জুলিয়ান সিদ্দিকী

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: শেষ কাতারের মানুষ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

খাল কিংবা গাঙ যখন মরে যায় তখন সে জমির ওপর রেখে যায় তার অস্তিত্বের ছাপ। জায়গাটা মাটি ফেলে ভারাট করে ফেললেও সেখানকার ঘাস বা গুল্ম-লতাপাতা জাতীয় গাছ-গাছড়াতেও লক্ষ্য করা যায় ভিন্নতা। আশপাশে জন্মানো উদ্ভিদরাজির ভিড়েও তাকে সনাক্ত করা যায় আলাদা ভাবে। তেমনি আমাদের সমাজেও কিছু কিছু মানুষ থেকে যায় যারা সবার সঙ্গে মিশে থাকলেও তাদের হাবভাব কর্মকান্ড এমনকি কথাবার্তা আর চলন-বলনেও ফুটে ওঠে খানিকটা ভিন্নতা। তাদের দিকে লোকজনের দৃষ্টিও থাকে খানিকটা তীর্যক কিংবা তেরছা। অকারণেই তারা শিকার হয় নানামূখী প্রতিযোগিতার। নিজের অজান্তেই তারা হয়ে পড়ে অন্যান্যদের জন্য অনুকরণীয়। কিন্তু যদিও তাদের সবাই অনুকরণ করতে চায় তা কখনো গোপন করাটা কারো কারো পক্ষে খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। আর ব্যাপারটি যখন প্রকাশ হয়ে যায় তখনই ওরা গণ্য হয় শত্রু শ্রেণীর। ধীরে ধীরে জন্ম হতে থাকে শ্রেণী বিদ্বেষ। যে কারণে এমনতর শ্রেণী বিদ্বেষের পথ ধরেই এগিয়ে আসে আরো অন্যায় অপরাধ আর অনাচার। কিন্তু মনেতে হাজারো সাধ থাকলেও সাধ্যের বা ক্ষমতারও একটি ব্যাপার থেকে যায় প্রচ্ছন্নভাবেই। আর তা আয়ত্ব করতে গিয়েই মানুষ আশ্রয় নেয় চাটুকারিতার। চাটুকার নিজেও জানে না যে, চাটুকারী করতে করতে কখন সে মনে প্রাণেও মোসাহেবে পরিণত হয়েছে।

এ কথা নিশ্চিত বলা যায় একজন চালাক মানুষ আর একজন সহজ সরল মানুষের ভেতর চিন্তা-ভাবনা আর পরিকল্পনাতেই বিস্তর পার্থক্য গড়ে ওঠে। যে কারণে একজন সাধারণ সহজ সরল মানুষের পক্ষে যা অনায়াসে করে ফেলা সম্ভব একজন চালাক বা মোসাহেব শ্রেণীর লোকের পক্ষে তা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে ওঠে। যা তার জটিল চিন্তা-ভাবনারই কুফল বলা যায়। মোসাহেব সমালোচনা জানে না। বিচার-বিশ্লেষণ জানে না। সে কেবল বলতে পারে ঠিক ঠিক! অতি উত্তম! তেমনি এই শিবপুর গ্রামটিতেও নানাবিধ মানুষের বাস সেই প্রাচীন কাল থেকেই। মানুষের প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে তেমনিই নানা ধরনের পেশা। আর গ্রামাঞ্চলের যাবতীয় পেশার ভেতর সব চাইতে সহজ পেশা হচ্ছে কথা বিক্রির পেশা। এ পেশায় নিয়োজিত হতে তেমন কোনো আর্থিক পুঁজির প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন কেবল খানিকটা তোঁয়াজ-তোষামোদ করে কথা বলার কৌশল আয়ত্ব করা। অবশ্য কালাম মাঝি কৌশলটা যেভাবে আয়ত্ব করেছে তার চেয়ে আরো ভালো আয়ত্বে আছে লোকজনকে কেমন কৌশলে নানাবিধ ফাঁদে ফেলে নিজের কার্যোদ্ধার করবে। সে যে এ কাজে প্রতিবারই সফল হয় তা কিন্তু নয়। কখনো কখনো তার যাবতীয় পরিকল্পনা পর্যবসিত হয় ব্যর্থতায়। তখন সে বিপুল উদ্যমে মস্তিষ্ক ক্ষয় করতে থাকে নতুন কোনো পরিকল্পনার পেছনে।

কালাম মাঝির কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, নৌকা চালানো তার পেশা নয়। এমনকি তার পূর্বপুরষের কেউ এ কাজটি করেছে বলে জানা নেই। কিন্তু কালাম মিয়ার নামের সঙ্গে মাঝি কথাটা জুড়ে যাওয়ার পেছনে একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। আর সে ইতিহাসটুকুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরো নানাবিধ অপকর্ম। পাপ-পঙ্কিল-দুর্গন্ধময় ঘটনাবলীর ঘনঘটা।

উনিশশো একাত্তরের সেই উত্তপ্ত দিনগুলোতে কালাম মিয়ার দিন কেটেছে মহা আনন্দে। যদিও তার কর্মকান্ড ছিলো রাজাকারের। কিন্তু অদ্যাবধি কথাটা সে কারো কাছে শিকার করেছে বলে জানা যায়নি। কিন্তু ঘটনা যে সত্য এ গ্রামের অনেক প্রবীণ সাক্ষী দিতে পারবেন তার সামনেই। তাদের সাক্ষ্যর প্রতিবাদ করতে সে পারবে না। কিন্তু প্রতিবাদ করতে না পারলেও সে চেষ্টা করে ঘটনার খাত অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে। যেমন আজকাল মতিউর রহমান নিজামি কিংবা মুজাহিদ গং প্রকাশ্যে ঘোষনা দিয়ে বেড়াচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তাদেরও অবদান আছে। যুদ্ধ করে তারা বাংলা দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। কোনোদিন হয়তো শোনা যাবে ওই পাপিষ্ঠরা বার নাম্বার আর তের নাম্বার সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলো। ইতিহাসও লেখা হবে সে অনুযায়ী। কারণ আমাদের দেশে বা সমাজে মোসাহেব লোকের তো আর অভাব নেই। নিজের স্বার্থোদ্ধারে হেন কাজ নেই তারা করতে রাজি হবে না।

কালাম মিয়ার সখ্যতা যখন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মন্নান মোল্লার সঙ্গে কাঁঠালের আঠার মতই জড়িয়ে গিয়েছে, তখনই কোনোভাবে পাক হানাদারদের ক্যাপ্টেন আজগর খানের কানে গিয়েছিলো যে কালাম মিয়ার বউ যেমন সুন্দরী, আশপাশের দুচার গ্রামে দেখা পাওয়া ভার। আর তা শোনার পরই আজগর খান খবর পাঠিয়েছিলো তার বউকে নিয়ে যেতে। শোনা যেতো মন্নান মোল্লার বউ আর মেয়ে রাত বিরাতে বাজারের পাকসেনাদের ক্যাম্পে আসা যাওয়া করে বোরখা পরে। সেখানে তাদের কী এমন কাজ থাকতে পারে তা ভেবে পায়নি কালাম। বর্ষাকাল ছিলো বলে, কালাম মিয়া তার বউ জরিনাকে নিয়ে ক্যাম্পে যাওয়ার বদলে পালানোর চেষ্টায় ভিন্ন পথ ধরেছিলো। গর্ভবতী জরিনাকে পাশের দুটো গ্রাম পর ছনখোলা নামক গ্রামটিতে তার মামার বাড়ি রেখে আসতে পেরেছিলো সেদিনই। কিন্তু ফিরে আসার সময়ই সে মুখোমুখি হয় মন্নান মোল্লার সঙ্গে। কিন্তু নৌকায় ঘাপটি মেরে বসেছিলো ক্যাপ্টেন আজগর। কালাম মোল্লাকে দেখতে পেয়েই ক্যাপ্টেন তাকে ডেকেছিলো মাঝি বলে। সঙ্গে সঙ্গে মন্নান মোল্লাও বলেছিলো, এই মাঝি তর বউ কিধার ভাগ গিয়া?

কালাম জানিয়েছিলো, তাকেই সে খুঁজতে বেরিয়েছে নৌকা নিয়ে। সেদিন থেকেই তার কাজ হয়েছিলো রাতের অন্ধকারে নৌকায় করে পাক হানাদারদের বিভিন্ন গ্রামে নিঃশব্দে পৌঁছে দেয়া। হয়তো ইচ্ছে করলে সে পালিয়ে যেতে পারতো যে কোনো সময়। কিংবা পালিয়ে গিয়ে সে যোগ দিতে পারতো মুক্তি যুদ্ধে। এ গ্রামের অনেকেই আক্কাস শাজাহান আর রুসমত আলির মত সে সময় মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ত্রিপুরা দিয়ে ভারতে ঢুকেছিলো। কিন্তু কালাম মাঝি পাক হানাদারদের যে গ্রামেই নামিয়ে দিতো সে গ্রামেই আগুন জ্বলে উঠতে দেখেছে। তাদের বন্দুকের এলোপাথারি গুলিতে নির্বিচারে মানুষ মরতে দেখেছে। কখনো বা মেয়েদের নিয়ে টানা-ঁেহচড়া হতেও দেখেছে। সে অবসরে কালাম মিয়া ঘরের ভেতর টাকা-পয়সা আর সোনাদানা হাতিয়ে বেড়িয়েছে।

তার দিন দিন ভালোই চলছিলো। মনে হতো এ এলাকায় সেই যেন একচ্ছত্র অধিপতি। যাকে যখন খুশি ধরে নিয়ে আসতে পারে। যে নারীকে যখন খুশি করায়ত্ব করতে পারে। দিনে দিনে তার নামের সঙ্গে নানাবিধ অপকর্মের কথা জড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মাঝি কথাটিও জড়িয়ে গিয়েছে। যদিও মাঝি কথাটা শুনতে তার ভালো লাগে না। স্বাধীনতার পর এ গ্রামেরই আক্কাস শাজাহান আর রুসমত আলি তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে মারতে চেয়েছিলো। কিন্তু একই গ্রামের মানুষ বলে, অন্যান্য মুরুব্বীরা, বয়স্কা নারীরা তাকে প্রাণে মারতে নিষেধ করেছিলেন বলে প্রাণে বেঁচে গেছে সে। কিন্তু প্রাণে বাঁচলেও আসলে সে জ্যান্তই মরে আছে। মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে এলে প্রথম সে আত্মগোপন করেছিলো কিছুদিন। বঙ্গবন্ধু যখন সাধারণ ক্ষমা ঘোষনা করলেন তখনই পরিস্থিতি বুঝে সে ফিরে এসেছিলো। কিন্তু শিবপুর গ্রামের মানুষ তার কর্মকান্ড বিস্মৃত হয়নি। যার ফলে, জুতোর মালা গলায় দিয়ে তাকে পুরো গ্রামে হাঁটানো হয়েছিলো ন্যাংটো করে। জুম্মা মসজিদের সামনে মাটিতে থুতু ফেলে তা চাটতে বাধ্য করা হয়েছিলো। নাক খত দিয়ে তাকে যেতে হয়েছিলো একশ হাত। আজও তার নাকে সে চিহ্ণ লেপ্টে আছে। যার ফলে মাঝি বলে কেউ ডাকলে তার মনে পড়ে যায় দূর অতীতের লজ্জাকর মুহূর্তগুলোর কথা।

যদিও সে অনেকবারই বলেছে যে, সে তার পাপের শাস্তি পেয়েছে। তার অপরাধের বিচার করা হয়েছে। তবুও কেন তাকে মাঝি বলে ডাকা হয়?

রুসমত আলি রহস্যের হাসি হেসে বলেছিলেন, মাঝি কইলেইত্ত তর মনে পড়বো যে, যুদ্ধের সময় কি কি আকাম-কুকাম করছিলি। যেই পাপে তুই নাকে খত দিছিলি। জুতার মালা গলায় নিয়া ল্যাংটা হইয়া সারা গ্যারামে হাঁটছিলি। মছিদের সামনে ছ্যাপ চাইট্যা খাইছিলি। মনে কর এইডাও তর এক রকম শাস্তি! যতদিন বাঁইচ্যা থাকবি, ততদিন তর এই কথা মনে পড়বো।

রুসমত আলি বেঁচে নেই। কিন্তু আজও এ কথা কেউ কেউ তাকে মনে করিয়ে দেয়। যদিও কেউ ভুলেও মনে করিয়ে না দিতো তাহলে হয়তো সে নিজেই ভুলতে পারতো না কখনো।

কালাম মাঝির মাঝে মধ্যে মনে হয় অপমানে অপমানে তার জীবনটাই বলতে গেলে ধবংস হতে চললো। কিন্তু উপায় তো নেই। বয়সও দিন দিন ভাটির দিকেই যাচ্ছে। না হলে সেন বাড়ির কালিমন্দিরের মেঝে খুঁড়ে লুকিয়ে রাখা স্টেনগানটা নিয়ে এসে একদিন এলোপাথারি গুলিতে গ্রামটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারতো। তখন তার অতীত কর্মকান্ড নিয়ে আর কেউ কিছু বলতে সাহস পেতো না। কোথাও উচ্চারিত হতো না তার গলায় জুতার মালা নিয়ে ন্যাংটো হয়ে সারা গ্রাম হাঁটার কাহিনী।  মসজিদের সামনে নাকে খত দেয়া কিংবা থুতু চেটে তোলার কাহিনিও। মসজিদেও তাকে নামাজের সময় দাঁড়াতে হতো না শেষ কাতারে। শওকত মিয়ার মত কোনো মুক্তিযোদ্ধাও মসজিদে ইমামতি করতে পারতো না। সে হয়ে উঠতে পারতো এ শিবপুর গ্রামের একচ্ছত্র অধিপতি। কলঙ্কিত অতীতের কারণে এ পর্যন্ত তার মেয়ে ফাতেমার জন্য কোনো পরিবার থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসেনি। মেয়েটা হয়তো শেষপর্যন্ত অবিবাহিতই থেকে যাবে। বেঁচে থেকে হয়তো একমাত্র কন্যার সুখ দেখে যেতে পারবে না সে। বেশ কয়েকবারই সে চেষ্টা করেছিলো গ্রামের লোকজনের সঙ্গে সদ্ভাব করতে। বিভিন্ন উৎসব পার্বণের ছুতোয় বিভিন্ন জনকে নিমন্ত্রণ করেও সুফল পায়নি। তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এ পর্যন্ত কারো পা পড়েনি তার বাড়িতে।

যাবতীয় গ্লানি আর ব্যর্থতার হাহাকার কালাম মাঝির মন যেন অমাবস্যার অন্ধকারে ঢেকে ফেলে। মনের দুঃখে মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হয় কালাম মাঝির। ইচ্ছে হয় ধান ক্ষেতে ছিটানোর জন্য শিশি ভর্তি যে বিষ পাওয়া যায়, তাই একদিন কিনে এনে ঢক ঢক করে পুরো শিশির বিষ গিলে ফেলে। কিন্তু মরার কথা ভাবলেও ভয়ে তার কলজে যেন শুকিয়ে যায়। তখনই তার স্মৃতিতে ঝাঁকে ঝাঁকে সদ্য পাখা গজানো উঁইয়ের মতই উড়ে আসে নিপীড়িত মানুষের যাবতীয় ঘৃণা মাখা কীর্তিকলাপের ছবি। দুঃস্বপ্নের মত ছেঁকে ধরে তাকে। মরে যাওয়ার কথাও তখন ভাবতে পারে না সে।

আজও কখনো কখনো বাঁশবাড়ি গ্রামের নুরালির আর্তনাদ তার কানে ভেসে আসে। চিৎকার করে বলা তার অভিশাপের বাণীগুলো মস্তিষ্কের কোষে কোষে ঝনঝন করতে থাকে। অবশ্য নুরালির তেমন কোনো দোষও ছিলো না। দোষ যেটা ছিলো, তা হলো তার আর্থিক অবস্থা। সিন্দুক ভর্তি থরে থরে সাজানো টাকা নাকি অনেকেই দেখেছে। আর তাই তার জন্য কাল হয়েছিলো। রাতের অন্ধকারে যখন পাক সেনাদের নিয়ে নুরালির বাড়িতে হাজির হয়েছিলো কালাম মাঝি, তখন তার পা চেপে ধরে নুরালি কেঁদে উঠে বলেছিলো, ভাই আমার সিন্দুকে যত ট্যাকা-পয়সা সোনাদানা আছে নিয়া যা। তাও আমারে জানে মারিস না!

কালাম মাঝির মনে নুরালির আর্তনাদ কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। অন্যান্য পাক সেনারা ঘরে ঘরে গিয়ে অন্য কিছু খুঁজছিলো। মেয়েদের আর শিশুদের চিৎকার ভেসে আসছিলো। কালাম মাঝি নুরালির মাথায় বন্দুকের নল তাক করে বলেছিলো, মনে আছে নুরালি, আমারে তুই কইছিলি ফকিন্নির পোলা। আমার বাবায় তর বাবার বছর কামলা আছিলো। আমরা গুষ্ঠিশুদ্ধা নাকি তগ পাও চাটছি। অহন দ্যাখ কে কার পাও চাটে।

নুরালি প্রাণের মায়ায় হামলে পড়েছিলো কালাম মাঝির পায়ে। কিন্তু কালাম মাঝি নির্বিকার ভাবে অতীতের অপমানের শোধ নিতেই নুরালির বুকে গুলি করেছিলো।

মরার আগে নুরালি তাকে অভিশাপ দিয়ে বলেছিলো, একদিন তুইও মরবি বছর কামলার ব্যাটা। মরার সময় তর জানি দুই ফোঁটা পানিও না জোটে।

তারপরই নুরালির কোমর থেকে চাবির গোছা নিয়ে সিন্দুক খুলে যা পেয়েছে সবই একটি পুটলি বেঁধে নৌকার গুলুইয়ের নিচে লুকিয়ে রেখে কালাম মাঝি নিজের হাতে  কেরসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো নুরালির ঘরে। এ ঘর ওঘর করে পুরোটা বাড়িই আগুনে আগুনে লাল হয়ে উঠেছিলো।

আজকাল মাঝে মধ্যেই মনে হয় অন্ধকারে বেরুলেই বুঝি নুরালির আত্মা এসে তার গলা টিপে ধরবে। যে কারণে সন্ধ্যার পর সে পারত:পক্ষে ঘর থেকে বের হয় না।

তার হাতে আর তার দৃষ্টির সামনে যাদের যাদের মৃত্যু হয়েছে তারা যেন সন্ধ্যা নামলেই চারদিক থেকে তার বাড়িটিকে ঘিরে ধরে। সে যেন শুনতে পায় তাদের রাগত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলেও কালাম মাঝির ইচ্ছে হয় না অজু করতে। ইচ্ছে হয় না নামাজ পড়তে। যদিও তার মাথায় সারাক্ষণই একটি টুপি থাকে। মাথায় টুপি, গায়ে লম্বা কোর্তা আর ঘন লম্বা দাড়ি দেখলে অচেনা মানুষ তাকে নিয়ে ভুলেও কোনো সন্দেহ পোষন করবে না।

ফাতেমা হয়তো রান্না শেষ করেছে। ঘরের ভেতর হাঁড়ি পাতিলের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো কালাম মাঝি। আজকাল তার খেতে তেমন ইচ্ছেও হয় না। কিন্তু ফাতেমার মুখের উপর কখনোই বলতে পারে না যে খাবে না। এমনিতেই সে মেয়েটার সামনে সারাক্ষণ ছোট হয়ে আছে। তারই পাপে আর কুকীর্তিতে মেয়েটার ভাগ্য ম্লান হয়ে গেছে বলে মাঝে মধ্যে বেশ আক্ষেপ হয় তার। কিন্তু তাই বলে তার কোনো অনুতাপ বোধ মনের ভেতর তেমন কোনো ব্যাপক ক্রিয়া করে বলে মনে হয় না। নয়তো তার চরিত্র আর মানসিকতা এখনো রয়ে গেছে রাজাকারের মতই।

ফাতেমা ঝাঁপের আড়াল থেকে বলে, আব্বায় নমাজ পড়ছেন?

কালাম মাঝি অজুও করেনি। নামাজও পড়েনি। কিন্তু হ পড়ছি! বলেই বুঝতে পারলো কথাটা মিথ্যে হয়ে গেল। তবে এ জন্যে সে তেমন একটা গ্লানি বোধও করে বলে মনে হয় না। যেমন গ্লানি বোধ করে না একাত্তরে নির্বিচারে অন্যায়-অপরাধে নিমজ্জিত থাকার কারণেও।

হ্যারিকেনের লালচে আলোয় কালাম মাঝি পাটি বিছিয়ে খেতে বসলে ফাতেমা বললো, আপনেরে না কইসিলাম টর্চ বাত্তির ব্যাটারি আনতে!

কালাম মাঝি এক হাতে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতে হাওয়া করতে করতে বললো, মারে, আমার একদম মনে আছিলো না। আইচ্ছা কাইল আইন্যা রাখমু!

একটি কাচের বাটিতে করে তরকারি এগিয়ে দেবার সময় হ্যারিকেনের আলোয় ফাতেমার গলায় ল্যাপ্টানো সোনার হারটি চিকচিক করে উঠলে কালাম মাঝির দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধিত হয়। মোটামুটি ভারি হারটির ওজন কম করে হলেও দু’ভরি হবে। আজকাল সোনার দাম যে হারে বাড়ছে। এখন কিছুতেই এমন একটি হার সে ফাতেমাকে কিনে দিতে পারলেও মন থেকে সায় পেতো না। তার ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। একাত্তরে এ দেশে যুদ্ধ হয়েছিলো। নয়তো সে যেমন বছর কামলার ব্যাটা ছিলো, এখনও হয়তো তাকেও কারো বাড়িতে বছর কামলা হয়ে কাল কাটাতে হতো। দেশে যুদ্ধ এসেছে বলেই না সে খানিকটা টাকা-পয়সা আর সোনাদানা সংগ্রহ করতে পেরেছিলো। আর অমন মূল্যবান সম্পদ আছে বলেই শেষ বয়সের জন্য তেমন কোনো দুশ্চিন্তা তার মাথায় আসে না।

কালাম মিয়া প্রথম যেদিন ক্ষেতের কাজ সেরে সিকদার বাড়িতে খেতে গিয়েছিলো, সেদিনই সে বাড়ির মেজ সিকদারের ছোট বউ আয়শার গলায় এ হারটি দেখতে পেয়েছিলো সে। আয়শাকে প্রথম দেখে সে যেন পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিলো। তখনই আয়শা তার বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে খানিকটা হেসেছিলোও যেন। সেটা প্রশ্রয়ের না তাচ্ছিল্যের তা বুঝতে পারেনি কালাম। যুদ্ধের সময় সিকদার বাড়ির পুরুষরা যখন পালিয়ে যায়। বড় আর মেজ সিকদার যখন মুক্তি বাহিনীতে যোগ দেয়ার কথা শোনা যায় তখনই একদিন তাদের বাড়ি গিয়েছিলো কালাম মাঝি। সন্ধ্যার দিকে আয়শার সঙ্গে ভাব জমাতে চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু তাকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি আয়শা। তার কোনো কথার জবাব না দিয়ে ঘরে গিয়ে ভেতর থেকে খিল এঁটে দিয়েছিলো।

সে আক্রোশও হয়তো তার ভেতরে ঘাপটি মেরেছিলো। একদিন তাই সুযোগ বুঝে সে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো আয়শার ওপর। কিন্তু আয়শা ছিলো দুর্দান্ত সাহসী আর শক্তিময়ী মেয়ে। তার সঙ্গে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে কালামের মনে হয়েছিলো আয়শা যেন ঠিক পুঁথিতে পড়া সোনাভানের মতই। কিংবা সোনাভানই বুঝি ছিলো আয়শার মত। কিন্তু আয়শা হঠাৎ ঘরের বেড়ায় গুঁজে রাখা কাটারিটা হাতে নিতেই কালাম সরে এসেছিলো নিরাপদ দুরত্বে। মিলিটারির ভয় দেখালে আয়শা যেন নাগিনীর মতই ফুঁসে উঠে বলেছিলো, দরকারে এই জান কুরবানি দিয়া দিমু তাও আমারে আর ছুইতে পারবি না গোলামের ছাও!

