শৈলী বাহক

দস্যু । মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম

দস্যু । মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক.
পশ্চিমের আকাশটা খানিক মেঘাচ্ছন্ন হয়ে আছে। শীতকাল কিনা তাই সূর্যের ম্রিয়মাণ আলোয় মনে হচ্ছে, বেলা পড়ে এল। কিন্তু,
বাস্তবিক অর্থে তা নয়, তখনও দুপুর দেড়টার ন্যায় আন্দাজ করা যায়। বেলা ঠিকই আছে। জায়গামতন নেই শুধু আমার অবাধ্য মনটা। আমার সম্মুখে একটা খামবিহীন নগ্ন চিঠি পড়ে আছে। একদৃষ্টে সে দিকেই তাকিয়ে আছি। মনে আকাশ পাতাল ভাবনা। চিঠিটাই যত ভাবনার মূল। চিঠিতে প্রকৃত সাধু ভাষায় লেখা-

“কাল দ্বিপ্রহরের প্রাক্কালে আসিতে না পারিলে তোমার স্থাবর-অস্থাবর ও সকল সম্পত্তি বিক্রয় হইয়া যাইবে। কাল খাজনা
দিবার শেষ দিন।”

পূর্বের ঢাকা মানিকগঞ্জের আবাদি অঞ্চলে আমার বাবার কিছু সম্পত্তি ছিল। তার জন্য বৎসর বৎসর কিছু খাজনাদি দিতে হত; গত সাতবৎসর যাবত বাজার-সদাই ও খরচা-পাতিপূর্বক কিছুই অবশিষ্ট না থাকায় ক্রমান্বয়ে নিয়মিত কিস্তির সময় উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

চিঠিটা আমার কোন দুঃসম্পর্কের বৃদ্ধ আত্মীয় লিখেছিলেন। তাই, এমন পরিষ্কার সাধু ভাষায় লেখা।নগ্ন চিঠিটা সামনে রেখে আকাশ পাতাল ভাবছিলাম। একে তো বেলা পড়ে যাচ্ছে এদিকে আবার শীতকাল, তার উপর আবার মেঘলা মেঘলা ভাব। সাত-পাঁচ ভেবে সেই অসময়েই বাড়ী থেকে বের হওয়ার তোর-জোড় করছিলাম। তখন জানতাম না ভবিষ্যতের অতল গর্ভে কি লুকিয়ে রাখা আছে। কিন্তু সেদিন কোন বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে ঘর থেকে বের হওয়ায় আমায় যে ভয়ানক বিপদে পড়তে হয়েছিল তা ভাবলে আমার বুক আজও কেঁপে কেঁপে উঠে। এখনও আমি সেই ভয়ানক দিনের ছবি মন হতে মুছতে পারি না। কি সাঙ্গাতিকই না সে দৃশ্যপট !

হাতে একটা চটের ব্যাগ। কাঁধে রংচটা কালো
ছাতা। গরম কাপড়ে গাঁ-য়ের আগা গোড়া
ঢেকে গ্রাম ছেড়ে মাঠের সরু রাস্তায় এসে
পড়লাম। তখন গ্রামে পাঁকা রাস্তা হয় নাই। আমার বাড়ী হইতে মানিকগঞ্জের কৃষ্ণপুর সদর হবে, দশ-বার কিলো। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাঁকালাম। ঘণ্টা দু’য়েক বেলা আছে, এর মধ্যে এই দশ-বারো কিলো শেষ করতে হবে ভেবেই আমার বুকের হৃদপিন্ড হাপড়ের ন্যায় আওয়াজ তুলতে লাগল। আমি খুব দ্রুত চলতে লাগলাম।কাঁচা মাঠের রাস্তা ধরে যাচ্ছি। প্রকাণ্ড মাঠের আইল গুলি এঁকে-বেঁকে অজগর সাপের মত বহুদূর চলে গেছে। দুই এক জায়গায় বাবলা বনের ঝোপ, কোথাও বা কেয়া বনের মাঝে দুই চারটি নারিকেল গাছ মাথা ঝেড়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

