ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৮
দিনদিন মতিউর রহমান আর কারি দেলোয়ার হোসেনের ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কানা আজমেরও ক্ষমতা আর দাপট বাড়ে। সম্প্রতি তার কাঁধে বন্দুক উঠার পর তার হাব ভাবে মনে হয় যেন মতিউর রহমান আর কারি দেলোয়ারকেও ছাড়িয়ে যাবে। হরি ঘোষকে সেদিন একা পেয়ে বুকে বন্দুক তাক করে ধরে বলেছে, মমতাকে যেন সে তার হাতে তুলে দেয়। নয়তো তাকে মেরে তার বাড়ির চালতা গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখবে।
কিন্তু কানা আজমের কথা শুনে হরি ঘোষ উল্টো কেঁদে কেটে জানিয়েছে, মমতা কোথায় চলে গেছে সে বলতে পারে না। তিনদিন ধরে গ্রামে গ্রামে ঘুরছে আর মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
কানা আজম সে কথা বিশ্বাস করেছে কিনা জানে না হরি ঘোষ। কিন্তু তারপর এ প্রসঙ্গে আর কিছু না বললেও সে জানিয়ে দেয় যে, যে ক’ঘর হিন্দু আছে তারা যেন কলমা পড়ে মুসলমান হয়ে শান্তি কমিটি আর রাজাকারে নাম লেখায়। নয়তো মসজিদের সামনে হিন্দু পুরুষগুলো হাত-পা বেঁধে সবার সামনে খৎনা করাবে। আর এ কথা শুনেই যেন গ্রাম বলতে গেলে আরো দ্রুত জনশূন্য হয়ে যেতে থাকে। কখনো কখনো মানুষের কাছে তার প্রাণের চেয়ে ধর্ম রক্ষাই বড় হয়ে দেখা দেয়। নিতান্তই যাদের যাওয়ার উপায় নেই তাদেরই থেকে যেতে হয় বাধ্য হয়ে। বিশেষ করে সুরানন্দী গ্রামের সুধাংশু ঠাকুর মন্দির ছেড়ে কোথাও যাবেন না বলে ঠিক করেছেন। তার স্ত্রী সন্তান সবাই ভারতে চলে গেলেও তিনি মন্দির আঁকড়ে পড়ে রইলেন। এখানেই জন্ম। এখানেই বৃদ্ধি। মরলে এখানেই তিনি মরতে চান। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা জীবনভর মানুষকে কালীর বরাভয় দিয়ে এসেছেন। নিয়মিত পূজা-অর্চনা করে এসেছেন। এখন স্বার্থপরের মত কালী মাতাকে একা ফেলে কোথায় যাবেন? তিনিই যে এতকাল কালীর রক্ষক হয়ে ছিলেন।
এরই মাঝে হঠাৎ একদিন শোনা গেল গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে। যে যেদিকে পারে ছুটে পালাচ্ছে। মুহূর্তে যেন গ্রামটা শূন্য হয়ে গেল। চান্দভানু চুলোয় রান্না চড়িয়েছিলো। প্রাণের ভয়ে সব ফেলেই পালাতে হয়েছিলো। মিলিটারি চলে গেছে জানার পর ফিরে এসে দেখলো চুলায় যেভাবে হাঁড়ি বসানো ছিলো তেমনিই আছে। তবে চুলোর আগুন নিভে গেছে।
আস্তে আস্তে সংবাদ পাওয়া যায়, ইবরাহিম কারি, বাচ্চু মিয়া, জয়নাল হাজি, রহম আলিদের ধরে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছে পাকিরা।
মতিউর রহমান পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো মন্দিরের কাছে। সেখানেই মন্দিরে চুয়াত্তর বৎসর বয়সের সুধাংশু ঠাকুরকে দেখে একজন পাকি সেনা নাকি বলেছিলো যে, এ তো কদিন পর এমনিতেই মরবে। এ মুক্তি হবে কি করে। ছেড়ে দাও একে। তবুও মতিউর রহমান জানায়, এ হিন্দু লোকটার কাছেই মুক্তিরা আসা যাওয়া করে। এলাকার মুক্তিরা এর মাধ্যমেই খবরাখবর পায়।
তারপরই মন্দির থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করা হয় সুধাংশু ঠাকুরকে। সে দিন কোন কারণে উপবাস ছিলেন তিনি। সূর্যোদয় থেকে পরদিন সূর্যোদয় পর্যন্ত উপবাস। দুর্বল দেহে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না বলে কোমরে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে সোজা হতে বলা হয়েছিলো। কিন্তু তিনি পড়ে গিয়েছিলেন মন্দিরের মেঝেতে। কালীর চরণে আশ্রয় চেয়েছিলেন জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত। কিন্তু স্বার্থপর কালী কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। ঠাকুরকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে এনে মাথায় গুলি করেছিলো একজন পাকি। অন্যদিকে মতিউর রহমান কালীর মূর্তিটাকে টেনে মেঝেতে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে টুকরো টুকরো করে দিয়েছিলেন।
তারপর পাকিরা চলে গেলে মতিউর রহমান আজমকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুধাংশু ঠাকুরের কুঁড়ে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতে। সে ঠাকুরের ঘরে আগুন লাগানোর পরপরই মন্দিরের ভেতরও আগুন দিয়েছিলো।
এভাবেই দিনদিন তৎপরতা বাড়ে স্বাধীনতা বিরোধীদের। দিনের বেলা আজম তার সঙ্গীদের নিয়ে নৌকায় করে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায় আর যাকে ইচ্ছে তাকেই ধমক দেয়। চড়-থাপ্পড় দেয়। কখনো বা বুক বরাবর বন্দুক তাক করে বলে, কইলজায় গুল্লি দিমু!