কালাম কিছু বুঝে উঠবার আগেই আয়শা নিজের পেটে চালিয়ে দিয়েছিলো কাটারিটা। মুহূর্তেই পেটের মাঝ বরাবর দুভাগ হয়ে নাড়ীভুড়ির কিয়দংশ বেরিয়ে এসেছিলো। আয়শা পড়ে গিয়েছিলো মেঝেতে।

কালাম বলেছিলো, খালি খালি ক্যান জীবনডা নষ্ট করলা। আমি থাকলে পাঞ্জাবীরা তোমার দিকে চোখও তুইল্যা চাইতো না!

তখনই আয়শা একদলা থুতু কালামের মুখে ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলো, শুওরের জাগা খাটালে। তুই আমার যেই সর্বনাশ করছস মরার কালে জানি তর জানাজা না হয়, দাফন-কাফন না হয়।

তারপরই অল্প সময়ের ভেতর স্থির হয়ে গিয়েছিলো আয়শার দেহ। কালাম মৃত আয়শার গলায় সোনার হারটি চকচক করতে দেখে তার মাথা গলিয়ে সেটিকে অক্ষত অবস্থায় খুলে নিয়ে কোমরে গুঁজেছিলো। সেই সঙ্গে ঘরের ট্রাংক আর বাক্স-পেটরা খুঁজে খুঁজে আরো ক’টি সোনার চুড়ি আর তাবিজ পেয়েছিলো। ভেবেছিলো জরিনাকে বিয়ের পর কোনো গয়না তৈরী করে দিতে পারেনি। এবার সে তার গলায় আর হাতে নিজেই পরিয়ে দেবে এ অলঙ্কারগুলো। কিন্তু কথায় বলে পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। পরদিন সন্ধ্যা নাগাদ নৌকা বেয়ে ছনখোলা পৌঁছেই সে জানতে পারে যে সপ্তাহখানেক আগে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলো জরি না। কিন্তু অবনী ডাক্তারকে বাজার থেকে পাক বাহিনীর লোকেরা ধরে নিয়ে যাওয়ার ফলে আশপাশের গ্রামে চিকিৎসা করার মত কেউ নেই। যার ফলে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে জরিনা।

তখন তার চোখ পড়েছিলো শিশু ফাতেমার ওপর। জরিনার ভাইয়ে বউয়ের কোলে বেশ শান্তশিষ্ট হয়ে ঘুমুচ্ছিলো। তারপর সে ভেবেছিলো মেয়েটি বড় হলে তার বিয়ের সময় গয়নাগুলো দেবে।

দিনে দিনে মেয়েতো বড় হলো। বড় হতে হতে প্রায় বুড়িয়ে যেতেও বসলো কিন্তু গয়না দিয়ে সে কাকে সাজাবে? আরো গয়নার যেগুলো সে তার খাটের নিচে মেঝেতে লুকিয়ে রেখেছে সেখান থেকে বেছে বেছে ভালো আর সুন্দরগুলো দিয়ে মেয়েকে মনে মনে সাজালেও কিন্তু বাস্তবে তা আর হলো কই। এ পর্যন্ত মেয়ের বিয়ের কোনো সম্বন্ধই এলো না।

কালাম মাঝির বুক বিদীর্ণ করে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে হঠাৎ। যা শুনে চমকে উঠে পিতার দিকে তাকায় ফাতেমা।

কালাম মাঝি নির্বিকার ভাবে খেয়ে চলেছে। চেহারায় দীর্ঘশ্বাসের কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। তবুও বলে, আব্বায় কি হুনছেন শওকত মিয়া মইরা গেছে!

কালাম মাঝি খাওয়া ভুলে চমকে উঠে বললো, কোন শওকত?

ফাতেমা বললো, মুক্তি শওকত। মছিদের ইমামতি করতো।

তুই কার থাইক্যা হুনলি?

পানমতির কাছ থাইক্যা পান লইতাসিলাম, তহনই কইলো।

আজ বাড়ি থেকে বের হয়নি বলে কোনো সংবাদ পায়নি। কিন্তু মেয়ের মুখ থেকে খবরটা শুনে সুদীর্ঘকাল পর কালাম মাঝির বুক থেকে যেন পাষাণ ভার নেমে যাওয়ার মত আরাম বোধ হয়। এ গ্রামে আর কোনো মুক্তি জীবিত নেই। পথ চলতে কাউকে দেখে অকস্মাৎ তার উঁচু মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার মত ঘটনা আর ঘটবে না। তার মনে পড়ে, এই শওকত মুক্তি আর রুসমত আলি মিলে মন্নান মোল্লার চোখ দুটো নষ্ট করে দিয়েছিলো। চিকিৎসার অভাবে সেগুলো দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছিলো।

পালিয়ে থাকা কালাম মাঝি সাধারণ ক্ষমার সুযোগে গ্রামে ফিরে আসার সময় রেল স্টেশনে দেখা হয়েছিলো মন্নান মোল্লার সঙ্গে। মন্নান মোল্লাকে ভিক্ষে করতে দেখে প্রথম চমকে উঠেছিলো সে। তারপর কাছে এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি হতেই নিজের পরিচয় দিয়েছিলো ফিসফিস করে।

কালামের পরিচয় পেয়ে মন্নান মোল্লার মুখে একটি নির্ভাবনার হাসি ফুটে উঠেছিলো। তারপর সে তাকে জানিয়েছিলো যে, পাক সেনারা অর্জুন সেনের পাকা দালানের যে ঘরটাতে মাঝেমধ্যে খাওয়া-দাওয়া করতো, সে ঘরের উত্তর দিকের দেয়ালে ছাদের কাছে যে ঘুলঘুলিটা আছে তার ভেতর অনেকগুলো সোনার গয়না আছে। কালাম পারলে যেন সেখান থেকে খানিকটা বিক্রি করে কিছু টাকা-পয়সার ব্যবস্থা করে দেয়। টাকা পয়সা পেলে সে পাকিস্তান চলে যাবে। সেখানকার একজনের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছে। চোখের চিকিৎসা করাবে।

কালাম মাঝি তখন যেতে পারেনি সেখানে। অর্জুন সেনের বেঁচে যাওয়া ছেলে-মেয়েরা সে বাড়িতে বাস করছিলো। কিন্তু তাদের অবস্থা এখন আরো খারাপের দিকে। জমি-জমা যা ছিলো ভাগ-বাটোয়ারা করে যে যেমন পেরেছে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন বাড়িটাতে বিকাশ সেন আর তার বউ আছে কেবল। তবুও কালাম মাঝির সাহস হয় না সেদিকের পথ মাড়াতে। যদিও তাদের কেউ জানে না যে, খাল পাড়ে হাত-পা আর চোখ বাঁধা অর্জুন সেনকে কারা মেরে ফেলে রেখেছিলো। তবুও স্বাভাবিক ভাবেই সন্দেহটা কালামের দিকেই ধেয়ে আসার কথা।

তবে নিজের সঞ্চয় থেকে কিছু গয়না বের করে গোপনে বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা দিয়েছিলো মন্নান মোল্লাকে। টাকা পেয়ে মন্নান মোল্লা জানিয়েছিলো, সেন বাড়ির কুয়োর ভেতর দুটো বন্দুক, একটি পিস্তল আর আরো কিছু গয়নাগাটি আছে। পারলে সেগুলো সংগ্রহ করে পরে যেন সে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভাগ আধাআধি।

কালাম মাঝি জিজ্ঞেস করেছিলো, তুমি পাকিস্তান গেলে আমি তোমারে পামু কই?

আমি আবার ফিরা আমু। অন্য পরিচয়ে তর বাড়িতে গিয়া উঠমু। কেউ কিছু বুঝতে পারবো না।

তার কিছুদিন পরই শোনা গেল মন্নান মোল্লার স্ত্রী আম্বিয়া খাতুন আর মেয়ে রাবেয়া গ্রামে নেই। তাদের পরিত্যাক্ত ঘরবাড়ি আসবাবপত্র যেভাবে যেমন ছিলো তেমনিই পড়ে আছে। কেবল বসবাস করতো যারা তারাই নেই। এ নিয়ে শিবপুর এবং তার আশপাশের কয়েকটি গ্রামেও বেশ কানাঘুষা চললো। কিন্তু সঠিক সংবাদ কেউ বলতে পারলো না। যার ফলে মন্নান মোল্লার নিখোঁজ স্ত্রী-কন্যার নামে  নানাবিধ মুখরোচক কাহিনী ছড়াতে লাগলো মুখে মুখে।

শেষবার নাজিরপুরের কে একজন লম্পট লোক নাকি জানিয়েছিলো যে, নারায়নগঞ্জের টানবাজার বেশ্যাপল্লীতে ঠিক তাদের মতই দুজনকে নাকি দেখা গেছে। কিন্তু দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের উৎসাহেও ভাটা পড়তে থাকে। একদিন এসব গল্পও ধীরে ধীরে থেমে গেলেও হয়তো ঠিকই সঞ্চিত রয়ে যায় মানুষের স্মৃতি ভাণ্ডারের আনাচে-কানাচে।

এখনও যে পরিমাণ গয়না কালামের কাছে সঞ্চিত আছে তা দিয়ে সে অনেকদিন চলতে পারবে। শেষবার শেখ মুজিবকে যেদিন সপরিবারে মেরে ফেলা হলো, সেদিন খবরটা শুনতে পেয়ে আনন্দে পাগল হয়ে যেতে বসেছিলো সে। রাতের বেলা ফাতেমা ঘুমিয়ে পড়লে হ্যারিকেনের আলো কমিয়ে চারদিকের বেড়ায়  শাড়ি মেলে দিয়ে গয়নাগুলোকে মেপেছিলো। ছয় সেরের কিছুটা বেশি হয়েছে। মনেমনে বাজার দর হিসেব করে সে আমলেই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছিলো তার। আর এখন তো শোনা যায় সোনার বাজার আগুন।

মুক্তিযোদ্ধা শওকত মিয়ার মৃত্যুর সংবাদে চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগলো। শহর থেকেও অনেক বড় বড় মানুষ এসেছেন জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য। থানা থেকে পুলিশ এসে মৃত শওকত মিয়ার বুকের ওপর দেশের লাল-সবুজ একটি পতাকা বিছিয়ে দিলে সাতটি বন্দুক আকাশের দিকে মুখ করে গর্জে উঠলো। সেই সঙ্গে বেজে উঠলো পিতলের বিচিত্র কয়েকটি বাদ্যে করুণ সুর। দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাপারটা দেখলেও সামনে যেতে বা জানাজায় অংশ নিতে সাহস পেলো না কালাম মাঝি। বলা যায় না, কোনো দুর্মূখ যদি বলে বসে যে, মুক্তিযোদ্ধার জানাজায় কোনো রাজাকারের জায়গা নাই। সে ভয়ও তাকে এগোতে নিষেধ করেছিলো হয়তো।

মুক্তি যোদ্ধা শওকত মিয়ার দেহাবসানের পর কয়েকদিন পুরো গ্রামটি যেন স্তব্ধ হয়ে রইলো। কারো মুখে কোনো উচ্চ শব্দ বা অট্টহাসি শোনা গেল না। প্রতিটি মুসলমান ঘরেই শওকত মিয়ার রূহের মাগফেরাতের জন্য মেয়েরা-বউরা কোরআন খতম দিয়েছেন। বিশেষ ভাবে ঘরে ঘরে দোয়া পড়ানো হয়েছে। আর একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রতি মানুষের হৃদয় উৎসারিত স্বতস্ফুর্ত ভালোবাসার সুবাস মাখানো শ্রদ্ধা প্রকাশের ধরন দেখে কালাম মাঝির বুকের খাঁচা আরেকবার বুঝি বিদীর্ণ হতে বাকি থাকে।

পরবর্তী জুম্মার নামাজের দিনই গ্রামের পুরুষরা আরেকবার অনুভব করলো যে, শওকত মিয়া নেই। জুম্মার নামাজ পড়ানোর মত তেমন কেউ এগিয়ে এলো না। ফলে যার যেমন জোহরের নামাজ পড়েই বিদায় নিতে হলো।

একটি মসজিদে নামাজ পড়ানোর মত কোনো ইমাম নেই এ কথাটা মুসুল্লিদের শুনতে যেমন খারাপ লাগে তেমনি ইমাম ছাড়া একটি মসজিদের অবস্থানও খুব একটা শক্তপোক্ত বলে বিবেচিত হয় না বোধ হয়। তাই গ্রামের ধর্মপ্রাণ লোকজন বৈঠক করে ঠিক করলেন যে, গ্রামের মসজিদের জন্য একজন ইমাম নিযুক্ত করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সবার আত্মীয়-স্বজনদেরও খবর দিতে বলা হলো। কেউ এ গ্রামে জায়গীর থেকে যদি মসজিদের ইমামতির ভার নিতে চায় তাহলে ইমামের থাকা খাওয়া আর হাত খরচের ব্যবস্থা হবে চাঁদা তুলে। সবাই এতে সম্মতি দিলেও দু-চারদিনের ভেতর তেমন কাউকে পাওয়া যায় না। শেষটায় এক পঞ্চাশোর্ধ মৌলবি এসে উপস্থিত হলেন গ্রামে।

সংবাদ পেয়ে ইব্রাহিম মেম্বার ছুটে এসে মৌলবি সাহেবকে বাড়ি নিয়ে গেল। কথায় কথায় জানা যায় তার স্ত্রী-সন্তান ঘরবাড়ি এমনকি জমি-জিরাতও কিছু নেই। শৈশবেই পিতৃমাতৃহীন হয়ে চট্টগ্রামের কোনো একটি এতিমখানায় বড় হয়েছেন। সেখানকার কোনো জনবিচ্ছিন্ন পাহাড়ী এলাকার মাদ্রাসায় লেখাপড়া করে দেশে দেশে ঘুরছেন আর জায়গীর থেকে মসজিদে মসজিদে নামাজ পড়াচ্ছেন।

পিছুটানহীন মিষ্টভাষী মৌলবি সাহেবকে অপছন্দ করার কোনো কারণই খুঁজে পেলো না কেউ। সেদিন থেকেই চান মৌলবির ঠাঁই হলো ইব্রাহিম মেম্বারের বাড়িতে। খাওয়া-দাওয়াও তার ঘরেই হবে। এ নিয়ে গ্রামের কাউকে উদ্বিগ্ন হওয়ার দরকার নেই কথাটি বেশ গর্বের সঙ্গেই যেন প্রকাশ করে শিবপুর গ্রাম তথা রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইব্রাহিম।

মৌলভি সাহেব সুযোগ পেলেই নামাজ শেষ করে আরো কয়েকজন মুসুল্লিকে নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে যান। ধর্মের ওপর নানাবিধ মূল্যবান বয়ান রাখেন। এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে তিনি একদিন জোহরের নামাজ শেষে চলে আসেন কালাম মাঝির বাড়ি। অন্যান্য মুসুল্লিরা কালাম মাঝির ঘরে ঢুকতে আপত্তি জানালে মৌলবি সাহেব আরেক প্রস্থ বয়ান করেন। মুসলমান মুসলমানের সঙ্গে সদ্ভাব না রাখলে সে আর মুসলমান থাকে না। মোনাফেক হয়ে যায়। আর মৃত্যুর পর মোনাফেকের স্থায়ী নিবাস হবে জাহান্নাম।

মুসুল্লিরা বিভ্রান্ত হন। এর মাঝে জালাল শেখ বলে উঠলেন, মুনাফেক থাকলে থাকমু। তাও রাজাকারের লগে কোনো সমন্দ করমু না! এই বদমাইশরা মানুষ হয় না! সুযুগ পাইলেই পাল্টি খায়!

মৌলবি সাহেব হাসি মুখে বোঝান। আল্লার দুনিয়ায় সব মানুষই সমান। যে চোর তাকে কি ভালো হওয়ার সুযোগ দিতে নাই? ভালো হওয়ার সুযোগ না দিলে খারাপ মানুষ ভালো হবে কেমনে? ভালোবাইস্যা বুকে টাইন্যা না নিলে কি সে আমাদের সঙ্গে আসবে?

চান মৌলবির মিষ্টি কথায় জালাল শেখও বিভ্রান্ত না হয়ে পারেন না। তাই তিনি চুপ করে থাকেন। তার নিরবতায় মৌলবি সাহেব আবার বলে উঠলেন, মউত সবার কাছেই আসবে। আর মউতের পর আমরা সবাই যাইতে হবে মাটির নিচে। সেখানে কে রাজাকার কে মুক্তি কে মোল্লা কে মলবি, কে হাজি-গাজি তার কিছুই পরিচয় থাকবে না। তখন আমাদের নাম হবে মুর্দা। একটাই পরিচয়। কাজেই আল্লার রাস্তায় যখন বাইর হইছি, দিনের কাজে নামলে মনের কালো সাফ সুতরা কইরা নামতে হবে।

চান মৌলবির কথায় সবচেয়ে রাগি আর জেদি মানুষ বলে পরিচিত জালাল শেখও প্রায় বত্রিশ বছর পর কালাম মাঝির ঘরে প্রবেশ করলেন।

কালাম মাঝি দীর্ঘকাল পর নিজের ঘরে গ্রামের মানুষ দেখে অভিূত হয়ে পড়লো। জালাল শেখের হাত দুটো ধরে বলে উঠলো, আমি যে অন্যায় করছি, তার সাজাও পাইছি। তাও তোমরা আমারে মনের থাইক্যা মাপ করতে পার না!

জালাল শেখ নির্বিকার বসে থাকলেও মনে হয় কালাম মাঝির ওপর তার তেমন একটা ক্ষোভ এ মুহূর্তে নেই।

বুদ্ধিমতি ফাতেমা চট করে সবার জন্য তেতুল-গুড়ের শরবত বানিয়ে নিয়ে আসে। মাথায় লম্বা করে ঘোমটা দিয়ে একটি থালায় শরবতের গ্লাস সাজিয়ে এনে সবাইকে সালাম দিয়ে দাঁড়ায়।

মৌলবি সাহেব ফাতেমার দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, মাশাল্লা, মাশাল্লা!

তারপর কালাম মাঝির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাইয়াডা কি ভাইসাব আপনের? আদব কায়দা মাশাল্লা খুবই ভালো। এমন মাইয়া সব বাপ-মায়ের ঘরে হয় না।

ফাতেমা নিজের প্রশংসা শুনে শরবতের গ্লাস ভরা থালা তার বাবার পাশে রেখেই ঘরের ঝাঁপের আড়ালে গিয়ে অদৃশ্য হয়।

এ গ্রামটিতে প্রথম এসেই কেমন যেন একটি ঘোর লাগা অনুভূতি হয়েছিলো চান মৌলবির। প্রথম দর্শনেই গ্রামটিকে পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো তার। ইচ্ছে হচ্ছিলো এমন একটি সুন্দর গ্রামে যদি তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারতেন। এমন কি মৃত্যুর পর তার কবরটিও যদি এ গ্রামটিতেই হতো, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পেতেন। অনেক তো ঘোরাঘুরি হলো। জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই  ধর্মে-কর্মে আর জেহাদে বিলিয়ে দিয়েছেন। নিজের জন্য কিছু করারই সময় পেলেন না। কেবল আখেরাতের সঞ্চয় বাড়িয়েও তেমন কোনো শুভ ফলের সম্ভাবনা দেখছেন না। কারণ ইহ জগতের প্রধান কাজটিই তিনি এখনো অসম্পূর্ণ রেখেছেন। এ প্রসঙ্গে রসুল নির্দেশ করেছেন, যারা সামর্থ থাকা অবস্থায় বিবাহ করে না, তারা তানির দলের কেউ না। কথাটা ভাবতেই চান মৌলবির ভাবনা হয়। বিয়ে না হয় করলো। কিন্তু তার খাওয়া-পরা চলে অন্যের দয়ায়। বিয়ে করলে বউকেও কি এভাবে জায়গীর থাকার ব্যবস্থা  করে দিতে পারবেন? এমন কিছু একটা হলে কিন্তু মন্দ হতো না। কিন্তু তিনি শংকিত চিত্তে ভাবেন যে, রসুল কোন সামর্থের কথা বলেছেন? শারিরীক না আর্থিক? তখনই মাথায় ভিন্ন আরেকটি ভাবনা আসতেই তিনি প্রায় উত্তেজিত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লেন।

এত বড় একটি গ্রামে কোনো মক্তব বা মাদ্রাসা নেই। ছেলে-মেয়েরা আরবি না শিখলে ধর্ম-কর্ম করবে কিভাবে? ইসলামের বুনিয়াদ মজবুত হবে কিভাবে? আর এখানে যদি একটি মাদ্রাসা স্থাপনের কাজে সফল হন তো তার সঙ্গে লাগোয়া একটি ছোট্ট ঘরও করিয়ে নিতে পারবেন। আখেরাতের জন্য পূণ্য সঞ্চয় করতে মানুষ অনেক টাকাই খরচ করতে রাজি হয়ে যায়। এভাবে নিজের জন্য আলাদা থাকার জায়গা হলে বউকে খাওয়ানোর পথও বেরিয়ে যাবে। বাকি জীবন এ মাদ্রাসা আর মসজিদ আঁকড়েই এ গ্রামে স্থায়ী হয়ে যেতে পারবেন।

মৌলবি সাহেব পরের শুক্রবার জুম্মার নামাজ আরম্ভ করার আগে মুসুল্লিদের উদ্দেশ্যে বললেন, নামাজের পরে আপনেরা থাইকেন। একটা জরুরি বিষয় বয়ান করবো।

কেউ কেউ বললো যে, তাদের কাজ আছে।

মৌলবি সাহেব বললেন, বেশি কথা না। দুই চাইর মিনিট লাগবে।

নামাজের পর তিনি তুলে ধরলেন তার পরিকল্পনার কথা। আর কি আশ্চর্যের বিষয়, মসজিদে উপস্থিত সবাই প্রস্তাবটাকে সঙ্গে সঙ্গেই লুফে নিলো। এমন একটি ভালো কাজ আরো আগেই হওয়া উচিত ছিলো। বিগত বিশ বছর ধরে শওকত মিয়া এ মসজিদে ইমামতি করলেও মাদ্রাসা বা মক্তবের ব্যাপারে কখনোই ভেবেছেন বলে মনে হয় না। এ না হলে আরো আগেই এ গ্রামে একটি ছোটখাট মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা হয়ে যেতো।

কিন্তু কে কে এ উদ্যোগ নেবে তা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতে থাকা অবস্থাতেই একটি তাবলিগ জামাতের দল তাদের গ্রামের মসজিদে এসে আশ্রয় নিলো। তারা এখানে অবস্থান করবেন সাতদিন। তারপর কোনো একদিন সুযোগ হলে এক চিল্লা অর্থাৎ চল্লিশ দিন থাকার জন্য আসবেন।

তাবলিগের লোকজনের সঙ্গে মিশে গিয়ে চান মৌলবি সাহেব ইসলামের নানা বিষয়ে লোকজনকে অবহিত করেন। ফলে অনেক নতুন নতুন মুখ দেখা যেতে লাগলো মসজিদে। এ দলটি কেবল পুরুষদের নসিহত করেই ক্ষান্ত রইলো না। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে বা কয়েক ঘরের নারীদের কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘরে বসিয়ে বয়ান করতে থাকেন ইসলামকে আরো কতটা শক্তপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়। পর্দার সমস্যা হলে মেয়েদের শাড়ি টানিয়ে পর্দার ব্যবস্থা করা হয়। যার ফলে দলটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে কালাম মাঝিও। নামাজের সময় তাবলিগের লোকজন জ্যেষ্ঠ বলে তাকে টেনে সামনের কাতারে নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলেও পেছন থেকে কেউ প্রতিবাদ করে না আজকাল। কালাম মিয়াও সুযোগ বুঝে খানিকটা আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনের কাতারে বসে নামাজের অপেক্ষা করে।