হেমন্তকাল শেষ। মাঠের ধান কাটাও হয়ে গেছে, ধানের গোঁছা কোন কোন জায়গায় বা মাঠের মধ্যে এলো-পাথাড়ি পড়ে আছে, কোথাও বা কামলারা মাথায় করে ধানের পাঁকা আঁটি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। ধানের শক্ত গোঁছা মাড়িয়ে মাঠ চলতে বড়ই পা ব্যথা করছে। মাঠ ছেড়ে ধূল্যার মেঠো রাস্তায় উঠলাম। সাটুরিয়া হতে সে রাস্তা বরাবর হিন্দুপাড়া হয়ে কৃষ্ণপুর চলে গেছে। আমি সেই সদর রাস্তা ধরে যাচ্ছি। সন্ধ্যেও হয়ে হয়ে আসছে। মাঠে চোর ডাকাতের কোন ভয় ছিল না, কিন্তু মাঠের পথটা ভাল না বলে সদর
রাস্তায় উঠলাম। খানিক দূর রাস্তা ধরে হেঁটে আমার বড় ক্লান্তি বোধ হল। কিন্তু না হেঁটেও উপায় নাই। তখনও আমায় দুই-তিন কিলো রাস্তা পাড়ি দিতে হবে। অতি ক্লান্তভাবে হাঁটছি এমন সময় দেখি একজন যমদূতের মত কৃষ্ণবরণ লোক, গ্রামের ভেতর হতে হেলে-দুলে সদর রাস্তার দিকে আসছে। তার সেই বিভীষিকা মেশানো চেহারা, দূর হতে সেই জনশূন্য মাঠের মধ্যে দেখে, আমি ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। সে আমায় ভদ্র লোক ভেবে সানন্দ্যে কুশললাপ করলো। আমি ভয়ে জমে গিয়ে ভাব জমানোর জন্য তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,

‘ভাইজান, গ্রামখানির নাম কি’
সে কাকের ন্যায় কর্কশ স্বরে বললো, “এ গ্রামের নাম সাহেবপাড়া। যাইবেন কই?”- সে কঠিন স্বরে জানতে চাইলো-
‘জ্বি। সাঁইপাড়া।’
“চলেন আমিও সাঁইপাড়া যামু” বলে সে লোকটা আমার সঙ্গী হয়ে উঠলো।

দুই.
মনে খানিক ভয় উঁকি দিয়ে উঠলো। এ আমার সঙ্গ নিল কেন? মনে কি কোন পাপ আছে? এই ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তা ধরে চলতে লাগলাম। সে নানা প্রকার প্রশ্ন করে, আমি তার উত্তর দিই। সে কতক্ষণ পর হাতের ছড়িটা ঘাড়ে তুলে নিয়ে আমার পাশ থেকে সড়ে এসে একটু পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করল। তখন আমরা আবার রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে পড়েছি। লোকটাকে পিছন পিছন আসতে দেখে আমার ভয় হল। পিছন থেকে ছড়ি দিয়ে মাথায় এক ঘা বসিয়ে দিতে বড়ই সুবিধা। কিন্তু মনের ভয় মুখে প্রকাশ করতে পারলাম না। তাকে তাই বললাম,

‘ভাইজান, আপনি আমার সামনে সামনে চলেন, মাঠের পথ তো আমি চিনি না।’
“কাছেই একটা গ্রাম আছে। ভায়া, কি চুরুট খান?”
চুরুট খাওয়ার ইচ্ছা ছিল না তবুও ‘হ্যাঁ’ বলে দিলাম।
সে বললো- “আমার সঙ্গে আসুন।”

সে আমায় একটা লোকের বাড়ীতে নিয়ে গেল। সেখানে তারই মতন আট-দশ জন দাওয়ার উপর বসে গল্প করছিল। আমার সঙ্গীকে দেখে তারা আদর-অাপ্প্যায়ন করলো। তামার কলিকাতে তামাক সাজিয়ে দিল। আমি নিবিষ্ট মনে তামাকু খাচ্ছি সাথে দু’একটা মিষ্টি শসদানাও;
তখন তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলো,
“ভদ্রলোকের যাওয়া হবে কতদূর ?”
আমি বলিলাম -‘জ্বি। সাঁইপাড়া।’
“কেন,কোন মামলা-মোকাদ্দমা আছে নাকি?”
‘না, তবে কিছু খাজানা দেয়ার বরাত আছে।’
অন্যমনস্ক ভাবে এই কথাটা বলে বড়ই
অন্যায় কাজ করেছিলাম; পরে যদিও এর জন্য বড় মাশুল দিতে হয়েছিল। আমার কাছে খাজনার টাকা আছে শুনে তারা পরস্পরে চোখের নিমিষেই একটা চক্র তৈরী করে ফেলল। তাদের চোখের গোপন ইশারাটা আমি অবশ্য দেখতে পেয়েছিলাম। মনে ভয় হল, অনুতাপ হতে লাগলো,-
কেন এ কথাটা বললাম! আমার সঙ্গের লোকটার কোমরে একটা পুটলীর ন্যায় কিছু একটা বাঁধা ছিল। সে তা খুলে মেঝেতে রাখল। আমি দেখতে পেলাম, কিন্তু কিছু বললাম না।

