ভালবাসার গল্প: এক নিস্তব্ধ ভালবাসা
অনবরত মুঠোফোনটা বেজেই চলেছে, দৃষ্টি আকর্ষণের বৃথা প্রচেষ্টা। একজন দুজন নয়। বহু মানুষ স্মরণ করছে ওকে। শুভেচ্ছা বার্তা ও পেয়েছে, নিছক কম নয় তার পরিমাণ ও। আজ ঈদ এর দিন। কোন ভ্রূক্ষেপ ই নেই ওর। সকালে ঈদ এর নামাযটায় ও অনুপস্থিতি। গায়ে দেয়া হয়নি প্রিয় মানুষটির দেয়া নীল পাঞ্জাবীটি। ঘুমহীন টলটলে দুটো চোখ, অনিয়মে বেড়ে ওঠা মাথা ভরা উস্কখুস্ক অগোছালো চুল আর নিথর দেহটা দেয়ালে ঠেকিয়ে দৃষ্টি মেলে আছে জানালা গলে বাহিরে। রোদেলা আকাশে মেঘ জমেছে, মেঘের আড়াল দিয়ে সূর্যের উজ্জ্বলতা জাহিরের তীব্র প্রচেষ্টা দেখতে খারাপ লাগছেনা আজ।
এক দুবার হয়তো চোখের পাতা ফেলেছিল, এর ই মাঝে এক পসলা বৃষ্টি যে কখন ঝরে পড়ল সেই সময়টি ও দেখা হয়নি আজ। মেঘরাজ বিদায় নিয়েছে, সূর্যের আলোতে জলে ভেজা নারিকেলের পাতাগুলোতে কে যেন মুক্ত গেঁথে রেখেছে। হঠাৎ করেই কোত্থেকে জানি এক বৃষ্টিভেজা শালিক এসে বসলো পাতার উপর আর শুরু করলো জল ঝারবার কসরত। এক শালিক দেখে আজ ও একটু ও বিচলিত নয়। কিভাবে হবে! একা একা তো ঝগড়া হয়না।
সম্বিত ফিরে পেল রুদ্র ছোট ভাইটার করা অনাকাঙ্ক্ষিত এক প্রশ্নে। ও যে কখন ঘরে ঢুকেছে খেয়াল ই করেনি। “ভাইয়া, তুমি কি গোঁফ দাঁড়ি করছ?” সহজ সরল প্রশ্নটা শুনে এক গাল হাসল রুদ্র। পাশের কক্ষ থেকে মা শুধরে দিল, “গাধা। গোঁফ দাঁড়ি করতে হয়না, রাখতে হয়।” হয়তো নিজের অজ্ঞতার লজ্জায় ছোট মানুষটা আর দাড়ালোনা ঘরে, অন্য ঘরে চলে গেল।
রুদ্রর হাতে আজ অনেক সময়। আজকের দিনটার কোন প্রভাব নেই ওর মনে। নেই কোন পরিকল্পনা। জীবনের নিদারুণ বিড়ম্বনায় আজ অনেক বেশি আহত সে। দেয়ালে ঝুলানো যান্ত্রিক পাখাটার দিকে তাকিয়ে সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দেয় কিন্তু যদি জিজ্ঞাসা করা হয় পাখাটা কোনদিকে ঘুরছে, হয়তো বলবে, “কই! খেয়াল করিনি তো!” আজ রুদ্র বড্ড এলোমেলো। ওর জীবন বধ করা হয়েছে, মনের মানুষটা তার কাছে শুনতে চায়না আর ভালবাসার গল্প।
ঈদ এর বিকেল। সবাই বেরিয়েছে ঘুরতে। হ্যাঁ। সবাই। শূন্য দৃষ্টি মেলে সামনে চেয়ে আছে রুদ্র। সূর্যের হলদেটে আভা চারিদিকে ছড়িয়ে আছে। আবার শুরু হল বৃষ্টি, ক্ষণিকের জন্য। রুদ্রর মনে পরে গেল সেই দিনটির কথা, যেদিন এই বর্ষার প্রথম কদম ফুলটি তার হাতে তুলে দেয়ার ভূত ঘাড়ে চেপেছিল।