ঘরে ঘরে গিয়ে মাদ্রাসা নির্মাণ কমিটি টাকা-পয়সা ধান-চাল তোলার পরিকল্পনা করলে চান মৌলবি জানান যে, গ্রামের সবাই একটি আবেদনে স্বাক্ষর করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে পাঠালেই সেখান থেকে মাদ্রাসা তৈরীর যাবতীয় ব্যবস্থা করা হবে। গ্রামবাসীর অযথা টাকা পয়সা খরচের প্রয়োজন নেই।

আসলে তাবলিগ জামাতের নাম দিয়ে জামাতে ইসলামের লোকজন দেখা করতে এসেছিলো কালাম মাঝির সঙ্গে। তাদের একজনের কাছেই খবর পাওয়া গেছে যে মন্নান মোল্লা সামনের মাসেই পাকিস্তান থেকে দেশে আসছে ভিন্ন পরিচয়ে। এসে এ মসজিদেই সে উঠবে। কালাম মাঝি যেন সময় মত তৈরী থাকে।

এদিকে চান মৌলবির সঙ্গে কালাম মাঝির সম্পর্ক দিন দিন গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে উঠছিলো। বলতে গেলে তার একমাত্র সুহৃদ মৌলবি সাহেব। কথায় কথায় মনের অশান্তি কথা জানায় কালাম মাঝি। মেয়েটার বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে সেই কবে। কিন্তু এ পর্যন্ত বিয়ের কোনো সম্বন্ধই এলো না। কোনো সতীন-ছেলেমেয়ে সহ বা খুব বেশি বয়স্ক পুরষের সম্বন্ধ এলেও কালাম মাঝি বেশ আয়োজন করেই ফাতেমার বিয়েটা দিয়ে দিতো। সে সুযোগ কি তার আসবে? মাঝে মাঝে তার আশংকা হয় যে, জীবদ্দশায় হয়তো কন্যার বিয়ে দেখে যেতে পারবে না সে।

চান মৌলবিও ঠিক একই রকম কাতর কন্ঠে জানান যে, তার বয়সও পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। অথচ অভাবের কারণে বিয়ে করতেই সাহস পেলেন না। তা ছাড়াও বিয়ে না করলে মুসলিম হিসেবে আখেরাতে রসুলের শুপারিশের যোগ্য হবেন না। কিন্তু এ বয়সে কে তাকে মেয়ে দেবে? আর এভাবেই দুঁহু কোঁরে দুঁহু কাঁদার ফলে কালাম মাঝিই বলতে গেলে খানিকটা নির্লজ্জের মত মৌলবি সাহেবের কাছে প্রস্তাব রাখে যে, ফাতেমাকে যদি তিনি বিয়ে করতে রাজি থাকেন তাহলে বিয়ের পর তাকে আর থাকা খাওয়ার ভাবনা করতে হবে না। আখেরাতে রসুলের সুপারিশ অর্জনের পথও সুগম হবে নিঃসন্দেহে।

চান মৌলবি সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে। কিন্তু পাকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, আপনের প্রস্তাব তো পাওয় গেল, এখন গ্রামবাসী কি বলে আলাপ কইরা দেখি। কারণ কেউ যদি ঘর জামাই থাকে তাইলে মানুষ তারে অনেক মন্দ-সন্দ বলে। অপমানও করে।

কালাম মাঝি মৌলবি সাহেবের দুটো হাত ধরে ব্যাগ্র কন্ঠে বলে উঠলো, আমি আপনেরে জমি লেইখ্যা দিবো। ঘর উঠাইয়া দিবো। নিজের নামে দলিল করা বাড়িতে থাকবেন। কেউ কিছু বলতে সাহস পাইবো না।

কথাটা খুবই মনঃপূত হয় মৌলবি সাহেবের। তবুও বলেন, কন্যার তো বয়স হইছে। সবার আগে তারও একটা মতামত জানা দরকার না?

ফাতেমা হয়তো কোনো প্রলোভনেই বুড়ো মৌলবির স্ত্রী হতে রাজি হতো না। যদি সে গ্রামের আরো দশটা পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারতো। তার বাবা কালাম মাঝি যদি সমাজের সঙ্গে অঙ্গীভুত হয়ে গ্রামে বাস করতে পারতো। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে এখন তার যে বয়স হয়েছে স্বামী হিসেবে কোনো যুবককে প্রত্যাশা করাটাও হয়তো তার বোকামী অথবা দুরাশা বলে গন্য হবে। তাই সে কোনো কিছু না ভেবেই বলে ওঠে, আপনের য্যামনে ভালো হয় তাই করেন।

আসলে কথাটা শুনে তারও মনের ভেতর কেমন অজানা একটি শিহরণ বইতে আরম্ভ করেছে। শেষপর্যন্ত তার বিয়ের ফুল ফুটছে তাহলে। আর এ আনন্দে সারা রাত সে ঘুমাতে পারলো না। যাও খানিকটা ঘুমের আমেজে চোখ দুটো বুঁজে এসেছিলো তাও খুবই মনোরম একটি স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিছানা থেকে গড়িয়ে মেঝেতে পড়ে তার ঘুম ছুটে যায়।

বাকি রাতটুকু আর ঘুমাতে পারে না ফাতেমা। জানালা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তিনদিনের একটি তাবলিগ জামাতের সঙ্গে নিজের অতীত পরিচয় গোপন করে চোখে ভারি কাচের চশমা পরা মান্নান মোল্লা তার জন্মভূমি শিবপুর গ্রামে এসে উপস্থি হলেও কেউ তাকে চিনতে পারে না। হয়তো ঘুণাক্ষরেও কেউ অনুমান করতে পারে না যে, মান্নান মোল্লা জীবিত আছে কিংবা এ গ্রামে কখনো সে আসতে পারে। যদিও কালাম মাঝি দীর্ঘ একটি সময় তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলো সেও চিনতে পারলো না। মান্নান মোল্লাও কারো কাছে নিজের পরিচয় দিলো না।

আসরের নামাজ শেষ করে সে মুসুল্লিদের নিয়ে গ্রামটি ঘুরে দেখতে বেরোয়। উদ্দেশ্য পথে যদি কারো সঙ্গে নিতান্তই দেখা হয়ে যায় তাহলে তার ইসলাম ধর্মীয় মনোবল চাঙ্গা করতে দু’এক কথা বলবে।

সবার সঙ্গে মান্নান মোল্লা নিজের খাখা করা বেওয়ারিশ কুকুরের আশ্রয়স্থল শূন্য ভিটেটির দিকে চেয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, এই বাড়ির লোকজনের কথা কেউ জানে?

তখনই গ্রামের দু একজন অতি উৎসাহী খেটে খাওয়া মানুষ তাকে জানায়, এইডা রেজাকার মন্নানের বাড়ি আছিলো। দেশ স্বাধীনের পরে তারে মুক্তিরা ধইরা কানা কইরা দিছে। আর তার বউ-মাইয়া নজু ড্রাইভারের লগে ভাইগ্যা গিয়া দৌলদিয়া নডি বাড়িত জাগা লইছে হুনছিলাম!

কথাগুলো শুনে মন্নান মোল্লার মনে রাগ হলেও এখানে দাঁড়ানোটা আর নিরাপদ মনে করলো না। বলা যায় না কে কখন চিনে ফেলে চিল-কাকের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে হেনস্থা করে কালামের মতই গলায় জুতোর মালা পরিয়ে গ্রামময় ন্যাংটো করে হাঁটাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মন্নান মোল্লার মনে হলো একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের মনে রাজাকারদের প্রতি এখনো ঘৃণার যে তীব্রতা, তা দূর হতে হয়তো আরো হাজার বছরেরও বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে তাদের। এ দেশে এখনো যাদের মনে জন্মভূমির প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা আছে তারা হয়তো কোনোকালেই রাজাকারদের  ব্যাপারে সহজ-স্বাভাবিক হতে পারবে না। যে কারণে রাজাকারদের সঙ্গেও কতিপয় মূর্খ যারা স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস জানে না তেমন কিছু লোক, কিছু বেজন্মা  লোভী জানোয়ার প্রকৃতির মানুষ আর কিছু দুশ্চরিত্র পিতা-মাতার সন্তান ছাড়া অন্য কারো সদ্ভাব গড়ে উঠতেও দেখা যায় না।

মন্নান মোল্লা মসজিদে ফিরে এসে কালামকে ডেকে বলে যে, তার ঘরে  এক বেলা ডালভাতের ব্যবস্থা সে করতে পারে কিনা। মসজিদে তাবলিগ জামাতের বারোয়ারী রান্না খেতে খেতে তার খাওয়ার রুচিই নষ্ট হয়ে গেছে। অনেকদিন হয় তৃপ্তি সহকারে সে খেতে পারছে না।

কালাম মাঝি তাবলিগ জামাতের আমিরের কথায় সানন্দেই রাজি হয়ে যায়। যে কারণে ডাল ভাতের সঙ্গে সঙ্গে সে চান মৌলবির সঙ্গে ফাতেমার বিয়ের দিনও ঠিক করে ফেললো। গ্রামের লোকজনদেরও সেদিন বিয়েতে আসার জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে অনুরোধ করে এলো সে। কিন্তু দেখা গেল তেমন কেউ বিয়েতে উপস্থিত হয়নি। কেবল ভিক্ষে করে খায় খালেকের ল্যাংড়া ছেলে জগ্যা। যার নাম ছিলো জগলু। লোকজনের অবহেলায় জগ্যা বলে সে এখন পরিচিত। সেই ফাতেমা আর চান মৌলবির বিয়েতে গ্রামের মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করতে এলো হয়তো।

বিয়ের আসরেই সিদ্ধান্ত হয় যে কালাম তার গাঁটের পয়সা খরচ করেই নিজের জমিতে মাদ্রাসা করে দেবে। তার পাশের জমিটাও লিখে দেবে ফাতেমা আর চান মৌলবির নামে। আপাতত সংসার জীবনটা শুরু করার জন্য একটি ঘর তুলে দেবে টিন দিয়ে।

খাওয়া দাওয়া করে যাওয়ার পর ল্যাংড়া জগ্যা সারা গ্রামেই ফাতেমার সঙ্গে ইমাম সাহেবের বিয়ের খবরটা ছড়িয়ে দিলো। যার ফলে পরবর্তী জুম্মার নামাজের সময় মসজিদে তেমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যার মুসুল্লি দেখা গেল না।

মৌলবি সাহেব গ্রামে ঘুরে ঘুরে যাকে পেলেন তাকেই বললেন যে, তিনি একটি ভুল করে ফেলেছেন। গ্রামের মানুষকে না জানিয়ে তিনি কালাম মাঝির মেয়ে ফাতেমাকে বিয়ে করে ফেলেছেন।

কথাটা শুনে বলতে গেলে সবাই একবাক্যে জানালো রাজাকারের সঙ্গে জেনে বুঝে যে ব্যক্তি আত্মীয়তা করে তার পেছনে নামাজ তারা পড়বে না।

তবুও চান মৌলবি জোড় হাত করে ক্ষমা চেয়ে লোকজনকে বোঝাতে থাকেন। ইহকাল পরকাল নিয়ে বেশ বেদনাদায়ক বয়ান দিতে থাকেন। এতে কিছুটা কাজও হয়। বেশিরভাগ মানুষই ধর্ম ভীরু বলে পরকাল সম্পর্কে এক আধটু ভয় ঠিকই তাদের শংকিত করে তোলে। ধীরে ধীরে জুম্মার দিনে মসজিদে লোকজনের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও মৌলবি সাহেবের মুখের ভাব প্রসন্ন হতে থাকে।

গ্রামের কোনো কোনো অতি কৌতুহলী বউ বা মেয়েরা এ বাড়ি ও বাড়ির আড়াল দিয়ে মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে ফাতেমাকে দেখতে আসে। তারা ভেবে পায় না বৃদ্ধ এ মৌলবির মাঝে কী এমন রহস্য আছে যে, ফাতেমার মত মেয়ে তাকে বিয়ে করতে রাজি হলো? নাকি এ কথা সত্যি যে, সময় মত বিয়ে না হলে মেয়েদের মনে যুবক বা বৃদ্ধ পুরুষ নিয়ে তেমন কোনো দ্বন্দ্ব থাকে না।

যদিও ফাতেমা বাড়ি থেকে বেরিয়ে কখনো পাড়া বেড়াতে পারেনি। যাও প্রথম প্রথম বের হতো তাকে কেউ সঙ্গে নিতো না। খেলতে ডাকতো না। অন্যান্য বাচ্চারা রাজাকারের ছাও বলে তাকে ঠেলে দিতো দূরে। এ নিয়ে একবার সে তার বাবা কালাম মাঝিকেও প্রশ্ন করেছিলো। কিন্তু কালাম মাঝি তাকে বুঝিয়েছিলো যে, তার বাবা এ গ্রামের সবচেয়ে ধনী লোক বলে অভাবী লোকজনের ছেলেমেয়েরা তাকে ঈর্ষা করে।

ফাতেমা ফের জানতে চেয়েছিলো, আমারে তাইলে সবতে রাজাকারের ছাও কয় ক্যান?

কালাম মাঝি বলেছিলো যে, রাজাকার হলো রাজার বংশ। তাদের আসল দেশ হচ্ছে পাকিস্তান। বংশ-মর্যাদায় এ দেশের মানুষের চাইতে তারা অনেক উঁচু বলে হিংসা করে এ কথা বলে। এ দেশের ছোট জাতের মানুষদের সঙ্গে মিশলে তারই অপমান।

ফাতেমা মেনে নিয়েছিলো কথাটির সত্যতা। আর তারপরই তার জগত হয়ে উঠেছিলো পিতৃগৃহের সীমানার ভেতর। যে কারণে এ গ্রামের কোন মেয়েটির বাপের বাড়ি এখানে বা কে ভিন্ন গ্রাম থেকে এ গ্রামে বউ হয়ে এসেছে তার হদিস বলতে পারবে না সে। সবাই অপরিচিত বলে সে তাদের সঙ্গে সহজ হয়ে কথাও বলতে পারে না। শেষটায় বিরক্ত হয়ে বা শংকিত হয়েই বুঝি সে ঘরের দরজা ভেতর থেকে খিল দিয়ে বন্ধ করে  দিয়েছিলো। মেয়েরা এসে দরজায় করাঘাত করে করে ফিরে গেছে। ফাতেমা তখন এক ঠায় বসেছিলো ঘরের ভেতরকার অন্ধকারে। কোনো সাড়া শব্দও করেনি।

তাবলিগ জামাতের শেষ দলটির আমির সাহেবকে খুবই পছন্দ হলো কালাম মাঝির। সে হা করে কথাগুলো শুনছিলো। আমির সাহেব বলছেন,  বাংলাদেশের একমাত্র সাচ্চা ইসলামী দল হইলো জমুতি এসলাম। সেই দলে যোগ দিতে পারলে তোমার মত রাজাকার আছে যারা তাদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ রাখতে পারলে দিনদিন তোমার ক্ষমতা বাড়তেই থাকবো। তা ছাড়া জিয়া সাব আছিলেন পাকিস্তানপন্থী। ইন্ডিয়ার দালালরা তারে মাইরা ফালাইয়া কিছুটা ক্ষতি করছিলো। লিডার গোলাম আযম হুজুররে দেশের মাটিতে স্থায়ী কইরা দিয়া গেছিলেন তানিই। শুনতে পাই মইতর রহমান নিজুমী আর আলি আসান মুজিদ এই দুই বেশ্যা মাগির জাউড়া পোলারা মালাউনের দল আম্লিগের লগে জোট পাকাইতাছে। এদিক দিয়া জিয়া সাবের বউও খুবই ভালো। আহা! দেখতে জানি জান্নাতের হুর! সোভানাল্লা! তানিও জিয়ার মতই পাকিস্তানরে পছন্দ করেন শুনতে পাই। আম্লিগের লগে তার কোনোই আপসের কথা শুনা যায় না।

তখনই কালাম মাঝি হঠাৎ বলে উঠলো, হুনছি, যুদ্ধের বছর তানি পাকিস্তানেই আছিলেন অনেকদিন। যার লাইগ্যা মিলিটারির বড়বড় সাবগো লগে তানির খাতির দুস্তি ভালাই আছে অহনো!

তাবলিগের আমির সাহেব হঠাৎ কাশতে কাশতে বললেন, তোমাদের এলাকার পানিটা সুবিধার না। গলায় বুকে কেমন কফ বইসা যাইতাছে।

কালাম মাঝি অস্থির হয়ে বললো, নুন-আদা দিয়া চা জ্বাল দিয়া দিতে বলি?

আর এ কথা মনে হতেই তার মনে পড়লো, চান মৌলবি এখন ফাতেমার সঙ্গে আছে। তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না হয়তো।

তারপর সে বললো, বাজার থাইক্যা দুলালের তালমিশ্রি আনাইয়া দিবো?

আমির সাহেব বললেন, দুলালের তাল মিশ্রি ভারতের। আর ভারতের সব কিছুই হিন্দুরা বানায়। ওইখানকার মুসলমানরাও মূর্তি দেখলে নমস্কার করে। হিন্দুর হাতের জিনিস মুসলমানের জন্য হারাম।

কালাম উৎসাহী হয়ে বললো, তাইলে আমরা যে বাজারের ঘোষের দোকান থাইকা জিলাবি-বাতাসা কিন্যা আইন্যা মিলাদ পড়াই?

সেইটাও খরাব। হিন্দুরা সব কিছুতেই গরুর চেনা মিশায়। গরুর চেনা মিশানো মিষ্টি-বাতাসা দিয়া মিলাদ হবে না।

তারপর আমির সাহেব পকেট থেকে একটি শক্ত কাগজ বের করে কালামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, পারলে ঢাকা শহর গিয়া এই ঠিকানায় দেখা করবা। আর যেমন কইরা পার এই গ্রামে তোমার নিজের কিছু লোক হওন চাই। অর্থ-বলের সঙ্গে লোক-বলও দরকার।

খুবই ভালো ভালো কথা বলেছিলেন আমির সাহেব। মনে পড়লে এখনো যেন কালাম মাঝির কানে সে কথাগুলো মধু বর্ষণ করে। আমির সাহেব আবার আসবেন বলেছেন। তার ইচ্ছে কালাম মাঝি একদিন রহিমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হবে। তারপর থানার এমপি। আর তখনই সুযোগ মত জমুতি ইসলামের মজবুত ঘাঁটি বানাবেন শিবপুরে। তখন শিবপুরের হিন্দু নামটাও পরিবর্তন করে মুসলমান নাম দেবার স্বপ্ন দেখেন তিনি। তখন এ গ্রাম আর ইউনিয়নের নাম হবে আযমপুর। তাদের লিডারের নামে নাম।

কিন্তু কালাম মাঝি অনেক ভেবেও জনপ্রিয় হওয়ার মত তেমন কোনো রাস্তা খুঁজে পায় না।

শিবপুর খালের ওপর অনেক পুরোনো একটি কাঠের পুল ছিলো। গত বর্ষার পর থেকেই সেটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। তার ওপর কারা যেন রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে বিভিন্ন আকৃতির কাঠগুলো খুলে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়ে দু’পাড়ের লোকজনের মাঝে একে অন্যকে দোষ দেয়া নিয়ে বাদানুবাদ তর্কাতর্কি থেকে একপ্রস্থ ধাওয়া-ধাওয়ি হয়ে গেল।

দু’পক্ষই ঘোষনা দিয়েছে যে, অপর পক্ষ পুল পেরিয়ে এলেই ঠ্যাং ভাঙ্গবে। এ নিয়ে দু’গ্রামের সর্দার-মাতব্বরদের ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিবপুরের পক্ষে রুসমত আলির ছেলে আহমদ আলি আর  শাহজাহানের ভাই কালু মিয়া দেন দরবার করেও কোনো সমাধানে পৌঁছুতে পারলো না। তখনই চান মৌলবি তার বয়োকনিষ্ঠ শ্বশুর কালাম মাঝিকে পরামর্শ দিলেন যে, সে যদি সিমেন্ট-পাথর আর লোহা দিয়ে পাকা একটি সরু পুল বানিয়ে দেবার প্রস্তাব করে, তাহলে হয়তো লোকজনের মধ্যকার উত্তেজনা কমলেও কমতে পারে। এমন কি এটা করতে পারলে লোকজনের মনে ঠাঁই পেতেও তেমন একটা সময় লাগবে না। সেই সঙ্গে এটাও প্রচার পাবে যে, এ গ্রামের অর্থশালী কেউ থাকলে সে কালাম মাঝিই।

নিজের বয়সের চাইতেও জ্যেষ্ঠ জামাতার পারামর্শ উড়িয়ে দিতে পারে না কালাম মাঝি। কথাটার মাঝে সত্যতা যেমন আছে সম্ভাবনাও আছে তেমনিই। আর তাই পরবর্তী জুম্মার দিনে কালাম মাঝি গ্রামবাসীর কাছে প্রস্তাব রাখলো যে, দু’গ্রামের মানুষ মিলে যদি সিমেন্ট পাথর আর লোহা দিয়ে একটি পাকা পুল বানিয়ে নেয়, তাহলে এ সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানও আপাতত পাওয়া যেতে পারে।

প্রস্তাবটি যেন খুবই পছন্দ হয় মুসুল্লিদের। তারা একবাক্যেই বলে উঠলো যে, কথায় কোনো গলদ নাই।

কিন্তু ওপাড়ের মানুষ রাজি হয় কি না সেটাই প্রশ্ন।

গ্রামাঞ্চলের কথা বাতাসে বাতাসেই যেন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিক। কালামের প্রস্তাবও পৌছে গেল খালের ও পাড় রহিমপুরে। লোকজনের  মাঝে কম বেশি উত্তেজনা ফুটে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে খানিকটা দ্বিধাও যেন কাজ করছিলো। রাজাকারের দান গ্রহণ বৈধ হবে কি হবে না। রাজাকারের সাহায্যে জনসাধারণের  জন্য কিছু করাটা উচিত হবে কি হবে না, তা নিয়েই বেশ কিছুদিন জায়গায় জায়গায় ছোটখাট জটলা দেখা গেল।

তাগলিগ জামাতের শেষ দলটির আমির সাহেবের সঙ্গে কথা বলে যেন হঠাৎ করেই দিব্য জ্ঞান লাভ হয়েছিলো কালাম মাঝির। আর সে কারণেই হয়তো সে নিজেই উপলব্ধি করতে পারছে যে, অত্রাঞ্চলের মানুষের মনে যদি ঠাঁই করে নিতে হয় তাহলে এখনই সময়। অনেক সময় প্রয়োজনের কাছে মানুষের নীতিবোধও কখনো কখনো বাঁধা পড়ে যায়। যে কারণে সে নিজেই তখন ফেরি করে বেড়ায় তার নীতিবোধ। আর সময়-সুযোগে দেখে-শুনে দরও হাঁকে উচ্চ মূল্য।

সমাজের অভাবগ্রস্থ মানুষদের চারিত্রিক দৃঢ়তা কোনো কালেই হয়তো ছিলো না। আর তাই হয়তো নানা কারণে বিভিন্ন সময়ে তারা ব্যবহৃত হয়ে আসছে নিজেদের অজান্তে। এখনও তাই ঘটলো, যা কারো মনেই তেমন কোনো সন্দেহের উদ্রেক ঘটালো না।

গ্রামের উত্তর পাড়ার জলিল উদ্দিনের মৃত্যুর পর তার দু’ছেলে খলিল আর দলিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজ করে জীবন নির্বাহ করেছে। জমিজমা নেই বলে কাজ করেই তাদের খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। সম্প্রতি তারা স্টেশনে কুলির কাজ আরম্ভ করে দিয়েছিলো। কিন্তু দু’গ্রামের মাঝে পাকা পুল হবে জানতে পেরে তারা এসে উপস্থিত হলো কালাম মাঝির ঘরের দরজায়।

কালাম মাঝি অবাক হয়ে তাদের শুধায়, তরা কি মনে কইরা?

