মাহাবুবুল হাসান নীরু নীরু

ভালবাসার গল্প: বাবা, অন্তু হারিয়ে গেছে!

ভালবাসার গল্প: বাবা, অন্তু হারিয়ে গেছে!
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

2222নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তুতুলি। যার জন্য এতো অপেক্ষা, যার প্রতীক্ষায় এতো প্রহর গোনা, ওর সেই স্বপ্নের পুরুষটি হেঁটে যাচ্ছে নীল ক্ষেতের ফুটপাত ধরে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না তুতুলি। আবেগে কেঁপে ওঠে ওর দেহ-মন। ও নিজের অজান্তেই হাত তুলে গলা ছেড়ে চিৎকার করে ওঠে প্রিয় মানুষটার নাম ধরে। কিন্তু দূরত্ব অনেক। জনকোলাহল ছাপিয়ে, দূরত্ব ডিঙ্গিয়ে সে চিৎকার পৌঁছুলো না তার কানে।

নিউ মার্কেট থেকে বেরিয়ে বাসায় ফেরার জন্য রিকশা ঠিক করছিলো তুতুলি, এ সময় ওর চোখ পড়লো রাস্তার ওপাড়ে ফুটপাতে পথচারীর ভিড়ে আরাধ্য মুখটার ওপর। রাস্তায় গিজগিজ করছে রিকশা, টেম্পো, মিনিবাস। সহসা রাস্তা পেরুনোর উপায় নেই। অথচ ওর আরাধ্য মুখটা দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে জনস্রোতে, চলে যাচ্ছে চোখের আড়ালে। ছটফট করছে তুতুলির তৃষ্ণার্ত, অস্থির মন।

অনেক চেষ্টা করে তুতুলি যখন রাস্তা পেরুতে সমর্থ হলো তখন প্রিয় মুখটা হারিয়ে গেছে নীলক্ষেতের মোড়ে। পাগলের মতো খুঁজলো। ছুটোছুটি করলো। অবশেষে নিষ্ফল হলো। বুক ঠেলে উঠে এলো বাঁধভাঙ্গা কান্না। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো সে। তারপরও তুতুলির প্লাবিত চোখ চলমান জনস্রোতে খুঁজে ফেরে প্রিয় মুখটি। যদি দেখা মিলে যায়। অকস্মাৎ যদি ফের খুঁজে পায়। ওর ভেজা মুখখানার ওপর প্রশ্নবোধক দৃষ্টি ফেলে ফুটপাতে বয়ে চলে ব্যস্ত মানুষের ঢল। সময়ের পথ ধরে সময় গড়ায়, শেকল ছেঁড়া সেই পাখিটা নজরে আসে না ব্যাকুল প্রতীক্ষার পরও।

এতো কাছে পেয়েও মানুষটাকে হারিয়ে ফেললো সে। বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষায় প্রহর গুনছে কিন্তু আজ চোখের দেখা দেখলো শুধু, সেও বেশ দূরত্বের ব্যবধানে। কিছুটা সময়ের জন্য। হতে পারলো না মুখোমুখি। ছুঁতে পারলো না। বলতে পারলো না একটি মাত্র কথা, ‘কেন তুমি এভাবে নিজেকে আড়াল করে রেখেছো অন্তু?’ বুকটা ওর দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায়। চৈত্রের খর দুপুরের রাখালের বাঁশির করুণ বিচ্ছেদের সুর ওর নরম কলিজা এঁফোড়-ওফোঁড় করে। স্মৃতির জানালায় আছড়ে পড়ে কুন্ডলি পাকানো একটা ধূলিঝড়। বড় জ্বালা। বড় যন্ত্রণা। অসহ্য! নিজের তপ্ত মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরে তুতুলি। কোনো রকমে একটা রিকশা ঠিক করে উঠে পড়ে তাতে। যানজট ঠেলে রিকশা চলে। ধীরে। মাঝবয়সী রিকশাওয়ালা বলে, ‘বুঝলেন আফা, মনে শান্তি নাই, ছয় টাকার খ্যাপ মারতে দিন কাবার। রাস্তার জাম আমাগো জান লইয়া টানাটানি শুরু করছে। বাঁচতে পারমু নাগো আফা।’