তামাক খাওয়ার পর আমার সঙ্গী তাহাদের মধ্যে এক বয়স্কা বৃদ্ধের কানে কানে কি একটা কথা বলল। এরপর, আমায় বললো,
“ভায়া, তবে চলুন।”
আমি উঠলাম। সে এবার আমার আগে আগে চলতে লাগলো। খানিক দূর এসে মাথায় হাত দিয়ে বলল,
“এই যা,ভায়া একটু দাঁড়াবেন কি ?
আমি একটা পুটলী গ্রামের মধ্যে ফেলে
এসেছি।”
পুটুলীর কথা এখনও আমার বেশ মনে
আছে। আমি দেখেছিলাম সে ইচ্ছা করে
পুটলিটা খুলে রেখেছিল। এতক্ষণে স্পষ্ট
বুঝতে পারলাম, সে পুটলী আনতে যাবার উছিলায় পথের মধ্যে সন্ধ্যা করার চেষ্টায় আছে। দস্যুদের কার্য্যে অন্ধকার প্রধান সহায়, কাজেই সে নানা প্রকারে দেরি করবার চেষ্টা করছে। আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম,
‘তোমার পুটলী তুমি ফেলে এসেছ, তাতে আমার কি? আমি চললাম। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো কেন ? তুমি কি পথ চিনো না, নাকি?’
হঠাৎ এমন তাড়া খেয়ে লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। মিনমিনিয়ে বলল,
“ভায়া, তবে তুমি অগ্রসর হও, আমি ফিরে যাই।”
পিছন ফিরে দেখলাম সে হনহনিয়ে চলে গেল।

