জুলিয়ান সিদ্দিকী

উপন্যাস: উত্তাপ কিংবা উষ্ণতা

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কখনো ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে গেলে খুবই খারাপ লাগে হাসানের। কিন্তু আজ তেমন একটা খারাপ লাগছিলো না তার। বিগত সময়গুলোতে সে এমনি একটি কিছুর প্রত্যাশায় হয়তো ছিলো। যে কারণে খুব ভোরের দিকে ঘুম ভাঙিয়ে ফিজা যখন জানালো যে, সন্ধ্যার দিকে এয়ারপোর্টে এসে নামছে। অন্য সময় হলে হয়তো সে ফোন রেখে দিতো। কিংবা পাল্টা কোনো প্রশ্ন করে তাকে নিরুৎসাহীত করতে চাইতো। কিন্তু আজকের ভোর বেলাটাই তার কাছে কেমন যেন হঠাৎ করেই সুন্দর মনে হতে লাগলো।

বলতে গেলে গত তিন-চার মাস ধরে একাই দিন কাটাচ্ছে সে। একমাত্র ছেলে মাশাকে নিয়ে মনিরা চলে গেছে কানাডায়। তার ভবিষ্যৎ নাকি অন্ধকার হয়ে যাবে হাসানের সঙ্গে থাকলে। সেও নির্বিকারভাবে বলেছিলো, আমার কারণে যদি তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার মনে হয়, সেটাকে তুমি উজ্জ্বলতা দিতে যা খুশি করতে পার। আমার আপত্তি নেই।

মনিরা যেন ক্ষেপেই উঠেছিলো। বলে উঠেছিলো, তা তো আপত্তি করবেই না। কেউ যদি তোমার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে মুখিয়ে থাকে তাহলে আর আপত্তি করবে কেন? আপদ যতটা তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততটাই তোমার সুবিধা!

হাসান অবাক হয়ে ভাবে যে, সে বললো কি আর মনিরা তার অর্থ করলো কি!

তারপর সে রাগ সামলে শীতল কন্ঠে বলেছিলো, আমার দিক থেকে কোনো সমস্য নেই। যত সমস্যা তোমার। আমি তোমাকে কখনোই বলিনি বা আমার আচরণে কখনোই হয়তো প্রকাশ হয়নি যে, তোমাকে আমার প্রয়োজন নেই!

সেটা তুমি মনে করতে পারো। কিন্তু আমি সব সময়ই দেখি ফিজা বদমাশটার ফোন পেলেই তোমার চোখমুখ বদলে যায়। তখন আমার দিকে তোমার কোনোই কেয়ার থাকে না। মনিরা যেন আরো জ্বলে উঠে বলেছিলো।

হাসান সন্ধ্যার মুখে মুখে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে আগ্রহ বোধ করছিলো না। মেয়েরা যখন কোনো সংসারে থাকতে না চায় তখন তারা কত রকমেরই রাস্তা খুঁজে নিতে পারে। তৈরি করে নিতে পারে নিজের জন্য মসৃন কোনো পথ। এ ক্ষেত্রে পুরুষটির যদিও অনেক কিছুই করার থাকে, তাতে পরিবেশ আরো নোংরাই হয়। আশপাশেও এর দুর্গন্ধ ছাড়ায়। তাই মনে মনে আগেই হার মেনে নিয়েছে হাসান। মনিরা যে তার সঙ্গে সংসার করতে গিয়ে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠছে তা আরো আগেই টের পেয়েছিলো সে। যে কারণে ছেলেটাকে মাঝে মাঝে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করতো যে, বাবাকে ছাড়া থাকতে চেষ্টা কর। বাবার সঙ্গে সবসময় থাকলে কিংবা বাবার জন্য খুব বেশি মন কেমন কেমন করলে ছেলে-মেয়েরা জীবনে তেমন একটা উন্নতি করতে পারে না। কোনো প্রয়োজনে তারা বাবা-মাকে ছেড়ে দূরে থাকতে পারে না। কিন্তু ছেলেটার ভাব ভঙ্গিতে তেমন কিছু বুঝতে পারেনি হাসান। তবে দিন পনেরো আগে সে একটি মেইলে জানিয়েছিলো যে, তার খুবই খারাপ লাগছে। তার মা নাকি বলেছে যে, তাকে দেশে পাঠিয়ে দেবে।

মাশাকে ফিরতি মেইলে কিছু বলা হয়নি। কেবল ফিজাকে জানিয়েছিলো সময় করতে পারলে মাশার সঙ্গে যেন দেখা করে। তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে লেখাপড়ায় মন দিতে বলে। কিন্তু সে ব্যাপারে ফিজাও কিছু জানায়নি তাকে। তারপর আজ ভোর বেলাই তার ফোন। কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কেবল নিজের কথাটা বলেই সে ফোন রেখে দিয়েছে। হাসানের ইচ্ছে ছিলো মাশার কথা জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি।

হাসান শুয়ে থেকেই ঘড়ি দেখে। পৌণে পাঁচটা। এ সময় তার ঘুম তেমন ভাঙে না। বরং ঘুমটা এ সময়ই আরো গাঢ় হয়। আজ পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন। সে বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সূর্যটা মাত্র ঘুম থেকে জেগে আড়মোড়া ভাঙছে হয়তো। পূব আকাশটা বেশ লালচে দেখাচ্ছে।

তখনই তার মনে পড়ে প্রায় সপ্তাহ খানেক সে ল্যাপটপ নিয়ে বসেনি। নানা দিকে ছুটোছুটির কারণে সেটা তেমনিই পড়ে আছে। কোনো জরুরি ইমেইল থাকতে পারে। তিনচারদিন আগে কিছু ম্যাটেরিয়েলের জন্য ফ্যাক্স পাঠিয়েছিলো শাহজাহানের কাছে। সেগুলোর শিপমেন্টের ব্যাপারে কিছু করেছে কিনা তাও ফিরতি ফ্যাক্সে জানায়নি। শাহজাহান ইমেইল করে থাকতে পারে। ভাবতে ভাবতে সে একটি সিগারেট ধরিয়ে কম্পিউটারের সামনে এসে বসে। বেশ হালকা একটি ধূলোর আস্তরণ দেখা যাচ্ছে। ড্রয়ার থেকে রুমাল বের করে মুছে নিয়ে সেটাকে অন করতেই মনিটরে কেমন হিজিবিজি রঙচঙে লেটার দেখায়। কিছুক্ষণ পরই সেটা আবার ঠিক হয়ে যায়। কম্পিউটারের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে সে অজ্ঞই বলতে গেলে। কিভাবে কেমন করে কম্পিউটার কাজ করে তা তার জানা নেই। আর ব্যাপারটা তার কাছে খুবই জটিল মনে হয় বলে তা নিয়ে মাথা ঘামাতেও পছন্দ করে না।

ল্যান্ড ফোনের কানেকশনটা খুলে সে ল্যাপটপের মডেমে সংযোগ দিয়ে ডেস্কটপ থেকে ডায়ালআপ কানেকশনের আইকনে ক্লিক করে। কিছুক্ষণ কিরকির করে শব্দ হয়ে নেট সংযোগ পেতেই সে জিমেইলের ওয়েব পেইজ খোলে। অ্যাকাউন্ট ওপেন করতেই বেশ কিছু নতুন মেইল দেখতে পায়। এর মাঝে একটি মাশার। আরেকটি অচেনা। আর বাকিগুলো বেশিরভাগই স্পাম নয়তো হাবিজাবি মেইল।

মাশার মেইলটা ওপেন করতে তার মন খুশি হয়ে উঠলো। বাংলায় ম্যাসেজ লিখেছে। অথচ দেশে থাকতে তাকে বাংলা টাইপ করাটা কিছুতেই শেখাতে পারেনি হাসান। এখন দেশের বাইরে গিয়ে ঠিকই শিখে নিয়েছে। আসলে মানুষ তার বৃত্তের বাইরে না গেলে হয়তো নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে সজাগ হয় খুব কমই। অভ্র বাংলা ইন্টারফেস ওরা ভালোই বানিয়েছে। এর পোর্টেবল কি বোর্ডটাই হাসানের পছন্দ। যেখানে সেখানে গিয়েও সে এটা ব্যবহার করতে পারে। কম্পিউটারে বাংলা ফন্ট না থাকার জন্য আক্ষেপ করতে হয় না।

মাশা লিখেছে, বাবা, তোমাকে খুবই মিস করছি। স্কুল থেকে ফিরে বেশিরভাগ সময়ই ঘরে একা থাকি। মা প্রতিদিন ডানিয়েল বলে একটি লোকের সঙ্গে তাদের খাবারের গাড়ি নিয়ে কোথায় কোথায় যায়। ফিরতে ফিরতে কখনো তিনদিন বা সপ্তাহও লেগে যায়। এ কথা বলতে মা আমাকে একদিন খুব মেরেছে। জ্বর এসে গিয়েছিলো। আরো বলেছে আমাকে নাকি দেশে পাঠিয়ে দেবে। আমিও খুশি হবো বাবা। তোমাকে ছাড়া এখানে আমার ভালো লাগছে না। কাঁকন আপুর জন্য দুটো ক্লিপ কিনেছি। ফিজা আন্টি একদিন অমাদের এখানে এসেছিলো। দেশে থাকতে তাকে কখনো দেখিনি। সে বলেছে তুমি তাকে চেনো। সে কদিন পর দেশে যাচ্ছে। তোমাকে বলতে বলেছে। আমি ইয়াহু ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতে শিখেছি। তুমিও তোমার কম্পিউটারে ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার ইনস্টল করে নিও।

মেইল পড়ে মন খারাপ হয়ে যায় হাসানের। ছেলেটা যে ভালো নেই বোঝাই যায়। কিন্তু মনিরা সেখানে গিয়ে কি দিনদিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠলো? নাকি ছেলেটাই বুঝতে ভুল করছে?

হাসান এ নিয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারে না। কিন্তু ইয়াহু জানলেও ম্যাসেঞ্জারটা কি ধরনের বুঝতে পারছে না সে। অবশ্য ফিজার কাছ থেকেও সে জেনে নিতে পারবে। মাশার কাছে ফিরতি মেইল লিখতে লিখতে সে ভাবে, ম্যাসেঞ্জারে কথা বলতে পারলে অনেকটা কষ্ট কমে যাবে। সপ্তাহে দু একদিন যদি ছেলেটার সঙ্গে কথা বলা যায় তো মন্দ কি!

মাশার অ্যাড্রেসে ইমেইল পাঠিয়ে দিয়ে হাসান কম্পিউটার বন্ধ করে দিতে গিয়েও করে না। আবারও নিজের ইমেইল অ্যাকাউন্ট ওপেন করে অচেনা মেইলটা ওপেন করলো।

শাহজাহান মেইল করেছে। যে যে ম্যাটেরিয়ালের কথা সে বলেছিলো, তা সে পাঠিয়ে দিয়েছে। হয়তো কিছুটা দেরি হবে। দেরির জন্য ভাবে না হাসান। কোম্পানির প্রয়োজন মিটলেই হলো। বেশিক্ষণ কম্পিউটার খোলা রাখতে ভালো লাগে না তার। মনিটরে চোখ রাখতেই ইচ্ছে হয় না আজকাল।

সে উঠে কিছুক্ষণ লাফায়। লাফাতে লাফাতে তার হঠাৎ হাসি পেয়ে যায়। একা ঘরে একজন মাত্র মানুষ। সময় কাটানোর তেমন কোনো উপায় জানা নেই। অফিসে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণই তার সময়টা হয়তো ভালো কাটে। সব কিছু কেমন ভুলে যায়। ভুলে যায় নিজকেও। মনেই হয় না যে, সে একটি মাত্র ফ্লাটে ভূতের মত একা একা বাস করে। লাফাতে লাফাতে তার শরীরে হালকা ঘাম ফুটে উঠতে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসও বেশ দ্রত চলতে থাকে। কিন্তু খুব দ্রুতই যেন ক্লান্ত হয়ে যায় সে। ক্লান্তি কাটাতে মেঝেতে বসে থাকে কিছুক্ষণ। কিছুটা ভালো লাগতে থাকলে সে উঠে কিচেনে যায়। এক কাপ কফি হলে মন্দ হতো না। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কফির কৌটাটা দেখতে পায় না সে। শেষে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে ফিরে আসে।

চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে ঘড়িতে সময় দেখে। সাড়ে ছটা। সাতটার দিকে মুক্তার মা আসবে। তার জন্য নাস্তা তৈরি করে দিয়ে ঘর গোছগাছ করে ঝাঁটপাট দিয়ে চলে যাবে। অফিস থেকে ফিরে আসার আগেই সন্ধ্যার দিকে সে আবার আসবে। তার কাছে রাখা চাবি দিয়ে মেন দরজা খুলবে। রাতের জন্য খাবার রেঁধে দিয়ে ফের চলে যাবে। মাঝে মাঝে নিজেই রেসিপি দেখে খাবার রাঁধে হাসান। তেমন একটা খারাপ লাগে না। একা একা এসব করতে খানিক মজাও লাগে তার।

মুক্তার মা আসতে আসতে সে গোসলটা সেরে নেবার মনস্ত করে। কিন্তু তখনই দরজার বেল বেজে উঠলো। কে আসবে এখন?

দরজা খুলতেই বহুদিনের পরিচিত হকার আকবরের হাসিমুখ দেখা যায়। দৈনিক পত্রিকাটি বাড়িয়ে ধরে বলে, দুই মাসের বিল বইক্যা আছে সার!

বলিস কি? দেইনি?

আকবর দেঁতো হাসি দিয়ে বলে, চাই নাই ইচ্ছা কইরাই!

কত হয়েছে?

তিনশ বিশ ট্যাকা।

হাসান কিছুটা অবাক হয়ে বললো, কাগজের দাম পাঁচ টাকা। বিশ টাকা বেশি কেন?

দুইটাই একত্রিশা মাস। দশট্যাকা দামের একটা রান্দনের ম্যাগাজিন দিসিলাম।

ঠিক ঠিক!

মনে পড়ে হাসানের। টাকা নিয়ে এসে দিয়ে দিতেই সে বলে, কোনো ম্যাগাজিন রাখবেন?

না।

সে দরজা বন্ধ করে দিয়ে সেখানেই মেঝেতে বসে পত্রিকা মেলে ধরে। শিরোনাম হয়েছে জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রীর শ্লীলতাহানি। দিনভর বিক্ষোভ।

মনটা সঙ্গে সঙ্গেই বিষিয়ে উঠলো হাসানের। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি একই কারণে পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে বারবার। কর্তৃপক্ষ যদি নিরাপত্তাই না দিতে পারে, তাহলে মেয়েদের নিচ্ছে কেন সেখানে? আর কোনো সংবাদ দেখার প্রতি আগ্রহ থাকে না তার।

দরজায় মুক্তার মা বেল বাজায় হয়তো। তার বেল টেপার ধরনটা আলাদা। একই সঙ্গে তিনবার বেজে ওঠে। হাসান দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে তাকায় মুক্তার মার প্রতি। কিছুটা সাজগোজ করেছে মনে হয়। পরনের কাপড়টাও নতুন। সে বলে উঠলো, কোথায় গিয়েছিলে, নাকি যাবে?

মুক্তার মায়ের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। হয়তো হাসি লুকাতেই সে মুখে হাত চাপা দিয়ে মুখ নামিয়ে ভেতরে ঢোকে। তারপর কিচেনের দিকে যেতে যেতে বললো, আইজ আমারে দেখতে আইবো!

তাই হয়তো কিছুটা আগে আগেই সে এসে পড়েছে।

দরজা বন্ধ করতে করতে হাসান ভাবে, এরা তো তেমন একটা ভালো খেতে পরতে পায় না। ভালো জায়গায় থাকতেও পারে না। তবুও এদের শরীরের গঠন তেমন একটা নষ্ট হয় না। কেন? মুক্তার বিয়ে হয়ে গেছে আজ থেকে বছর পাঁচেক আগে। অথচ মুক্তার মা নামের এ মহিলাটি এখনও বিয়ের নামে কিশোরীদের মতই লজ্জা পায়। এদের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে? মাশার জন্মের পরপরই মনিরা কেমন ঝিমিয়ে পড়েছিলো। মন থেকে যেন যাবতীয় রঙ-রস উবে গিয়েছিলো তার। দিনদিন মুটিয়ে গিয়ে শরীরের যাচ্ছেতাই অবস্থা করে ফেলেছে। তার দিকে তাকালে মাঝখান দিয়ে মনে হতো সে আট-দশজন ছেলে-মেয়ের মা বুঝি।

হাসানের বেশ কৌতুহল হয় মুক্তার মার বিষয়ে। সে কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, মুক্তার বাপের কি হলো? তোমাকে দেখতে আসবে কেন?

মুক্তার মায়ের মুখে আবার হাসি ফুটে ওঠে। ভাইজান কিছুই মনে রাখতে পারেন না! গত মাসে না হ্যায় আবার বিয়া করলো!

তাই তুমিও বিয়ে করবে আবার? তালাক-টালাক ছাড়াই?

এত বছর এক লগে ঘর কইরা যদি মুখের তিন কথায় সব শ্যাষ হইয়া যায়, হ্যামন ঘরের কি দাম?

তাই বলে তালাক ছাড়াই?

বুইড়ায় তালাক ছাড়া আবার বিয়া করতে পারলে আমি করলে কি দুষ?

হাসান হেসে উঠে বলে, এ বয়সে তুমি আবার বিয়ে করবে?

মাইয়া মানষ্যের একলা থাকলে অনেক বিপদ!

তোমার বয়স কত হলো?

মুক্তার মা হাসানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, হুনছি যুদ্ধের বছর আমার চাইর বছর আছিলো।

হাসান মনে মনে হিসেব করে দেখলো, এর বয়স প্রায় চল্লিশ কিংবা চল্লিশেরও বেশি। কিন্তু এ বয়সে তার বিপদ হবে কেন? নাকি মেয়েরা সব সময়ই বিপদগ্রস্থ? লোভী পুরুষের চকচকে দৃষ্টির খোরাক? আর মেয়েরা একা থাকলে তাদের বিপদ হয়, ছেলেদের হতে পারে না? সে তো নিজেও কতদিন ধরে একা একা আছে। তার বিপদ নেই! অনেক ধরনের বিপদেই সে আছে। তবে সমস্যা হলো ছেলেদের বিপদটা তেমন কারো চোখে পড়ে না। নিঃসঙ্গ মেয়েদের যেমন সুযোগ সন্ধানী পুরুষরা নানাভাবে বিরক্ত করে বা লোভের ফাঁদে ফেলতে চায়, ছেলেদের ক্ষেত্রে তেমন ঘটনা কদাচ ঘটে। তাই তাদের ব্যাপারটা তেমন কারো বিবেচনায় আসে না।

মুক্তার মা মনিরার বাপের দেশের মেয়ে বলে, তাকে যথেষ্ট বিশ্বাসও করা যায়। তা ছাড়া এমনিতেও মহিলার হাতটানের অভ্যাসের কোনো ঘটনার কথা জানে না হাসান। এমন কিছু ঘটে থাকলে আগেই মনিরা হয়তো জানাতো।

হাসান বললো, তোমার আজ বিয়ে হয়ে গেলে এক সপ্তাহের ছুটি। যাওয়ার সময় কিছু টাকা নিয়ে যেয়ো।

মুক্তার মা মাথা দোলায়।

হাসান বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। মুক্তার মার কাজ শেষ হতে হতে সব মিলিয়ে ঘন্টা দেড়েক। ততক্ষণে সেও অফিসের জন্য তৈরি হয়ে যেতে পারবে।

অফিস থেকে বেরোতে বেরোতেই অনেকটা দেরি করে ফেলে হাসান। আগাম কোনো শিডিউল ছাড়াই আজ মিটিং ডেকে বসেছে। মিটিঙে বসে মনোযাগ দিতে পারছিলো না সে। অথচ তার ব্রিফিংটাই ছিলো জরুরি। তবুও কোনো রকমে সে নিজের বক্তব্য শেষ করে বাকি রিপোর্ট কয়েকদিনের মধ্যেই দিয়ে দেবে বলে জানিয়ে দিলো। তখন বাইরে হয়তো সন্ধ্যা নামতে আরম্ভ করেছে।

হাসানকে ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে এমডি মহিবুল্লা বললেন, কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে নাকি? তাহলে আপনাকে আর আটকাবো না।

হাসান বললো, কানাডা থেকে আমার এক রিলেটিভ আসবে সন্ধ্যায়।

টার ফ্লাইটে?

