অবিবেচক দেবনাথ

ম্লান-মোহিনীর ছায়ানটে

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

[ শৈলীতে এটা আমার প্রথম পোষ্ট করা গল্প। আমি গল্প লেখার চেষ্টা করছি, জানি না শুরুটা কেমন হচ্ছে। তবুও সকলের স্নেহ-ভালোবাসার প্রত্যাশা করি আর প্রত্যাশা করি গল্প লেখার ক্ষেত্রে আমার গল্পে যে ভুলগুলো হবে সেগুলো ধরিয়ে দিতে। গল্পটা একটু বেশী বড় বলে দু’বারে পোষ্ট করব।একবারেই পোষ্ট করতে পারতাম, কিন্তু টাইপিং এ অলসতা কাজ করছে বলে দু’বারে পোষ্ট করব পুরো গল্পটা। আর বানান ভুলের জন্য ক্ষমা পার্থী।

গল্পটিতে নোয়াখালী জেলার আঞ্চলিক ভাষা আমি ব্যবহার করেছি, কারো কোনস্থানে বুঝতে অসুবিধা হলে জানাবেন।]

ম্লান-মোহিনীর ছায়ানটে

অবিবেচক দেবনাথ

(১)

উদ্ভান্তের মতো সিগারেট ফুঁকে চলছে নির্ঝর। ধোঁয়ার কুন্ডলি বাতাসের দ্যোলায় উড়ে যাচ্ছে দূর হতে বহুদূরে। কিছুসময় পরে ধোঁয়ার অস্তিত্ব হারিয়ে যাচ্ছে চোখের অদূরে। প্রচন্ড অস্থিরতায় সিগারেটর এই ধোঁয়া ভালো কাজ দেয়। মুখের ফুঁ’তে টেনে নিয়ে নাক-মুখ দিয়ে ছেড়ে দিলেই কষ্ট লাঘব হয়, বিষন্নতা কমে। সত্যি তাই? সত্যি-মিথ্যা জানা নেই। নির্ঝরের এখন সিগারেটই ভালোলাগছে। কষ্টগুলোকে কি সুন্দর করে উড়িয়ে দেবার আয়োজন!

(২)

দূর হতে মা লক্ষ্য করলেন নির্ঝর কি যেন করছে বাড়ির দক্ষিনের অঙ্গিনায় কাটবাদাম গাছতলায় বসে। তাই একটু এগিয়ে এলেন কাছে। কাছে আসতেই মা দেখলেন নির্ঝরের হাতে সিগারেট। নির্ঝর এতটা আনমনা যে, মায়ের তার কাছে উপস্থিতি সে কিছুতেই টের পেল না। মাকে হঠাৎ পাশে দেখেই সে তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দিতে চাইল। কিন্তু মা বাঁধা দিল, ছেলের হাতে সিগারেট দেখে মা মুখের কিনারায় হাসি ফুটিয়ে তার পাশে গিয়ে বসল। নির্ঝর ভাবতে পারল না এ কিসের হাসি, তাই সে মাথা নিচু করে সিগারেট হাতে ধরে অপরাধীর মতো বসে রইল। হাতে সিগারেট নিয়ে বসে থাকাতে মা ভাবতে লাগল আজ তার ছেলে বড় হয়েছে, সে বাবুদের মত হাতের মুঠিতে সিগেরেট রেখে দু’ঠোঁটে চেপে আলতো করে সিগারেট খাচ্ছে, নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছড়িয়ে বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছে। আর এ ধোঁয়া কিছু সময়ের মধ্যে বাতাসে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তিনি ভাবতে লাগলেন তার ছেলেও আস্তে-আস্তে বাবুদের মত হচ্ছে, এ ভাবনা তার কাছে গচ্ছিত অনেক দিন হতে আর তাই মায়ের কাছে এ আনন্দও ভীষন রকমের। মায়ের এই খুশির কারণ হলো এই যে, একেবারে কর্পপদস্থ পরিবার নির্ঝরের। ঠিকমতো মাথা গুজানের জায়গা নেই, পেটে নিয়মিত খাবার নেই, তবু বাবা-মায়ের অনেক স্বপ্ন নির্ঝর একদিন লেখা-পড়া শিখে মানুষের মত মানুষ হবে। দেশ-জাতী-সমাজের নিকট তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করবে। সে জন্য নির্ঝরের বাবা-মা রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করছে মানুষের বাড়ী-বাড়ী। সংসারে এত অভাব অনটন থাকার স্বত্ত্বেও ছেলের লেখাপড়া থামতে দেয়নি। অবশ্য শুধু বাবা-মা নয়, নির্ঝরের লেখাপড়ার জন্য নির্ঝরের নিজেরই আছে অক্লান্ত শ্রম, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা। দিনে-রাতে টিউশনি না করলে বাবা-মায়ের একক প্রচেষ্টায় তার মাষ্টারস পর্যন্ত পড়াই হতনা। তাছাড়া মেধাবী হওয়ায় গ্রামের সবাই তাকে সমীহ করে।

