সকাল রয়

পুরুষ কেন এমন হয়?

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

০১.

পুরবী সিনেমা হলটা পেরুতেই দীপার সাথে মুখোমুখি দেখা। পাশ কাটিয়ে যে যাবো সে উপায় টুকু পর্যন্ত নেই। ওর দিকে যে সরাসরি তাকাবো সেরকম পরিস্থিতিও নেই। আমি ইতস্তত করে কিছু বলতে যাবো অমনি ও বলে বসল নিমা দিদি চার দিন ধরে পড়াতে আসছো না যে, তোমার কি শরীর খারাপ করেছে নাকি ? নিজেকে সামলে কোনভাবে বললাম না,রে কদ্দিন কাজের খুব চাপ যাচ্ছে কাল থেকে যাবো।
ঠিক আছে যেও ! আজ দেখা না হলে কাল চলে যেতাম তোমাদের বাসায়; তুমি তো জানো তোমাকে ছাড়া আমি অন্য টিচারের কাছে পড়তে গিয়ে অস্বস্তিতে ভুগি।
পাশ কাটিয়ে রিকসা নিয়ে দীপা চলে গেলো।
দীপা চলে গেল কিন্তু ওর অস্বস্তিটা আমাকে দিয়ে গেল! দেখা না হলে বাসায় চলে আসতো কথাটা মনে হলেই মাথাটা ঝিম মেরে যায়। যে বাড়িতে আসতো সেটা তো আর আমার আবাসস্থল নেই। আমি দীপার কাছে মিথ্যে বললাম।
এ কদিন তো আমি ব্যাস্ত নই বরং আত্মদহনে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে পুরো অবসরে আছি। আর অশান্ত মন কে শান্ত করতে গিয়ে নিজের কাছেই বারবার হেরে যাচ্ছি। কখনও কাঁদছি দীক্ষা শিক্ষা বিসর্জন দিতে চলেছি আমি ক্রমশই ভেঙ্গে পড়েছি একটু একটু করে। আমি পরাজিত হয়েছি পুরুষের কাছে। পরাজিত শব্দটা মনে হতেই আমি শৈশবের নদীতে হারিয়ে যাই ।

০২.

তখন বয়সের শুরু চার কি পাঁচ। আমি মা’র কোল,বাবার কোল থেকে পড়শিদের কোলে ঘুড়ে বেড়াই। আমি মেয়ে বলে সবাই কাছে টানে আদর করে আরে কত্ত কি। কত কদর আমার আমি মেয়ে !!
যখন দশ এগারো বয়স গায়ের জামা খুলতে আমার অস্বস্তি !! সব দেখে ফেলেছে। কিছুটা অবাক চোখে তাকাতাম। রকের ছেলেগুলো যখন তাকিয়ে থাকত বুঝতাম না তখন। এখন বুঝি ওরা মনে মনে আমার শরীরটাকে অদৃশ্য ভাবে চেটে চেটে খেত। কলেজের জীবনটা কাটাতে গিয়ে প্রেমে পড়েছি ভালবেসেছি কিন্তু ছেলেদের সেই শরীর দেখা, অকথ্য কটুক্তির হাত থেকে বাচাতে পারিনি। প্রতিবাদ করতে চেয়েছি পারিনি পাছে ভয় আমাকে জাপটে ধরেছে। যদি কোন অঘটন এসিড কিংবা অপহরন।

কিছু কিছু পুরুষ নারীকে মানুষ ভাবতে পারেনা। নারীকে গনিকা বৃত্তিতে নামিয়ে দিয়ে তারাই আবার নারীকে বহুগামিনী বলছে !! শুধু কি নারীই বহুগামিনী পুরুষ নয় ? একদলা থু-থু ফেলতে ইচ্ছে করে সেইসব পুরুষদের গায়ে যারা নিজেরা গনিকা বৃত্তিতে ইন্ধন যুগিয়ে পতিতার সাথে রাত কাটিয়ে শেষে বাসর রাতে বউকে বলে আমি পবিত্র। জীবনে তুমিই প্রথম!!!! হায়রে পুরুষ !!
কেন যে মেয়ে হলাম যেন মেয়ে হওয়াটা একটা নেগেটিভ ফ্যাক্টর!!! আজ এই দিন পর্যন্ত পুরুষের দৃষ্টি থেকে বাদ পড়ছে না নারীরা। আজকাল কালো কিংবা একটু বেশি রকমের ময়লা,মোটা,রোগা মেয়েরাও বাদ পড়ছে না। রাস্তায় মেয়ে দেখলেই তাদের ফ্যাল ফ্যাল চাওনি তারা অদৃশ্যভাবে নেড়ি কুকুরের মতো জিহ্বা নাড়তে থাকে। এভাবেই নারীরা বারবার হারছে পুরুষের কাছে প্রতিনিয়তই প্রতিবাদ করতে পারছেনা।