রিকশাওয়ালার কথাগুলো তুতুলির কানে গেলো না। ওর কানে বাজছে অন্তুর সেদিনের সেই কথাগুলো, ‘তুতুলি, বই-পুস্তকে পড়েছি মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই, কিন্তু তুতুলি, আমি এমন একটা জীবন নিয়ে জন্মেছি যার সাধ আছে, সাধ্য নেই। স্বপ্ন আছে, প্রাপ্তি নেই। তুমি বর্ণিল, আমি বিবর্ণ। তুমি সতেজ, আমি বিধ্বস্ত। তুমি চলমান, আমি অথর্ব।’

রিকশাওয়ালার কথাগুলো তুতুলির কানে গেলো না। ওর কানে বাজছে অন্তুর সেদিনের সেই কথাগুলো, ‘তুতুলি, বই-পুস্তকে পড়েছি মানুষের অসাধ্য বলে কিছু নেই, কিন্তু তুতুলি, আমি এমন একটা জীবন নিয়ে জন্মেছি যার সাধ আছে, সাধ্য নেই। স্বপ্ন আছে, প্রাপ্তি নেই। তুমি বর্ণিল, আমি বিবর্ণ। তুমি সতেজ, আমি বিধ্বস্ত। তুমি চলমান, আমি অথর্ব।’

তুতুলি বলেছে, ‘এতো সহজে হতাশ হয়ে পড়ছো কেনো অন্তু, ধৈর্য ধরো, দেখো নিশ্চয় জীবনটা পাল্টে যাবে।’

‘আর কবে পাল্টাবে তুতুলি! আর কতো ধৈর্যধারণ করবো? মেঘে মেঘে বেলা তো আর কম হলো না। বেকারত্বের অভিশাপ যে কতো দুর্বিষহ সে তুমি বুঝবে না। মেস ভাড়া দেয়ার সামর্থ্য পর্যন্ত আজ আমা হতে লুপ্ত। লেখাপড়ার শেষ ধাপ ডিঙ্গিয়েছি সেও তিন বছর হয়ে গেলো। না তুতুলি, আমি আর পারছি না। আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’ অন্তুর কথায় বুকটা কেঁপে উঠেছে তুতুলির। সে অন্তুর মনে সাহস যোগানোর চেষ্টা করেছিলো, ‘ভেঙে পড়ো না অন্তু।’

‘ভেঙেই তো গেছি তুতুলি,’ অন্তুর কক্তে চরম হতাশা, ‘পড়তে আর কিছু বাকি রয়েছে কি?’

কথা বলতে পারেনি আর তুতুলি। যৌবন জোয়ারী শরীর, চোখে রঙিন চশমা। সুপুষ্ট, মসৃণ, লাস্যময়। মন জুড়ে কামনার ঝড়ের ক্ষ্যাপা তাণ্ডব। অদৃষ্টের হাতে নিজেদের সঁপে দিতে চেয়েছিলো তুতুলি। আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সূর্যকে সাক্ষী রেখে জীবনের সাথে কঠিন বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিলো অন্তুকে। কিন্তু অন্তু অনড়। নিরেট, শক্ত পাথর। আকাশের দিকে তাকিয়ে ওর মন ভরে না, বাতাস গিলে ভরে না পেট। লক্ষ লক্ষ মাইল দূরের চন্দ্র আর সূর্যকে সাক্ষী মানতে নারাজ সে। কঠিন বাস্তবতার নির্মম কষাঘাতে রঙিন চশমা চোখে তোলার ফুরসৎ পায়নি সে কখনো। আর তাই বুঝি তুতুলির ভরা শরীরের অতি স্পষ্ট রেখাগুলো নজর কাড়তে পারেনি অন্তুর। তুতুলির দু’চোখে আহ্বান ছিলো, দু’ঠোঁটে কামনা, ওর আলোক উদ্ভাসিত বুকের ছন্দ, সৌরভ অন্তুর বিবর্ণ জমিনে ঘটাতে পারেনি সবুজের সমাহার। তুতুলি যতোই ঘেঁষতে চেয়েছে অন্তু ততোই ছিটকে সরে গেছে।

