শৈলী টাইপরাইটার

অনুগল্পঃ প্রিয়তমা

অনুগল্পঃ প্রিয়তমা
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

….
“নওশীন! এই নওশীন!”
বাথরুমের কলটা ছাড়া, হয়তো তাই ডাক শুনছে না। তূর্যের ফোনটা বাজছে, আনমনে থাকায় খেয়াল করা হয়নি। না, তূর্যের নয়। নওশীনের ফোন বাজছে। ড্রেসিং টেবিলের ওপর থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো সে। থেমে থেমে বিপ বিপ আওয়াজ হচ্ছে। তূর্যের কুঞ্চিত ভ্রুর নিচে আলোকিত ফোনের স্ক্রিন। প্রতিদিন কে এত টেক্সট দেয় নওশীনকে?
.
“আমার প্রাইভেসিতে নাক গলাচ্ছ কেন?”
দ্রুত নিজের ফোন হাতে নিতে গিয়ে আঙুলের বড় নখের আঁচড় বসিয়ে দিলো নওশীন।
“আউচ!”
“স্যরি।”
জানালার ওপাশ থেকে বিড়াল ডাকলো, “মিঁয়্যাও।”
তূর্য একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমার বিড়ালটা প্রতিদিন মাঝরাতে কই যায়?”
“তোমার হাত ঠিক আছে তো?”
“সামান্য খামচিতে কি মরে যাব নাকি?”
“খেয়ে এসেছো?”
“হুম, অফিসে আজ নায়লার সাথে দেখা.. আজই আমাদের ডিপার্টমেন্টে জয়েন করলো। আমাকে দেখে ছাড়লোই না। রেস্টুরেন্ট থেকে একসাথে ডিনার পর্ব সেরে এসেছি।”
“নায়লা নাঈম!”
“ধূর, তুমিও ফাজিল। আরে আমার বন্ধু নায়লা। গত সপ্তাহেই তো দেখলে।”
নওশীন মুখ বাঁকা করলো। নজর এড়ায় না সেটা তূর্যের। বলে, “সন্দেহের কিছু নেই, আমরা বন্ধুই.. আর কিছু না।”
“ক্লোজ ফ্রেন্ড?”
“হুম।”
“কতটা ক্লোজ? কাঁধে মাথা রাখার মত ক্লোজ?”
তূর্যের মুখ শক্ত হয়, “মানে?”
নওশীন গদাইলশকরিচালে তূর্যের কাঁধ থেকে একটা লম্বা চুল আঙুলে তুলে নেয়। তারপর চেয়ে দেখে তূর্যের বিস্ফোরিত মুখ।
“বাথরুমের কলটা ছেড়ে এসেছি…. যাই, বন্ধ করে আসি।”
“এতরাত অবধি জেগে আছো কেন?”
“তোমার বিড়ালটা ঘুমাতে দেয়নি…. সন্ধ্যা থেকে ডাকতে শুরু করেছে।”
“ও…।”
মাথাটা আপনা থেকেই নিচু হয়ে যায় তূর্যের। এ যেন যুদ্ধে হেরে স্বীয় সমর্পণ। নওশীন চলে যায় বাথরুমে। মন খারাপ করে রাতের নীরবতা ছাপিয়ে ডেকে ওঠা ঝিঁঝিঁপোকার ডাক শোনে তূর্য। নায়লার সাথে জমে ওঠা চুরি চুরি পরকিয়া কত সহজেই না বিশ্লেষণ করে ফেলল নওশীন। ও কি কষ্ট পেয়েছে? আচ্ছা, নওশীন যদি একই কাজ করতো, পরকিয়ায় জড়াতো কষ্ট পেত তূর্য? যুগটা আধুনিক, মানুষ এখন অনেক বেশি প্র্যাকটিকাল। যেখানে দশ মিনিট পর কারও মুড কেমন থাকবে সে নিজেই জানে না সেখানে একটা মানুষের সাথে সারাজীবন পার করার হিসাবও তো অনিশ্চয়তার খাতায় লিপিবদ্ধ। তবু… মনে হয় তূর্য কষ্ট পেত। কিন্তু কারণটা কী? তূর্য নিজেও জানে না।
