সেজান মাহমুদ

হুমায়ূন আহমেদ এর ‘দেয়াল’ কে উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এই মুহূর্তে বোধকরি সবচেয়ে বড় মানসিক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কাজ হলো হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা সম্পর্কে খুব বেশি নেতিবাচক কিম্বা  খুব বেশি আক্রমণাত্নক সমালোচনা করা। একাধারে তাঁর অসুস্থতা, অন্যদিকে তাঁর প্রতি লেখক হিসাবে আস্থা-দাবি, আশা-আশাহতের দ্বন্দ্ব। তারওপরে আজকাল সময়ের এতো সংকুলান যে যা আমাকে বুদ্ধিবৃত্তি বা হৃদয়বৃত্তিতে সন্তুষ্ট বা তৃপ্ত করে না তার প্রতি কোন মনোযোগ দিতে চাই না। হুমায়ূন আহমদ  সম্প্রতি ‘দেয়াল’ নামের একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লিখেছেন। পৃথিবীর যাবতীয় তত্ত্ব থেকে বিশ্লেষণ করে ‘দেয়াল’ কে উপন্যাস হিসাবে সমালোচনা করা যায়, করতে পারি। কিন্তু ততোটা মনোযোগ দেবার আগেই এই উপন্যাস সম্পর্কে যতটুকু জানা গেছে, শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম এর আলোচনা, প্রকাশিত দুই টি পর্ব আর বিভিন্ন মন্তব্য থেকে, তাই-ই যথেষ্ট এই উপন্যাসের ইতিহাস চেতনা, সত্যতার প্রতি নিষ্ঠা, এমনকি লেখকের দৃষ্টভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আর এই প্রশ্ন তুলতে গিয়ে একটু আক্রমণাত্নক না হয়েও উপায় নেই, তা রবং বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্যের প্রতি মমত্ববোধের জন্যেই জরুরী। এটা বলা আমার নৈতিক দায়িত্ব বলেই মনে করি।

 

প্রথমতঃ ‘দেয়াল’ নিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা বা সরকারী আইনী আরোপ আমি তার বিপক্ষে। বহুবার এই মত প্রকাশ করেছি যে আমি লেখকের নিরঙ্কুশ স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। তবে যদি সরকার লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কোন তথ্য পালটে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে থাকেন তাহলে তা ভিন্ন কথা। এক্ষেত্রে আবারো বলবো আদালতের রায় দিয়ে যেন লেখকের লেখা প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করা না হয়।

 

দ্বিতীয়তঃ ইতিহাস ভিত্তিক শিল্প রচনায় লেখকের স্বাধীনতা কতটুকু, বা লেখকের নৈতিক কোন দায় আছে কি না এ প্রশ্ন করা অসংগত কিছু নয় , আবার এর উত্তরও সাহিত্য-সমালোচনার ইতিহাস থেকে খুঁজে নেয়া যায় সহজেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো ইতিহাস সবসময়ই স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। হয়তো স্পর্শকাতর না হলে তা ইতিহাসই হয় না। তাই এই স্পর্শকাতরতা বিচার করতে  ইতিহাস এর সময়কাল, অতিক্রান্তকাল, সত্যতার প্রতি ন্যায়নিষ্ঠতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে করাই সংগত। হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের ইতিহাসের সাম্প্রতিক ইতিহাস কে বেছে নিয়েছেন। ইতিহাসের কাছে সাইত্রিশ বছর একেবারেই কিছু না। অন্যদিকে যে বিষয়কে বেছে নিয়েছেন তা বোধকরি জাতির জন্য সবচেয়ে কলঙ্কের, সবচেয়ে স্পর্শকাতর একটি বিষয়। এখানে সব সময় মনে রাখা দরকার যে ‘ইতিহাসের সত্য আর শিল্পের সত্য এক নয়’। এই সত্য অর্থ কিন্ত আবার শুধু তথ্য নয়। সত্য হতে পারে ইতিহাসের পূর্ণনির্মাণ, ইতিহাসের অন্তর্নিহিত গূঢ় অর্থকে ডিসাইফার করা, হতে পারে ইতিহাসের ডিকন্সট্রাকশন। যতোদূর জানতে পারছি, কিম্বা এর আগেও হুমায়ূন আহমেদ এর ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ পড়ে মনে হয় না এগুলোর কোনকিছুর চেষ্টা করা হয়েছে কথিত ‘দেয়াল’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসের প্রেস-কপি ওপর ভিত্তি করে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম আলোচানা লিখেছেন। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক, নিজেও গল্পকার, সমালোচক, ব্যক্তিগতভাবে আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ। তিনি অকুণ্ঠচিত্তে হূমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন, শুধু ‘দেয়াল’ কেই নয়, ‘জোৎস্না ও জননীর গল্প’ কেও একই প্রশংসার উচ্ছাসে ভরিয়েছেন। তাঁর ভাষায়  ‘এই উপন্যাসে তিনি (হুমায়ূন আহমেদ) কোনো ইতিহাসবিদের জায়গা নেননি, যদিও একজন ইতিহাসবিদের নির্মোহ দৃষ্টি, বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্যনির্ভরতা তিনি বজায় রেখেছেন।’