তুতুলি জানতে চেয়েছে, ‘জীবনকে কেন এতো ভয় পাও অন্তু?’

অন্তু হেসেছে। ম্লান সে হাসি। শুষ্ক কণ্ঠে বলেছে, ‘আমার জীবনকে আমি ভয় পাই না তুতুলি। ভয় তোমার জীবনটাকে নিয়ে। আমার পোড়া, নিরস, বিরস জমিনে এসে তুমি বিবর্ণ হবে, বিধ্বস্ত হবে, তোমার চোখের রঙিন চশমাটা খুলে পড়ে খান খান হয়ে ভেঙে যাবে, মোহভঙ্গে তুমি আমাকে একটা জানোয়ার ভাববে, তার চে’ এই কি ভালো না তুতুলি, বেঁচে থাকবে আজকের দিনগুলো পরম ভালো লাগার দিন হয়ে?’

অন্তুর কথাগুলো শুনে রক্ত উঠে যায় তুতুলির মাথায়। ও চিৎকার করে ওঠে, ‘তুমি একটা কাপুরুষ।’

তুতুলির ধিক্কারে বীরপুরুষ হতে পারেনি অন্তু। মন ধারণ করেনি ক্ষ্যাপা ব্যাঘ্রের রূপ। অথবা কামনার ডানায় জাপটে ধরে তুতুলিকে নিয়ে রাজহাঁসের মতো আছড়ে পড়েনি কল্পিত রঙিন সরোবরে। বড় ব্যথা পেলো তুতুলি। বড্ড রাগ হলো। উধাও হলো ওর মনোজগতে জোৎস্নার প্লাবন। রাগে-দুঃখে সে অন্তুকে গলা চড়িয়ে বললো, ‘এমন কাপুরুষ তুমি, জানলে তোমার ভিটেও মাড়াতাম না।’

অন্তু রাগেনি। চটেনি। ফুঁসে ওঠেনি। হেসেছে। ম্লান সে হাসি। বলেছে, ‘আজ তুমি আমাকে অনেক কিছুই ভাবতে পারো তুতুলি, অনেক কথা বলতে পারো। বিশ্বাস করো কঠিন বাস্তবতা তিল তিল করে শুষে নিয়েছে আমার সমস্ত পৌরুষ, অবশিষ্ট আছে শুধু উরুর সন্ধিস্থলের বর্ধিত মাংসপিন্ডটা। এখন ওটার অস্তিত্ব অনুভব করতেও আমার ঘেন্না হয়।’ এক সময় অন্তুর কণ্ঠটা বেদনার্ত হয়, ‘আমার এক শরীরের ভারই আমি বইতে পারছি না তুতুলি, এরপর তোমার শরীর। তারপর দুই শরীরের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসবে আরও শরীর, এক, হতে পারে একাধিক।’

ফুঁসে ওঠে তুতুলি, ‘ভাবনার কোনো গন্তব্য নেই, যতোই ভাববে ভাবনার পরিধি ততোই বাড়বে, মহাশূন্যের মতো। শেষ নেই। অমন ভাবনা তুমি বসে বসে ভাবো। আমার দুঃখ তোমার মতো একটা নির্জীবকে আমি আমার জীবন ভেবেছিলাম।’

অন্তু কোনো উত্তর দেয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে মাত্র। হতাশার ফ্যাকাশে চোখ মেলে আকাশ দেখেছে। আর অন্তুর মুখের উপর সাফ জবাব দিয়েছে তুতুলি, ‘এই শেষ। আর নয়। মরা পুরুষের সাথে তো আর ঘর বাঁধা যায় না।’