.
“আই লভ ইউ।”
কানভেদ করে কথাটি তূর্যের চিন্তাজগতে পৌঁছতেই কারণটি খুঁজে পায় তূর্য। সে তাকায় টিভি স্ক্রিনের দিকে। ক্রমাগত পোষা বিড়ালটার ওপর হাত বুলিয়ে যেতে যেতে টিভির পর্দার নায়িকা কাজল আগারওয়ালকে দেখতে থাকে সে। দক্ষিণের টপ নায়িকা। এইমাত্র নায়ক তাকে প্রপোজ করলো। চেহারায় তার ছড়িয়ে আছে মাধূর্য, যেমনটি ছড়িয়ে আছে নওশীনের চেহারায়। সেকারণেই নওশীনের পরকিয়া মানতে পারবে না তূর্য।
.
বসার ঘর থেকে দরজার ফাঁক গলে তূর্যের চোখ যায় নওশীনের দিকে। ঘরে বসে কাকে যেন ফোনে টেক্সট করছে নওশীন, আর হাসছে মিটিমিটি। এত মধুর হাসি কল্পনাতেও খুঁজে পাওয়া যায় না। নওশীনের রূপের ব্যাপারে আরও একবার চমৎকৃত হয় তূর্য।
.
.
.
“এত ডিপলি কী ভাবছো তূর্য?”
“ভাবছি, নওশীনকে সত্যিটা বলে দেব।”
“কোন সত্যি?”
“তোমার-আমার রিলেশনের ব্যাপারটা।”
“সত্যিটা বলে যদি স্বস্তি মেলে তবে তাই করো।”
“হুম।”
“ও রিঅ্যাক্ট করবে নাতো?”
তূর্য ওয়াইনের গ্লাসটা কাছে টেনে নিয়ে বলে, “করবে।”
“নওশীন তোমায় ভালবাসে তাহলে।”
“ও রিঅ্যাক্ট করবে, আনন্দের রিঅ্যাক্ট। মুক্ত হবার রিঅ্যাক্ট।”
“ওর জীবনেও কেউ আছে নাকি?”
“টার্নিং পয়েন্টে চলে এসেছো। হুম, আছে একজন। প্রতিদিন ফোনে কনভার্সেশন হয় ওদের।”
“কী কথা হয়?”
“জানি না। তেমন ভালবাসাকে ডিপলি রিয়েলাইজ করার মত কিছু হবে হয়তো।”
বলেই এক চুমুকে ওয়াইন গলধঃকরণ করে তূর্য। নায়লা বুঝতে পারে সে রেগে গেছে।
.
রাগের মাথায় হুট করে সিদ্ধান্ত নিলে তার ফলাফল ভাল হয় না। নায়লা জানে তূর্য এখন রেগে গেছে, তার থেকে ভাল কিছু এখন আশা করা যাচ্ছে না। যত দ্রুত সে গাড়ি চালাচ্ছে তাতে করে অ্যাক্সিডেন্টের সম্ভাবনা বেশি। তবু সিটিলাইটসের আলো মাড়িয়ে জোরে গাড়ি চালাতে তূর্যের ভাল লাগছে। নিজেকে রেসার মনে হচ্ছে।
“শূন্যে ভেসে গাড়ি নিয়ে ফ্ল্যাট স্পিন দিতে জানো?”
নায়লা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলে, “ফ্ল্যাট স্পিন কী?”
“সমতল ভূমিতে একটা কেন্দ্রবিন্দুতে গাড়িকে সম্পূর্ণ অর্থাৎ তিনশো ষাট ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে ঘোরানো।”
“তূর্য, তুমি কি ঠিক ডিসিশন নিচ্ছ?”
“প্রসঙ্গের বাইরে কথা বলছো কেন?”
“কারণ এখানে তিনটা জীবন জড়িয়ে আছে। তোমার আর নওশীনের মাঝে আমাকে জড়িয়ো না। হয়তো নওশীন সইতে পারবে না। আর আমরা দুজন তো বন্ধু হয়েও থাকতে পারি।”
