মামুন ম. আজিজ

সৃজনশীল বিতলামি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

সুজনশীল শিক্ষা

এক যুগ আগের কথা। বাংলাদেশে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে  তখন সবচেয়ে লুক্রেটিভ বিষয় ছিল কম্পিউটার সায়েন্স, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারীং বা কম্পিউটার টেকনলজি অর্থাৎ কম্পিউটার রিলেটেড কোন বিষয়। মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধার লড়াইয়ে ভীষন হুড়োহুড়ি। ঐ বিষয়ে টিকতেই হবে। চান্স না পেলে জীবনটা ঐ খানেই বোধহয় একেবারে কুপোকাত হয়েই গেলো। যে বিফল হয় পারিপার্শ্বিক মানুষের কাছে তার মেধা সংক্রান্ত প্রশংসায় ভাটা পড়ে যায় । পাবলিক ভার্সিটিগুলোতে কম্পিউটার রিলেটেড বিষয়টি এক নম্বরে। প্রাইভেট ভার্সিটির সংখ্যা তখন পুরোদমে বাড়ন্তের তুঙ্গে। সেগুলোতেও কম্পিউটার নামক বিষয়ে ভর্তির ধুম চলছিল।

অথচ দেশে কম্পিউটারের সত্যিকার অর্থে জাগরণ তখন মাত্র বছর দুই তিন চলছে। এত এত ভার্সিটিতে কম্পু বিষয়ে সব মেধাবীরা ভর্তি তো হচ্ছিল, কিন্তু শিক কোথায়? পাবলিক ভার্সিটি তাদের ফিজিক্স, ইলেকট্রনিক্স বা রিলেটেড বিষয়ের সিনিয়ির শিক্ষকদের বিদেশ থেকে কোর্স করিয়ে এনে কম্পু শিক্ষক বানাচ্ছে । বিদেশ ফেরত কম্পু নামযুক্ত কোন বিষয়ে মাষ্টার্স পাশ কিংবা কোন ট্রেনিংকৃত স্কলাররা লেকচারার হয়ে জয়েন করছে ছড়ানো ছিটানো প্রাইভেট ভার্সিটিতে কম্পিউটার পড়াতে। অনেকে সেই কম্পিউটার আলোড়ন এবং সুনাম কাজে লাগিয়ে দেশের কম্পিউটার বিশেষজ্ঞও হয়ে উঠেছেন। অথচ প্রকৃত কম্পিউটার পোগ্রামিং কিংবা কম্পু সংক্রান্ত অন্যান্য নলেজ সেই অর্থে দৃঢ় ভাবে খুঁজে পাওয়া ছিল দুষ্কর । নতুন বিষয়ে সেইটাই ছিল স্বাভাবিক।

আমার এক বন্ধু বিতলাও তখন পড়ত এক স্বনামধন্য ভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে। বিতলার প্রকৃত নামটা আজ আর আমার মনে নেই। বিতলা নামেই তাকে শিক্ষক মহল সহ সকলেই ভালো ভাবে চিনত।  ২য় সেমিষ্টারে সি++ পোগ্রামিং পড়াতেন একজন সিনিয়র শিক্ষক। যিনি ততদিনে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে সুনাম কুড়িয়ে ফেলেছেন। সুনাম আর পোগ্রামিং এক জিনিস নয়। সেটা টেকনো যুগের শিক্ষার্থীরা তার ক্লাস করেই বুঝে ফেলত। বিতলার তাই ঐ ক্লাসে মনোযোগ এবং উপস্থিতি দুটোই একটু বেশী কম ছিল। সেই বিতলা সেদিন সকালে ক্লাসে একটু দেরীতে ঢুকলো । ক্লাসে তখন নাম ডাকছেন সি++ স্যার। তিনি বিতলার দিকে তাকিয়েই বললেন, ‘আগে প্রোজেক্ট জমা দিয়ে তারপর সিটে বস।’