এসব কথা আমার মাথাটাকে নষ্ট করে দিয়েছে। আমি ঘোর পাকের মধ্যে আছি। তবুও হয়তো পুরুষকে চিনতে আমার কিছুটা বাকী থাকতো কিন্তু চারদিন আগে যে ঘটনা ঘটে গেছে আমার জীবনে তাতে পুরোপুরি চেনা হয়ে গেছে মনে পড়লে এখনও মাথা ঝিমঝিম ভাবটা চলে আসে।

আজ থেকে চারদিন আগে;
ক্লাস ছিলনা তাই তারাতারি বাসায় ফিরে এলাম। রিকসা থেকে নেমে গেট পেড়িয়ে ঢুকলাম। কলিং বেল চাপতে হলোনা দরজা হালকা খোলা। মনে হলো কেউ কিছুক্ষণ আগেই ঢুকেছে।
ড্রইংরুমে থেকে কিচেনে যাবো। কাজের মেয়ে ইতি বললো দিদি আজ সকাল সকাল চলে এলে যে কেউ নেই বুঝি স্কুলে ? আমি ব্যাগটা পাশে রাখতে গিয়ে বললাম হ্যাঁ, আজ মনটাও ভালো নেই তাছাড়া স্কুলে ছাত্র আসেনি খুব একটা। তুই রান্নার আয়োজন কদ্দুর করলি ? আর তোর দাদাবাবু কখন গেছে ? সবজি’র ঝুড়িটা হাতে নিয়ে ইতি সামনে এসে বললো রান্না অর্ধেক হয়ে গেছে দিদি। আর দাদাবাবু এখনো বাসায়!!
সে,কি রে অফিস যায়নি!!
না একজন মেহমান আসছে ; মেহমানটা আবার কে?
ইতি আরো কিছু বলতে চাইছিলো হাতের ইশারায় আমি থামিয়ে দিয়ে বললাম তুই কিচেনে যা আমি দেখছি।
বেড রুমের দিকে গেলাম। দরজার বাইরে লেডিস জুতো!! বিস্ময় বাড়লো। লেডিস মেহমান নিয়ে বেডরুমে ? একটু থমকে দাঁড়ালাম ওসব কিছু!!!
না-তা হবে কেন। ভালবেসে বিয়ে চার বছরের প্রেম অমিত এতটা নীচ হতে পারেনা। হয়তো ওর পুরোনো ক্লাসমেট কেউ হবে।
হাতল ঘুড়িয়ে দরজা খুলতে গেলাম অবাক না হয়ে পারলাম না; ভেতর থেকে বন্ধ। ডাক দিতে গিয়ে আবার থমকে গেলাম। নাহ্!! চলে এলাম। কিচেনে গিয়ে রান্নায় হাত লাগালাম। মাথা ঘুড়ছে। ইতিকে ডেকে বললাম তোর দাদা বাবুকে গিয়ে ডাক দে’ তো ?
মনের ভেতর এবার ঢেউ খেলছে !! সারা জীবন ধরে নিজেকে শুদ্ধ রেখেছি একটা বিশুদ্ধ ভালবাসা পাবো বলে। আমি চাইনি আর দশটা মেয়ের মতো অজানা অচেনা একটা পুরুষকে প্রথমেই শরীরটা ভোগ করতে দিয়ে তারপর মনটাকে স্পর্শ করে তারপর শরীরে যেতে। আর এজন্য বাবা মা’র পছন্দ করা কাউকে বিয়ে করিনি; করেছি নিজের পছন্দ করা পুরুষটিকে। ভালবাসবো ,জানবো,বুঝবো মনের মিল হলে তারপর বিয়ে। কিন্তু যদি সেখানে সর্বনাশের হাতছানি দেখি…….ওহ !! না আর ভাবতে পারছিনা শরীর কাঁপছে।
থমথমে ভাব নিয়ে ইতি সামনে দাঁড়াল। দাদাবাবু আসছে। ওর মুখ দেখে কিছু একটার ইঙ্গিত পেয়ে গেছি আমি। দাতে দাত চেপে রাগটা সামলাতে হবে।
অমিত কিছুটা বিস্ময় চোখে বেড়িয়ে এলো; সাথে যাকে দেখলাম তাকে আগে কখনো দেখিনি আর তার উষ্কোখুষ্কো চুল দেখে আমার বুঝার কিছু বাকী থাকল না। রাগে আমার পা কাঁপছে।
কৃত্রিম হাসি হেসে অমিত বললো আজ এত তারাতারি এলে যে, ক্লাস নেই বুঝি?
আমি বললাম স্কুল ফাকা তাই এলাম; না এলেই বোধ হয় ভালো হতো।
নিমা তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আমার পুরোনো বন্ধু মিতা দে; ওই যে শেখর রায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় যে তোমার ফেবার পারসন ওনার সহধর্মিনী।
আজ আমিও মিথ্যে হাসি হেসে বললাম ও তাই আপনার কথা শুনেছি আগেও। মেয়েটি সোফায় বসতে বসতে বললো আপনি বাসায় নেই জানলে আসতাম না।পরিস্থিতি ঘোলা হয়ে গেলো।