অন্তু কোনো উত্তর দেয়নি। দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে মাত্র। হতাশার ফ্যাকাশে চোখ মেলে আকাশ দেখেছে। আর অন্তুর মুখের উপর সাফ জবাব দিয়েছে তুতুলি, ‘এই শেষ। আর নয়। মরা পুরুষের সাথে তো আর ঘর বাঁধা যায় না।’

অন্তু দেখলো তুতুলির নাকের পাটা ফুলে গেছে, গরম নিঃশ্বাস বইছে। চোখে ঝরছে আগুন। ভস্ম করে দিতে চাইছে অন্তুকে। এক সময় তুতুলি অন্তুকে দেখালো পশ্চাদদেশ। পিছন ফিরে চাইলো না একটিবারও। শুধু ওর কানে ভেসে এলো অন্তুর শেষ কথাগুলো, ‘তোমার আমার প্রেমের সুধামাখা দিনগুলো আমার পরম পাওয়া, যতোদিন বেঁচে থাকবো বুকে লালন করবো পরম যতেœর সাথে।’

সেই শেষ কথা। শেষ দেখা। আর কখনো, কোনোদিন তুতুলি অন্তুর দেখা পায়নি। দেখা দেয়নি অন্তু। অন্তুকে রাগের বশে অনেক কথা বললেও অন্তুর বিচ্ছেদ ওকে বিরহের দাবানলে নিক্ষেপ করলো। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ জ্বলতে লাগলো তুতুলি। যতোই জ্বলে শরীরের জ্বালা ততোই কমে যায়, চোখের রঙিন চশমাটা হালকা হতে হতে এক সময় খসে পড়ে। মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে একটা অসম্ভব দৃঢ়তা নিয়ে বাবার মুখোমুখি হয় সে। প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলে, বাবা, আমি পড়াশোনা করবো, ভার্সিটিতে ভর্তি হবো।’

মেয়ের কথায় বেশ খুশি হলেন আবদুল হাফিজ। ভার্সিটিতে ভর্তি করে দিলেন তিনি তুতুলিকে। শুরু হলো তুতুলির নতুন জীবন। আরাধনার জীবন। আসলে তুতুলির পতিত শিক্ষা জীবনে নব উদ্যমের বীজ বপিত হয়েছে অন্তুর কারণেই। রাগে-দুঃখে অন্তুকে তিরস্কার করে ফিরে এলে নতুন ভাবনা পেয়ে বসলো তুতুলিকে। ওর মনে হলো, আজ যদি সে শিক্ষিত হতো, উপার্জনক্ষম হতো তবে অনায়াসেই সে অন্তুর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলতে পারতো, ‘তুমি বিধ্বস্ত, তাতে কি, আমি তো পূর্ণ। উঠে এসো আশাহত পথিক আমার হাত ধরে, আজ আমার আছে, একদিন তোমারও হবে। দু’জনে যৌথ প্রচেষ্টায় গড়বো সুরম্য নগরী।’ কিন্তু তুতুলির যা শিক্ষা তাতে অন্তুর জীবনে বোঝা হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। পূর্ণ জোয়ারী যৌবনের কামনা বাসনা মনের সকল কপাট বন্ধ করে রেখেছিল। টানাটানির সংসার ওদের। চার ভাই বোন। বাবার আয়ে কোনো রকমে চলে যায়। এরই মাঝে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাস করার পর তুতুলি ঘোষণা দিলো সে আর লেখাপড়া করবে না। কিন্তু আবদুল হাফিজের বড় ইচ্ছে, লেখাপড়া করে ছেলেমেয়েগুলো মানুষের মতো মানুষ হোক। যে করেই হোক কষ্টেশিষ্টে চালিয়ে নেবেন তিনি। মেয়েকে অনেক বোঝালেন। তুতুলির এক কথা সে আর পড়াশোনা করবে না। তুতুলির শরীর জুড়ে ভরা পূর্ণিমার প্লাবন। নানা বর্ণের বাহারি ফুলে ভরপুর মনের বাগান। চোখ বুঁজলেই পৌঁছে যায় সুখনগরে। ঘাড়ের ওপর অনুভব করে পিয়াসি যুবকের ঘন, ভারি নিঃশ্বাস। শরীরের কূলে কূলে মোচড় খায় পরিচ্ছন্ন যৌবন। কখনো বা প্রবলভাবে।