এখন আদালতের আদেশ ও অন্যান্য আলোচনা থেকে আমরা জানতে পারছি আসলে হুমায়ূন আহমেদ ইতিহাসবিদের মতো বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা এবং তথ্য-নির্ভরতা বজায় রাখেন নি। অন্তত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এর ব্যত্যয় দেখা গিয়েছ। একটি শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনায়, অন্যটি এই পটভূমির খুব গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি চরিত্র ‘খন্দকার মোস্তাক আহমেদ’ এর ভূমিকায়। যদিও খুনীদের প্রতি একধরণের মমত্ববোধ তৈরির ‘ভিউ পয়েন্ট’ বা দৃষ্টিভঙ্গিও  প্রকাশ পেয়েছে এমনটি জানা যাচ্ছে। সেই সঙ্গে আত্মস্বীকৃত খুনিদের অন্যতম মেজর ফারুক যুদ্ধের শেষ দিকে এসে পক্ষ নিলেও সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার সময়-সুযোগ পাননি। কিন্তু তার মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প তুলে দিয়ে তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা বানানোর প্রচেষ্টা ইত্যাদি নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলা যায়। আমি যেহেতু পুরো উপন্যাটি পড়তে পারি নি তাই উপন্যাসের সার্থকতা ইত্যাদি আলোচনা না করে একটি ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস হিসাবে ‘দেয়াল’ এর ইতিহাসের তথ্যের প্রতি সততা, দায়বদ্ধতা এবং সাহিত্য হিসাবে পরিনতি কী হতে পারে তার দিকে অল্প আলোক প্রক্ষেপণ করবো। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলামের ইংরেজি সাহিত্য, সাহিত্য তত্ত্ব এবং সাহিত্য ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর সাহিত্য নিয়ে জ্ঞানের প্রতি আমার কোন সংশয় নেই। আমি বরং প্রশ্নাকারে তাঁকেও জিগ্যেস করতে পারি কেন তিনি দেয়াল কে বস্তনিষ্ঠ গবেষণালব্ধ  তথ্য-নির্ভর বলেছেন। সাহিত্যের ইতিহাসে ইতিহাস-নির্ভর উপন্যাস, নাটক বা এপিক কাব্য নিয়ে যারা বিস্তর লিখেছেন তাঁদের মধ্যে জার্মান লেখক, জীববিজ্ঞানী গ্যোটে (Goethe),  দার্শনিক হেগেল, রুশ কবি পুশকিন এবং সাহিত্য সমালোচক বেলিনস্কি বোধকরি একই ধরণের তাত্ত্বিক ধারণা পোষণ করতেন, তা হলো,

“..The writer’s historical fidelity consists in the faithful artistic reproduction of the great collisions, the great crises and turning points of history.”

