উপন্যাস: বিপর্যস্ত বিপর্যয়
অপু মিজান সাহেবের কনিষ্ঠ সন্তান। শফির বাসায় থেকে ঢাকা কলেজে বি.এস.সি পড়ছে। সেই সাথে সুযোগ মত শফির কাছে ক্যালকুলাসের জটিল ইকোয়েশানগুলোও বুঝে নেয়। কিন্তু আজ বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিল না সে। অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল বারবার।
ব্যাপারটা প্রথমে খেয়াল করেনি শফি। আলফা বিটার মান দুটো বসিয়ে বারবার বুঝিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও অপু যখন ভুল করছে তখনই খেয়াল করে শফি। বলল, ‘অ্যাহোন রেহে দে। পরে দেখিয়ে দেবানে!’
শফি নিজেই উঠে পড়ে। এ মুহূর্তে একটা পান মুখে না দিলেই নয়।
শফি চলে যাওয়ার পরও টেবিল ছেড়ে নড়ে না অপু। গুম হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। অঙ্ক করতে যে কোন উৎসাহ পাচ্ছে না তা ঠিক। কিন্তু আর কিছু করতেও মন চাইছে না। এখন বসে থেকে কী বা করা যায়! আঙুলের নখ খুঁটতে খুঁটতে ভাবে সে। যাত্রাবাড়ি গেলে কেমন হয়? সুফিয়া হয়ত ফ্যাক্টরি থেকে ফেরেনি এখনো। বাঁ হাতের কব্জি উল্টিয়ে ঘড়ি দেখে। মাত্র তিনটা বিশ। হঠাৎ তার মনে পড়ে যে, আজ শুক্রবার। সুফিয়া কাজে যাবে না।
বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বেড রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় অপু।
লুবনা শুয়ে শুয়ে কি একটা বই পড়ছে।
‘ভাবি!’
অপু ডাকে লুবনাকে।
বইয়ের ফাঁকে আঙ্গুল রেখে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় লুবনা। ‘কিছু বলবি?’
‘দশটা টাকা হবে?’
‘কোথাও যাচ্ছিস নাকি?’
‘একটু ঘুরে আসি।’
‘যাত্রাবাড়ি?’
‘নাহ।’
‘সত্যি?’
লুবনার বিশ্বাস হতে চায় না।
‘সত্যি মিথ্যের কি আছে?’
নির্দ্বিধায় মিথ্যে বললো অপু।
সব মানুষের জীবনেই কিছু সময় আছে, যেগুলো হঠাৎ করে সামনে উপস্থিত হলে কেউ মিথ্যে বলতে দ্বিধা করে না। তেমনি সেও এখন এমনি একটি সময়ের সম্মুখীন। মিথ্যে বলতে সংকোচ করবে কেন?
লুবনার পাশেই চিত হয়ে আছে শফি। চোখ বোঁজা অবস্থাতেই মাঝেমাঝে জাবর কাটার মত পান চিবোচ্ছে। অপু যে এখন যাত্রাবাড়ি যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অপুর মিথ্যে বলার ধরণ দেখে খুব রাগ হয় তার। এখন কারণ জানতে চাইলেও আরো একগাদা মিথ্যে বলবে। তাই অপুকে কিছু বলারও উৎসাহ পায় না।
‘এই, ঘুমুলে? শুনছো?’
‘শুনছি।’
‘অপু টাকা চাচ্ছে। দেবো?’
‘ওর টাকাই তো! দেবে না কেন? দাও। যখন যা চাইবে দিয়ে দেবে।’
চোখ খোলে না শফি। মিথ্যেবাদীর চেহারা দেখে মন খারাপ করতে চায় না সে।
লুবনা বইটা উপুড় করে বিছানায় রেখে নেমে আসে। তারপর আঁচলে বাঁধা চাবির গোছা থেকে কটা চাবি ধরে ওয়ারড্রবের ড্রয়ারের তালায় ঢোকায়। কাউকে টাকা দিতে হলে লুবনার মন সব সময় খারাপ হয়ে যায়। কাউকে একটা টাকা দিতেও ইচ্ছে হয় না। সেটার ছাপ সব সময় তার মুখে পড়ে।
চেহারা ম্লান হয়ে যায়। সে অবস্থাতেই ড্রয়ার খুলে কাপড়-চোপর-কাগজ-পত্রের নিচ থেকে টাকা বের করে অপুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো, ‘তাড়াতাড়ি ফিরিস!’