সেটা ঠিক খেয়াল করতে পারিনি। সন্ধ্যা মানে সাড়ে ছটা সাতটা নাগাদ হতে পারে।

তিনি ঘড়ি দেখে বললেন, সময় তাহলে বেশি নেই। কোন এয়ার লাইন বলতে পারলে এখনি ইন্টারনেট থেকে জেনে নেয়া যেতো।

হাসান হেসে বললো, সেটাও বলেনি স্যার!

আপনাকে নিয়ে এক যন্ত্রণা। কিছুতেই আপনার মন নেই দেখছি!

হয়তো তিনি বিরক্তই হলেন। বললেন, আচ্ছা যান!

হাসান প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এলো। গাড়িতে বসে স্টার্ট দিতেই সেটা স্টার্ট নিলো না। কি ব্যাপার? সকালে আসার সময়ই ফুয়েলট্যাঙ্ক ভর্তি করে নিয়েছিলো। কদিন আগে কাওসার বলছিলো কেউ তার গাড়ি থেকে তেল চুরি করছে। কিন্তু ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি সে। গাড়ি থেকে কে আবার তেল চুরি করবে? তেল চুরি করে করবেটাই বা কি? তাই সে মজা করে কাওসারকে উল্টো মেমোরিয়াল ট্যাবলেট খাওয়ার কথা বলেছিলো। কিন্তু এখন তার ফুয়েল গজ শুন্যের ঘরে দেখতে পেয়ে কাওসারের কথাটা হৃদয়ঙ্গম হলো। সে তবুও বেরিয়ে ফুয়েল ট্যাঙ্কের ঢাকনা খুলে স্টিক ঢুকিয়ে দেখলো, সত্যিই। তেল নেই। গাড়ির নিচে তাকিয়ে দেখলো তেল চুইয়ে পড়ছে কি না। কিন্তু তা ও না। তাই বলে ফুয়েল ট্যাঙ্ক একেবারেই শূন্য হয় কী করে? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো সবার মুখই স্বাভাবিক। ব্যাপারটা কারা ঘটাতে পারে? গেটে সিকিউরিটি আছে। অন্যান্য ড্রাইভাররাও নিত্যদিনকার মত বসে বসে রাজনৈতিক প্যাঁচাল পাড়ছে। তাহলে ঘটনাটা কখন ঘটলো? নাকি এদের সবাই এ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত?

সে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দিয়ে লক করে দিলো। হয়তো কাল এসে দেখা যাবে বাইরের লুকিং গ্লাস দুটো নেই। আজকাল হরহামেশাই এসব হচ্ছে। নেশাখোরের সংখ্যা বেড়ে যাওয়াতে ছিঁচকে চোরের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। একবার গুলশানে এক মহিলাকে সে দেখেছিলো পথচারীদের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা চাইছে। পরনে তার ভালো আর দামী কাপড়ই ছিলো। কেবল পায়ে কিছু ছিলো না। হাসানকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে একজন পথচারী বলেছিলো, বড়লোকের বউ। ভিক্ষা কইরা হিরোইন খায়!

বাইরে এসে একটি ট্যাক্সি দেখতে পেয়ে হাত তুলতেই সেটা তার পাশে এসে থামলো। হাসান বললো, এয়ারপোর্ট।

না। হেইদিগে জাম বেশি।

হুশ করে লোকটি গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।

হাসান আরো খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আরেকটা ট্যাক্সি ধরলো। তারও একই জবাব। সেদিকে জ্যাম।

তাহলে? সময় তো বেশি নেই।

আচ্ছা যা হবার হবে। হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। এয়ারপোর্ট যাওয়াটাকে অত গুরুত্ব দিচ্ছে বলেই সময়টা বেঁকে বসেছে। যখনই সে খুব মন দিয়ে একটা কিছু করতে চায় তখনই শুরু হয় নানা ঝামেলা। কারো উপর যদি মন থেকেই নির্ভর করে, কদিন পর দেখা যায় সে মানুষটা ভিন্ন রকম হয়ে গেছে কিংবা তার মন মত চলছে না। তাই আজকাল সে তেমন কিছু প্রত্যাশা করে না। জীবনটা যেভাবে চলছে চলুক। কোনো কিছুকে তেমন করে আর আঁকড়ে ধরবে না। তবুও ফিজার আসার সময়টা নিয়ে সে কিছুটা উদ্বিগ্নই ছিলো হয়তো। আর তাই তার সময়টা পেছনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করেছে। নাহ। মনে মনে ভাবে সে। ফিজাকেও অনেকটা গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছে। তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়া যাবে না। মনিরাকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছিলো সে। পরিণামে সে এখন তার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। তার মাঝে মাঝে মনে হয় মানুষের সম্পর্কটা উলের মত। ঠিকঠাক মত আর পরিমিত থাকলে আরামই হয়। আর বেশি টানাটানি করলে খাটো হতে থাকে। মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কাউকে নিজের দিকে খুব বেশি আকর্ষণ করতে চাইলে সে দূরে সরে যায় হয়তো। কিংবা ব্যাপারটা কেবল তার বেলাতেই ঘটে থাকতে পারে।

একটি রিকশা নিয়ে বাসস্টপে চলে আসে সে। কোনো ট্যাক্সি বা সিএনজি নয়। বাসেই যাবে। গিয়ে যদি ফিজাকে দেখতে পায় তো ভালো। না পেলেও তার কিছু যায় আসে না। ফিজা তার তেমন কাছের কেউ না। বন্ধুর মত। আর বন্ধু হলেও কথা ছিলো। তাই বলে বন্ধুর মত এমন কাউকে অতটা গুরুত্ব না দিলেও চলে হয়তো।

আস্তে ধীরে সে টিকেট কেটে বাসে ওঠে।

তারপর এয়ারপোর্ট এসে নামলেও সে অকারণেই ধীর লয়ে হেঁটে যায়। ফুটপাতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানে। শেষেটায় এয়ারপোর্টের গ্রীন চ্যানেলের সামনে ফাঁকা জায়গাটায় দাঁড়িয়ে থাকে।

গরমের দিন বলে সন্ধ্যা হয় দেরিতে। সূর্যটা এয়ারপোর্ট বিল্ডিঙের আড়ালে ডুবতে বসেছে হয়তো। এদিকে বেশ দীর্ঘ ছায়া। কিন্তু গরমটা কমছে না। এরই মধ্যে তার শরীর ঘামতে আরম্ভ করেছে। নিচের পাকা রাস্তা থেকে তাপ উঠে আসছে টের পাওয়া যায়। তখনই ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে কেউ একজন এগিয়ে আসতে থাকে। তার দিকে চকিতে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় হাসান। ফিজা কি? তেমন তো মনে হলো না। কেমন যেন অচেনা মেয়েদের মত লাগছে। কানে ব্লুটুথ স্পিকার লাগানো। হয়তো সেলফোন থেকে গান শুনছে। গড়নটাও বেশ হালকা পাতলা মনে হলো। নাকি তার দেখার ভুল? সে আবার মুখ তুলতেই অবাক হয়ে যায়। আরে ফিজাই তো! তার কথাগুলো খানিকটা চিৎকারের মত শোনায়। ভাবছিলাম কে না কে!

ট্রলি টেনে থামিয়ে ফিজা বললো, আমাকে না চেনার কি হলো? নাকি সত্যিই মনে রাখোনি?

আরে বলে কি! হাসান এগিয়ে গিয়ে ট্রলিতে হাত রেখে দাঁড়ায়। না চেনার অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমত: তোমার শরীর অনেক শুকনো মনে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত: তোমার…

থাক আর বলতে হবে না। তোমার গাড়ি কোথায়? বলে, ফিজা তার দিকে উৎসুক হয়ে তাকালো।

আর বোলো না! সকালের দিকে অফিসে আসার সময় ট্যাঙ্ক ফুল করে নিয়েছিলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে স্টার্ট দিচ্ছি, হচ্ছে না! ফুয়েল গজে চোখ পড়তেই দেখি শূন্যের ঘরে।

তাহলে কিসে করে এলে?

বাসে।

এটাও কি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে? যেন সত্যি সত্যি অবাক হয়ে হাসানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ফিজা।

কিন্তু হাসান নির্বিকার থাকতে চেষ্টা করে।

সে মনে মনে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেছে যে, আর কিছুকেই অতটা গুরুত্ব দেবে না। তাই হালকা ভাবে বললো, তোমাকে বলিনি যে, বিশ্বাস করতেই হবে।

ফিজা একই ভাবে কিছুক্ষণ হাসানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হয়তো কঠিন কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজকে সামলে নিয়ে হাত তুলে ট্যাক্সি ডাকলো।

তারপর বললো, নাকি ভুল করে ওয়ালেটও অফিসের ড্রয়ারে রেখে এসেছো?

তখনই আঁৎকে উঠে হাসান তার প্যান্টের পেছনের পকেটে হাত দেয়। আর তা দেখে ফিজা হেসে উঠলো।

হাসান তেমনি হেসে বলে, হাসার কি হলো? এমন অনেকবারই ঘটেছে। একবার অফিসের ড্রয়ারে এটা রেখে চলে এসেছি। টাকা-পয়সা ক্রেডিট কার্ড এটার মধ্যেই ছিলো। অর্ধেক পথ এসে যখন মনে পড়লো তখন ফিরে গিয়ে দেখি কালাম অফিস তালা দিয়ে চলে গেছে।

ট্যাক্সিটা এসে পাশে থামতেই হাসান বললো, বনশ্রী।

ড্রাইভার জানালো, ভিতরে গেলে কিছু বেশি দিতে হইবো।

কেন? মিটারে যা আসে তাই নেবে! অসুবিধা কি?

অসুবিধা আছে। বলে, মাথা ঝাঁকিয়ে বললো লোকটি। তিন-চাইর ঘন্টা লাইনে বইয়া থাইক্যা গ্যাস পাই না ঠিক মতন।

হাসান বিরক্ত হয়ে বলে, বেশি কত নিবা?

বিশ ট্যাকা দিয়েন।

আর কোনো কথা না বলে ওরা ট্রলি থেকে লাগেজ নামিয়ে গাড়িতে তোলে। লাগেজ বলতে দুটো ট্রাভেল ব্যাগ। সিটের পেছনেই জায়গা হয়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর ফিজা বললো, কিছু বলছো না যে?

কি বলবো! তুমি এখনই মাত্র এয়ারপোর্টের ঝামেলা সেরে বেরিয়ে এলে। এখনই তোমাকে বিরক্ত করা কি ঠিক হবে?

তাহলে কখন বলবে?

আজ রেস্ট নাও। কাল এক সময় বলি!

আজ অসুবিধা কি?

তোমার দিকটা ভেবেই বলছি।

আমার কোনো অসুবিধা নেই।

বলো কেমন আছ? মাশার সঙ্গে দেখা করেছিলে বলে ধন্যবাদ। সে তোমাকে চিনতে পারেনি। কি কি কথা হলো তোমাদের?

ফিজা একবার মাথা ঘুরিয়ে তাকায় হাসানের দিকে। যেন বেশ বিরক্ত সে। কিন্তু কিছু না বলেই সে ফের সামনের দিকে তাকায়।

হাসান ড্রাইভারের মাথার ওপর আয়নাটার দিকে তাকায়। দেখতে পায় লোকটা সেখানে তাকাচ্ছে একটু পরপরই। ড্রাইভারদের এ কৌতুহলটা খুবই জঘন্য। শুধু পেশাদার ড্রাইভারই নয়। কোনো সৌখিন ভদ্রলোকও স্টিয়ারিং ধরে বসলে সেখানে তাকাবে একটু পরপর। ড্রাইভারদের মত পেছনের সিটের ওরা কি করছে তা দেখার কৌতুহল হয়তো তার নাও থাকতে পারে। কিন্তু সেও এক সময় পেছনের সিটের মানুষগুলোর প্রতি কৌতুহলী হয়ে উঠতে পারে।

অন্য সময় হলে বা হাসানেরর গাড়ি হলে ফিজা সামনের দিকেই উঠে বসতো। তখন হাসান অনায়াসেই তার একটি হাত ধরে বলে উঠতে পারতো, এতদিন কেমন ছিলে? কিন্তু অচেনা কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে সে কেমন যেন আড়ষ্ট বোধ করে। হয়তো বা ফিজাও। তারও যেন কিছু বলতে আগ্রহ হয় না উৎকর্ণ ড্রাইভারের কারণেই।

ফিজা কিছুক্ষণ উসখুস করে বললো, মেন রোডেই গাড়িটা ছেড়ে দেবো।

তাহলে?

হাসান অবাক হয়ে ঘাড় ফেরায় ফিজার দিকে।

রিকশা করে যাবো।

তারপরই সে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বললো, গাড়ির এসি চলছে না?

ড্রাইভার জানালো, খারাপ।

তাহলে মেন রোডেই নামিয়ে দাও। গরমে আমার বমি পাচ্ছে।

হয়তো সত্যিই তার গরম লাগছিলো বেশি। কিন্তু হাসান তেমন একটা টের পাচ্ছিলো না।

কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার সত্যি সত্যিই রাস্তার এক পাশে ট্যাক্সিটা চাপিয়ে নিয়ে থামায়।

থামালে কেন?

হাসান অবাক হয়ে ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

ঘাড় ফিরিয়ে লোকটি জানায়, আপায় কইলো না মেইন রোডে নামায় দিতে!

তাই বলে এখানে?

আরো সামনে থামাইলে সার্জেনে ধরবো। এখান থাইক্যা বনশ্রীতে ঢুকবার রাস্তা বেশি না।

গাড়ি বিদায় করে দিতেই ফিজা হাসানের একটি হাত ধরে বলে উঠলো, ব্যাগটা আমাকে দিয়ে দাও।

দুটো এক সঙ্গে নিতে পারবে না।

রিকশায় উঠলে অসুবিধা হবে না।

চলো রিকশা দেখি।

তোমাকে দেখতে হবে না। বলেই ফিজা হাসানের হাতের ব্যাগটা নিজের দিকে টানে। আমিই পারবো।

কোনো কারণে সে হাসানের প্রতি রেগে উঠেছে হয়তো।

তারপরই সে একটি রিকশায় ব্যাগ দুটো তুলে দিয়ে নিজেও উঠে পড়লো। হাসান বললো, একা যাওয়াটা ঠিক হবে না। সন্ধ্যার পর ছিনতাইর ঘটনা ঘটেছে অনেক।

হলে হবে। এই চলো! বলে, সে রিকশা চালককে তাড়া দেয় যেন।

হাসান সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে দেখে ফিজার থমথমে মুখ। একবার পেছনের দিকে না তাকিয়ে চলে যাওয়া। সে ইচ্ছে করলে ফিজার একটি হাত ধরে বলতে পারতো, রাগ করছো কেন? রাগের কী এমন কারণ ঘটলো? আর তখনই তার রাগ পড়ে যেতো। হয়তো হড়বড় করে বলতে আরম্ভ করতো আসার আগে যে যে কথাগুলো তার মনের ভেতর জমেছে। কিন্তু হাসান বেশ ভালো করেই টের পাচ্ছে যে, মনিরাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে কেমন পস্তানোটাই না পস্তাচ্ছে! এখন থেকে সব কিছুই নেবে হালকা ভাবে। যত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ই হোক না কেন। অতটা গুরুত্ব আর দেবে না।

ফিজাকে নিয়ে রিকশাটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সে একটি চা স্টলে ঢোকে। এখানে বসে বসে এককাপ চা খেয়ে তারপর ঘরের উদ্দেশ্যে যাবে। একবার ডায়রিয়ায় সপ্তাহখানেক ভোগার পর মনিরা তাকে অনেকবারই বলেছে, বাইরের এসব স্টলের কিছুই যেন সে না খায়। পানি তো দূরের কথা এক কাপ চা পর্যন্ত না। এরা এমন জায়গা থেকে পানি আনে যা দেখলে এমনিতেই ডায়রিয়া হয়ে যাবে। হাসান আজকাল এসব কিছুই মানছে না। মনিরার চাপাচাপিতেই সিগারেট ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সে চলে যাওয়ার পর আবার শুরু করেছে। ভাবছে এখন থেকে মাঝেমধ্যে বারে গিয়ে নয়, প্রতিদিন ঘরে বসেই মদ গিলবে সে। জীবনটাকে যতটা নিয়ম আর শৃক্সক্ষলার নিগড়ে বেঁধেছিলো, সবই একে একে আলগা করে দেবে। নিজকে সব কিছু থেকেই মুক্ত করে ফেলবে। সমাজের যেখান থেকে সে উঠে এসেছিলো প্রয়োজনে সেখানেই আবার ফিরে যাবে। কথায় বলে, যেখান থেকে উৎপত্তি সেখানেই তার বিনাশ। কাজেই সে তো নিজের বিনাশই চায়। কী হয় এত নিয়ম মেনে? কি হয়েছে তার? কোন ভালোটা হয়েছে? কেবল মাশার কথা মনে হলেই তার খানিকটা খারাপ লাগে। ভালো থাকতে ইচ্ছে হয়। বেঁচে থাকার আগ্রহ জাগে। কিন্তু মাশাতো ওই মনিরার গর্ভেই ছিলো দশমাস। তার স্বভাব চরিত্র কি আর কমবেশি তাতেও সংক্রমিত হবে না? হবেই যে তারও যেমন নিশ্চয়তা নেই আর হবে যে না তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। পৃথিবীর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর যেন হয়তো বা হয়তো নয় এর সামান্য ফাঁকটুকুতেই সঙ্কুলান হয়ে যায়। বাকি স্থানটুকু ফাঁকাই পড়ে থাকে। কাজেই ছেলেকে নিয়ে অতটা না ভাবলেও চলবে। মানুষের জীবনে অনেক কিছুই ঘটতে পারে যা অপ্রত্যাশিত। আবার এমন অনেক প্রত্যাশিত ব্যাপারও আছে যার একটিও ঘটে না।

