই বা আসে কোথা থেকে?

১৩

একেবারে অন্য এক লরাকে আবিষ্কার করল এনামুর। লাঞ্চ করতে এক করে করে অনেক কথা বলল। নিজের কথা, বিলের কথা আর তার বাচ্চার কথা। এনামুরকে শুরুতেই বলেছে, তার সব কথা তাকে শুনতে হবে আর সব শেষে সে বলবে আজকের দিনটা কেন বিশেষ।

তোমাকে প্রথম কবে দেখেছি সেটা ঠিক মনে নেই। তবে আমার এতটুকু বুঝতে এক মুহূর্ত লাগে নি, তুমি আর পাঁচ জন পুরুষ থেকে অন্য রকম। তোমার  মধ্যে আমি কখন লোলুপ দৃষ্টি দেখি নি। এর আগে ভেবেছিলাম কোন পুরুষের সাথে অন্তরঙ্গতা করব না।  কিন্তু তোমার সাথে কথা বললে, আমার বিশ্বাস আর আস্থা বেড়ে যায়। তুমি আমাকে মুখে না বললেও, বুঝিয়েছ,  শরীরের চাহিদা ছাড়াও ছেলে মেয়ের সাথে সম্পর্ক হতে পারে। ভাগ্যিস তোমাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম।

বিলকে একে একে সবাই ত্যাগ করলেও, লরা তার ভালবাসাকে আশ্রয় দিয়েছিল। তাকে ঘিরে জীবন সাজাতে চেয়েছিল। কলেজ শেষ করার আগেই বিলকে বিয়ে করে  একটা এপার্টমেন্টে নিয়েছিল। বাবা-মার একেবারেই মত ছিল না। যে ছেলে লেখা পড়া ছেড়ে দিয়ে কোন কাজ কর্ম করে না; তাকে বিয়ে করা হয়ত পৃথিবীর কোন বাব মাই সমর্থন করতে পারে না। লরার এক কথা, সে তার কথা কোন ভাবেই ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

কিন্তু এক সাথে থাকতে আরম্ভ করে লরা নতুন এক  বিলকে আবিষ্কার করল। তার প্রতি সমান্যতম সম্মান পর্যন্ত দেখায় না। উঠতে বসতে ব্যাঙ্গ, কটূক্তি করা ছাড়াও রাত করে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরে আসে। এমনকি লরার গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত দ্বিধা করত না। লজ্জায় এই সব কথা বাবা মাকে পর্যন্ত বলতো না।  একবার কপালে দাগ দেখে, বান্ধবী সারা যখন জানতে চাইল কিসের দাগ। প্রথমে লরা কোন উত্তর দেয় নি। পরে সারা চেপে ধরলে, বলল, এই দাগ বিলের মারের থেকে হয়েছে।  কথাটা শুনে সারা রেগে চিৎকার করে বলল, কি এত বড় সাহস তোমার বাসায় থাকে তোমার পয়সায় খায়; আর কি-না তোমাকে মারে। আমি এখনই পুলিশ ডাকছি। লরা সারার হাত চেপে ধরে বলল না সেটা আমি করতে পারব না। আমি ওকে ভালবাসি। ওর মনের অবস্থা আমি বুঝি। বেচারার ফুটবল ক্যারিয়ার নষ্ট হয়ে গেছে। সেই দুঃখ ভুলতেই এরকম কাজ করে।  এই অদ্ভুত যুক্তি শুনে সারা চাপা গলায় উত্তর দিল, হায়রে অবলা শিক্ষিতা নারী, তুমি এখনও পুরুষ মানুষ চিনতে পারলে না।