 

এই শিল্পিত বিনির্মাণে লেখক বা শিল্পীর অপরিসীম স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু যখন শিল্পকর্মটি বিচার করা হয় তখন অতিক্রান্ত কাল খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সিরাজুদ্দৌলা নাটকে ইতিহাসের চরিত্রগুলো রূপায়ন করতে গিয়ে মীর জাফর কে এতোটাই বেঈমান হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে যে ‘মীর জাফর’ এখন বেঈমানী বা কৃতঘ্নতার সমার্থক। এখন একজন লেখক দাবি জানিয়েছেন যে ইতিহাসে আসলে মীরজাফর এর চেয়ে মোহন লালের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল বেশি কিন্তু নাটকে দ্বিজেন্দ্র লাল রায় তার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়েছিলেন। আমি ঘটনার সত্যতা জানি না, বা এই আলোচনায় জানারও প্রয়োজন নেই। যদি ঘটনাটা সত্যিও হয় এখন এই দীর্ঘ অতিক্রান্তকালে তা আর ইতিহাসের কোন ক্ষতি করবে না, বর্তমান বাস্তবতারও কোন ক্ষতি করবে না। বরং এই নতুন তথ্য হিসাবে ইতিহাসে অন্তর্ভূক্তি পেলেও নাটক হিসাবে সিরাজুদ্দৌলা সেই আগের অবস্থানেই থাকবে এবং মীরজাফর সেই মীরজাফরই থেকে যাবেন।  কিন্তু  উপন্যাস ‘দেয়াল’ এমন একটি সময়ের যা থেকে অতিক্রান্ত কাল মাত্র সাইত্রিশ বছর। সমসাময়িক ঘটনাভিত্তিক রাজনৈতিক উপন্যাস, বা ইতিহাস-নির্ভর  লেখায় এই দায়বদ্ধতার অন্য মাত্রা আছে। আমার কাছে শেখ রাসেলের মৃত্যু দৃশ্যটির পরিবর্তনটি এমন কোন গুরুতর বিষয় নয়, বরং হয়তো ঘটনাকে আরো নাটকীয় এবং মর্মস্পর্শী করে উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু খন্দকার মোস্তাক আহমেদ এর বঙ্গবন্ধু কে হত্যার ঘটনা থেকে দূরে রাখা বা অনবহিত দেখানোর অনেক বড় রাজনৈতিক মাত্রিকতা আছে। সেই মাত্রিকতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস এবং তদপরবর্তী উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক কর্মকান্ডের আইনী দিকের সঙ্গেও জড়িত। বিশেষ করে দেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিচার করার প্রস্তুতি চলছে, এবং কালক্রমে হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারও পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে, এমতবস্থায় শুধু উপন্যাস রচনার নামে ইতিহাস নিয়ে এই হঠকারীতা প্রশ্ন সাপেক্ষ বৈ কি।অন্যদিকে ইতিহাসের উপাদানকে শিল্পে ব্যবহার এবং রূপান্তরের যে আঙ্গিকগত নিরিক্ষা সারা পৃথিবী জুড়ে দেখা যায়, সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে ঋদ্ধ, সংহত, গবেষকের নিষ্ঠা নিয়ে লেখার প্রবনতাকেও লক্ষ্য করা যায় না।

এই প্রসঙ্গে আমেরিকার পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, আমার বন্ধু বলেও যাকে দাবি করতে পারি সেই রিক ব্র্যাগ এর কথা স্মরণ করি। আমি ‘রিক ব্র্যাগঃ জীবন ছোঁয়া এক গল্পের রূপকার’ শিরোনামে লেখা লিখেছিলাম তাঁকে নিয়ে।“রিক ব্র্যাগ (Rick Bragg)। রিক শুধু একজন সাংবাদিকই নন, একজন তুখোর গল্পকারও। কিন্তু তিনি গল্প লেখেন সত্যি ঘটনার ভিত্তিতে, সরেজমিনে তদন্তের পর। নিউ ইর্য়ক টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনের জন্য তিনি ইতোমধ্যেই পেয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার (Pulitzer Prize), আমেরিকার সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকমন্ডলী প্রদত্ত বিশেষ পুরস্কার, আমেরিকান সোসাইটি অব নিউজ পেপারস এডিটর’স ডিসন্টিংগুইশড রাইটিং এওয়ার্ড পেয়েছেন দু’দুবার। এছাড়াও চল্লিশটি ছোট-বড় সাংবাদিকতার পুরস্কার তার ঝুলিতে। সুতরাং রিক যে একজন স্বনামখ্যাত ব্যক্তি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সম্প্রতি রিক ব্রাগ আলোচিত হয়েছেন আবার, যখন তিনি ইরাক যুদ্ধে আমেরিকান মহিলা যুদ্ধবন্দী বা প্রিজনার অব ওয়ার (Prisoner of War) জেসিকা লিঞ্চ (Jessica Lynch)-এর জীবনীভিত্তিক একটি বই লেখার জন্য মোটা সন্মানীর (3 million dollar) বিনিময়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।“ যারা জানেন বা জানেন না তাদের মনে করিয়ে দেবার জন্য বলি, জেসিকা লিঞ্চ ছিলেন আমেরিকার একজন সাধারণ সৈন্য। ইরাকের যুদ্ধের সময় জেসিকার সঙ্গীদল মরুভূমির মধ্যে ইরাকী সৈন্যদের দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং তাঁর সঙ্গের চারজন সৈন্য মৃত্যুবরণ করে। জেসিকা কে যুদ্ধবন্দী হিসাবে ধরে নিয়ে যায় সাদ্দাম বাহিনি। সেখানকার হাসপাতাল থেকে পরে তাঁকে আমেরিকান বাহিনি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। দেশে ফেরার পরে বুশ সরকার জেসিকার বীরত্ব, আত্নত্যাগ ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক মিডিয়া প্রচার করতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে রিক ব্র্যাগ জেসিকার জীবন ভিত্তিক গ্রন্থ রচনার জন্য চুক্তিভূক্ত হন। এখানে লক্ষ্যনীয় যে রিক ব্র্যাগ সব সময় সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা লিখেছেন। তাঁর নিষ্ঠার জন্য, অসাধারণ গল্প বলার জন্য এবং বিশ্বাসযগ্যতার জন্য তিনি ছিলেন একেবারে প্রশ্নাতীতভাবে সম্মানীয়।

