আহমেদ মাহির

শুকনো পাতার পথ ধরে

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

১।।

রাতজাগা পাখিটা মাঝে মাঝেই জানালায় এসে উঁকি দেয়
শোনায় হারানো কবিতাগুলো ; সেই বসন্তের আগেই
ঝড়ে যাওয়া কবিতাটা , বৈশাখে কথা নেই বার্তা নেই
হুট করে মুখ থুবরে পড়া গাছের মতন কবিতাটা এমনকি
দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের মাঝে যে কবিতাটি
ক্লান্ত বেশে ঘুমিয়ে পড়েছিল – সে কবিতাটিও শোনায়
রাতজাগা ওই পাখিটা ।

জোনাকির মতন জ্বলন্ত সিগারেট আর ঘরময় কুয়াশার মতন
ধোয়ার মাখামাখি খেলা – তৃষ্ণার্তের মতন আজও চেয়ে আছি,
সেই রাতজাগা পাখিটা ঠিক ফিরে আসবে কোনোদিন আবার ।

২।।

অতঃপর হাসপাতালের কামরা ছেড়ে
গৃহস্থালি ব্যস্ততাময় গৃহের পশ্চিম কোনের কামরা ,
শত ব্যস্ততা এ কোনে ও কোনে
তবু সে হৃদয় স্তব্ধতায় ঠাসা ।

হাত-পা-মাথা জুড়ে কত কত সঞ্জামের ছড়াছড়ি –
ওসবে নাকি জীবন দেবে
চালিয়ে নেবে শ্বাস আর ধুকপুক আরও কিছু কাল,
তবু চারপাশে শুধু ফিসফিস আর দুঃস্বপ্নের কানাঘুষা ।

বড় আদরের একমাত্র ছেলেবউ তার শিয়রেতে বসা
তার ফিনফিনে পাতলা সফেদ চুলে
ছেলে বউয়ের হাত অলসভাবে চলে –
রাত জেগে থাকা ক্লান্ত চোখে জলের রেখা হামেশা ।

জীবনের নেশা পূর্ণতা পেয়েছে তার
চোখের তারা থেকে মিটেছে হাহাকার
তৃপ্ত চোখ অলস বেগে দেখে স্মৃতিদের খেলা
নিস্তব্ধ স্বরে হুটোপুটি করে চারটি দেয়াল ঘেসে ।

৩।।

হৃদয়, অনেক তো হল , এবারে ছুটি দে
তোর দাসত্ব করে করে অনিকেত প্রান্তরে !
তুই যে হাহাকারে সুর বুনিস ,
তা খুবলে খায় আমায় অবিরত ।
হৃদয়, কেন অবুঝ তুই ?
অনেক তো হল , এবারে ছুটি দে
তোর আহবানে চেনা সবুজ ছেড়েছি
মানিয়ে নিয়েছি চোখের প্রান্তরে ধু ধু বালুরেখা ;
হৃদয়, অনেক তো হল , এবারে ছুটি দে ।

৪।।

চাঁদটির আজ হেসে গল্পে মাতার কথা ছিল ,
হল না ; এক থাল গাম্ভীর্য নিয়ে থমথমে সে
হাতঘড়ির টিকটিক শব্দটিও আজ বড় প্রকট
স্বরে বেজে চলেছে । হাসপাতালের কোনে
বেঞ্চিতে কনিষ্ঠা থেমে থেমেই গুনগুন স্বরে
বিলাপ বকে যায় । সে সুর কানে আসে ,
আবার হারিয়ে যায় মৃদু বাতাসের সাথে ।

সে আজ আর নেই । উনুনঘরের উষ্ণতায়
কেটেছে যে জীবন , তা বুঝি পূর্ণতা পেল
হিমাঙ্কের দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস বিয়োজনে !

৫।।

এরপরে একরাশ ধুলোর ঝড় তুলে ফিরে যাওয়া !
দিগন্তরেখা মুছে গিয়ে জলপ্রপাতে রূপ নেয় আর
ছাপোষা গেরস্থালী থমকে দাঁড়ায় উদাস চোখের তারায় ।
ফিরে যাবার রেখায় ইচ্ছেরা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে
কানাগলির মোড়ের নিভু নিভু করে জ্বলে থাকা ল্যাম্বপোস্টের মতন
আর স্বপ্নেরা যাযাবর পাখির মতন এর মাঝে তার মাঝে হারিয়ে যায় ।
ফিরে যাবার রেখায় শব্দেরাও স্তব্ধতায় বিবর্তিত হয়
নিত্য সকালে যে দ্বারকাকটা কর্কশ স্বরে ভ্রু-সন্ধিতে কুঞ্চন এনে দিত ,
তার বাক হারায় গভীর কাল চোখের জলপ্রপাতের রেখা ধরে ।
পথের ক্লান্তিমালা সব এক নিমেশে উড়ে গেল দীর্ঘশ্বাসের পথে –
এরপরে একরাশ ধুলোর ঝড় তুলে সেই ফিরে যাওয়া !

