ফাতেমা প্রমি

মেঘলা নীল অন্তর

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

“ওর নজর ভালো না, আমি আপা আগেই তোমারে কইছিলাম। তখন তো শুন নাই। এখন বুঝো। “

চেঁচাচ্ছিল সুফিয়া বেগম। পাশেই বসে আছে তার বোন মুনিয়া। কথা গুলো বোনের উদ্দেশ্যেই বলছিল সে। বেশী কথা বলা সুফিয়া বেগমের মুদ্রাদোষ; চেঁচানোটাও তাই। অন্য সময় হলে সুফিয়াকে থামিয়ে দিত মুনিয়া। কিন্তু আজকের ঘটনা অন্যরকম, তাই  সে কিছু বলছে না। চোখে একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে সে। তার দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে সামনে বসে থাকা নোংরা মাখা, মলিন চেহারার মেয়েটি যেন মানুষ না। যেন অন্য কোন গ্রহ থেকে উঠে আসা প্রাণী সে। কতই বা বয়স হবে মেয়েটির? পনেরো বা ষোল হবে খুব জোড়। পরিপাটি পোশাক পরিয়ে বেণী দুলিয়ে স্কুলে পাঠালে বেশ লাগত। কিন্তু তার পরনে আক্ষরিক অর্থেই শতছিন্ন এক টুকরো কাপড়। ময়লা চুল, ময়লা হাত পা। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে গেছে। নাম তার পরী, দেখতেও তেমনি। একটা সময় ছিল যখন পরীর মতই জীবন ছিল মেয়েটির। কিন্তু এখন সে দাঁড়িয়ে মিয়া বাড়ির উঠনে। মাইনে খাটা চাকরানী। ভাগ্যগুণে পাওয়া এই পরিচয়টুকুও আজ বোধহয় হারাতে বসেছে সে।

সামনে উঠোনে খেলা করছিল আর পরীর হাতে খাবার খাচ্ছিল মুনিয়ার ছোট্ট ছেলেটি। বেশ খানিকটা বমি হয়ে আপাতত ভালই আছে সে। মুখটা নীল হয়ে যাওয়ায় প্রথমে সবাই বেশ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আপাতত তেমন কিছু হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

সুফিয়া বেগম চেঁচাল,  ”  বলি ছেলেকে কোলে নাও আপা। চল মুন্সির কাছে নিয়া যাই। নজর লাগায়া তোমার পোলাডারে মারল কিনা দ্যাখো।”

সুফিয়া বেগমের চিৎকারে মুনিয়া যেন এবার সম্বিত ফিরে পেল। ঝাঁপটে ধরে ছেলেকে কোলে তুলে নিল সে। বুক চাপড়ে চিৎকার করে উঠলো,  “আমার মানিকরে মাইরা ফালাইছে রে। এই হারামজাদী বদনজরী ডাইনীডারে বিদায় কর। বিদায় কর।”

সুফিয়া বেগমের গলা বোনের চেয়েও এক স্কেল উপরে চড়ল, ” কিসের বিদায় আপা। ওর বিচার হইব, বিচার। বাইন্ধা রাখন লাগব ওরে; এইবার আর ছাড়া যাইবো না । গেরামের ভালো চাইলে ওর ঐ বদনজরী চক্ষু দুইটা আইজকা গালায়া দিতে হইব । “

**

সে সন্ধ্যেটা কোনমতে কান্নাকাটি করে পার করল পরী। সেই তখন থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় গোয়াল ঘরে বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে তাকে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে  মেয়েটি। তারপর রাতটাও পার হল, তারও পরে যখন দুপুর হয়ে এল ভয়টা জেঁকে বসল। সেই পুরনো ভয়। আদি সেই ভয়, যে ভয় ওকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মারে! কিছুক্ষণ আগে গোঁ গোঁ শব্দ বেরুচ্ছিল মুখ দিয়ে, এখন সে একেবারে চুপ হয়ে আছে। কান্নার রেখাটাও শুকিয়ে গেছে। একমনে বসে পরী আল্লাহ্‌র নাম জপ করতে লাগলো। শত ভীতিকর চিন্তা মাথায় খেলে গেল তার। মনে পড়ে গেল পুরনো কতশত কথা। সেই শৈশব থেকেই সে কুলটা, নজর খারাপ নামে পরিচিত। পরী যেখানে, সেখানেই ঘটে যত আজগুবি ঘটনা।

মনে পড়ল পরীর, সেই যে স্বামীর ঘরে নতুন বৌ আসার সেই কথা। সেই দিনের কথা ভাবলে আজও তার ভয়ে কণ্ঠনালী শুকিয়ে আসে। কার না হিংসে হবে আপনজনকে পর হতে দেখলে। ওরও হিংসে হয়েছিল। হয়েছিল প্রবল দুঃখবোধ। তীব্র অভিমান আর অপমান। কষ্টের প্রবলতায় জ্বর এসেছিল তার। মেয়েটির ধ্বংস চেয়েছিল সে, সত্যি। তাই বলে এতটা চায়নি সে।

বাসর রাতেই মারা গেল তার স্বামীর দ্বিতীয় বৌ। মুখ দিয়ে ফেনা ভেঙে নিস্তেজ হয়ে গেল মেয়েটা মিনিটের মধ্যে। দম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পরীর। অবাক চাহনিতে দেখছিল সে। অস্ফুটে বলেছিল, “এইডা কি হইল!”