সিগারেট এভাবে হাতে ধরে রাখতে ভালো লাগছে না, তাই অবচেতন মনে মুখের পাশে নিয়ে আরোক চুমুক টান দিল, টান দিয়ে পাশে তাকাতেই মায়ের চোখে চোখ পড়ল। মাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার মাথা নিচু করে ফেলল সে। তার সিগারেট খাবার দিকে এভাবে মায়ের চেয়ে থাকাতে লজ্জায় মরে যাচ্ছে নির্ঝর। মনে-মনে সে নিজে নিজের উপর ধ্বিক্কার ছুড়ছে আর প্রচন্ড আহত হচ্ছে। এভাবে মায়ের সামনে বসে সিগারেট খাওয়া যেন তার সারাজীবনের অর্জিত শিক্ষাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে। সে ভাবছে মা বোধহয় তার সিগারেট খাওয়া দেখে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে। মা হয়ত কখনো ভাবতেই পারে নি তার ছেলের এই বেহালদশা। নিজের এই ভগ্নদশায় সে নিজেকে নিজের মনে বলতে লাগল, কি হবে এই আমাকে দিয়ে? আমি কেন এমন পরিবারে জন্ম নিলাম? যে বাবা-মা আমাকে ভালো অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য নিজেদের রাতদিন এক করে দিয়েছে, ভুলে গেছে নিজেদের সাধ-আহ্লাদ, বিনিময়ে আমি তাঁদের কি দিয়েছি? কি দিতে পারব তাঁদের? সত্যি নিজেকে অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে তার,  সাথে ইচ্ছে করে প্রচন্ড ঘৃনা করতে। হ্যাঁ,  দিয়েছি। আজ আমার জন্য আমার মা কষ্ট পাচ্ছে। হায়রে হতভাগার জীবন, এই কি তুই তোর মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করছিস? এই রকম মুখ উজ্জ্বল করার জন্যই তো তোকে নিয়ে তোর মা-বাবার স্বপ্ন দেখা, বেঁচে থাকা। ভাবতে-ভাবতে কান্নায় বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে নির্ঝরের। নিজেকে আর সামাল দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিল নির্ঝর। ছেলের হঠাৎ কান্না দেখে মা হতবম্ব হয়ে গেলেন, ছেলের সাথে সুর মিলিয়ে তিনিও বেমালুম কাঁদতে আরম্ভ করলেন আর ছেলেকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন তার কি হয়েছে। নির্ঝর মাকে বলল, মা আমায় মাপ করে দাও, আমার ভুল হয়ে গেছে। বোকা মা তখনো বুঝতে পারেনি, ছেলে কি ভুল করেছে। মা নির্ঝরকে বলল, কি অইছে তোয়র বাপ, তুয়ই কান্দয়ের কিল্লাই?  য়াঙ্গো ত বেগ্গিন এ তোয়র, তোয়র কিছু অইলে য়ারে কও। নিজের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট পাছে ঠেলে নির্ঝর মাকে জিজ্ঞাসা করল, মা আপনি কি আমার সিগারেট খাওয়া দেখে কষ্ট পেয়েছেন?  মা নির্ঝরের দিকে অবাক চোখে তাকাল, কিছুক্ষন চুপ থেকে তারপর জবাব দিল, রাগ করমু কিল্লাই বাপ? সিগরেট খান কি খারাপ? ঐযেন, মিত্তুলবাবুগো দেছ ন, হেতারাও তো সিগরেট খা, হেতাগো দেছ না কত নাম। একথা বলে মা নির্ঝরকে বুকে টেনে নিল।