প্রোজেক্ট যে কবে করতে দিয়েছিল সেটাইতো বিতলা জানতো না। ক্লাসের এটেন্ডেন্স না হয় প্রোক্সি দিয়ে চালিয়েছে। মনে মনে ফুঁসছে রুম মেটটার উপর, ব্যাটা জানালোই না। একবার চোখ চলে গেলো তার দিকে। তারপর মনে পড়ল-বলেছিল তো; কিন্তু তখন যে হাতে ছিল তের খানা তাস। কিন্তু সে দমবার নয়। তার ব্রেন চলে হাই স্পিডে। বলেই দিল, ‘জি স্যার, করেছি , কিন্তু, হয়েছে কি স্যার, রুমে কম্পিউটারের ভেতর ফপিটা ঢুকানো ছিল। সকালে বের করে আনব , কারেন্টটা ঠিক তখনই চলে গেলো। আর বের করা হলো না। সরি স্যার।  স্যার আমি লাঞ্চের সময় এনে ঠিক দিয়ে যাব।’স্যার মানলেন।

লাঞ্চে হলে যাবার সময় কই বিতলার। ক্যান্টিনে তাহলে বিতালামিটা করব কে? রুমমেটকে পেয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে বের হবার পথেই।

‘ফ্লপিতে প্রোজেক্টটা করা আছে তোর কাছে?’

‘না, একটাই ছিল, জমা দিয়ে দিলাম তো।’

‘কোন খালি ফ্লপিও নেই?’

‘একটা নষ্ট ফপি আছে।’

‘দে, ঐ টাই দে।’

বিতলা চরম সাহস নিয়ে স্যারের রুমে গিয়ে স্যারের চরম হাসির সাথে প্রতিটা বিট মিলিয়ে হাসতে হাসতে সেই নষ্ট ফ্লপিটাই জমা দিয়ে দিল। স্যার বললেন, ‘ভবিষ্যতে দেরী করবে না। সময় মতো দিয়ে দিবে কিন্তু। ’

ঐ ঘটনার  পরের সপ্তাহে করিডরে স্যারের সাথে বিতলার দেখা। স্যার কাছে ডাকলেন। বিলতাও হেলে দুলে হাজির।

‘কেমন চলছে পড়াশুনা?’

‘দারুন স্যার। আমার পড়ার স্পিডে মাঝে মাঝে কম্পিউটারের স্পিড ফেল মারছে।’

‘মানে’

‘মানে , মানে স্যার প্রোগ্রাম লিখতে লিখতে কম্পিউটার প্রায় হ্যাঙ্গ হয়ে যাচ্ছে, প্রোসেসরের স্পিড মনে হয় বাড়ানো দরকার। তাই না স্যার?

‘ হুম, আসলে কিছু পোগ্রাম অনেক দীর্ঘ হয়তো, ভুল বেশী হয়ে গেলে কম্পিউটার হ্যাঙ্ক করে যায়। একটু খেয়াল করে করবে যাতে ভুল না হয়।’

‘জি স্যার।  স্যার, ঐ যে সি++ এর প্রোজেক্টা দেখেছেন স্যার? ঠিক আছে না? ’

‘হ্যাঁ ঠিক আছে, তবে দু একটা সিনটেক্স একটু ভুল হয়েছে। তবুও পোগ্রাম রান করেছে।

নম্বর পাবা। মাত্র এক মার্ক কেটেছি ভুলের জন্য।

‘থ্যাঙ্কুউ ভেরি মাচ স্যার। দোআ করবেন।’

বিতলার ফাইনাল রেজাল্ট কিন্তু মোটেও খারাপ হয় নি। যে দেশের যে ভাও পাল তুলিয়া নৌকা বাও । বিতলা এ দেশের জন্য যথার্থ।

বিতলার বিতলামি কিন্তু সেই প্রথম না। ওর মুখেই শুনেছি। ক্লাস সেভেনে যখন পড়ে, এক রাগী শিক্ষক সমাজ বিজ্ঞান পড়াতেন।  কোন না কোন অযুহাতে প্রতিদিন একপাল ছাত্রকে তার মারতেই হবে। কিছু না পেলে পড়া পাড়ে এমন একজন কে দিয়ে কে কে ক্লাসে কথা বলেছে তাদের নাম লিখিয়ে ক্লাস শেষ হবার আগে ১৫ মিনিট ধরে গুনে গুনে ৫টা করে বেতের বাড়ি মারতেন। একদিন ক্লাসে সবাই পড়া বলতে পেরেছে, সেদিন কথা বলার কারনে নামও লেখানো হয়নি। হঠাৎ কি মনে করে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই কাশ রুমের মধ্যে কি বোকা কেউ আছে? থাকলে উঠে দাড়াও।’

