হরিপদ কেরানী

অণুগল্পঃ নিষিদ্ধ সন্তরণ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

সকালটা বাসায়। সারাদিন অফিসে। বিকেলটা কফির মগে। সন্ধ্যেটা বিলিয়ার্ড টেবিলে। ক্লাব-পার্টি- টুংটাং -চিয়ার্স। কখনও বাগান বাড়ীতে মক্ষিরাণী শিখিয়ে যাচ্ছে জীবনের সংগা-”লাইফ ইজ…….”। চারপাশে রঙ্গীণ কাঁচের দেয়াল। অফিসে। বাড়ীতে। গাড়ীতে-সর্বত্র। এর মাঝেই ব্যস্ত জীবন কেটে যাচ্ছে জীবনের খোঁজে।

কর্পোরেট-সোস্যাল লাইফে আমার সময় কোথা জীবনের মানে খোঁজার! শহরের সবচেয়ে উচু দালানের অফিসে বসে রঙ্গীণ কাঁচের দেয়ালের ভিতর দিয়ে যখন পুরো শহরটাকে নিজের পায়ের নীচে দেখতে পাই-তখন ভাবি এইতো জীবন! নিজেকে সবার উঁচুতে রাখতে পেরেছি! নূহের প্লাবনের সাধ্য কোথায় আমাকে ডোবায়!

আমার হাই প্রোফেশনাল বউটা কর্পোরেট সোস্যাল লাইফের চক্করে পড়ে কখন যে ভদকার নেশায় বুঁদ হয়ে নতুন ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে কোন বাগানের দিক যে চলে গেল বুঝলাম না কিছুই। শুনেছি দ্বিতীয়বার মালা বদল করেও ফুলের গন্ধ তার জোটেনি আজও। একমাত্র সন্তান ষ্টেটসে-জানিয়েছে ফিরবেনা কোনওদিন।

মনে পড়ে শৈশবে বাবাকে দেখেছি স্যাঁতস্যাঁতে অফিসে বসে ঘর্মাক্ত শরীরে ডান হাতের মধ্যমায় থুথু ভিজিয়ে লেজারের পাতা উল্টানো আর সস্তা কলমে ক্রমাগত লিখে যাওয়া। তখনি মনে হতো ধ্যাৎ কেরাণীর আবার জীবন! জীবন হলো কলমের দু প্রান্ত দুহাতে ধরে রিভলভিং চেয়ারে বসে ক্রমাগত দোল খাওয়া। বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম-”আচ্ছা বাবা, তোমার জীবনের স্বপ্ন কি?” বাবা বলেছিলেন-”খোকা তুই একদিন অনেক বড় হবি”। সাথে সাথে ঘরের কোণের সরিসৃপটা ”টিক টিক” করে জানান দেয় অনাগত ভবিষ্যতের সত্যতা। আমি আবার জিজ্ঞেস করি”আর?” বাবা উত্তর দেয়- ”বেতনটা যদি আরেকট বাড়ত!”

আমার বিকেলগুলো কেড়ে নেওয়া মেয়ের নাম অনুরাধা। সেই অনুরাধারা যেবার ভিটেমাটি বেচে কলকাতা চলে গেল, যাওযার সময় ওকে জিজ্ঞেস করলাম -”তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না রে”। সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলো ”হ্যা। খুব”। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম ”তোর জীবনের স্বপ্ন কি রে?” সে বলল ”স্বপ্ন তো মরে গেছে!” আমি বল্লাম ”মৃত স্বপ্নটাই না হয় বল!” সে চোখ ভর্তি অশ্র নিয়ে বলেছিলো ”আমার খুব শখ ছিলো কোন এক পূর্ণিমায় তোমার সাথে বসে যমুনার ঢেউ গুনবো!” বাবা মরলে চোখ সামান্য ভিজেছিলো কিন্তু সেবার কেন যেন আমি ডুকরে কেঁদেছিলাম। অনুরাধা আজ কোথায়? দু চোখে যমুনার স্বপ্ন নিয়ে ভাগীরথীর তীরে বসে কি সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলো?

বাবা, মহৎপ্রান পিতা আমার! শৈশবে তোমাকে দেখে খুব করুণা হতো। মনে হতো এক নিমিশে যদি তোমার সব অভাব ঘুচিয়ে দিতে পারতাম! সেই থেকে জীবনের উল্টো পথে আমার ডুব সাঁতার। সাঁতরাতে সাঁতরাতে কখন যে আটকা পড়ে গেলাম কাঁচের দেয়ালের মাঝে। সূর্যের নষ্ট আলো প্রতিনিয়ত এখানে ঘুরপাক খায়। পাপ আর দুঃখ বইতে বইতে আজ আমি বয়সের ভারে নুয়ে পড়া বৃদ্ধের মতো ক্লান্ত।

ভদকার পেগ এর মাত্রা বাড়তে থাকে ক্রমাগত- চার, পাঁচ, ছয়, সাত …..। এইতো এইতো দেখতে পাচ্ছি পিতার মুখ, পিতামহের ঘামের গন্ধ, ফেলে আসা গ্রাম, অনুরাধা, যমুনার ঢেউ, দিগন্তের ঐ কিনারে ওটা কে? আরে ওটাই তো আমার মা। মা! তোমার মুখ তো আমি কবেই ভুলে গেছি!

মায়ের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা নদী। দেবনদী মন্দাকিনী। তার ওপার থেকে ভেসে আসছে অন্ধ বয়াতীর দোতারার সুর। তারও ওপাশে পুণ্যাত্না যুধিষ্ঠির। আহা যুধিষ্ঠির! আমায় কি সাথে নেবে তোমার তপোবন যাত্রায়? আমি আসছি যুধিষ্টির! মাঝে দেবনদী মন্দাকিনী। এক সন্তরণেই শেষ হয়ে যাবে! একটু দাঁড়াও যুধিষ্ঠির!

ট্রিগারটা তর্জণীতেই ছিলো। আর নলটা চিবুক বরাবর………….।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to অণুগল্পঃ নিষিদ্ধ সন্তরণ

You must be logged in to post a comment Login