প্রক্সি অথবা প্রেমপত্র
আমি যখন ক্লাস টেনের ছাত্র, তখন কেমন কেমন করে যেন লাইলি নামের ক্লাস ফাইভের একটি মেয়ের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। প্রকাশ্যেই চিঠি চালাচালি করতাম। ছাত্ররা তো বটেই কোনো কোনো শিক্ষকও চিঠি আদান-প্রদানের ব্যাপারটি দেখেছেন। ভাবতাম প্রেম বুঝি অমনই। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আবিষ্কার করি যে, মেয়েটি যখন চিঠি দিতো তাতে ভুল বানানে লেখা অনেক পরিণত ভাবনার প্রকাশ থাকতো। থাকতো দেহগত নানা অস্বস্তিকর কথাও। তার শারীরিক গড়ন বাড়তি থাকায় তাকে যুবতীর মত মনে হলেও কথা-বার্তা বলার সময় টের পেতাম যে, সত্যিই বয়স এবং মনের দিক থেকে প্রায় বাচ্চা রয়ে গেছে। কেবল চিঠিতে থাকতো যত পরিণত যুবতীর কথাবার্তা। চিঠি পড়তাম আর ভেবে আকুল হতাম, এসব কথা কি সে ঠিক মত বুঝে শুনে লিখেছে? নাকি পরিণত কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়? কিন্তু তার আচরণে তো এমন কিছু দেখতে পাই না!
তার আমার সম্পর্কের কথা স্কুলের বাইরেও প্রায় অনেকেরই জানা ছিলো। এমন কি তাদের পরিবারের কেউ কেউ জানতেন। বিশেষ করে তার বড় বোন আর দুলাভাই। দুলাভাইটার সঙ্গে তাদের বাড়িতে আমার আলাপ হয়েছিলো একবার। ভদ্রলোকের কথাবার্তায় বেশ প্রশ্রয় প্রচ্ছন্ন ছিলো। এক সময় ব্যাপারটা আমার বাবা-মায়ের কানেও এলো। মায়ের গ্রামের জানা-শোনা লোকের মেয়ে বলে মায়েরও কৌতূহল ছিলো হয়তো। একদিন কী এক প্রসঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, মাইয়াডারে আওনের কতা কইসচাইন!
সুযোগ বুঝে একটি চিঠিতে লিখে জানিয়ে দিলাম যে, মা তোকে দেখতে চান। তার ঠিক দুদিন পরই সে এলো। তাদের গ্রাম যেদিকে, সেদিক থেকে না এসে উলটো পথে এলো। সঙ্গে আরো দুজন সহপাঠী। সুরাইয়া আর মাহমুদা। যারা তার চাচাতো বোনও। ওই দু বালিকা দেখতেও ছিলো নাবালিকা। ক্লাস ফাইভের বাচ্চারা বড় হলে আর কতটুকুই হয়! কেবল আমার প্রেমিকাই ছিলো ব্যতিক্রম।
সেদিন স্কুল বন্ধ ছিলো বলে বাড়িতেই ছিলাম। তো উলটো পথে আমাদের বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়ালো তিনজন। আমি ঘরেই ছিলাম। বাইরে ফিসফাস আর চাপা হাসির শব্দে আমি কৌতূহলী হয়ে দরজায় এসে মুখ বাড়াতেই দেখতে পাই, তিন সখি চঞ্চল দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাকে দেখতে পেয়েই ওরা পরস্পর গা ঠেলাঠেলি আরম্ভ করলো। আমি কিছু বলার আগেই লাইলি বলে উঠলো, পানি খাম!
সেদিনের ঘটনাটি পরে বেশ কিছুদিন আমাদের ঘরের নানা আলোচনায় আসতো ঘুরেফিরে। আমার বোন মাঝে মাঝেই আমার দিকে তাকিয়ে বা তার বন্ধুদের দিকে অর্থপূর্ণ হাসির ছুড়ে দিয়ে বলে উঠতো, ‘পানি খাম!’
আমি তখন সেখান থেকে কোনো উপায়ে পালাতাম।
সেদিন তিনজনই নগ্ন পায়ে থাকলেও লাইলির চোখে কাজল ছিলো। ছিলো লিপস্টিকে রাঙানো দু ঠোঁট। এমন কি কপালে ছিলো একটি লাল টিপও। যা তাদের তিনজনের মাঝে তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছিলো।
বেশ ভালো বুদ্ধি বের করেছে দেখি! মনে মনে ভাবি। কিন্তু মা ঠিকই টের পেয়েছেন যে, আমি আসতে বলেছি বলেই ‘সখিগণের আগমন।‘ তাদের ঘরে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে মাকে বলি, ‘তিনডা মাইয়া আইসে! পানি খাইবো!’