দুজনেই বিগলিত হাসি হেসে জানায় যে, কালাম মাঝির হাতকে শক্ত করতেই তারা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে থাকবে। বিপদ আপদে পাহারা দেবে। বড়লোকের শত্র“র তো অভাব নেই। তা ছাড়া সমাজের নেতৃত্ব দিতে গেলে সঙ্গে শক্তিশালী মানুষ দু’চারজন থাকা দরকার। তা না হলে লোকজন তেমন একটা মান্য করে না।

কালাম মাঝি বুঝতে পারে যে, এরা হচ্ছে ভাগাড়ের হাঁড় চাটা শকুন। চাহিদা সামান্যই। তবুও সে জানায়, আমার তো কাজের লোক অহন দরকার নাই।

তাও থাকি। বেশি কিছু চাই না। ঘরের খোরাকটা চালাইয়া রাইখেন।

কালাম মাঝি বললো, তোরা যা এখন। আমি একটা কাজ করতাছি।

কিন্তু ওরা চলে না গিয়ে খানিকটা আড়ালে গিয়ে বসে।

কালাম মাঝি বসে বসে হিসাব করছিলো কেমন টাকা হলে সে নিজেই কাজটা করে ফেলতে পারে। কিন্তু একজনের গাঁট থেকে অতগুলো টাকা বেরিয়ে গেলে কেমন দেখায়। এ কাজে যদি অন্যদেরও শরিক করা যেতো তাহলে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে তাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ সহ আলাপ আলোচনার সুযোগও হয়তো পাওয়া যেতো। এতকাল যেভাবে সে একঘরে হয়ে লোক সমাজের সঙ্গে সংশ্রবহীন অবস্থায় কাটিয়ে এসেছে তা থেকে উত্তরণের একটি মাত্র পথই খোলা আছে। আর তা হলো জন-সংযোগ। সুযোগটা যখন হাতের কাছেই সেটাকে অবহেলা করে দূরে সরিয়ে দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ বলে বিবেচিত হবে না হয়তো।

কালাম মাঝি ঘর থেকে বেরিয়ে রহিমপুর হাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে খলিল আর দলিলও তার সঙ্গী হয়। চলতে চলতে খেয়াল করে যে দু’জন দু’পাশে কেমন পাহাড়ের মতই ভাব নিয়ে হাঁটছে। ব্যাপারটা তেমন একটা মন্দ লাগে না কালাম মাঝির। পথে সে যাকে যাকে পেলো তাকেই বললো যে, পাকাপুল করে দেবার পর সে গ্রামে একটি মক্তব বানাবে। যেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কোরআন শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে এসলাম সম্পর্কে নানাবিধ জ্ঞানার্জন করতে পারবে। যা হবে সম্পূর্ণ অবৈতনিক। কায়দা-কিতাব- আমপারা-কোরআন যার যা প্রয়োজন তা সেখান থেকেই সরবরাহ করা হবে। আর এ কথা শুনে অনেকেই রাজি হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। এমনকি এ প্রতিশ্র“তিও কেউ কেউ দিলো যে, পাকা পুল আর মক্তব করার সময় বিনা পয়সায় দু’চারদিন কাজ করে দেবে।

কিন্তু সব জায়গাতেই একজন দুষ্টু আর চরিত্রহীন লোকের ঠাঁই হতে পারে না বলেই কিছু কিছু জায়গায় তাকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করা হয়। কালাম মাঝির অতীত ইতিহাস যারা ভালো করেই জানেন তারা তাকে এহেন অপকর্ম থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে দু’গ্রামের মুনষদের একত্র করার প্রয়াস পান। তারা জানান যে, একটি রাজাকারের  অনুদানের চাইতে একজন ভিখিরীর অনুদানও অনেক সম্মান জনক। দু’গ্রামের মানুষ চাঁদা তুলেই পাকা পুল করে নিতে পারবে। কিন্তু অভাবী মানুষরা সাধারণত যেদিকে বিনা পয়সার গুড় দেখতে পায়, তা চিটাগুড় হোক আর নোনাগুড়ই হোক সেদিকেই ভিড় করতে থাকে। আর এভাবেই দু’গ্রামের ভেতর হঠাৎ করেই কালাম মাঝি লোকবলের দিক দিয়ে বলীয়ান হয়ে উঠতে লাগলো দিনদিন।

এখন লোকজনের সঙ্গে আলাদা করে কথাবার্তা বলার জন্যেই তাকে নতুন একটি ঘর তুলতে হয়েছে। অথচ ছ’সাতমাস আগেও তার রান্নাঘরটি শন দিয়ে ছাওয়ার জন্য কাজের লোক খুঁজে পায়নি। জগ্যাকে বলে কয়ে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করালেও গ্রামের মানুষের ভয়ে দিনের বেলা কাজ করতে সে সাহস পায়নি। রাতের অন্ধকারে একটু একটু করে কাজ করে দিয়েছিলো। আর সে গ্রামেই সবার চোখের সামনে দিয়েই এ গ্রামেরই নসুমুদ্দির রিকশা ভ্যানে করে বাজার থেকে কাঠ এসেছে। টিন এসেছে। কাঠমিস্ত্রিরাও নিশ্চিন্তে কাজ করেছে। কেউ কিছু বলার প্রয়োজনও মনে করেনি হয়তো। দিনের বেলা সূর্যের আলো নতুন টিনের চালে প্রতিফিলিত হয়ে যেন কালাম মাঝির এত কালের অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িটাকে অতিরিক্তি উজ্জ্বলতায় আলোকিত করে রাখে। নতুন ঘরে লোকজন কাঁঠাল কাঠে তৈরী নতুন চেয়ার আর ঢেলানীতে বসে নানাবিধ গপসপ করে। খলিল আর দলিল মহা উৎসাহে গুড় দিয়ে রঙ চা বানিয়ে লোকজনের হাতে হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দেয়। সময়ে সময়ে চান মৌলবিও তাদের দু’একটি ধর্মের কথা বলতে চেষ্টা করেন।

দু’গ্রামের মানুষের মনে আপাতত নিজের অবস্থান খানিকটা দৃঢ় করার পরই তাবলিগ জামাতের আমির সাহেবের দেয়া ঠিকানায় দেখা করতে গেল কালাম। আর ঢাকা শহর থেকে ফিরে আসার পরই যেন ভিন্ন মানুষ হয়ে ওঠে সে। যেন সে দেখতে পায় একাত্তরের সেই দিনগুলোকে তার সামনে পড়া মেরুদণ্ডহীন মানুষগুলোর থরথরি কম্প। কিন্তু রুসমত আলির ছেলে আহমদ আলি আর কালু মিয়া বলতে গেলে দুর্দান্ত সাহসী। তারা তাকে মুখের ওপর এখনও রাজাকার বলে গালি দেয়ার মত হিম্মত রাখে। তবু আপাতত তাদের না ঘাটিয়ে জমুতি এসলামের মিটিঙে কি করে লোকজন হাজির করা যায় তা নিয়েই বেশ কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল সে।

কথায় আছে ভাত ছিটালে কাকের অভাব নেই। কিন্তু কাকেরও তো জাতভেদ থাকে। সবগুলোই যদি পাতিকাক হয় তাহলে চলে কিভাবে! দু’একটি দাঁড়কাক না হলে  কাকেদের সমাজও হয়তো তেমন একটা স্বাভাবিক হতে পারে না। তবুও তেমন একটা দুর্ভাবনা হয় না কালাম মাঝির। গরিবগুর্বো মানুষ যে কজনই পাওয়া যায় তাও মন্দ কি। দলে ভারি হওয়া নিয়ে কথা। পল্টনের জনসভা হতে আরো দিন পনের বাকি আছে। এরই মধ্যে কথাটা সুকৌশলে ছড়িয়ে দিতে পারলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না। এ গ্রাম এবং তার আশপাশের গ্রামগুলোর অনেকেই ঢাকা শহর কখনোই যায়নি। এ সুযোগে তারা ঢাকা শহর থেকে ঘুরেও আসতে পারবে। তবে শর্ত একটিই থাকবে যে, বিনা ভাড়ায় বাসে চড়ে গেলে মিটিং শেষ হলে যে যেদিক পারে যাবে। কোনো বাধা নেই। তবে একই বাসে ফিরে আসতে হলে এশার নামাজের পরপরই বাসে চাপতে হবে। কথাটি যেন বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতই ছড়িয়ে পড়লো চারদিক। ফলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে লোকজন এসে জানালো তাদের এতজন লোক আছে। কেউ জানালো তার বিশ কি পঁচিশজন লোকের যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।

কালাম মাঝি লোকগুলোর চেহারা আর পোশাক দেখেই বুঝতে পারে যে, এদের অনেকেই ঢাকা শহরে যেতে পারলে সহজে ফিরে আসবে না। কিছুদিন কষ্ট করে হলেও সেখানে থেকে কোনো কাজকর্ম জোটাতে পারে কিনা দেখবে। তবুও ব্যাপারটি খুব একটা মন্দ হবে বলে মনে হয় না। মিটিঙে কিছুক্ষণ থেকে আস্তে ধীরে ওরা যদি সরেও পড়ে তাতেও কিছু আসবে যাবে না। ততক্ষণে তার নাম উঠে যাবে দলের তাঁবেদারদের তালিকায়। দুটো বাসের সামনেই সবুজ কাপড়ে সাদা রঙ দিয়ে বড় বড় হরফে লেখা থাকবে মুন্সি কালাম মাঝি খন্দকার। জমুতির লোকেরা বাস দুটো আর কাপড়ে লেখা নামটিই দেখবে। কতজন লোক এলো সেটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এ কথা মনে হতেই কালাম মাঝির মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠলো।

মানুষ যখন কোনো একটি চাপের ভেতর থাকে তখন তার মনের অবস্থাও থাকে তেমনিই নির্জীব। যে কারণে এতকাল কালাম মাঝির মনে একবারও উদয় হয়নি জরিনার কথা। বাতি নিভিয়ে দিয়ে অন্ধকার ঘরের ভেতর শুয়ে থেকে নানাবিধ দুশ্চিন্তা করলেও কখনো তার মনে হয়নি যে, সে নিঃসঙ্গ। শরীর বলে যে একটি অনিবার্য ব্যাপার আছে তা যেন এতকাল ভুলেই ছিলো। কিন্তু আজকাল বিছানায় শুয়ে পড়ার পর রাত্রিটুকু যত গভীরতা পেতে থাকে তার মনে জরিনার অনুপস্থিতি যেন ততটাই তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। আর তখন এক ধরনের অব্যক্ত কষ্টবোধ তাকে সহস্র সূঁচাগ্রে বিদ্ধ করতে থাকে।

যুদ্ধ শুরুর আগের দিনগুলোতে সে যখন কাজকর্ম সেরে ঘরে ফিরতো। কোনোদিন কাজের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে কখনো মনের ভুলেই বলে ফেলতো হয়তো যে, আজ খুবই খাটাখাটুনি গেছে। হাতপায়ে অনুভব করতে পারছে সে খাটুনির জের। তখনই হয়তো জরিনা কেরসিন গরম করে তার পায়ে মালিশ করে দিয়েছে। কখনো বা খানিকটা অতিরিক্ত সোহাগ ভালোবাসা দিয়ে তা দূর করে দিতে চেষ্টা করেছে। যে কথা তার একবারের জন্যও বিগত বত্রিশ বছরে মনে পড়েনি। কিন্তু ঢাকা থেকে ফিরে আসার পরই তার কেন যেন মনে হচ্ছিলো সে খুবই একা। এতকাল যেন তার কেমন একটি ঘোরের ভেতরই সময়গুলো গড়িয়ে বছরের পর বছর গড়িয়েছে। কিন্তু এখন যেন খুব বেশি ক্লান্তিতেই সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। হাত পায়ের সঙ্গে সঙ্গে শরীরটাও যেন খুবই ব্যথিত হয়ে আছে। ফাতেমা একবার বলেছিলো যে, হাতে পায়ে কেরসিন গরম করে ডলে দেবে কিনা। কিন্তু মেয়ের কাছ থেকে যা পাওয়া যাবে তা হচ্ছে পিতার প্রতি কন্যার কর্তব্য। কিন্তু তার যেন এরও অতিরিক্ত আরো কিছু চাই।

কালাম মাঝি শুয়ে পড়লে খলিল আর দলিলও চলে যায়। প্রথম প্রথম যেতে চাইতো না। কিন্তু সেই তাদের জোর করে পাঠিয়ে দিতো। আজ অনেকটা রাত হয়ে গেলেও খলিল আর দলিল কাচারি ঘরে বসে আছে। মাঝে মাঝে তাদের দু’একটা উচু কথার শব্দ কিংবা উচ্চকিত হাসির শব্দও ভেসে আসছিলো। এদিকে শরীরের যত্রতত্র ব্যথায় কালাম মাঝি এপাশ ওপাশ করতে থাকলেও ঘুমুতে পারছিলো না। পাশের ঘরে চান মৌলবির হাসির পাশাপাশি ফাতেমার চাপা হাসিও যেন ছিটকে পড়ছে থেকে থেকে।

কালাম মাঝি হঠাৎ বিছানা থেকে নেমে দরজাটা আলতো করে খুলে উঠোনে নেমে আসে। কাচারি ঘরের দরজা আর জানালার ফাঁক গলে আলো আসছিলো বলে সে প্রায় নিঃশব্দেই সেদিকে এগিয়ে যায়। দরজায় ধাক্কা দেবে নাকি তাদের কারো নাম ধরে ডাকবে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতেই সে দরজার ফাঁক গলে আসা আলোক রেখায় চোখ রাখে। দু’ভাই মিলে একটি সাদা প্লাস্টিকের বোতল থেকে কিছু তরলাংশ গ্লাসে ঢেলে ঢেলে বেশ আয়েশ করে গিলছে। মনে হচ্ছে এর অমৃত স্বাদে দুজনই মত্ত হয়ে ভুলে গেছে আশপাশের কথাও।

কালাম মাঝির কাছে বোতলের ব্যাপারটি অপরিচিত নয়। বাজারের আয়ূর্বেদিক অষুধের দোকানে গোপনে এসব বোতল বিক্রি হওয়ার কথা শুনেছে সে। কিন্তু কখনোই তা নিয়ে ভাবেনি। কিন্তু তরল পদার্থটির গুণের কথা তার অজানা নয়। যুদ্ধের বছর অর্জুন সেনের বাড়িতে মাঝে মধ্যে মান্নান মোল্লার সঙ্গে আশপাশের শান্তি কমিটির লোকজন দেখা করতে এলে কিংবা পাকি সৈন্যদের বড় কোনো অফিসার এলে সে রাতে যেন মদ আর মাংসের মচ্ছব বসতো সেখানে। প্রায়ই দু’একটা বোতল কিংবা আধা পূর্ণ বোতল সে পেয়ে যেতো ঘর পরিষ্কার করার সময়। সযতনে লুকিয়ে রাখতো সেগুলো। কখনো কখনো বোতল হাতে মাঝ রাতের দিকে চলে যেতো বিলের দিকে। এর স্বাদের কথা তার অজানা নয়। কিন্তু পাকিস্তানিরা পরাজিত হবার পর অবস্থা পাল্টে গেছে। অনেক কিছুই তাকে হজম করতে হয়েছে মুখ বুঁজে। কিন্তু আজকাল সুযোগ পেলেই যেন তার ভেতরকার অবদমিত ইচ্ছেগুলো সহস্র পাখা মেলে বেরিয়ে আসতে চায়। সে হঠাৎ করেই দরজায় করাঘাতের সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর গলায় ডেকে উঠলো, খলিল-দলিল!

তখনই দু’ভাই দরজা খুলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ভ্যাবলার মত সোজা হয়ে দাঁড়ালো কালাম মাঝির সামনে।

কালাম বললো, অনেক রাইত হইছে। এইবার বাইত্যে যা!

খলিল বললো, রাইত তো বেশি হয় নাই। কিন্তু কথাগুলো জড়িয়ে যেতেই কালাম মাঝি তার হাত ধরে টেনে নামালো। দেখাদেখি দলিলও টলতে টলতে নেমে আসে। কালাম মাঝির সামনে দাঁড়িয়ে সে বলতে চেষ্টা করলো কিছু। কিন্তু হিক্কা ওঠার কারণে কথাই বলতে পারলো না।

কালাম মাঝি তাদের বললো, তগ বাইত্যে যা হারামজাদারা!

যাইতাছি সাব! বলতে বলতে দু’ভাই হেড়ে গলায় গান করতে করতে বাড়ির দিকে যায় বোধ হয়।

কালাম মাঝি কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করেই যেন লাফিয়ে ওঠে কাচারি ঘরে। দরজাটা ভেতর থেকে হুড়কো তুলে বন্ধ করে দিয়ে এগোয় বোতলের দিকে। দু’জন মিলে একটি বোতল শেষ করেছে কেবল। কিন্তু এতেই ওরা বেহাল হয়ে গেছে। আরেকটি বোতলের মুখ খোলা। হয়তো তখনই এসেছে সে। যে কারণে সেটা তেমনি রেখেই তারা বেরিয়ে গেছে।

কালাম মাঝি দীর্ঘকাল পর মদের সাক্ষাৎ পেয়ে ভেতরে ভেতরে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বাংলা মদ মানের দিক দিয়ে নিম্নমানের হলেও মদ্যপায়ীদের কাছে মদের বোতল ধোওয়া পানিটাও হয়তো একই রকম উপাদেয়। তাই যেন বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বোতলটি হাতে তুলে নিয়ে বোতল থেকেই সরাসরি বেশ কিছুটা পাণীয় মুখে নিয়ে গিলে ফেললো সে। কিন্তু তিতকুটে স্বাদ আর বিশ্রি গন্ধে তার নাক মুখ কেমন কুঁচকে উঠলো সঙ্গে সঙ্গেই। আর তখনই গলার ভেতর আর মাথাসহ কেমন ঝিম ঝিম করে উঠলো। মুখের ভেতরটাও যেন খানিকটা বোধশূন্য মনে হতে লাগলো। ব্যাপারটি তার কাছে ভালোই লাগে কিছুটা। মনে হতে লাগলো যেন একটি নতুন খেলা পেয়ে গেছে সে। যে খেলাটিতে মজাও আছে। তা মনে হতেই সে আরো দু’ঢোক গেলার পর অনুভব করলো তার ঝাঁঝালো ক্ষমতা। বুকের ভেতরটাও যেন মুখের মত বোধশূন্য হয়ে যাচ্ছে। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো বোতলটার দিকে। নিচের ঠোঁটটা কেমন ঝিনঝিন করতে থাকলো। খানিকটা অবাক হয়ে সে নিচের ঠোঁটটি  দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে অনুভব করতে চেষ্টা করছিলো কোনো বোধশক্তি আদৌ আছে কি না। আর এমন একটা হাস্যকর কাণ্ড করতে করতে তার সত্যিই হাসি পেতে লাগলো। তখনই সে আরো দু’ঢোক খেলো। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না। মনে হলো কিছুই মুখে পড়েনি বা গিলতেও পারেনি। তখনই সে ঢকঢক করে বোতলের বাকি তরলটাও গিলে ফেলে শূন্য বোতলের দিকে তাকিয়ে ভাবলো যে, আসলে বোতলে কিছুই ছিলো না। এমনি এমনিই সে বোতল থেকে কিছু পান করতে চেষ্টা করছিলো।

সে হতাশ হয়ে বোতলটিকে একদিকে ছুঁড়ে মারলো। আর তখনই মনে হলো সে কেন একা? কোথাকার কে না কে চান মৌলবি দিব্যি বুড়ো বয়সে বিয়ে করে সংসার করছে। তাহলে এতদিন সে করলো কি? আরো আগেই তো তার এমন একটি ব্যাপার নিয়ে ভাবা উচিত ছিলো। পাকিস্তান কেন যে ভেঙে বাংলাদেশ হলো। না হলে হয়তো সে রাজাকার হতো না। তাকেও মসজিদের সামনে নাকে খত দিতে হতো না। চেটে খেতে হতো না রুসমত আলির থুতুও। সবাই জোট বেঁধে তাকে ন্যাংটো করে জুতোর মালা পরিয়ে সারা গ্রামে হাঁটিয়েছিলো। সে যন্ত্রণা এখনও তার বুকে দগদগে ক্ষতের মতই জ্বলছে। সে কাচারি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চানমিয়া আর ফাতেমা যে ঘরে থাকে সে ঘরের দরজায় লাথি মেরে বললো, ওই ফকিন্নির পোলা মৌলবি! আমার বাইত্যে আর কতদিন খাবি? মাইয়া বিয়া দিছি এইবার বউ নিয়া ভাগ! ওই ফকিন্নির ঘরের ফকিন্নি চান মিয়া!

ফাতেমা হ্যারিকেন হাতে দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তার পিতা কালাম মাঝির দিকে। সে বুঝতে পারছিলো না হঠাৎ করেই তার বাবার কি হলো? মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেল না তো?

চান মৌলবি নানা দেশ চড়ে খেয়ে এসেছেন। নানা ঘটনা আর নানা মানুষের সঙ্গে মিশে তার দৃষ্টিও হয়ে উঠেছে অভিজ্ঞ। আর সে অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি তার শ্বশুরের কণ্ঠস্বরে ঘটনার আড়ালের ব্যাপারটি ধরে ফেললেন। তিনি চুপ চাপ ঘরথেকে বেরিয়ে দরজার কাছে রাখা কলসটির ভেতর হাত দিয়ে দেখলেন পানি আছে কি না। তারপর কালাম মাঝির পেছন থেকে গিয়ে কাঁধের ওপর হাতের কনুই দিয়ে একটি আঘাত করতেই কালাম মাঝি উপুড় হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

তখনই ফাতেমা আৎকে উঠে বললো, আপনে বাবারে মারলেন?

চান মৌলবি কোনো জবাব না দিয়ে কলসটি নিয়ে উপুড় করে সব পানি ঢেলে দিলেন কালাম মাঝির মাথায়। তারপর ছুটে গেলেন শূন্য কলস হাতে। হয়তো পুকুর কিংবা বাড়ির পেছনকার পায়খানার ডোবা থেকে কলসটি ভরতি করে এনে ফের কালাম মাঝির মাথায় ঢালতে থাকলে ফাতেমা এগিয়ে এসে চান মৌলবির হাত চেপে ধরে সরোষে বলে উঠলো, আপনে এইসব করতাছেন কি?

চান মৌলবি রাগ করেন না স্ত্রীর আচরণে। তিনি কলসির বাকি পানিটুকু কালাম মাঝির মাথায় আর গায়ে ঢেলে দিয়ে বললেন, ঝামেলা শুরুর আগেই শেষ কইরা দেওয়া ভালো। তোমার বাপ মদ খাইছে!

ফাতেমা আরো অবাক হয়ে বললো, মদ কি?

এইটা খাইলে খুব নেশা হয়। মানুষ আর মানুষ থাকে না। তোমার বাপ এখন একটা জানোয়ারের থাইক্যাও খারাপ। মানুষ জানলে তারে আবার নাকে খত দেওয়াইতে পারে। জুতার মালা গলায় দিয়া সারা গ্যারামে ল্যাংটা কইরা হাঁটাইতেও পারে।

ফাতেমা আরো দ্বিগুণ বেগে জ্বলে উঠে বললো, কি কইতাছেন আপনে? আমার বাপ আমি জানি না! আর আপনে দুইদিন হইলো না এই বাইত্যে আইসাই সব জাইন্য বইসা আছেন?

চান মৌলবি খানিকটা হেসে বললেন, তোমার বাপেরা স্বাধীনতার বছর যুদ্ধের সময় কোনখানে কি করছে সবই মানুষ জানে। এখন মাথা ঠান্ডা কর, পরে সব বুঝাইয়া বলবো।

ফাতেমার রাগ কমে না হয়তো। সে বলে, আমার বাপ আপনের শ্বশুর। তার গায়ে আপনে হাত তুললেন? আমার বাবারে আপনে মারলেন?

