মুভি রিভিউ: ভূতের নাইটি এবং রস-রসিকতা
বাংলা ছায়াছবিতে ইদানিং কাতারে কাতারে ভূতেরা তো বটেই, এমনকি তাদের নাইটিও হানা দিচ্ছে- কী অদ্ভুতুড়ে কান্ড রে বাবা! অবিশ্যি, শুধু টলিপাড়া কেন, সাগরপারের বলিপাড়ারও আনাচ-কানাচ থেকে মুখ দেখাচ্ছে ভূতেরা। সেখানে সব কিছু পাওয়ার জন্য ভূতের সঙ্গে শুয়ে পড়ছে নায়িকা, জাঁদরেল বেশ্যার ঘাঘু ভূত অশান্তি বাধিয়ে দিচ্ছে দুঁদে পুলিশের সংসারে! হচ্ছেটা কী এসব?
এসবই আদতে প্রযুক্তির উন্নতিমাত্র। একটা লম্বা সময় ধরে ভূতেদের কাছে টেকনোলজি বলতে জানা ছিল ছাপাখানার আঁধার কোণ, সেখানেই ডেরা বেঁধে ছাপার অক্ষর আর প্রেস মালিককে হয়রান করত তারা। এখন দিনকাল অনেক ঝকঝকে, মানুষের বই পড়ার অভ্যেসও কম; তাই কি তারা সরে এসেছে সিনেমার দিকে? তাও বোধহয় নয়।
ছায়াছবিতেও অনেক দিন ধরেই আনাগোনা করছে তেনারা, তফাতের মধ্যে রক্ত চুষে খাওয়া, ঘাড় মটকে দেওয়া- এসব সেকেলে রঙতামাশা ছেড়ে তারা ঝুঁকেছে বিশুদ্ধ রসিকতার দিকে। সভ্য মানুষের একটা বড় পরিচয় তার রসবোধ, ভূতেরাও সেই পথে কিছুটা সভ্যভব্য হয়েছে আর কী!
এখন হিসেবের খাতায় চোখ রাখলে মালুম হচ্ছে, ভূতের ছবির মরা গাঙে বান ডেকেছে সেই গত বছর থেকেই। বাংলা ছবির খতিয়ান ধরলে এব্যাপারে অনীক দত্ত-র ভূতের ছবির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দাবিদার। ভূতেদের কথা শুনে তাঁদের গল্প ক্যামেরাবন্দী করার পর থেকেই পরিচালক পেয়েছেন বক্স অফিসে হিটের সোনার কাঠির সন্ধান; বাকিদের অনেকেও দেখাদেখি হামলে পড়েছেন সেই পথেই।
কেন না, অনীক দত্তর ছবিটা ভূতেদের ফিরে ফিরে দেখার ভবিষ্যৎ বাসনাটা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। এই নিয়ে গত বছরেই যখন পিয়ালী ফিল্মস-এর কর্ণধার অরিজিৎ দত্ত-র সঙ্গে কথা হয়েছিল, তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, সেই সময়ে এই ছবিটার ব্যবসায়িক সাফল্য বেশ ভাল। অরিজিৎ এও বলেছিলেন, সেই বছরে ভূতেদের জুতসই প্রতিদ্বন্দ্বী বলতে ছিল খোদ সত্যাণ্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী, কিন্তু ভূতেরা জনপ্রিয়তায় ছাপিয়ে গেছে তাকেও। স্বাভাবিক, ব্যোমকেশ সামান্য মানুষ মাত্র, ভূতেদের সঙ্গে কীভাবেই বা পাল্লা দেবে সে! ফলে, পরিসংখ্যান বলছে, সেই বছরে ব্যোমকেশ যতদিন হলে চলেছিল, তার থেকেও বেশি হল দখল করে রেখেছিল চৌধুরি প্যালেসের ভূতেরা।
তাহলে আর পরিচালক-প্রযোজকদের দোষ কী! তাঁরা তো চাইবেনই নিশ্চিত ব্যবসার প্রতিশ্রুতি। আর ছায়াছবির হালফিলের ট্রেন্ড বলছে, সে প্রতিশ্রুতি একমাত্র পূরণ করছে ভূতেরাই। মানুষে কথা না রাখলেও তারা রাখে; অন্যান্য বদ-অভ্যেস থাকলেও এইটি তাদের নেই। হাতেনাতে প্রমাণও মিলল তার, বছর শেষের মুখে ফের হলে ভিড় টেনে আনল সন্দীপ রায়-এর পরিচালনায় একঝাঁক সাহিত্যের ভূত। তারপর চলতি বছরে হরনাথ চক্রবর্তীও সাফল্য পেলেন ছায়াময়কে ধরে; ছবি নিয়ে সমালোচকরা যাই বলুন না কেন, ভূতের জন্যই সুড়সুড় করে ছবি তৈরির টাকা ঘরে তুলে দিল ছায়াময়। সে পর্ব শেষ হতে না হতেই বাংলা ছবির রুপোলি পর্দায় আসতে চলেছে এক গয়না-বাতিকগ্রস্ত ভূতের গপ্পো।