জাহাজডুবি যাত্রী অথৈ সাগরে বাঁচার আশায় আঁকড়ে ধরে সামান্য কাঠের টুকরোটাকেও। যদিও জানে এটা যথেষ্ট নয়, তবু আপ্রাণ চেষ্টা বেঁচে থাকার। অন্ধ যৌবনের কামনা বাসনা অনুরূপ। কাউকে মনে ধরলে কাছে টেনে তাকে পিষে ফেলতে চায় অরুদ্ধ আবেগ। তখন মনে হয় সেই হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন। মনের আকাশে ওড়ে রঙিন কাগজের ঘুড়ি, ত্বকে কামনার শিশির জ্বল জ্বল করে নব্য যৌবনের আলোকে। কামুক বাঘিনী পেলো ব্যাঘ্রের সন্ধান। তুতুলির আহ্বানে সাড়া দিলো অন্তু, দু’জনের মধ্যে বয়সের একটা বড় ব্যবধান সত্ত্বেও।

অন্তু পাস করে চাকরির জন্য ঘুরছে। অভাবী জীবন। দরিদ্র কৃষক বাবার অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েছে কিন্তু চাকরি মেলেনি। একদিন তুতুলির রঙিন চশমায় আটকে গেলো অন্তু। থাক অভাব, তাক দারিদ্র্য তথাপি অন্তু মানুষ। বেদনার আস্তরণ সরিয়ে তুতুলি অন্তুর মনে জাগাতে চাইলো নেশা। ভালোবাসা, ভালোলাগার নেশা। রূপের নেশা, রঙের নেশা। কামনা, বাসনা। নাড়া পেয়ে সাড়া দিলো অন্তু। তুতুলির খোলাচুলে খুঁজে পেলো জীবনের সৌরভ। কিন্তু বাস্তবতার ভোঁতা আর চোখা গুঁেতাগুতিতে ক্ষতবিক্ষত অন্তু সর্বদা ছিলো সচেতন। তুতুলির জালে ধরা পড়লেও, ক্ষ্যাপা যৌবনের নেশায় মাতাল হয়ে ওঠেনি কখনো। তুতুলিকে সে অনেকভাবে বুঝিয়েছে নিজের হতদরিদ্র জীবনের কথা। তুতুলি কানে তোলেনি সেসব। পরিণতিতে একদিন বিচ্ছেদ।

মেঘে মেঘে গড়িয়েছে বেলা। সূর্য ডুবেছে, আবার উদিত হয়েছে। দিনে দিনে মাস, মাসে মাসে বছর। একে একে গড়ালো পাঁচটি বছর। গভীর আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয়ে বেশ কৃতিত্বের সাথেই তুতুলি শেষ করলো ওর শিক্ষা জীবন। পৈতৃক সূত্রে পিতার কর্মস্থলে একটা চাকরিও মিলে গেলো। আয় রোজগার মন্দ নয়। নিজেকে অনেক সাধ্য সাধনায় শক্তভাবে দাঁড় করানোর পাশাপাশি তুতুলি একদিনের জন্যও ভুলে গেলো না অন্তুকে। অর্ন্তজ্বালায় নিশিদিন জ্বলে তুতুলি। পথে ঘাটে যেখানেই যায় অনুসন্ধানী দৃষ্টিযুগল খুঁজে ফেরে অভিমানী প্রিয় মানুষটাকে। কিন্তু দেখা পায় না।

