অণুগল্পঃ এনকাউন্টার
রাত্রির তৃতীয় প্রহর। রফিক অপক্ষো করছে। যে কোন সময় তাঁকে দৌঁড়াতে বলা হবে। আশ্বিনের শুরুর এই সময়টা দারুণ এক সময়। হালকা হালকা শীত। সামান্য কুয়াশা। গড়াই নদীর ফুরফুরে হাওয়া মনটা মাঝে মাঝে উদাস করে দেয়। জীবনটাকে মনে হয় খুব সহজ এবং আনন্দময়। “লালবই” এর তত্ত্বগুলোর ঠিক যেন বিপরীত।
রফিকের হাতে সময় খুব বেশী নেই। এই মুহূর্তে সে কিছু সুখ স্মৃতি মনে করতে চাচ্ছে। সুখম্মৃতি যা আছে সবই তো শৈশব আর কৈশোরে। তারুণ্যের সবটাই তো রয়ে গেছে লাল বইয়ের অক্ষরে অক্ষরে। লাল বই, লাল সালাম, ভুল বিপ্লব, ভুল তত্ত্ব-অবশেষে ভুল পথ। জীবনটাই চলে গেল ভুলে ভুলে। মা, তোমার মুখটা খুব মনে পড়ছে। তোমার মৃত্যুর খবর পেয়েও তোমার মুখটা শেষবারের মতো দেখতে যেতে পারিনি। হাই কমান্ডের নির্দেশ পালন করেছি। বড় করে দেখেছি লাল বইকে। তোমার চেয়েও।
শৈশবের পাঠশালা, গড়াই নদীতে ঝাঁপাঝাঁপি, বিকেল বেলা বাবার তর্জনী ধরে হাটে যাওয়া – কতই না সরল, সুন্দর ছিলো জীবন! তারুণ্যে এসে পরিচয় হলো মিলির সঙ্গে। ভালোবাসা, স্বপ্ন আর দাবিতে ভরা একজোড়া চোখ। এখনও চোখ বুঁজলে ঠিক মনে পড়ে। তার সমস্ত চাওয়াকে উপো করে আমি ভালোবেসেছিলাম লাল বইকে। দেশে বিপ্লব হবে। সব মানুষ হবে সমান। না খেয়ে থাকবে না কেউ। গরীব কৃষককে করতে হবে না বর্গা চাষ। মিলির ভালোবাসা তো এসবের কাছে অনেক তুচ্ছ!
রফিক অপেক্ষা করছে সেই বিশেষ নির্দেশের। যে কোন সময় নির্দেশ চলে আসবে। সে এখন ভাবছে তার বাড়ীর কথা। কতকাল, কত বছর সে বাড়ী যায়নি। চৌচালা ঘর, ঝকঝকে উঠোন, উঠোনের শেষ সীমানায় খড়ের পালা, তার পাশে গোয়াল ঘর, একটা লাউয়ের মাচা- আহা! একেবারে ছবির মতো এক বাড়ী। তাঁর খুব ইচ্ছে করছে বাড়ীর উঠোনে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে শীতের রাতের কালপুরুষকে খুঁজতে!
রফিকের চিন্তায় ছেদ পড়ে। নির্দেশ এসে গেছে। কিন্তু কোন্ দিকে দৌঁড়াবে সে বুঝতে পারছে না। চারদিকই তো ফাঁকা। কিন্তু এলাকাটা তাঁর চেনা। তাঁর বাড়ী কোনদিক তাও সে জানে। সে বাড়ীর দিকেই দৌঁড়াতে থাকে। এটাই মানুষের চিরন্তন টান। নদীর স্রোতের মতো স্বভাবিক স্বভাব। কিন্তু লাল বই তাঁকে জীবনের বড় একটা অংশ তাঁর বাড়ীর বিপরীত দিকে ছুটিয়েছে।
আমন ধানের ক্ষেতের উপড় দিয়ে রফিক ছুটছে। সে জানে পেছনে কি ঘটবে। কিন্তু সে তাকাতে চাচ্ছে না। তাঁর পেছনে কালো পোশাকের কিছু মানুষ রাতের কালো অন্ধকারে কালো রাইফেল তাক করে আছে তাঁর দিকে। অনেক বছর পর সে এখন মায়ের শরীরের গন্ধ পাচ্ছে। আশ্বিনের রাতের এই তৃতীয় প্রহরে মায়ের কোলে গুটিশুটি মেরে শুয়ে সে এখন মায়ের কাছ থেকে ওম নেবে। আলস্যমাখানো আনন্দময় ওম!
11 Responses to অণুগল্পঃ এনকাউন্টার
You must be logged in to post a comment Login