নীল নক্ষত্র

নির্বাক বসন্ত [মোট ২৫ পর্ব], পর্ব-৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

নিশাত যথারীতি রাডার, জাহাজের হেড এর পজিশন, কোর্স সহ সব কিছু রুটিন চেক আপ করে ইলেকট্রিক জগে কফির পানি গরম দিল। কালো কফি। কাল কফির পোড়া পোড়া গন্ধটা নিশাতের দারুণ ভালো লাগে। সাথে সামান্য চিনি। মিষ্টি বেশি খায় না, ভালো লাগে না। রাতে চলন্ত জাহাজে ব্রিজের এই ডিউটিতে কালো কফি এক দারুণ জিনিস। কে যে এই কফি আবিষ্কার করেছিলো তাকে পেলে অন্তত একটু ধন্যবাদ জানান উচিত! কফি বানিয়ে এক কাপ তারেকের হাতে দিয়ে নিজে একটা নিয়ে আবার তার প্রিয় সেই স্টার বোর্ড সাইডের সাইড লাইটের স্ক্রিনের উপর বসল। এতক্ষণে ব্যস্ততার জন্য লক্ষ করেনি এখন চোখ পরল সামনের সাগরের দিগন্ত রেখা থেকে জেগে উঠছে বিরাট চাঁদ। চাঁদ থেকে চকচকে একটা রূপালী মেঠো পথের মত এসে পৌঁছেছে ওদের জাহাজের সামনে।
তারেক চাঁদটা দেখেছ?
তাই দেখছি।
কি সুন্দর তাই না?
হ্যাঁ।
ইস আমি যদি এখন এই পথ দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাম!
মনে মনে এই পথ বেয়ে চলে গেল অনেক দূরে। হাতের কফির কাপে এখনো একটা চুমুকও দেয়া হয় নি। কফি ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, কাপটা হাতেই ধরা রয়েছে। রাতের এই তারা ভরা খোলা আকাশের নিচে সাগর বুকে চাঁদ থেকে বয়ে আসা এমন পথে কার না একটু হেঁটে বেড়াতে ইচ্ছা করে! নিশাতের কি দোষ? সে তো এমন দায়িত্ব জ্ঞান হীন না। সে যতই ভাবুক না কেন কাজের দিকে তার পুরো খেয়াল। সাগর যতই উত্তাল মাতাল হোক না কেন তার ডিউটির সময় জাহাজ এক আধ মাইলের বেশি ড্রিফট হবে না। লোড আনলোডের সময় তো পাইপ লাইন, পাম্প, প্রত্যেকটা ভাল্ব, জয়েন্ট লিক করছে কি না, টেম্পারেচার ঠিক আছে কি না, পাম্পিং প্রেসার ঠিক আছে কি না, কোন গ্রেডের তেল কোন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে, এক ট্যাঙ্কের তেল লিক করে ভিন্ন ট্যাঙ্কে যাচ্ছে কি না সব তার নখ দর্পণে।
এক হাতে কফির কাপ আরেক হাতে টর্চ থাকবেই, তার বয়লার স্যুটের পকেটে আস্ত এক ওয়ার্কশপ। বার বার করে তার চোখ সব কিছুর উপর দিয়ে ঘুরছে। সে নিজে ঘুরছে ডেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। কখনো কোন গাফিলতি বা অবহেলা বা অমনোযোগ নেই। সম্পূর্ণ দায়িত্ব সচেতন। তবে খোলা সাগরে ব্রিজে ডিউটির সময় কিংবা অবসর সময় কিংবা বহির্নোঙরে নোঙ্গর করে থাকার সময় যখন ডিউটি করে তখন তার বিস্মিত চোখ অবাক হয়ে বারবার নতুন সব দৃশ্য দেখে নেয় আর ভাবে বিধাতার কি অপূর্ব সৃষ্টি যা নিজ চোখে না দেখলে বোঝা কত কঠিন!