টাকাটা নিতে নিতে অপু বললো, ‘দেখি!’
তারপর সে কিছুটা দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়।
অপু বেরিয়ে যেতেই লুবনা বললো, ‘দেখলে তো, কেমন মিথ্যুক!’
‘দেখতে তো পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের কী করার আছে?’
‘আমি কি জানি! ভাই তোমার। ভাল-মন্দ কিছু হলে তোমারই লাগবে!’
‘ও এখনো ছোট আছে নাকি! নিজের ভাল-মন্দটা বোঝে না?’
লুবনা ড্রয়ারে তালা লাগিয়ে ফিরে আসে বিছানায়। বলে, ‘না। বোঝে না! এ বয়সের ছেলে-মেয়েরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ভাল-মন্দ জ্ঞান থাকে না। কেউ বোঝাতে গেলেও তাকে শত্রু ভেবে বসে। তাই বলে একবারে হাল ছেড়ে দিলে তো চলে না।’
‘যখন সবই জানো, বোঝাতে পারো না?’
‘হুঁহ! আমার কথায় তোমার ভাই কত পাত্তা দেয়!’
লুবনা বইটা আবার তুলে নেয়।
শফি কিছু একটা বলতে চেয়েও থেমে যায়। ছাদের দিকে চোখ রাখে।
যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা পেরিয়ে পূব দিকের একটা এঁদো ডোবার পাশেই আছিয়ার ঘর। দেওয়াল ঘেরা টিনের ঘরটাতে গাদাগাদি করে থাকে অনেকগুলো মানুষ। আছিয়া ও তার স্বামী-সন্তান মিলে এগারজন। তার উপর ছোট বোন সুফিয়াকে নিয়ে সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছে বার জনে।
ঢাকা শহরে সস্তায় বাসা ভাড়া পাওয়াটা দুষ্কর। যাও দু একটা মিলে যায়, তাও আবার আশ-পাশের দুর্গন্ধে পেট ফুলে যাওয়ার উপμম হয়। সস্তার বাড়ি এমনই। পাশে এঁদো ডোবা কিংবা নালা-নর্দমা না থেকে পারে না। নয়তো দেখা যায় খুব কাছেই সিটি কর্পোরেশনের দেওয়াল-ভাঙা ডাস্টবিন। কাক-কুকুরের হল্লা-চিল্লা আর দুর্গন্ধে একাকার। তবে কিছুদিন থাকলে সবারই সয়ে যায়।
আছিয়ার দু’ছেলে টেইলারিং শপে সেলাইর কাজ করে। সে নিজেও ঘরে বসে অর্ডারি কাপড় সেলায়। সুফিয়া কাজ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। এই চারজনের আয় মিলিয়ে মোটামুটি সংসারের খরচ চলে যায়। এর মাঝে আছিয়ার স্বামী নওয়াব আলি তার গ্রামের বাড়ি থেকে প্রাপ্ত বর্গা ফসল নিয়ে আসে। ধান-চাল-গমের সাথে ডালেরও অভাব থাকে না।
নওয়াব আলির আরেকটা কাজ হচ্ছে ছেলে-মেয়েদের স্কুলে আনা নেওয়া। তা ছাড়া চৌরাস্তার মোড়ে চা-স্টলে বসে গল্প-গুজব, আড্ডা মারা হচ্ছে অবসর কাটানোর মাধ্যম। তাই আজও সে আড্ডা দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে দু এক কাপ চা পানের জন্য স্টলের সামনে ফেলে রাখা বেঞ্চিতে দু পা তুলে জাঁকিয়ে বসে। একটু পরপর মিরপুর থেকে আসা মিনিবাসগুলোর দিকে অস্থির ভাবে দু’চোখ ঘুরিয়ে আনছে। কারণ, আজ বিশেষ একজনের আসার কথা।
বেশ কিছুক্ষণ পরেই একটা মিনি বাসের দরজায় অপুকে দেখ গেল। কিন্তু নওয়াব আলি তা লক্ষ্য করলো না। সে তখন পাশের এক বৃদ্ধের সঙ্গে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপে মত্ত।
চৌরাস্তা পার হয়ে কিছুটা ঘুর পথে একটি ডোবা পাশ কাটিয়ে এগোয় অপু। সরু কাঁচা রাস্তা ধরে একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে কড়া ধরে নাড়ে।