মা হাসতে হাসতে বলেন, ‘এত বড় গ্যারামডার কোনো বাইত পানি পাইলো না?
ওরা ঘরে আসতেই মা বলে উঠলেন, তরা কোন গ্যারামের?
তারা গ্রামের নাম বলতেই মা বললেন, কোন বাড়ি? কাগো মাইয়া? এত দূর আওন লাগলো পানি খাওনের লাইগ্যা?
এর মাঝে মাহমুদা বলে উঠলো, আমার আব্বায় ইস্কুলের কেরানি!
মা চিনতে পারলেন। সে সঙ্গে বাকি দুজনের বাবাকেও চিনতে পারলেন। যাই হোক পানি পানের উদ্দেশ্যে এলেও কাউকে কেবল পানিই এগিয়ে দেওয়ার চল গ্রামাঞ্চলে নেই। অন্তত সে সময়ে আমি দেখিনি। মা তাদের শুকনো খাবার জাতীয় কিছু দিয়েছিলেন। সেখানে আমার জায়গা হয়নি বলে আর জানা হয়নি খাবারটা কী ছিলো।
পরে তাদের বাড়ি গেলে আমাকে চানাচুর খেতে দিয়ে তিন সখির ভেতর সর্দারনী বলেছিলো, আমরা যা খাইসিলাম, তাই দিলাম!
কথা শুনে বুঝতে পারি যে, সেদিন মা তাদের চানাচুর খেতে দিয়েছিলেন। যা তাদের কাম্য ছিলো না হয়তো। আমাকে চানাচুর খেতে দিয়ে তারা তিনজনই খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। বাইরে থেকে আরেকটি মেয়েকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে লাইলিকে বলি, ‘হেই মাইয়াডারে আমগো গ্যারামো দেখছি!
সে জানালো, এইডার নাম খুকি। তোমগো গ্যারামোই তার নানার বাড়ি।
তারপর কথার ফাঁকে খোঁজ নিতে নিতে জানি, মেয়েটিও লাইলির চাচাতো বোন। লেখাপড়া বেশি করেনি। কিছুদিন স্কুলে গিয়ে আর যায় না।
খুকির মামারাও কোনোভাবে আমার আর লাইলির ব্যাপারটা জেনে গেলে, দেখা হলে আমাকে জামাই বলে ডাকতো। কিন্তু স্কুল ছেড়ে কলেজে পদার্পণ করার পর আমাদের প্রেমেও কেমন জানি ভাটা পড়তে থাকে। তখনই টের পেতে থাকি চোখের আড়াল মানে মনের আড়াল। লাইলি সিক্সে উঠে গেলেও আমার সঙ্গে আর তেমন যোগাযোগ হতো না। একদিন কলেজে যাওয়ার সময় দেখতে পাই খুকি তার মামার বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। এ ভাবেই মাঝে মাঝে তাকে দেখতে পেতাম। কিন্তু কথা হতো না, তারপর বেশ কিছুদিন পর শুনতে পাই খুকির বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে হয়ে গেছে লাইলিরও। লাইলির বিয়ের সংবাদ জেনেও কেন যেন আমার একটুও খারাপ লাগেনি। হয়তো প্রেম বা ভালোবাসা ব্যাপারটা আমাদের দুজনের কাউকেই ততটা গ্রাস করতে পারেনি।
আমি তখন আরো উঁচু ক্লাসে পড়তে ঢাকা চলে গেছি। ছুটি ছাটায় বাড়ি আসি। মাঝে মাঝে দেখা হয় খুকির সঙ্গে। অপুষ্ট শরীর। তার চেয়েও আরো অপুষ্ট একটি শিশু তার কোলে। আমি ইচ্ছে করলে তাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি। হয়তো সেও ভালো মনেই জবাব দেবে। কিন্তু শুরু থেকেই কেন যেন তার প্রতি কোনো আগ্রহ বোধ করতাম না। প্রথম প্রথম লাইলির দূতিয়ালি করতো। লাইলির নাম দিয়ে অনেক কথা বলতো। পরে লাইলির কাছ থেকে জানা যেতো তেমন কোনো কথা হয়নি খুকির সঙ্গে। সেই মিথ্যাচার বা আগ বাড়িয়ে আমার সঙ্গে আলাপের কারণেই হয়তো তার সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়ে গিয়ে থাকবে। কিন্তু তারপরও জীবন সংগ্রামে আমি যখন খুব ব্যস্ত, স্ত্রী-সন্তান আর নিজের অন্ন-বস্ত্রের যোগাড়-যন্ত্রের পেছনে ব্যয় হয়ে যায় দিন-রাতের অনেকটা সময়। মায়ের মুখটা একটিবার দেখতে, মায়ের স্নিগ্ধ কণ্ঠস্বর একটিবার শুনতে স্ত্রী-সন্তানের বন্ধন আলগা করে মাসে দু মাসে ছুটে আসতাম গ্রামের বাড়ি, তখনও খুকির সঙ্গে দেখা হতো।