এতক্ষনে নির্ঝর বুঝতে পারল তার মা তার সিগারেট খাওয়াতে দোষের কিছু পায়নি। আসলে নির্ঝরের মাথায়ই ছিলনা তার পরিবারের অবস্থান যেখানে, সেখানে এসব বেদপি না বরং অনেক ভদ্রতার। কারণ তারা ভদ্র বলে যাদের মানে তারা যে সবাই সিগারেট,  মদ, ফেন্সিডিল, হিরোইন সহ সব খায়। আর তার মতো পরিবারের লোকদের কাছে তা আশ্চর্যের ও অধরা জিনিস। আআরতাই মায়ের কাছে সিগারেট খাওয়াটা প্রসংশারই। নিজের অবস্থান মনে পড়তেই নির্ঝরের মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। বেদনার কনাগুলো পুনরায় রক্তের মধ্যে ছুটা-ছুটি শুরু করল। ভয়ে শরীর কম্পিত হতে লাগল,  এতক্ষনে নির্ঝর অনুভব করতে পারল তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, নিঃশ্বাস পড়তে বাঁধা খাচ্ছে, চোখের তারা দিয়ে আগুনের ফুলকি বের হচ্ছে। সব অন্ধকার হয়ে আসছে তার চোখের সামনে। সবকিছু তন্দ্রাচ্ছন্ন বিষন্নতায় ধুকছে, পাশে ফিরে নির্ঝর দেখল মা অবাক চিত্তে তার দিকে চেয়ে আছে। নির্ঝরের অন্তরের পুজ্ঞীভুত কষ্টগুলো যেন মাকে ছুঁতে চাচ্ছে। তাই নির্ঝর মাকে বলল, মা আপনি এখন যান, আমি একটু একা থাকতে চাই। মা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কান্না জড়িত গলায় জিঞ্জাসা করল- বাপগো তোয়র কি কিচ্ছু অইছে? অইলে য়ারে কও। নির্ঝর বলল সময় হলে জানাবো মা, এখন আমায় একটু একা থাকতে দাও। নির্ঝরের কথায় মা চলে গেল কিন্তু তার মুখে ফুটে উঠল নিধারূণ চিন্তার ছাপ। কি হল তার বাছার? যাকে ঘিরে তাদের এত আশা-প্রত্যাশা, এত স্বপ্ন-সুখ তার মায়াময় মুখখানা এত মলিন কেন? কেন এত বিমর্ষতার ছাপ? মা শুধু ভেবেই যাচ্ছে কিন্তু কূল-কিনারা কিছুই খুঁজে পেলনা।

(৩)

নির্ঝর উদাসিনভাবে আকাশের দিকে চেয়ে আছে আর ভাবছে প্রকৃতিতে আচমকা কত বৈচিত্র্য হয়, এই মেঘ, এই বৃষ্টি, এই সৃষ্টি, এই ধ্বংশ। তাহলে তার বেলায় কি আচমকা কিছু হতে পারে না! অদূর হতে দূর-দূরান্তে চলে যায় কত খবর, তাহলে তার আকুতি-বিকুতি মিশ্রিত মনের কথাগুলো কি নীশি তার মনের মাঝে আঁকতে পারেনা? সে কত মায়ামধুর সময় কেটেছিল তার হাতে হাত রেখে, দু‘জনে একসাথে কত স্বপ্নের চারা বুনেছিল মনের আকাশে। এইতো সেদিনইতো দু’জনে বলেছিল-জান; একদিন আমরা ছোট্ট ডিঙ্গি নিয়ে বেড়াতে যাব জ্যোৎস্না রাতে। ফুটফুটে চাঁদের কনা আমাদের কোলে বসে জ্যোৎস্নার আলো গায়ে মাখবে আর আবেশে সুখ ছড়িয়ে দেবে আমাদের দু‘জনার মনে। কিন্তু কই? কিছুই হলনা। স্বপ্নগুলো শুধু তাকে ঘিরে রেখেছে, বিক্ষত স্বপ্নদ্রষ্টা অন্তরকে সীমাহিন কষ্টের নীলিমায় আচ্ছাদিত করে তাকে আজ বসে-বসে সব স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে। তার আরও আজ মনে পড়ছে নীশি বলেছিল সে তাকে ছাড়া বাঁচবেনা, তাকে ছাড়া তার সুখ-স্বপ্ন সব বৃথা হবে। সত্যি কি তাই! যদি তাই হয়, তবে সে কি করে তাকে আজ এতটা পর করে দিল? কি অভিমানে সে এতদিনের গড়া স্বপ্ন-সুখের বিন্যাস ছন্নছাড়া করে দিল? তবে কি সে এতদিন তার ভালো অবস্থানের আশায় তাকে ভালোবেসে ছিল? হয়ত তার আশাছিল আমি আমার যোগ্যতায় ভালো একটা চাকুরী পাব আর তাতে তার জীবন স্বাচ্ছন্দে কাটবে? না, সে এতটা স্বার্থপর নয়। নিজের মনেই ভাবে আর উত্তর দেয় নির্ঝর, নীশি যদি স্বার্থপরই হত তবে সে আরো আগে বলে দিতে পারত আমাকে তার পছন্দ নয়। তাছাড়া তার পরিচিত অনেক বড়লোকের ছেলে ছিল, যাদের বিয়ে করে সে সুখী হতে পারত। কিন্তু সে তা করল না। নানান ভাবনায় আজ উঁকি দিয়ে যায় নির্ঝরের মনে। তার সব তাল-গোল পাকিয়ে যাচ্ছে, সে ঠিক-বিঠিক কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা। অস্থিরতা তাকে আজ তার কোমরে জড়িয়েছে। হাজারো চেষ্টা করেও সে আজ বেরুতে পারছেনা তার জড়ানো হাত থেকে। শুধু ভাবনার বিশাল হতে চিন্তামগ্ন বিষয়ের তথ্য উদ্ধারের অক্লান্ত প্রচেষ্টার প্রকাশ পাচ্ছে শরীর থেকে নিঃসৃত ঘামে।