তিন.
আমি মনে মনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।ভাবলাম
লোকটা চোর বা ডাকাত না হয়ে যায় না। কি
ভয়ানক চেহারা ? দেখলেই যেন প্রাণ ভয়ে
কেঁপে কেঁপে উঠে। ভাবলাম, এখন তো অন্ধকার হয়ে পড়ছে। আর আধ কিলো গেলে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাব, ভয়ই বা কিসের? তবু আমি সদর রাস্তা ছেড়ে মাঠ ধরে চললাম। মেঘটা ততক্ষনে একটু বেশী আঁধার করে আসছে। এক এক বার বিদ্যুৎের চমকা-চমকিতে, সেই আঁধারের মধ্যে আলো, আবার ভয়ানক অন্ধকারের জানান দিচ্ছে।এই সময়ে হঠাৎ একবার বিকট শব্দ করে বিদ্যুত চমকিয়ে উঠলো,
বিদ্যুতের আলোয় নিমেষের মধ্যে পেছন ফিরে যা দেখলাম তাতে আমার গাঁ শির শির করে উঠলো! আমি নির্বাক হয়ে সে স্থানে দাঁড়ালাম, গাঁ বেঁয়ে অবিশ্রামভাবে ঝরঝরিয়ে ঘাম পড়ছে, শরীর থর থর করে কাঁপছে। দেখলাম দুই জন লোক, ভয়ানক কৃষ্ণবরণ চেহারা, দুই গাছি লাঠি কাঁধে করে ঊর্দ্ধশ্বাসে সদর রাস্তার উপর দিয়ে ছুটছে।তারা যে কে হতে পারে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলো না। আর তারা যে আমার পিছনে পড়েছে তাও বুঝতে আমার বাকী রইল না। আমি আর দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম না। ধীরে ধীরে এক ঝোপবেষ্টিত জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করলাম। সাপ-খোপের ভয় তখন আর মাথায় নেই। ভাবলাম, লাঠির আঘাতে মাথাটা চৌচির হওয়া অপেক্ষা সাপের দংশনে মারা যাওয়া ঢের ভাল। যেখানে ঢুকলাম সে স্থানটি ছিলো একটা ভাঙ্গা শিবের মন্দির। বট গাছের জটে সেই ভাঙ্গা মন্দিরটা সম্পূর্ণ আচ্ছাদিত। মন্দিরের ভেতর কোন দেবতার প্রতিমূর্ত্তি নাই। বোধহয় দশ বার বৎসর সে স্থানে কেউ আর কখনো পদার্পণ করে নাই। আমি নিঃশব্দে সেই মন্দির পার্শ্বে লুকিয়ে পড়লাম। ভয়ে তখনও আমার শরীর হির হির করে কাঁপছে, ঘন ঘন নিশ্বাস বের হচ্ছে; কিন্তু ভরসা করে নিশ্বাসও জোরশব্দে
ফেলতে পারছি না, পাছে সেই শব্দে দস্যুরা
যদি আমার সন্ধান পায়।সেই পূর্ব পরিচিত লোকটার কণ্ঠস্বর আমার কানে গেল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে কান পেতে রইলাম। যা শুনলাম তাতে আমার প্রাণবায়ু উড়ে যাওয়ার ন্যায় অবস্থা।
“এত্তগুলো টাকা কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত হবে না, যে প্রকারেই হোক টাকা গুলো হাত করতেই হবে।”
আর একজন বলে উঠলো, “তাতো বটেই, কিন্তু ওকে মোটেও ছেড়ে দেয়া হবে না।আমাদের আড্ডার জায়গা দেখে ফেলেছে,ছেড়ে দিলে অনায়াসেই আমাদেরকে দারোগা বাবুর কাছে সোপর্দ করতে পারবে, সুতরাং, বজ্জাতটাকে জীবিতও রাখা যাবেনা। কিন্তু এরই মধ্যে হতচ্ছারা লোকটা গেল কোথায় ? আমাদের চক্ষে ধূলো দিবে, এ বড়ই আশ্চর্য্য কথা ! চল একবার ওই ঝোপের মন্দিরটার ভিতর দেখে আসি।”

এ কথা শুনে আমার প্রাণ যায় আর আসে, বুঝলাম এবার আর রক্ষা নাই। কিন্তু তথাপি কোন উচ্চ-বাচ্চ চিৎকার করলাম না। নিঃশব্দে ঠায় সেই মন্দিরের একটা ভগ্নপ্রায় দরজার আড়ালের মাঝে অন্ধকারে মিশে রইলাম। দস্যুরা আমার পাশ দিয়ে গেল কিন্তু দেখতে পেল না। আমি মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করতে লাগলাম। অন্ধকারে দস্যুরা আমাকে দেখতে না পেয়ে চলে গেল। সহসা সে স্থান হতে বের হতে আমার আর সাহস হল না। ঘণ্টা খানেক সেই পোড়ো মন্দিরের মধ্যে কাটালাম। তার পর ধীরে ধীরে সেখান হতে বের হলাম; খানিক রাস্তা অতিক্রম করতেই কান্দাপাড়া বাজার দেখতে পেলাম। তখন আমার মনে আশা জাগলো, এই যাত্রায় হয়তো পরিত্রাণ পেলাম। যে স্থানে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম, সে স্থানটার নাম “পোঁড়ার ভিটা”। মানুষ খুন করবার এটা অত্র এলাকার বিখ্যাত স্থান। কান্দাপাড়া বাজারে আমার পরিচিত একটা মিষ্টান্ন দোকানে গিয়ে, কিছু মিষ্টি দ্রব্য খেয়ে একটু জল মুখে দিলাম। দেখতে দেখতে দোকানে দু’চারজন আমার পরিচিত বন্ধুসকল এসে জমায়েত হল। আমি তাদের কাছে একে একে পথিমধ্যে বিপদের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলাম; তারা সকলে শুনে বললো,
“এ যাত্রায় কি রক্ষাই না তুমি পেয়েছো!”
কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে আমরা গ্রামের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। তখন আর কিসের ভয় ? সঙ্গে আট-দশ জন ভদ্রলোক। সকলেই পরিচিত। হরেক রকমের গল্প করতে করতে খুব আনন্দে আধা কিলো পথ কেটে গেল। আমার জনৈক বন্ধু তাঁর বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক জেদ করছিল। কিন্তু আমার নাকি অদৃষ্টে আরও কষ্ট ভোগ আছে, তাই তাদের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বাড়ির দিকে পথ চললাম। তাঁরা যে যার মত চলে গেল।

