চলে গেলেন কথাশিল্পী ও গবেষক আহমদ-উজ-জামান

সাঈদ চৌধুরী: বাংলাদেশ বেতারের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও গবেষক আহমদ-উজ-জামান (৩০ মে ২০১৬, রাত
সাড়ে ১১টায়) ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না-লিল্লা-হি ওয়া ইন্না-ইলাইহি রা-জিউন।
আল্লাহ ছাড়া কারু কাছে/নোয়াই না তো, আমার মাথা/এই দুনিয়ায় ছড়িয়ে চলি/মুক্ত আলোর বিজয়গাথা॥
অজ্ঞ যারা, অন্ধ যারা/এই আলোকে জাগবে তারা/জাগবে আকাশ, নিখিল ধরা/আজাদ প্রাণের রোশনি মাখা॥
ফররুখ আহমদের ছড়ার ছন্দে আহমদ-উজ-জামান নিজের জীবন দর্শন জানান দিতেন এভাবেই। বলতেন এই জগৎ ছাড়া
আরো এক জগৎ আছে। আমরা তা দেখি না। ‘নুরুন আলা নূর’। জ্যোতির ওপরে জ্যোতি। জ্যোতি দুনিয়ার বস্তুকে দৃশ্যমান
করে, প্রকৃতিকে ঔজ্জ্বল্য দান করে।
আহমদ-উজ-জামান একজন নিভৃতচারী কথাশিল্পী। সতেজ ইতিহাস, ক্ষুরধার পর্যবেক্ষণ আর প্রখর স্মৃতিভরা তাঁর
লেখাগুলো পাঠককে পুলকিত করে; নদীর স্রোতের মতো সমুদ্রের দিকে নিয়ে যায়।
ছোটোগল্প দিয়ে লেখালেখির যাত্রা শুরু হলেও তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বহে না কুড়া নদী’ একটি আত্মকথার স্মারক; তাঁর
ভাষায় পারিবারিক জার্নাল। রেডিও এবং টেলিভিশনে তাঁর রচিত নাটক ও ফিচার ব্যাপক ভাবে প্রসংশিত।
স্মৃতিচারণ মূলক লেখায় জীবনের ছোট ছোট গল্প, মজাদার কাহিনী, আর ভাল-মন্দের হৃদয় ছোঁয়া অনুভূতির অন্যরকম
একটা গভীরতা আছে। ‘শিশু-কিশোরদের কবি ফররুখ আহমদ ও প্রাসঙ্গিক স্মৃতি’ কিংবা ‘বহে কুশিয়ারা’ গ্রন্থই তার
প্রমান।
জীবন ও ঘটনা প্রবাহ রচনায় আহমদ-উজ-জামানের স্নিগ্ধ হাত ছিল। মাউন্টব্যাটেন, জিন্নাহ ও নেহরু শীরোনামের লেখাটি
তার স্বাক্ষর বহন করে। জাতীয় দৈনিকে ‘স্মরণ’ শীরোনামে সাহিত্যিক ও গবেষক আতোয়ার রহমান, প্রখ্যাত সাংবাদিক
এস এম আলী, সাংবাদিক ফজলুল হক সেলবর্ষী সহ অসংখ্য গুনীজনের কথা তিনি লিখেছেন।
আমার প্রথম গ্রন্থ ‘ছায়াপ্রিয়া’ নিয়ে (২.১১.১৯৯৫) দৈনিক জালালাবাদে তাঁর একটি লেখা প্রকাশিত হয়্। ‘আমার নোট
থেকে’ শীরোনামে নিয়মিত কলামে আহমদ-উজ-জামান লেখেন- ছায়াপ্রিয়া উপন্যাসটি পড়ে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম।
আমার ধারনা ছিলো, সিলেটের নতুন লেখকদের লেখায়-সাহিত্যে সিলেট আসছেনা। কোনো? সবাই কি ভাগীরথী বুড়িগঙ্গা
কেন্দ্রিক লেখক ও কবি। আমি তাই খুঁজছিলাম এমন একজনকে, যিনি সিলেটের সন্তান হয়ে সিলেটকে তার লেখায় তুলে
ধরছেন। ছায়াপ্রিয়া আমাকে দিয়েছে সেই সিলেট, যে সিলেট সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্তর পরিবর্তন করে নতুন সিলেট, নতুন
সিলেটীরা গড়ে উঠছেন তার তথ্য ও স্বাদ।
আহমদ-উজ-জামানের জন্ম ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর সিলেটের সংস্কৃতি ও শিক্ষার পাদপীঠ গোলাপগঞ্জের ভাদেশ্বরে
এক সংস্কৃতিবান বনেদি পরিবারে। তাঁর পিতা জমির আহমদ চৌধুরী এবং মাতা তুহফাতুন্নেছা চৌধুরী সমাজসেবী ও
সংস্কৃতিবান ছিলেন। তিনি ভাদেশ্বর এইচ ই স্কুল থেকে ১৯৫১ সালে ম্যট্রিকুলেশন এবং সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৫৭
সালে গ্রাজুয়েশন করেন।
আহমদ-উজ-জামান কর্মজীবনে ১৯৫৯ সালে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে প্রোগ্রাম প্রোডিউসার পদে
যোগদান করেন। তিনি ১৯৬২ সালে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে ও ১৯৬৭ সালে রংপুর বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠান সংগঠক ও
সহকারী আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক
হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে সিলেট বেতার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক এবং রংপুর ও খুলনা বেতার কেন্দ্রের
আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেন।
চাকরিকালিন সময়ে তিনি রংপুর কেরানিপাড়ায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। জীবনের শেষ সময়কাল সেখানেই কাঠিয়েছেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, ছোট ভাই সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
কথাশিল্পী আহমদ-উজ-জামান ছোটোগল্প, নাটক, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, স্মৃতিকথা প্রভৃতি বহুমাত্রিক গদ্য রচনা করেছেন। ১৯৪৮
সালে সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায় তাঁর প্রথম ছোটোগল্প ছাপা হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো হচ্ছে : বিদায়, দাবী,
প্রায়াশ্চিত্ত, ইতিহাসের পাতা। তাঁর নাটকগুলোও রেডিও-টেলিভিশনে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদপত্রে
তাঁর অসংখ্য নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। জাতীয় দৈনিক নয়া দিগন্ত এবং সিলেটে দৈনিক জালালাবাদ ও রংপুরে দৈনিক যুগের
আলো পত্রিকায় দীর্ঘদিন প্রবন্ধ/কলাম লিখেছেন। দৈনিক যুগের আলো তাঁকে ১৯৯৭ ও ২০০০ সালে শ্রেষ্ঠ কলামিস্ট হিসেবে
সম্মাননা প্রদান করে। ‘গুল্ম পাতায় কাঁপন’ শিরোনামে তাঁর চাকরি জীবনের স্মৃতিকথা বেতার বাংলায় ধারাবাহিকভাবে
প্রকাশিত হয়। তাঁর আত্মজীবনী ‘বহে না কুড়া নদী’ ২০০৫ ও ‘বহে কুশিয়ারা’ ২০১২ এবং ‘সিলেটের পাঁচ মনীষা ও প্রাসঙ্গিক
ভাবনা’ আগস্ট ২০১২ সালে প্রকাশিত হয়। পাঁচ মনীষা বইটি সুলেখক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল তার পান্ডুলিপি প্রকাশন
সিলেট থেকে বের করেছেন।
You must be logged in to post a comment Login