ঘরে ফিরে বাইরের কাপড় না ছেড়েই বিছানায় এলিয়ে পড়ে হাসান। কেন তার জীবনটা এমন হতশ্রী হতে বসেছে দিনদিন? তার নিজের কি কিছুই করার নেই? দিনরাত সব কিছুই যদি ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকে তাহলে কতটা সহ্য করা যায়? একটি মানুষের সহ্যের সীমারেখাই বা কতটুকু? যদিও হাসানের সহ্য শক্তি কম নয়। জীবনের এ স্তরে আসতে তাকে অনেক কিছুই সহ্য করতে হয়েছে। অনেক অপছন্দের বিষয়ের সঙ্গেও আপস করতে হয়েছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয় এই বুঝি ভেঙেচুড়ে মুখ থুবড়ে পড়লো। কী প্রয়োজন ছিলো নিজকে এতটুকু টেনে তুলবার? যেখানে ছিলো সেখানেই কি নিজকে সুখি আর সন্তুষ্ট রাখতে চেষ্টা করলে হতো না? কিন্তু সময় যে অনেকটা গড়িয়ে গিয়েছে। একটি ধাবমান ট্রেনের জানালা দিয়ে যেমন দেখা যায় বাইরের দৃশ্য কতটা গতিশীল হয়ে দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। তখন হঠাৎ করেই ট্রেনটাকে থামাতে চেন টানলেও সেটা আরো বেশ কিছুটা পথ সামনে গিয়ে থামবে। তখন পূর্ববর্তী দৃশ্যটির কাছে আসতে হলেও কিছুটা পথ উল্টো হেঁটে না এলে তা দৃশ্যমান হয়তো হবে না। হাসান কি তেমনি উল্টো হাঁটবে কিছু পথ? কিন্তু কতটা পথ হাঁটলে সে ফিরে যেতে পারবে তার শুরুর জায়গাটিতে? তা ছাড়া তার শুরুর জায়গাটি কি আর এতদিন পর শূন্য রয়েছে? তাতো থাকার কথা নয়। পৃথিবীর যে নিয়ম, প্রকৃতি পৃথিবীকে যেভাবে চালায় তাকে সেভাবেই চলতে হবে। আর সে নিয়মে একজনের শূন্য স্থান অন্য কেউ এসে পূরণ করবে। মনিরার শূন্য স্থানটিও কি পূর্ণ করবে কেউ? কে করতে পারবে? ফিজা? সে তো তেমন মেয়ে নয়। সে হয়তো মনিরার চাইতেও আরো উচ্ছৃক্সক্ষল জীবন কাটিয়ে এসেছে। হয়তো বা ক্লান্তি কাটাতেই কদিনের জন্য ফিরে এসেছে দেশে। কম পানির মাছ বেশি পানিতে গিয়ে পড়লে যেমন অকারণেই লাফালাফি করে, তেমনি এদেশীয় ছেলে-মেয়েরাও আমেরিকা কানাডা গিয়ে হঠাৎ করেই বাঁধন মুক্ত হওয়ার ফলে দিশেহারা হয়ে যায়। এর বেশি কিছু ভাবতে পারে না হাসান। সে দেশীয়রা যতটা না, আমাদের দেশীয়রা চড়ে যায় আরো কয়েক কাঠি উপরে। ফিজা যে খুব একটা লাফালাফি করেনি তাই বা সে বলে কি করে? দেশে তো বলার মত ছিছি করার মত অনেকেই থাকে। কিন্তু তাদের চোখের আড়ালে কে কি করছে তাতো আর ছিছির অপেক্ষায় থেমে থাকবে না।

হাসান শুয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে আরো ভালো হতো। কিন্তু প্রচন্ড ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও সে ঘুমুতে পারলো না। উঠে পড়ে জামা-কাপড় ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। শরীরটা যেন খানিকটা কাঁপছিলো। সে বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসতেই শুনতে পায় সেলফোনটা বাজছে। কোথায় রেখেছে মনে করতে পারে না। রিঙটোন শুনে এগিয়ে যেতে যেতে সে শুনতে পায় যেন প্যান্টের পকেটের ভেতরই রিঙ বাজছে। হ্যাঁ। প্যান্টের পকেটেই। সেটা বের করে হাতে নিতেই দেখতে পায় অচেনা লোকাল নাম্বার। এত রাতে কে করবে ফোন? ফিজা?

ফোন রিসিভ করে কানে লাগাতেই শুনতে পায়, তোমার কি মন খারাপ?

হাসানের ইচ্ছে হয় যে বলে, মন আমার ভালো ছিলো কখন যে খারাপ হবে? কিন্তু সেটা সে বলে না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ফিজার কণ্ঠ নিশ্চিত হয়ে বললো, কি বলবে বলো!

তুমি কি রেগে আছো?

নাহ। কেন রাগ করবো? কার উপর রাগ করবো? এমন কেউ কি আছে আমার?

তুমি এত রাত পর্যন্ত বাইরে কি করছো?

আমি বাইরে কি করে বলছো?

ল্যান্ড ফোনটায় কতবার রিং করলাম, বাজছে তো বাজছেই।

তখনই হাসানের চোখ পড়ে ফোনটার ওপর। সকালের দিকে কানেকশন খুলে ল্যাপটপের মডেমে লাগিয়েছিলো। সেটা তেমনিই আছে। খোলা হয়নি।

শুনতে পাচ্ছো?

বলো।

তুমি এতক্ষণ বাইরে না থাকলে আমি চলে আসতে পারতাম।

আরো দেরি হলে কেন আসতে পারবে না?

নিচের গেট তালা মেরে দিয়েছে!

কেয়ারটেকারকে বলো খুলে দেবে।

বাবা মা বলবেন না কোথায় যাচ্ছি? তখন কি বলবো?

কেন? বলবে আমার এখানে আসবে। রাতটা এখানেই থাকবে!

এ দেশে কি এসব চলে?

খুব চলে! অনেক বাবা মা এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না আজকাল।

ছিছি!

হাসান হেসে উঠে বলে, ছিছি করার কি হলো?

এদেশে এসব হলে তো ছিছি করারই কথা।

ও দেশে ছিছি না হতে পারলে এখানে হবে কেন?

কি আবোল তাবোল বকছো! এটা কি ওসব দেশের মত?

তাহলে এদেশের মানুষগুলো ওদেশে গিয়ে এখানকার মত থাকে না কেন?

যেখানকার যে নিয়ম!

কে বলেছে? ওখানকার কেউ তো এখানে এলে আমাদের মত হয়ে যেতে পারে না!

বুঝতে পারছি তোমার মুড ভালো নেই। কাল দেখা হবে।

কাল দেখা হবে না।

ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে হাসান।

কেন?

কালই শুধু নয়। সপ্তাহ খানেক দেখা হবে না।

কোথায় যাবে?

সুন্দরবনে।

ফিরবে কবে?

সপ্তাহ খানেক পর।

তাহলে আমাকেও সঙ্গে নাও।

সেটা হবে না। অফিসিয়াল কাজে যাচ্ছি। একটা টিমের সঙ্গে।

ওহ! ব্যাটারা প্রোগ্রাম বানাবার আর সময় পেলো না!

এখন ঘুমোও। রাখি!

হাসান ফিজার অপেক্ষা না করেই লাইন কেটে দেয়।

তারপর পাওয়ার অফ করে দিয়ে সেটাকে বিছানার উপর ছুঁড়ে ফেলে। আর তখনই বুঝতে পারে তার বেশ ভালো লাগছে। সে কি সত্যিই ফিজার উপর রেগে ছিলো? মিথ্যে বলে খানিকটা প্রতিশোধ নিলো? হবে হয়তো। ফিজা তার সঙ্গে বিনা কারণেই যদি রাগ দেখাতে পারে তাহলে তার মিথ্যে বলাটা তেমন দোষের হবে কেন? সকালের দিকে মুক্তার মা যেমন বলেছিলো, তার বুড়ো বিয়ে করতে পারলে সে বিয়ে করলেও তা দোষের হবে না। জীবনটা সমানে সমানে না হলে বয়ে বেড়ানো খুবই কষ্টের হয়তো। আজকাল মাঝে মধ্যেই হাসানের কাছেও জীবনটাকে খুব ভারি বলেই বোধ হচ্ছে। তবে এখন ফিজার সঙ্গে কতগুলো মিথ্যে বলার কারণেই হয়তো বা খানিকটা প্রতিশোধ নেবার মত হওয়াতেও তার মনটা হালকা হয়ে উঠেছে। সে কিচেনে গিয়ে চুলো জ্বালিয়ে পানি বসায়।

তারপর ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে প্লেটে নিয়ে অভেনে গরম করে নিয়ে খেতে বসে। কিন্তু ভুতের মত একা একা খেতে তার ভালো লাগে না। ইচ্ছে হয় সব বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তখনই তার মাথায় ভাবনা আসে, আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়? তার ফ্লাটটাকে এতিমখানা বানিয়ে ফেললে কেমন হয়। রুম তো অনেকগুলোই আছে। তার জন্য একটি রুম রেখে বাকিগুলো অনাথ বাচ্চাদের জন্য ছেড়ে দিতে পারে। তারা এখানে থাকবে খাবে। সময়ে হইচই ঝগড়াঝাটি মারামারি কিংবা কান্নাকাটিও করবে। ঘরটাকে তখন এমন ভৌতিক বলে মনে হবে না।

নতুন একটি বিষয়ে মাথা ঘামাতে পেরে যেন সে কিছুটা স্বস্তিও বোধ করে। তারপর ভাবতে ভাবতে কখন যে খেতে আরম্ভ করেছে বুঝতে পারে না সে। খাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে সে টের পায় যে খানিকটা হলেও খেতে পেরেছে। প্লেট-বাটিগুলো ধুয়ে কিচেনের তাকে রেখে দিয়ে সে কাপে গরম পানি ঢালে আর তখনই চুলোর পাশেই দেখতে পায় কফির কৌটা। কাপে এক চামচ কফির গুঁড়ো ছেড়ে দিয়ে সে ফিরে আসে নিজের রুমে। ল্যাপটপটা চালু করে চেয়ার টেনে বসে। মাশা বলেছিলো ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার ইনস্টল করে নিতে। ব্যাপারটা নিজে নিজেই পারে কিনা দেখতে হবে। আর এ সমস্ত ব্যাপারের সব কিছুর সঙ্গেই একটা হেল্পমেনু থাকে। তেমন কিছু থাকলে আর কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না।

কফি খেতে খেতে সে ইয়াহুর সাইটে গিয়ে ম্যাসেঞ্জার খুঁজতে থাকে। আর পেয়েও যায়। লেখাটার উপর ক্লিক করতেই কয়েকটা অপশন দেখায়। ইনস্টল লেখাটাতে ক্লিক করতেই তার প্রত্যাশিত কাজের বেশ খানিকটা এগিয়ে যায়। তারপর কেবল অপেক্ষা করা। অন্যান্য দেশগুলোর চাইতে বাংলাদেশের ইন্টারনেটের গতি তুলনামূলকভাবে কম। এখানে সব কিছুই হয় ঢিমে তালে। সে চা খেতে খেতে পুরোনো একটি ম্যগাজিনের পাতা উল্টাতে গিয়ে দেখতে পায় মাশার হাতের আঁকা-বাঁকা লেখা। একটি কাগজে খুব ছোটছোট করে আব্বু আব্বু কথাটাকে যতবার পেরেছে ততবারই লিখেছে। কাগজটার কোথাও সামান্য ফাঁক রাখেনি। ছেলেটা যে তাকে এতটা ভালোবাসে তার হাবে-ভাবে কখনোই টের পায়নি হাসান। এখন কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ দুটো আপনা আপনিই ভিজে আসে। তখনই তার চোখ পড়ে ল্যাপটপের পর্দায়। ইয়াহু ম্যাসেঞ্জার ইনস্টল শেষ। এখন রিস্টার্ট করতে হবে। সে তাই করে। মাশার কাছে আরেকটি মেইল পাঠায় কি ভাবে কি করতে হবে জানাতে। সেটা করতে পেরে তার মনটা বেশ হালকা মনে হয়। ঘড়িতে দেখলো রাত দুটো পেরিয়ে গেছে। না ঘুমালে সকাল সকাল আবার অফিসে যেতে পারবে না।

অফিসে এসে প্রথমেই সে তার গাড়িটাকে দেখে। বাইরের দিক দিয়ে কোনো কিছু খোয়া গেছে কি না। কিন্তু দেখে মনে হয় সব ঠিকঠাক আছে। বাইরে থেকে তেল আনিয়ে স্টার্ট দেবার সময় টের পাওয়া যাবে আদৌ ঠিক আছে কি না। সে গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরের দিকে উঠতে থাকে। এমডি সাহেবকে কাল কথা দিয়েছিলো আজ রিপোর্ট দেবে। কিন্তু কিভাবে আরম্ভ করতে কিছুই মাথায় আসছে না। সে বসে বসে ভাবছিলো আর মনে মনে ছক আঁকছিলো। তখনই দরজা ঠেলে জিহাদকে আসতে দেখে সে। অনেকদিন পর সে এদিকটায় এলো। এতদিন এদেশ ওদেশ করে ঘুরে বেড়িয়েছে। সে অবাক হয়ে বলে, কবে এলি?

এখনই। প্লেন থেকে নেমে তোর কাছেই চলে এলাম।

আয় বস। তো কেমন আছিস?

জিহাদ বসতে বসতে বললো, পালিয়ে থাকাটাকে কি ভালো থাকা বলে?

কেন পালাবি? তোর তো তেমন সমস্যা দেখি না।

সব কিছুই বাইরে থেকে বোঝা যায় না। আচ্ছা যাক সে কথা। তোর কি সময় হবে?

কেন? হাতে একটা জরুরি কাজ আছে।

ওটা কি এখনই শেষ করতে হবে? নাকি বিকেলের দিকে করলেও চলবে?

এখনই করার কথা। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।

বিষয়টা কি?

এই তো। আমাদের অ্যানুয়াল রিপোর্ট।

কিছুই করতে হবে না। একটা টেবল অব কনটেন্ট বানিয়ে সেটাতে এক একটা সাবজেক্টের নাম বসিয়ে প্রিন্ট করে নে। বাকি ডকুমেন্টতো আছেই। ফটোকপি করে সিরিয়ালি অ্যাটাচ করে দে।

হাসান অবাক হয়ে তাকায় জিহাদের দিকে। বলে, কাল থেকে এটা নিয়েই ভাবছিলাম। কিন্তু কিভাবে শুরু করবো সেটাই পারছিলাম না।

এত ভাবলে চলে না। যারা বেশি ভাবে, তাদের দিয়ে ভাবনাটা ছাড়া আর কিছুই হয় না। কাজের লোকদের ভাববার সময় নেই। এই আমাকেই দেখ না, কত কাজ করছি। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছি। কোম্পানির স্বার্থও দেখছি। কোন কাজটা আটকা পড়ে আছে?

আছে। তুই নিজেই আটকা পড়ে আছিস নিজের কাছে। বলে, কলিং বেল টিপলো হাসান। তখনই দরজা ঠেলে আমির আলি ঢুকলো। তার দিকে ডকুমেন্টগুলো বাড়িয়ে ধরে বললো, দুটো করে কপি নিয়ে এসো।

আমির আলি কাগজগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতেই, হাসান টেবল অব কন্টেন্ট সাজিয়ে ফেলে দুকপি প্রিন্ট নিয়ে নেয়। তারপর জিহাদকে বললো, তাহলে আমার কাজ হয়ে গেছে। এখন বল তোর জন্য কি করতে পারি? কফি খাবি?

অত সময় নেই। তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যাবো ভাবছিলাম।

কতক্ষণ লাগবে?

ঘন্টা খানেক।

তাহলে যেতে পারি। তোর বউয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলি?

জিহাদ হেসে বললো, দেখা করলে কি হবে?

আরে গাধা, তোর বউ না!

বউ কথাটা ঠিক আছে। কিন্তু মানুষটা পর হয়ে গেছে।

কেমন? হাসান হঠাৎ করেই জিহাদের কথাটা ধরতে পারে না।

কিছু মনে করিস না! বলে জিহাদ তাকিয়ে থাকে হাসানের মুখের দিকে।

তারপর বলে, তোর বউ অতমাস হলো গিয়েছে। কোথায় আছে, কার সঙ্গে আছে জানিস কিছু?

তখনই হাসানের মনের ভেতর কিছু একটা যেন টং করে উঠলো। জিহাদ কী বোঝাতে চাচ্ছে?

সে কেমন বিমূঢ়ের মত তাকিয়ে থাকে জিহাদের মুখের দিকে।

জিহাদ পকেট থেকে সিগারেট আর লাইটার বের করে নিজে একটি ধরিয়ে লাইটার আর প্যাকেটটা ঠেলে দেয় হাসানের দিকে।

তারপর বলে, হাজবেন্ড হিসেবে তাকে যথেষ্ট সময় দিতে পারি না। আর ঘরে বসে বসে যদি সে বোর হয়ে কাউকে আমার অজান্তেই বেছে নেয় আমার কি করার আছে?

তোর বউ তুই ঠিক রাখতে চেষ্টা করবি না? বলে একটি সিগারেট ধরায় হাসানও।

হয়তো আমি ঠিক রাখতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঘরের বউ বলে কথা। সে নিজে যদি ঠিক না থাকে আমার কী সাধ্য তাকে পাহারা দিয়ে রাখি!

হাসান আরো অবাক হয়ে যায়। বলে, এ কেমন কথা! তোরটা খাবে পরবে, তোরই বাড়িতে থেকে আরেকজনের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটাবে তা কি করে সম্ভব? সে রাইট কি তার আছে?

হয়তো আছে। যেহেতু সে আমার ছেলে-মেয়েদের পেটে ধরেছে। নিরাপদে জন্ম নিতে দিয়েছে। তাদের লালন-পালন করছে। ইচ্ছে করলে তো সে আমাকে না জানিয়ে খসিয়ে ফেলতে পারতো যে কোনো সময়। সে কৃতজ্ঞতা থেকেই বলতে পারিস ঝামেলা করতে চাচ্ছি না।

এটুকুর জন্যই সে সবটুকু অধিকার পেয়ে গেল?

প্রশ্নটা জিহাদকে করতে পারলেও হাসানের মনের কোথাও যেন আবার টং করে ওঠে কিছু। সে মনিরার কথা ভাবে। ভাবে মাশার কথা। একটি বিবাহিত মেয়ে কি বেশিদিন একা থাকতে পারে না? কেন পারে না? হয়তো সবাই একরকম হয় না। জিহাদের বউ নাসিমা আর হাসানের বউ মনিরা কি তবে একই রকম? তাহলে কি সেও জিহাদের মত বউকে বিশ্বাস করে করে ঠকেছে এতকাল?

জিহাদ মাথা নিচু করে কিছু একটা ভাবে হয়তো। অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়ে। তখনই আমির আলি দুহাতে কাগজ-পত্র নিয়ে ঢোকে। তার হাত থেকে কাগজগুলো নিতে নিতে হাসান বললো, দুটো কফি দিয়ে যেতে বলো।

আমির আলি চলে গেলেও জিহাদ তেমনিই একমনে অ্যাশট্রেতে ছাই ঘষতে থাকে সিগারেটের আগুন দিয়ে। হাসান তার দিকে একবার তাকিয়ে কাগজগুলোকে টেবল অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে স্টেপল করে ড্রয়ারে রেখে তালাবন্ধ করে দেয়। ভাবে কফিটা খেয়েই দুজন বেরোবে।

কফি দিয়ে যেতেই হাসান বললো, কফি নে। এটা শেষ করেই বেরুচ্ছি। তারপর তোর যেখানে ইচ্ছে নিয়ে যাবি।

সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে চেপে নিভিয়ে জিহাদ কফির কাপ হাতে নিয়ে বলে, মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস?