 

রিক ব্র্যাগ লিখেছেন সাউথ ক্যারোলিনার সুসান স্মিথের কথা। মাত্র তেইশ বছর বয়েসের এই মা তার দুই ছেলে, তিন বছরের মাইকেল এবং চোদ্দ মাসের আলেকজান্ডার স্মিথ কে গাড়িতে রেখে নদীতে ডুবিয়ে দেন গাড়িটি। তারপর পুলিশকে খবর দেন এই বলে যে এক কালো ষন্ডামার্কা লোক তার গাড়িটি হাইজ্যাক করেছে তার দুই ছেলেসহ। পুলিশি অনুসন্দ্ধানে যখন জানা গেল আসলে এই মা-ই তার দুই ছেলের খুনী তখন সাড়া আমেরিকায় হইচই পরে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই সকলের চোখে এই সুসান স্মিথ একজন খুনী, সামাজবিরোধী ব্যক্তি। রিক তখন নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ ধারাবাহিক লিখলেন এই সুসান স্মিথের ওপর। তার লেখায় বের হয়ে এলো তেই বছরের এই মায়ের করুন কাহিনী। সেই ছোটবেলা থেকে সৎ বাবার যৌন অত্যাচার, স্বামীর নির্যাতন আর অভাবের পেষণে কি করে এই তরুণী হয়ে ওঠে এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগী। রিকের লেখায় বের হয়ে আসে সভ্য সমাজের অন্তরালে জেগে ওঠা দুষ্ট ক্ষতের মতো গ্লানিকর ইতিহাস। আইনের বিচারে দোষী এই তরুনী, সমাজের চোখে নৃশংস এই মা হয়ে ওঠেন এক ট্রাজিক গল্পের নায়িকা।

 

আমি রিক ব্র্যাগ কে জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে লেখা বই প্রসঙ্গে জিগ্যেস করেছিলাম এভাবে,

 

‘তোমার বাবা ছিলেন কর্মবিমূখ মদ্যপ, মাতাল, আমার বাবাও ছিলেন কর্মবিমূখ, ফুটবল-পাগল বা ফুটবলের মাতাল। তুমি এদেশের স্বনামখ্যাত লেখক, আমিও আমার ভাষার ক্ষুদ্র লেখক। এবার বলো একজন লেখক যখন জনপ্রিয় হন, তখন সবচেয়ে বড় কম্প্রোমাইজ বা আপোষ তাকে কিসের সাথে করতে হতে পারে?’