৬।।

প্রহরের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েও
পাখিদের নিয়ম মেনে চলা কিচির মিচিরের মতন
বাঁশি ফোঁকে ওই ভদ্দরলোক ঢুলুঢুলু চোখে ।
বিনিদ্র কোন রাত্রিতে সেই বাঁশির সুর শুনে
এক পাত্র নীল নিদ্রা পান করব কোনোদিন হয়ত !
দীর্ঘশ্বাসের ছন্দহীন সুরে স্মৃতিরা জমা হয়
কখনো উত্তরের দেয়ালে আবার কখনো
ঘুণপোকার মত শব্দে ঘুরতে থাকা
তিন পাখা ভেদ করে ঘরের ছাদে ।
প্রহরের পর প্রহরের পর্দা উন্মোচিত হয় নিঃশব্দে
ঘরময় স্মৃতিদের কোলাহল আর
উঁইপোকাদের তীব্র ব্যস্ততা কবিতার খাতায় ।
জানালা ফুরে শেষ রাতের শেয়ালের
অশুভ কলরব ছুটে এলে মনে পড়ে
এক পাত্র নীল নিদ্রা পান করা হল না আর !

৭।।

আবারও সন্ধ্যা নামে শিয়ালের ডাকের সাথে
মুক্তো দানার মতন নক্ষত্রের মেলায় ,
মোমের আলোয় দেয়াল জুড়ে মিটিমিটি ছায়া
আরও একটু ভাল করে ছায়াটিকে দেখে নেই – আমার খোঁজে ।

৮।।

ফুরিয়ে গিয়েছি প্রতিনিয়ত শব্দের মতন
ঝরনার চোখ বেয়ে জল ঝড়ে অবিরত তাই নিঃশব্দে !

৯।।

অনেক বর্ণে সাজানো শব্দমালা গুছিয়ে রেখেছিলাম
মহুয়ার খেলাঘরের পুতুলটির মতন করে , নিস্তব্ধতার মোড়কে ।
চলে যাবার বেলায় অনেক করে খুঁজেছি ,
মোড়কটি ছাড়া আর অবশিষ্ট কিছুই নেই আমার !

১০।।

দেখেছি, চোখের তারায় স্বপ্নেরা কেমন করে মরে যায়
মধ্যাহ্নের সোনালী আলোয় সুনীল শুভ্রতার মাঝে
শোকের ছায়া কাজলের কালির মতন লেপটে আছে
চোখেরই তলায় – মায়ার বিচ্ছুরন পবিত্র অশ্রুজলে
তবু সে পুনঃ স্বাগত জানায় , পবিত্র মৃত্যুর আঙিনায় !

১১।।

নির্ঘুম রাতের শেষে নক্ষত্রদের শান্তির ঘুম দেখে ভাবি,
ওদের বুকেও তো ত্রিকালের শাশ্বত বেদনারা খেলা করে
ওদের ঝকমকে চোখের তারায় লুকায়িত ত্রিভুবনের
বিচ্ছেদের সুর নিয়ে ওরা কেমন করে শান্তিতে চোখ বোজে ?

১২।।

মৃত স্বপ্নেরা সারি সারি পড়ে আছে রাস্তার বাঁকে
চোখের তলায় মেঘের ছায়া আর মৃত চোখ নির্লিপ্ত
দেখে তবু দেখে না সেই সুনীলকে আর
মেঘেরাও মুখ ফিরিয়েছে তাই বুঝি বিষাদে !
তপ্ত হাওয়া নীরবে স্পর্শ করে বলে গেল, খুনি আমায় !
শহরের ম্লান হয়ে যাওয়া জোছনারা বলে, খুনি আমায় !
নির্লিপ্ত ওই চোখেরা অভিবাদন জানিয়ে বলে, খুনি আমায় !
অশ্রুহীন চোখ বুজে স্বীকার করে নেই নীরবে, ‘খুনি আমি’ !

১৩।।

এখনও বাকি আছে অনেকটা পথ অথচ
পায়ে ঝিঁঝিঁ ডাকা দুপুরের স্থবিরতা,
বয়ে যাওয়া লু হাওয়াতেও ইচ্ছে হয়
চোখ বুজে থাকি কিছুকাল পথের বাঁকে ।

১৪।।

গৃহস্থালি সুর্যের আলো ম্লান হয়ে গেল
মেঝের কোনেতে লুটিয়ে পড়ে সহসা,
মা’র সাদা শাড়িতে প্রতিফলন
শুধুই শুভ্রতার বেশে অযতনে ।

১৫।।

ফিরে আসতে হয় বলেই ফিরে আসি,
নাহলে সেই কবে দুত্তোরি-ছাঁই বলে
কাঁধের নকশা মাখা তামাশা ফেলে
দূর-মেঘবতীর দেশে যেতাম চলে!

### কোনো একটা সময় ছিল, যখন শৈলী ছিল আমার দৈনন্দিন জীবনের একটা অংশ । প্রতিটি নাম ছিল যেন এক একটি পরিচিত মুখ । দীর্ঘ একটা সময় বাদে আজ কেমন অদ্ভুত ঠেকছে । অপরাধ বোধেও ভুগছি – প্রকৃতপক্ষে, এ শৈলীর একখন্ড জমির অপচয় ছাড়া আর তো কিছু নয় । …

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login