জুলিয়ান সিদ্দিকী

উপন্যাস: কালসাপ-১৫ (শেষপর্ব)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

পরিকল্পনা মত কাজের কাজ কিছুই হয় না। স্কুলঘরের পেছনের ঢালে অ্যামবুশ করতে গেলে তাদের পেরিয়ে যেতে হবে কানা আজম আর তার সঙ্গী দুজনকে। অন্ধকারেই তাদের উঁচু কণ্ঠের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে থমকে গেল দলটি। কোনোভাবে তাদের এড়িয়ে যেতে চাইলেও তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যায় না। তাদের অবস্থান স্কুলঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরে বলে তাদের মুখোমুখি না হয়ে উপায় নেই। কিন্তু মূল সমস্যা হলো এমন অসময়ে গুলি করা যাবে না কিছুতেই।

ছ’জনের দলটি ঠিক করে দুজনে মিলে যদি একজনকে জাপটে ধরে তাহলে ওরা অকস্মাৎ ভয় পেয়ে চিৎকার দিতে পারে। আর সে চিৎকারে স্কুল ঘরের পাকি সেনারা কৌতুহলী হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে কেউ কেউ। অন্ধকার বলে বোঝা যায় না তাদের অবস্থান কোথায়। শেষটায় সিদ্ধান্ত হয় যে করেই হোক তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর তখনই শোনা যায় কানা আজম বলছে, তরা খাড়া। আমি মুইত্যা আইতাছি!

ধানক্ষেতের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা দলটি আরো সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করে। অন্ধকারে কানা আজমের হাতের টর্চ জ্বলে ওঠে। কিছুক্ষণ পর মূত্র নিষ্কাষণের ছররর শব্দ শোনা যায়।

হাসন আলি মুহূর্তেই রাইফেলের বাঁট দিয়ে সজোরে আঘাত করে কানা আজমের মাথা লক্ষ্য করে।

আক্রান্ত হয়ে প্রচণ্ড ভয়ে তার মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে এলে বাকি দুজনও এগিয়ে আসে। কিরে ডরাইলি ক্যান? সাপে কামড়াইলো?

নিজেদের রসিকতায় নিজেরাই হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে। আর তখনই দুজনের মাথায় আচমকা আঘাত করে আলিম বক্স আর হোসেন মৃধা।

রাজাকার তিনজনই ধরাশায়ী হলে আলিম বক্স হোসেন মৃধাকে বললো, কাকু, আপনের দাওডা দেন!

সোনাভান আলিম বক্সের একটি বাহু ধরে বললো, আজাইরা খুন-খারাপি কইরেন না! এরা অহনো পোলাপান!

হোসেন মৃধা আলিম বক্সের দিকে দা এগিয়ে দিতে দিতে বললো, কালসাপ বড় আর ছোডর মইধ্যে কোনো ফারাক নাই। দুইডার বিষেই মানুষ মরে!

আলিম বক্স অন্ধকারে কি করে বোঝা যায় না। কেবল বার কয়েক থপথপ করে ভোঁতা শব্দ শুনতে পাওয়া যায়।

আলো ফুটে উঠতে হয়তো বেশি দেরি নেই। তবুও তারা যতটা দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব স্কুল ঘরের মাঠের ঢালু অংশে আড়াল নেয়।

আলিম বক্স বললো, গ্রেনেড হাতে লও!

পাঁচটি গ্রেনেড তাদের মুঠোর ভেতর নিঃসাড় পড়ে থাকে জেগে উঠে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে উড়ে যেতে। কিন্তু ভোরের আলো ফুটে উঠলেও কাউকে দেখা যায় না টাট্টিঘরের দিকে যেতে। এমন কি হাবিলদার কাশেম তার দল নিয়ে সামনের পাটক্ষেতে আছেন কিনা তাও টের পাওয়া যায় না। এদিকে অপেক্ষা করতে করতে চারদিক বেশ ফর্সা হয়ে উঠতে থাকে।

হঠাৎ করেই সামনের পাটক্ষেত থেকে একটি গুলি বিস্ফোরিত হয়ে স্কুল ঘরের টিনের দরজায় আঘাত হানলে সঙ্গে সঙ্গেই পাকি সেনাদের বিশ-পঁচিশ জনের একটি দল স্কুল মাঠে বেরিয়ে এসে এলোপাথারি গুলি ছুঁড়তে থাকে। বিশেষ করে মাটির বস্তার আড়ালের সাবমেশিনগান থেকে  একের পর এক গুলি ছুটে যায় পাটক্ষেত লক্ষ্য করে। পাটক্ষেত থেকেও পাল্টা গুলি আসতে থাকে।

আলিম কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। তখনই আচমকা সে চাপা স্বরে বলে উঠলো, গ্রেনেড! আর তখনই এক সঙ্গে পাঁচটি গ্রেনেড উড়ে গিয়ে পড়লো স্কুলের মাঠে। মুহূর্তেই দ্রিমদ্রিম শব্দে চারটি বোমা ফাটার শব্দ হয়। একটা ফাটে নাই! বলেই আলিম বক্স ফের বলে ওঠে, আবার!