 

রিক কিছুক্ষণ একেবারে চুপ থাকার পর বললেন,তুমি যদি আমাকে সোজা প্রশ্নটি করতে তাহলে আমিও সহজে উত্তর দিতে পারতাম। আমি জানি তোমার ভূমিকাটি অহেতুক নয়। আমি জেসিকা লিঞ্চ-এর ওপর বই লিখতে সম্মত হয়েছি, জেসিকা আমাদেরই একজন। যদি এই লেখাটিতে আমি আমাদের মানুষের গল্প বলতে না পারি তাহলে এটাই হবে আমার ব্যর্থতা, এটাই হবে আমার কম্প্রোমাইজ বা আপোষ। আমি খুশি হলাম এই ভেবে যে রিক আমার ঈঙ্গিতটা ধরতে পেরেছেন এবং সৎ ভাবে উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন। রিক এতোদিন লিখে এসেছেন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কথা, যে কারনে তার আজ এতো খ্যাতি। আমেরিকার কোন যুদ্ধ-বন্দীকে নিয়ে লিখতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই জেসিকা লিঞ্চের ঘটনার সঙ্গে রাজনীতি এবং অর্থনীতি দুটোই জড়িত। তাই রিকের এই অকপট স্বীকারোক্তিতে তার প্রতি আমার মুগ্ধতা আরও বেড়ে গিয়েছিল।

 

এবার লক্ষ করুন প্রকৃতপক্ষে কি ঘটলো এই জেসিকা লিঞ্চ কে নিয়ে। বইটি বের হবার মাত্র কিছুদিন আগে জেসিকা লিঞ্চ টিভি সাক্ষাতকারে জানালেন তাঁকে নিয়ে যে বীরত্বের কাহিনি প্রচার করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। তিনি আসলে বীরের মতো যুদ্ধ তো করেনই নি, রবং যখন তাঁর দল আক্রান্ত হয়েছিল তিনি ভয়ে ট্রাকের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন এবং পাল্টা গুলি করতে ভুলে গিয়েছিলেন। এভাবেই তাঁর চার সঙ্গীর মৃত্যু হয়। তিনি কোনভাবে বীরের খেতাব বা মিথ্যা প্রাপ্তির কথা জীবনের এই সন্ধিক্ষণে এসে গ্রহণ করতে পারবেন না। এখন লেখক হিসাবে রিক ব্র্যাগ এর কি দায়িত্ব? তিনি তো আর ইতিহাসের বই লিখছিলেন না, ইতিহাস নির্ভর লেখা লিখছিলেন। তিনি কি এই মিথ্যাচার গ্রহণ করতে পারতেন না? কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং এই জেসিকা লিঞ্চের সেই দারিদ্রপীড়িত ছোট বেলা, সত্যতার প্রতি অনুরাগ, কষ্টকর জীবন-যাপন তুলে আনলেন তাঁর লেখায়, ‘আই এয়্যাম এ সোলজার টু’ গ্রন্থে। তাঁর পরও শুধু এইরকম মিথ্যাচার এর গল্প লেখার কারণে পাঠকের কাছে বিরাট আকারের খেসারত দিতে হলো রিক ব্র্যাগ কে, তিনি প্রায় প্রত্যাখ্যাত হলেন পাঠকের কাছে, সমালোচকের কাছে।

 

অন্যদিকে একটি ইতিহাস নির্ভর উপন্যাস লেখার জন্য যে গবেষণা, তথ্যের বিশ্লেষণ, নানা রকমের প্রেক্ষিতকে পর্যলোচনা করে সত্যের সার অংশটুকু তুলে আনার জন্য যে পরিশ্রম এবং ধী-শক্তি তার কতটুকু ব্যয় হয়েছে এই উপন্যাসে এরকম প্রশ্ন করা যেতেই পারে। যেমন, বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে সে সময়ের বেশিরভাগ লেখা্তেই কোন কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। হুমায়ূন আহমেদ অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের লেখার সূত্র ধরে যে সব তথ্য দিয়েছেন তা তিনি যাচাই করেন নি যেমন আমরা জানি, তেমনি এও জানি যে অ্যান্থনি মাসকারেনহাস কীভাবে সামরিক জান্তার যোগসাজশে অনেক বানোয়াট লেখা লিখেছেন। কারো কারো লেখায় এমন কি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেও এরকম ধারণা উঠে এসেছে যে একদল রাগী, তরুন সামরিক অফিসার শেখ মুজিব কে হত্যা করছে। এই ধরণের সরলীকরণ শেখ মুজিব হত্যাকান্ডের পেছনে আন্তর্জাতিক শক্তিধরদের আড়াল করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। না হলে এই খুনীরা কী করে সেই সময়ের আরেক ডিক্টেটর গাদ্দাফির কাছে আশ্রয় পেয়েছিল? এদের বিচার করতে বরাবরই  (এতোদিন) পরাশক্তির বাধাই বা এসেছে কেন? গাদ্দাফি কাদের সৃষ্ট একনায়ক, এধরণের প্রশ্নের মধ্যে দিয়েও অনেক সত্য বেরিয়ে আসে। সাহিত্যিকের কাজ প্রকৃতপক্ষে একজন ইতিহাসবিদের চেয়েও কঠিন! তাই এই উপন্যাস পড়ে পাঠক বরং জানবেন খন্দকার মোস্তাক শেখ মুজিব হত্যার কিছু জানতেন না, কর্ণেল ফারুক ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা, দরদী মনের পীর বংশীয় মানুষ। সুতরাং তাঁদের কৃত-কর্ম নিয়ে একধরনের নরোম মনোভাব তৈরি হতেই পারে।