বার কয়েক কড়া নাড়ার পর বছর সাতেকের একটা মেয়ে দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারে। আর অপুকে দেখতে পেয়ে ‘মা! খালা! অপু মামা এয়েছে!’ বলতে বলতে অদৃশ্য হয়ে যায় ঘরের ভেতর।
অপু ভেতরে ঢুকে দরজার হুড়কো লাগিয়ে এগোয়।
পাকা মেঝের ওপর দু’পা ছড়িয়ে গাট্টা-গোট্টা গরিলার মত দেখতে এক শ্যামলা রমণী কাঠির মত হাত-পা আর মাথাটা অস্বাভাবিক বড় রোগা-পটকা এক শিশুকে বুকের দুধ পান করাচ্ছে। অপুকে দেখতে পেয়েও তার মাঝে কোনো ভাবান্তর হয় না।
‘আছিয়া বু’! ভালো আছো?’ বলে, বারান্দায় রাখা ছোট্ট চৌ-পায়ায় বসে পড়ে অপু।
‘ভালো থাকপার আর সুযোগ পালাম ক’নে!’ বলে, আছিয়া তার হাতের কাছের মোড়াটা টেনে সামনে আনে। তারপর অপুকে হাতছানি দিয়ে বলে, ‘কাছে এসে মোড়াডায় বয়। দুডো কতা বলি!’
অপুর মাঝে নড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। আছিয়ার দু হাঁটুর মাঝখানে বেঢপ ভাবে উঁচু হয়ে থাকা পেটটার দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় ফ্যামিলি প্ল্যানিঙের কোনো খবর এদের কাছে এখনো পৌঁছেনি।
‘সুফিয়া! শুনে যা!’ বলে, হাঁক ছাড়লো আছিয়া।
একটু পরেই অনিন্দ্য রূপসী না হলেও কম রূপসী বলা যাবে না, এমন বিশ-বাইশ বছরের এক যুবতী পর্দা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে। ফর্সা চেহারার টানাটানা দুটো চোখ। হরিণ নয়না বললেও খুব একটা ভুল হবে না। তবে ডান চোখটা একটু ট্যাঁরা।
ভালো মত না দেখলে হঠাৎ কেউ বুঝতে পারবে না। সুন্দর নাক। প্রসাধন বর্জিত পাতলা দু ঠোঁট। মাথার কালো কোঁকড়ানো চুলগুলো ফুলে ফেঁপে ছড়িয়ে আছে পিঠের উপর। পরনের হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার কামিজ গায়ের রঙের সাথে মিশে গিয়ে তার সৌন্দর্যকে আরো খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছে যেন। এমন রূপ যে প্রসাধনের পর আরো আগুনের শিখা হয়ে উঠবে তা বাড়িয়ে বলা অর্থহীন। সৌন্দর্যের দু মেরুতে দুজন। একসঙ্গে এদের দেখলে কেউ বলবে না যে, এরা সহোদরা। এদের জন্মদাতা সম্পর্কে মাঝেমাঝে অপুর মনে সন্দেহ জাগে। কারণ, রঙ তো দূরের কথা, চেহারা এবং স্বভাবেও বিন্দুমাত্র মিল এই দু বোনের মাঝে খুঁজে পাওয়া ভার।
সুফিয়াকে দেখতে পেয়ে অপুর চঞ্চলতা বেড়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়। তাকে ঘিরে মনের ভেতর একটা মমত্ববোধ ক্রমাগত পাক খেয়ে উঠতে থাকে। ওকে না পাওয়ার চিন্তাটা উদয় হলেই সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে আরম্ভ হয় সুতীব্র বেদনার অস্থির ঝাঁপা ঝাঁপি।
সুফিয়াকে কিছু বলতে হয় না। এ মুহূর্তে তার যা করণীয় তা বুঝে নিয়েছে। আর এই বিশেষ অতিথিটিকে আপ্যায়নের দায়টাও কেবল তারই। সুফিয়া চলে গেল। কিন্তু অপুর মনে হলো সে আরো কিছুক্ষণ থাকলে ভালো হতো যেন।
কোলের বাচ্চাটাকে ঘুরিয়ে আঁচলে বুক ঢাকে আছিয়া।
তারপর উঠে বলে, ‘ঘরে গিয়ে বয় ভাই!’