তুতুলি অন্তুকে সেদিন রাগের মাথায় কাপুরুষ বললেও সে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে অন্তুর বলিষ্ঠ পৌরুষকে। অন্তুর মতো পুরুষকে আজ সে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। অন্তুর মতো ছেলেরা গড্ডালিকাপ্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে দেয় না। ওদের আত্মসম্মানবোধ দারুণ স্বচ্ছ আর প্রবল। তুতুলি মনে করে আজ আমাদের সমাজে অন্তুর মতো ছেলেরা অবহেলিত না হলে, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন হলে দেশ ও জাতি অধিক উপকৃত হতো। কিন্তু অনাদর, অবহেলা, লাঞ্ছনা-বঞ্চনায় নিখাঁদ সোনায় প্রতিনিয়ত খাঁদ জমছে। তুতুলি জানে না অন্তু এখন কতোটুকু ‘অন্তু’ আছে। কোথায় আছে, কেমন আছে।

ভাবনার সাগরে ভাসতে ভাসতে বাসায় ফিরলো তুতুলি। শূন্য মনে বেদনার স্তূপ। নতুন করে বিচ্ছেদ যন্ত্রণা ওকে কুরে কুরে খেতে লাগলো।

তুতুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে চাকরিতে যোগ দেবার পর থেকে বাবা আবদুল হাফিজ ওর বিয়ের জন্য উঠে-পড়ে লেগেছেন। তারা জানেন অন্তুর কথা। এ সম্পর্কে আবদুল হাফিজের মতামত হচ্ছে, ‘এতো বছর যখন ছেলেটা এলো না কিংবা একবারও খোঁজ নিলো না তখন ওর জন্য আর অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না।’ আবদুল হাফিজ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে প্রায়ই বলেন, ‘মা, এতোই তো খোঁজাখুঁজি করছিস, কই তার তো দেখা মিলছে না, ওর জন্য নিজের জীবনটা কেন নষ্ট করছিস মা।’

তুতুলি বাবার এমন কথায় প্রতিবাদ করে ওঠে, ‘না বাবা, ওর জন্যই আমি জীবনকে নতুন করে গড়তে পেরেছি, নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড়াতে পেরেছি। নারী হলেও এখন আর আমি দুর্বল নই।’

‘তোর সব কথাই ঠিক আছে মা,’ আবদুল হাফিজ কণ্ঠে আদর ঝরিয়ে বলেন, ‘বয়সের একটা ব্যাপার আছেরে মা। দিনে দিনে তোর বয়স তো আর কম হলো না, সেই সাথে আমারও। কবে যে চলে যাই কে জানে। তোর বিয়েটা না দেয়া পর্যন্ত এ বুড়োর শান্তি নেই। রাত-দিন এই একটা যন্ত্রণা প্রবলভাবে ক্ষতবিক্ষত করে আমাকে আর তোর মাকে।’

কোনো কথা বলেনি তুতুলি। আবদুল হাফিজ আরো অনেক কথা বলেন। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহযোগ্য মেয়ে ঘরে রাখলে কতোটা পাপ হয় ও আখেরাতে এর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কি ধরনের জবাবদিহি করতে হবে এবং এ পাপের জন্য দোজখের আগুনে কতো হাজার বছর জ্বলতে হবে তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেন। কিন্তু এতোসব কথা কানে যায় না তুতুলির। ওর মন প্রতীক্ষায় প্রহর গুনে অন্তুর জন্য। ওর দু’চোখ সর্বক্ষণ খুঁজে ফেরে অন্তুকে। সেই আকাঙিক্ষত অন্তুকে আজ চোখের দেখা দেখেও হারালো তুতুলি। মাঝখানে অনেকগুলো বছর অতিক্রান্ত হলেও অন্তুকে চিনতে একটুও কষ্ট হয়নি ওর। মুখবয়বে শুষ্কতার ছাপ এখনো বিদ্যমান। তুতুলি ভাবে শুধু একবার যদি অন্তুর মুখোমুখি হতে পারতো সে তবে বলতো, ‘আজ বাবার বলে নয় নিজের শক্তিতে আমি চলমান। আজ শুধু আমার শরীর নয়, তোমার শরীরও বহন করার যোগ্যতা অর্জন করেছি আমি, শরীরে শরীর মিশে আরও শরীর এলে সেটিকেও বহন করতে এখন আমি সক্ষম।’ কিন্তু হায়, তুতুলি যেদিকেই সে চায়, অন্তু নেই, পায় না অন্তুর সন্ধান।

