জুলিয়ান সিদ্দিকী

ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৩

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

চূর্ণ-বিচূর্ণ রেডিওর ভগ্নাংশ হাতে নিয়ে সন্তানহারা জননীর মত আকূল হয়ে কাঁদে চান্দভানু। সঙ্গে মুখে ওড়না চেপে কাঁদে জুলেখাও। কিন্তু হোসেন মৃধার যেন কোনো শোকতাপ নেই। যেন কোনো অশনী সংকেতে স্থবির হয়ে পড়েছে সে। তবুও তার মনে কেবল একটি ভাবনাই কাজ করছিলো যে, আগামী কাল সন্ধ্যায় লোকজন যখন দেশের খবর শুনতে বাংলা ঘরের সামনে এসে জড়ো হবে, তখন তাদের তাদের কী জবাব দেবে সে? সে কি মুখ ফুটে বলতে পারবে যে, মতিউর রহমান এসে রেডিওটা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে?

সে হঠাৎ উঠে এগিয়ে যায়। চান্দভানুর পিঠে হাত রাখলে তার কান্না যেন আরো বেগবান হয়। হোসেন মৃধা বলে, হাসনের মা কান্দিস না! কাইল যেমনেই পারি রেডিও একটা যোগাড় কইরা আনমু।

কিন্তু পরদিন খুটভর্তি টাকা নিয়ে পিতাপুত্র দুজনেই নৌকা নিয়ে আশপাশের গ্রামগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। যার কাছে রেডিওর সংবাদ পাচ্ছে তার ঠিকানা মতই গিয়ে উপস্থিত হচ্ছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত যাও একটা পুরোনো রেডিওর সন্ধান পাওয়া গেল কিন্তু সেটার মালিক রাধারাম রায়ের কোনো হদিস পাওয়া গেল না। ঘরবাড়ি যেমন ছিলো তেমনই আছে। কেবল তার বাসিন্দারাই নেই দু’জনের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল তার আশপাশের অনেক হিন্দু পরিবারই রাতের অন্ধকারে ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।

পিতাপুত্র ভগ্নমনোরথ হয়ে ফিরে এলেও গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়ানোর ফলে তাদের বাড়তি একটি লাভ হয়। আর তা হলো তারা জানতে পেরেছে যে, মতিউর রহমান গ্রামে গ্রামে শান্তি কমিটি আর হিজবুল্লা গঠন করতে আরম্ভ করে দিয়েছেন। নৌকা আর সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে মিটিং করে বেড়াচ্ছেন।

আগুন নিভে গেলেও কখনো কখনো ছাইয়ের গাদায় আগুনের কণা আত্মগোপন করে থাকে। সেই গাদায় যদিও আগুনের কোনো কণা অবশিষ্ট না থাকে তবুও সেই ছাইয়ের গাদা আগুনের উত্তাপকে বেশ কিছুটা সময় হলেও ধরে রাখে।

পিতাপুত্র ব্যর্থ হলেও তা যে সাময়িক তা দুজনের কেউই বিস্মৃত হয় না। হাসন আলি বললো, বাবা, আমারে কি একবার টাউনে যাইতে দিবা? একবার চেষ্টা কইরা দেখতাম কোনো রেডিও পাই কিনা!

হোসেন মৃধা লেখাপড়া তেমন না জানলেও নিজস্ব সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে অনুধাবন করতে পারে যে, পাঁচটা গ্রাম ডিঙিয়ে এসে মতিউর রহমানের মত মানুষ যেখানে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্ব বিনাশে তৎপর হয়, সেখানে শহরের দিকে তো মুসলিম লিগের চামচার সংখ্যা আরো বেশি। তারা কি নিশ্চেষ্ট বসে আছে?

লোকভর্তি একটি কোষা নৌকা তাদের অতিক্রম করে যাওয়ার সময় লোকজন জানালো যে, পান্তার বাজারে মিলিটারি এসে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।

এ সংবাদে হোসেন মৃধা খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও হাসন আলি ঘাবড়ায় না। বলে, বাবা, আমাগো চাইরো দিগে পানি। আমাগো তত ডর নাই!

হোসেন মৃধা বললো, চাইরো দিগে পানি তো পান্তার বাজারেও আছিলো। তা ছাড়া মতিউর রহমানের মত মানুষের লগে কোনো বিশ্বাস নাই।

পান্তার বাজারে মিলিটারি আইছে মনে করি আমাগ গ্যারামে আইতেও বেশি দেরি নাই। কথাগুলো বলার সময় এবার হাসন আলিকে সত্যি সত্যিই চিন্তিত দেখায়।

সন্ধ্যার দিকে গহর মাঝি বাংলা ঘরের প্রান্তে তার সেই চিরাচরিত নিয়মে হাঁক দিলেও আজ কেউ কোনো সাড়া দেয় না। হোসেন মৃধা হাসন আলি চান্দভানু আর জুলেখা ঘরে থাকলেও তারা কেউ সারা দিতে উৎসাহ পায় না।

কাদার উপর দিয়ে হাঁটার সময় মানুষ যেমন সাবধানে আর আস্তে ধীরে পা ফেলে দেখে নেয় সামনে মাটিতে পা দেবে যায় কিনা, তেমনি সাবধানতায় যেন নিজে নিজেই কথা বলতে বলতে ভেতর বাড়ির আলতা বেড়ার কাছে এসে মুখ বাড়ায় সে। রসুই ঘরে আলো দেখা গেলেও মানুষ-জনের সাড়া-শব্দ না পেয়ে গহর মাঝি বলে উঠলো, বাইত্যে কেউ নাই নাকি? গেল কই সবতে?