অবশ্য ভেবে দেখলে, গয়নার প্রতি ভূতেদের টান নতুন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই যে ‘মণিহারা’ গল্পে লিখে গিয়েছিলেন ভূত হয়েও মণিমালিকার হাড়সর্বস্ব শরীরে গয়না পরার শখের কথা; সেটাকেই ইউএসপি করে একদা বাজার মাতিয়েছিলেন খোদ সত্যজিৎ রায়-এর মতো পরিচালক। অস্বাভাবিক কী, ভূতেরা তাঁকে বরাবরই কৃপা করেছে; গুগাবাবা সিরিজের কথা মাথায় না রাখলে ভূতেদের অসম্মান করা হবে। সেখানেও গুপি-বাঘার যা কিছু কেরামতি, সবই তো ভূতের রাজার দয়ায়! সেই ভূতের গয়না খিদেকেই আর দিন কয়েকের মধ্যেই পর্দায় আনছেন অপর্ণা সেন তাঁর ‘গয়নার বাক্স’ ছবিতে। ইতিমধ্যেই ছবিটা নিয়ে আলোচনায় বাজার সরগরম, নিশ্চিত ব্যবসার কথা আর না বললেও চলে!
তা বলে নাইটি? ভূতে যখন গয়না পড়তে পারে, তখন আর নাইটিতে দোষ কী! সেরকমই একটা অভিশপ্ত নাইটির গল্প ফ্রেমবন্দী করতে চলেছেন আরেক পরিচালক বিরসা দাশগুপ্ত। তাঁর ছবিতে না-পাওয়া প্রেমকে খুঁজে ফিরবে খুন হয়ে যাওয়া অতৃপ্ত এক ক্রুনারের শখের গোলাপি নাইটি। খুঁটিয়ে দেখলে, এতগুলো ছবির মধ্যে বিরসার ছবিতেই আসছে ভূতের সঙ্গে যৌনতার প্রসঙ্গ; আর তা অস্বাভাবিকও নয়। ভূতের গল্পের মোদ্দা কথাই তো গা-শিরশিরানি; তা যেমন ভয়ের ভাগে কিছুটা পড়ে, তেমনই পড়ে যৌনতার খাতেও। বিশ্বখ্যাত অনেক ভূতের গল্পই পাশাপাশি যৌনতাকে রেখে এগিয়েছে। এই যেমন, ব্রাম স্ট্রোকার-এর ড্রাকুলা! স্ট্রোকার আর ইতিহাস দুইই ধরলে ড্রাকুলা রক্তপিপাসু হয়েছে অনেকটা যৌনসঙ্গিনী হত্যার পরেই, তারপরেই তার সব বিশ্বাস উবে গিয়েছে ঈশ্বরের উপর থেকে। মজার কথা, বাংলা ভুতুড়ে ছবিতে যৌনতা এত সামান্য পরিমাণে মিললেও বলিউডের ছবিতে তা কিন্তু অমিল নয়। বলিউড বরাবরই সমানতালে এগিয়েছে ভূতের যৌন খিদেকে সম্বল করে!
আর এর উদাহরণও নেহাত কম নয়। ফিরে যাওয়া যাক গত বছরেই। তখন বলিউড থেকে বাজার-কাঁপানো ভূতের ছবিগুলো কী? ‘রাজ ৩’-র কথাই ধরা যাক। সেই ছবিতে নায়িকা প্রতিদ্বন্দ্বীকে জব্দ করার জন্য কিচ্ছুটি না ভেবেচিন্তে শুয়ে পড়েছে ভূতের সঙ্গে; এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা তার খারাপও লাগেনি। অন্যদিকে রয়েছে রিমা কাগতির তলাশ; সেখানে তো বেশ্যার ভূত পুলিশের মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে প্রেমে ফেলেছে এবং যেভাবে শরীরের বিনিময়ে পার্থিব উন্নতি সম্ভব- সেই পথেই বদলা নিয়েছে তার খুনের! এমনকি গত বছরে বলিপাড়ার ছবিতে মোবাইল-এর সিমেও ডেরা বেঁধেছে ভূত! তবে ব্যাপারটা এখানেই থেমে যায়নি। সেই ছবিদুটোর পরে পরেই এবছরে পাল্লা দিয়ে মুক্তি পেয়েছে রামগোপাল ভার্মার ইতিপূর্বে বিখ্যাত ছবি ‘ভূত’-এর থ্রিডি ভার্সান; এর পেছনে থ্রিডি রাজ ৩-এর ভূমিকা অনেকটাই। এমনকি ভূতের চাহিদায় ‘মার্ডার ৩’ ছবিটাও থ্রিলার থেকে সরে এসে কিছুটা সম্বল করেছে ভৌতিক ব্যাপার-স্যাপার; সেখানেও ভূত আর যৌনতা হাত ধরে হেঁটেছে পাশাপাশি!