হাসান কফিতে চুমুক দিয়ে তাকায় জিহাদের দিকে। বলে, কি মনে হয়?

মনে হয় এতসব কার জন্য করেছি? আর সবই কি আমার একার জন্যে? এত আন্তরিকতা নিয়েই যদি সব করতে পারি, তাহলে আমাকে ঠকতে হবে কেন?

হাসান জিহাদের ভাবনাগুলোও যেন পড়তে পারে। বুঝতে পারে তার কষ্টটা কোথায়। কিন্তু সে তুলনায় তার নিজের কষ্টটাকেই যেন বড় মনে হয়।

মাথা নাড়াতে নাড়াতে জিহাদ হঠাৎ বলে ওঠে, ইচ্ছে হয় কোথাও পালিয়ে যাই। কিংবা নিজকে ভুলে যাই। তোর কি এমন কোনো অষুধের কথা জানা আছে যা খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়? শুনেছি পাগল হলে মানুষ কিছুই মনে করতে পারে না।

কফিটায় চুমুক দে! বলে, হাসে হাসান।

তারপর আবার বলে, এমন অনেক ধরনের অষুধের কথা জানি। কিন্তু বেশিদিন পাগল থাকা যায় এমন কোনো অষুধের কথা জানি না।

জিহাদ হঠাৎ হেসে উঠে কফিতে চুমুক দেয়। কফিতে ঘনঘন কটি চুমুক দিয়ে কাপটা রেখে দিয়ে বলে, ওঠ তো! আমার আরো কাজ আছে।

হাসান উঠতেই জিহাদ টেবিলের উপর থেকে সিগারেট আর লাইটার নিয়ে পকেটে পোরে। নিচে নেমে এসে একটি রিকশায় উঠে বলে, স্কালাস্টিকায় চলো।

হাসান মনে মনে ভিড়মি খায়। জিহাদের বাচ্চারা কি তাহলে সেখানেই পড়ে? আজকাল কি তার আয় বহুগুণে বেড়ে গেছে? তারপরই যেন সে লজ্জা পায়। ভাবে সে জিহাদকে ঈর্ষা করছে কেন? যার যেমন যোগ্যতা। জিহাদ তার নিজের যোগ্যতায় যদি তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আয় করে, তাহলে তার ঈর্ষা করাটা সাজে না। নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যকে ঈর্ষা করলে যাবতীয় ব্যর্থতা সাফল্যে পরিণত হবে না। সে বললো, তোর বাচ্চারা কি ওখানেই পড়ে?

আরে না! সেখানেই এক বাড়িতে যাবো।

তাই বল! বলে হেসে উঠলো হাসান। ভেবেছিলাম তোর বাচ্চারা ওখানেই পড়ে আর মনে মনে জেলাস হচ্ছিলাম!

নারে, জেলাস হবার মত তেমন কিছু নেই আমার ভেতর। আমি নিজেও কখনো জেলাস হই না।

ও বাড়িতে কেন?

আছে একটা কাজ। তুই শুধু দেখে যা। এক ধরনের মানুষ টাকার জন্য কি কি করে। কিভাবে ওরা নিজেদের ঠাঁট বজায় রাখে। যে দলে আমি নিজেও আছি!

হাসান বুঝতে না পেরে রাস্তার চলতি যান-বাহন আর পথচারীদের দেখতে থাকে।

কিছুক্ষণ পর রিকশাটা স্কলাস্টিকা পেরিয়ে যাবার আগেই জিহাদ দিক নির্দেশনা দিতেই রিকশাঅলা হঠাৎ করেই বাঁক নিলো। আরো কিছুদূর গিয়েই একটি বাড়ির সামনে থামাতে বললো সে।

রিকশা থেকে নেমে লোকটাকে ভাড়া দিয়ে বললো, পনের-বিশ মিনিট দেরি করলে আমরা তোমার রিকশাতেই উঠতে পারবো। এর বেশি দেরি দেখলে থেকো না।

জিহাদ এগিয়ে গিয়ে লিফটের বোতামে হাত রাখে।

তারপর দরজাটা খুলে যেতেই দুজন ভেতরে গিয়ে ঢোকে। জিহাদ বললো, বড়লোকের বেশ্যা বউ। বিভিন্ন পার্টি এসে নানা কাজের জন্য কন্ট্রাক্ট করে।

হাসান অবাক হয়ে বললো, বউ হয়তো নয়! কেপ্ট বলতে পারিস।

ওই একই হলো। কলমা পড়লেই বউ হয়, না হলে বউ করা যায় না?

হাসানের মুখে কোনো কথা যোগায় না।

লিফট থেকে বেরিয়ে একটি দরজায় টোকা দেয় জিহাদ।

হাসান বললো, কলিংবেল তো আছেই।

জিহাদ চাপা স্বরে বললো, এখানেই রহস্য।

কিছুক্ষণ পরই দরজা খুলে যায়। সিনেমার নায়িকাদের মত রঙচঙে সাজুগুজু করা এক মহিলা বললো, আপনি জিহাদ?

জি।

আসুন। সঙ্গে কে? আপনার তো একা আসার কথা ছিলো।

অসুবিধা নেই। আমার বন্ধু।

ওরা ঘরে ঢুকতেই মহিলা আবার বললো, এদিকে আসেন।

ওরা মহিলার পেছন পেছন আরেকটি ঘরে গিয়ে ঢোকে। এটাও ড্রয়িংরুমের মত করেই সাজানো। দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে মহিলা বললো, আমার নাম কি জানেন?

জিহাদ বললো, সখিনা।

বসেন বসেন! বলেই মহিলা হেসে উঠলো।

ওরা বসতেই মহিলা বিপরীত দিকে বসে বললো, আজকের জন্য আমি সখিনা। গতকাল কিংবা আগামী কালের জন্য ভিন্ন কেউ।

তারপরই সে বললো, জায়গাটার নাম কি?

বনানির কোথাও। বলেই জিহাদ এটি কার্ড বের করে মহিলার সামনে ঠেলে দিলো। ভদ্রলোকের নাম শামসুদ্দিন চৌধুরী। কার্ডে বাড়িটার ওনারের নাম ঠিকানা আর ফোন নাম্বার আছে। তা ছাড়া আপনার পারফর্মেন্সের উপরই আমাদের কাজ অনেকটা নির্ভর করবে।

সখিনা হেসে উঠে বললো, ও নিয়ে একদম টেনশন করবেন না! পে করবেন কিন্তু ডলারে!

পেমেন্ট হয়ে গেছে মনে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।

ম্যানি ম্যানি থ্যাঙ্কস! বলেন, ঠান্ডা-গরম কি খাবেন?

কিছুই না। আমাকে বলা হয়েছে শুধু কথাগুলো বলতে।

তারপরই জিহাদ দাঁড়িয়ে পড়ে বললো, আমরা এখন যাবো।

ঠিক আছে। বলেই সখিনা চট করে উঠে দরজাটা খুলে দিলো।

সঙ্গে আসতে আসতে সে হাসানের দিকে তাকাচ্ছিলো ঘনঘন।

তারপর হয়তো কৌতুহল দমন করতে না পেরে বলেই ফেললো, আপনার বন্ধুটিকে মনে হয় কোথাও প্রায়ই দেখি।

হাসানেরও এমন মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা সে তখনই ধরতে পারছিলো না।

জিহাদ বললো, ঢাকা শহরের একটি রাস্তা দিয়ে যদি প্রতিদিন আসা যাওয়া করেন, তাহলে একই মুখ দেখতে পাবেন। মাঝে মধ্যে দু একটা অচেনা মুখ এসে যায়।

তা হয়তো ঠিক। তবে রাস্তা-ঘাটে নয় হয়তো। বলে হাসানের চোখের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো সখিনা।

ওরা বেরিয়ে আসতেই হঠাৎ করে বাইরের গরম টের পেলো। হাসান বললো, ঘরটায় এসি চলছে মনে হয়।

তোর মাথার উপরই ওটা চলছিলো।

ওরা হাঁটতে হাঁটতে রিকশার সন্ধান করে। তখনই হাসানের মনে পড়ে যে, মহিলাকে বারে দেখেছে অনেকবার। আর সেও হয়তো তাকে খেয়াল করেছে বলেই কথাটা বলতে পেরেছে। হাসান মনে মনে ঠিক করে যে, ও বারটায় আর কখনোই ঢুকবে না। প্রয়োজনে দুচার বোতল ঘরেই নিয়ে যাবে।

জিহাদ বললো, ডলারে কত পেমেন্ট হয়েছে জানিস?

হাসান মাথা নাড়ে।

পাঁচশ!

হাসান অবাক হয়ে বলে, এত? কী আছে ওর মাঝে? এর চে আমার কাজের বুয়াটাও অনেকাংশে ভালো হবে!

জিহাদ হাসে।

তারপর বলে, আরে বুড়ো শকুনগুলো তো ওসব বোঝে না! রঙচঙ দেখেই খুশি। আর খুশি কত দামেরটা পেলো জেনে।

জিহাদের জন্য করুণা হয় হাসানের। খানিকটা কম আয় করলে কি খুব কষ্টে চলবে সে? অন্তত সেদিক দিয়ে মনে হয়, জিহাদের চেয়ে সে অনেকাংশে ভালো আছে। চাকরির খাতিরে এমন ধরনের নোংরা বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হয় না।

সন্ধ্যার দিকে বেশির ভাগ সময়ই তার খারাপ লাগতে আরম্ভ করে। ইচ্ছে হয় ঘরে চলে যেতে। কাজ করতে ভালো লাগে না। কয়েক দিন চলেও গিয়েছিলো। কিন্তু মহিবুল্লা সাহেব একদিন তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, হাসান সাহেব, বুঝতে পারছি আপনি যথেষ্ঠ বোর ফিল করছেন। এভাবে অনিয়ম করলে কি ভাবছেন আপনার সঙ্গে আমি খারাপ ব্যবহার করবো? আর সে কারণ দেখিয়ে রিজাইন লেটার ছুঁড়ে ফেলবেন আমার টেবিলে?

হাসান কেমন যেন বিভ্রান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে মহিবুল্লা সাহেবের প্রতি। কিছু একটা বলতে নিয়ে মুখ খুললেও মহিবুল্লা সাহেব একটি হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি চাকরি ছেড়ে দিলে আমি জোর করে ধরে রাখতে পারবো না। তার চেয়ে ভালো আপনি সপ্তাহ খানেক ছুটি নিয়ে আপনার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে আসেন। মন ভালো হয়ে যাবে।

হাসান অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো মহিবুল্লা সাহেবের দিকে। বললো, আমার তো তেমন আত্মীয়-স্বজন নেই স্যার!

আত্মীয়-স্বজন নেই এমন হতেই পারে না। আর সত্যিই তেমন হলে কিছু কিছু কাছের মানুষ থাকে। যাদের কাছে আপনি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কাছে যাদের প্রত্যাশা অনেক। তেমন কেউ না থেকে পারে না। কখনো কখনো তাদের অ্যাভয়েড করাটা খুবই কঠিন হয়ে যায়। যদিও মনে প্রাণে তাদের অ্যাভয়েড করতেই চাচ্ছেন। কিন্তু মন থেকে তেমন একটা জোর পাওয়া যায় না।

তখনই হাসানের মনে পড়ে কামরুলের কথা। যে রাগ করে অনেকদিন ধরে তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে।

হাসান হেসে উঠে বললো, আসলে আপনার ব্যাপারটা আমার উপর চালিয়ে দিয়ে খুব একটা ভালো করেননি।

সত্যি বলছি! বলে, খানিকটা হাসলেন মহিবুল্লা সাহেব। এমন ধরনের কেউ কেউ থেকে গেলে যাদের কাছে আপনার কোনো প্রত্যাশা নেই অথচ তাদের নিয়ে ভাববার যথেষ্ট কারণ রয়েছে, তাহলে দেখেছি জীবনটা তেমন একটা একঘেয়ে মনে হয় না।

তারপর তিনি কিছুক্ষণ পেপারওয়েট নেড়েচেড়ে বললেন, এই তো মাস ছয়েক হয়তো হবে না, আপনি ফিনল্যান্ড গিয়েছিলেন। তখন এক শুক্রবার খুব ভোরে ঘুম ভাঙতেই ঘরের কাউকে তেমন কিছু না বলে সাধারণ বেশেই বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তারপর চলে গিয়েছিলাম কুলাউড়া। সেখানে আমার তেমন কেউ নেই। একটি বন্ধু আছে। অহেদ আলি। যে আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে পেছনে পড়ে গিয়েছিলো অনেক আগেই। থেকে গিয়েছিলো গ্রামে। অনেক দিন যোগাযোগ নেই বলে হঠাৎ আমাকে দেখে চিনতে না পেরে আপনি আপনি করে কথা বলতে আরম্ভ করেছিলো। আমি খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। তখন তাকে ধরে বললাম, আমি মহিবুল্লা। একই সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। একবার তুই গাছ থেকে পড়ে পা ভেঙে ফেললি। কাউকে না জানিয়ে তোকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার কথা শুনে অহেদ আলি কেঁদে উঠেছিলো। সেদিনটা থেকে গিয়েছিলাম তার বাড়ি। তার বড় মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছিলো। আসতে পারিনি। আমরা দুজনের কেউ সারা রাত ঘুমুইনি। কিন্তু আমার কি লাভ হয়েছে জানেন? ফিরে এসে বুঝতে পারছিলাম, বেশ ঝরঝরে অনুভব করছি। মনের ভেতর যে বিরক্তি আর চাপ ছিলো, সেটাও টের পাচ্ছিলাম না।

হাসান বললো, এমন হলে তো ভালোই ছিলো। কিন্তু সত্যিই আমার তেমন কেউ নেই।

নেই বলছেন কেন? হয়তো ভুলে গেছেন। যান, ঘরে গিয়ে ভাবতে থাকেন। অফিস ব্যাপারটা একদম ভুলে যান।

হাসান অফিস থেকে ফিরে আসতেই দেখতে পেলো ঘরে মেয়েদের স্যান্ডেল। ড্রয়িং রুমের একটি সোফায় খোঁপায় আটকানোর একটি বড় ক্লিপ পড়ে আছে। তখনই ফিজা ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললো, এই তোমার সাত দিনে সুন্দরবনের অ্যাসাইনমেন্ট সেরে ফেরা?

হাসান সুন্দরবনের কথা শুনে অবাক হয়ে বললো, আমি সুন্দরবন গেছি কে বললো?

তাহলে কি আমি বানিয়ে বানিয়ে বলছি?

হাসান ধরতে পারে না ফিজার কথা।

ফিজা বললো, তাহলে কি তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছিলে?

কোন কথা বলেছিলাম বুঝতেই তো পারছি না!

কদিন আগে বলেছিলে না যে, অফিসের একটি টিমের সঙ্গে সুন্দরবন যাচ্ছো!

তখনই তার মনে পড়লো যে, ফিজা অকারণে তার সঙ্গে রাগ দেখানোতে সেও তাকে মিথ্যে করে বলেছিলো সুন্দরবনের কথা। ফিজার দিকে তাকিয়ে কথা ঘোরাতেই বললো, চাবি পেলে কোথায়? ঘরে ঢুকলে কিভাবে?

মুক্তার মা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে জেনেই এসেছি।

সে তোমাকে ঘরে থাকতে দিলো?

দেয়নি। বসে বসে পাহারা দিচ্ছে! বলেই হেসে উঠলো ফিজা।

তারপর আবার বললো, আমার অগোচরে দরজায় তালা দিয়ে দিয়েছে। ভেবেছে আমি কিছুই দেখতে পাইনি।

হাসান ইশারায় জানতে চাইলো, কোথায়?

ওইতো কিচেনেই আছে হয়তো। কেন?

তার দায়িত্বশীলতার জন্য পুরষ্কার দিতে হবে। ডাকো তো তাকে?

ফিজা সেখানে দাঁড়িয়েই ডাকতে লাগলো, মুক্তার মা!

মুক্তার মা কিচেন থেকে মুখ বাড়িয়ে বললো, কি করমু কন!

এদিকে এসো।

মুক্তার মা এলে হাসান বললো, বিয়ের মিষ্টি এনেছো?

ভাইজানের যেমন কথা! এতদিন বাদে কি মিষ্টি থাকে?

ফিজা বললো, কিসের মিষ্টি?

আরে এ মহিলা তো গত সপ্তাহে বিয়ে করেছে।

ফিজা কি বুঝে হাসতে নিয়েও ঠোঁট চেপে মুখ বন্ধ করে রাখে।

হাসান বললো, দুকাপ চা করে আনো। তারপর আজকের মত তোমার ছুটি।

মুক্তার মা চলে যেতেই ফিজা চাপা কন্ঠে বললো, এই বুড়ি আবার বিয়ে করেছে?

শুধু বিয়ে নয়। বুড়োটা তালাক ছাড়া আবার বিয়ে করেছে বলে সেও সেভাবেই বিয়ে করেছে!

ফিজা চোখ বড় বড় করে বললো, দেশটা কি তাহলে পাল্টে যাচ্ছে?

তেমন আর পাল্টাচ্ছে কই? বরং মাঝে মধ্যে মনে হয় পেছনের দিকেই হাঁটছে।

হাসান বললো, তুমি বসো, কাপড় পাল্টে আসি।

এখন নয়! তোমাকে নিয়ে বেরোবো।

হাসান টাইয়ের নট আলগা করতে করতে বলে, আজ আর বাইরে বেরুচ্ছি না। সারাদিন তো বাইরেই ছিলাম!

আমার কিছু কেনাকাটা লাগবে।

ও তুমি যাবার সময় করে নিও।

তোমাকে নিয়ে বেরুবো বলেই তো সেই কখন থেকে বসে আছি!

হাসান দুহাত জোড় করে বললো, আমাকে নিয়ে আর টানাটানি করো না! এ সময়টায় খুবই টায়ার্ড ফিল করি!

মুক্তার মা চা নিয়ে এসে টেবিলে রেখে বললো, আমার কাজ শেষ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

মুক্তার মা চলে গেলে হাসান ফিজাকে বললো, আমি একটু আসছি।

তারপর সে তার ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টিয়ে বাথরুমে ঢুকলো। সংক্ষিপ্ত গোসল সেরে প্রতিদিনই এক কাপ চা খায়। আজও সুযোগ যখন আছে তা ছাড়তে চায় না।

ফিজাকে বসিয়ে রেখেই হাসান বাথরুম থেকে গোসল সেরে বেরিয়ে আসে।

ফিজা বললো, এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল?

তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে হাসান বললো, মেয়েদের সময় বেশি লাগে। ছেলেদের ততটা সময় লাগে না।

ফিজা চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিতে নিয়েও থেমে গিয়ে বললো, জেন্ডার ধরে কথা বলবে না! মুখে চা ছুঁড়ে দেবো কিন্তু!

হাসান হাসতে হাসতে চায়ের কাপ হাতে নেয়। তারপর বলে, অফিস থেকে ফিরে এলে আমার কিছুই ভালো লাগে না। মাশার সঙ্গে মনিরা ভালো ব্যবহার করছে না। ঘরে এলেই খিটিমিটি লেগে যায়। ছেলেটা চলে আসতে চাচ্ছে।

চলে আসতে বলো। আসলে মাশা ওখানে ভালো নেই।

তোমাকে কিছু বলেনি?