(৪)

প্রায় দশ বছর গত হয়েছে। মিত্তুলবাবুর জমিদারী এখন শেষ। উপার্জন ছাড়া এভাবে টাকা উড়ালে রাজার ভান্ডও পুরায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ তিনি। বাপ-দাদার গড়িয়ে দেয়া জমিদারী মাতলামি আর আনন্দ উল্লাস করে শেষ, এখন পথে এসে দাঁড়িয়েছে তার অবস্থান। সারাদিন এজন-সেজন থেকে ধার ছেড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। গরীব মানুষের আচার ব্যবহারও গরীব, তাই তারা হাত বাড়িয়ে কিছু পায়। কিন্তু মিত্তুলবাবুর মতো যারা, তারাতো আর গরীবদের মতো কিছু খুঁজে চাওয়ার মতো কোমল আচারণ রপ্ত করতে পারে না, তাই তাদের ভাব ব্যবহারে লোকজন সন্তুষ্ট হতে পারে না বলে প্রাপ্তীটাও কম। খুব কম লোকই তাকে বিশ্বাস করে হাত বাড়ায়। এমন দুর্দিনে তার বড় সঙ্গী নির্ঝর। সময়ের পরিক্রমায় নির্ঝর এখন এলাকার সবচাইতে সম্মানিত ও সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তি। জীবনের সব হতাশা আকাঙ্খা ভুলে সে বাবা-মায়ের সুখের জন্য আজ সব করেছে। যে স্বপ্ন একদিন ভেঙ্গে-চুরে তাকে খানখান করে দিয়েছে, সে স্বপ্নকে সে আজ জোড়া দিয়েছে দেশের কল্যানে, বাবা-মায়ের সুখের জন্যে, অনাহত মানুষের সুখী করার আশায়। তার কাজ তাকে মহান করছে দিনকে-দিন।

(৫)

নোংরা মলিন ভুষনে নীশি যখন তার বাবার বাড়িতে এসে পৌঁছল তখন সূর্য্য অস্তমিত হবার অপেক্ষা করছে। দীর্ঘ সময় পর বাড়ির উঠোনে পা রাখতেই স্তম্ভিকতা তাকে গ্রাস করেছে। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে সে চারপাশে চোখ ভুলাতে লাগল। আর অবাক দৃষ্টিতে ভাবতে লাগল- রাজবাড়ির সোন্দর্য্য যেখানে শোভা পেত সেখানে কি দেখছে সে। সবকিছু জরা-ব্যাধিগ্রস্থ হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। যে বাড়িতে লোকজনের কোলাহলে মুখরিত থাকত রাত অবধি, তা কেন আজ নীরব-নিস্তব্ধ? যে বাড়ির উঠোনে ফুল-প্রজাপতির একছত্র অধিকার ছিল, সেখানে এখন কেন শেওলা ধরা মাটি? যেখানে একরাত্রি যাপনের আশায় কতলোকে স্বপ্ন দেখত, সেখানে কেন সব শূন্যতায় নীরব হাহাকার কান্নায় মোড়িয়ে আছে? একি হাল তার বাবার বাড়ির? দারুণ চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল নীশির মনে। সে ঠাঁই দাঁড়িয়ে ভাবতে লাগল। সে ভুল করে অন্য কারো বাড়িতে ডুকে পড়েনি তো? ভুল করে চলে যায়নি অন্য কোন পাড়ায়? চারদিকে তাকিয়ে সব মিলিয়ে দেখছে সে, না সব ঠিক আছে। এই তো আমাদের বাড়ির উঠোনের মন্দিরটা, হ্যাঁ ওইতো পাশের পুকুরটা, সামনে গাছপালার ছায়াঘেরা বাগান। আচ্ছা আমি স্বপ্নে নেই তো! এবার নিজের হাতে বুড়ো আঙ্গুলে কামড় দিয়ে দেখে সে, না সে জেগে আছে। তাহলে সব এমন তাল-বেতাল খাপছাড়া কেন? কোন এক অজানা ভয়ে হু-হু-কারে কেঁদে উঠল নীশির হৃদয়। নীশি উঠোনে দাঁড়িয়েই মাকে ডাক দিল। কোন জবাব এল না। তাই দরজা কাছে এগিয়ে গেল।