১৪

লে অফ হওয়া ম্যানেজারদের অফিস বিল্ডিং  থেকে বের করে অনেকটা বিজয়ী হাসি মুখে নিয়ে জন হেনরি তার অফিস রুমে ঢুকল। যাই হোক মোটামুটি বড় ধরণের উপদ্রপ ছাড়াই এ রকম কঠিন কাজ শেষ করা গেছে। ছোট একটা দৃশ্য অবশ্য কেলি জোন্স তৈরি করেছিল। কিন্তু জন হেনরি এর থেকে অনেক বড় দৃশ্য মোকাবেলা করার জন্য তৈরি ছিল। এখন তার বস, কোম্পানির প্রেসিডেন্টকে ফোন করে বলতে হবে মিশন  সাকসেসফুল।

জন হেনরি বেশ কয়েকবার ফোন করে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে পেল না। ধরে নিল কোন জরুরী মিটিঙে হয়ত আটকে পড়েছে। না হলে তো তার ফোন রিসিভ না করার  কোন কারন থাকতে পারে না। বিশেষ করে সে নিজেই যখন বলে দিয়েছে, কাজটা শেষ হওয়া মাত্রই তাকে যাতে জানান হয়।

ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার বেশী সময় আর পেল না। দরজায় একটা টোকার শব্দ হয়ে দরজাটা খুলে ফেলল। তার অনুমতির জন্যে কিংবা তাকে উঠে এসে দরজা খুলে দেয়ার কোন সুযোগ পর্যন্ত দিল নয়া।

চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে কোম্পানির প্রেসিডেন্ট  অস্টিন ব্রাউন তার অফিসে ঢুকছে।

১৫

অল্প কিছুদিনের মধ্যে লরার ফুট ফুটে ছেলে ব্রায়েনের জন্ম হল। ওর ধারনা ছিল বাচ্চা কাচ্চা হলে হয়ত বিল পরিবর্তিত হবে। সংসারের কিছুটা দায়িত্ব বুঝে নিবে। কাজ কর্ম করে আয় রোজগার করবে, বাচ্চার জন্যে খরচ করবে। কিন্ত ভাবনাটাই সার। বিলের স্বেচ্ছাচার কমল তো নাই, বরং বেড়েই গেল। কারণে অকারণে লরার সাথে সাথে বাচ্চার উপরও অত্যাচার আরম্ভ করল।

লরা আর বিল এক সাথে বছর পাঁচেক ছিল। এক দিন সন্ধ্যায় বিল এসে লরার কাছে বলল, আমাকে ফাইভ হানড্রেড  ডলার দাও। বন্ধুরা লস ভেগাস যাচ্ছে গেম্বেল (জুয়া) খেলতে। আমিও যাব ওদের সাথে। লরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তার কষ্টের আয় জুয়া খেলার জন্যে সে কখনই দিতে পারবে না। সাথে সাথে বিল হৈ চৈ আরম্ভ করে দিল। আমাকে ডলার না দিলে তোমার আজ বিপদ আছে। লরা উত্তরে বলল, কি করবে, আমাকে মারবে। আমাকে আগেও মেরেছ। আমি তোমার কাছে মার খাওয়াকে কেয়ার করি না। বিল চিৎকার বলল, দেখ আমি কি করি।

বিল ছোট ব্রায়েনকে ধরে ছুঁড়ে মারল দেয়ালের দিকে।

ব্রায়েন রক্তাক্ত হয়ে মেঝেতে পড়ল। লরা তাকিয়ে দেখল ব্রায়েনের ছোট মাথা ফেটে একাকার হয়ে গেছে। সেখান থেকে মনে হচ্ছে কি যেন বের হয়ে  আসছে।

১৬

এম বি এম কর্পোরেশানে এ রকম দৃশ্য আগে কখন হয় নি।

ভাইস প্রেসিডেন্ট জন  হেনরি চিৎকার করে বলছে,  you can’t do this to me আমি তোমাদের জন্যে দিনে আঠার ঘণ্টা করে কাজ করে সব লে অফের প্ল্যান করে দিলাম। আর আমাকে কি-না  তোমরা সেই ফাঁদে ফেললে। মনে হচ্ছে সে একেবারে অপ্রক্রিতিসস্থ হয়ে পড়েছে। প্রেসিডেন্ট অস্টিন ব্রাউনের মা’কে জড়িয়ে কঠিন ধরণের গালিটা দিতে লাগল। এর মধ্যে সিকিউরিটির লোক এসে জন হেনরিকে টানতে টানতে দরজার দিকে নিয়ে যেতে লাগল।  ‘এই রাজা এই ফকির’ ধরণের বাস্তব নাটক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে  আরেকবার মঞ্চায়িত হল।