“সে যদি অন্য কারও সাথে রিলেশন করতে পারে তো আমার করতে ক্ষতি কী?”
.
নায়লাকে আর কোনো কথা বলবার সুযোগ না দিয়ে তূর্য, নায়লাকে নিয়ে বাড়িতে পৌঁছলো। সিঁড়িভেঙ্গে ওপরে উঠবার সময় নওশীনের ম্যাসেজ, “এত দেরী হচ্ছে কেন? তোমার জন্য কিন্তু সারপ্রাইজ আছে।”
থমকে যায় তূর্য। সারপ্রাইজ! কী সারপ্রাইজ? সাক্ষাৎ ভালবাসার মানুষকে প্রেজেন্ট করে বলবে না তো সারপ্রাইজ?
“দাঁড়িয়ে পড়লে কেন তূর্য?”
নায়লার কথায় তূর্য আবারও চলতে শুরু করে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তারা দুজনেই অবাক হয়ে শোনে ভেতর থেকে ভাসাভাসাভাবে নওশীনের আহ্লাদী কথা শোনা যাচ্ছে। একটা কথা ইন্দ্রিয় সজাগ করতেই দুজনে স্পষ্ট শুনলো, “আই লভ ইউ।”
.
তূর্য, নায়লাকে বলে, “তারমানে আমি ছাড়াও তার লাইফে অন্য কেউ আছে, যেমনটি আমার লাইফে তুমি আছো।”
.
তূর্য দরজায় হাত রেখে নক করলো। নওশীন দরজা খুলে দিতেই সে বলে, “কোথায় তোমার বয়ফ্রেন্ড যে তোমায় আমার থেকেও বেশি ভালবাসে?”
“মানে? আর নায়লা আজকের দিনে এতরাতে এখানে কেন?”
কথা শুনে মনে পড়ে তূর্যের আজ তাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকী। তূর্য লক্ষ্য করে নতুন একটি শাড়ি পরেছে নওশীন। এমতাবস্থায় বিড়ালটাও চলে আসে। নওশীন বলে, “জানো, তুমি যখন থাকো না এই বিড়ালের মাঝে তখন তোমাকে খুঁজে পাই। একটু আগে তোমায় ভেবে ওর সাথে অনেক কথা বলেছি।”
তূর্য বুঝতে পারে একটু আগে দরজার আড়াল থেকে যে কথোপকথন শুনেছিল সেটা বিড়ালের সাথে হয়েছিল। অতঃপর তূর্যের বোধোদয় হয়, সে ভুল পথে আছে। এখানে সে ছাড়া নওশীনের জীবনে আর কোনো দ্বিতীয় মানব নেই। তূর্য হাতজোড় করে মেঝেতে হাঁটুগেড়ে বসে পড়ে। তার চোখ টলমল করে অশ্রুতে।
“এসবের মানে কী তূর্য?”
নায়লা বলে, “মানেটা না বুঝলেই ভাল। আপাতত তুমি এই পাগলকে সামলাও। বাই।”
.
নায়লা চলে যেতেই নওশীন বলে, “ওঠো তো তূর্য।”
তূর্য উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “স্যরি।”
“কীসের জন্য?”
“স্যরি ফর এভরিথিং।”
নওশীন স্মিত হাসে, অকারণেই।
“তোমার সারপ্রাইজটা কী?”
নওশীন এবারেও কিছু না বলে তূর্যের ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলে, “এটাই ছিল সারপ্রাইজ।”

 

আল মাহমুদ বাপ্পি:

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login