বলেছে। কিন্তু একজন বাইরের মানুষের কাছে যতটুকু বলা যায় ততটুকুই। সন্তান হিসেবে মাকে সে ছোট করতে চায়নি হয়তো। তা ছাড়া বাচ্চা মানুষ সারাক্ষণ ঘরে থাকে। বাইরে গিয়ে একটু ছুটোছুটি করতে না পারলে মন ভালো হবে কি করে! আমি পার্কে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমার সঙ্গে তেমন চেনাজানা নেই বলে প্রথম প্রথম বের হয়নি।

হতে পারে মনিরাই বলেছে অচেনা কারো সঙ্গে বাইরে না যেতে। তা ছাড়া এখানে থাকতে আমিও কতবার এমন কথা বলেছি।

চা খাওয়া শেষ করে হাসান বললো, মেইলগুলো চেক করে দেখি। ছেলেটার নতুন কোনো মেইলও থাকতে পারে।

ফিজা চায়ের কাপ রেখে হাসানের একটি হাত ধরে বললো, এখন না। বাইরে থেকে এসে।

হাসান আলতো করে হাত ছাড়িয়ে নিতে চেয়ে বললো, রাত করে বাইরে বেরোবো না।

রাত কত হয়েছে আর? মোটে নটা!

তবুও।

প্লিজ চলো না! বলেই ফিজা হাসানের কোমর পেঁচিয়ে ধরে। হাসানের কাছে ব্যাপারটা ভালো লাগে না। শরীরটা কেমন শিরশির করে। সে ঠেলে ফিজাকে সরিয়ে দিতে চাইলে ফিজা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। তারপর তার খোলা বুকে মুখ আর গাল ঘষতে থাকে।

হাসান এক হাতে ঠোঁট মুছে নিয়ে ফিজাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। তার কেমন যেন ঘিনঘিন লাগে। মনে হয় ফিজার পুরো শরীরেরই দগদগে ঘা আর পূঁজ বিজবিজ করছে। কিন্তু ফিজার বাহু বন্ধন থেকে নিজকে মুক্ত করতে পারে না সে। কিন্তু একজন কামতাড়িতা নারী যদি তাকে খানিকটা জোর করেই থাকে তাহলে তারও কিছু একটা করা উচিত। কিন্তু মন থেকে সায় পায় না। একবার সে ফোনে বলেছিলো, সে দেশে আর যাই হোক শরীরের কষ্টে ভুগতে হয় না। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত যৌন সম্পর্কের ফলে আশ্বীন-কার্তিক মাসের দিকে কোনো কোনো মাদী কুকুর অসুস্থ হয়ে পড়ে। শরীরের ক্ষতে অনেক সময় মাছিও ভিনভিন করতে দেখেছে সে। দৃশ্যটা মনে পড়তেই হঠাৎ তার বমির বেগ হয়।

ফিজা বিস্মিত হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, কি হলো?

বমি পাচ্ছে! বলতে বলতে বাথরুমের দিকে ছুটে যায় হাসান। দরজা খোলার আগেই হড়হড় করে বমি করে ফেলে। খালি পেট ছিলো বলে তেমন কিছু বের হয়নি। খানিকক্ষণ আগেই যে চা টুকু খেয়েছিলো সেটাই বেরিয়ে এসেছে।

পেছন থেকে ফিজা তার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, হঠাৎ করে কী এমন হলো? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে? ডাক্তারের কাছে যাবে?

না, দরকার নেই।

তাহলে কেন এমন হলো?

হাসানের ইচ্ছে হয় বলে, ফিজা তুমি চলে যাও। তোমাকে কেন যেন খুবই ঘিনঘিনে মনে হচ্ছে। পুরোটা তোমাকেই মনে হচ্ছে নোংরা। অসুস্থ মাদী সারমেয়।

কিন্তু সে কথা না বলে, বললো, কিছুক্ষণ পরই ঠিক হয়ে যাবে।

হাসান ফিরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। শরীরটা কেমন কাঁপছে মনে হয়। ফিজা পাশে এসে বুকে হাত দিয়ে বসতেই তার সেই ঘিনঘিনে অনুভূতিটা ফিরে আসে আবার। সে তাকাতে পারে না ফিজার দিকে। এক পাশে মুখ ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে।

অনিশ্চিত কন্ঠে ফিজা বললো, নাকি চায়ে কিছু ছিলো?

হাসানের তা মনে হয় না। চায়ে কী এমন থাকবে যে ওতে বমি হওয়ার মত ব্যাপার ঘটতে পারে? তবুও ফিজাকে যেন আশ্বস্ত করতেই সে বললো, হতে পারে খালি পেটে চা খাওয়া ঠিক হয়নি।

ফিজা তখনই বললো, তাহলে চলো খেয়ে নাও। ভালো লাগবে।

হাসান মুখ বিকৃত করে বললো, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।

তার মনে হচ্ছিলো যে, এখান থেকে ফিজা এখন চলে গেলেই ভালো হতো। তাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু বেচারি মনে কষ্ট পাবে ভেবে কিছু বলতেও পারছে না।

ফিজা উঠে গিয়ে টেবিলে খাবার সাজায়।

তারপর হাসানকে টেনে তোলে। সামান্য একটু হলেও মুখে দাও। তারপর ঘুমোতে চেষ্টা করো। আমি থাকলে কি সুবিধা হবে?

কি আর সুবিধা হবে? তা ছাড়া একটি মেয়ে সারা রাত অন্যের ঘরে থাকলে তা ভালো দেখাবে না।

ফিজা হঠাৎ চোখ তুলে তাকায় হাসানের দিকে। কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে যায়।

তারপর বলে, তুমি খেয়ে নিও। আমি যাচ্ছি!

ফিজা দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেও হাসান কিছু বলতে পারে না।

মাঝ রাতে ঘুম ভাঙে হাসানের।

পেটে যথেষ্ট ক্ষিধে আছে। সে উঠে টেবিলের দিকে যায়। উল্টে-পাল্টে দেখে। কিন্তু খাবে কি খাবে না দ্বিধায় ভোগে। শেষটায় ক্ষিধেটা যাতে মরে সে অনুপাতে খেয়ে ওঠে। একটি সিগারেট ধরিয়ে সে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। ইনবক্সে দুটো মেইল দেখতে পায়। একটি মাশা আরেকটি মনিরা। মনিরা কি মনে করে মেইল করলো? সে কিছুটা অবাক হয়ে মনিরার মেইলটাই আগে দেখে। আসলে ওখানে বসেও তার ওপর খবরদারী করছে সে। ফিজার সঙ্গে হাসান যেন কোনো ধরনের সম্পর্ক না ঘটায়। বিয়ে করার তো প্রশ্নই ওঠে না। নইলে তাকে জেলের ঘানি টানতে হবে।

ইনবক্স থেকে সেটাকে মুছে দেয় হাসান। তারপর মাশার মেইলটা খোলে। আকৃতি দীর্ঘ। অনেক কিছুই লিখেছে। সামনের মাসে সে একাই দেশে ফিরে আসছে। একদিন মনিরা ডানিয়েলকে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা সে দেখতে পেয়েছিলো বলে, রাতের বেলা মনিরা খুবই মেরেছে তাকে। ধাক্কা দিয়ে বিছানা থেকে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলো। পড়ে গিয়ে তার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা মচকে গেছে। মেইলটা অনেক কষ্ট করে চারদিনে সে লিখেছে।

মাশার জন্য খুবই খারাপ লাগতে থাকে হাসানের। ইচ্ছে হয় এখনই সে ছুটে গিয়ে তাকে নিয়ে আসে।

দেয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলো মাত্র বারটা! ভালো করে তাকাতেই দেখতে পায় সেটা বন্ধ হয়ে আছে। টেবিলের উপর হাত ঘড়িতে সময় দেখলো তিনটা দশ। আরেকটি সিগারেট ধরিয়ে সে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। অনেক দূরের অন্ধকারে বাড়িগুলো কেমন ভৌতিক আর নিঃসঙ্গ দেখায়। তবুও কোনো কোনো বাড়ির জানালায় আলো দেখা যায়। সে আলোতে কখনো হয়তো নড়তে দেখা যায় মানুষের ছায়াও।

ল্যান্ড ফোনটায় হঠাৎ রিঙ বাজতে থাকে। হাসান ঘরে গিয়ে ফোন ধরতে উৎসাহ পায় না। ভাবে কয়েকবার বেজে এমনিতেই থেমে যাবে। কিন্তু একবার দুবার তিনবার বাজলে হাসান ফিরে গিয়ে ফোন ধরে। হ্যালো।

কেমন আছ?

ভালো।

মনিরার কণ্ঠস্বর চিনতে পারে হাসান। সে বলে, মাশা কেমন আছে?

ভালোই। তবে খুবই খারাপ হয়ে গেছে আজকাল! স্কুলের খারাপ ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশে দিনদিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!

এমন মনে হলো কেন?

ভাবতে পারো? তোমার ছেলে আমাকে সন্দেহ করে!

কি ধরনের সন্দেহ?

মনিরা ভিন্ন কথা পাড়ে। ওকে সামনের মাসেই দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

একা থাকতে পারবে? তুমিও কেন চলে আসছ না?

কি হবে দেশে ফিরে? কি আছে ওখানে? সেই তো সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি বাপ-বেটার ফাই-ফরমাশ খাটা!

ওখানে থাকলে কেউ ফাই-ফরমাশ করবে না?

শোনো, ফিজা বদমাশটাকে একেবারেই পাত্তা দেবে না বলছি! ও একটি নষ্ট মেয়ে!

তোমার কি অবস্থা? ছেলে কেন মাকে সন্দেহ করে তা কিন্তু বলোনি!

সে বোঝেই বা কতটুকু? তার সন্দেহ করাটাই তো অন্যায়!

হাসান হেসে উঠে বলে, বাচ্চারা অস্বাভাবিক কিছু দেখলেই তো বলবে নাকি?

, এরই মধ্যে বাপের কানেও পৌঁছে গেছে?

মনিরার কন্ঠে ঝাঁঝ স্পষ্ট। তোমার ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সামনের মাসের আঠারো তারিখে। বিমানের নাম্বার আর সময় পরে মেইলে জানিয়ে দেবো!

তোমার কাজকর্ম চলছে কেমন?

চলছে! যেমন চলার কথা!

ডানিয়েল কেমন আছে? তার বয়স কি তোমার চেয়ে কম?

মনিরা রেগে উঠে বললো, ফিজা মাগিটা তোমার কান ভারি করেছে, না! শয়তানটা নিজে নষ্ট হয়েছে তো হয়েছেই, আমার সংসারটা ভাঙতেও উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি!

হাসান বলে, বাগানে বেড়া না থাকলে গরু-ছাগল ঢুকতেই পারে। দূর থেকে কি আর সেটা সামাল দেয়া যাবে?

তুমি কোনো ক্ষেত বা বাগান নও। নয়-ছয় আমাকে বুঝিও না! মুক্তার মা এখনো আছে তো?

আছে। ভাবছি কাল থেকে ওকে আসতে মানা করে দেবো।

কেন? স্বাধীনতায় ব্যাঘাত হচ্ছে?

সে জন্যে না। সে আমার এখানেই কাজ করে আর গোয়েন্দাগিরী করে বলে। তোমার ইনফর্মার বলেই তাকে বাদ দিয়ে দেবো।

তাহলে তোমার খাওয়া আর ঘর গোছগাছ চলবে কি করে?

এটাও ঠিক করে রেখেছি। ফ্লাটটা বিক্রি করে দেবো।

তাহলে? আমাদের দিকটা একবার ভাবলে না?

ভেবেছি বলেই ঠিক করেছি বেচে দিয়ে শহর থেকে চলে যাবো। কোনো গ্রামের দিকে গিয়ে ঘরবাড়ি-জমি-ক্ষেত কিনে নেবো।

মনিরা কিছু না বলেই ফোন রেখে দেয়।

রিসিভার রাখতে রাখতে হাসান হেসে ওঠে। বেশ কিছুটা টাইট দেয়া গেছে। তবে তার মনে হয় মনিরা এমনিতেও তার সঙ্গে হয়তো থাকবে না। একবার কি একটা নিয়ে হঠাৎ বলে উঠেছিলো, রাখলে রাখো না রাখলে নাই। তোমার সঙ্গে ঘর না করলেও আমার চলবে। সেই থেকে মনিরার উপর থেকে তার বিশ্বাস দিনদিন হালকা হয়ে উঠেছে। ও কথা শোনার পর মনিরাকে এক বিন্দুও বিশ্বাস করতে পারে না সে। তা ছাড়া যাকে বিশ্বাস করা যায় না, তার জন্য মমতা বা ভালোবাসা অনুভব করাটাও বোকামি হয়তো।

এরই মধ্যে ফিজা একদিন তাদের বাড়ি যেতে বলেছিলো। কিন্তু হাসান কাজের ছুতোয় সেদিকে আর যায়নি। মহিবুল্লা সাহেব দেশে নেই বলে তারও কোনো কাজ নেই। অফিসে গিয়ে বিনা কাজে সময় পার করতে তার ভালো লাগে না। তাই ঘর তালা দিয়ে নিচে নেমে কেয়ারটেকার খবিরকে বললো, খেয়াল রেখো। আমি কদিন না ও ফিরতে পারি। কে আসে যায়, আমার ঘরের তালা ভাঙে কি না দেখো।

তারপর একটি একশ টাকার নোট খবিরের সার্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বেরিয়ে আসে হাসান। ঘর থেকে বেরোবার আগে তেমন একটা পরিকল্পনা তার ছিলো না। কিন্তু গাড়িটার কথা ভেবেও সেদিকে না এগিয়ে একবারে গেটের বাইরে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই তার মনে হয় কামরুলের সঙ্গে অনেকদিন দেখা নেই। কেমন আছে কামরুল? এখনও কি তার ওপর রেগে আছে?

সে আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে এদিক ওদিক তাকায়। রিকশা পাওয়া যায় কি না দেখে।

হঠাৎ তার পোশাকের দিকে দৃষ্টি পড়ে। এ পোশাকে গ্রামাঞ্চলে গেলে লোকজনের কৌতুহল বাড়বে। খুবই সাধারণ পোশাকে যাওয়া উচিত। সে ইন করা সার্টটা টেনে বের করে ফেললো। টাইটাকে খুলে খুবই সতর্ক ভাবে যাতে কারো চোখে না পড়ে এমনভাবে গুটিয়ে রাস্তার পাশে ফেলে দিলো।

তারপরই প্রশান্তির শ্বাস ফেলে একটি চলন্ত রিকশাকে হাত তুলে ডাকে। বলে, চলো বাসস্ট্যান্ড।

বছর খানেকের ভেতরই বলতে গেলে এদিকের রাস্তা ঘাট বদলে গেছে অনেকটা। গ্রামকে গ্রাম বলে মনে হয় না। অনেক বাড়িতেই বিল্ডিং দেখা যাচ্ছে। রাস্তাও আর কাঁচা নেই। অ্যাসফল্টের কালো আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে চিরাচরিত সেই বেলেমাটি। আগে বাস থেকে নেমে হেঁটেই সে চলে যেতো কামরুলের বাড়ি। কিন্তু এখন তার হাঁটতে ইচ্ছে করছিলো না। কামরুলের মেয়ে কাঁকন ছানার সন্দেশ পছন্দ করতো। এখন তো বলতে গেলে কত বড় হয়ে গেছে! আগের মত তার পছন্দ থাকলেও কৈশোরের সে উচ্ছ্বাসে ভাটা পড়েছে অনেক। অথচ তিন-চার বাছর আগেও তাকে দেখতে পেলে ছুটে এসে কোমর জড়িয়ে ধরে বলতো, কেমন আছ কাকু? আমার জন্য কি আনছো?

রিকশা থেকে নামতেই এক যুবক তাকে সালাম দিয়ে বললো, আপনে হাসান কাকা না?

হাসান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো যুবকের মুখের দিকে।

আমারে চিনতে পারেন নাই?

হাসানের মুখের ভাব পরিবর্তন হয় না।

সে বললো, আমি লাভলু! আপনে আমারে ইস্কুলে ভর্তি করাইছিলেন।

মনে পড়ে হাসানের। সে তো অনেক বছর আগের কথা। তখন হাসানের বয়স হয়তো এ যুবকটির সমানই হবে। সে বললো, এত আগের কথা মনে আছে তোমার?

কেন থাকবো না? আপনে আমারে ইস্কুলে ভর্তি না করাইলে তো আমি আইজ মাস্টারি করতে পারতাম না!

তাই? তুমি মাস্টারি করছো?

জি কাকা!

খুব খুশি হলাম!

তারপর সে আবার বললো, রাস্তা-ঘাট হঠাৎ করেই কেমন বদলে গেছে। নতুন ঘরবাড়ি হয়েছে বলে পুরোনো রাস্তা ভুলে গেছি।

চলেন, আমি নিয়া যাই।

কামরুল যুবকটির সঙ্গে যেতে যেতে বলে, কামরুল কেমন আছে? শরীর ভালো আছে তো? তার মেয়ে কাঁকন কত বড় হয়েছে?

যেতে যেতে জানা যায় যে, মাস ছয়েক হতে চললো কামরুল মারা গেছে। কী একটা রোগ হয়েছিলো। ঠিকমত চিকিৎসাই পায়নি নাকি ডাক্তার রোগ ধরতে পারেনি এমন ধরনেরই সন্দেহ সবার মনে। সময় মত শহরের ভালো কোনো ডাক্তারকে দেখাতে পারলে হয়তো কামরুল এখনও বেঁচে থাকতে পারতো। সংসারের টানাটানির কারণে কাঁকনের লেখাপড়া প্রায় বন্ধ। টাকা পয়সার অভাবে পরীক্ষার ফরম পূরণ করতে পারছে না। সময়ও খুব একটা নেই। লাভলু বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো কামরুল বেঁচে থাকতে। কিন্তু লেখাপড়া শেষ না করিয়ে মেয়ের বিয়ে দেবে না বলে জানিয়েছিলো। কিন্তু এখন যদি সে লেখা পড়া না করতে পারে, তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কি? কিন্তু কাঁকনের মা রাজি হচ্ছে না।

হাসান বললো, কাঁকণ তোমাকে পছন্দ করে?

লাভলুর মুখে হাসি দেখা যায়। মাথা নিচু করে সে ঘাড় চুলকায়। কিন্তু হাসানের জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর দেয় না।

কাঁকনই আগে দেখতে পায় হাসানকে। কিন্তু আগেকার মত ছুটে এলেও বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এতদিন পরে আসলা? বলেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে সে। চোখে ওড়নার প্রান্ত চেপে ধরে বলে, সেই তো আসলা, আরো কয়টা মাস আগে আসলে কি ক্ষতি হইতো?

হাসানের ভালো লাগে না। কান্নাকাটি তার সহ্য হয় না। সে এগিয়ে গিয়ে কাঁকনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আমার বাবা মা কেউই তো নেই। তবুও তো তোর মা আছে। কাঁদছিস কেন?

তখনই কাঁকন হাসানের বুকে মাথা রেখে আরো জোরে কেঁদে ওঠে।

কামরুলের স্ত্রী শাহেদা চোখ মুছে বললো, মানুষটা নিজে তো মরলোই। সঙ্গে সঙ্গে আমরা মা মাইয়া দুইজনরেও জ্যান্ত মাইরা থুইয়া গেল। যেই কিছু জমি-জমা ছিলো, সেইটাও বন্ধক দিয়া টাকা আনতে হইছে। সামনের দিনগুলা কেমন কইরা পার করি চিন্তা করতে গেলে সব কেমন খোয়া খোয়া লাগে!