তখনই বিড়বিড় করে কিছু বলতে শোনা যায় কালাম মাঝিকে।

বাবা, বাবা! বলেই ফাতেমা তার বাবার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে বললো, বাবা কথা কন!

তখনই কালাম মাঝি কাত হয়ে ফাতেমার দিকে মুখ ফেরাতেই সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আঁচলে মুখ চেপে ধরে। আর সঙ্গে সঙ্গেই কেমন ওয়াক! ওয়াক! করে উঠলো।

চান মৌলবি বললেন, এখন কলস ভইরা ভালো পানি আনো। শুকনা কাপড় গামছাও আইনো।

ফাতেমা যেন ব্যাপারটির গুরুত্ব এতক্ষণে উপলব্ধি করতে পারে। বলে, বাবায় খাইছে কি? মা¹ো! উন্দুর পচা গন্ধের থাইক্যাও খারাপ!

চান মৌলবি কালাম মাঝিকে টেনে বসিয়ে দিলে সে বলে উঠলো, আমার বমি পাইতাছে!

তাইলে বমি করেন! ভালা লাগবো!

কালাম মাঝি হা করে গলার ভেতর একটি আঙুল ঢুকিয়ে দিয়ে হড়হড় করে বমি করতে থাকে।

ফাতেমা ঘর থেকে খাওয়ার পানি ভর্তি কলস নিয়ে এসে কালাম মাঝিকে বমি করতে দেখে কেমন স্থানুর মত তাকিয়ে থাকে কলসি কাঁখে।

১০

প্রতিদিন খুব সকাল সকাল ফাতেমা কিংবা চান মৌলবি জেগে ওঠার আগেই কালাম মাঝির ঘুম ভাঙে। কিন্তু আজ অনেক বেলা হয়ে গেলেও তার ঘুম ভাঙে না। বিছানায় চিৎ হয়ে ব্যাপক ভাবে নাক ডাকাতে ডাকাতে ঘুমুচ্ছিলো সে। ফাতেমা এসে কয়েকবার ডাকাডাকি করে গেলেও তার ঘুম ভাঙেনি।

চান মৌলবি ফজরের নামাজের পর মসজিদে বাচ্চাদের আরবি শিখিয়ে ফিরে আসতে আসতে বেলা প্রায় আটটা বেজে যায়। চানমিয়া মসজিদ থেকে ফিরে এসে শ্বশুরকে তখনও ঘুমুতে দেখে ফাতেমাকে বললেন, তোমার বাপ কি এখনো ঘুমাইতাছে?

ফাতেমা নিঃশব্দে মাথা দোলালে চান মিয়া ফের বলেন, মসিদে কয়েকজন তোমার বাপের কথা জিগাইছিলো। আমি বলছি শরীর ভালো না।

ফাতেমা বললো, খলিল আর দলিল মনে হয় কাচারি ঘরে আছে। তাগোরে জিগাইলে পাইবেন, বাবায় এই জিনিস পাইলো কই?

ওই দুই বদমাইশিত্তো এইসব হাবিজাবির খবর জানে। বাজারের কুলিরা রাইত হইলে দল বাইন্ধা গিলতে শুরু করে আর বাজারের যত পাগলনী-ফকিন্নিগো বিপদ বাড়ায়। মিটিঙের সুযুগে বদমাইশগুলা কাঁচা পয়সা পাইয়া কাইল এই জিনিস নিয়া আইছে হইবো।

তারপর চানমিয়া বললেন, কিছু খাওনের ব্যবস্থা করছো?

ফাতেমা জানালো, আর অল্প বাকি।

তখনই কাচারি ঘরের দিকে আসে চান মৌলবি। ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতে পায় খলিল আর দলিল লুঙ্গির খুঁট থেকে চিড়া বের করে মুখে দিয়ে চিবোচ্ছে।

চান মৌলবিকে দেখেই দুজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, মলিসাব ভালা আছেন?

চান মৌলবি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমাগো তানি বাঙলা মদ পাইলো কই?

খলিল দলিল খানিকটা চমকে উঠলেও দলিল বললো, বাজারে সাধনার ঘরেইত্ত কত আছে। তানি কাইল আওনের সময় মনে কয় আনছে।

কালাম মাঝির ঘুম ভাঙতেই সে ঘর থেকে গামছা কাঁধে বের হলে দেখতে পায় চান মৌলবি কাচারি ঘর থেকে বের হয়ে আসছে। তখনই তার মনে পড়ে যায় গতরাতের ঘটনা। ছিছি! তাহলে মেয়েটাও জানতে পেরেছে ব্যাপারটা! তখনই তার আরেক মন বলে উঠলো, আমার শরমের কি আছে! আমার ট্যাকা আছে আমি মদ খামু। ঘরজামাই শালার ব্যাটা কইবো কি? কিছু কইলে পাছায় লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিমু না!

আর এ কথা মনে হতেই সে স্বাভাবিক ভাবেই বলে, ওই ঘরে খইল্যা দইল্যা আছে?

চান মৌলবি মাথা নেড়ে পাশ দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকেন।

খলিল দলিল গতরাতের কথা ভেবে হয়তো খানিকটা শঙ্কিত বোধ করে। কিন্তু কিছুই যেন হয়নি এমন ভাব দেখিয়ে কালাম মাঝি বললো, মসিদের কাছে আমার যেই জমিডা আছে তার লগে অর্জুন সেনের দুই বিঘা জমি আছে। বিকাশের লগে আইজ দেখা কইরা কবি, ওই দুই বিঘা জমিন আমার চাই। দাম চাইলে দাম দিমু। জমিন চাইলে জমিন দিমু। তয় কথাডা জানি কারো লগে অখনই আলাপ না করে কইয়া দিবি।

খলিল দলিল দু’ভাই একই সঙ্গে বেরুতে গেলে কালাম মাঝি বললো, দইল্যা যাউক। খইল্যা তুই কিছুক্ষণ পর আমার লগে বাজারে যাবি।

তারপরই সে আবার তাকে জিজ্ঞেস করলো, নাস্তা-পানি কিছু খাইছস?

খলিল মাথা নেড়ে জানায়, চিড়া খাইছি!

তখনই কালাম মাঝি তাকে বললো, দইল্যারে ডাক দে। নাস্তা কইরা যাইতে ক!

খলিল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘর থেকে বেরিয়ে ছুটতে থাকে দলিল যে পথে গেছে সেদিকে।

কালাম মাঝি পুকুর থেকে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে এসে ফাতেমাকে ডাকে। ফাতেমা কালাম মাঝির জন্য খাবার নিয়ে এসে বিছানা পেতে দেয়।

তখনই দলিলকে দরজায় দেখা গেলে ফাতেমা তার হাতে ভাজা মাছ সহ পান্তাভাতের দুটো সানকি তুলে দেয়।

কালাম মাঝি ভাজা মাছ দিয়ে পান্তা ভাত খেতে খেতে ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বলে, মাইয়াগো বিয়া হইলে বাপের বাড়ি বেশিদিন থাকতে নাই। তুমি তোমার জামাইর বাইত্যে গিয়া থাকবা। অনেকদিন তো রইলা বাপের বাইত্যে। এইবার নিজের সংসারে গিয়া নিজের জিনিস বুইজ্যা লও।

ফাতেমা জানে, তার বাবা যখন তাকে তুমি করে বলে, বুঝতে হবে ভেতরে ভেতরে খুবই রেগে আছে। আর তখন তার বলা কথাগুলো না মেনে উপায় নেই। কিন্তু বাবার মুখে আকস্মিক ভাবে স্বামীর বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে সে যেন সহসা আকাশ থেকে ভূমিতে পতিত হয়। সঙ্গে সঙ্গে আৎকে উঠে বললো, এইডা কি কইতাছেন আব্বা! আমি আপনেরে ছাইড়া কই যামু? আর যার লগে আমারে বিয়া দিলেন, আপনেইত্তো জানেন মানুষটার চাল-চুলা নাই!

কালাম মাঝি ভাতের গ্রাস মুখে দিয়ে মাঝের কাঁটা বাছতে বাছতে মেয়ের দিকে তাকায়। ফাতেমার বিস্ময় যেন তখনো কাটেনি। চোখে মুখে যেন তাই জানান দিচ্ছে। কদিন ধরে চানমিয়ার মতিগতি ভালো ঠেকছে না। চান মৗলবি আজকাল জালাল শেখ আহমদ আলি বিশেষ করে যারা রাজাকার আর পাকিস্তানের নাম শুনলেই থুথু করে, কারো মুখে পাকিস্তান বা রাজাকারদের পক্ষে কোনো কথা শুনলে জুতো হাতে তেড়ে যায় তেমন মানুষদের সঙ্গে মিশছে। অনেক সময় তাদের দেখা যায় নিভৃতে বসে নিচু স্বরে আলাপ করতে। এও শোনা গেছে, দেশের রাজাকারদের নতুন করে বিচার করার জন্য মানুষ জোট বাঁধছে। স্বাধীন দেশের মাটিতে রাজাকারদের বিচার করতেই হবে এমন দাবী দিনদিন জোরালো হয়ে উঠছে। কিন্তু নিজের মেয়ের জামাই যদি বিরোধী পক্ষের ইন্ধন জোগায় তাহলে কেই বা এমনটা সহ্য করবে? যে কারণে চান মৗলবির প্রতি দিনদিন তার ক্ষোভও দুর্নিবার হয়ে উঠছে। মূর্খ মানুষদের যে যা বোঝায় তারা তাই বোঝে। বলা যায় না ফের কালাম মাঝিকে লোকজন আবরো কঠিন কোনো বিপদে ফেলে কি না। তাই শঙ্কিত কালাম মাঝি কোনোভাবে চানমিয়ার মুখ বন্ধ করতে ছলছুতা খুঁজতে আরম্ভ করেছিলো। এবং ছুতা একটা যেন পেয়েও গেল। সে খানিকটা সময় নিয়ে আবার বলে, তোমার সোয়ামীর ঘরবাড়ি না থাকলে হ্যায় যেহানে ঘুমাইবো তুমিও তার লগে ঘুমাইবা। গাছের নিচে থাকলে গাছের নিচে। মসিদে থাকলে মসিদে।

আব্বায় কি মজা করতাছেন? আপনে কি জানেন না মৌলবির কি আছে কি নাই?

আমি তো জাইন্যা বুইঝ্যাই তোমারে বিয়া দিছি। তার যে কিছু নাই তোমারেও কইছি। তুমি তো তহন কওনাই যে, অমন ফকিন্নির পোলারে বিয়া করমু না!

পিতার কথা শুনে ফাতেমার বুক ফেটে কান্না আসতে থাকে। সজোরে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে নিলেও সে কোনো রকমে সেটাকে চেপে রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু সে ভেবে পায় না যে, হঠাৎ করেই বা তার বাবা এমন ধরনের কথা বলছে কেন?

ফাতেমার নিরবতায় কালাম মাঝি খেতে খেতে বলে, তোমার জামাইরে কইও যে, মসিদের কাছে যেই জমিনডা আছে, ওহানে গিয়া জানি বাড়ি বাইন্ধা লয়। আর তুমিও জানো যে, ওই ফকিন্নির পোলার ট্যাকা-পয়সা নাই। লাগলে আমার কাছ থাইক্যা তুমি কর্জ নিয়া দিতে পার।

পিতার কথাবার্তা যেন চামারের কিংবা সত্যিকার একজন কসাইর মত বলেই মনে হয় ফাতেমার কাছে। প্রচন্ড ঘৃণা আর রাগে তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। যেন তার বাবা তাকে অপমান করার জন্যই কথাগুলো ইচ্ছে করে তাকে শোনাচ্ছে।

ফাতেমার চোখে পানি দেখতে পেয়ে হাহা করে হেসে ওঠে কালাম মাঝি। বলে, তুই কান্দস ক্যান? আমি একটা কথাও মিছা কই নাই। তুই আমার মরণের পরে যেই সম্পত্তি পাবি তার থাইক্যা যেই ট্যাকা তুই কর্জ নিবি তা বাদ দিমু!

বাবার কথা শুনে ফাতেমার মন প্রসন্ন হয়ে ওঠার বদলে খানিক আগে যেমন ঘৃণায় বিষিয়ে উঠেছিলো তা যেন ধীরে ধীরে তার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সে কি মনে করে হঠাৎ উঠে পড়ে কালাম মাঝির দৃষ্টির আড়ালে সরে যায়।

১১

চান মৌলবি শ্বশুর কালাম মাঝির বলা কথাগুলো স্ত্রী ফাতেমার মুখ থেকে শুনতে পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। রাতের আঁধারে তার মুখাবয়ব দেখতে পায় না বলে ফাতেমার চোখে পড়ে না রাগে আর অপমানে শক্ত হয়ে ওঠা চান মৌলবির চোয়ালের পেশীগুলো। বেশ কিছুক্ষণ সে এক ঠায় বসে থাকে বিছানার ওপর।

ফাতেমা তাকে শুয়ে পড়তে আহ্বান করলেও চান মিয়া তেমনি বসে থেকেই বলে, তোমার থালে যদি পরতেক দিন কেউ কুত্তারে খাইতে দেয়। আর হেই থাল আবার ধুইয়া মুইছ্যা তোমার সামনে দিয়া কেউ পোলাউ বাইড়া দেয়, তুমি কি খাইতে পারবা?

চান মৌলবির কথাটি প্রথমে ধরতে পারে না ফাতেমা। সে না বুঝেই বলে, কি কইলেন?

চান মিয়া ফের একই কথা বললে ফাতেমা সঙ্গে সঙ্গেই বলে ওঠে, কুত্তায় খায় এমন থালে মানষ্যে খায় ক্যামনে?

তাইলে আমরা মনে হয় মানুষ না।

ফাতেমা স্বামীর হেয়ালী ধরতে পারে না। বিস্মিত হয়ে তার একটি হাত টেনে নিয়ে বলে, আপনের কথার অর্ধেকই আমি বুঝতে পারি না। কি কইতাছেন ইট্টু সোজা কইরা কইলেইত্তো পারেন!

চান মিয়া বললো, এই যে আমরা এইখানে পইড়া আছি, কোন আশায়? দুইডা ভাতের লাইগ্যা?

ফাতেমা হঠাৎ করেই যেন বুঝতে পারে কথার প্রসঙ্গ কোন দিকে গতি নেবে। তাই সে অন্ধকারেই উঠে বসে স্বামীর কাঁধে গাল পেতে দিয়ে বলে, আব্বার কথাবার্তা আইজকাইল আমিও বুঝতে পারি না। মানুষটা দিনদিন জানি কেমন হইয়া যাইতাছে।

মানুষটা আগে যেমন আছিলো তেমনি আছে। সাপ দেখ না, বেশি শীত পড়লে গর্তে ঢুইক্যা থাকে। সুদিন পাইলে আবার বাইর হয়। তোমার বাপও এতদিন গর্তে ঢুইক্যা আছিলো। সময় ভালো হইছে দেইখ্যা গর্তের ভিতর থাইক্যা বাইর হইয়া আইতাছে। সাপ তো তার ছোবল ভুইল্যা যাইতে পারে না। বিষদাঁত না তুললে তার ছোবলে মানুষ মরবোই।

ফাতেমা এমন রহস্যময় কথা বুঝতে না পারলেও যেমন ছিলো, তেমনিই চুপচাপ থাকে। চান মৌলবি ফের বলেন, মানুষও সাপের মত তার বদস্বভাব ভুলতে পারে না। তোমার বাপের কীর্তিকলাপ যদি শোনো তাইলে তুমিই তার মুখে থুতু দিবা। এমন খারাপ চরিত্রের মানুষগুলা কেন যে বদলায় না! তুমি কি জানো তোমার বাপেরে মানুষ এখনও রাজাকার কইয়া গাইল দেয়?

তখনই ফাতেমা হেসে ওঠে। যেন কোনো শিশুর মুখে আধো আধো বোলে রাগের কিংবা অভিমানের কথা শুনছে।

তারপর বলে, রাজাকার তো ভালা! আব্বায় কইছে রাজাকাররা নাহি রাজার বংশ। আমাগ আসল দেশ পাকিস্তান।

তখনই অন্ধকারে শিউড়ে ওঠে যেন চান মৌলবি বলেন, ছিছি! মানুষ এমন বেশরম হইতে পারে! আরে এক কান কাটলে যায় বনে দিয়া, আর দুই কান কাটলে যায় মাঝ রাস্তা দিয়া।

ফাতেমা অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, এই কথার লগে কান কাটার কথা উঠতাছে ক্যান?

কারণ আছে। এই কথা আরেকদিন বলমু। কিন্তু তার আগে কও, তুমি কি আমার লগে যাইবা?

কই যামু? আর আপনে যাইবেন কই?

যেখানেই যাই। বলছিলাম না যে, কুত্তারে যেই থালে খাইতে দেয় হেই থালে তুমি পোলাউ খাইতে পারবা কি না! এখন তোমাগ বাড়ির ভাত আমার কাছে কুত্তার থালের পোলাউর মতনই মনে হইতাছে।

ফাতেমা স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পারে বলেই খানিকটা সময় নিয়ে বলে, হুনছি আপনের কিছুই নাই। নাই কোনো আত্মীয়-স্বজন। তাইলে আপনে যাইবেন কই?

যার নিজের ঘরবাড়ি নাই, সারা দুনিয়াই তার ঘরবাড়ি। আমার যদি মাথা গোঁজবার জাগা হয়, তাইলে তোমারও হইবো।

চান মৌলবির কথা শুনে ফাতেমা কেমন যেন শক্ত হয়ে বসে থাকে। ছোটবেলা থেকেই সে সচ্ছলতার ভেতর দিয়ে বড় হয়ে উঠেছে। অভাব কি জিনিস তা হয়তো তার কল্পনারও বাইরে। একবার দেশে দুর্ভিক্ষ লেগেছিলো। বলতে গেলে পুরো গ্রামের মানুষই ভাতের জন্য হাহাকার করেছে। রিলিফের পচা চাল আর পচা আটার জন্য মারামারিও করেছে। যারা কিছুটা স্বচ্ছল ছিলো তাদের ঘরেও মিষ্টি আলু আর কাউনের ভাত ছাড়া বাড়তি কিছু খাবারের ব্যবস্থা ছিলো না। সেই দুর্বিনীত সময়েও তারা পিতা-কন্যা তিনবেলা ভাত-মাছ খেতে পেরেছে। আর সে পরিবেশে বড় হওয়া ফাতেমা যেন চান মৌলবির কথায় অন্ধকারাচ্ছন্ন হাভাতে আর শতচ্ছিন্ন পরিধেয় সম্বলিত ভষ্যিতের বিকট মুখভঙ্গী কল্পনা করেই কেঁপে উঠলো। হয়তো বা শিউড়ে উঠলো তার অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবেই।

ফাতেমার এহেন পরিবর্তন যেন মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে যায় চান মৌলবির কাছে। তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন যে, এমন নির্লজ্জ আর গ্লানিকর জীবনের গণ্ডী থেকে নিজকে বিযুক্ত করবেনই। ভেবেছিলেন যে, একটি মানুষ চিরকাল দুশ্চরিত্র থাকতে পারে না। বয়সের উর্ধগতির সঙ্গে সঙ্গে মানব চরিত্রেও স্থিরতা আসে। অতীতের ভুলের জন্যও মনেমনে অনুতপ্ত হয়। কিন্তু কালাম মাঝি যেন এখনও সেই উনিশশো একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধী শান্তি কমিটির আজ্ঞাবহ। তাবৎ যুদ্ধাপরাধী আর রাজাকারীয় চরিত্রের সক্রিয় মূর্তি। মনেমনে যে ব্যক্তি এখনো এ দেশে উড়াতে চায় চাঁদতারা খচিত সাদা আর সবুজ কাপড়ের তাপ্পি মারা পতাকা। অথচ তার মন থেকে এখনো হয়তো মুছে যায়নি ন্যাংটো হয়ে গলায় জুতার মালা পরে সারা গ্রামে হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি। গ্রামের একমাত্র মসজিদের সামনে লোকজনের বৃত্তে মুক্তিযোদ্ধার মুখ থেকে ফেলা থুতু মাটি থেকে জিভ দিয়ে চেটে তোলার যন্ত্রনাময় ঘটনার লজ্জা।

চান মৌলবি অন্ধকারেই ফাতেমার দিকে ঘুরে বসে বলে, তুমি যদি আমার সঙ্গে যাইতে রাজি থাক, তাইলে মনে মনে তৈয়ার হও।

কিন্তু ফাতেমা যেন চান মৌলবির পরিকল্পনার কথা শুনতে পেয়েই স্থবির হয়ে গেছে। ভোঁতা হয়ে গেছে তার যাবতীয় বুদ্ধি-বিবেচনার শান।

চান মৌলবি অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, তোমার ইচ্ছা না হইলে যাইবা না। আমি যেমন তোমারে জোর কইরা বিয়া করি নাই, তেমনই তোমার মনের উপরে কোনো জোর করতে চাই না। আমি মানুষটা এত খারাপ না। যুদ্ধের বছর যুদ্ধে না গেলেও রাজাকার হইতে পারি নাই।

ফাতেমা স্বামীর কথার অর্থ আর উদ্দেশ্য ধরতে না পারলেও বেশ বুঝতে পারছিলো যে, লোকটির সঙ্গে এতদিন যে সহজ একটি সম্পর্ক বজায় ছিলো তা হয়তো আগামী দিনগুলোতে অতটা সহজ থাকবে না। এখন যেমন অন্ধকারে বসে থেকে তার সমস্ত দেহ আর মন আড়ষ্ট হয়ে আছে চান মিয়ার সঙ্গে জীবন কাটাতে চাইলে হয়তো বাকী জীবনটা এমনই আড়ষ্ট ভাবেই কাটাতে হবে।

ফাতেমাকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে চান মৌলবি নিজে শুয়ে পড়ে বললো, শুইয়া পড়লাম। আমার ঘুম পাইতাছে।

চান মৌলবি শুয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাতেমা বিছানা থেকে নেমে পড়ে। তারপর চুপচাপ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে একবার মুখ তুলে তাকায়। বেশ ঘন হয়ে আকাশে তারা ফুটেছে আজ। অনেক ছোট ছোট তারাকেও কেমন পরিষ্কার দেখতে পায় সে। কিন্তু তখনই হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে চোখ দুটো কান্নার জোয়ারে ঝাপসা হয়ে যায়। কদিন যাবৎ টের পাচ্ছে তার দেহে আরেকটি প্রাণের অস্তিত্ব। অথচ ব্যাপারটি জানাবে জানাবে করেও সুযোগ পাচ্ছিলো না সে। তার ওপর চান মৌলবির এমন একটি কঠিন সিদ্ধান্ত শুনে বলতে গেলে তার মনটাই যেন ভেঙে গেল।

১২

প্রতিদিনকার মত ফজরের নামাজ পড়তে গিয়ে ফিরে আসেননি চান মৌলবি। বেলা অনেক হয়ে গেলেও তার ফেরার কোনো আলামত দেখতে না পেয়ে শঙ্কিত ফাতেমা উঠোনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মসজিদের দিকে তাকায়। নিত্যদিনকার প্রাতঃকালীন আরবি পাঠ সেরে শিশুরাও হয়তো যার যার ঘরে ফিরে গেছে। কিন্তু চান মৌলবি তো এখনো ফিরে এলো না। তাহলে কি সত্যি সত্যিই লোকটি চলে গেছে? ব্যাপারটি মনে হতেই ফাতেমার বুকের ভেতরটা কেমন দুরদুর করে ওঠে। লোকটা যে সত্যিই চলে যাবে কথা শুনে কিন্তু মোটেও এমনটি মনে হয়নি তার কাছে। সে ভেবে নিয়েছিলো যে, মনের ক্ষোভেই বুঝি কথাগুলো বলছিলো মৌলবি। আর যার চাল-চুলো নেই তেমন একটি মানুষ যতটাই রাগ করুক যাবে আর কোথায়? তাই ব্যাপারটিকে তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়নি তার কাছে। যে কারণে তার মনে হয়েছিলো তাকে আর তার বাবা কালাম মাঝিকে অপমান করতেই বুঝি মৌলবি কথার ছুরি শানাচ্ছে। কিন্তু সত্যি সত্যিই যদি লোকটি চলে যায় তাহলে তো ব্যাপারটি খুবই দুঃখজনক। আর গ্রামের মানুষের কাছে যখন ঘটনাটি প্রকাশ হয়ে পড়বে, তাহলে কি সেও নিরাপদ থাকবে? লোকজন নানা ধরনের রসালো মন্তব্য করা থেকে আরম্ভ করে আরো বিচিত্র ধরনের গল্প ফেঁদে বসবে। তা ছাড়া এখন চান মৌলবিকে ছাড়া তারও তো দিনরাত দুর্বিসহ হয়ে পড়বে।

হঠাৎ করেই সে কেমন উদভ্রান্তের মত ছুটে যায় কাচারি ঘরে। এ ঘরে সে সাধারণত আসে না। আর কোনো জরুরি প্রয়োজনে আসতে হলেও সে বাইরে থেকেই খলিল কিংবা দলিলকে ডাকে। কিন্তু আজ সরাসরি কাচারি ঘরে ঢুকেই কেমন অপ্রস্তুত হয়ে যায়। বেশ কিছু অচেনা মানুষ বসে আছে কালাম মাঝিকে ঘিরে। সবারই পরনে টুপি-কোর্তা আর গালভর্তি দাড়ি থাকলেও চেহারা কেমন যেন ধারালো আর ষণ্ডাগোছের মনে হয়। অচেনা মুখগুলো হঠাৎ করেই যেন তার দিকে ঘুরলো আর তখনই কিছু দর্শনীয় ও লোভনীয় দৃশ্য দেখে বোধকরি তাদের প্রত্যেকের দৃষ্টিই চকচকে হয়ে উঠলো। তাদের নগ্ন দৃষ্টির সামনে নিজকেই যেন নগ্ন মনে হয় ফাতেমার। আর এমন একটি ব্যাপার মনে হতেই  তার পুরো দেহ থরথর করে কেঁপে ওঠে মুহূর্তেই।

কালাম মাঝি ফাতেমাকে দেখে হঠাৎ বেশ নরম সুরে বলে উঠলো, কী কইবা আম্মা?