(৬)

মিত্তুল কাকার ঘরের দরজায় এই গৌধুলি বেলায় নোংরা বসনে জড়ানো একটা মহিলা উঁকি-ঝুঁকি মারছে আর কি যেন খুঁজছে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বিষয়টি চোখে পড়ল রত্নার মার। তাই এগিয়ে এল সামনে ব্যাপারটি দেখার জন্য। উঠোনে এসে দাঁড়িয়ে সে গলা ছেড়ে বলল- কে? আমনে কি টোগান? পেছন থেকে আচমকা ডাক শুনে নীশি পিছে ফিরে তাকাল। ফিরে সে রত্নার মাকে দেখতে পেল। তাকে দেখে নীশি জিজ্ঞাসা করল-কিগো রত্নার’মা বৌদি, ভালা আছ নি? রত্নার মা নীশিকে ভালোভাবে চিনতে পারল না। পারবে কি করে? দশ বছর আগেকার নীশি আর আজকের নীশিতে যে কিছু মিল নেই। দশ বছর আগে সে ছিল চঞ্চলা তরুনি। যার রুপের ছটায় পাগল হয়ে পড়ত অনেক বৃদ্ধ আবাল জনতা। আজ তার চেহারার সে জলুস নেই। দীনদুখি পরিবারের মেয়েদেরও একটা শারিরিক কোমলতা থাকে, কিন্তু তাও হারিয়েছে নীশি। মনে হয় হাজারো রোগে নেতিয়ে পড়া শরীরে দু‘চারটা হাঁড়ছাড়া কিছু পাওয়া যাবে না, যা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই রত্নার মা বলল- আমনে কে? কারে চানের? নীশি বুঝতে পারল রত্নার মা তাকে চিনতে পারে নি, তাই লজ্জিত স্বরে নীশি বলল- বৌদি য়ার মাওদ্দাই কোনানে? রত্নার মা এবার অনুমান করল ও নীশি, তাই একটু বড় স্বরে বলল- কিলো নীশি! তর এই হাল কিল্লাই? য়াই ত চিন্তামই হারিয়ের না। একথা বলে রত্নার মা তাকে বুকে জড়িয়ে নিল। হাতের জড়ানো বাঁধন থেকে বের হয়ে নীশি আবার প্রশ্ন করল-বৌদি মা-বাবারা কোনানে গেছে? আর আঙ্গো বাড়ির এ অবস্থা কা? রত্নার মা নীশিকে জিজ্ঞাসা করল- তুই বায়ির কিচ্ছু জানস না? নীশি মনে-মনে কোন এক অজানা ভয় পাচ্ছে, সে ভাবছে তার বাবার ভিটে বাড়ি সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। নিশ্চয় বড় কোন কিছু ঘটে গেছে। কিলো কি কই তোরে? রত্নার মার পুনঃজিজ্ঞাসায় নীশির মৌনতা ভাঙ্গে। নীশি বলল- কেমনে জানুম বৌদি? বাবা য়ারে স্বর্গ চাই বিয়া দিছে, হিয়ানের সুখ ছারি য়াই তোঙ্গো খবর লমু কেমনে? বলেই নীশি কান্না জুড়িয়ে দিল। নীশির উত্তর শুনে রত্নার মা বুঝতে পারল নীশির শ্বশুড় বাড়ির অবস্থা। আর তার চেহারা, বেশ-ভুষা দেখে সেটা আরো ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। কারণ যত হত-দরিদ্র হোক না কে, কেহই এত মলিন রুপে কোথাও বেড়াতে যায়না। নীশির সাথে-সাথে রত্নার মাও কাঁদছে আর বলছে, নীশি তোর যে বিয়া অইছে এখবর আমরা হরে ছুইনছি। তুই যেদিন তোর মামাগো বাইত চলি যাছের হেদিন আমরা মনে কইরছি তুই হ ত