শাহেদা নিজেই যেন বিশালাকার একটি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হাসানের সামনে। হিসেবে যদি ভুল না হয় তাহলে শাহেদার এখন বত্রিশের মত বয়স চলছে। কাঁকনের হবে পঁনেরো। যেখানে মাকেই আবার পাত্রস্থ করা যাবে সেখানে মেয়ের বিয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু লাভলু বসে আছে এ ব্যাপারে একটি হ্যাঁ না শুনতে। তবুও শাহেদার একই কথা, মানুষটার বড় আশা ছিলো মেয়েরে অনেক লেখাপড়া করাইবো।

তাদের কথার মাঝে হাসান কিছু বলাটা সঙ্গত মনে করে না। তাই সে কাঁকনের ওপরই ব্যাপারটা ছেড়ে দেয়। কাঁকন জানায় আরো কিছু দিন যাক।

লাভলু প্রায় ক্ষেপে উঠে বলে, আর কত? এই কইরা কইরা তো গ্রামে আমার মুখ দেখানের পথ রাখলা না!

হাসান লাভলুকে বললো, বাপ, রাগ করিস কেন? যাক না কটা দিন। মাসখানেক পর আমি আবার আসবো। তখন এ নিয়ে কথা বলা যাবে।

লাভলু মন খারাপ করে উঠে যায়।

হাসান ইচ্ছে করলে তাকে ডেকে ফেরাতে পারতো। কিন্তু তাকে কী বলে প্রবোধ দেবে সে? তাই যে যাওয়ার তাকে যেতে দেয়াটাই অনেকাংশে নিরাপদ।

কাঁকনের দিকে তাকিয়ে হাসান বললো, শুনলাম তোর পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছিস। এ নিয়ে কিছু ভেবেছিস?

কাঁকন চোখ তুলে তাকায় হাসানের দিকে। কিন্তু কিছু না বলে ফের চোখে ওড়না চেপে ধরে।

হাসান তাকায় শাহেদার দিকে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে শাহেদা বললো, আপনের উপর তেনার খুব আশা-ভরসা ছিলো। অসুখে পড়ার আগে একবার আপনের ওখানে গেছিলো। কিন্তু আপনের দেখা পায় নাই। দেশের বাইরে নাকি ছিলেন।

হাসান কামরুলের কথা ভেবে কষ্ট পায়। যে তার কাছে এতটা আশা করেছিলো তার জন্য সে কিছুই করতে পারলো না। তা ছাড়া সময়ও অনেক সময় মানুষকে নানাভাবে ঘুরিয়ে মারে। সে চক্রে পড়ে কামরুল হন্যে হয়ে খুঁজলেও হাসানের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। কিন্তু এখন কামরুলের পরিত্যক্ত সংসার নিয়ে সে করবেটা কি? তাদের জন্য সে কতটুকুই আর করতে পারে!

দুপুর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। হাসান বললো, দেখ, একটা মানুষ চইলা গেছে বইলা আমাদের সব কিছুই বন্ধ হইয়া যাইতে পারে না। এখন তোমাদের জন্য আমি কি কি করতে পারি বলো! আমার সাধ্যে যতটা সম্ভব আমি করতে তৈরিআছি।

কাঁকন ওড়না সরিয়ে চোখ মুছলে হাসান বললো, তুই কোন ক্লাসে যেন ছিলি?

ম্যাট্রিকের ফরম পূরণ চলছে।

তুই ফরম ফিলাপ করতে পারিস নাই। এই তো?

কি করে করবো?

টেস্ট পরীক্ষাতে অ্যালাও হইছিলি?

কাঁকন মাথা নেড়ে বললো, সব গ্রপে আমার পজিশন সেকেন্ড।

তা হইলে তো খুবই ভালো রেজাল্ট! স্কুল তো এখনো খোলা আছে। তাই না?

আছে।

চল। বলে হাসান উঠলে শাহেদা বললো, একবারে খালি মুখেই বাইর হইবেন?

ফিরা আসবো তো। তখন মুখ ভরাইও!

স্কুলে এলে দুএকজন পুরোনো বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়ে যায় হাসানের। তাদের দিকে তাকিয়েই হাসানের মনে পড়ে যে বয়স তারও অনেক হয়েছে। কিন্তু বন্ধুদের চিনতে পারলেও বন্ধুরা তাকে চিনতে পারে না। হাসান অবাক হয়ে হামিদুল্লার কাছে গিয়ে বলে, কিরে হামিদ! তুই তো এতটা বুড়া হইয়া যাস নাই যে আমারে মনে করতে পারবি না!

হামিদুল্লা আরো অবাক হয়ে বলে, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পরলাম না ভাই!

হাসান হেসে উঠে বললো, চোখে চশমা তো ঠিকই আছে। না চেনার কি হইলো?

হামিদুল্লা অবশেষে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরে হাসানকে। ঠিক চিনতে পারি নাই ভাই! কিছু মনে করিস না!

চাইর পাঁচ বছরে যারা মানুষরে ভুইলা যাইতে পারে তাগো ব্রেন বইলা জিনিসটা ঠিক আছে কি না আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে!

হামিদুল্লা হাসানের একটি হাত ধরে বলে, কত দিকের সমস্যা নিয়া দিন পার করতে হয়। সব দিক সামাল দেওয়াটাও অনেক সময় কঠিন হইয়া পড়ে!

হাসান প্রসঙ্গ পাল্টাতেই হয়তো বলে, কি কাজ করতে আসছিলি? তা কি শেষ হইছে?

ছেলেটার ফরম ফিলাপের টাকা দিয়া গেলাম।

আমিও তো কামরুলের মেয়েটারে নিয়া আসছি।

খুব ভালো করছস। শুনছি মেয়েটা পড়শুনায় খুবই ভালো।

কিন্তু জমি-জিরাত নাই। আলাদা আয়ের কোনো ব্যবস্থা নাই। কামরুলের বউ-মাইয়া বাঁচবো কি খাইয়া?

হাসানের কন্ঠে আক্ষেপ গোপন থাকে না।

কামরুল তো তর উপরে খুবই আশা ভরসা রাখতো। তুই কি তাদেরে ফালায় দিবি?

আমি তো দাতা হাজি মহসিন হইয়া জন্মাই নাই! তোরাও তো কামরুলের ভালো বন্ধু আছিলি।

এখনও আছি। তবে সামর্থে যতটুকু কুলায় তার বেশি করতে পারি না। আমরা কয়েকজনে মিল্যাই তো পরিবারটারে এতদিন চালাইয়া রাখছি।

খুব ভালো করছস। বাকি দিনগুলা কেমনে চলবে? তাদের মাসখানেক চলতে কেমন খরচ হয় সেইটা তো এতদিনে তোদের জানা হইছে আশা করি।

আমরা তিনজনে এক হাজার কইরা তিন হাজার দিতাম।

তাতে চলতো?

গরিবের যেমন চলে আর কি!

তখনই কাঁকন এগিয়ে এসে বললো, কাকু চলো!

টাকা জমা দিছিস?

কাঁকন মাথা নাড়ে।

তারপর হামিদুল্লার দিকে তাকিয়ে বললো, মা বলতেছিলো চাচিরে একবার খবর দিতে। তুমি কি বাড়ি যাইয়া খবরটা বলবা?

হামিদুল্লা হাসতে হাসতে ঝগড়াটে ভঙ্গিতে বললো, তুই গিয়া বলতে পারস না?

আমি তো এখন ব্যস্ত। বলেই হেসে উঠলো কাঁকন।

হামিদুল্লা বললো, তোর আর ভয় নাই। তর আসল কাকু আইসা গেছে।

কাঁকন কেমন করে একবার হামিদুল্লার দিকে তাকিয়ে বললো, আসল নকল বিপদের সময়ই চিনতে পারছি।

বলার সময় তার কন্ঠে কিছুটা অভিমানও যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে।

হামিদুল্লা বললো, আমি এখন যাই।

তারপর হাসানের একটি হাত ধরে আবার বললো, আজকে থাকবি তো? আমার ঘর-বাড়িটা একবার দেখবি না?

আজ পারবো না। আরেকবার আসলে যাবো।

তর জাগাটারে এভাবে ফালাইয়া রাখছস কেন? কিছু না করলে বিক্রি কইরা দে। ভালো দাম পাবি!

হাসান বললো, জায়গাটা তো আমি কিনি নাই। দাদার কাছ থাইক্যা বাবায় পাইছিলো। সেই সূত্রে আমি। বেচা-বিক্রির অধিকার নাই! থাকুক যেভাবে আছে! আগে পরে কিছু একটা তো অবশ্যই করবো!

তখনই কাঁকন হাসানের একটি হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বললো, কাকু, তুমি কি চইলা যাইবা?

একটা জরুরি কাজ আছে। এখানে থাকা যাবে না।

আসার পর তো কিছুই মুখে দিলা না।

খাইতে গেলে যে অনেক দেরি হইয়া যাবেরে!

তবুও চলো। মায়ের নাকি তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে।

হাসান তাকায় কাঁকনের চোখের দিকে। সেখানে সে কি দেখতে পাবে? আসলে সে দেখেও দেখতে চায় না। কিন্তু ওদের নিয়ে না ভেবেও পারে না। আর ভাবতে গেলেও আরো সমস্যা এসে চেপে বসবে কাঁধে। এ গ্রামের সব কৌতুহলী ভালো-মন্দ মানুষ যে এখন তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে কি কি করছে তার সবই দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে। সামান্য একটু পা হড়কালেই চেপে ধরবে সবাই। মানুষ এমনই এক জটিল প্রাণী যে, আগে থেকে ধারণা করা যায় না তাদের মনে কী আছে। তবুও অনেক সময় অনিচ্ছায়ও তাকে অনেক কিছু করতে হয়। ফাঁসের রজ্জু গলায় এসে পেঁচিয়ে যাচ্ছে দেখতে পাওয়া সত্ত্বেও সে সরাতে পারে না তার মাথাটুকু। সামান্য পিছু হঁটতে পারে না নিশ্চিত সর্বনাশ জেনেও।

মাশা আজ দেশে ফিরছে। কিন্তু একা ঘরে এসে বেচারা কষ্টই পাবে কেবল। কে তার দেখাশুনা করবে। কে তার খাওয়া গোসলের যতœ নেবে? মুক্তার মাকে বিদায় করে দেয়াটা সত্যিই হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। কিন্তু এমন অকৃতজ্ঞ পুষেও নিজের ক্ষতি করাই শুধু। লাভের মাঝে এটুকুই হয় যে ব্যক্তিগত জীবন আর ব্যক্তিগত থাকে না। বিমান সাড়ে দশটার দিকে এসে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। হাসান নিজে নিজেই যতটা পারলো যা কিছু এলোমেলো আর ছড়ানো ছিটানো ছিলো সবই গোছাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক সে পেরে ওঠে না। ঘরটা আগোছালোই থেকে যায়। ভেবেছিলো শেষটায় ফিজার শরণাপন্ন না হয়ে হয়তো উপায় থাকবে না।

তখনই ফোনটা বেজে উঠলো।

হাসান হাতের কাজ ফেলে ফোন ধরতেই শুনতে পায় কাঁকন বলছে, কাকা, মা হঠাৎ কইরা মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। গ্রামের ডাক্তার বলতেছে ভালো ডাক্তার দেখাইতে। তুমি কি একবার আসতে পারবা?

আজ তো মাশা দেশে আসছে। কিছুক্ষণ পরই আমি এয়ারপোর্ট যাচ্ছি। তুই আমার ঠিকানা মত তোর মাকে নিয়ে চলে আয় না। নাকি বেশি খারাপ? রিকশায় বাসে উঠতে পারবে তো?

তা পারবে। তুমি কখন ঘরে থাকবা?

দুটোর পর থেকেই আছি। চলে আয়।

আচ্ছা।

ফোন রেখে দিলেও হাসান ঘর গোছানোর দিকে মনোযোগ দিতে পারে না। হাতে তেমন একটা সময়ও নেই।

সে নিজেও তেমনি আগোছালো হয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটতে থাকে এয়ারপোর্টের দিকে।

হাসান ভেবে ভেবে কোনো থই পায় না। দশ বারো বছরের একটি ছেলে একাকি দেশে ফিরছে। তার সঙ্গে কেউ নেই। গাইড করার মত কেউ নেই। ডিপার্চার আর ইমেিগ্রশনের ব্যাপারগুলো কি একা একা সামলাতে পারবে? একটি ছোট্ট বালক এয়ারপোর্টের গ্রিন চ্যানেল দিয়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে আসছে ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন আশ্চর্য লাগছে।

হাসানের হঠাৎ খেয়াল হয় যে, ফিজাকে মাশার কথাটা জানানো হয়নি। অবশ্য জানানো উচিত ছিলো। ট্রাফিক সিগন্যালে লালবাতির সংকেত পেয়ে গাড়ি থামিয়ে সে ফিজার নাম্বারে রিঙ করে। কিন্তু সংযোগ পাওয়া গেল না। অপারেটর জানাচ্ছে এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। ল্যান্ড লাইনে রিঙ হলেও কেউ ধরলো না।

সবুজ সংকেত পেয়ে ফের গাড়ি ছোটালো হাসান। কিছুটা তাড়াহুড়োর কারণে একটি রিকশাকে প্রায় মেরেই দিচ্ছিলো। কোনো রকমে ব্রেক কষে সামলে নিয়ে পাশ কাটানোর সময় রিকশাঅলা এবং রিকশার যাত্রীদের গালাগাল শুনতে পায় সে। এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে গাড়ি থামিয়ে সে বেরিয়ে আসে। যাত্রীদের বেরাবার পথের সামনে একটু দূরেই দাঁড়ায় হাসান। কোন দিক দিয়ে মাশা বেরিয়ে আসে দেখতে পাবে। বারবার সে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিলো। এগারোটা পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো মাশা আসছে না কেন?

সে এগিয়ে গিয়ে কাচের দেয়ালের ভেতর উঁকি মারতে চেষ্টা করে। আর তখনই দেখতে পাওয়া যায় লাল টকটকে গেঞ্জি গায়ে চোখে কালো সানগ্লাস লাগানো একটি বালক ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বেরিয়ে আসছে। হাসান সেদিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হতে কিছুটা সময় নেয়। আর তখনই ট্রলি ছেড়ে ছুটে আসে মাশা।

হাসান এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মাশা ঝাঁপিয়ে পড়ে বাবার কোলে।

হাসান ছেলেকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরেই কেমন হুহু করে কেঁদে ওঠে। সেই সঙ্গে মাশাও কাঁদে।

মাশার শরীরটা হাসানের বুকের ভেতর কাঁপছিলো। ছেলেকে চুমু খেয়ে হাসান বললো, তোর শরীর ভালো আছে তো?

মাথা নাড়ে মাশা।

তাহলে কাঁপছিস যে?

ভয় পেয়েছিলাম।

কেন?

যদি তোমাকে চিনতে না পারি! তুমি যদি আমাকে চিনতে না পারো!

মাশা দুহাতে হাসানের গলা জড়িয়ে ধরে রাখে। সে অবস্থাতেই হাসান মাশার ট্রলিটাকে টানতে টানতে পার্কিঙের দিকে হাঁটে।

ছোট ছোট দুটো লাগেজ পেছনের সিটে ফেলে দিয়ে মাশাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে হাসান। ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে উঠে বললো, কি খাবি?

দরজা টেনে বন্ধ করে দিতেই মাশা জানালো, কিছু না।

তোর ক্ষিধে লাগেনি?

খেয়েছি তো! তোমার জন্য চকলেট এনেছি।

মাশার কথা শুনে হাসান হো হো করে হেসে ওঠে। তুই আমার জন্য চকলেট এনেছিস?

লাস্ট উইকে কিনে রেখেছিলাম।

টাকা কে দিলো?

যাবার সময় তুমি যে একশ ডলার দিয়েছিলে, ওখান থেকেই।

খরচ করিসনি?

বাইরে যেতাম না তো! স্কুল থেকে ফিরে ঘরেই থাকতাম।

তোর মা সঙ্গে এসেছিলো?

মাথা নাড়ে মাশা।

কিভাবে এয়ারপোর্টে এলি?

ট্রাভেল কারে।

হাসান মাশাকে মাঝে মাঝে দেখছিলো। কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। গলাটা যেন আগেকার তুলনায় আরো খানিকটা লম্বা মনে হচ্ছে।

মাশা বললো, বাবা, কাঁকন আপুকে দেখতে নিয়ে যাবা?

আরে, ওরা তো আজই আসবে বলেছে।

তাহলে তো ভালোই। কাঁকন আপুকে আর যেতে দিয়ো না!

সেটা কি হয়? কিছুদিন বাদে তার পরীক্ষা।

তাহলে আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে থাকবো। থাকতে দেবে না বাবা?

তোর ইচ্ছে হলে থাকিস।

তারপরই হাসান আবার বলে, গ্রামে গিয়ে কি থাকতে পারবি?

একবার গিয়ে দুদিন ছিলাম তোমার মনে নেই?

ঠিকই মনে আছে। কিন্তু মাশাকে আর দৃষ্টির আড়াল করতে চায় না হাসান। বেঁচে থাকতে কোনো একটা অবলম্বন চাই। মাশাই এখন তার সবচেয়ে বড় অবলম্বন।

ঘরে ফিরে মাশা তার লাগেজ খুলে চকলেট বের করলো। আরো খানিকক্ষণ খুঁজে পেতে দুটো ক্লিপ বের করে বললো, ক্লিপগুলো কাঁকন আপুর জন্য। সুন্দর না বাবা?

হাসান বললো, কে কিনে দিয়েছে?

ফিজা আন্টির সঙ্গে একদিন ঘুরতে গিয়েছিলাম। তখন কিনেছি।

তারপর মাশা হেসে বললো, ফিজা আন্টি দেখেনি!

কিন্তু তোর আপুর মাথায় তো চুল নেই!

হাসানের কথা শুনে কেমন অবাক হয়ে তাকায় মাশা।

মাশার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে সে আবার বলে, সেদিন গিয়েছিলাম না, তখন দেখলাম তার চুল তোর চুলের চেয়েও ছোট। উঁকুন হয়েছিলো বলে তার মা ন্যাড়া করে দিয়েছে।

মাশা হাসতে হাসতে বললো, তাহলে আরো মজা হবে!

হাসান হাসে। কি রকম?

আমার গিফট পেয়ে সে তখনই ইউজ করতে পারবে না!

হাসান তাকিয়ে থাকে মাশার দিকে।

তখনই সে লাফিয়ে এগিয়ে যায় ল্যাপটপের দিকে। হাসানের দিকে তাকিয়ে বলে, গেমগুলো আছে? নাকি ডিলিট করে দিয়েছো?

তুই দেখ না! আমি তো এখনো এত কিছু বুঝি না!

মাশা ল্যাপটপ নিয়ে বসতেই হাসান কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। দুপুরের জন্য খাবারের কি ব্যবস্থা করা যায়। সে তো আর এত খাবার রান্না করতে পারবে না। তবুও যেটা সে ভালো পারে বলে মনে করে তাই রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।

কাঁকনকে দেখেই তার কোমর জড়িয়ে ধরে মাশা বললো, কেমন আছ আপু? তোমাকে আমি অনেক মিস করেছি!