কেউ ওঠে না।  একে ওপরের মুখের দিকে তাকায় কেবল। হঠাৎ বিতলা উঠে দাঁড়ালো।

স্যার জিজ্ঞেস করলেন,‘কেনো তুমি নিজেকে বোকা মনে কর, বল? না বলতে পারলে ১০টা বেতের বাড়ি।’

বিতলার উত্তরে বলল, ‘স্যার আসলে আমার খুব খারাপ লাগছিল সবাই চালাক হয়ে বসে আছে আর আপনি একা দাঁড়িয়ে আছেন……তাই আমিও দাঁড়িয়ে’

এরপর কি হয়েছিল আর বিতলা বলেনি।

কিন্তু সেই সব মারমুখি শিক্ষকদের আকালের দিন এসেছে। আইন হয়েছে শিক্ষকরা আর শিক্সার্থীদের শারীরিক অত্যাচার করতে পারবেন না। কিন্তু ঐ যে এ দেশে আইন তৈরী হওয়া যেমন স্বাভাবিক ঠিক আইন এর প্রয়োগ না হওয়াটাও যে তেমনই স্বাভাবিক। তবুও আশা করি আজকালের ছাত্র ছাত্রীদের স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সেই বেতের ভয়ে সারা রাত ধরে মুখস্ত করা পড়াও ভুলে যেত হয় না। আইন এগিয়েছে , শিক্ষকদের মারমুখী আচরণও কমেছে এবং বলার অপক্ষা রাখে না বিতলার মত উন্নত প্রসেসর যুক্ত মস্তিষ্কের সমাহার আজকের যুগের শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতুল। শুধু খেয়াল রাখতে হবে তাদের সেই উন্নত প্রসেসরকে ব্যবাহার উপযোগী করার যথাযথ সুযোগটা যেন শিক্ষক এবং অভিবাবক মহল দিতে পারেন।

আজকাল স্কুল পর্যায়ে প্রায় সব বিষয়েই প্রশ্নপত্রে দেখছি সৃজনশীল প্রশ্ন বলে একটা আলাদা ভাগ থাকে। উন্নত টেকনো যুগের ছেলেমেয়েরা স্বাভাবিকভাবেই সৃজনশীল প্রশ্নে ভালোই করবে। কিন্তু যারা পড়াচ্ছেন তাদের সৃজনশীলতা বিকাশের এই রকম অতীত ব্যবস্থা ছিলনা সেটাও সত্য। তাদের অনেককেই সৃজনশীল প্রশ্ন করতেই শুনেছি হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর শেখানোর বিষয়টা না হয় উহ্যই থাক। এই বিষয়ে একটা ছোট কৌতূক শুনলাম।

ক্লাস এইটের কোন ক্লাসে  কম্পিউটার বিষয়ে সৃজনশীল বিভাগে প্রশ্ন করা হয়েছে -“ মনে কর, তুমি তোমার বাসার বড় ভাইয়ার কম্পিউটারটিতে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড ওপেন করে সেখানে তোমার  ইংরেজী পাঠ্য বইয়ের ২৯ নম্বর পাতাটি হতে ১০টি লাইন দেখে দেখে টাইপ করেছো। টাইপ শেষ করার পর দেখলে  সেখানে দশটি বাক্যের নিচে লাল দাগ ( আন্ডারলাইন)  দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়ে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।

(ক) লাল দাগ দেখা যাচ্ছে কেনো?

(খ) লাল দাগগুলো কি কোন সমস্যা?

(খ) এই সমস্যা দূর করার জন্য কি ব্যবস্থা নিতে হবে?”

আমাদের বিতলার কোন এক নবপ্রজন্ম সৃজনশীল উত্তরে লিখেছিল-

‘আমার বড় ভাইয়ার কম্পিউটারে এমএস ওয়ার্ডের টুল বারের অপশন উইন্ডোর  ‘স্পেলিং ও গ্রামার’ এ ‘চেক এজ ইউ টাইপ’ অপশনে ‘টিক’ চিহ্ন টি উঠিয়ে দেয়া আছে। সে কারনে ভাইয়ার কম্পিউটারে ভুল লিখলেও লাল আন্ডারলাইন দেখা যায় না। আমিও ভাইয়ার সাথে সাথে বছর সাতেক  আগেই টাইপ করা শিখেছি। দেখে দেখে টাইপে আমার খুব কমই ভুল হয়।’

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


16 Responses to সৃজনশীল বিতলামি

You must be logged in to post a comment Login