আছিয়ার পেছন পেছন অপু ঘরের ভেতর যায়।
একটা বিছানা। একটা টেবিল আর একটা চেয়ারেই ঘরটা ভর্তি হয়ে গেছে। অপু ঘরের একমাত্র চেয়ারটা টেনে বসতেই আছিয়া আবার মেঝেতে বসে। মুখ তুলে অপুকে একবার দেখে বলে, ‘বাড়ি গিয়েছিলি ভাই?’
‘গিয়েছিলাম।’
আছিয়া কিছুটা উৎসাহী হয়ে বললো, ‘চাচা-চাচিরে কিছু কইসনি? ওরা কি রাগ কইরেছে?’
‘নাহ। বেশিক্ষণ ছিলাম না।’
আসলে সে বাবা মার সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করার সাহস পায়নি। এখনো তার বড় ভাই দিপু বিয়ে করেনি। আমাদের সমাজে বড় জনকে বাদ দিয়ে ছোটজনের বিয়েকে কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না। ধরে নেয় যে, বড়টার খুঁত আছে নিশ্চয়ই!
‘দিন তারিখ কিছু ঠিক করেছিস?’
‘মা তো এ বিয়ে কিছুতেই মানবেন না। তাছাড়া অ্যাহোনও…।’
অপুর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা করে না আছিয়া। তার আগেই বলে ওঠে, ‘ধুর পাগল! মা-বাপ প্রথম প্রথম এমন না মানলিও পরে ঠিকই মাইনে নেয়।’
তারপর মুখে একটা তাচ্ছিল্য ফুটিয়ে বলে, ‘কত্তো দেখলাম! এ নিয়ে ভাবিসনে!’
আছিয়া মুখ বিকৃত করে দুহাতে উকুন ভর্তি মাথা চুলকায়। তারপর আবার বলে,
‘অত ভয় পাচ্ছিস ক্যান? তুই না সবারকার ছোডো ছেলে! তোর বিয়েডা দুই দিন আগপাছ সবারই মাইনে নিতি হবে। না মাইনে উপায় নেই!’
এভাবে বিয়ে করাটা যে তার পরিবারের কেউ মেনে নেবে না, অপু ভালো করেই জানে। বিশেষ করে মায়ের মনে কী করে যে দুঃখ দেবে, নিজের থেকেই সায় পায় না।
এ নিয়ে অনেক ভেবেছে সে। কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পায়নি।
‘শোন!’ আছিয়া আবার বলে, ‘বিয়েডা এহন হইয়ে যাক। বচ্ছর খানেক কাউরে কিছু বলিস না। তার বাদে পড়া শেষ করে কোনো একটা চাকরিতে ঢোক। তখন আস্তে ধীরে বিয়ের কথাডা দুই একজন করে জানা। চাচা-চাচির কানে যখন কথাটা ওঠপে, তখন দেখবি কেউ আর রা করতিছে না!’