এখন জাহাজ চলছে। এখন কোন অবস্থায় সাগর বুকে চাঁদের বিছান পথে কোন ভাবেই বেড়ানো চলবে না। আবার জাহাজে ফিরে এলো। কাপে চুমুক দিয়ে দেখে ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেছে। উঠে এসে আবার পানি গরম দিল, তারেককে জিজ্ঞেস করলো আর এক কাপ চলবে কিনা।
নিশাত ভাই আমি এখন আর না।
আচ্ছা বলে সে নিজে এক কাপ নিয়ে এবার ব্রিজের ভিতরে বসল। বাইরে ঠাণ্ডা লাগছে। বসে তারেকের সাথে নানা বিষয় নিয়ে আলাপ। কখনো নিজ দেশের আবহাওয়া, রাজনীতি, দেশি খাবার, প্রেম ইত্যাদি। হঠাৎ করেই একেক প্রসঙ্গ আসে আবার তা হঠাৎ করেই মিলিয়ে যায়।
দেখলাম কাল তোমার চিঠি এসেছে তা বাড়ির কি খবর?
না নিশাত ভাই তেমন কোন বিশেষ খবর নেই, এই কেমন আছ, আমরা ভালো আছি এই সব যা গতানুগতিক তাই।
হ্যাঁ তাইতো হবে, তুমি আর কি চাও?
কেন এর বাইরে আর কিছু থাকতে পারে না তাই আর কি। আচ্ছা নিশাত ভাই, ফরিদাকে (একটা জাহাজের নাম) একটু ডেকে দেখেন তো পান কিনা, শুনলাম ওরা নাকি মাস্কাটে আছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, আপনি যখন বাইরে ছিলেন তখন আমি শুনেছি ওরা গ্রে বাহরাইনের সাথে কথা বলছিল।
আচ্ছা দাঁড়াও এখনি ডাকছি।
বলে উঠে এসে রেডিওর রিসিভার হাতে নিয়ে ডাকতে শুরু করলো
‘ফরিদা ফরিদা দিস ইস প্যাসিফিক ম্যারিনার কলিং’
সাগর বুকে ইথার এর মাধ্যমে হাবিবের কণ্ঠে ভেসে এলো ফরিদার জবাব
‘ইয়েস প্যাসিফিক দিস ইস ফরিদা প্লিজ কাম ডাউন টু চ্যানেল ১৯’
চ্যানেল পরিবর্তন করে ১৯ এ এসে আবার ডাকল ফরিদাকে। ওপাশ থেকে এলো হাবিবের কণ্ঠ,
কিরে নিশাত তোদের মাস্কাট ইটিএ আমি জানি তা তোরা কি শিডিউলে আছিস নাকি চেঞ্জ হবে?
না, উই আর ইন শিডিউল!
আচ্ছা তোরা এখান থেকে শুধু ফ্রেশ ওয়াটার নিবি নাকি বাঙ্কারও (জ্বালানি তেল) নিবি?
দুইটাই লাগবে
আজ সী খুবই শান্ত কাজেই আমরা একেবারে কাটায় কাটায় পৌছাতে পারবো, এইতো আর মাত্র ৩৫ মাইল দূরে আছে, মাস্কাটের লাইট দেখা যাচ্ছে। ওদিকে আবার অরুণ’দা বলে গেছে তাকে যেন সকালে ব্রিজে আসতে না হয় তার আগেই যেন আমি নোঙ্গর করে রাখি। তাছাড়া আমরা যে ইটিএ দেই তা সাধারণত মেইনটেইন করি, আমরা তোদের মত নাকি? মনে নেই ওই যে রাস্তানুরাহ থেকে ইটালি ফেরার পথে কি কাণ্ড করেছিলি?
না রে সে তো হঠাৎ একটা দুর্যোগের কারণেই হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা শোন, মনির কি ফ্লাই করতে পেরেছে খবর পেয়েছিস?
হ্যাঁ ও এতো দিনে বাংলাদেশে পুরোন হয়ে গেছে।
যাক ভালো হয়েছে, আমার সাথে মানামাতে দেখা হয়েছিল।
হ্যাঁ বলেছে, ওরা যেদিন দুবাই আসছিল সেদিন আমরা কুয়েত থেকে এখানে আসছিলাম তখন আমার সাথে কথা হয়েছে।
তাহলে তোরা এখানে কত দিন যাবত আছিস?
এইতো আজ কয়েক দিন হবে, তোদের ও এখানে দেরি হবে আমাদের পরে তোরা বের হবি কাজেই তোরা সবাই আজ বিকেলে আসবি আমাদের জাহাজে।
সেতো আসব কিন্তু এত দেরি কেন?
