গল্পঃ লজ্জাবতী
জীবনের সুখ-দুঃখের স্মৃতি গুলো ছাড়া আরও কিছু স্মৃতি আছে, যেগুলো সুখের না দুঃখের অনুমান করা কঠিন। মাঝে মধ্যে এই স্মৃতিগুলো বিশ্লেষণের চেষ্টা করি, কিন্তু শ্রেণীবিন্যাস করতে পারি না।
মস্তিষ্ক একটু অবসর পেলেই স্মৃতিভাণ্ডার হাতড়ায়। অগণিত স্মৃতিগুলোর মধ্যে একটি, এই মুহুর্তে বারবার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। কোন ভাবেই ওটাকে সরানো যাচ্ছে না। প্রত্যেকটা স্মৃতিতেই স্থান, কাল ও পাত্র থাকে; নামকরণে পাত্রই বেশি গুরুত্ব পায়। এই স্মৃতিটা বেনামি, পাত্রের নাম জানা নেই; কলেজ জীবনের ঘটনা।
কলেজ জীবনে লজিং থেকেছি বেশ কয়েকটি। একটি ভাল লজিং পাওয়া কত কঠিন তা ভুক্তভোগীই ভাল জানেন। দুরত্ব বেশি হলেও একটা ভাল লজিং পেয়েছিলাম। লজিং পরিবারের সদস্যদের ভাল ব্যবহারের কাছে হাঁটার কষ্টটা সামান্য মনে হতো।
লজিং থেকে কলেজের দুরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। কাঁচা রাস্তা; দুই পাশে গ্রাম। চৌরাস্তার মাথায় কয়েকটি দোকান ঘর, লোকে বলে ‘রাস্তার মাথা’। ‘রাস্তার মাথা’য় একটি মেয়ে রোজ আমার জন্য অপেক্ষা করতো। কোন দিন আমাকে দেখলে আগে চলতো; কোন দিন পিছু নিতো। প্রথম দিকে ব্যাপারটি ছিল খুবই বিড়ম্বনাপূর্ণ ও বিরক্তিকর । ইচ্ছে করে দেরি করে বের হতাম, ফলাফল একই। যে দিন দেরিতে বের হতাম, সে আমার আগে আগে হাঁটতো। মেয়েটির স্কুলের সামনে দিয়েই আমার কলেজে যাতায়াত। প্রথম যখন দেখা, তখন সম্ভবত সে ক্লাস নাইনে পড়তো। দেখলে মনে হবে কলেজ ছাত্রী। ইচ্ছা করলে সব কিছু জানা যেত; জানার তাগিদ অনুভব করিনি।
ফিরতি সময় দেখতাম একান্ত বাধ্যগত কেউ আগে আগে হাঁটছে। আমি গতি বাড়িয়ে দিয়ে তাকে পেছনে ফেলে দিতাম। ওভারটেক করার সময় ভাবটা এমন ফুটিয়ে তুলতাম, বাধ্যগতের আগে হাঁটতে নেই। মেয়েটি মনে হয় তাই চাইত, রাস্তার এক পাশে সরে যেত।
নারী তার প্রয়োজনীয় অবলম্বন নিজেই সৃষ্টি করে নেয়; কিভাবে নিতে হয় সেটা নারীই ভাল জানে। স্কুলে যাতায়াতের জন্য মেয়েটির হয়ত কোন সঙ্গী-সাথী ছিল না। গ্রাম বাংলার মেয়েরা একা চলতে অভ্যস্ত নয়। ছেলে বেলায় পাশের বাড়ির বয়স্ক মহিলারাও বলতো,
“তুহিন, আমার সাথে একটু যাবে?”
পিচ্ছি মানুষ, সঙ্গে গেলে কী লাভ? না গেলে কী ক্ষতি? বুঝতে পারতাম না। মুরুব্বিদের কথা রাখতাম।
মেয়েটি আমার আগে-পিছে চলে। এতে তার লাভ-ক্ষতি সেই ভালো বুঝবে। লোকে ধারণা করবে আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, অথচ তারা জানে না যে মেয়েটার নামটাই আমার জানা হয়নি। নাম জানার চেষ্টাও করিনি। আশ্চর্য ব্যাপার, সামান্য দুরত্ব বজায় রেখে আড়াই কিলো মিটার পথ, দুই বছর এক সাথে হেঁটেছি ।
এক পর্যায়ে আমার মধ্যে একটা দায়িত্ববোধ জন্মেছিল। মনে হতো দেরি করা ঠিক হবে না। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।
বৈশাখ মাস। প্রচণ্ড গরম পড়ছে। কলেজ শেষে ফিরছি। হঠাৎ দেখি আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। দুইজনেই দ্রুত হাঁটছি। মনে হচ্ছে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হবার আগে বাড়ি পৌঁছতে পারবো না। অনুমান জয়ী হল। অর্ধেক পথেই বৃষ্টি নামল; সাথে প্রচণ্ড বাতাস। ভাবছি ভিজতে ভিজতে হাঁটবো। আমার হাতে একটা নোট বুক। মেয়েটির ব্যাগ ভর্তি বই। ভিজে সব নষ্ট হয়ে যাবে। রাস্তার পাশে মাজার সংলগ্ন মসজিদ ছাড়া বাড়ি-ঘর অনেক দূরে। মনে প্রচণ্ড দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। মন একবার বলছে ‘চট জলদি মসজিদে আশ্রয় নাও’। আমি আশ্রয় নিলে, সে ও কি আমাকে অনুসরণ করবে? বৃষ্টিতে ভেজা একটা মেয়ে, একই ছাউনির নিচে; বাজে দেখাবে না? লোকে কি ভাববে? ওর বই খাতা নষ্ট হলে আমার কী?