তাই! ঝলমলে মুখে মাশাকে জড়িয়ে ধরে কাঁকন।

তারপর আবার বলে, তুমি বিদেশে ছিলা শুইনা আমারও অনেক মন খারাপ হইছিলো।

আমার ঘরে চলো। তোমার জন্য একটা গিফট আছে। আমি নিজে কিনেছি। বলতে বলতে মাশা কাঁকনের হাত ধরে তার ঘরের দিকে নিয়ে যায়।

শাহেদা বললো, কেমন আছেন?

হাসান হাসে।

তারপর বলে, তুমি কেমন আছ? মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলা কেন?

সেইডাই তো বুঝলাম না! ডাক্তারও তেমন কিছু বললো না।

ঠিক আছে। খুব ভালো ডাক্তারের কাছে তোমারে নিয়া যাবো। এখন রেস্ট নাও। খাওয়া-দাওয়া কর। বিকালের দিকে সবাই যাবো।

শাহেদা হাতের হাঁড়িটা দেখিয়ে বললো, আপনেদের লাইগ্যা পিঠা বানাইয়া আনছি। কই রাখবো?

হাসান বললো, দেখ কই রাখবা। ফ্রিজে রাখতে পারো।

শাহেদা কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হাসানের দিকে।

হাসান শাহেদার হাত থেকে হাঁড়িটা নিয়ে ফ্রিজের ভেতর রেখে দেয়।

তারপর মাশাকে ডেকে বললো, তোর আন্টি আর আপুকে সবগুলো ঘর বাথরুম আর কিচেন দেখিয়ে দে তো বাবা! আমি তোর ফিজা আন্টির সঙ্গে কথা বলে আসছি।

ফিজা ফোন ধরতেই হাসান বললো, তুমি কি আসতে পারবে?

কেন?

গ্রাম থেকে কামরুলের বউ-বাচ্চা এসেছে।

ফিজা বললো, আমি কি করবো? মুক্তার মা কোথায়?

ওকে তো ছাড়িয়ে দিয়েছি!

এখন কি মুক্তার মায়ের জায়গায় আমাকে নিতে চাচ্ছো? বলেই রিসিভার রেখে দিলো ফিজা।

হাসান বুঝতে পারে না ফিজার এমন উদ্ভট আচরণের হেতু। তার মন খারাপ হয়ে যায়।

খাওয়ার টেবিলে হাসানকেই সব করতে হয়। কাঁকন অবাক হয়ে বলে, কাকা, এই সব কি তুমি রান্না করছো?

হাসান বললো, খেতে কি খারাপ হইছে?

মাংসটায় লবন হয় নাই!

তাতে কি? কাঁচা নুন নিয়া নিলেই হবে।

শাহেদা খানিকটা হেসে বললো, পুরুষ মানুষের রান্দা খাইতে আমার কেমন জানি শরম লাগতাছে!

এই ঘরে তো কোনো মহিলা ছিলো না। আমি না রান্না করলে কে করবে?

শাহেদা একবার হাসানের দিকে তাকিয়ে বললো, লবন কই আছে?

তখনই মাশা উঠে গিয়ে লবন নিয়ে আসে।

খেতে খেতে মাশা বললো, বাবা আমাকে একটা ডেস্কটপ কিনে দিও। আপুকে কম্পিউটার শেখাবো।

তখনই হাসানের মনে হয় যে, কোনোভাবে শাহেদা আর কাঁকনকে এখানে রেখে দিতে পারলে মাশা হয়তো অনেকটা ভালো থাকবে। যদিও তার মনে হয় ভাবনাটা অনেক স্বার্থপরের মত হয়ে গেল। কিন্তু আরেক মন বলে, এতে করে ওরা মা মেয়েও আরো ভালো থাকার কথা। শাহেদার দিকে তাকালে তার মনে হয় মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পেছনে দুর্বলতা ছাড়া তেমন বড় কোনো কারণ নেই হয়তো। কিন্তু ওরা তো তার এমন কোনো আপনার জন নয় যে, তার অসুবিধা হেতু এখানেই থেকে যাবে। তা ছাড়া তাদের নিজেদেরই ঘর-সংসার আছে। তা ফেলে কি এখানে থাকতে রাজি হবে? আর হলেও তাদের গ্রামের লোকজন কি ভাববে?

বিকেলের দিকে সবাইকে নিয়েই ডাক্তারের কাছে গেল হাসান। শাহেদার সমস্যার কথা বললেও মাশার আসন্ন অসুবিধাগুলো নিয়ে ভাবছিলো সে। ডাক্তার কয়েকটি টেস্টের কথা জানালো। আর তখনই মনে মনে কিছুটা খুশি হয়ে উঠলো সে। এই সেই করে সপ্তাহ খানেক তাদের রেখে দেয়া যাবে নিশ্চিন্তে।

দুদিন পর রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই জানা গেল শাহেদার কিছুই হয়নি। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করলেই হবে।

হাসান বলেছিলো, ভিটামিন-টিটামিন কিছু দেবেন না?

ডাক্তার হেসে বললো, অষুধ বলতে কিছুই না।

ফিরে আসার সময় হাসান বললো, এখানে কদিন থাকো। ভালো ভালো রান্না কইরা আমাদের কয়দিন খাওয়াও আর নিজেও খাও। তারপর দেখবা সব ঠিক হইয়া গেছে।

শাহেদা বিস্মিত হয়ে বলে, আমার ঘরবাড়ি ফালাইয়া এখানে থাকি কি কইরা?

তখনই সুযোগ বুঝে হাসান বললো, গ্রামে গেলে নিজের যতœ নিতে পারবা ঠিক মত? দরকারি জিনিস খাইতে পাইবা সময় মত? তা ছাড়া মেয়েটার সামনে পরীক্ষা। তারও ভালো-মন্দ খাওয়া আর পরাশুনার ভালো পরিবেশ দরকার। তোমার ভাঙ্গা ঘরবাড়ির থাইক্যা তোমার মেয়ের ভবিষ্যৎ দেখা বেশি জরুরি।

হাসানের কথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে যায় শাহেদা। মিন মিন করে বলে, কিন্তু এখানে সে থাকলে তার ইস্কুল?

সেটা পরে দেখা যাবে। আর মূলত তখনই হাসানের মাথায় স্বার্থপরের মত আরেকটি ভাবনার উদয় হয়। সে ভাবে স্কুল আর শিক্ষাবোর্ড পাল্টে কাঁকনকে ঢাকা নিয়ে আসা কোনো ব্যাপারই না। তা ছাড়া তার বন্ধুদের ধরলে তারাই মাতা-কন্যাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করে ফেলতে পারবে। এমন একটি কথা ভাবতে পেরে নিজকে যেন অনেকটা নির্ভার মনে হয় তার।

মাশা কাঁকনের সঙ্গে থাকতেই যেন পছন্দ করে বেশি। আর কাঁকনও যেন মাশাকে ছাড়া থাকতে চায় না। তবুও সপ্তাহ পেরোতেই সে অস্থির হয়ে উঠলো যেন। বললো, কাকা, আম্মার জন্য তো আমার লেখাপড়া গোল্লায় যাইতেছে। পরীক্ষা দিলে ফেল ছাড়া আর কিছুই জুটবে না!

হাসান হেসে বললো, তাইলে তোর মা এখানে থাকুক। তুই বাড়ি চইলা যা!

কাঁকন অবাক হয়ে বললো, আম্মারে ছাড়া কি কইরা থাকবো?

তুই কি চাস তোর মা এখনই মইরা যাক!

ছিছি কাকা! এমন কথা বইলো না! বলেই শাহেদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁকন।

হাসান বললো, তাইলে তুই ঠিক কর, তোর কাছে কোনটা ইম্পর্টেন্ট? মা না লেখাপড়া?

কাঁকন বললো, দুইটাই!

দুইটা হবে না। একটা।

না! আমার দুইটাই ঠিক চাই!

তাইলে একটা রাস্তাই আছে।

কি?

কাঁকন বিপুল আগ্রহে তাকায় হাসানের মুখের দিকে।

তোর স্কুল বদল কইরা এখানে চইলা আসা। কাছের স্কুলটায় ভর্তি কইরা দিবো। দুই ভাইবোনে এক সঙ্গে আসা-যাওয়া করতে পারবি।

হাসানের কথা শুনে কাঁকনের চোখ-মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

১০

অফিস থেকে ফিরতে আজকাল প্রায়ই দেরি হয়ে যায় হাসানের। যে কারণে মাশার সঙ্গে তার দেখা হয় না সকাল ছাড়া। কাঁকন পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও শাহেদা টিভির সামনে বসে বসে ঝিমোয়। কখনো কখনো কাঁকনও ঘুমিয়ে পড়ে দশটা না বাজতেই। তখন নিজের কাছেই খারাপ লাগে হাসানের। আজও শাহেদা হয়তো টিভির সামনে বসে বসে হাসানের অপেক্ষায় ঝিমোচ্ছিলো। দরজার লক খোলার শব্দে উঠে এসেছে। যেমনকার টিভি তেমনি চলছে। শাহেদার ঘুম কাতুরে চোখ দেখে হাসান বললো, তুমি জাইগা আছ কেন? ঘুমাইয়া পড়লেই তো পারতা!

শাহেদা হাই চাপতে চাপতে বললো, আপনের যেমন কথা! একলা একলা ভূতের মতন খাইবেন, না?

হাসান চমকে উঠে আবার তাকায় শাহেদার দিকে। কিন্তু কিছু বলে না। কত দিন হাসান এভাবে ঘরে ঢুকে মনিরাকে জেগে থাকতে বা তার জন্য অপেক্ষা করতে কখনোই দেখেনি। দশটার পর আর তাকে দেখা যেতো না। তখন একা একাই তাকে সব কিছু নিয়ে খেতে হয়েছে। কখনো খাবার গরম করতে হলেও মনিরাকে কখনো ডাকেনি। এ নিয়ে মনিরার মনে কোনো সমস্যা হয়েছে বলে মনে হয়নি। এমন কি সে কখনোই বলেনি যে, তুমি একা একা টেবিলে বসে ঠান্ডা খাবার খাও, আমাকে ডাকলেই তো পারতে। অথচ শাহেদা কে না কে, এত রাত অব্দি বসে আছে তার জন্য। ভাবতেই তার মনে হয় যে, সে একেবারেই ভারবাহী কোনো গাধা নয়। তার জন্য অপেক্ষা করার মত কেউ সত্যিই আছে। কিন্তু সেটা কিসের থেকে? মন থেকে না কৃতজ্ঞতা থেকে?

এত কিছু নিয়ে ভাবতে চায় না হাসান। তার কাছে এ মুহূর্তটিই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। সে বলে, ডাক্তার তোমারে বলছিলো, বিশ্রামে থাকতে। এমন কইরা রাত্র জাগলে আর বিশ্রাম পাইলা কেমনে?

খাওন আর ঘুম ছাড়া কি কাজ করি? বলে হাসে শাহেদা।

তারপর আবার বলে, হাত-মুখ ধুইয়া আসেন! আমি খাবার দিতাছি।

কাঁকন কি করতেছে? মাশা কি ঘুমায় পড়ছে?

দুই ভাই-বইনে কি নিয়া য্যান লাফালাফি করতাছিলো এতক্ষণ। কাহিল হইয়া মনে হয় ঘুমাইয়া পড়ছে।

পড়ালেখা ঠিক মত করতেছে তো?

বলতেছিলো, মাস্টার নাকি কইছে ইংরাজি আর অংকডায় মনোযোগ দিতে।

হাসান কাপড় পাল্টে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার নিতে নিতে কাঁকনের বিষয়টা নিয়ে ভাবে। সব স্কুলের টিচাররাই তো আজকাল প্রাইভেট পড়ায়। কেউ কেউ নিজের ঘরেই কোচিং সেন্টার খুলে বসে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ভালো ছাত্র-ছাত্রীও দুএকটা টিউশানি করে। তেমন কাউকে পেলে অবশ্য ভালো হতো। কিন্তু আশপাশে কি এমন কাউকে পাওয়া যাবে? অবশ্য পত্রিকায় অনেকেই টিউশানির উদ্দেশ্যে বিজ্ঞাপন দেয়। তেমন কারো সঙ্গে কথা বললেই হবে। একটু গাইড পেলে যদি মেয়েটা লেখাপড়ায় আরো ভালো হয় তো সেও মাশাকে এক আধটু হেল্প করতে পারবে।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে খেতে বসে সবই গরম গরম দেখে হাসান বললো, এখনই রান্না করলা নাকি?

না। গরম করলাম!

প্লেটে খাবার দিয়ে শাহেদা পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। কখন কি লাগে নিজেই পাতে তুলে দেয়। আগেকার মত চামচ দিয়ে বা ভাতের বোলে হাতের পাঁচ আঙুল ডুবিয়ে দিয়ে ভাত নেবার সুযোগ নেই হাসানের। সে খেতে খেতে বললো, তোমার মেয়েরে একজন ভালো মাস্টার রাইখা দাও!

শাহেদা হেসে উঠে বললো, আমি মাস্টার রাখবো কেমনে?

প্রতিদিন যে খবরের কাগজ দিয়ে যায় তা কি পড়? নাকি যেমনেরটা তেমনিই রাইখা দাও?

মাইয়াটা তো পড়ে। মাশাও পড়ে।

তুমি পড় না?

আমি পইড়া কি করবো? শাহেদার মুখে লজ্জা মাখা হাসি ফুটে ওঠে।

কি করবা মানে?

হাসান অবাক হয়ে তাকায় শাহেদার দিকে।

শাহেদা হয়তো এক দৃষ্টে হাসানের মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে মুখ তুলতেই চট করে দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।

হাসান বললো, কাগজ পড়বা। সব খবর পড়বা। কোনখানে কি ঘটতেছে সব পড়বা! আর পড়াইতে চাই যেখানে লেখা আছে তা মন দিয়া পড়বা। কে কেমন ক্লাসের ছেলে-মেয়েরে কোন কোন বিষয় পড়াইতে চায়, তা মনে রাখবা। দরকার হইলে কলম দিয়া মার্ক কইরা রাখবা!

শাহেদা ফের হাসে। যেন এটা তার জন্যে শুধু শুধুই একটি বাড়তি ঝামেলা। এমনিই তো বেশ ছিলো।

হাসান আবার বলে, হাইসো না! যা বলতেছি কইরো! তোমার মেয়ের মাস্টার লাগবে বলছিলা না? তুমি খোঁজ না করলে কে করবে? আমার কি অতটা সময় আছে?

হাসানের প্লেটের খাবার প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিলো। শাহেদা চামচ দিয়ে আরো ভাত ঢেলে দিতে দিতে বললো, আমরা মা মাইয়া দুইজনেই আপনের কত খরচ করাইতাছি, আবার মাস্টার রাখলে খরচ আরো বাইড়া যাবে না!

তারপর সে আরো খানিকটা তরকারি ঢেলে দেয় হাসানের প্লেটে।

ব্যাপারটা হাসানের খুবই ভালো লাগে। বিয়ের পর মনিরা কখনো এমন আন্তরিকতা নিয়ে তার প্লেটে খাবার তুলে দিয়েছে কি না সন্দেহ। সে তরকারি দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে আবার বললো, দেখ, তোমার মেয়েটা আমার এখানে আছে। এখন সে যদি লেখাপড়ায় ভালো না হয় তো গ্রামের মানুষে বলবে কি? বলবে না আদর দেখাইয়া আনার পরে আর তা মনে রাখি নাই! তা ছাড়া একজন মাস্টার এমনিতেই দরকার। ছেলেটা কি পড়াশুনা করে তা তো আমি দেখতে পারি না।

শাহেদা কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে হাসানের মুখের দিকে। দৃষ্টিতে মুগ্ধতা কিংবা কৃতজ্ঞতা দুটোই যেন আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকে।

শুক্রবার খানিকটা বেলা করে ঘুম ভাঙতেই মাশা হাসানকে মনে করিয়ে দিলো কম্পিউটারের কথা। কিন্তু সে বললো, নতুন করে কম্পিউটার কিনে কি হবে। একটা তো আছে।

মাশা বললো, ওটা তো তোমার!

তুই নিতে চাইলে নিয়ে নে। অফিসে আমার আরেকটা আছে।

সত্যি? মাশার যেন বিশ্বাস হতে চায় না ব্যাপারটা।

হাসান মাথা দোলাতেই মাশা বললো, তাহলে এটা আমাদের ঘরেই রাখবো।

তোর ইচ্ছে হলে নিয়ে রাখ!

মাশা ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে নিয়ে দুহাতে বুকে চেপে ধরে তার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে কাঁকনকে বললো, আপু দেখ! বাবা আমাকে এটা দিয়ে দিয়েছে!

তখনই শাহেদাকে এদিকে আসতে দেখে হাসান।

শাহেদা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বললো, ঘুম ভাঙলো?

একটি সিগারেট ধরিয়ে হাসান বললো, এসো।

শাহেদা ভেতরে ঢোকে না। দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, নাস্তা করবেন কখন?

হাসান সে কথার জবাব না দিয়ে বললো, তোমারে যে কথা বলছিলাম তা কদ্দুর হইলো?

কয়েকটা দাগাইছি।

আচ্ছা। নাস্তা করার সময় দেখবো।

হাসানের হঠাৎ মনে হয় শাহেদার স্বাস্থ্য যেন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো। হাতের হাঁড়গোর আগে যেমন চামড়ার আবরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইতো তেমনটা যেন মনে হচ্ছে না এখন। চেহারাতেও কেমন উজ্জ্বলতার সঙ্গে সঙ্গে একটি সুখিসুখি ভাব চলে এসেছে।

১১

ইয়াসিন দেখতে অনেকটা ফর্সা আর লম্বা চওড়া। লম্বা মানুষদের খানিকটা কুঁজো দেখা যায় অনেক সময়। কিন্তু ইয়াসিনের শরীরটা বেশ টানটান। বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। সেকেন্ড ইয়ার। হাসান তাকে বললো, ছাত্রী কেমন? এ প্লাস থাকবে তো?

ইয়াসিন বললো, আর একটু মনোযোগী হলে আরো ভালো রেজাল্ট করতে পারবে।

হাসান কাঁকনের দিকে তাকিয়ে বললো, কিরে, তোর কি মনে হয় পারবি?

কাঁকন বললো, মনে হয় পারবো!

হাসান আবার বলে, মনে হয় বললে তো হবে না! তেমন রেজাল্ট কইরা আমারে দেখাইতে হবে।

তারপরই শাহেদাকে দেখতে পেয়ে বললো, টিউটররে চা-নাস্তা দিছো?

শাহেদা আড়াল থেকে নিঃশব্দে হ্যাঁ বোঝাতে মাথা উপর নিচ করে।

হাসান ফের ইয়াসিনের দিকে ফিরে বলে, ছাত্রটা কেমন? সারাদিন কেবল কম্পিউটার নিয়েই বসে থাকে। লেখাপড়া কি হচ্ছে কিছু?

ইয়াসিন মাশার পিঠে হাত দিয়ে বললো, ওর জন্যে ভাববেন না। ভেরি গুড বয়!

