তাহমিদুর রহমান

ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৪)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

চার

রাতে রফিকের ভাল ঘুম হয় নাই। একবার বাথরুমের যাওয়ার জন্যে, আরেকবার কিসের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল বলতে পারবে না। বাথরুম যাওয়ার পরও ঠিকই ঘুম এসেছিল কিন্তু শব্দে ঘুম ভাঙ্গার পর দুঘন্টা জেগে থাকতে হল। ফজরের আগে আগে যাওবা একটু ঘুম এল, তাও ভেঙ্গে গেল চিৎকার চেঁচামেচিতে। জানালার কাছেই কে যেন তরকারীওয়ালার সাথে হারামীর বাচ্চা, শূউরের বাচ্চা বলে ঝগড়া করছে। রফিক তবু শুয়ে থাকে কিছুক্ষন এভাবেই, আজ কোথাও যাবে না বলে ঠিক করেছে সে। তবে ইন্টারভ্যূর প্রস্তুতি আর নতুন সিভি ছাড়বে বলে ঠিক করেছে। আর কাপড় ধোঁয়া, নিজের জিনিসপত্র গোছানো তো আছেই।

পাশের বিছানায় রফিকের রুমমেট দিনানাথ বাবুর বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর। তিনি একটা বলপেন কোম্পানীতে চাকরি করেন, দোকানে দোকানে গিয়ে বলপেন সাপ্লাই দেওয়ায় তার কাজ। সকাল বেলাতেই তিনি বিছানায় ঝিম বসে আছেন দেখে রফিক শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করে,

-কি খবর দিনানাথদা? ম্যাদকা মেরে বসে আছেন কেন?

-আর বইলেন না রফিক দাদা। সকাল বেলাতেই ডাইরেক্ট এ্যাকশন।

-মানে?

-পাতলা পায়খানারে দাদা, পাতলা পায়খানা। এলিফ্যান্ট রোডে একটা দোকানের সামনে আলুর চপ খাইছিলাম। সেটারই ফল হয়েছে। একেবারে পানি বের হচ্ছে দাদা।

সকালবেলাতেই এমন কথা শুনতে কার ভাল লাগে? রফিক প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করে।

-আজ তবে বাইরে যাবেন না?

-কি বলেন দাদা? এ অবস্থায় বাইরে যাব? পাঁচ মিনিটে একবার বাথরুম দৌঁড়াতে হচ্ছে। এখন বাহির হলেই কাপড় নষ্ট হয়ে যাবে।

রফিক আর কথা বাড়ায় না, বিছানা থেকে উঠে পড়ে। যখন মশারী নামানো শুরু করেছে তখন দিনানাথ বাবু আবার বলে উঠে,

-আপনি বাইরে যাবেন না?

-নাহ, আজ ঠিক করেছি ঘরের কাজ করব; বাইরে যাব না। কেন?

-না মানে আপনি তো আজিজ মার্কেটের দিকে প্রায়ই যান। ওখানে একটা দোকানে সাপ্লায়ে্র অর্ডার ছিল। যদি আপনি একটু পৌঁছে দিতেন, বড় উপকার হয় দাদা।

-না দাদা, আজ বাইরে যাব না; আজকের দৌঁড় মোড়ের দোকানটা পর্যন্ত।

-নিয়ে যান না দাদা। আপনাকে বিশ পার্সেন্ট ছেড়ে দিব।

রফিক কথা শুনে হাসে। বলে,

-আমাকে বিশ পার্সেন্ট দিলে আপনার থাকে কি?

-তবু অর্ডারটা ধরা দরকার দাদা। যদি অর্ডার পাই তবে পরের বার লাভ হবে।

-তা ঠিক, কিন্তু আজ যে বাইরে যাব না দাদা।

-তাহলে আজকের বাজারটা করে দেন দাদা। আপনার সামনেরটা আমি করে দিব।

-এটা করে দেওয়া যায়। তবে আমারটা করে দেওয়ার সময় পাবেন তো?

দিনানাথ বাবু দেঁতো হাসি হাসে। বলে,

-গতবারের খোঁচা দিলেন দাদা?

রফিক হাসির প্রতিত্তর হাসি দিয়ে ব্রাশ হাতে ডাইনিংয়ে চলে আসে। ডাইনিংয়ে চৌকির উপর সকালের নাস্তা সাজানো। কে খেয়েদেয়ে একদম উদোম করে ফেলে রেখে গিয়েছে। দেখে মেজাজ খারাপ হয় রফিকের, খাবারগুলো ঢেকে রাখে এক এক করে।

রফিকদের মেসটা বড় মগবাজার থেকে একটু দূরে, পুরাতন একটা ছয়তলা বিল্ডিং। আড়াই কাঠার উপরে প্রতি ফ্লোরে দুইটা করে ইউনিট, নিচতলার একটা ইউনিটই রফিকদের মেস। সিঁড়ি ঘরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার তার উপর দুইজন হেঁটে উঠতে গেলে ধাক্কা খেতে হয়। ঘরের ভিতরটাও লাইট ছাড়া অন্ধকার হয়েই থাকে। পাশে একদম বিল্ডিং এর পাশ ঘেষে উঠেছে আরো বিল্ডিং। ঘিঞ্জি শব্দটা বলতে যা বুঝায়, এলাকাটা ঠিক তাই।