নাহ… কোন ফুলের দোকান ঘুরে ফুল পাওয়া যায়নি। রাজপথে ফুল হাতে ছুটে আসা ক্ষুদ্র বিক্রেতাও ফুল এর সন্ধান দিতে পারেনি। সারা সকাল দুপুর বহু এলাকা ঘুরেছে, কদম ফুলগাছও পেয়েছে কিন্তু একটা ফোঁটা ফুলও যে পাইনি। গোল গোল সবুজ ফুলগুলো যেন ওর দিকে চেয়ে রসিকতা করেই দুলছিল। অবশেষে পথ চলতে চলতেই দেখল এক পথশিশু কদমফুল ছিড়ে ছিড়ে পথে ফেলছে। হুড়মুড় করে রিকশা থেকে নেমে ছুটে গেলো ছেলেটার কাছে। বাচ্চাটার হাতে দেখল মাত্র একটা আধা ছেড়া ফুল। জিজ্ঞাসা করলো ফুলগাছ কোথায়। প্রত্তুতরে ছেলেটা জানাল, “ভাই। ফুল তো জালায় নাই।” মানে, ফুল তো ফোটে নাই। আশা হারালোনা। ছেলেটাকে সাথে নিয়েই খুঁজে বের করলো কদম ফুলগাছ। প্রস্ফুটিত কিছু ফুল দেখে খুব খুশি হল রুদ্র।
এরপর শুরু হল আরেক পরীক্ষা। গাছে উঠতে পারেনা রুদ্র। আশেপাশে তেমন কাউ কে পেলনা। কিন্তু ফুল তো যেভাবেই হোক লাগবেই। বহু কসরত করে কিছুদূর উঠল। এরপর একটা লাঠি আর ওর মাঝারিকার দেহটা কাজে লাগিয়ে বহু ভঙ্গিমায় কিছু ফুল পাড়ল। ফুলগুলো একত্র করে শুরু করলো আবার পথচলা। সারাটা দিন খাঁ খাঁ রোদ ছিল। তৃষ্ণা পেয়েছে টের পেল। দু বোতল পানি কিনল। একটা নিজে পান করলো আরেকটা থেকে মাঝে মাঝেই ঠাণ্ডা পানি ঢালল ফুলের ওপর। পাছে ভয় হয়, এই গরমে ফুলগুলো যদি মিইয়ে যায়। একটা বার ও হাত থেকে কোথাও রাখলনা কারণ চোট পেলে ফুলের পাপড়ি গুলো বসে যেতে পারে।
এভাবেই পৌঁছল গন্তব্যে। তখন সন্ধ্যা। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা কিভাবে দিবে ফুলগুলো ওর হাতে। ততক্ষণে ফুলগুলো মিইয়ে গেছে। আর দেরি না করে মন মানুষটিকে ডাক দিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল ফুলগুলো। কিভাবে দিতে হয় রুদ্র জানতোনা। অপরিণত মস্তিষ্কের পাগলামির এই অঘোষিত প্রচেষ্টা পরিণতি পেল। মনের মানুষটার মুখে এক ঝলক হাসির দেখা সে পেল। মানুষটি বলল, “আমার জন্য কেউ কখনো এমন করেনি।” রুদ্রর মনে হল, এতটুকুই তো সব, আর কিছু চাইনা জীবনে। সারাদিনের অভিযানের পর এক সুখী মানুষের তৃপ্ত হৃদয় নিয়ে রুদ্র ঘরে ফিরল।
রুদ্র আজ নিশ্চুপ। দুনিয়ার গড়া তথাকথিত সমীকরণে ওকে ফেলা হয়েছে আজ। আর দশটা হীনচেতা মানুষের সারিতে ওকে দাড় করানো হয়েছে আজ। অপরাধ টা কি? রুদ্র জানেনা। হয়তো ওর পাগলের মত অস্বাভাবিক ভালবাসা আজ মানুষের কাছে দৃষ্টিকটু। হয়তো ওকে আজ বিশ্বাস করতে পারেনা মানুষটি। রুদ্র জানেনা কিভাবে প্রমাণ দিবে। এইত গতদিন ও রুদ্র নিকষ আঁধার দেখে ফিরেছে, একটুও দ্বিধা করেনি এইভেবে যে মানুষটা হয়তো সুখে থাকবে ও সরে গেলে। এর থেকে বেশি কিছু রুদ্রর জানা ছিলোনা।
দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। দূরের দৃশ্যপট গুলো আর দেখা যাচ্ছেনা। রুদ্র বুঝল সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এর ই মাঝে মা কয়েকবার এসে খেতে বলে গেছে। লাভ হয়নি। জোর করে কিছু খাইয়ে দিয়েছে, রুদ্র টের পায়নি। এখন মুখটা মিষ্টি লাগছে, হয়তো পায়েস ছিল জিনিসটা।
এখন রাত। ঈদ এর দিনটি প্রায় শেষ। গানের গলা ভালোনা রুদ্রর। মনের মানুষটিকে তাই গান শোনাতে পারেনা সে। কিন্তু এখন সে গাইছে, ভয় কি! কেউ তো আর শুনবেনা। গলা ছেড়ে গান গাইছে রুদ্র। চোখের জল গাল গড়িয়ে পরছে। কাঁপা কাঁপা ভাঙ্গা গলায় তারপরেও সে গাইছে।
বহু নামে ডাকতো রুদ্র তার মনের মানুষটিকে। বহু নামে। সব গুনলে হয়তো কয়েক ডজন হবে। আজ ডাকতে পারেনা। ওর উপর আজ মনঃমানুষটির নিষেধাজ্ঞা আরোপিত। রুদ্রর খুব কষ্ট হয়। নীল বেদনায় ছটফট করে বিছানায়। আজ ওকে দেখবার কেউ নেই। রুদ্র আজ অনেক একা। ওর চারপাশের জীবনগুলো আপন গতিতেই চলছে, ওকে নিয়ে কোন পরিকল্পনা হবেনা, ওর জন্য কেউ সাজবেনা, সামনে দাড়িয়ে বলবেনা, “দেখো তো আমায় কেমন লাগছে!”, এভাবেই চলতে থাকবে সবকটি মানুষের পৃথিবী। থেমে থাকবে রুদ্রর মতো কিছু মানুষের জীবন। হয়তো সে একটু আলাদা, হয়তো মানুষ না। আজ ও নিজেকে বড্ড ভয় পায়, যেমন টা আগে ছিলোনা।
===== ঈদ এর আগের দিন =====
পিটপিট করে চোখ মেলে নিজেকে খুঁজে পায় রুদ্র হাসপাতালের ICU এ। বিরক্তি ভরা চোখে চারদিক দেখতে থাকে। তার তো এখানে থাকার কথা না। তাহলে কি কোথাও গড়মিল হল!!! লজ্জায় মুষড়ে পড়ে রুদ্র। এত ছোট কাজটাও সে ঠিকমত করতে পারলনা। তার মা সময়মতই তাকে ধরে এখানে এনেছেন। এক নিদারুণ লজ্জা আর ঘৃণা অনুভব করলো নিজের প্রতি।
=====================
ঈদ এর দিনরাত উভয়ই পরিসমাপ্তির পথে। রুদ্র এখনো ভালবাসে তার মনের মানুষটিকে, হয়তো আগের থেকে আরও বেশি। কিন্তু আজ ও বলতে পারেনা, নাম ধরে ডাকতে পারেনা, আগের মত করে হাসতে পারেনা। একটা আশা নিয়ে এখনো বেঁচে আছে সে। হয়তো ওর মানুষটি একদিন বুঝবে ওকে, তারপর ওকে শেখাবে কিভাবে হাসতে হয়, কিভাবে ভালবাসতে হয়।
রাত খুব বেশি না। তাতে কি! রুদ্র এখন ঘুমাবে…
======================
অগোছালো লাগছে ঘটনাগুলো! আসলে গল্প আর মানুষের জীবনের মাঝে এই একটাই তফাৎ, জীবনে সবকিছু গল্পের মত সুন্দর করে সুবিন্যস্ত ভাবে ঘটেনা। এক রুদ্রের এক জীবনের এক টুকরো বাস্তবতা এখানে। আপনাকে যদি শিহরিত না করে, না হাসায়, না কাঁদায় তাতে রুদ্রর জীবনের কিছু যায় আসবেনা। যদি ওর জীবন থেকে আপনি ভালবাসা শিখতে পারেন, এটাই হবে ওর এলোমেলো জীবনের সার্থকতা।
(সংগৃহীত)
You must be logged in to post a comment Login