নাইসম্যান ক্লথ হাউজ
পলেস্তারা খসে পড়া বিল্ডিংটায় এখনো টিকে আছে নাইসম্যান ক্লথ হাউজটি। স্মৃতির ভারে অমলিন হয়েও হতে পারেনি; কাগজ ফুলের লতানো ডাল গুলো এখনো পেচিঁয়ে রেখেছে পুরোনো বিল্ডিংটাকে।
যে পথে শুধু রিকসার চলাচল ছিলো সেখানে সি.এন.জি নেমে এসেছে গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে। চারপাশটা বিবর্তনের মতো শুধু বদলে গেছে শুধু বদলে যায়নি অতীতের সেই নাইসম্যান ক্লথ হাউজটি। হাজার আনন্দ আর সুখের স্মৃতির মাঝেও কিছু কিছু যন্ত্রনাদায়ক স্মৃতি থাকে।
আমার শত স্মৃতির বিলুপ্তি ঘটেছে! কিন্তু সেই স্মৃতির আয়নাটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলেও হারিয়ে যায়নি সেই টুকরো গুলো। চোখ বন্ধ করলে এখনও শুনতে পাই নিশীথের কন্ঠ’-
-রাত্রি একবিন্দু ভালবাসা কিনতে একশো ফোটা রক্ত দিতে হলেও তোমাকে ভালবাসবো? কি, ফেরাবে না,তো আমায়?
বুকর ভেতরটায় কাসরঘন্টা বাজে একটানা ঢং ঢং করে, কখনোবা দি-দ্রিরিম শব্দে নিশ্বাসের সাথে সাথে ঢোলের বাড়ি পড়ে এখনও মনে হলে তিরতির করে শরীর, ও অসহ্য…সে ……যন্ত্রণা !
টিচার লেনের ভাড়াবাড়িতে নিশীথ থাকতো। নাইসম্যান ক্লথ হাউজের সেলসম্যন। ক’টাকাই বা বেতন পেতো? বাবা .মা, বোন গুলোর ভরণপোষণ; তারপরও গায়ে মেখেছিলো ভালবাসার রং। ওর মুখ ফসকে যাওয়া সে কথা,
– আচ্ছা রাত্রি -মানুষের কি স্বাধ আহ্লাদ থাকতে নেই? আমার কি ভালবাসার রং গায়ে মাখতে স্বাদ হয়না?
– হয়, কিন্তু নিশীথ ভাবতে পারছনা- তুমি আমি দু’জন – দু’আঙ্গিনার মানুষ এভাবে ভালবাসা হয়না ?
পেছন থেকে হেড়ে গলায় শশীমোহন বলে উঠে আহা! এতো কি-কথা হচ্ছে এখানে? নিশীথ কাষ্টমারকে তারাতারী বিদেয় দাও।
হেড়ে গলার কাছে আমাদের কথা চাপাঁ পড়ে যায়। আমি ওকে বোঝাতে ব্যার্থ হই ও,কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? কিন্তু সমাজ,ধর্ম আর বাধ্য বাধকতার ঘোলাজল যে এখনো কাটেনি।
এ বাজারে তখনও দোকানে ফুল বিক্রি শুরু হয়নি। জানিনা কার গাছ থেকে কাটা শুদ্ধ গোলাপ নিয়ে এসে কলেজ রোডের ধারে, পুরোনো রাজার গেটের কাছে দাড়িয়ে ভিজছে নিশীথ। আমায় দেখে দৌড়ে ছাতার নিচে আসে,
– রাত্রী তোমার জন্য বর্ষাস্নাত গোলাপ
– নিশীথ ভিজে গেছো যে, কলেজ যাওনি কেন?
– এ মাসের মাইনে দিতে পারিনি!