রাতের খাওয়া সেরে ওরা বসেছিলো পাশাপাশি। হোসেন মৃধা তাকিয়ে ছিলো হাসন আলির মুখের দিকে। সে কোনো শব্দ না করে ছেলেকে মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে জানালো বোইরে বেরোতে।

বুঝতে পেরে হাসন আলি বললো, যামু যে, মুখ দেখামু কেমনে?

চান্দভানু নাক টেনে বললো, মানুষগুলা কত দূর থাইক্যা আইবো, না জানাইলে চলবো?

হাসন আলি বাইরে বেরিয়ে এলে গহর মাঝি বলে, কি কাকু, খবর-বার্তা আইজ হোনাইবা না?

ঠিক তখনই নৌকার গায়ে লগি ঘষটানির শব্দ ভেসে আসে। হয়তো আরো কেউ স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনতে সঙ্গীদের নিয়ে চলে এসছে নৌকা নিয়ে।

হাসন আলি মৃদু কণ্ঠে জানায়, রেডিও আর বাজবো না কাকু। নষ্ট হইয়া গেছে!

কও কি?

হাসন আলির কথা শুনে ব্যথা পেয়েই যেন আৎকে ওঠে গহর মাঝি। বলে, সারানের কোনো ব্যবস্থা নাই?

কেমনে? হাসন আলি হতাশ কণ্ঠে বলে উঠলো। নারায়ণ পান্তার বাজারে গিয়া নতুন ঘর নিছিলো। খবর পাইলাম পান্তার বাজারেও পাকিরা আগুন দিছে।

তাইলে তো খুবই খারাপ কথা! কান্নার মত শোনায় গহর মাঝির কথাগুলো।

অন্ধকারে কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না বলে, কেউ কারো মুখের ভাব পরিবর্তন দেখতে পায় না।

হাসন আলিকে চুপ থাকতে দেখে গহর মাঝি ফের বলে, তুই এই খবর পাইলি কই?

গহর মাঝির কথার জবাব দেবার আগেই হঠাৎ কোত্থেকে এসে মজিবর মাস্টার বলে উঠলো, হুনলাম মতিউর রহমান আইয়া নাকি তোমাগ রেডিও ভাইঙ্গা দিয়া গেছে?

আপনে হুনলেন কার কাছে?

বিস্মিত হাসন আলি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা মজিবর মাস্টারের মুখ দেখতে চেষ্টা করে।

মজিবর মাস্টার কণ্ঠস্ব নামিয়ে বললো, আমার এক ছাত্র কইলো মতিউর রহমান নাকি বাইত্যে ফিরা গিয়া তার খাতিরের মানুষগো কাছে কইয়া বেড়াইতাছে যে, দিছি জয়বাংলা ভাইঙ্গা। এহন সবতে মিল্যা হোনো জয়বাংলার খবর!

তাদের এ সমস্ত আলাপ আলোচনার মাঝেই বাকি সব শ্রোতারাও চলে আসে। কেউ একজন হঠাৎ হ্যারিকেন উঁচিয়ে ধরে জানতে চায়, হাসন আলি ক্যাডা?

হাসন আলি হ্যারিকেন উঁচিয়ে ধরা যুবকের অচেনা মুখ দেখে অবাক হলেও তার মুখে নিজের নাম শুনে খানিকটা ভয়ও পায় যেন। বলে, আপনেরে তো আমি ঠিক চিনতে পারতাছি না!

যুবকটি হ্যারিকেন নামিয়ে জানায় আমি বিবির ছইয়া গ্যারাম থাইক্যা আইছি।

তখনই আলিম বক্সের কথা মনে পড়ে হাসন আলির। সেও সেই গ্রামেরই ছেলে। দুজনেই মমিনউদ্দিন মেমোরিয়াল হাই স্কুল থেকে একসঙ্গে লেখাপড়া শেষ করে শহরের একমাত্র সরকারি কলেজে বিকম পড়ছে।

হাসন আলিকে ভাবতে দেখে যুবকটি বললো, আপনের লগে আমার একটা কথা আছে। গোপন।

অসুবিধা নাই। হাসন আলি বললো। এরা দুইজন আমাগ আপন মানুষ। সামনেই কইতে পারেন।

যুবকটি ইতস্তত করে বললো, তাও ইট্টু অসুবিধা আছে।

হাসন আলি তাকে নিয়ে গহর মাঝি আর মজিবর মাস্টার থেকে খানিকটা দূরে সরে বলে, কি কইবেন?