এ কথা শুনে মাশা হাসতে হাসতে জিভ কামড়ে ধরে।

ইয়াসিনের কথা শুনে হাসানের মনটা ভালো হয়ে যায়। প্রসন্ন বোধ করে। বাবা-মা যদি ছেলে-মেয়ের যতœ নিতে না পারে, পরিণতি সব সময় খারাপের দিকেই যায়। মাশাকে আর কাঁকনকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে কটা দিন খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলো সে।

তারপর ইয়াসিনকে আবার বললো, প্রতি পঁনের দিনে অন্তত একটা পরীক্ষা নেয়া দরকার। এতে বোঝা যাবে প্রগ্রেস কেমন হচ্ছে!

ইয়াসিন অভয় দিয়ে বললো, ও নিয়ে ভাববেন না।

ঠিক আছে। তুমি যখন বলছো, ভাবনা ছেড়েই দিলাম!

ইয়াসিনের সঙ্গে কথা বলার জন্যেই হাসান অফিসের কাজে বাইরে বেরোবার সুযোগে ঘরে চলে এসেছিলো। ফের অফিসে যাবার জন্য দরজার দিকে যেতেই দেখতে পায় শাহেদা চায়ের কাপ হাতে তাকে হাতছানি দিচ্ছে।

সে হাসিমুখে এগিয়ে যেতেই শাহেদা বললো, চা-টা মুখে দিয়া যান!

হাসান সেখানে দাঁড়িয়েই চায়ের কাপে চুমুক দেয়।

শাহেদা বললো, ভাবি নাকি কয়দিন পরে আসতাছে?

হাসান চমকে উঠে বললো, তোমারে কে বললো?

মনিরা আসছে সে নিজে জানে না অথচ শাহেদা জানলো কিভাবে?

সে আবার জিজ্ঞেস করলো, মনিরা কি ফোন করছিলো?

মনে হয়। মাশা ফোনে কার লগে জানি কথা কইলো। তারপরেই ফোন রাইখ্যা বললো যে, তার মা আসতাছে।

শাহেদার চোখে মুখে যেন খানিকটা ভয় বা উদ্বেগ জমে উঠেছে শরতের মেঘের মতই।

হাসান বললো, যখন আসবে তখন দেখা যাবে।

শাহেদার সংশয় যেন কাটে না। বলে, আমরা যে আছি এ নিয়া সমস্যা হইবো না তো?

হাসান চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে বললো, কোন সমস্যার কথা বলছো! থাকার না খাওয়ার?

তারপর সে আবার বললো, তোমরা তোমাদের মত থাকবা। সে তার মত। সমস্যার তো তেমন কিছু দেখি না!

খানিকটা ইতস্তত করে শাহেদা আবার বললো, নাকি ভাবি আসনের আগে আমরা গ্রামে চইলা যাবো?

শাহেদার কন্ঠে অনিশ্চয়তার দেয়াল যেন ঝুরঝুর করে ভাঙে।

বললাম তো, এইটা নিয়া তোমাদের ভাবনার কিছু নাই!

হাসান তার অন্তর্গত অস্থিরতা গোপন রাখতে পারে না।

কিন্তু তবুও শাহেদার অবয়বে তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না।

হাসান অফিসে ফিরে মহিবুল্লা সাহেবের রুমে ঢুকতেই তিনি বললেন, আসেন হাসান। তো খবর কি? আপনার কাজ কদ্দুর এগোলো?

মহিবুল্লা সাহেবের টেবিলের দিকে এগাতে এগোতে হাসান জানায়, আজই ব্যাপারটা ফাইনাল করলাম। সপ্তাহ খানেক পর হয়তো পুরোপুরি জানা যাবে।

হাসানকে চেয়ার দেখিয়ে বসেন! বলে, মহিবুল্লা সাহেব আবার বললেন, আমাদের কন্টেইনার দুটো চলে এসেছে। আপনি কি কাল অথবা পরশু চিটাগং যেতে পারবেন? হাতে এখন কাজ কেমন?

তেমন চাপ নেই।

তাহলে আপনার সুবিধা মত একবার চিটাগং থেকে ঘুরে আসেন। কাস্টমসে ফোন করেছিলাম। ওরা জানালো কাগজপত্রে কি একটা ঝামেলা আছে।

আচ্ছা। তাহলে আজ রাতেই যাবো।

হাসান যতটা গুরুত্ব দিয়ে ব্যাপারটি ভাবছিলো, আসলে সেটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিছু টাকা ধরিয়ে দিতেই ব্যাপারটা মিটে গেল।

তারপর কন্টেইনার দুটো ট্রেইলারে তুলে দিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা করিয়ে দিয়ে হাসান ফিরে আসে। দুটো রাতের ব্যাপার। কিন্তু হাসান ফিরে এসে দেখে যে তার ঘর বলতে গেলে হাসপাতাল হয়ে আছে। সবারই জ্বর। তিনজনই বিছানায়।

আজকাল ডেঙ্গু বলে একটি রোগের প্রাদুর্ভাব খুবই বেশি। কিন্তু ডাক্তার জানায় এটা ডেঙ্গু নয়। এক ধরনের ফ্লু। প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া এর কোনো চিকিৎসা নেই। শরীরের তাপমাত্রা বেশি থাকলে মাথায় পানি ঢালতে হবে বেশি করে। অষুধ না খেলেও চলে। এমনিতেই সপ্তাহ খানেক পর ছেড়ে যাবে। তবুও হাসানের মনের ভয় কাটে না। বেশি খারাপ দেখা গেল শাহেদা আর কাঁকনের। মাশার গায়ে তেমন বেশি জ্বর নেই। কদিন পর কাঁকনের পরীক্ষা। এ সময় জ্বর থাকলে লেখাপড়ার খুবই ক্ষতি হয়ে যাবে। জ্বরটা খুবই খারাপ। আশপাশে যাদের হয়েছে তাদের বেশিরভাগই জানিয়েছে যে, জ্বর সেরে গেলে শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়ে।

হাসান অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে এলো। থার্মোমিটার দিয়ে তিনজনেরই জ্বর দেখলো। মাশার গায়ে এক ডিগ্রি তাপমাত্রা বেশি। কাঁকনের একশ তিন। শাহেদার একশ চার। মাশাকে শুয়ে থাকতে বলে হাসান শাহেদা আর কাঁকনের মাথায় পানি ঢালে। কিন্তু বেশি পরিমাণে পানি ঢালার ফলে, শাহেদার ঠান্ডা লেগে গেল। ডাক্তারকে ফোন করে জানালো ঠান্ডার জন্য কি করা যায়?

ডাক্তার জানালেন, প্যারাসিটামল। না সারলে রোগি নিয়ে আসতে হবে।

হাসানের ভালো লাগে না। রাতভর ঘুমাতে পারলো না সে। পালা করে মা-মেয়ের মাথায় পানি ঢেলেছে।

হাসানের অবস্থা দেখে মাশা বললো, বাবা, আমি টাইম করে ওদের ওষুধ খাওয়াবো। জ্বর দেখবো। তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।

হাসান মাশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, অসুবিধা নেই। তুইও শুয়ে থাক!

শুয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে না!

তাহলে গল্পের বই পড়তে পারিস। নয়তো গেম খেলতে পারিস।

মাশা একটি বই নিয়ে কাঁকনের পাশে শুয়ে পড়ে।

হাসান দেখলো বেলা কম হয়নি। অথচ এখনো কারো নাস্তা হয়নি। সে বেরিয়ে গিয়ে দোকান থেকে শুকনো খাবার নিয়ে আসে।

১২

বিকেলের দিকে মনিরা এসে শাহেদা আর কাঁকনকে দেখে কপাল কুঁচকে রাখলো। ওদের সঙ্গে ভালোমত কথাও বললো না। কিন্তু শাহেদা জ্বর গায়েই উঠে পড়ে বললো, কেমন আছেন ভাবি?

মনিরা হয়তো জবাব দেবার প্রয়োজন বোধ করলো না। কিন্তু শাহেদা যেন খেয়াল করেনি ব্যাপারটা এমন ভাবে সে আবার বললো, পথে কোনো অসুবিধা হয় নাই তো? নাস্তা-টাস্তা কিছু খাইবেন?

মনিরা বলে উঠলো, আমার কথা তোমাকে ভাবতে হবে না। আরামে থাকতে এসেছো, আরাম করো, যাও!

মনিরার কথা শুনে শাহেদার মুখ কেমন কালো হয়ে যায়।

হাসান ব্যাপারটা খেয়াল করলেও এ বিষয়ে কিছু না বলে বললো, এইমাত্র এলে, রেস্ট নাও কিছুক্ষণ!

মনিরা সে কথার ধারে কাছে না গিয়ে কেমন ছ্যাত ছ্যাত করে বললো, ঘরটাকে তো আশ্রম বানিয়ে রেখেছো। আর ঘরের যে অবস্থা, বস্তির লোকজনও ঘর-দোর এর চেয়ে ভালো গোছগাছ করে রাখে!

মনিরার কথার জবাবে কি বলতে পারে কথা খুঁজে পায় না হাসান।

মাশা তার মাকে দেখলেও তেমন একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো না। কাঁকনের পিঠে মুখ ডুবিয়ে শুয়ে থাকলো।

মনিরা ব্যাপারটা দেখতে পেয়ে বললো, ছেলেটাকে কি ওই ফকির-ফাকরাদের মতই বানিয়ে ফেলেছো নাকি? ধন্য তোমার রুচি!

হাসান বললো, তুমি কি ঝগড়া করতে চাচ্ছো?

আমাদের ছেলে আর কামরুলের বউ-মেয়ে কি সমান হলো?

হাসান অযথা নিজকে তর্কে জড়াতে চায় না। সে বললো, এসব নিয়ে পরে আলাপ হবে। এখন তুমি রেস্ট নাও। আমি অফিস থেকে একটি কাজ সেরে ফিরে এসে কথা বলবো।

হাসান অফিসে এলেও কাজে মন দিতে পারে না। তার কেবলই ভয় হয়, শাহেদা কিংবা কাঁকনকে না আবার একা পেয়ে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করে মনিরা। কিছু বলার সময় তার মুখে কখনোই লাগাম থাকে না।

অফিস থেকে ফেরার পথে রাতের জন্য খাবার নিয়ে আসে হাসান। তা দেখেও যেন জ্বলে উঠতে চায় মনিরা। এত আদিখ্যেতা কিসের? ওরা যদি গ্রামে থাকতো নিজেদের জন্যে কি খাবার রেঁধে খেতো না?

হাসান কিছুই বলে না। সে অপেক্ষা করে মনিরা কখন স্বাভাবিক হয়ে আসে তা দেখার জন্যে।

তার অবর্তমানে মনিরা হয়তো কিছু আজেবাজে কথা বলে থাকতে পারে। যে কারণে হয়তো শাহেদা আর কাঁকনের মুখ ভার মনে হয়। রাতের বেলা সাধাসাধি করেও তাদের খাওয়ানো গেল না কিছু।

মনিরা মাশাকে তার সঙ্গে ঘুমাতে বললে সে জানালো, আমি আপুর সঙ্গে ঘুমাই!

না। সেখানে তোমাকে ঘুমুতে হবে না।

মাশাকে জোর করে বেডরুমে নিয়ে আসে মনিরা। কিন্তু শুয়েও মাশা কেমন ছটফট করে। বলে, আমার ঘুম আসছে না! আমি আপুর সঙ্গে ঘুমাবো।

হঠাৎ রেগে উঠে মনিরা বললো, এত কথা কেন? খুব বাড় বেড়েছে তোমার! আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাশার গালে চট করে একটি থাপ্পড় কষিয়ে দেয়।

থাপ্পড়ে হয়তো ভালোই জোর ছিলো। মাশা কাঁদতে আরম্ভ করে।

মনিরা ফের ছেলেকে ধমক দিয়ে বললো, চুপ! কোনো শব্দ না! খুব সেয়ানা হয়েছো? তোমার ছাল সব তুলে দিয়ে যাবো এবার!

মনিরা যে পুরানো রাগ মাশার উপর ঢালছে তা বুঝতে পারলেও হাসান কিছু বললো না। সে মাশাকে তুলে দিয়ে বললো, চল! তোর আপুর কাছে আমি নিয়ে যাচ্ছি!

শাহেদা আর কাঁকনের ঘরে ঢুকেই মাশা যেন প্রচন্ড ঘৃণায় বলে উঠলো, আমি আপুর সঙ্গে তাদের বাড়ি চলে যাবো! তোমাদের সঙ্গে থাকবো না!

তারপরই সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

হাসান ফিরে এলে মনিরা শুয়ে পড়ে বললো, লাইট নিভিয়ে দাও!

হাসান লাইট নিভিয়ে দিয়ে খানিকটা দাঁড়িয়ে থাকে। মনিরার সঙ্গে একই বিছানায় শুতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু ব্যাপারটা শাহেদা কিংবা কাঁকন টের পেয়ে যাক তাও সে মনে মনে চাচ্ছে না। শেষে ইতস্তত করেই সে বিছানায় শুয়ে শক্ত হয়ে পড়ে থাকে। পুরোনো দিনগুলোর মত মনিরার দিকে ফিরে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে পারে না। কোথাও যেন একটি অদৃশ্য বাধা তাকে খানিকটা দূরে ঠেলে রাখে।

গত রাতে ঘুমুতে পারেনি সে। দিনের বেলাও পারেনি বলে শোওয়ার খানিক পরই ঘুমে তার দুচোখ জড়িয়ে এলো। কিন্তু মাঝরাতে মনিরার ধাক্কায় তার ঘুম ভেঙে গেলে শুনতে পায়, মনিরা তাকে আঁচড়ে খামচে বলছে, এই তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছো? আমি এতদিন পর এলাম আর আমার দিকে তোমার কোনো কেয়ার নেই! পেয়েছো কি? না কি ওরা মা মেয়ে তোমাকে গিলে ফেলেছে?

হাসান উঠে বসে বললো, কী বলছো তুমি? ওরা শুনতে পেলে ভাববে কি?

মনিরা যেন জ্বলে উঠলো দপ করে। ভাববে আবার কি? ওরা তোমার আশ্রিত। বউ-বাচ্চা তো নয়!

তারপর আরো জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো, ওরা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে তোমার ঘাড়ে এসে উঠেছে বুঝতে পারছি না ভাবছো? আর তোমার মতলব যে কি তাও আমার জানা আছে! কিন্তু মনে রেখো, যা আশা করেছো তা আমি হতে দেবো না!

হাসান বললো, আস্তে বলো না! মাঝরাতে এত জোরে চেঁচাচ্ছো, আশপাশের মানুষ শুনতে পাবে তো!

আশপাশের গুলি মারো! আমার দিকে তোমার কোনোই কেয়ার নেই, তার অর্থ কি?

হাসান মনিরাকে শান্ত করতে বলে, দেখ, কালরাতে ঘুমুতে পারিনি। আজ সারাদিনও রেস্ট নিতে পারিনি। এখন আমাকে একটু ঘুমুতে দাও। যা বলার সকাল হলেই বোলো। এখন শুয়ে পড়ো! প্লিজ!

মনিরা যেন হঠাৎ করেই চুপসে যায়।

তারপর সে শুয়ে পড়লে হাসানও শুয়ে পড়ে।

হাসানের নতুন করে ঘুম আসছিলো না। হঠাৎ করেই যেন ঘুমটা ভেঙে যাওয়াতে চোখ দুটোও যেন জ্বলছে। কিন্তু চোখের পাতা এক করতে পারে না। সে অন্ধকারে জানালার আবছা আলোটার দিকে তাকিয়ে থাকে।

পাশে মনিরার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো হাসান। সে ঘুমিয়েছে কি না ঠিক বুঝতে পারে না। ঠিক তখনই হঠাৎ মনিরা পাশ ফিরে হাসানের দিকে সরে এসে তার বুকের উপর হাত রেখে বলে, সরি! আর সঙ্গে সঙ্গেই হাসানের শরীরটা ফের শক্ত হয়ে যায়। বেশ কিছুদিন আগে ফিজার ক্ষেত্রেও তার এমন একটি অনুভূতি হয়েছিলো। বমি করে ফেলেছিলো সে। মনিরার ব্যাপারেও তার একই অনুভূতি হতে লাগলো।

ব্যাপারটা হয়তো টের পায় মনিরা। সে কিছু না বলে, আবার পাশ ফিরে শোয় হয়তো। কিন্তু হাসান শুয়ে থাকতে পারে না। সে মুখ চাপা দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হড়হড় করে বমি করে ভাসিয়ে দেয় বাথরুমের ফ্লোর।

বাকি রাত আর কথা হয় না মনিরার সঙ্গে। সে ঘুমোয় কি ঘুমোয় না তা বলতে পারে না হাসান। সে বেশিক্ষণ চোখ মেলে রাখতে পারে না।

সকালে ঘুম ভাঙতেই হাসান দেখে মনিরা বিছানায় নেই। সে উঠতে গিয়েই টের পায় পুরো শরীর ব্যথা করছে। খানিকটা শীত শীতও বোধ হচ্ছে যেন। মনেমনে ভাবে যে, জ্বরই এসে গেল কিনা। সে বিছানা থেকে নামতেই দেখতে পায় শাহেদা এগিয়ে আসছে।

মনিরা কোই?

ব্যাগ সুটকেস নিয়া গেল গিয়া দেখলাম।

কিছু বলে নাই?

মাশারে নাকি বলছে সুখে থাকতে!

তারপরই শাহেদা আরো এগিয়ে এসে হাসানের লালচে চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, আপনের শরীর ভালো তো? চোখ দুইটা দেখি লাল!

তখনই যেন হাসানের পুরো শরীর একবার কেঁপে উঠলো থরথর করে। আর তা দেখেই কিনা শাহেদা ছুটে এসে তার দুটো বাহু ধরে চমকে উঠে বললো, এই কি? আপনের শরীলে তো জ্বর!

শরীরের ব্যথাতেই অনুমান করছি কিছুটা।

তারপর সে আবার বললো, মাশা আর কাঁকন কোই?

ইস্কুলে গেল।

তারপর কি বুঝে হঠাৎ হাসানের কপালে হাতের উল্টো পিঠ লাগিয়ে শাহেদা বললো, আপনে শুইয়া পড়েন দেখি! মাথায় পানি ঢালতে হইবো!

শাহেদা হাসানকে ছেড়ে দিয়ে বেরুতে চাইলে হাসান তাকে ফের হাত ধরে টানে নিজের দিকে। শাহেদার জ্বরও যেন কমেনি। সে তাকে এক হাতে বেষ্টন করে বললো, মাথায় পানি ঢালবার দরকার নাই। তুমি আমারে কিছুক্ষণ ধইরা রাখো!

শাহেদা হঠাৎ হাসানের চোখে চোখ রাখে। খানিকটা তাকিয়ে থেকে কিছু ভাবে হয়তো। তারপরই অকস্মাৎ হাসানকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে মুখ ডোবায়। ঠোঁটের উষ্ণতায় যেন জ্বর চাখে।

হাসান নিজের জ্বরতপ্ত শরীরে শাহেদার জ্বরের উত্তাপ অনুভব করতে করতে টের পায় ভিন্ন আরেকটি উত্তাপ যেন তাকে ঘিরে ধরছে আপাদমস্তক। যে উত্তাপে একটু একটু করে গলতে আরম্ভ করেছে সে নিজে। হয়তো একই উষ্ণতায় গলছে শাহেদাও।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


21 Responses to উপন্যাস: উত্তাপ কিংবা উষ্ণতা

You must be logged in to post a comment Login