তার চোখের বিস্মিত ভাষা বোঝেনি কেউ। স্বামীও না! শুভ দৃষ্টির বিনিময় যেদিন হয়েছিল তখনও কি মানুষটা তার চাহনি বুঝতে পেরেছিল? মনে হয় না। যদি বুঝতোই, তাহলে কি আর বিস্মিত চাহনিটাকে অশুভ মনে হত তার?

***

সেবারও এমন হয়েছিল, তার কথা কেউ বোঝেনি। সবাই ভেবেছিল তারই দোষ। কিন্তু সে তো কিছু করেনি। এই কথা কেউ বিশ্বাস করল না। বরং দোষ তারই ভেবে নিল সবাই, শাস্তিটাও দিল। সেদিনও এভাবেই বেঁধে রাখা হয়েছিল তাকে। তারপর বিচারের নামে নষ্ট প্রহসন! নজর খারাপ মেয়ের নজরে নজর মেলাতে পিছপা হয়নি ওরা। কি দুঃসহ, কি ভীতিকর সেই মুহূর্তগুলি। সেকথা মনে হতেই যেন আরও কুঁকড়ে গেল পরী। সেদিনের সেই শুভনজরের সমাজপতিরাই আজও বিচারকের আসনে থাকবে!

সুফিয়া বেগম এসে সেটাই জানিয়ে গেল তাকে। আশে পাশে ভিড় জমেছে বেশ একটা। ছোট ছোট বেশ কিছু জটলা তৈরি করেছে তারা। তাদের মাঝে হাসি মুখ করে পান চিবুতে চিবুতে কথা বলছে সুফিয়া বেগম, “পরী নাম যে ক্যান রাখছিল ডাইনীটার। ওর চউখ দেখলেই ভয় লাগে। “

এই ভয় আর উত্তেজনা পরী আর সহ্য করতে পারছিল না। কি ঘটবে? কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে?

কম্পিত গলায় সে বলল, “বিচার হইবো কখন? চোখ কি সত্যই তুলবো? “

মুনিয়া মুখ ঝামটে বলল, “বদ নজরীর দেমাগ্ দ্যাখো! বিচারেরে ডরায় না, ডাইনী।”

সবাই সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল।

****

চারপাশে হায়েনারা হাসছে যেন বিষাক্ত নখর নিয়ে । মানুষকে কষ্ট দিয়ে কি অদ্ভুত জান্তব আনন্দ পায় মানুষ!

“এরচেয়ে চোখ যাওয়াও ভালো আছিল। ক্যান এই মিথ্যা নাটক? অশুভ চাউনি আমার? তাইলে নজর কইরা সেইদিন ক্যান বাঁচতে পারিনাই? কু নজরই যদি হইব, তাইলে নয়নে নয়ন রাইখা কান্নার ভাষা কাউরে বুঝাইতে পারি না ক্যান? কৈ আমার নজরের ক্ষমতা! ঐ তো বইসে আছে সেই পিশাচগুলা, ওরা আমার নজরের তাপে পুইড়ে মরে না ক্যান? ঐ তো দাঁড়ায় আছে সেই মানুষটা। যার সাথে আমার একদিন শুভ-দৃষ্টি হইছিল। সেইদিন আমার নজর তার কোন ক্ষতি করতে পারেনাই ক্যান?”

আপনমনে পরী ভাবছিল এসবকথা।

বিচার শুরু হবে একটু পরেই। কিন্তু পরিবেশ তেমন গুরুগম্ভীর না। আশপাশের গ্রাম থেকে সবাই হাজির হয়েছে। এই গণ্ডগ্রামে বিনে পয়সায় এমন বিনোদনের সুযোগ পেয়ে খুশি সবাই। অনেকটা সময় মজা করা যাবে। মেলা বসবে লোকের। পানের বাটা এহাত ওহাত হবে, সাথে গল্প ঘুরবে মুখে। তাই সবার মাঝে উৎসব উৎসব  ভাব। বিচারকের আসনে যারা বসে, তাদের আনন্দটা আরও একটু বেশী। সবাই জানে, এই বিচারের উদ্দেশ্য।

না, চোখ উপড়ে ফেলা হবে না; সবাই সেটা জানে। জানে পরীও। কারণ সেরকম কিছু হলে তাদের গুজবে,বিনোদনে, কর্মে-ক্লেশে, কামে কে রসদ যোগাবে?

হঠাৎ কি যেন হয়ে গেল তার, চোখের সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। বেদনার মেঘলা নীল অন্তরে তার কালো মেঘ জমা হতে লাগল। ভয় বস্তুটা বেশ ভিন্ন ধাঁচের!  বেশী ভয় পেলে যেমন অনুভূতি হয় মানুষের, ঠিক তার বিপরীত অনুভূতি হয় হঠাৎ সেই ভয় কেটে গেলে। পরীরও তাই হয়েছে। ঠোঁটের কোণে বরং একটু বিদ্রুপের হাসি যেন ঝুলে পড়ল। নিজের প্রতি, মিয়া বাড়ির প্রতি নাকি গোটা সমাজের প্রতি? তার এই ভ্রুকুটির, বিদ্রুপের তল খুঁজে পাওয়া কঠিন। প্রশান্তির নজরে চারপাশে দৃষ্টি বুলালো সে। সবাইকে তুচ্ছ মনে হতে লাগলো তার। কি ভণ্ড, কি মিথ্যা চারদিকে! নিজেকেই যেন একতরফা নিচু গলায় প্রবোধ দিল , “ডর কিয়ের! ডর নাই! “

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


One Response to মেঘলা নীল অন্তর

You must be logged in to post a comment Login