এদের ফ্রেশ ওয়াটারে কি যেন সমস্যা তাই
এখানে আয় আলাপ হবে তখন সব জানবি, আসবিতো?
নিশাত আমতা আমতা করছে দেখে হাবিব বলে দিল ভয় করিস না লাইফ জ্যাকেট পরে আসবি আর এক্সট্রা রেফট নিয়ে আসবি।
আচ্ছা ঠিক আছে আসবো। তোরা কোথায় নোঙ্গর করেছিস?
আমরা একটু সাউথে আছি।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে, আমি তোদের কাছাকাছি এঙ্কর ড্রপ করবো।
হ্যাঁ তাই করিস।
আচ্ছা শোন, তারেক মনে হয় শফিক ভাই এর সাথে কথা বলবে, উনি কি ডিউটিতে?
হ্যাঁ আছে দে ওকে।
নিশাত গিয়ে স্টিয়ারিং ধরে তারেককে কথা বলার জন্য পাঠিয়ে দিল। তারেকের কথা শেষ হলে বলল নিশাত ভাই আপনি আরও একটু থাকেন আমার ক্ষুধা লেগেছে কিছু খেয়ে আসছি।
শোন আমারও ক্ষুধা পাচ্ছে মনে হয় আমার জন্যও কিছু নিয়ে এসো।
কি খাবেন?
তুমি যা খাও তাই নিয়ে এসো।
কিছুক্ষণ পর তারেক গরম দুইটা স্যান্ডউইচ আর এক গ্লাস অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে চার্ট টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল
দেন এবার আমার হাতে দেন আপনি খেয়ে নেন।
মাস্কাট আউটার এঙ্কারেজে পৌঁছে ফরিদাকে খুঁজে পেতে কোন অসুবিধা হলো না। ফরিদার এক মাইলের মধ্যে ওদের দেয়া ইটিএ অনুযায়ী ঠিক ভোর সাড়ে পাঁচটায় নোঙ্গর করে রেডিওতে গ্রে বাহরাইনকে জানিয়ে দিল।
ব্রিজের টুকিটাকি কিছু গোছগাছ করতে করতে সকাল ছয়টা বেজে গেল। ব্যাস, এখনকার মত ওর ডিউটি শেষ। এবার নিজের রুমে গিয়ে পোশাক বদলে আবার গরম গোসল দিয়ে একটু আগে তারেকের বানানো বিরাট দুই স্যান্ডউইচ খেয়ে আর ক্ষুধা নেই বলে সরাসরি বিছানায়। এয়ারকন্ডিশন রুমে কম্বল গায়ে শোবার প্রায় সাথে সাথেই ঘুম।
ঘুম ভাঙল দুপুর একটায়। উঠে সবাইকে ফরিদার নিমন্ত্রণের কথা জানালো।
অরুণ’দা বলল সবাই কি আর যেতে পারবো জাহাজ নোঙ্গরে রয়েছে জাহাজে থাকবে কে?
শুনে তারেক বলল আপনারা সবাই যান আমি থাকবো। শফিক ভাইর সাথে আমার একটু দরকার ছিল তা রাতে রেডিওতে কথা বলে সেরে নিয়েছি।
আচ্ছা বেশ তাহলে তুমি থাক।
নিশাত আবার এই সব সামাজিকতা নিয়ে বেশ সতর্ক। দেশে সব আত্মীয় স্বজন বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখার কাজটা সে নিরলস ভাবে নিয়মিত করে যেত। এটা ওর কাছে একটা দায়িত্বের মত মনে হতো। কারো কোন নিমন্ত্রণে সময় মতো হাজির হতো, বলতো অবশ্যই যাবো। যাবো না কেন, সমাজে বাস করি না? আমরা সামাজিক জীব না? এক জন আরেক জনের কাছে না গেলে কি হয়? অবশ্যই যেতে হবে!