বাসায় ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে অনেকক্ষণ কাঁদলো। অঝোর ধারায়। এক সময় পিঠে স্নেহের পরশ পেয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে তুতুলি দেখলো বাবা আবদুল হাফিজ এবং মা মিনারা হাফিজ দু’জনেই দাঁড়িয়ে আছেন ওর সামনে। মিনারা হাফিজ এগিয়ে এসে খাটের ওপর বসে মেয়ের মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে হাত বুলোতে লাগলেন।

ভারী কণ্ঠে আবদুল হাফিজ প্রশ্ন করলেন, ‘এভাবে কাঁদছিস কেন মা?’

তুতুলি শুষ্ক কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘বাবা, আজ নীলক্ষেতে আমি অন্তুকে দেখেছি কিন্তু ওর মুখোমুখি হতে পারিনি, তার আগেই হারিয়ে গেছে ভিড়ের মধ্যে।’

আবদুল হাফিজ চেয়ারটা টেনে বসলেন, বললেন, ‘এ তোর দেখার ভুলও হতে পারে মা।’

তুতুলি প্রবলভাবে দু’দিকে মাথা নাড়ে, ‘না বাবা, এতোটুকু ভুল হয়নি।’

আবদুল হাফিজ দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘এতোগুলো বছর অপেক্ষা করে যাকে শুধু চোখের দেখা দেখলি আরও কতোগুলো বছর অপেক্ষা করে যে তার মুখোমুখি হতে পারবি সে খোদা জানে।’

বাবার হৃদয়ের রক্তক্ষরণের শব্দ কানে বাজলো তুতুলির। ও ফ্যাকাশে দৃষ্টিতে তাকায় বাবার দিকে। আবদুল হাফিজ উঠে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। স্ত্রীর কোল থেকে মেয়ের মাথাটা নিজের কোলে টেনে নিয়ে, মাথায় হাতে বুলোতে বুলোত আর্দ্র কণ্ঠে বললেন, ‘মা তুতুলি, তোর বুড়ো বাবা মা যে আজ বড় একটা অন্যায় করে ফেলেছেরে মা।’

বাবার এমন নরম আর মধুর কক্ত তুতুলির আবেগে ঝড় তোলে। মমত্বভরা চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আবেগাপ্লুত কণ্ঠে সে বলে, ‘কি অন্যায় বাবা?’

আবদুল হাফিজ তাকালেন স্ত্রীর দিকে। মিনারা হাফিজ মেয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললেন, ‘তোর জীবনটা আমরা এভাবে নষ্ট হতে দিতে পারিনারে মা। আমরা তোর বিয়ে ঠিক করেছি। খুব ভালো ছেলে। একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে ভালো চাকরি করে। স্বল্পভাষী। স্বভাবে ধীরস্থির। বড় লক্ষ্মী ছেলে। তুই সুখী হবিরে মা।…

তুতুলি একবার বাবার দিকে, একবার মায়ের মুখের দিকে তাকালো, তারপর বালিশে মুখ গুঁজে আবার হু হু করে কাঁদতে লাগলো।

-মাহাবুবুল হাসান নীরু


শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to ভালবাসার গল্প: বাবা, অন্তু হারিয়ে গেছে!

You must be logged in to post a comment Login