যুবকটি নিচু কণ্ঠে বললো, আলিম বক্স কিছুক্ষণ বাদে আইবো। আপনের লগে কথা আছে।

তারপরই যুবকটি চলে গেলে মজিবর মাস্টার এগিয়ে এসে বলে, এহন দিনকাল ভালা না বেশি। অচেনা মানুষের লগে কোনোখানে যাইও না। যে কোনো সময় বিপদ হইতে পারে।

কিছুক্ষণ পরই আলিম বক্স আসে। দু’বন্ধুতে দেখা হলেও তেমন কোনো উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না কেউ। খানিকটা আড়ালে টেনে নিয়ে আলিম বক্স বললো, হুনছি কিছুদিন পরে গ্যারামে গ্যারামে মিলিটারি নামবো। আমাগ মতন যারা আছে তাগো সবতেরে জোর কইরা মিলিটারিতে ভর্তি করবো। নাম দিবো রাজাকারকিন্তু পাইক্যরা বড় বড় শহরে অনেক মানুষ মারতাছে। ঘরবাড়িতে আগুন দিতাছে। কাশেম বইল্যা একজন হাবিলদার কিছু পোলাপানরে যুদ্ধের ট্রেনিং দিতাছে। আমি ঠিক করছি যুদ্ধে যামু। তার লাইগ্যা একবার তরে জানাইতে আইলাম।

হাসন আলি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো, আমিও যামু।

তাইলে তর বাপ-মা’রে কইয়া আয়!

বাপ-মা হুনলে কি আমারে যাইতে দিবো?

না কইয়া যাওনডা কি ঠিক হইবো?

বাইত্যে থাইক্যা আমি পাইক্যাগো দলে গিয়া মরনের থইক্যা দেশের লাইগ্যা যুদ্ধ কইরা মরলেও মনে করি ভালা!

কথা তো ঠিকই। তাও বাপ-মা বইল্যা কথা। তরে না দেখলে দুইজনেই পাগল হইয়া যাইবো। বেশি দূর হইয়া যাইবো বইল্যা তরে ঢাকা পড়তে যাইতে দিলো না মনে আছে?

হাসন আলি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললো, তুই কি একবারে মেলা কইরা আইছস?

আরে হ! আলিম বক্স অস্থির কণ্ঠে জানায়। আমার লগে আরো মানুষ আছে। সবতে নৌকায় বইয়া রইছে!

তাইলে তুই খাড়া, আমি বাবারে রাজি করতে পারি কি না দেইখ্যা আই!

তখনই হোসেন মৃধার মুখোমুখি হয় হাসন। বলে, বাবা আপনে কি কথা হুনতাছিলেন?

হোসেন মৃধা বললো, মেলা করলে এহান থাইক্যাই কর। তর মা জাননের আগেই।

মারে কইতে হইবো না? বিস্মিত হাসন আলি হোসেন মৃধার দুহাত চেপে ধরে।

তর মা এই কথা হোনলে এহনই তরে আবার পেটের ভিতরে ঢুকাইতে চাইবো! যা বাজান!

হাসন আলি হোসেন মৃধার দুপায়ের সামনে উবু হলে হোসেন মৃধা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো, দিরং করিস না!

আড়ালে কান পেতেছিলা গহর মাঝিও। হাসন আলি আলিম বক্সের সাথে এগোতে থাকলে গহর মাঝিও তাদের পিছু নেয়। হঠাৎ পেছন ফিরলে আলিম বক্স গহর মাঝিকে দেখে বললো, আপনে কে?

আমি গহর মাঝি।

আমাগ পিছ লইছেন ক্যান?

গহর মাঝি বিচলিত না হয়ে বললো, নৌকা বাইতে তো ভালা মাঝির কাম লাগে।

কথা শুনে আলিম বক্স হাসন আলির হাত মুঠিতে নিয়ে চাপ দিলে সে বললো, অসুবিধা নাই।

নৌকা বিলের মাঝামাঝি পৌঁছুলে চাঁদের আলোয় একজন যাত্রীকে দেখা যায় গামছা অথবা মাফলারে মুখ আড়াল করে রাখতে। হাসন আলির সন্দেহ হলে সে আলিম বক্সকে বলে, মুখ ঢাইক্যা রাখছে কে?

আলিম বক্স বললো, তানির নাম নাজিউর রহমান।

হাসন আলি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো, সিদ্ধেশ্বরীতেও একজন নাজিউর আছে। আমার মামু লাগে।

নাজিউর রহমান মুখের আড়াল সরিয়ে দিয়ে বলে উঠলো, হরে মামু আমিই। মিয়াভাই কইলো আমারে তার হিজবুল্লা হইতে। তার লাইগ্যাই পলাইতাছি!

হাসন আলি বিস্ময় আর আনন্দে বলে উঠলো, মামু ভাইগনা যেই কামে যায়, আপদ বালাই আড়ে যায়!

(চলবে)

প্রকাশিত পর্বগুলো পড়তে চাইলে

পর্ব-১

পর্ব-২

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


11 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৩

You must be logged in to post a comment Login