বিকেলে জাহাজের ক্যাপ্টেনের অনুমতি নিয়ে নিলো। দুপুরে খাবারের পর শাহিনকে নিয়ে ওদের জাহাজে ইঞ্জিন চালিত রাবারের ডিঙ্গি পাম্প করে, ইঞ্জিনে তেল ভরে টেস্ট করে লাইফ জ্যাকেট, রেফট নিয়ে রেডি করে রেখেছিল। ক্রেন দিয়ে ডিঙ্গি নামিয়ে তাতে করে ফরিদায় এসে পৌঁছল। তারেক রেডিওতে বলে দিয়েছিল। কাছে এসে দেখে ওখানকার সবাই এসে জাহাজে ওঠার জন্য সিঁড়ি নামিয়ে জাহাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ইমরান, শফিক, হাবিব সবাই।
হাবিব এবার বল কি আয়োজন করেছিস।
আরে মাত্র এলি এখনি কি একটু ধৈর্য ধর দেখবি কি করেছি।
না তুই আগে বল, তুই তো জানিস আমার সমস্যা কোথায়, কত রিস্ক নিয়ে ডিঙ্গিতে করে এসেছি। শুধু তোদের ডিঙ্গি নেই বলে এসেছি না হলে কি আমাকে আনতে পারতি?
আরে বেকুব দেখ এই সাগরের দিকে তাকিয়ে দেখ কোন কিনারা দেখা যায়?
নতুন করে আবার কি দেখতে বলছিস, আমি সাগরে বাস করি না কি আকাশে বাস করি?
আচ্ছা এখন বল এই কুল কিনারাহীন সাগরে সাতার জানলেই কি আর না জানলেই কি! তুই যদি সাতার জানতি তাহলে সাতরে কোথায় যেতে পারতি কোথায় গিয়ে উঠতি?
জ্ঞান দিয়ে ভুলাতে পারবি না, মাস্টারি করিস না বল কি করেছিস।
আরে পাগল এখনি কি এখন একটু ড্রিঙ্কস খা খাবার সময় হোক তখনই দেখবি।
না তুই বল।
তাহলে চল গ্যালিতে (জাহাজের কিচেন) চল, নিজেই দেখ।
সত্যিই গ্যালিতে গিয়ে দেখেত নিশাতের মাথা খারাপ হবার অবস্থা। চিংড়ি ভর্তা, শুঁটকির ঝুরি, রূপ চান্দা মাছ ভাজি, তাজা ম্যাকারেল মাছ ভুনা, মাংস ভুনা আর পাতলা ডাল।
রূপ চান্দা কোথায় পেলি?
বলিস না কুয়েত থেকে আসার পথে দেখি জেলেরা ফিশিং ট্র্যাপ ফেলে রেখেছে, জাহাজ কাছে নিয়ে ক্রেন দিয়ে সেই ট্র্যাপ উঠিয়ে দেখি বোঝাই মাছ। সব নিয়ে এসেছি। এই ম্যাকারেলও। অনেক মাছ ছিল। তোরা যাবার সময় কিছু নিয়ে যাবি।
নিশাত এবার একটু শান্ত হলো।
চল এবার সেলুনে চল।
কেক আর কোক খেতে খেতে হৈ চৈ। শাহিন মহসিনের নাচা নাচি, টেবিল ঠুকে তবলা বাজিয়ে গান সবই হলো।
চল এবার খেতে যাই।
হ্যাঁ যাবো তবে তারেক একা রয়েছে ওর জন্য আগে কিছু দিয়ে দে না হলে পরে মনে থাকবে না।
সত্যিই হাবিব কয়েকটা প্যাকেটে করে তারেকের জন্য এই সব অমূল্য খাবার আর ফ্রিজ খুলে দুই বালতি ভরা মাছ ওদের ডিঙ্গিতে নামিয়ে রেখে এলো। এবার সবাই খেতে বসল। ফরিদার বাঙ্গালি কুক চিটাগাংয়ের আব্দুল হাই, চমৎকার সব রান্না করেছে। নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে আবার এক তরফা আড্ডা দিয়ে রাত নয়টায় জাহাজে ফিরে এলো।