বেয়াইতি যাছের। হরে হরে হুনি তোর নাকি বিয়া অই গেছে। বেকে ত হুনি আইরচার্য অইগেছে, গাঁয়ের মইধ্যে তোগে অবস্থা বেকের তুন কত বালা আছিল, অথচ তোর বিয়া কারোগোরে না জানাই দি দিছে। কান্নাজড়িত স্বরে নীশি বলল-বৌদি সব কমু তোঙ্গরে, অন আগে কও আঙ্গো ঘরের বেকে কোনাই গেছে? রত্নার মা জবাব দিল- তোর বিয়ার এক বছর হরে এ ত তোর মা মরি গেছে। রত্নার মার মুখে একথা শুনে নীশির মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল, একথা শোনার সাথে-সাথেই সে দিকশূন্য দেখতে লাগল, তাই সে আশাহীন চোখে গলা ফাটিয়ে বিলাপ করে কাঁদতে আরম্ভ করল, ও মাগো, তুয়ই য়ারে ছাড়িদি কোনাই গো গেছ, য়ারে অন কে আর দেই রাখবগো।ও মাগো, তুয়ই ক্যামনেগো এত পাষান অইছ গো, য়ারে অন কে আর দেই রাখবগো। ও মাগো…….। হঠাৎ এতজোরে কান্নার শব্দ হওয়াতে আশপাশের বাড়ির লোকজন ছুটে এসে চারপাশে ভিড় জমাতে শুরু করল কারণ অনুসন্ধানের জন্য। গাঁয়ের জীবনটাই আসলে এমন, কোন একটা বিষয় সংঘটিত হলে লোকজনের মধ্যে উৎসুকতার অন্ত থাকে না। গাঁয়ের লোকজন রত্নার মাকে জিজ্ঞাসা করতে লাগল মহিলাটা কে? নীশি তার মায়ের জন্য বিলাপ করে কাঁদছে। তবু উৎসুক জনতা তাকে দেখে সন্দেহের চোখে রত্নার মাকে নানান প্রশ্ন করছে। কেউ কেউ সহমর্মিতায় নয়নজলে ভাসছে নীশিকে জড়িয়ে ধরে, কেউ কেউ নীশির মুখমন্ডল আর চিবুক ধরে বুকে টেনে নিয়ে ওকে শান্তনা দিচ্ছে। কয়েকজন দশবছর পর নীশির হঠাৎ আগমনে তাকে ভালো করে নিরীক্ষন করে যাচ্ছে। একজন ছুটে গেল মিত্তুলবাবুকে খুঁজে আনতে। সারা গ্রাম ভর হৈ-হৈ রব উঠে গেল মুহূর্তের মধ্যে। একজন বৃদ্ধা মহিলা বলে উঠল, তোর মা সর্গ্গবাসী য়োক, মরি না গেলে অনতাই হেতিরে তোর বাপের অত্যাচার সইতে অইত। বুড়ির কথা শুনে নীশি কান্নার স্বরে জানতে চাইল মায়ের কি হয়েছিল, মা কিভাবে মারা গেল। রত্নার মা জবাব দিল- নীশি আছস যন বেগ্গিন হুইনতি হাইরবি। আগে একটু আত-হা ধুই কাপড়-চোপর হাল্টাই ল। এরপর সবাইকে একটু সরিয়ে দিয়ে রত্নার মা নীশিকে নিয়ে ঘরে ডুকে গেল। দু‘এক জন সাথে-সাথে ঘরে গেল। বাকীরা উঠোন হতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। সন্ধ্যা হওয়াতে কেউ-কেউ ঘরে ধুপ-দ্বীপ জ্বালাতে চলে গেল। কেউ-কেউ আবার চার-পাঁচজনের জোট পাকিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে নানান বিষয়ে আলাপ করছে।

চলবে………………………

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to ম্লান-মোহিনীর ছায়ানটে

You must be logged in to post a comment Login