আরো পাঁচটি বোমা যেন একই সঙ্গে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে।

পাক বাহিনীর দলটির জীবিত সদস্যরা মাটির উপর শুয়ে পড়ে গুলি চালাতে থাকে। মেশিনগানের মুখও এদিক ঘুরছে মাঝে মাঝে।

হোসেন মৃধা লক্ষ্য ঠিক রেখে গুলি করতে চেষ্টা করছিলো। কিন্তু মাথার উপর দিয়ে শীস কেটে বেরিয়ে যাওয়া গুলির ঝাঁপটায় মাথা তুলতে পারছিলো না।

ওরা ফের গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। এবার বিস্ফোরণের শব্দের পর যেন গুলির শব্দ থেমে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে পাটক্ষেতের দিক থেকে গুলি আসতে থাকলে স্কুলের মাঠ থেকেও গুলি ছুটে যায় সেদিকে। এবার লক্ষ্য স্থির করে মেশিনগান লক্ষ্য করে হাতের শেষ গ্রেনেডটা ছুড়ে দেয় আলিম বক্স। তারপর চান্দভানুকে বলে, আপনেরটাও মারেন বস্তাগুলার উপরে।

চান্দভানু যেন মুহূর্তেই ভুলে যায় তার আশপাশের মৃত্যু দূতের কথা। কি মনে করে গ্রেনেডের পিন খুলে সোজা উঠে দাঁড়িয়েই সেটা ছুঁড়ে দেয় মেশিনগানের পেছনে বসা লোক দুটোর দিকে। আর তা বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চান্দভানু লুটিয়ে পড়ে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে যায় ধানক্ষেতের দিকে।

চান্দভানু লুটিয়ে পড়লে হোসেন মৃধা কেমন দিশাহারা বোধ করে। তখনই সে হয়তো কর্তব্য ভুলে গিয়ে হাতের রাইফেল ফেলে ছুটে যায় চান্দভানুর কাছে। সে সঙ্গে ছুটে যায় জুলেখা আর মমতাও। প্রশিক্ষণের সময় তাদের অনেক করে বলা হয়েছিলো যে, যুদ্ধ চলার সময় আবেগ দমিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু এ কথা কেউই মনে রাখতে পারেনি। হাসন আলি তার তার মায়ের মৃত দেহের পাশে কেমন বিবশ হয়ে বসে আছে।

একা আলিম বক্স মাথা ঠাণ্ডা রেখে স্কুল মাঠে পড়ে থাকা আহত পাকি সেনাদের নড়াচড়া করতে দেখলেই তাদের মাথা লক্ষ্য করে গুলি করছিলো। আর তখনই পাটক্ষেতের দিক থেকে জয়বাংলা ধ্বণি দিতে দিতে অবশিষ্ট দলটি উঠে আসে স্কুল মাঠে।

স্কুলমাঠের উৎফুল্ল মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে আলিম বক্স বললো, ওস্তাদ কই?

তখনই যেন হুঁশ ফিরে আসে দলটির। তারা ফের ছুটে যায় পাটক্ষেতর দিকে। তাদের এলোমেলো পদক্ষেপ আর ছুটাছুটিতে ভেঙে যায় পাটগাছ। নূয়ে পড়ে পাটগাছের চূড়া। তারই এক ফাঁকে দেখা যায় হাবিলদার কাশেমের নিথর দেহ। একটিমাত্র গুলি সবার অলখে কখন তার বুক বিদীর্ণ করে গেছে কেউ হয়তো টের পায়নি।

সবাই মিলে হাবিলদার কাশেম আর চান্দভানুর মৃতদেহ ধরাধরি করে নিয়ে যায় স্কুল মাঠে। দু’জন দেশপ্রমিক শহিদের মৃতদেহ আকাশের দিকে মুখ করে সৎকারের অপেক্ষায় থাকে প্রশান্ত মুখে।

তখনই হোসেন মৃধা কেমন উদভ্রান্তের মত বলে উঠলো, এহানের কোন ঘরে জানি মাইয়া মানুষের চিক্কুর হুনছিলাম!

স্কুলঘরের দালানের বন্ধ দরজা দুটো বাইরে থেকে খোলার পর দেখা যায় আরেক নারকীয় দৃশ্য। বিবস্ত্র আর ক্ষত-বিক্ষত মেয়েগুলোর কেউ আর জীবিত নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই তাদের গায়ের সার্ট, গেঞ্জি অথবা গামছা খুলে ঢেকে দেয় বে-আব্রু আর নিথর দেহগুলো।

(সমাপ্ত)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to উপন্যাস: কালসাপ-১৫ (শেষপর্ব)

You must be logged in to post a comment Login