 

হুমায়ূন আহমেদ ভাগ্যবান যে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষা-বঞ্চিত, যারা শিক্ষিত তাদের মধ্যেও আবার বড় অংশ কুশিক্ষিত, অথবা রাজনৈতিক মতাদর্শে অন্ধ। সাহিত্য সমালোকদের মধ্যেও নিরপেক্ষ, নৈর্ব্যক্তিক বিশ্লেষণ খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার। তা না হলে এই ইতিহাস ভিত্তিক রচনায় যদি সত্যি প্রমাণিত হয় যে মোস্তাক আহমেদ আসলে বঙ্গবন্ধু হত্যার সব কিছু জানতেন (আমার জানা যতো তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ আছে তাতে মনে হয় মোস্তাক আহমেদ শুধু জানতেনই না, হয়তো জড়িতও ছিলেন)  তাহলে এই বিকৃতি তা যতোই উপন্যাস সৃষ্টির নামে হোক না কেন, তার দায়ভার হুমায়ূন আহমেদ কেই নিতে হবে। শিল্পের সত্য আর ইতিহাসের সত্য এক না হলেও শিল্পের প্রতি যে নিখাদ নিষ্ঠতা দেখাতে হয় তার অভাবের জন্য তাঁকেও হয়তো কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে একদিন। হয়তো বিকৃতির অভিযোগে এই বই আস্তাকুঁড়ে ছূড়তেও দ্বিধা করবে না কেউ। আবার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যারা এই ভিউপয়েন্ট থেকে লাভবান হবেন তাঁরা মাথায় তুলে নাচবেন ঠিকই। এখন প্রশ্ন হলো এই দ্বিধা-বিভক্ত জাতিগত মানসে হুমায়ূন আহমেদ আরেকটি বিভক্তির বিষ ইঞ্জেকট করে যাবেন নাকি সবশেষে এদেশের ইতিহাসের এক ট্রাজিক নায়কের মর্মান্তিক পরিনতি সকল কে ন্যুব্জ, অশ্রুসিক্ত করবে? পূর্ববর্তী কর্মের মধ্য দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর যে মানসের পরিচয় পাই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে তাঁর কাজে সেটা আশা তো করা যাচ্ছেই না, বরং ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক একধরণের সূক্ষ্ণভাবে মুক্তযুদ্ধবিরোধীদের প্রতি নরোম জায়গা তৈরি করে দিচ্ছেন। এই সংশয়, সেই পরিনতির দিকে তাকিয়ে, লেখকের স্বাধীনতার দিকে তাকিয়ে মনে হয় ‘দেয়াল’ কে  উপেক্ষা করাই শ্রেয়তর!

পুনশ্চঃ হুমায়ূন আহমেদ বলেছেন,“আদালতের নির্দেশ মেনে আমি আমার বইয়ে প্রযোজনীয় সংশোধনী আনবো। সে লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি।”

যে দুটি বই থেকে তিনি তথ্য নিয়েছেন  রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক হালিমদাদ খান  এর বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭২- ১৯৭৫

 এন্থনী মাসকারেনহাসের ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’ যা মূলত ভুলে ভরা।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login