সময় কম; সিদ্ধান্ত নিতে হবে দ্রুত। সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হয়নি। প্রচণ্ড বাতাস আর বৃষ্টি আমাকে মসজিদের বারান্দায় নিয়ে গেছে। ফিরে দেখি মেয়েটি ও ভিজে একাকার। সে বারান্দায় প্রবেশ করেনি। মুসল্লিরা জুতা-সেন্ডেল যেখানে রাখেন, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভেজা চুল হাতে ঝেড়ে শুকিয়ে নিচ্ছি। ঠাণ্ডা লাগছে। টিনের চাল বেয়ে বৃষ্টির পানি ঝর্ণার মত ঝরছে। তিনটা চড়ুই চুপচাপ মৃতদেহ বহনকারী খাটিয়ার উপর বসে আছে, চঞ্চলতা নেই। কোন প্রকার শব্দ করছে না। একটা ঠোঁট দিয়ে পালক খোঁচাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে পাখা ঝাপটাচ্ছে, মনে হয় আমাদের মত ভিজেছিল।
মেয়েটি নির্বিকার, মোনালিসার মত দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি দেখতেই মগ্ন, ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে ধরেছে। একটু দূরে আম গাছের ভেঙ্গে পড়া কিছু ডাল–পালা । চিত্রশিল্পী দৃশ্যটি আঁকলে অপরূপ এক চিত্র হতো। পেছনে এক তরুনের ঝাপসা অবয়ব থাকতো চিত্রে। দর্শক মনে হাজার প্রশ্নের জন্ম নিত। প্রকৃতির উপর মেয়েটি বিরক্ত না মুগ্ধ ? ঝাপসা তরুণটা কে? ভাই, বন্ধু বা অন্য কেউ?
অজানা ছবি দেখে যার যা ইচ্ছা অনুমান করতে বাঁধা নেই। শিল্পী তার শিল্পকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেন। দর্শকের কল্পনাশক্তি মুক্ত; যা খুশী অনুমান করুক।
কবি দৃশ্যটি দেখলে ঝটপট খাতাটা বের করে লিখে নিতে পারতেন একটা কবিতা; প্রকৃতির মাঝে মিশে যাওয়া এক কিশোরীর বন্দনা । কথা শিল্পীর জন্য হতো চমৎকার গল্পের পটভূমি। আমার মধ্যে শিল্পের সামান্যতম গুণ নেই। আমি কিছুই করতে পারিনি, নির্বাক দর্শক। কল্পনায় তার সাথে কথা বলেছি। সে উত্তর দিয়েছে। আমি বলেছি,
: আচ্ছা, তুমি আমার পেছনে লেগেছ অনেক দিন হয়; কথা বল না কেন?
: আমি আগে কথা বলি আর আমাকে নির্লজ্জ মেয়ে ভাবো–এই তো? আমি পেছনে লেগেছি!!
: ওমা! এ তো দেখি সাক্ষাৎ লজ্জাবতী! লজ্জা-জ্ঞান দেখি প্রকট! যখন আমার আগে-পিছে হাঁটো, লজ্জা-জ্ঞান কোথায় থাকে ? নামটা তো বলতে পারতে?
: আপনি বড়, উচিৎ ছিল নামটা জেনে নেয়া। আপনিই কাণ্ডজ্ঞানহীন।
: আমাকে কাণ্ডজ্ঞান শিখাচ্ছো!! দেখো মেয়ে, গায়ে পড়ে মেয়েদের সাথে কথা বলে ‘বেহায়া’ অপবাদ মাথায় নিতে চাই না। তোমার নাম তোমার কাছেই থাক।
: আপনার প্রচুর ‘হায়া’ দেখছি। কথা বললেই কি ‘বেহায়া’ হয়ে যায়? একদিন আপনার সব ‘হায়া’ হারিয়ে যাবে। ভান ধরেন কেন? ভণ্ডরাই ভান ধরে, নকল সাধু সাজে।
: হা হা হা, তুমি দেখি অনেক কিছু জানো। মনে রেখো, যে দিন তোমাদের কেউ লজ্জা হারিয়ে আমার ‘হায়াবাগে’ ঘুরবে, সেদিন কথা বলবো।
: সেই দিনের অপেক্ষায় থাকেন,আমি গেলাম।
কল্প রাজ্য থেকে ফিরে দেখি, সত্যিই মেয়েটি অনেক দূর চলে গেছে। আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। ঝড়-বৃষ্টি কমে এসেছে। মুয়াজ্জীন এসেছেন; আসরের আজান দিবেন। আমি নামাজ পড়ে যাবো। আজানের ধ্বনি শুনে চড়ুই তিনটি এক সাথে বেরিয়ে গেল। মনে হচ্ছে এতক্ষণ স্বপ্নই দেখছিলাম ।
দীর্ঘ দিন পর মেয়েটির কথা মনে পড়ছে বার বার। আজ তার নাম দিয়েছি লজ্জাবতী। জীবনে তার আসল নামটি জানা হবে না; আমার দেয়া নামটিও জানানো গেল না।
4 Responses to গল্পঃ লজ্জাবতী
You must be logged in to post a comment Login