এই বছরটাও তার ব্যতিক্রম নয়। আর দিন কয়েকের মধ্যেই মুক্তি পেতে চলেছে ‘এক থি ডায়েন’; ভূতের বদলে এই ছবির ইউএসপি ডাকিনীবিদ্যা; তবে মুখ্য আকর্ষণ ওই ভৌতিক গা-শিরশিরানি আর ভূত-মানুষের যৌন টান। ঠিক এই যুক্তি ধরে তৈরি হচ্ছে ‘রাগিণী এমএমএস ২’ ছবি। প্রথমটায় যেমন ফাঁকা বাড়িতে শরীরখেলার রাত কাটাতে গিয়ে ভূতের খপ্পরে পড়েছিল নায়িকা; এবারেও তার বদল ঘটছে না। হ্যাঁ, অভিনেত্রীর বদল অবশ্য হয়েছে। এবারে রাগিণীকান্ডে ফাঁসতে চলেছেন দুনিয়া কাঁপানো যৌন প্রতিমা সানি লিওন; যুক্তির স্বপক্ষে বিশদে আর কীই বা বলার আছে?
অবশ্য একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। ভূত আর যৌনতার এই সমীকরণ ব্যবসা দিচ্ছে ঠিকই; তবে তার চেয়েও এগিয়ে রয়েছে যৌনতাবিহীন ভূতের গপ্পোই। এব্যাপারে ফের তাকাতে হচ্ছে সেই বাংলা ছবির দিকেই। বিশেষ করে অনীক দত্তর ছবিটার দিকে। তাঁর ছবিটার একটা রিমেক এবার বানাতে চলেছে যে বলিউড; সেটার নাম দেওয়া হয়েছে গ্যাং অফ ঘোস্টস। ভুতুড়ে কান্ড; সন্দেহ নেই। অনেক আগে, বাংলা ছবির সোনার যুগে বলিউড টুকত বটে বাঙালির চিন্তাভাবনা; গ্যাং অফ ঘোস্টস দিয়ে যেন শুরু হল সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তবে এও সত্যি, সৌজন্য সূত্র ওই ভূতেরাই। আশ্চর্য কী, একসময় বলিউড কাঁপিয়েছিল ওই বাঙালি মাথা থেকে বেরনো ভুতুড়ে ছবি মধুমতী, যার পরিচালনায় বিমল রায়, সঙ্গীতে সলিল চৌধুরি, চিত্রনাট্যে খোদ ঋত্বিক ঘটক! সেই ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য বলিউডে যেমন সাড়া ফেলেছিল ভূত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষায়, অনীক দত্তর ছবিও এখন সেই দিক থেকেই এগিয়ে রাখছে ভূতেদের।
কেন না, ভূতের ছবিতে একটা হালফিলের জনচাহিদার কথা না বললেই নয়। ভূতের ছবিতে ভয় থাকলে ক্ষতি নেই, যৌনতা না রইলেও নো পরোয়া, কিন্তু হাস্যরসটাকে বাদ দিলে চলবে না! সারা ভারত জুড়েই এখন ছায়াছবির চিত্রনাট্য হিউমারনির্ভর হচ্ছে, নানান দিক থেকে ভেবেচিন্তে জীবনের সঙ্গে সমান্তরাল স্রোতে বয়ে চলা হাসির ছোঁওয়া আসছে চিত্রনাট্যে। মানুষ ছায়াছবি দেখে বেশি ভাবতে চাক বা না চাক, আনন্দ পেতে চাইছে ভরপুর। সেই আনন্দ যদি তৈরি হয় ভূত আর নির্মল হাসির খোরাকে; তখন সেই পথে এগোলে ক্ষতি কি!
অনির্বাণ চৌধুরী
You must be logged in to post a comment Login