পিতার মুখে এমন ডাকটা সে অনেক কাল শুনতে পায়নি। যে ডাকটা শুনলে তার হাত-পা শিথিল হয়ে যায়। শিথিল হয়ে যায় মনের ভেতরকার যাবতীয় অস্থিরতাও। মনে হতে থাকে পৃথিবীটা বুঝি চিরকালই এমন মায়াময়। এমন কোমলতায় আচ্ছন্ন। কিন্তু এ মুহূর্তে পিতার কন্ঠে মধুর সম্বোধন শুনতে পেয়েই হয়তো কান্নার বেগ সামলাতে পারলো না সে।

কালাম মাঝি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলাপ করছিলো লোকগুলোর সঙ্গে। যারা অনেকেই অনেক দূরগ্রাম থেকে এসেছে। আলোচনায় ব্যাঘাত হলেও কালাম মাঝি তেমন একটা বিরক্ত হয় না। কন্যার চোখে পানি দেখলে তার সবকিছুই যেন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন কন্যার চাইতে পৃথিবীর আর কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না। তাই সে আলোচনার কথা ভুলে গিয়ে উঠে এসে ফাতেমার মাথায় হাত রেখে বললো, কী হইছে আম্মা? ওই ঘরে চলো!

কাচারি ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ফাতেমা তার বাবার একটি হাত ধরে সজোরে ডুকরে উঠে বলে, তানি বুঝি সত্য সত্যই চইল্যা গেছে!

হঠাৎ করেই ফাতেমার কথা বোধগম্য হয় না কালাম মাঝির। সে কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ক্রন্দনরত আত্মজার দিকে তাকিয়ে থাকে।

ফাতেমা হঠাৎ কালাম মাঝির হাত ধরে ঝাাঁকি দিয়ে বলে উঠলো, একটা কিছু করেন আব্বা! মানুষটা আমারে ফালাইয়া চইল্যা গেছে মনে কয়।

এবার যেন মেয়ের আকুতি কালাম মাঝির বোধকেও সজোরে নাড়া দেয়। মুহূর্তেই তার চোয়াল দুটোর পেশী ফুলে উঠতে দেখা যায়। দেখায় চোখ দুটো লালচে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকের পাটা দুটোও ফুলে উঠেছে। তবুও সে যথাসম্ভব কন্ঠস্বর সংযত করে বললো, মোলোবি কি তরে এই কথা কইছে?

ফাতেমা আঁচলে নাক মুছে জানালো, কাইল রাইতে কইছিলো আইজ হ্যার লগে যামু কিনা। এই বাইত্যে হ্যার থাকনের ইচ্ছা নাই।

আইচ্ছা যা। আমি দেখি। তুই কোনো চিন্তা করিস না। আইজ না পারি কাইল একটা খবর আইন্যা দিমু।

ফাতেমাকে সান্ত্বনা দিলেও ফাতেমার কান্না থামে না। কিন্তু তা যেন আর দেখার প্রয়োজনও বোধ করে না কালাম মাঝি। সে ফের কাচারি ঘরে গিয়ে ঢোকে। আর কিছুক্ষণের ভেতরই দেখা যায় লোকগুলো একে একে বেরিয়ে যাচ্ছে।

কালাম মাঝি লোকগুলোকে কিছুটা দূর অবধি এগিয়ে দিয়ে এসে ফাতেমাকে বললো, তুই পাগলামী করিস না। আমি এহনই বাইর হইতাসি। ঘরেই থাকিস কইলাম।

সেই যে কালাম মাঝি বেরিয়ে যায় তারও ফেরার কোনো লক্ষণ দেখতে পায় না ফাতেমা। ভীতচিত্তে ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় রুদ্ধ শ্বাসে সে অপেক্ষা করে পিতার ফিরে আসার। দুপুর গড়িয়ে গিয়ে বিকেল আসে। বিকেল গড়িয়ে গিয়ে রাত নামলেও কালাম মাঝি ফিরে আসে না। কিন্তু বিনিদ্র রাত কাটিয়ে দিয়ে ভোরের দিকে সে জানালা খুলতেই তার বাবার কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। কারো সঙ্গে যেন কথা বলতে বলতে আসছে।

তখনই সে দরজা খুলে দিয়ে পিতার আগমনের অপেক্ষায় থাকে। আর পিতাকে দেখতে পেয়ে সে আগ্রহ ভরে ভারী কন্ঠে জানতে চায়, খবর পাইলেন?

কালাম মাঝি মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। কিন্তু মেয়ের অস্থির  কণ্ঠে বারংবার জিজ্ঞাসায় নিশ্চুপ থাকতে না পেরে বলে উঠলো, মোলোবির আশা ছাইড়া দে মা!

ক্যান আব্বা? ফাতেমার মুখে বিস্ময় ঝাঁপিয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখ দুটোও বড়বড় হয়ে যায়।

তুই এই কথা আমারে জিগাইস না। কইলে সহ্য করতে পারবি না।

ফাতেমা নিজকে অতটা দুর্বল নারী হিসেবে ভাবে না হয়তো। তাই সে এবার দৃঢ়কন্ঠে জানতে চায়, আপনে কন আব্বা। যত কষ্টেরই হউক, আমি শুনতে চাই। মানুষটা কি বাইচ্যা নাই?

কালাম মাঝি চকিতে একবার তাকায় মেয়ের মুখের দিকে। তার চোখে চোখ পড়ে। তারপরই সে দৃষ্টি নামিয়ে বলে, চাল-চুলা আর ঠিকানা ছাড়া মানুষরে কই খুঁজমু মা!

এইডা কি কইলেন আব্বা? একটা মানুষ একই দিনে আর কদ্দুর যাইতে পারবো?

কালাম মাঝির কাছে ফাতেমার প্রশ্ন করার ধরন ভালো ঠেকে না। তার মনটাও কেমন যেন আজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে।

১৩

চান মৌলবি নিখোঁজ হলে গ্রামের মসজিদে ফের জামাত পড়ানোর সংকট তৈরী হয়। লোকজন অনেকেই কালাম মাঝিকে বলেছে ইমাম হতে। সে কোনোরকমে বাংলা লিখতে পড়তে জানলেও আরবী একেবারেই জানে না। সেটাও তার সাহস সঞ্চয় করতে না পারার একটি বড় কারণ। কিন্তু তবুও তার ইচ্ছে থাকলেও জালাল শেখ আহমদ আলি আর কালু মিয়ার কথা ভেবে সম্মত হতে পারে না।ওরা সত্যিকার অর্থেই তাকে ঘৃণা করে। পেছনে নামাজ পড়া তো দূরের কথা, তাকে যে মসজিদে ঢুকতে দেয় এই অনেক! ইমাম হওয়ার দুঃসাহস দেখাতে গেলে সেটা তার জন্য কাল হয়েও দাঁড়াতে পারে। তাই গ্রামের লোকজন মিলে মাদ্রাসার এক ছাত্রকে ঠিক করেছে কেবল জুম্মার নামাজ পড়ানোর জন্য। কিন্তু এটা কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করছে সবাই মিলে।

পাকা পুল তৈরীর কাজ আরম্ভ হয়েছে বলে ক’টা দিন খুব ব্যস্ততায় কেটেছে কালাম মাঝির। কিন্তু এরই ভেতর দিয়ে শোনা যাচ্ছিলো যে, বিকাশ সেন তার পৈতৃক ভিটা বিক্রি করে দিয়েছে কালাম মাঝির কাছে। কিন্তু এ কথা শোনার পর বিকাশ সেন নিজেই ছুটে এলো কালাম মাঝির কাছে। আর কালাম মাঝিও যেন এমনটিই চেয়েছিলো। বিকাশ সেন ঘরে ঢুকেই কালাম মাঝির একটি হাত ধরে ডুকরে উঠে বললো, আমি তোমার কোন ক্ষতিডা করছিলাম?

কিছুই তো বুঝতে পারতাছি না। তুমি কী কও?

আমি নাহি আমার বসত ভিটা তোমার কাছে বেইচ্যা দিছি?

কালাম মাঝি হঠাৎ ঘর ফাটিয়ে হেসে উঠে বললো, দুধ ছাড়া তো আর দই হইতে পারে না। তোমার জাগা জমিন আস্তে আস্তে তো সবই যাইতাছে। বাড়িডাও তো যাওনের পথে। তো আমি কই কি, তুমি বাড়ির কিছুডা অংশ আমার কাছে বেইচ্যা দিতে পার। কুয়াডাতো মনে কয় বন্ধ হইয়া গেছে। জাগাডাও ঝাড়-জঙ্গলে ভইরা গেছে। যে জাগা কোনো কাজে লাগে না, সেইডা রাখনের কোন দরকার আছে বইল্যা মনে করি না!

কেমন সন্দেহজনক ঘোলা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বিকাশ সেন বললো, জঙ্গল দিয়া করবা কি?

কালাম মাঝি আবার হাসে। দাড়িতে হাত বুলিয়ে জানায়, একটা ঠিকানা। তোমার বাড়িডা হইবো আমার আসল ঠিকানা। আর আমি তোমার পড়শী হইলে কাউয়া-কুত্তা আর চোখ দিতে পারবো না।

বিকাশ সেনকে চুপ থাকতে দেখে, কালাম মাঝি আবার বললো, ভাইব্যা দেখ দাদা! দাম তোমারে খারাপ দিমু না। তোমারও লাভ হউক লগে লগে আমারও কিছুডা লাভ হউক। তয় ভাবনা চিন্তা কইরা আগে দেখ। পরে আমারে জানাইও। কোনো জোরাজুরি নাই। তোমার মন চাইলেই কইবা। নাইলে নাই।

বিকাশ সেনের মন না চাইলেও যে তার না বলার জো নেই তা অস্বীকার করবে কিভাবে? ধূর্ত কালাম যেভাবে কথাটিকে চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে, কোনদিন না এ কথা ছড়িয়ে দেবে যে, পুরো ভিটেমাটিই কালামের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। এ দেশে কী না সম্ভব? যুগ যুগ ধরে প্রবাহিত প্রাকৃতিক নদী-খালও ব্যক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ মালিকানার দলিলও দেখাচ্ছে প্রমাণ হিসেবে। কালাম যে কোনো দিন সেটা করবে না তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বিকাশ সেন বিষাদ মুখে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই খলিল খানিক ব্যস্ত ভঙ্গীতে ঘরে ঢুকলে কালাম মাঝিও চমকে ফিরে বলে, কিরে?

খলিল, নিচু স্বরে বলে উঠলো, ভাইস্যা উঠছে!

খলিলের কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কালাম মাঝির মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যায় হঠাৎ। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠলো, কিছু একটা কর!

সময় নাই! খলিল আরো নিচু কণ্ঠে প্রায় ফিসফিস করে বলে, অনেক মানষ্যে খাড়াইয়া খাড়াইয়া দেখতাছে। চকিদার গেছে থানায়। পুলিশও আইয়া পরতে দেরি নাই!

কালাম মাঝি খানিকটা ভেবে বললো, তাইলে আমাগ মানুষরে কইয়া দে, পুলিশে জিগাইলে জানি কয়, লাশ কার কেউ চিনে না। এই গ্যারামে আগে দেখে নাই। পুলিশ না যাওন পর্যন্ত কেউ জানি না সরে!

যদিও সে খলিলকে কথাটা বললো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়লো। নাভির কাছে পেটের ভেতর কেমন চিনচিন করে ব্যথা করতে থাকে। সময় পেরুনোর সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরটাও যেন অবসন্ন হয়ে আসতে থাকে। সে বিছানায় পড়ে থাকে স্থির হয়ে। আর তখনই যেন ঝড়ের বেগে ফাতেমা এসে বললো, আব্বা খালের পানিতে নাহি কারো লাশ ভাইস্যা উঠছে। আপনে কি একবার দেখবেন?

কালাম মাঝি ভেতরে ভেতরে আতঙ্কের কারণেও হয়তো অসুস্থ বোধ করছিলো। তাই সে বললো, কার না কার লাশ আমি দেখতে যামু ক্যান? আর এই খবর তুই পাইলি কই?

হুনলাম কয়জন যাইতে যাইতে কইতাসে খালের পানিতে নাহি লাশ ভাইস্যা উঠছে।

কালাম মাঝি তেমনি নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করে বললো, মাইয়ালোকের লাশও তো হইতে পারে।

আমাগ তানি যদি হয়? ফাতেমার কণ্ঠে কান্নার বিস্ফোরণ ঘটতে যেয়েও যেন অকস্মাৎ চাপা পড়ে যায়।

কালাম মাঝি মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আরো মুষড়ে পড়ার অবস্থা হয়। ফাতেমা যদি জানতে পারে যে, এটা সত্যিই চান মৗলবির লাশ তাহলে শোকে আর দুঃখে হয়তো পাগল হয়ে যাবে। সে কণ্ঠস্বর নরম করে বললো, মোলোবির লাশ হইতে যাইবো ক্যান মা? তারে মানষ্যে খুন করতে যাইবো কোন কারণে? তার কি কারো লগে জমি-সম্পদ না ট্যাকা-পয়সার মামলা আছিলো? তুমি হুদাহুদি বদ চিন্তা কইরো না মা। যারা পরের উপরে খাইয়া মানুষ হয়, তাগো আক্কল-পতার কিছুডা কমই হয়। হ্যায় যে, বাড়ি ছাইড়া গেল একবার কি ভাবছে আমাগো এহন কী হইবো? আমরা কি গ্যারামে মুখ দেখাইতে পারমু? তার কি উচিত আছিলো না একবার কইয়া যাওয়া?

ফাতেমা তার বাবার কথায় আস্বস্ত হতে না পারলেও ফের কোনো প্রশ্ন তোলে না। কিন্তু সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় যে, সে নিজে গিয়েই দেখবে। তার মন বলছে চান মৌলবির নিরুদ্দেশের পেছনে কোনোভাবে হলেও তার বাবা কালাম মাঝির হাত আছে। তার বাবার অতীত ইতিহাস নাকি খুব একটা ভালো না। তবে সে জানতে আগ্রহ প্রকাশ না করাতে সে আলোচনা আর বেশি দূর এগায়নি। এমনিতেও চান মৌলবি খানিকটা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলো নিজের নিরাপত্তা নিয়ে। একদিন রাতের বেলা কারা যেন অন্ধকারে তাকে জাপটে ধরেছিলো। কোনোক্রমে নিজকে মুক্ত করে ঘরে ফিরে আসতে পেরেছিলো। সে ঘটনা কাউকে বলতে নিষেধ করেছিলো মৌলবি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে ঘটনার সঙ্গেও এ ঘটনা জড়িয়ে থাকতে পারে।

আব্বা আমি ইট্টু বাইরের থাইক্যা আইতাছি। বলে, ফাতেমা ঘর থেকে বোরখা নিয়ে বের হয়ে যায়। পথে নামতে নামতে বোরখা গায়ে চড়াতে চড়াতে অনুভব করে যে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন খাখা করছে। দুচোখ ফেটে নামতে চাচ্ছে পানির স্রোত। সে দ্রুত পায়ে খাল পাড়ে মানুষের জটলার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করে কয়েকজন পুলিশের পোশাক পরা লোকজনও আছে।

সে এগিয়ে গিয়ে মেয়েদের ভীড়ের দিকে যেতে চাইলে পুলিশের একজন বলে উঠলো, এই তুমি কে? কি চাও?

ফাতেমা ভীত কণ্ঠে জানায়, লাশ দেখতে আইছি।

তুমি কি লাশ চিনবা?

লাশ পুরুষ না মাইয়ালোকের?

পুরুষ।

ফাতেমা তখনই প্রায় ছুটে যাওয়ার ভঙ্গীতে ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে যায়। আর পানিতে ভেসে ওঠা দুর্গন্ধময় লাশটি দেখেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। তখনই আশপাশ থেকে লোকজন বলে উঠলো তুমি কান্দ ক্যান?

ফাতেমা বোরখার নেকাব তুলে বলে ওঠে, এইডা তো চান মোলোবির লাশ!

কয়েকজন সঙ্গে সঙ্গে খেকিয়ে উঠে বললো, হ, তোমারে কইছে! দিনরাইত যারে আমরা মসিদে দেখি হ্যারে আমরা চিনি না আর তুমি চিন্যা ফালাইলা? চান মোলোবি দাড়ি কাটলো কবে?

পুলিশের লোকটি এ কথা শুনতে পেয়ে ফাতেমাকে বললো, চিনতে পারছো?

কান্না ভুলে গিয়ে ফাতেমা কেমন বিভ্রান্ত দৃষ্টি নিয়ে একবার পুলিশের মুখ আরেকবার লাশের মুখ দেখে। হঠাৎ তার মনে হয়, চান মৌলবির তো বড়বড় দাড়ি ছিলো। আর তখনই সে সবেগে মাথা নেড়ে জানায়, না। মনে বুঝছিলাম তানি বুঝি আমাগো মোলোবি সাব!

১৪

দিন কয়েক গ্রামের পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে রইলো। বিশেষ করে কালাম মাঝির বিপক্ষের কাউকে পুলিশ সাক্ষী না করাতে তারাও বেশ ক্ষুব্ধ ছিলো। লাশটি চান মৌলবির না হোক নিরুদ্দেশ হওয়ার ব্যাপারটিও পুলিশের তদন্তের তালিকায় থাকা উচিত ছিলো। কিন্তু এ ব্যাপারে কী করণীয় তার দিক নির্দেশনার অভাবে গ্রামের লোকজন কিছুদিন পরই ফের ঝিমিয়ে পড়তে বাধ্য হয়। আর তার সঙ্গে সঙ্গে কালাম মাঝিও বন্ধ হয়ে যাওয়া পুলের কাজটি নতুন উদ্যমে তদারকি আরম্ভ করে দেয়।

এদিকে ফাতেমা যেন তার সব উদ্যম হারিয়ে স্থবির হয়ে গেছে। কোনো কিছুতেই যেন তার আগ্রহ নেই। এক বেলা খেতে না পেয়ে কালাম মাঝি দলিলকে বললো, সংসার দেখাশুনার জন্য কাউকে যোগাড় করতে। আর এটিকে কোনো সুযোগ ভেবেই হয়তো দলিল তার বড় মেয়ে কনিকে নিয়ে আসে।

বিয়ের বছর দুয়েক পর কনির স্বামী আরেকটি বিয়ে করলে সে বাপের বাড়ি ফিরে এলে স্বামী তাকে ফিরিয়ে নিতে আসেনি বলে তারও যাওয়া হয়নি। তার সম্পর্কে গ্রামে নানা ধরনের রসালো গুজব থাকলেও কালাম মাঝির পরিবারে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে সে জানালো রাতের বেলা এখানে থাকতে পারবে না। কালাম মাঝি কিংবা ফাতেমা এতে আপত্তি করার কোনো কারণ হয়তো দেখেনি। চালাক-চতুর বলে কালাম মাঝির সংসার বুঝে নিতে দেরি হয় না কনির। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘরে বাইরের সব কাজ এক হাতে সামাল দিতে যেন তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় না। অভাব অনটনে বেড়ে উঠলেও কালাম মাঝির ঘরে এসে তিনবেলা পেট পুরে খেতে পেয়ে তার দেহে যেটুকুর অভাব ছিলো তাও যেন লুপ্ত হয়ে গেল অল্প কিছু দিনেই। সারাদিন কাজ সামলে রাতের বেলা খাওয়ার পাট চুকিয়ে সে তার বাবা দলিলের সঙ্গেই চলে যায়। আর এভাবেই ফাতেমার নিষ্ক্রিয়তায় কালাম মাঝির সংসারটি এলামেলো হয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও তা চলতে থাকে সুচারু ভাবেই।

পাকা পুলের কাজ শেষ না হতেই কালাম মাঝি ঘোষনা দিলো মাদ্রাসা তৈরী করবে। আর এ কাজে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে সর্বস্তরের লোকজনই যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো। দুদিকের কাজ সামাল দিতে গিয়ে আজকাল কালাম মাঝির হিমশিম খেতে হয়। যে কারণে হাত পা ব্যথার কথা জানালে কনি নিজেই আগ্রহ ভরে বলে ওঠে, তেল গরম কইরা ডইল্যা দিমু?

আর এ কথা শুনেই যেন দীর্ঘকালের ঘুম থেকে জেগে ওঠে ফাতেমা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে কনির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ব্যাপারটি কালাম মাঝিরও দৃষ্টি এড়ায় না। সে ফাতেমাকে বললো, কিছু কইবি মা? ভাত খাবি?

ফাতেমা তখনই বিছানা থেকে নেমে আসে। থালা টেনে নিয়ে নিজেই খেতে বসে। কনি দাঁড়িয়ে দেখলেও এগিয়ে আসে না। ফাতেমাকে তার ভীষণ ভয়। শুনতে পেয়েছে গ্রামের বউ-ঝিরা বলাবলি করছিলো যে, চান মৌলবি নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর ফাতেমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই সে পারতপক্ষে ফাতেমার ধারে কাছে আসে না। কিন্তু কালাম মাঝির কথামত দূর থেকে তার দিকে দৃষ্টি রাখতে ভোলে না। তবুও মাঝে মাঝে ঘর থেকে বেরিয়ে পাড়ার বিভিন্ন মেয়েদের  সঙ্গে কিকি বিষয় নিয়ে আলাপ করে তা জানতে না পারলেও ফাতেমা যে স্বামী শোকের অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে এসেছে এটাই যেন কালাম মাঝির জন্য অনেক বেশি আনন্দের।

এরই মাঝে একদিন হঠাৎ মুন্নাফ দফাদারের মেয়ে পানিতে পড়ে গেলে বাড়ির পুব দিক থেকে একটি শোরগোল শুনতে পেয়ে হঠাৎ ফাতেমা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়। আর সে সংবাদ দিতে এসে কনি দেখতে পায় কালাম মাঝিকে দুজন লোক দুপাশ থেকে ধরে বাড়ি নিয়ে আসছে। কনি জিজ্ঞেস করলো, হইছে কি? তখনই তার চোখ পড়ে কালাম মাঝির ডান পায়ের আঙুলে সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা।

লোক দুটো কালাম মাঝিকে ঘরে নিতে নিতে বললো, পায়ের উপরে ইট পড়ছে। বুইড়া আঙ্গুলডা ছেইচ্যা গেছে!