এমনই এক দিনের বেলা ঘুরতে ঘুরতে কানা আজম নৌকা লাগায় হোসেন মৃধার বাড়ির দক্ষিনাংশে। দলটিকে এদিকে আসতে দেখেই হোসেন মৃধা তার বাড়ির আশপাশে পড়শীদের সংবাদটি জানিয়ে বেতকাঁটার জঙ্গলে গিয়ে আত্মগোপন করে।
হয়তো আজমের ইচ্ছে ছিলো জুলেখাকে নিজের ক্ষমতা দেখাবে। কিন্তু জনশূন্য ঘরবাড়ি দেখে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে সে হোসেন মৃধার ঘরে ঢোকে। ধানের গোলায় বন্দুক দিয়ে ঘা দিয়ে ইচ্ছে মত ধান ছিটায়। বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করে চালের মটকা ভাঙে। পানির কলস ভাঙে। ঘরের একটি আলমারিতে কাপড়-চোপড় দেখে সেগুলোকে টেনেটেনে মেঝেতে ফেলে।
একটি টিনের সুটকেস ছিলো সেটিকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে পরখ করে ভেতরে ধাতব কিছু নড়ে কি না।
তার সঙ্গী খালেক বললো, তুই কি সোনাদানা-ট্যাকা-পয়সা খুঁজস?
তারপর বাইরে এসে এদিক ওদিক তাকায়। বেতের জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। শেষে কি মনে করে সে ফের ঘরে ঢোকে। হ্যারিকেন, কুপি থেকে তেল ঢালে কাপড়গুলোর ওপর। বাইরে থেকে খড়ের গাদা থেকে খড় টেনে টেনে এনে মৃধার দুটো ঘরের ভেতর জড়ো করে। যেন প্রবল আক্রোশে জুলেখাকেই জ্যান্ত পোড়াবার সংকল্প করেছে।
তাকে এভাবে ছুটোছুটি করতে দেখে সঙ্গীরা বলে, করতাছস কি পাগলের মতন?
দেখ চাইয়া। বলেই সে কোমর থেকে দেয়াশলাই বের করে ঘরের ভেতর স্তুপ করা খড় আর কাপড়ে আগুন ধরিয়ে বাইরে চলে আসে।
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরই দুটো ঘরে দাউদাউ আগুন জ্বলে উঠতে দেখা যায়। এক ঘরের আগুন উড়ে গিয়ে পাশের ঘরের চালে বা বেড়ায় পড়ে। এভাবেই আগুনের বিস্তার ঘটতে থাকলে কানা আজম তার সঙ্গীদের নিয়ে নৌকায় উঠতে উঠতে বললো, কাইল মিরধার গরু দুইডা মতি মাওলানার বাইত্যে নিয়া যাবি।
বেতকাঁটার জঙ্গলের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থেকে চোখের সামনেই বাড়িঘর পুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখলো হোসেন মৃধা, চান্দভানু, জুলেখা আর মমতা।
চোখের সামনে নিজের এতকালের সাজানো সংসার জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেতে দেখে অকস্মাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলো চান্দভানু। আর তখনই বিপদের গন্ধ টের পেয়ে হোসেন মৃধা চেপে ধরলো স্ত্রীর মুখ। চাপা কণ্ঠে বলে উঠলো, চিক্কুর দিস না! চিক্কুর দিস না! কানার দলে টের পাইলে আমাগো আর বাঁচন নাই!
এমন অবস্থায় কী করে কান্না রোধ করা সম্ভব সে কৌশল জানা নেই চান্দভানুর। তবুও সে চোখেমুখে আঁচল চাপা দিয়ে কান্না থামাতে সচেষ্ট হয়। ফলে ভেতর থেকে উঠে আসা কান্নার দমকে পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে।
দুদিন পর গভীর রাতে মজিবর মাস্টার প্যাঁচার ডাক ডাকলে হোসেন মৃধা বেতের জঙ্গল থেকে সন্তর্পণে বেরিয়ে আসে। মাস্টারের মুখোমুখি হয়ে চাপা কন্ঠে শুধায়, খবর কি?
খবর ভালো না। মতিউর রহমানের বাইত্যে আবার কয়ডা মিলিটারি আইছে বোট নিয়া। ইস্কুলঘরে অস্ত্রপাতি আর গোলাবারুদও জমা করতাছে হুনতাছি। আর পান্তার বাজারে লঞ্চ ভইরা আরো পাকি আইছে নাকি। ইস্কুলঘরের চাইরো দিগের মানুষ যে যেমনে পারতাছে পলাইতাছে। মনে হয় এমনে আমার আসা যাওয়া আর ঠিক হইবো না। পানি টান ধরছে। নৌকা নিয়া আওয়া খুবই কষ্ট। ঠিক করছি হাসনের দলের লগে মিশ্যা যামু।
হোসেন মৃধা বললো, এইডাই ঠিক কাম হইবো। কানা আজম আর তার দলও অনেক বড় হইছে। রাইতে ঘুরাফিরা করে। তাগো গলার আওয়াজ পাই!
রাতের নিস্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে দূরে কোথাও মৃদু ট্যাট ট্যাট করে শব্দ হয়। হয়তো কোথাও গুলি চালিয়েছে পাকিরা অথবা মুক্তিযোদ্ধা দলের ছেলেরা।
(চলবে)
8 Responses to ধারাবাহিক উপন্যাস: কালসাপ-৮
You must be logged in to post a comment Login