ডাইনিংয়ে হাত মুখ ধোঁয়ার জন্য একটা ছোট্ট বেসিন আছে। বেসিনের কলটাতে হাত দিলেই পুরো বেসিনটাই নড়াচড়া শুরু করে। রফিক সেখানেই হাত মুখ ধুয়ে বাথরুমে ঢুকতে যাবে এমন সময় দিনানাথ বাবু এক্সকিউজ মি ব্রাদার বলে বাথরুমে ঢুকে যায়। রফিকদের মেসে একটাই বাথরুম, দশজনে মিলে ভাগাভাগি করে; ব্যস্ত দিনে একদম হুড়োহুড়ি লেগে যায়। আজ অবশ্য ছুটির দিন, বেশির ভাগ লোকজনই ঘুমাচ্ছে; কিন্তু দিনানাথ বাবু ছুটির দিনটাও ব্যস্ত করে ফেলেছেন। এমন সময় দিপু এসে রফিককে জিজ্ঞেস করে,

-কে গিয়েছে বাথরুমে?

-দিনানাথদা।

-অ। যখনই আসি তখনই ঢুকে থাকে। সমস্যা কি?

-উনার পেট খারাপ।

-অ। এ আর নতুন কি।

দিপু নাস্তা খেতে বসে যায়। ও একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ফার্মেসিতে পড়ে। একদম পড়াশোনায় মন নেই, তবু কিভাবে যে পাশ করে তা আল্লাহ মাবুদ জানে। এজন্যে সব সময়ই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নিয়ে রফিকের মনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দেখা যায়। সে অনেক কষ্ট করে অনার্স মাস্টার্স পাশ করে এসেছে। হোক না মফস্বলের কলেজ, পাশ করতে জান বের হয়ে গিয়েছে ওর। সারাজীবন প্রশ্ন কমন পেয়ে পরীক্ষা দিয়েছে খুব কম। প্রতিবারে আল্লাহই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। রফিকও এই ফাঁকে নাস্তা করে নেওয়ার চিন্তা করে। ওর অবশ্য সকালের প্রাতঃকাজ নিয়ে সমস্যা আছে। ভাগ্য ভাল থাকলে সকালে উঠেই দৌঁড়াতে হয় নয়ত ঠিক নাস্তার পরে। এখন বাথরুম যেতে না পারে প্রাতঃকাজের আগেই নাস্তা করার সিদ্ধান্ত নেয়। নাস্তা এমন কোন সুখাদ্য না, লাউয়ের ঘন্ট আর শুকনো রুটি। খাওয়া শুরু করতেই দিনানাথ বাবু বাথরুম থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ে আসে। কাতর ভঙ্গি করে বলা শুরু করে,

-মরে গেলাম দাদা, একেবারে পানি বের হচ্ছে।

দিপু রেগে যায়, খেতে খেতে দিনানাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে বলে,

-অ্যা্রে ভাই, খাওয়ার সময় আজে বাজে কথা কইয়েন না; খাইতে দ্যান।

-অ। সরি ব্রাদার।

তারপর দিনানাথ বাবু রফিককে উদ্দেশ্য করে বলে,

-দাদা আপনি তো সকালবেলা চা খেতে বাইরে যান, তখন গোটা পাঁচেক স্যালাইন নিয়ে আসেন।

রফিকও খেতে খেতে বিরক্তবোধ করে। সংক্ষেপে নিয়ে আসবে বলে মাথা ঝাঁকায়।

আজ সকালেই বেশ রোদ উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে আজ গরমে ঢাকা শহর জিহ্বা বের করে ফেলবে। মেস থেকে বের হয়ে মোড়ে চা খেতে আসে রফিক। হোটেলে রফিকের বাকির খাতা খোলা আছে, সবাই খুব ভাল করে চিনে এখানে ওকে। তাই কোন কিছু অর্ডার না দিলেও ঠিকই চা চলে আসে টেবিলে। রফিক চায়ে চুমুক দিয়েই চোখ মুখ বিকৃ্ত করে ফেলল, তিতকুটে স্বাদ চায়ের। হোটেল বয়কে ডাক দেয় সে।

-এটা কি চা দিয়েছ? তিতায় খেতে পারি না। চিনি দিয়ে আন।

-তিতা হইছে? নতুন কইর‍্যা বানায়া দেই ভাইজান।

রফিক মাথা নাড়ে। হোটেল বয় চায়ের কাপটা নিয়ে হোটেলের পিছনে গিয়ে হাঁক দেয় নতুন একটা চায়ের কাপে নতুন চা দিতে। এই হোটেল বয়টার নামও রফিক, সবাই ডাকে রফিক্ক্যা। রফিকের আগে এ নিয়ে সংকোচবোধ করত কিন্তু এখন আর হয়না। আরো দশটা মানুষের নাম রফিক হতেই পারে।

