কিশোরটি !
এক পত্রিকার রিপোর্টার আমি ;
পত্রিকাটির নাম বলছি না ।
আমার ‘রিপোর্টার লাইফ’ আজ বহু বছরের
সে সূত্রে রিপোর্টও করা হয়েছে বহু
করেছি সাধারনধর্মী রিপোর্ট আবার ব্যতিক্রমধর্মীও…
আশুঃ ঈদ উপলক্ষে আমার
সাধারন রিপোর্টগুলির পাশাপাশি
চালাচ্ছিলাম এক ব্যতিক্রমধর্মী রিপোর্টের কাজ ।
রিপোর্টের নাম – ‘হাসিমুখী মানুষের গল্প’ ।
উদ্দেশ্য ছিল, ঈদের আনন্দের সাথে
বারতি কিছু আনন্দ যোজন করা ।
অবশ্যি হাসিমুখী মানুষের
আনন্দের গল্পে নিজেকে আনন্দ
দেব না ; এমন স্বার্থহীন আমি নই ।
অবসরে তাই, সে রিপোর্টের আয়োজনে
রাস্তায় হাসিমুখী মানুষ খুঁজে খুঁজে
নিচ্ছিলাম সাক্ষাৎকার ।
একদিন দুপুরে , কমলাপুর রেল-স্টেশনে –
দেখলাম অদুরে, এক কিশোর দাঁড়িয়ে ।
চুল তার এলোমেলো ; কাঁধে কালো এক ঝোলা ।
বেশ গোছালো হয়েও যেন
কোনো এক স্বপ্নের ঘোরে
তার চোখ বড় উদাসীন !
আর ঠোঁটের কোনে লেগে আছে
এক রহস্যময় মায়াবী হাসি !
‘একা একা হাসছে’ (!) -এমন মানুষের আত্মকথা
বেশ মজারই হবার কথা ।
আমি আমার স্বার্থ অন্বেষনে
ছুটলাম সে কিশোরের কাছে …
আমি কিশোরটির ঠিকানা বলছি না ; জানাচ্ছি না পরিচয় ।
আমি জানতে চাইলাম কিশোরটির হাসির পেছনের কথা ;
আমার জিজ্ঞাসায় তার হাসি ম্লান হল না এততুকু ।
উত্তরে সে বলল, ” মাত্র ট্রেন স্টেশান ছেড়ে গেল ।
ট্রেনে আমার মমতাময়ী মা আর
আদরের ছোট বোনটি ।
দেখতে দেখতে চোখ থেকে হারিয়ে গেল ট্রেনটি
কান থেকে নিঃশেষ হল ট্রেনের হুইসেল ।…”
কিশোরটির ঠোঁটে লেগে থাকা
হাসি ভেদ করে বেরিয়ে এল একটি দীর্ঘশ্বাস ।
কিশোরটি সেই দীর্ঘশ্বাস ছুঁড়ে দিয়ে আবার বলতে লাগলো,
“হয়ত আমার মা আর বোনটির সাথে
আমার দেখা হবে না আর কোনোদিনই ;
তবু আমি আমার মায়ের কাছে থেকে যাব
চিরদিনই ; যদ্দিন সে বাঁচবে আমায়
বুকে করে বাঁচবে ।
আর আমার বোন ?
আমি যেভাবে অন্য কোনো ট্রেন দেখে ,
ট্রেনের হুইসেল শুনে, আমার
মা আর বোনকে বহনকারি ট্রেনটির স্মরন করব,
আমার বোনও হয়ত’ কোনোদিন
কারো ভাই দেখে, কারো মুখে ভাইয়ের গল্প শুনে
আমায় স্মরন করবে ;
সেদিন হয়ত’ তার বুক চিড়ে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরুবে ;
ক্ষনিকের জন্য চোখ ভিজে যাবে জলে।…
বহুদিনের বহু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রিপোর্টার হয়েও
সেদিন দুপুরে হাস্যমুখী ছেলেটির সামনে
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম হতভম্ব হয়ে ।…
ক্ষানিক বাদে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে
কিশোরটিকে সহানুভূতির স্বরে জিজ্ঞাসা করলাম,
“তোমার বাবা নেই বুঝি ?”
এবারে কিশোরটি সশব্দে হেসে উঠল !
বলল, “আপনার বুঝি আমাকে দেখতে
‘ঈসার’ মত লাগছে ? বাবা থাকবে না কেন ?
আমার বাবা আছে; অবশ্যই আছে;
না থাকার মত হলেও আছে !
আমার মা আর বোনকে বিদায় জানাতে
আমার বাবাও এসেছিল ।
এই সুবাদে বাবার সাথে আমার দেখা
এক বছর পর !
অবশ্যি বাবাকে দেখলে এই এক বছর নিয়ে সংশয় জাগে ;
সত্যিই এক বছর তো !
এই এক বছরে বাবার বয়স যেন দশ বছর
বেড়ে গিয়েছে !
এক বছর আগের সেই গোছান গোছের মানুষটি
আজ কেমন জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে !
গালে খোঁচা খোঁচা পাকা দাঁড়ি;
মাথায় কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল;
গালের চামড়া-কপালের চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে;
গলার চামড়া ঝুলে গেছে;
গায়ে তাঁর ময়লা কোঁচকানো কাপড়
আর পায়ের স্যান্ডেলটি আধছেঁড়া…
আমার ছোট বোনটির জন্য বাবা চকলেট এনেছিল;
সম্ভবত তাঁর কাছে থাকা শেষ অর্থের অংশটুকু দিয়ে কেনা।
প্যান্টের পকেট থেকে বাবা যখন
চকলেট বের করছিল’ ; তখন পকেটের
সবটাই বের হয়ে গেল ।
দু’চারটে কাগজ আর দু’টি দু’ টাকার নোট ।…”
ছেলেটি হঠাৎই আমার দিকে চাইল, বলল,
“বুঝলেন, একদিন আমার অনেক ছিল,
আজও অনেক আছে ;
যা ছিল তা হারিয়েছি তবু
যা ছিল না তার সবই মিলে গেছে ।”
সেই দুপুর থেকে সাক্ষাতৎর নেওয়া
বন্ধ করে দিয়েছি ।
মানুষের হাসির আড়ালে যা থাকে
তা জানার চে’না জানা ঢের ভাল !
©আহমেদ মাহির
২৭/১০/০৮
### আমার সেই কালো অধ্যায়টি , যা এক নতুন মাত্রা দিয়েছে আমায়
-তাকে স্মরন করে…
8 Responses to কিশোরটি !
You must be logged in to post a comment Login