প্রেসিডেন্ট অস্টিন ব্রাউন নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করে ডেকে পাঠাল জন হেনরির এসিসট্যান্ট রিচার্ডকে। অল্প কথায় তাকে জন হেনরির দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে অস্টিন ব্রাউন বের হয়ে পড়ল। আবার গুঞ্জন চলতে লাগল অস্টিন ব্রাউন, রিচার্ডকেও এক ফাঁদে ফেলবে। সে হবে পরের শিকার। হায়রে ! পৃথিবীর সব চেয়ে ধনী আর উন্নত দেশ এমেরিকা; সেখানে প্রয়োজন শেষ হলে যে কেউ ডাস্টবিনে নিক্ষিপ্ত হতে পারে। মানুষ কি তা হলে বর্জ্য পদার্থ?

১৭

লরার জীবনে দুটো  বড় ঘটনা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে গেল।  ছোট ব্রায়েন এত বড় আঘাত সহ্য করতে পারলো না। লরার আকুতি মিনতি আর বিধাতার কাছে ফরিয়াদ খুব বেশী ফলপ্রসূ হল না। ব্রায়েন মাকে ছেড়ে চলে গেল পরপারে।

অন্য ঘটনাটাও প্রায় একই সময়ে ঘটল। পুলিশ বিলকে এ্যারেষ্ট করল নিজের সন্তানকে খুন করার অপরাধে।  তাও আবার লরার চোখের সামনে থেকে। বিল কঠিন শব্দগুলো ব্যাবহার করে বলল,  you bitch….. তুমি ডাইনি। তুমি আমার জীবন ধ্বংস করলে ……… তোমার জন্যেই আমার ছোট ছেলে মারা গেল। এইটা কয়টা টাকা দিলে তোমার কি ক্ষতি হত?

ক্ষতি অবশ্য হল লরার অনেকটাই। একদিকে বাচ্চার মৃত্যু, অন্য দিকে কোর্টে দৌড়া দৌড়ি। কিন্তু বিল লরার সব সহায়তা করার অনুরোধ নাকচ করে দিল। বলল, সে কোন দিন লরার চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায় না।  লরার সব হারিয়ে পথে বসার অবস্থা। বড় ধরনের ডিপ্রেশান পেয়ে বসল, একেবারে সুইসাইডাল।

বাবা মা লরাকে বাসায় নিয়ে গেল। চিকিৎসার ব্যাবস্থা করল। বছর কয়েক লেগে গেল মোটামুটি প্রকৃতিস্থ হতে। ডাক্তার সাজেষ্ট করল এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে। পরিচিত জায়গায় থাকলে প্যানিক এ্যাটাক হতে পারে। তার থেকে আগের মানসিক অবস্থা ফিরে আসার একটা বড় ধরণের সম্ভবনা আছে।  লরা নিউ ইয়র্ক থেকে চলে আসল ছোট শহর ফ্রাঙ্কলিনটনে। চাকরির অফারটা অবশ্য নিউ ইয়র্ক থেকে পেল। এম বি এম কর্পোরেশানে রিক্রুটার নিউ ইয়র্কে এসেছিল।