০.৪

মানুষ কতটা খারাপ হতে পারে তা ভাবতে পারছিনা। বাসায় নেই জেনেই এসে মজা লুটা হচ্ছিল এখন ধরা পড়াতে আবার আফসোস করা হচ্ছে। ওদের কে চা খাওয়ার কথা বলে আমি চলে এলাম।
ওদের সামনে দাড়াতে ঘৃণা হচ্ছিল । সন্দেহের তীরটা হৃদয়ের এপাশ দিয়ে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। কষ্টটা লাগতো না বেডরুমে গিয়ে যখন স্বল্পমূল্যের সেনসেশনের প্যাকেট পেলাম যা সদ্য ব্যবহৃত।
ভালবাসায় বিশ্বাসের মূল্য কতটুকু হলে টিকে থাকে তার হিসাবটাই মেলাতে পারছিলাম না। এই পুরুষরা নিজেকে সৎ ভাবে উপস্থাপন করে নারীদের কাছে। আর খোঁজে নারীর সতীত্ব,পতিব্রতা। যদি কোন নারীকে জোর করে পশুরা ধর্ষণ করে তাহলে সে কলঙ্কিত হিসেবে বিবেচিত হয় কিন্তু কেন? সে তো অসহায় ছিলো তবে তার সতীত্ব চলে গেল কেন? সমাজ তাকে ধিক্কার দেবে কিন্তু যে ধর্ষণ করেছে যে কলঙ্ক ছড়ালো তার অবস্থান থেকে সে ঠিকই শুদ্ধ থাকবে। সে কারো বাবা, ভাই, কিংবা কারো স্বামী হয়ে টিকে থাকবে এ জগৎ সংসারে।

চিন্তার জাল ছিন্ন হলো অমিতের ডাকে; কি ব্যাপার একা এখানে কি করছো ? না দাড়িয়ে আছি এমনি, তোমার বন্ধু চলে গেছে। অমিত বললো হ্যাঁ তুমি বোধহয় সন্দেহ করেছ !! আমার বাঁধ ভাঙ্গলো আমি আজ কিছু না লুকিয়ে সরাসরি বললাম তোমার চরিত্র এতো খারাপ এতো নিচু তুমি? তুমি তো জানতে তুমি খারাপ তবে আমার জীবনটা কেন নষ্ট করলে? অমিত পুরো চুপ করে গেল। হয়তো শেষ রক্ষার জন্য বললো আমি এমনটা চাইনি কিন্তু হঠাতই হয়ে গেল।
দলা পাকিয়ে গলার কাছে আমার কান্না জমলো আর চোখ ভরতি নোনা পানির ঢল। কি বলবো আমি কান্নাটাকে থমকে দিয়ে কোন রকম বললাম তোমরা পুরুষেরা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে এমন ক;টা পুরুষ আছে যে বিয়ের আগেই নিজেদের মনের প্রবৃত্তি মেটাতে নারীদের কাছে যাওনি পারবে বলতে?
আমার কথার প্রতিবাদ করতে গিয়ে অমিত বললো তুমি যে স্কুলের টিচারদের সাথে ফষ্টি-নষ্টি কর কই আমি তো সে কথা কোনদিন বলিনি।
সেই ক্ষণেই আমি ভাষা হারিয়ে বাক্যশূণ্য হয়ে গেলাম।

০.৫

পরের ঘটনা
আমি পুরো তিনদিন বাকশূন্য হযে মা’র কাছে পড়ে রইলাম। অমিতের সাথে সম্পর্ক রাখার বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও আমার রইলো না। আলো ছাড়া আমি ঘুমাতে পারতাম না ভয় লাগতো। অমিত যদি নেশা করে বাসায ফিরতো তবুও কিছু বলতাম না ভালবাসতাম যে। ভালবেসে সব সহ্য করা যায় কিন্তু নিজের আসনে অন্য কোন নারীর উপস্থিতি মেনে নেয়া যায়না।
এখন আধারে বসে থাকি তাতে কষ্টের ফারাকটা বোঝা যায় কম। চার রঙ্গা অনুভূতি গুলো একরঙ্গা হয়ে থাকে তাই কষ্ট যন্ত্রণা পাই কম। জানিনা অমিতকে বুলতে পারবো কি,না। তবে পুরুষকে ভালবাসতে পারবো না আর। জানি নারী একা থাকতে গেলেও সমস্যা পদেপদে যদিও আর কারও হাত ধরি তো সেটা ভালবাসায় না গড়িয়ে হবে বাহ্যিক অভিনয়।
আজ চারদিন পর ঘর থেকে বের হলাম।
কোথাও যাইনি, কারও সাথে কথা বলিনি। দেখা করিনি।কিন্তু এভাবে কি জীবন চলে? তাই আবারো পথে নামলাম যদিও মৃত্যুর আগ পর্যন্তই লোলুপ দৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবো না যতদিন না যৌবন ফুরাচ্ছে কাটাতে হবে এভাবেই কেননা আমি একজন নারী।

সমাপ্ত

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


4 Responses to পুরুষ কেন এমন হয়?

You must be logged in to post a comment Login