ফরিদা থেকে ফিরে এসেই কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়ে পরেছে। রাত বারোটায় ডিউটি। যদিও নোঙ্গর করা অবস্থায় ডিউটি তেমন কিছু না শুধু কয়েকটা বিয়ারিং দেখা এবং রাডারে চোখ রাখা। নোঙ্গর পিছলে জাহাজ সরে যাচ্ছে কি না তাই লক্ষ রাখা। চা, কফি, জুস কোক যা খুশি যত খুশি খাও। ব্রিজে বসে যা খুশী কর কোন বাধা নেই শুধু নিদ্রা দেবীর আরাধনায় মগ্ন না হলেই হলো। সেই রকম শিক্ষাই দিয়েছে তাদের বিভিন্ন ক্যাপ্টেন। বলতেন ইউ আর গোইং টু বি এ কিং অফ এ স্মল কিংডম সো, ইউ স্যুড গ্রো দ্যাট ওয়ে, আই ডিজায়ার দিস। ইওর এটিচুড, ইওর ম্যানার স্যুড বি লাইক দ্যাট, ইউ স্যুড নট বি এন অর্ডিনারি ম্যান ইউ স্যুড বি এ পারফেক্ট জ্যান্টল ম্যান, দিস ইস মাই ড্রিম। ঠিক এই রকম কঠিন নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থেকে নিশাত হয়ে উঠেছে একজন আদর্শ মানুষ।
অথচ সে সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘড়ের ছেলে। জন্ম নানা বাড়ি ঢাকা শহরের অদূরে। বাবা মার প্রথম সন্তান হিসেবে বেশ আদর যত্নেই বেড়ে উঠেছে। ছোট বেলা থেকেই সৌখিন জীবন যাপন তার পছন্দ। তবে বাবার সাধ্য সীমার বাইরে কখনো কিছু দাবী করেনি। পোশাক আসাক যাই ছিল তা চকচকে ইস্ত্রি করা ছাড়া কোন পোশাক তাকে কেও কখনো পড়তে দেখেনি। পায়ের জুতা জোড়াও সবসময় চকচক করতো। সেই ছোট বেলায় যখন সে মাত্র থ্রিতে পড়তো তখন থেকেই নিজের কাপর কয়লার ইস্ত্রিতে পাখা দিয়ে বাতাস করে কয়লা জ্বালিয়ে ইস্ত্রি করে পড়তো। নিজের জিনিষ পত্র ঘড় দরজা নিজেই গুছিয়ে পরিষ্কার করে রাখতো। নিজের স্কুলের কাপর চোপর ধুয়ে শুকিয়ে ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখতো, সাথে বাবা মার কাপরও ইস্ত্রি করে দিত মাঝে মাঝে। তবে জুতা পালিশের ব্যাপারে তার একটা খুঁতখুঁতানি ভাব থেকেই যেত। এই কাজটাতে সে কখনোই তৃপ্তি পেত না।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে জুতা পালিশ ওয়ালাদের দেখত কেমন করে তারা জুতা পালিশ করছে। আবার বাড়ির কাছের লন্ড্রির সামনে দাড়িয়েও দেখত তারা কোন কাপর কি ভাবে ইস্ত্রি করছে। বাসায় এসে সেই ভাবে চেষ্টা করতো। এভাবেই অনেক কিছু শিখে নিয়েছিলো। কুলি মজুর, ঠ্যালা গাড়ি ওয়ালা, কাঠ মিস্ত্রী, আকাশ, বাতাস, নীল প্রশান্ত সাগর, মাটির ধরণী, কারো কাছ থেকে শেখার কিছু বাকী রাখেনি। ওর বিশাল কৌতূহলী মন যার কাছে যা পেত তাই ধরে রাখত। মা যখন সেলাই মেশিন নিয়ে বসতেন তখন তার কাছে বসে দেখত মা কি ভাবে কেঁচি দিয়ে কাপর গুলি কেটে তা আবার সেলাই করে কি সুন্দর জামা পাজামা বানিয়ে ফেলছে। ওর অবাক চোখ শুধু বিস্মিত হত।
সব কাজের লোকদের বেশ সমীহ করে চলতো, কখনো কাউকে ছোট ভাবতে পারতো না। এরা কি সুন্দর করে সব কিছু বানিয়ে ফেলছে এই থেকে তাদের প্রতি ওর একটা শ্রদ্ধা বোধ আসতো ওর মনে। সংসারের কাজ মা একাই করতেন বাসায় কোন কাজের মানুষ ছিল না তাই সবসময় মাকে এটা ওটা কাজে সাহায্য করত। আটা মাখা, ঘড় ঝাড়ু দেয়া, কাপর গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে ছোট ভাই বোনদের কান্না থামানো এমনকি রান্নার কাজেও মাকে সাহায্য করতো। সার্টের বোতাম ছিঁড়ে গেলে কিংবা কোথাও একটু সেলাই খুলে গেলে নিজেই ঠিক করে নিতো মাকে কখনো বলতো না। এই ভাবেই ধীরে ধীরে কখন যেন সংসার নামের বিশাল নাট্য মঞ্চের সকল কুশীলবের অভিনয় তার মুখস্থ হয়ে গেছে তা সেও বুঝতে পারেনি। মা শেখাতেন কি ভাবে বাজার থেকে তাজা সবজী চিনে কিনতে হয়, কি ভাবে তাজা মাছ চেনা যায়, বাসায় নতুন অচেনা কোন অতিথি এলে তার পরিচয় জানতে হয়, কি ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতে হয়, কোথায় কখন কি খেতে হয় কি খেতে হয় না। সব কিছু।