বিছানায় শুয়ে তাকলেও হয়তো পায়ের যন্ত্রণায়ই উহ আহ করছিলো কালাম মাঝি। তারপরও বললো, দেখতো ফাতেমা কই গেল! দেখলাম মুন্নাফ দফাদারের বাড়ির দিগে গেল।

কনি ফাতেমার খোঁজে বেরিয়ে এলেও তাকে কোথাও দেখতে পায় না।

মুন্নাফের মেয়ের শুশ্রুষায় ব্যস্ত আহমদ আলির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো ফাতেমা। হয়তো ভিড়ের কারণেই সে কনির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। তাই সে ফিরে এসে জানায় যে, ফাতেমাকে সে কোথাও দেখতে পায়নি। উদ্বিগ্ন কালাম মাঝি বিছানায় উঠে বসলে কনি বললো, আপনে তো হাঁটতে পারবেন না। বিছনা থাইক্যা নাইম্যেন না।

কালাম মাঝি বললো, মাইয়াডা গেল কই দেখতে হইবো না?

কনি বললো, আমি আবার দেখতে যাইতাছি। আপনে বিছনায় থাকেন। বলেই সে বেরোয়। আর তখনই উঠোনে মুখোমুখি হয় ফাতেমার। সে বললো, কই গেছিলা? তোমার বাপের পায়ে ইট পইড়া ছেইচ্যা গেছে!

তখনই ফাতেমা খানিকটা ব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকে তার বাবাকে বিছানায় বসে থাকতে দেখে বললো, পায়ে ইট পড়লো ক্যামনে?

যে প্রশ্ন একজন সুস্থ আর স্বাভাবিক মানুষের মুখ থেকে বের হওয়ার কথা, তা ফাতেমার মুখ থেকে শুনতে পেয়ে যেন তার বুকের ভার নিমেষেই তিরোহিত হয়ে যায়।

বিকেলের দিকে পায়ের ব্যথা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্বরও বুঝি আসে কালাম মাঝির। সে কেমন কাঁপতে কাঁপতে বলে, আমারে একটা ক্যাথা দে দেখি!

তখনই ফাতেমা একটি কাঁথা এনে কালাম মাঝির গায়ে দিয়ে দেয়। কপালে হাত দিয়ে জ্বরের তাপ যেন পরখ করে সে। তারপর কনিকে বললো, তুই বাবার কাছে থাক, আমি একামত ডাক্তারের বাইত্যে যাইতাসি। আব্বার জ্বর বেশি বাইড়া গেলে মাথায় পানি ঢাইল্যা দিস!

ফাতেমা বেরিয়ে গেলে কালাম মাঝির কাতরানি বেড়ে যায় আরো।

খানিকটা দ্বিধা নিয়ে কনি যখন কালাম মাঝির কপালে হাত রাখে তখনই সে কনির হাতটি ধরে বলে উঠলো, মাথাডা জানি ছিড়া পড়তাছে। ইট্টু টিপ্যা দে দেহি!

কনি কালাম মাঝির পাশে বসে তার মাথা টিপতে থাকলে কালামের যেন খানিকটা আরাম বোধ হয়। সে কাতরানো থামিয়ে চোখ বোঁজে। হয়তো বা ঘুমিয়েও পড়ে। কিন্তু কনির যেন সে বোধ নেই সে তখন কালামের চুলের ফাঁকে বিলি দিতে থাকে।

ফাতেমা একামত ডাক্তারের বাড়ি থেকে ফিরতে বেশি সময় নেয় না। ঘরে এসে কনিকে তার বাবার পাশে বিছানায় বসে থাকতে দেখে বললো, জ্বর কিমুন? বলেই সে কালাম মাঝির কপালে হাত রাখে। বেশ তাপ আছে। কিন্তু ডাক্তার যে বড়িগুলো দিয়েছিলো তা পাওয়া যায় কালাম মাঝির কোর্তার পকেটে। সেখান থেকে দুটো বড়ি নিয়ে সে কনির সামনে বিছানার ওপর রেখে বললো, আব্বায় জাগলে এই দুইডা বড়ি পানি দিয়া খাইতে দিবি।

তারপরই যেন সে নতুন ব্যস্ততায় ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে।

১৫

দীর্ঘকাল জনবিচ্ছিন্ন থাকার ফলে গ্রামের পরিবেশ কেমন বলতে পারবে না ফাতেমা। কিন্তু যেদিন গ্রামে পুলিশ এসেছিলো সেদিনই সে প্রথম নিজের ঘর থেকে এতটা দূর এসেছিলো। আর তার পর থেকেই যেন বাহির তাকে আকর্ষণ করতে থাকে প্রবল বেগে। যদিও মাঝখানে ক’টা দিন সে বেশ মুষড়ে পড়েছিলো কিন্তু পাড়ার বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের সঙ্গে মেশার ফলে বেশ একটা সখ্য গড়ে উঠেছে তাদের সাথে। সবচেয়ে বেশি সখ্য হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলির ছোট মেয়ে স্কুল মাস্টার রাজিয়া সুলতানার সঙ্গে। বেশি বয়সে নতুন করে সে স্কুলে ভর্তি হতে পারবে কি না এ কথা জিজ্ঞেস করতেই বেশ অবাক হয়ে উঠেছিলো রাজিয়া সুলতানা। যদিও তার বয়স ফাতেমার চেয়ে অনেক কম, তবুও ফাতেমার খুব ভালো লাগে তাকে।  আর তাদের নানা আলাপ আলোচনার ভেতর দিয়ে যেন নতুন করে চিনতে পারছে তার জন্ম-দাতাকে। একটু একটু যা জেনেছিলো স্বামী চান মৌলবির কাছে। আরো অনেক কিছুই জানতে পারছে সে নতুন করে। সবচেয়ে অবাক করার মত ঘটনা হচ্ছে যে, দেশটা এখন আর পাকিস্তান নয়। বাংলাদেশ। যদিও তার বাবা শিখিয়েছিলো রাজাকার অর্থ রাজার বংশ। রাজিয়া সুলতানার কাছেই প্রথম সে জানতে পারলো যে, রাজাকার আসলে বাংলাদেশে একটি নোংরা গালি। যেমন বেজন্মা, জারজ শব্দগুলো গালি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ। তেমনি রাজাকার শব্দটিও গালি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ। তবে এ গালির সঙ্গে মিশে থাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের কিছু কলংকিত অধ্যায়। যাদের রাজাকার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অমানবিকতা আর দেশদ্রোহীতার অপরাধের সঙ্গে খুন-রাহাজানি, বসত বাড়িতে অগ্নি সংযোগ, নারীর শ্লিলতা হানি সহ বিচিত্র ধরনের অপরাধের ইতিহাস। সেই সঙ্গে রাজাকার শব্দটির সঙ্গে মিশে থাকে সাধারণ দেশ প্রেমিক মানুষের যাবতীয় ঘৃণা। যদিও গ্রামের অনেক মেয়েই জানে যে কালাম মাঝি রাজাকার। কিন্তু রাজাকার যে আসলে কী তা সত্যিই অনেকে জানে না।

রাজিয়া সুলতানা স্কুল থেকে ফিরে এলে ফাতেমা তাকে বলে, রাজাকারদের সম্পর্কে যা যা জানে সবটুকু বলতে। সে খুব বেশি কৌতুহলী উঠলো যে, উনিশশো একাত্তরে প্রকৃতপক্ষে এদেশে কী ঘটেছিলো। তখন রাজিয়া তাকে জানায় যে, তার কাছে বেশ ক’টা বই আছে। সেগুলো পড়লেই ফাতেমা অনেক কিছুই জানতে পারবে। আর সে কথা শুনেই ফাতেমা খানিকটা জোরে হেসে উঠলে রাজিয়া বললো, হাসনের কথা কইলাম কি?

আপনেও যেমন! হেদিন ইস্কুলে ভর্তির কথা কইছিলাম ক্যান হেইডাও বুঝলেন না?

কেন কইছিলা তা আমি বুঝমু কেমনে? কত মানুষ তো কয়েক ক্লাস পড়ার পর আর লেখা পড়া করে না। কেউ কেউ বয়স হইলে আবার ইস্কুলে যাইতে চায়!

ফাতেমা অবাক হওয়ার ভঙ্গীতে বলে, আমি জীবনেও ইস্কুলে যাই নাই। ইস্কুল কারে কয়, হেইডা দেখতে কেমন তাও জানি না!

রাজিয়া যেন তার জন্মের পর এই প্রথম বড় ধরনের কোনো আশ্চর্যজনক কথা শুনলো। যে কারণে সে চোখ বড়বড় করে বললো, কও কি তুমি? তাইলে এতডা বছর করলা কি? ঘর থাইক্যা বাইর হও নাই?

ফাতেমা ফের হাসে। হাসতে হাসতে বলে, আমি আছিলাম রাজার বংশের মাইয়া। বাইরে তো সব রায়ত আর ফকির ফাকরার পোলাপাইন। বাইর হইলেই তো তাগো মতন ছোডো জাতের লগে আমার কথা কইতে হইবো।

তাইলে কি কিছুই পড়তে শিখ নাই?

রাজিয়ার বিস্ময় যেন কাটে না।

ফাতেমা বললো, পড়তে পারি। কোরান পড়তে পারি। সুরা কেরাত পারি!

তাতো বুঝলাম। কিন্তু কি পড়তাছ তা কি বুঝতে পার?

ফাতেমা মাথা নাড়ায়।

তারপরই আবার বলে ওঠে, আমি বই পড়তে শিখতে চাই। কাউরে কইয়েন না জানি!

কইলে অসুবিধা কি?

রাজিয়া ভ্রূ কুঁচকে বলে।

আছে। অসুবিধা আছে। বলে, ফাতেমা একবার আশপাশে তাকিয়ে আবার বললো, আমার বয়েস চল্লিশের মতন। বুড়া বয়সে পড়তে চাই কেউ হোনলে আমারে শরম দিবো না!

রাজিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, আইচ্ছা এখন যাও। আমার অনেক কাজ আছে। তুমি পরে আইসো।

ফাতেমা মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসে।

পথ চলতে চলতে একবার কনির কথা ভাবে সে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় যদি বলে আসতো যে, দুপুরের রান্নাটা যেন সে করে ফেলে, তাহলে এখন ঘরে ফিরে নতুন করে রান্নার ঝামেলায় যেতে হতো না। তা ছাড়া তাকে সে দেখে এসেছিলো, তার বাবার বিছানায় বসে থাকতে। লক্ষণটা তার কাছে খুব ভালো মনে না হলেও তখন ঠিক অতটা তলিয়ে দেখেনি। কিন্তু কনি সম্পর্কেও দিন দিন যা শুনছে তা কোনো সুশীলা নারীর গুণ কীর্তনের আওতায় পড়ে না। এম্নিতেই স্বামী পরিত্যক্তা আর আইবুড়ো মেয়েদের দিকে সমাজের বাঁকা চোখটি সব সময়ই তীর্যক হয়ে আটকে থাকে। তাদের সম্পর্কে সামান্য কথাও ছড়াতে ছড়াতে অনেক বড় আর নানা বর্ণে বর্ণিল হতে থাকে।

ঘরে ফিরে ফাতেমা তার বাবা কালাম মাঝির কপালে হাত দিয়ে দেখতে পায় জাবর মোটামুটি কম নয়। হয়তো অষুধের প্রভাব এখনও শুরু নাও হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পায়ের দিকে চোখ পড়তেই যেন মনে হয় যে পা’টা আরো বেশ খানিকটা ফুলেছে। সে খানিকটা চিন্তিত হয়ে উঠলেও তেমন একটা ঘাবড়ায় না। মানুষ সব রোগকেই জয় করতে পারে যদি তার টাকা থাকে। তার বাবার টাকা আছে। খারাপ কিছু দেখলে প্রয়োজনে শহরের বড় হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তখনই কনি ভেজা কাপড়ে ঘরের দিকে এলে সে অবাক হয়ে বলে, তর অহন গোসল করনের কী কাম লাগলো?

কনি ফাতেমার দিকে চোখ না তুলেই বলে, চাইল ধুইতে পুকুরে গেছিলাম, পাও পিছলাইয়া পানিত পইড়া গেছি!

ফাতেমা বিরক্ত হয়ে বলে, অহন কী পিন্দবি? তুই কি কাপড় আনছস?

আমার কাপড় একটা আছে। তানি কিন্যা দিছিলেন।

তাইলে রান্দা হয় নাই?

বিয়ানের ভাত আছে। ক্ষিদা লাগলে খাইয়া লও।

ঘরের টিনের বেড়ার সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা একটি নীল পলিথিনের ব্যাগ থেকে লাল রঙের একটি সূতি শাড়ি হাতে নিয়ে হয়তো ভেজা কাপড় বদলাতে ফের বেরিয়ে যায় কনি।

কনির কথা শুনে ফাতেমা যেন বেশ কিছুটা ধাঁধাঁয় পড়ে যায়। তার বাবা কনিকে শাড়ি কিনে দিলো কবে? হয়তো খুব বেশিদিন হবে না। তাহলে কি কনির পরার মত কাপড় ছিলো না? নাকি এমনিই হাতে টাকা আছে বলে কনিকে শাড়ি কিনে দিয়েছে? আড়ালে আড়ালে আসলে কী ঘটছে কে জানে? সে তো খুব বেশিদিন সংসার বিমূখ হয়ে থাকেনি? এক কি দু সপ্তাহ। আর চাঁন মৌলবির নিরুদ্দেশ বা খুন হওয়ার একদিন পরই হয়তো কনি এ বাড়িতে এসেছে। আর এতটা স্বল্প সময়ে কী বা এমন ঘটতে পারে? অনেক দূর্ভাবনা এসে তার মনে ভিড় করলেও সে ব্যাপারগুলো মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চায়। তবুও খানিকটা সন্দেহ অথবা যুক্তিবোধ তাকে ধীরে হলেও ভাবাতে থাকে।

১৬

কালাম মাঝির পায়ের ব্যথা না কমলেও সময়ে সময়ে জ্বর আসে আসে আর যায়। এ অবস্থায় কিছুই খেতে ইচ্ছে হয় না তার। ফাতেমা তার বাবার পাশে বসা কনিকে জিজ্ঞেস করে আব্বায় কিছু খাইছে?

কনি বললো, ভাত দিতে কইছিলাম, না করছে।

ফাতেমা দেখতে পায় কনির মাথায় তেল দিয়ে চুল আঁচড়ানো। খোঁপায় সাদা রঙের একটি ক্লিপ। তার মনে হলো ক্লিপটা যেন তারই। কি মনে সে একবার তার বিছানার পাশের বড় আয়নাটার তাকে রাখা লিপস্টিক, পাউডার আর কালো ক্লিপ দেখতে পেলেও সাদা বড় প্লাস্টিকের ক্লিপটা দেখতে পায় না। সে ফিরে এসে কনিকে জিজ্ঞেস করে, তুই আমার ক্লিপ নিছস ক্যান?

কনি হাসে। বলে, তুমি তো লাগাও না। কতদিন ধইরা পইড়া রইছে দেইখ্যাই না আইজ দিলাম।

ভেতরে ভেতরে খুবই রাগ হয় ফাতেমার। ঘরের কাজের মানুষের এত বড় স্পর্ধা হয় কি করে? এদের বাড়তে দিলে শেষ পর্যন্ত সব কিছুই লুটে নিতে মনস্ত করবে। সে বললো, আমার কোনো কিছু তুই ধরবি না!

কনি ফের হাসে। ফাতেমার রাগ যেন তার কাছে হাস্যকরই।

ফাতেমা কনিকে হাসতে দেখে আরো রেগে গিয়ে বললো, তুই আইছস আমগো বাইত্যে কাম করতে, তর এত সাজনের শখ হয় ক্যান? নিজের বাইত্যে গিয়া যত পারস সাজাগুজা করগা, যা! তর আর কাম করতে হইবো না!

ফাতেমার এবারকার কথা যেন কনির আত্মসম্মানে লাগে। সে মুখ কালো করে বলে উঠলো, তুমি না করনের কি? আমি কি তোমার কথায় আইছি?

কনির কথায় অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে যায় যেন ফাতেমা। সে তার বাবার দিকে তাকায়। আব্বায় কি কিছু কইবেন?

মারে, অত রাগ ভালা না! নাইলে তর একটা জিনিস নিলোই, কত আর দাম? তুই আরো ভালা আর দাম দিয়া কিন্যা লইস। এইসব ছোটখাট জিনিস লইয়া বাড়ি মাথায় তুলতে আছে?

হ্যায় কি আর আমি কি? আমার জিনিস হ্যায় ধরবো ক্যান?

ও আল্লারে! বলে পাশ ফেরা অবস্থা থেকে চিৎ হয় কালাম মাঝি। কনিকে বলে, তুই আমার মায়ের কিছু ধরবি না আর। বাইদ্যানী আইলে তর যা মন চায় তুই লইস। তরে আমি ট্যাকা দিয়া দিমু!

কনি কেমন করে যেন ফাতেমার দিকে তাকায়। মনে হয় যেন ভেতরে ভেতরে ফাতেমার পরাজয় দেখে হাসতে হাসতে ফেটে পড়ছে। তারপর সে কালাম মাঝিকে বলে, আপনের লাইগ্যা সাবু জ্বাল দিয়া রাখছি, অহন আনমু?

কালাম মাঝি বললো, মুখের ভিতর তো তিতা হইয়া রইছে। খামু ক্যামনে?

কনি বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে, না খাইলে উইঠ্যা খাড়াইতে পারবেন? জোর কইরা হইলেও ইট্টু খান! বলতে বলতে কনি ভেতরের ঘরে যায়। দু একবার ঠুকঠাক ঠুনঠান শব্দ ভেসে আসে। তারপরই একটি প্লাস্টিকের বাটি হাতে ফিরে আসতে দেখা যায়। আর তা দেখে ফাতেমার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে তার বাবার উপর। ছোট জাতের মেয়েটাকে লাই দিয়ে তার বাবা কাঁধে তুলছে। এমন হলে পরে কনিকে সামলানো হয়তো কঠিন হয়ে পড়বে। যেখানে সে কনিকে চলে যেতে বলেছে সেখানে তার বাবা কনিকে তারই সামনে ইচ্ছে মত জিনিস রাখার অধিকার দিয়ে দিলো? এটা যেন তাকে চড় মারার চেয়েও আরো বড় হয়ে আঘাত করলো। তার বুক ফেটে কান্না আসতে থাকলে সে নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তার বাবা কি কনিকে পছন্দ করে? নয়তো মেয়ের কথার চেয়ে একটি কাজের মেয়ের শখ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো তার কাছে? তার মন চাচ্ছিলো যে, এ বাড়ি থেকে এখনই বেরিয়ে যেতে। আর তখনই তার মনে পড়ে চান মৌলবিকে।

মানুষটা বলেছিলো সঙ্গে যেতে। কিন্তু তখন সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেই হয়তো ভালো ছিলো। মানুষটাকে এভাবে হারাতে হতো না। ভেতরে ভেতরে চান মৌলবির জন্য খুব কষ্ট হতে থাকে তার। মানুষটাকে সে খুবই পছন্দ করতো। ভালোও বাসতো। কিন্তু বোকা লোকটা জেদ ধরলো তার সঙ্গে গাছের নিচে প্রয়োজনে থাকতে হবে। এমন বোকামীকে কেই বা প্রশ্রয় দেবে?

কিন্তু চোখের পানিতে বুক ভাসাতে ভাসাতে এখন তার মনে হচ্ছে যে, চান মৌলবির সিদ্ধান্তই হয়তো সঠিক ছিলো। ধীরে ধীরে তার চোখের সামনেই তার বাবা কালাম মাঝি বদলে যাচ্ছে। অথচ তার কিছু করার নেই। সে যে আরো দিন গেলে আরো বেশি অবহেলার শিকার হবে তা যেন কিছুটা অনুভব করতে পারছে। হয়তো বা কনিই এ সংসারকে এক সময় গিলে খাবে। সে যদি সেদিন মৌলবির কথায় সম্মত হতো আর তার সঙ্গে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো তাহলে হয়তো এসমস্ত অনাচার তাকে দেখতে হতো না। কিন্তু যে সুযোগ ছিলো, তাতো সে হারিয়ে ফেলেছে। এসব ভাবতে ভাবতে নিজকে বড্ড অসহায় মনে হয় ফাতেমার। বিয়ে হচ্ছিলো না সে এক ভালো ছিলো। বিয়ে যদি হলোই তাহলে ফের কেন সে একা হয়ে গেল। একাএকা যে তার দিনরাতগুলো আর কাটতে চায় না। ঘরে এলে যেন তার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

ফাতেমা দিনের বাকি সময়টা বিছানা থেকে উঠবে না বলেই ভেবেছিলো। কিন্তু হঠাৎ বাইরে থেকে রাজিয়া সুলতানার কণ্ঠ ভেসে আসে। ফাতেমা, ফাতেমা, ফাতেমা বু ঘরে নাই?

তখনই তাকে জিজ্ঞেস করতে শোনা যায়, কনিকে সে বলছে ফাতেমা ঘরে নাই?

কনি হয়তো কিছু বলে যা বুঝতে পারে না ফাতেমা। তখনই রাজিয়া সুলতানা ঘরে ঢুকে ফাতেমাকে বললো, এমন সময় শুইয়া আছ ক্যান? শরীল ভালা না?

ফাতেমা কিছু না বলে উঠে বসে। তখনই রাজিয়া বললো, আহমদ আলির বউডা মারা গেছে হুনছো?

না তো? তার না বাচ্চা হইবো!

ঘটনা তো হেইডাই। এই কিছুক্ষণ আগে একটা মাইয়া হইলো। কিন্তু তারপরেই বউডা ছটফট ছটফট কইরা মইরা গেল।

ফাতেমা বিছানা থেকে নেমে বললো, চল, যাই!

ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে রাজিয়া বললো, আমি আইছিলাম তোমার কাছে একটা কথা কইতে।

কি কথা?

অহনই কারো কাছে কইবা না।

আইচ্ছা কমু না!

দড়িকান্দি থাইক্যা আমার লাইগ্যা একটা পয়গাম আইছে। আইজ পোলা আর তার বাপ আমারে দেখতে আইবো। তুমি দেইখ্যা কইবা পোলা কেমন!

ফাতেমা খানিকটা অবাক হয়ে বলে, ক্যান, তুমি দেখবা না?

আমি তো দেখছিই। থানায় মিটিঙে গেলেই দেখি।

ফাতেমা বললো, কথা হয় নাই?

কথা তো হয়।

তাইলে তোমার কি মনে হয় না মানুষটা এমন?

তাতো হয়। কিন্তু মানুষ নিজের পছন্দডা ভালো না খারাপ হইলো হেই কথা অন্য কারো কাছ থাইক্যা শুনতে চায়।

গ্যারামে তো আরো বউ মাইয়া আছে। আমারেই ক্যান কইলা?

তুমি তো আমার মনের কথা জানো। তার লাইগ্যা তোমারে কইছি।

রাজিয়ার কথা শুনে ফাতেমার মনের ভেতর জমে থাকা খানিক আগের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট যেদুধূর হয়ে যায় নিমেষেই। এ গ্রামে শিক্ষিত বলতে রাজিয়া কেই সে হিসেবের মধ্যে ধরে। অন্যান্য যারা লেখা পড়া করেছে কেউ রাজিয়ার চেয়ে বেশি তো নয়ই, তার সমান লেখাপড়া জানা কেউ এ গ্রামে নেই। তাই রাজিয়া যখন তাকে কোনো বিষয়ে জিজ্ঞেস করে বা মতামত চায় তখন খুব ভালো লাগে তার।

সে রাজিয়ার দিকে ফিরে বলে, আইবো কতক্ষণে?