সে তখন পান খাওয়া শিখেছে। কিন্তু তার পান চিবানোর ধরন আর কেমন কেমন দৃষ্টিতে তাকানোর ভঙ্গী আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় কলেজ জীবনের আসা-যাওয়ার পথে। জগন্নাথ কলেজে যাওয়ার সময় ইংলিশ রোড পাড়ি দিয়ে সপ্তাহের ছ’দিন ক্লাস করতে যেতাম। একই পথে ফিরে আসতাম মেসে বা বাসায়। সে সময় রাস্তার পাশে কোনো ছোট্ট গলিতে বা কোনো বাড়ির সামান্য ফাঁক করে রাখা দরজায় আর স্টিল-রড, প্লেনশিটের দোকানগুলোর আড়ালের পতিতা পল্লীর সামনে মুখে বিচিত্র প্রসাধন আঁকা পেটিকোট-ব্লাউজ পরা বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের দেখতাম। তাদের কারো কারো চাহনি এবং পান চিবানোর ভঙ্গী ঠিক একই রকম ছিলো দেখতে। যেমনটা ফুটে উঠতে দেখা যায় খুকির মাঝে। আমার মনে হালকা কুয়াশার পর্দার মত একটি প্রশ্ন উঠেই ফের যেন মিলিয়ে যায় মৌসুমি হাওয়ার তোড়ে। খুকির ভাবনা খুব বেশিক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখতে পারে না আমাকে।
জীবনের ঘূর্ণিপাকে বা সময়ের পরিক্রমায় লাইলি অথবা খুকির প্রসঙ্গ আমার ভাবনা থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছিলো। দীর্ঘকাল পর ফের খুকির নামটি নতুন করে শুনে বিস্মিত না হয়ে পারি না। সেই সঙ্গে খুকির সামাজিক অবস্থানের ক্রমবিবর্তনের দিকটাও যেন এতকাল পর আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় একটি ঘটনার ভেতর দিয়ে। শুনতে পাই দুবাই প্রবাসী আক্কাসের বউ ফুলমতি প্রেম করছে মসজিদের তারাবির ইমাম সোলমান মুন্সির সঙ্গে। তার সুটকেসে অনেকগুলো চিঠি পাওয়া গেছে। এ নিয়ে বেশ থমথমে একটি পরিবেশ বিরাজ করছিলো তাদের বাড়িতে। দুজনের নামে শরিয়তের বিচার হবে এমন কানাঘুষাও শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার জানা নেই শরিয়তে প্রেমপত্রের ব্যাপারে কোনো বিধান আছে কি না বা থাকলে তার জন্য অপরাধীকে লঘু নাকি গুরুদণ্ড পেতে হবে তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দুর্ভাবনায় ছিলাম।
আমার সঙ্গে আক্কাসের বেশ খাতির ছিলো এক সময়। তাদের বিয়েতেও গিয়েছিলাম। তেমনই একটা সংকটে ফুলমতি আমাকে ধরলো একটা উপায় বের করার জন্য। সন্ধ্যা হয় হয়। আমিও ঢাকা ফেরার জন্য মায়ের পায়ে চুমু খেয়ে মাত্র উঠে দাঁড়িয়েছি বিদায় নেওয়ার জন্য। সেই মুহূর্তে ফুলমতি আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে জানালো তার বিপদের কথা।
মায়ের কান বাঁচিয়ে জিজ্ঞেস করি, চিঠিতে কী লেখছিলা?
আমি কি জানি? নাক টেনে ফুলমতি জানিয়েছিলো, চিডি লেখছে জোলাগো বাড়ির খুকি।
আমি অবাক না হয়ে পারি না। এখানেও খুকি? আর তখনই আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, দীর্ঘকাল আগে লাইলির পক্ষে এই খুকিই প্রক্সি দিতো বলেই হয়তো তার প্রকৃত মনের নাগাল পাইনি বা লাইলি বুঝতে পারেনি আমার মনের আকুতি।
জুন ২৫, ২০১১।
6 Responses to প্রক্সি অথবা প্রেমপত্র
You must be logged in to post a comment Login