১৮

লরা বলতে লাগল আজকে আবার ছোট ব্রায়েনের জন্মদিক। আজকে থাকলে ওর বয়স দশ হত। আমি ওর জন্ম দিনে কেক কাটি, খুব আনন্দে থাকার চেষ্টা করি; ঠিক ওকে জন্ম দেয়ার সময়ে যেমন খুশি হয়েছিলাম……তেমন। আবার ওর মৃত্যু দিকে উন্মাদের মত কাঁদি; ঠিক ওর মৃত্যুর দিন যেমন কেঁদেছিলাম।

কথা শুনতে শুনতে এনামুরের চোখ কখন যে পানিতে ভরে গেছে সে বুঝতেই পারে নি।  ব্যাপারটা লরার চোখেও পড়ল। পরিস্থিতি একটু হালকা করার চেষ্টা লরা করল, ভয় নাই আমার মানসিক রোগ ফিরে আসবে না। এই দেখ এক ঘণ্টার  লাঞ্চ দুই ঘণ্টায় যেয়ে পৌঁচেছে।  চল চল অফিস ফিরে যাই।

১৯

রিচার্ড  নতুন পদ পেয়ে একটা ভাল কাজ করল। সে পিঙ্ক স্লিপ দেওয়ার আরম্ভ করল। তার মানে যাদেরকে কে অফ করা হবে, তাদের বলে কবে কার শেষ দিন। প্রথম পর্যায়ে ত্রিশ ভাগ লোককে লে অফ করা হচ্ছে। পরে অনেদের করা হবে। পিঙ্ক স্লিপে পনের দিন থেকে আরম্ভ করে দুই মাস পর্যন্ত সময় দেয়া হল।

এনামুর প্রথম পর্যায়ের ত্রিশ ভাগ লোকের মধ্যে নাই। কিন্তু লরা সময় পেল এক মাস। চাকরি খুঁজে পাওয়ার জন্যে খুব একটা বেশী সময় না। সবাই উঠে পড়ে লাগল নতুন চাকরির সন্ধানে।

লরা আবার একটা দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিল। সে বাবা মার কাছে নিউ ইয়র্কে ফিরে যাবে। বাবা মা র বয়স হয়েছে। তাদের দেখার কেউ  নেই। তা ছাড়া বড় শহর সেখানে গেলে চাকরির একটা হয়ে যাবে। লরা এনামুরকে অভয় দিয়ে বলল, ভয় পেও না। আমি এখন আগের থেকে অনেক শক্ত। তা ছাড়া আমি আমার ছেলে যেখানে শুয়ে আছে, তার কাছা কাছি থাকতে চাই। সময় পেলেই তার কাছে যেয়ে সময় কাটাতে পারব। উত্তরে এনামুর বলার মত কিছু পেল না।

২০

এনামুর লরাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এসেছে।

এটা সেটা কিছু কথা হতে লাগল।

চেকিং করে ভিতরে যাওয়ার আগে লরা বলল, আমি জানি তোমার একটা নতুন চাকরি এই শহরেই হবে। আমি সৃষ্টি কর্তাকে বলেছি, আমার একটা কথা রাখতে। তোমাকে যেন তিনি একটা কাজ অবশ্যই দেন। আমার মনে কোন সন্দেহ নাই, তিনি এই বার কথা রাখবেন।

এনামুর ভাবতে লাগল, অন্য রঙের অন্য ভাষার একটা মানুষ, তার মত এক জন বাঙ্গালীর জন্যে এত মায়া আসে কি করে।  তার থেকেই বা সে কি অপার্থিব শক্তি পায়।

এনামুর কিছু উদাসিন হয়ে অন্য দিকে তাকাল। লরা এনামুরকে can I give you a hug? উত্তরের অপেক্ষা না করে, এনামুরকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,  I am glad that I have found a friend like you. Now my heart will smile rest of my life. আমি খুব খুশি যে আমার তোমার মত এক জন বন্ধু আছে। আমার হৃদয় বাকি জীবন আনন্দেই থাকবে।

জুলাই ০৬, ২০১২

www.lekhalekhi.net

Source: Internet

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to পিঙ্ক স্লিপ

You must be logged in to post a comment Login