কইছে তো আছরের সময়।

তাইলে চল আহমদ ভাইয়ের মাইয়াটারে দেখি।

রাজিয়া বললো, বাচ্চাডা হইছে খুব সোন্দর। এই এক এক হাতের মতন। শইলডা কেমন তুলতলা দেখতে।

কোলে লইছিলা!

নাগো বইন। এত ছোট্ট বাচ্চা লইতে সময় যদি হাত ফসকাইয়া নিচে পইড়া যায়?

মা মইরা গেলে বাচ্চাডারে দেখবো কে?

হেইডাই তো চিন্তা। এমন কাউরে পায়া না গেলে হুনছি পালক দিয়া দিবো!

তখনই অকস্মাৎ রাজিয়ার হাত ধরে ফাতেমা বলে ওঠে, তাইলে আমারে দিয়া দিতে কও!

ফাতেমার কথা শুনে অকস্মাৎ হেসে ওঠে রাজিয়া। বলে, তোমার কি পোলাপান হইছে? তুমি কেমনে বুঝবা পোলাপান কেমনে পালে?

না বুঝলে কি হইলো। যারা পালছে তাগো কাছ থাইক্যা বুদ্ধি নিমু। বলে নিজেও হেসেওঠে ফাতেমা।

১৭

বাচ্চাটি দেখতে যেন সত্যিই সুন্দর আর তুলতুলা। ঘরের পকে পাশে আহমদ আলি মন খারাপ করে বসে আছে। কিন্তু তার কান্নার কোনো লক্ষণ দেখতে পায় না ফাতেমা। লোকটার বউ মরে গেছে অথচ কাঁদছে না, ব্যাপারটা যেন অবিশ্বাস্য মনে হয় তার কাছে।

একজন খুব বয়স্কা মহিলা বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। ইনিই আহমদ আলির মা। তিনি বসে বসে নিরবে কাঁদছিলেন। উঠোনে কাফন পরিয়ে একটি হোগলার উপর রাখা আছে মৃত বউটির দেহ। ফাতেমা গিয়ে আহমদ আলির মায়ের পাশে বসে বললো, জেডি মাইয়ারে কে দেখবো অহন? আপনে তো চোখে ঠিকমতন দেখতে পান না!

ফাতেমার কথা শুনে বৃদ্ধা শব্দ করে কেঁদে উঠে বলেন, আমার মায়ে তো গেল গিয়া আমারে ফালাইয়া, আমগো দুই বইনরে দেখনের কেউ রইলো না!

ফাতেমার খুব খারাপ লাগছিলো। বাচ্চাটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললো, জেডি, মাইয়াডা আমারে দিয়া দেন। আমি পালমু!

তখনই পাশ থেকে আরো দু তিনজন মাঝ বয়সী মহিলা কলরব করে ওঠে। ফাতেমা তাদের চেনে। তবে তাদের সঙ্গে তেমন একটা আলাপ হয়নি তার। একজন বললো, তুই তো বেডি মা হস নাই, বাচ্চা পোলাপানের সুবিধা অসুবিধা কেমনে বুঝবি?

হঠাৎ করেই নবজাত শিশুটির প্রতি তার আকর্ষণ এতটাই বেড়ে গেল যে, সে তখনই বলে উঠলো, আমি জেডির কাছেই থাকমু। খাওয়ানি, ঘুম পাতানি, কাপড়-ক্যাথা বদলানি সবই আমি করমু। আমারে কি করতে হইবো জেডি আমারে কইয়া দিবো!

উপস্থিত সবাই মোটামুটি সমর্থন জানালেও একজন বলে উঠলো, তুমি পরের বাইত্যে থাকলে মানষ্যে কইবো কি?

তাইলে জেডি আমার বাইত্যে থাকলো।

এইডা ক্যামনে হয়! বৃদ্ধা বলে উঠলেন।

তখনই ফাতেমা বৃদ্ধার হাত ধরে বলে উঠলো, জেডি হ্যারে আর কাউরে দিয়েন না। আমারে দিয়েন। আমিই সব করমু।

তর বাপে যেই খারাপ মানুষ। তরেই বাইত্যে জাগা দিবো না তাইলে।

না দেউক। আমি আপনের লগে থাকমু!

ফাতেমার কাকুতি মিনতি হয়তো আহমদ আলির কানে গিয়েছিলো। সে উঠে এসে বললো, দেহ ফাতেমা, তোমার নিজের পোলাপান হয় নাই। কিছুদিন পরে তোমার ভালা নাও লাগতে পারে। তা ছাড়া তুমি এই বাইত্যে থাকলে মানুষেও কম বেশি খারাপ কইবো। তোমার বাপেও খারাপ কইতে পারে। তোমার মান-ইজ্জতের দিকটাও তো তোমারে দেখতে হইবো।

আমিও তো এই গ্যারামেরই মাইয়া। আমারে নিয়া কথা উঠলে হেইডা আমি বুঝমু। তাও মাইয়াডারে আমি চাই!

ফাতেমার আকুতি আর সদ্যজাত শিশুটির প্রতি তার আগ্রহ দেখে শেষটায় সাব্যস্ত হয় যে, ফাতেমা এ বাড়িতে আহমদ আলির মায়ের কাছে থাকলেই কেবল ব্যাপারটা সম্ভব। নয়তো আনাড়ি ফাতেমার হাতে শিশুটির পুরো দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া সম্ভব নয়। অন্তত কিছুদিন হলেও অভিজ্ঞ নারীদের কাছ থেকে শিশু পরিচর্যা সম্পর্কে তার জ্ঞান অর্জন করতে হলে তাকে শিশুটির দাদির কাছেই থাকতে হবে। আর এতেই খুশি ফাতেমা। সে খুশি মনে উঠে রাজিয়া সুলতানার বাড়িতে যেতেই দেখতে পায় কিছু নতুন মুখের মানুষ তাদের উঠানে চেয়ারে বসে রয়েছে।

মাথার ঘোমটাটা একটু লম্বা করে দিয়ে ফাতেমা রাজিয়াদের ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলে দেখতে পায় রাজিয়া একটি নতুন শাড়ি পরে বসে আছে। তাকে দেখতে পেয়ে যেন খুশি হয়ে উঠলো রাজিয়া। তারপর তার কাঁধে দুহাত রেখে কানে কানে নিজের পছন্দের মানুষটির পরিচয় জানালো। আর তখনই সে ছুটে গিয়ে জানালার কপাটের ফাঁকে চোখ রাখে।

আসার সময়ই লোকটাকে দেখতে পেয়েছিলো ফাতেমা। রাজিয়া এমনিতে মানুষ হিসেবে ভালো হলেও দেখতে তেমন নয়। শ্যামলা হলেও যদি চোখ মুখের আদল ভালো হয় চলে। কিন্তু রাজিয়া যেন এ থেকেও বঞ্চিত। সে তুলনায় রাজিয়ার পাশে ছেলেটিকে খারাপ লাগবে না। জানালার কপাটের আড়াল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সে ফিরে এসে রাজিয়ার কাছে বসে বললো, তারা কি তোমারে দেইখ্যা গেছে?

রাজিয়া মাথা নাড়ে। না। আগে শরবত পান-তামুক খাইবো, নাস্তা করবো তার বাদে না!

তখনই রাজিয়ার মা এসে জানালো তর মামু কি কয় হুনছস?

রাজিয়া আগ্রহী হয়ে মুখ তুললে, তার মা বললো, পোলার বাপ নাহি রাজাকার আছিলো।

কিন্তু মায়ের মুখ থেকে সদরুদ্দিন মাস্টারের বাপ রাজাকার ছিলো শুনতে পেয়ে তার বুকের ভেতর যেন হাজার বছরের ঘুমন্ত সাগরে ঝড় ওঠে। সে আগ পাছ কোনো কথা না ভেবেই বলে উঠলো, হ্যাগোরে মানা কইরা দেও। মামু কই, আমি কথা কমু!

রাজিয়ার মা অবাক হয়ে বললো, তুইত্তো তাগো লগে সমন্দের কথা কইছিলি।

আমি সমন্দের কথা কই নাই। কইছি খোঁজ-খবর করতে। মামুরে আইতে কও! তারপরই সে উঠে তার নতুন কাপড় খুলে ফেলতে থাকে।

ফাতেমা বলে, তুই এই কথা আগে হুনস নাই?

হুনি নাই বইল্যাই তো মায়ের কইছিলাম খোঁজ খবর কইতে। আর এমন একটা কথা মামু আমারে আইজ কইলো। আগে কইলে কি অমন জন্তুর পোলার কথা মুখ দিয়া বাইর করতাম? মামু কবে কইছে এই কথা?

রাজিয়ার কথা হয়তো তার মামু রেজুদ্দিন শুনতে পেয়েছিলো। সে ঘরের বেড়ার কাছাকাছিই বসেছিলো বলে, ঘরের ভেতরকার আলাপ আলোচনা তার পক্ষেই শুনতে পাওয়ার কথা। আর তাই সে উঠে অতিথিদের বললো, আমি দেইখ্যা আই মাইয়ারে দেখানের কদ্দুর কি হইলো।

রেজুদ্দিন ঘরের ভেতর এলে রাজিয়া যেন তেড়ে যায় তার দিকে। আপনে এই খবরটা আগে কইলেন না কি বুইঝ্যা?

কিন্তু হ্যায় তো আর বাইচ্যা নাই! তার লাইগ্যা মনে করছিলাম বিয়ার আলাপ করতে অসুবিধা নাই।

আপনে তাগোরে মানা কইরা দেন!

এইডা কেমন কথা? অহন কেমনে তাগোরে মানা করি?

নাস্তা পানি করাইয়া দিয়া কন যে, আমি আৎখা অসুস্থ হইয়া গেছি। আইজ তারা যানি চইল্যা যায়। পরে কোনোদিন খবর জানামু।

রেজুদ্দিন ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভাবে, মেয়েটা রাজাকারদের এতটা ঘৃণা করে যে, ব্যাপারটা একবারের জন্যও তার মনে পড়েনি। রাজিয়ার এমন মানসিকতার কথা জানা সত্ত্বেও কেমন করে সে এতবড় ভুলটা করতে পারলো? এখন যদি ছেলে পক্ষকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে নানাজনে নানা কথা বলবে। মেয়ের চেহারা সুরত ততটা সুবিধার না বলে, মানুষ তার দোষটাই বড় করে দেখবে।

রাজিয়া নতুন কাপড় খুলে পুরোনো কাপড় পরলে তার মা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, রাজাকার বইল্যা তুই বিয়াডা মানা কইরা দিলি? রাজাকার কী এমন খারাপ হুনি?

মা, তুমি একজন মুক্তির বউ হইয়া এই কথা কইতে পারলা?

মারে, আমি কি আর অত কিছু বুঝি? তর বাপে যা কইছে তা হুনছি। এই যে রাইতের পর রাইত এত কথা হুনছি তার অর্ধেকও যদি বুঝতাম তাইলেও মনে কয় তর রাগের কারণ ধরতে পারতাম!

আমি এই বিয়া মানা কইরা দিতে কইছি দেও। এত কথা কইতে আমার ভালা লাগে না।

রাজিয়ার মা লেখাপড়া না জানা মেয়ে। সংসার, স্বামী-সন্তানের বাইরে তেমন কিছু বোঝে না। তাই নিজের গর্ভজাত শিক্ষিত সন্তানের কাছে নিজেই যেন অবোধ শিশু বলে পরিগণিত হয়।

১৮

কালাম মাঝি কনির কাঁধে ভর করে খোঁড়াতে খোঁড়াতে উঠোনে নেমে এসে মসজিদের নতুন ইমাম ইদ্রিস কারির মুখোমুখি হলে সে যেন কিছুটা ক্ষেপে উঠে বলে, বাড়ির ভিতরে আইবেন গলা খাকারি দিতে দিতে নয়তো কিছু একটা কইতে কইতে ঢুকবেন!

ইদ্রিস কারি জানালো, আমি তো হেই কহন থাইক্যা কইতাছি বাইত্যে কেউ আছেনি? আপনেরা তো মনে কয় আমার কথা হোনেনি নাই!

ইদ্রিস কারি নতুন মানুষ বলে জানে না যে, কালাম মাঝি আর কনির মধ্যকার সম্পর্ক কি। সে মনেমনে ধরে নেয় কনি হয়তো কালাম মাঝির স্ত্রীই হবে। তাই সে খানিকটা সন্ত্রস্ত হলেও জানায়, আইজ মগরেবের সময় মসিদে থাকতে পারবেন?

কালাম মাঝি অবাক হয়ে বললো, মসিদে কি?

অনেকদিন তো হইলো আমি আইলাম। পরায় দেড়মাস। কিছু ট্যাকা-পয়সার ব্যবস্থা না কইরা দিলে আমার বাইত্যে চলে ক্যামনে? হেই বিষয়েই কথা কইতে চাইছিলাম।

আইজগা অনেকদিন হইলো আমি ঘরের বাইরে যাই না। দেখলেন তো কেমনে চলাফিরা করি। আপনে যান, যা কথা হয় পরে আমি জাইন্যা নিমু।

কালাম মাঝির এ কথার পর, ইদ্রিস কারি মসজিদের উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছিলো ঠিকই। কিন্তু মাগরেবের নামাজের পর সেখানে কথায় কথায় উপস্থিত লোকজনের কাছে কালাম মাঝির স্ত্রীর কাঁধে ভর দিয়ে চলাফেরার কথাটা বলতেই, কালু মিয়া বলে উঠলো, ওই ব্যাডায় বিয়া করলো কবে? আমরা তো হুনছি দলিলের মাইয়াডা হ্যার বাইত্যে কাম করে!

ইদ্রিস কারি কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেলে আর তাতে নতুন কোন ঝামেলা বাধে তা ভেবেই বললো, আমি তো আর এত কিছু জানি না। কার বাইত্যে কি হয় আপনেরা কেউ না কইলে জানমু কেমনে?

তখনই ইদ্রিস কারির বেতনের বিষয়টা চাপা পেড়ে গেল উপস্থিত লোকজনের গুঞ্জরণের ফলে।

কিছুক্ষণ পরই লোকজন মসজিদের বাইরে বেরিয়ে এসে ছোটছোট দলে ভাগ হয়ে গেল। বেশি কৌতুহলী দলটি তখনই কালাম মাঝির বাড়ির দিকে যাত্রা করলো। ঠিক তখনই ইব্রাহিম মেম্বার এসে উপস্থিত হয়ে লোকজনকে এলামেলো অবস্থায় দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? দরবার হইবো না?

জালাল শেখ বেশ কিছুটা গম্ভীর হয়ে মসজিদের বারান্দায় বসেছিলেন। কিন্তু তিনি কিছু বলে উঠবার আগেই কালু মিয়া জানায়, রাজাকারডায় তো বাইত্যে রঙমহল বানাইছে!

ইব্রাহিম মেম্বার অবাক হয়ে বলে, কি কও বুঝলাম না!

তখন কালু মিয়া ইদ্রিস কারির বলা কথাগুলোকেই আবার বলে।

কথা শুনে চিন্তিত মুখে ইব্রাহিম মেম্বার বললো, বুইড়া মাইনষ্যে যদি এমন অকাম করে, তাইলে তো অনাচার আরো বাইড়া যাইবো?

তারপরই সে আবার জানতে চায়, মাইয়াডা কি রাইতে হেই বাইত্যে থাকে?

তাইতো হুনছি। পাশ থেকে বলে ওঠে, খালেকের ছেলে জগ্যা।

বিস্মিত ইব্রাহিম মেম্বার বলে উঠলো, কালাইম্যার  না একটা মাইয়া আছে? চান মোলোবির লগে বিয়া হইছিলো?

কালু মিয়া বলে, ফাতেমা তো অহন আহামদ ভাইয়ের মার লগে থাকে হুনছি। বলে, সে আবার বলে, আহামদ ভাই তো এহানেই আছিলো। তারে জিগাও!

অন্ধকারে কারো চেহারা তেমন বোঝা যায় না। তাই ইব্রাহিম মেম্বার বললো, আহমদ আলি আছ?

আছি! বলে অন্ধকার থেকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে সে।

ইব্রাহিম মেম্বার তাকে জিজ্ঞেস করলো, কালাইম্যার মাইয়া তোমার বাইত্যে কি করে?

আমার মাইয়াডারে হ্যায় পালতে চায়। তার লাইগ্যা ক্যামনে কি করতে হইবো, পোলাপানের কোন সুম কি লাগে এইডিই মা’র কাছে থাইক্যা জানতাছে বুঝতাছে।

তাইলে কালি বাইত্যে দলিলের মাইয়ারে লইয়া রাজাকারডা মজা করতাছে, কিছু একটা হইলে তো মাইয়াডারে লাত্থি মাইরা বাইর কইরা দিবো!

তাইলে কি করতে চাও?

হালার পুতে মজা করতে চাইলে সমাজে থাইক্যা করুক! নাকি কও? দলিলের মাইয়াডারও বাঁচনের একটা ব্যবস্থা হইয়া যাইবো!

তখন অনেকেই এ সঙ্গে সমর্থন জানাতে ঠিক ঠিক বলে ওঠে।

মেম্বার জালাল শেখের কাছে এগিয়ে গিয়ে ব্যাপারটা নিয়ে খানিক আলাপ করে জানালো, শরিয়ত মাইন্যা বিয়া করলে তারে অল্পে ছাইড়া দিমু। নাইলে চুদির পুতেরে আবার মসিদের সামনে নাকে খত দেওয়ামু!

জালাল শেখ বললেন, অহন দেশে আইন হইছে শরিয়তের বিচারের নামে দোররা জুতা পাত্থর মারা চলবো না। যে যেমনে থাকতে চায় থাকতে দেও।

এইডা হইতেই পারে না। আমরা সমাজ লইয়া থাকি। এইডা তো আর শহর না যে, যার যার রে হ্যায় কি করলো কেউ কওনের নাই! বিচার তার করতেই হইবো।

তারপরই সে ইদ্রিস কারির উদ্দেশ্যে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে, কারি সাব শরিয়তের বিচারে কি হইবো?

ইদ্রিস কারি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে বললো, আইজকাইল ফতোয়া দেওন বেআইনি। আইনের বাইরে কিছু করা যাইবো না।

দলিলরে খবর দিবো কে? হ্যায় তো সারাদিন থাকে ওই বাইত্যেই।

খবর দেওনের কাম কি? আমরা সবতে মিল্যা হমুন্দির পুতেগরে বাইত্যে গিয়া ধরি!

তাইলে চলো সবতে। কারি সাব আপনেও চলেন! বলেই হ্যারিকেনের আলো খানিকটা বাড়িয়ে নিয়ে ইব্রাহিম মেম্বার আগে আগে হেঁটে চললে বাকি মানুষগুলো তার পিছু পিছু মিছিলের ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়।

আগের কৌতুহলি দলটি কালাম মাঝির বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করছিলো। হয়তো বা অপেক্ষা করছিলো পেছনের দলটির জন্য। তাদেরই অতি উৎসাহি একজন আহমদ আলির বাড়ি গিয়ে ফাতেমাকে সংবাদ দিয়ে আসে তাড়াতাড়ি আসতে।

ফাতেমা আসতে আসতে দেখতে পায় ইব্রাহিমের নেতৃত্বে দলটি আগে আগে তাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে। সে এত মানুষ দেখে খানিকটা ভয় পেলেও এর উদ্দেশ্য বুঝতে পারে না। কিন্তু চেষ্টা করে তাদের আগে আগেই বাড়ি এসে তার বাবাকে সংবাদটি জানাতে। কিন্তু ঘুর পথে আসতে গিয়ে তার খানিকটা দেরি হয়ে গেলে, উঠোন ভর্তি লোকজন দেখে সে সত্যি সত্যিই ঘাবড়ে যায়। বলতে গেলে উপস্থিত সবাই তার অচেনা। তাই ইব্রাহিম মেম্বারের হাতে হ্যারিকেন দেখে এগিয়ে গিয়ে ফাতেমা জানতে চায়, কি হইছে? এত মানুষ ক্যান আইছেন?

কালু মিয়া বলে উঠলো, তেমার বাপেরে ডাক দেহি। লগে কনিরেও ডাইক্যো।

ফাতেমা অবাক হয়ে বললো, কনি তো তাগো বাইত্যে যায়গা রাইতের বেলা!

অনধকারে দণ্ডায়মান লোকজনের কেউ কেউ হেসে ওঠে ফাতেমার কথা শুনে। আর তখনই ফাতেমা কেমন উ™£ান্তের মত ছুটে গিয়ে ঘরের দরজায় করাঘাত করে চেঁচিয়ে ওঠে, আব্বা, আব্বা! ও আব্বা, উঠেন তাড়াতাড়ি!

অন্ধকার থেকে কেউ একজন কণ্ঠস্বর বিকৃত করে বললো, না বারাইলে ঘরে আগুন ধরাইয়া দিমু!

ভীত সন্ত্রস্ত ফাতেমা আরো জোরে জোরে ডাকে তার বাবা কালাম মাঝিকে। সে সঙ্গে আরো জোরে আঘাত করে চলে ঘরের দরজায়।

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর কনি দরজা খুলে দিলে ফাতেমা বিস্মিত হয়ে বলে, তুই এহানে কি করস?

কনি কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

ফাতেমা রেগে উঠে বললো, কথা কস না ক্যান?

তখনই উপস্থিত গ্রামের লোকজনের ভিড়ে ফের গুঞ্জরণ ওঠে। কেউ কেউ বলে, মা ডাকলে কথা কইবো!

আর এ কথার সঙ্গে সঙ্গে সম্মিলিত হাসির ফোয়ারা ছোটে যেন।

আব্বায় কই? বলে ফাতেমা ঘরে ঢোকে। বিছানায় শায়িত কালাম মাঝিকে ডাকতে ডাকতে ফাতেমা এগিয়ে গিয়ে তার বাবার একটি হাত তুলে ধরেই কেমন শিউরে ওঠে। কালাম মাঝি কেমন নিথর হয়ে পড়ে আছে বিছানায়।

ফাতেমা পাগলের মত তার বাবার শরীর ঝাকাতে ঝাকাতে ডেকেই চলে, আব্বা! আব্বা! ও আব্বা! উঠেন না আব্বা! কিন্তু কালাম মাঝি আদৌ উঠবে কিনা ফাতেমা বুঝতে না পারলেও কনি হঠাৎ কথা বলে ওঠে, তানি খুবই ডরাইছিলেন। কইতাছিলেন, আবার বুঝি ছ্যাপ চাইট্যা খাইতে হইবো! তার বাদে আগুন দেওনের কথা হুইন্যা আবার বিছনায় পইড়া গেল।

ইব্রাহিম মেম্বার হ্যারিকেনটা উঁচিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পাগল প্রায় ফাতেমার আচরণ দেখে কি বুঝলো কে জানে। তখনই সে বাইরে বেরিয়ে এসে বললো, চল যাই!

হইছে কি? অন্ধকারে কয়েকটা মুখ থেকে সম্মিলিত জিজ্ঞাসা ছুটে আসে।

ইব্রাহিম মেম্বার খানিকটা থেমে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো, নাই!

তারপরই সে এগিয়ে যেতে থাকে যে পথে এসেছিলো এ বাড়িতে। লোকজন কিছু না বলেই মেম্বারের পিছু পিছু হেঁটে চলে। যেতে যেতে তারা পেছনে শুনতে পায় ফাতেমা তখনো কালাম মাঝিকে ডেকে চলেছে, আব্বা, আব্বা! ও আব্বা!

——

*** আগে প্রকাশিত।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


10 Responses to মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস: শেষ কাতারের মানুষ

You must be logged in to post a comment Login