চার.
অন্ধকারে একা একা উঁচু-নিচু রাস্তায় হাঁটছি। হঠাৎ মনে হল আমার নিশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে; অন্ধকারে কিছু ঠাওড় করতে পারছিলামনা। তখনই মুখের উপর হাত স্পর্শ করে দেখি, দুইজন লোক আমার মুখে
কাপড় দিয়ে বাঁধছে, বুঝতে বাকী রইলো না যে আমি পুনরায় দস্যুদলের পাল্লায় পড়েছি। কিন্তু এরা যে পূর্বের সেই দুই পাষণ্ড কিনা, কণ্ঠস্বরে তাও ঠিক ঠাওরাইতে পারলাম না। প্রাণের দায়ে মৃতের ন্যায় আশাহীন হয়ে পড়লাম। কিছুসময় না যেতেই দেখি আর এক নতুন বিপদ উপস্থিত।পথের অপর পার্শ্ব হতে যেন আরও কয়জন লোক আসছে। তাদের মধ্যে একজন আমোদিত হয়ে বলল,
“ঐ যে বজ্জাতটা, বিলম্বের কোন প্রয়োজন নাই, কাজটা তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। কণ্ঠস্বরে বুঝলাম এরা আমার অনুগামী, সেই পূর্ব পরিচিত দস্যুদ্বয়, এবং আমার জীবননাশই এদের আজকের প্রধান লক্ষ্য। আমার বুক শুকিয়ে গেল! বুকের হৃদপিন্ডটা পাগলা ষাঁড়ের ন্যায় দাঁপাদাঁপি করছে। মুহূর্তের মধ্যে সেই পাষণ্ডেরা আমাকে লক্ষ্য করে আঘাত করতে তেড়ে আসল।  কিন্তু তারা বড় আশায় নিরাশ হয়েছিল। আমি দুরাচারদের দুরভিসন্ধির কথা শুনে, চোখের নিমিষেই নিঃশব্দে কাঁঠালগাছের পাশে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছি। এদিকে পূর্বের যে দস্যুরা আমার সম্পত্তি লুটের জন্য আমার মুখ বেঁধেছিল,তারা মনে করলো যে, এরা বুঝি সম্পদের সন্ধান পেয়ে তাদেরকেও আক্রমণ করতে আসছে। নিরুপায় হয়ে তাই তারাও আত্মরক্ষার জন্য অন্যদেরকে আক্রমণ করলো। তখন দুই দলে ঘোর মারামারি করতে লাগলো। এই গোলযোগে আশে-পাশের বাড়ির লোকেরা কারণ অনুসন্ধানের জন্য প্রায় সকলেই হ্যারিকেন নিয়ে রাস্তায় জড় হল আর, দু’দলকে একদম হাতে নাতে ধরলো। দেখা গেল দু’দলের লোকবলই প্রচন্ড আহত হয়ে পড়েছে, তাদের কতকের আহত স্থান হতে অজস্র রক্তপাত হচ্ছে!

এদিকে বৃহদাকার কাঁঠাল গাছতলায় আমার সাড়া পেয়ে লোকজন আমার হাত ও মুখের বন্ধন খুলে দিল। তখন আমি পূর্বের সমস্ত বৃত্তান্ত সকলকে খুলে বলি, সকলে সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। অবিলম্বে থানায় সংবাদ গেল। দারোগা বাবু এসে আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে নিয়ে গেল এবং তাদের সঙ্গীদের জিঙ্গাসাবাদ করতে থানায় নিয়ে গেল। শেষমেষ, সেই দুরাচারী দস্যুরা আপনাদের ফাঁদেই আপনারাই পড়লো। যথা সময়ে দস্যুদের বিচার হলো। যে দুই দুরাচার আমার অনুসরণ করেছিল তাদের “এটেম্প টু মার্ডার” অপরাধে চৌদ্দ বৎসরের জন্য যাবৎজীবন সাজা এবং অপর দস্যুদের সাত বৎসর করে সাঁজার মেয়াদ হয়ে গেল।

(সমাপ্ত)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login