বাবা মাসের প্রথমে বেতন পেয়ে বাসায় এসে খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বাজারে যাবার সময় নিশাতকে সাথে নিয়ে যেতেন। সেদিন সকাল থেকে মাকে দেখত তেলের বোতল, বাজারের ব্যাগ ধুয়ে মুছে শুকিয়ে রাখতে, বাজারের লিস্ট করতে আর তাই দেখে নিশাত বুঝতে পারতো আজ মাসের প্রথম, নিশ্চয়ই বাবা বাজারে যাবেন। বাবার সাথে বাজারে যেয়ে লক্ষ করতো বাবা কোন দোকান থেকে কি কিনছে, কি ভাবে দামাদামি করছে, কোন দোকানে কি জিনিষ পাওয়া যায়। বাজার শেষ করে সাইকেলের চার চাকার ঠ্যালা গাড়িতে মালামাল উঠিয়ে দিয়ে বাসার ঠিকানা দিয়ে দিতেন গাড়ি ওয়ালাকে। সে বাসায় মাল পৌঁছে দিত। আর ওদিকে বাবা তাকে নিয়ে যেতেন মিষ্টির দোকানে। দেখ বাবা তোমার কি পছন্দ। নিশাত ঘুরে ঘুরে চানাচুর, ডাল ভাজা কিংবা বাদাম ভাজা দেখিয়ে দিত আর তাই দেখে বাবা রসিকতা করেই বলতেন তোমাকে নিয়ে এলাম মিষ্টি কিনতে আর তুমি এসব কি দেখাচ্ছ?
হ্যাঁ মা তো মিষ্টি খায় না তাই মায়ের জন্য এগুলি নিবেন।
ও আচ্ছা আচ্ছা বেশ তাহলে বল তোমার জন্য কি নিবে?
একটা কিছু হলেই হবে।
মিষ্টি আর ঝাল কিছু নিয়ে বাবার হাত ধরে বাসায় এসেই মার হাতে ঠোঙ্গাটা দিয়ে দিত। বাবা সরকারি চাকরী করতেন কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ন্যায় পরায়ণ লোক, কোন অসদুপায় অবলম্বন করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যা বেতন পেতেন সচ্ছল ভাবে না হোক মোটা মুটি ভাবেই চলে যেত, বিলাসিতা করা হয়ে উঠত না। এখনো নিশাতের পরিষ্কার মনে আছে যখন সে ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছিল তখন স্কুলের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে বাবার হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ইস্ত্রি কিনে আনার জন্য বলেছিল। বাবা তাই দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি এতো টাকা কোথায় পেলে? যাই হোক সেই দিনই বাবা সন্ধ্যায় দোকানে গিয়ে একটা ইস্ত্রি কিনে এনেছিলেন।
নতুন চকচকে ইস্ত্রি পেয়ে নিশাতের আনন্দ দেখে কে, বারবার উলটে পালটে দেখছে। প্লাগে কানেকশন দিয়ে দেখে নিলো গরম হচ্ছে কি না। গরম হতে দেখে সে যে কি খুশী। সাথে সাথেই নিজের স্কুলের জামা প্যান্ট, বাবার জামা মায়ের শাড়ি সব ইস্ত্রি করে ফেললো।
[চলবে। এতক্ষণ নিশাতের সাথে নিরুর চায়ের নিমন্ত্রণের অপেক্ষায় থাকুন। ধন্যবাদ]

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login