আমি সেদিন বলতে পারিনি নিশীথ তোমার পুরো মাসের মাইনে আমি দিয়ে দিয়েছি।
রোজ সন্ধ্যেয় মন্দিরের ঘন্টা শুনে বের হই, আমাদের ছোট্ট নীড়টার পাশেই নিশীথদের ভাঙ্গা কুঠির। নিশীথের ভালবাসায় ভাঙ্গাঘরটাতেও ভালেবাসার আলো মাখামাখি।
নিশীথ তুমি রোজ ভগবান ঠাকুরের কে পুজো দাও প্রণাম করো; সে,কি তোমার মনের আশা পূর্ন করবেন? আমার হাতটি ধরে নিশীথ বলে কি,যে বল না তুমি? দেখো একদিন ঠিক হয়ে যাবে সব।
আমার মন বলে, না নিশীথ সব ঠিক হয়না তিনি উপর থেকে অনঢ় বসে থাকেন আর মজা দেখেন।
আমরা যে সত্যি ভালবাসার স্বপ্ন দেখি তাই তিনি কাদাঁতে চান। আযানের ধ্বন্নি কানে আসতেই, নিশিথ বলতো রাত্রী, নামাজ পড়বেনা বাসায় যাও!
আমি দু’হাত তুলে মোনাজাত করি খোদা এ কেমন ভালোবাসা দিলে তুমি!
কোন এক বিকেলে আমার হাত ধরে নিশিথ বলেছিলো ভুলে যেতে বলোনা; যাকে ভুলে যেতে বলবে তার ইচ্ছে গুলো যে মরে যাবে সেটা বুঝনা? -তোমাকে ছেড়ে গেলে তাহলে বাচঁবো না কিন্তু? ওই ভগবান ঈশ্বরও আমাকে ঠেকাতে পারবেনা।
সত্যি কেউ ঠেকাতে পারেনি; আমার মুখের বাক্য শোনার পর হয়তো একমুহুর্ত দেরি করেনি নিশীথ; সোমেশ্বরী জলে লাশ হয়ে ভেসেছিলো।
আমার বাবা জেনে গিয়েছিলো আমাদের সব। প্রচন্ড প্রহারের মুখে নিশীথ টিকে থাকতে পারেনি হৃদয় রক্তক্ষরণে ভালোবাসা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছে। হিন্দুর ছেলে হয়ে মুসলমানের মেয়েকে ভালবাসা! এতো বড়ো স্পর্ধা !!
সমাজ,পরিবার কুৎসা রটানোর ইস্যু পেয়ে হাততালি দিয়েছিলো। এই আমাকে যেন সমাজের চেখে জবাবদিহিতা করতে না হয়; পথে ফিরতে পাছে লোকের কথা শুনতে না হয় ; যেন আমি ভূলতে পারি প্রেমের আহবান; সর্বোপরি নিশীথের ভালোবাসা। আর সে চেষ্টায় দেশ ছেড়ে আমাকে ছুড়ে ফেলা হলো বিদেশে।
আজ মনে পড়লো যে শাড়ি জড়িয়ে পড়ে দাড়িয়ে আছি আমি- দশ বছর আগে নিশীথ দিয়েছিলো নিজের খরচ বাচিঁয়ে হোক না সে ক্ষুদ্র উপহার; তবুও ভালবাসার প্রথম উপহার কিংবা এটাই ছিলো ওর শেষ উপহার।
আমি মনের ভীতর থেকে ডুকরে কেদেঁ উঠি আমার বলতে ইচ্ছে করে নিশীথ আমি তোমাকে ভালবাসি। আজ আমি অনেক বড়; সমাজ সংস্কারকে ভয় করিনা। তুমি ফিরে এসো? কিন্তু আমার হাহাকারটা নাইসম্যন ক্লথ হাউজের দেয়াল পর্যন্তই ঠেকে যায়। নিশীথ আর আসেনা !
সমাপ্ত
গল্পটার ২য় সংস্করণ এটা প্রথম সংস্করণে একটু গোলমেলে ছিলো।
16 Responses to নাইসম্যান ক্লথ হাউজ
You must be logged in to post a comment Login