চা খেতে খেতে ওলির কথা মনে পড়ে রফিকের। সেদিন বাসাবোর বৌদ্ধ মন্দিরের মোড় থেকে তুরাগ বাস করে রামকৃঞ্চ মোড়ের কাছে নেমে গিয়েছিল। সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে মতিঝিল, কমার্শিয়াল এলাকা; রাস্তার ভাসমান হোটেলগুলোর একটিতে দুপুরের খাওয়া খেয়ে ফেলে। মেসে দুপুরের মিল কেটে দিয়েই এসেছিল। অবশ্য মেসে খেলে খরচ হত পঁচিশ টাকা, এখানে পঁয়ত্রিশ। দশ টাকার জন্যে মনটা খচখচ করতে থাকে রফিকের।

রফিক এমনিতেই একটু ভুলোমনের। দুপুরের খাবার খেতে খেতে ওর হঠাৎ মনে পড়েছিল, আজ ওলির সাথে আড়াইটার দেখা হওয়ার কথা। খাবার শেষ করেই শাহবাগের বাসে করে শাহবাগ চলে গিয়েছিল সে। কথা দিয়ে না রাখতে পারলে ওলি ভীষন রাগ করে। টিএসসিতে গিয়ে রফিক যখন ওলিকে খুঁজে বের করল তখন দুইটা বেজে একচল্লিশ মিনিট।

-এগার মিনিট লেট।

-ও আচ্ছা।

-ও আচ্ছা মানে কি?

-মানে লেট হয়েছে, সরি।

-হুম। সারাদিন তো টো টো করে ঘুরেছ, দেখেই বুঝা যাচ্ছে।

রফিক হাসে। বলে,

-আজ সকালে গোসল করে বের হইনি।

-খাটাশ।

রফিক আবারো হাসে। বলে,

-আজ তোমাকে শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছে।

-হুম, দেখতে তো পাচ্ছি; ট্যাঁরার মত তাকিয়ে আছ তখন থেকে।

-শুধু আমি? আশে পাশে দেখেছ? যেই যাচ্ছে সেই মুখ হা করে তাকিয়ে আছে।

এবার ওলি মুচকি করে হাসে। বলে,

-তাকালেই কি? আর তোমার তো গর্ব করা উচিত, সবাই তোমার প্রমিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।

-হুম। অন্যকে দেখিতে দিতে চাই না প্রিয়তমা, শুধু নিজ চোক্ষে দেখিবার চাই।

-ই, কবি আসছে।

রফিক হাসে। এক মিনিট দুজনেই চুপ থাকে। দুজন দুজনের তাকিয়ে যেন সময়টাকে উপভোগ করে তারা। ওলি বলে,

-তোমাকে হাজারবার বলেও একটা মোবাইল নেওয়াতে পারলাম না, আমি তোমার কোন খবর নিতে পারিনা। কত টেনশনে থাকি জান?

-টেনশন? কিসের টেনশন? মোবাইল আমার ভাল লাগে না, বাড়তি বোঝা। তোমাকে বাইরে থেকে কল করি সেটাই ঢেড় ভাল।

-কি টেনশন বুঝ না? বুঝবেও না, তোমার সেই অনুভূতি আছে নাকি?

-জ্বী ম্যাডাম, তো আমি কি করতে পারি?

রফিক দুষ্টমি করার চেষ্টা করে। হঠাৎ ওলি হাতের প্যাকেটটা উপরে তুলে বলে,

-ও ভুলেই গিয়েছিলাম, তোমার জন্যে একটা গেঞ্জি কিনেছি।

-কি কিনেছ?

-গেঞ্জি।

-কেন?

-তুমি পড়বে।

-না।

-না কেন?

-এমনি।

-তার মানে তুমি নিবে না?

-না।

-আমি শেষবারের মত বলছি, নিবে কিনা?

-বললাম তো না।

-ঠিক আছে।

ওলি সাথে সাথে চোখ মুখ শক্ত করে সোজা গাড়িতে গিয়ে উঠে। রফিকের কোন কথাতেই পেছন ফিরে তাকায়নি আর।

চা শেষ হয়ে গেছে। তারপরও চুপচাপ বসে থাকে রফিক। আজকে একটা কল দিতে হবে ওলিকে, ভাবে রফিক। তলপেটে চাপ পড়তেই উঠে পড়ে রফিক, হোটেল থেকে বের হয় আসে; পাশের ফার্মেসি থেকে কয়েকটা স্যালাইন কিনে মেসের উদ্দেশ্যে দ্রুত পায়ে এগোয়।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to ধারাবাহিকঃ নিশিযাত্রা (পর্ব ৪)

You must be logged in to post a comment Login