কথাটা মনে ধরে অপুর। এমন একটা সহজ ব্যাপার কেন যে এতদিন তার মাথায় আসেনি, ভেবে নিজের উপরই বিরক্ত হয় সে। এটা তো দিনের আলোর মতই সত্য যে, সবাই তাকে দূরে ঠেলে দিলেও মায়ের পক্ষে সেটা কখনোই সম্ভব নয়। সুফিয়ার প্রতি তাঁর এখনকার যে রাগ, তা অচিরেই ভেসে যাবে অপত্য স্নেহের বন্যায়।
প্লেটে করে কয়েক রকমের নাস্তা নিয়ে আসে সুফিয়া।
অপু দেখলো এরই মাঝে সুফিয়া কপালে একটা হলদে টিপ পরেছে। ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক ঘষেছে। হয়তো মুখে পাউডারের পাফও বুলিয়ে থাকবে। কারণ, কিছুক্ষণ আগের চাইতে তাকে আরো ভালো দেখাচ্ছে। কাছে আসতেই গত মাসে গিফট করা সেন্টের মিষ্টি গন্ধটা তাকে আরো ব্যাকুলতায় জড়িয়ে ফেলে।
প্লেটের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে অপু। ‘এত খাবার খাবে কে?’
সুফিয়া চোখ মটকে বলে, ‘তুমি একাই সাবাড় করবে নাকি? আমি আছি না!’
বলে, সামনে ট্রে সমেত প্লেটগুলো রেখে সামনা-সামনি বিছানায় বসে।
ভারি শরীরটা নিয়ে প্রায় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করতে করতে বাচ্চা কোলে উঠে দাঁড়ায় আছিয়া।
তারপর দরজার দিকে যেতে যেতে বললো, ‘তোরা কতা ক, আমি বাচ্চাডারে ঘুম পাড়োয়ে আসি।’
সে বাইরে গিয়ে বললো আবার, ‘দরজাডা আবজায়ে থো!’
সুফিয়া দরজাটা বন্ধ করে ফিরে আসতেই অপু লাফিয়ে উঠে এগিয়ে যায়।
‘অ্যাই! হচ্ছে কি?’ চাপা গর্জন করে ওঠে সুফিয়া। ‘বুবু এখনই ফিরে…।’
সুফিয়ার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অপু তার কথা বলার পথ রুদ্ধ করে দেয়।
ছাড়া পেয়ে কপট রোষে চোখ পাকায় সুফিয়া।
তারপর ওড়নায় ঠোঁট মুছতে মুছতে বলে, ‘রাক্ষস! এক্কেবারে সবুর নাই!’
অপুর মুখে দুষ্টুমির হাসি ফুটে ওঠে। চেয়ারে ফিরে গিয়ে বলে, ‘সুযোগটা যখন দিয়েই গেল, হাত ছাড়া করে লাভটা কি?’
‘সারাটা জীবন তো পড়েই আছে!’
‘এটা হল উপরি।’
‘ফাজলামো ছেড়ে খাও!’
‘তুমিও নাও।’
‘নিচ্ছি। তুমি আগে নাও।’
অপু একটা বিস্কিট হাতে নিয়েও কি মনে করে সেটা আবার পে-টে রেখে দেয়। তারপর বিছানায় গিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে বুকের ওপর হাত ডলতে ডলতে বললো, ‘উফ! বুকটা যেন কেমন করছে!’
সুফিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে অপুর উপর ঝুঁকে পড়ে বললো, ‘খুব খারাপ লাগছে?’
অপু সুযোগ বুঝে সুফিয়াকে বুকের সাথে চেপে ধরে। তারপর কোনো রকম সুযোগ না দিয়েই তার উপর চড়াও হয়।
সুফিয়া অপুর চোখে দেখতে পায় সর্বনাশের ঘনঘটা। সে কাতর স্বরে বলে, ‘অপু প্লিজ!’
অপু কিছুই শোনে না। বলে, ‘এখান থেকে সোজা কাজি অফিস। এখন আর কোনো কথা না।’
কিন্তু হঠাৎ সুফিয়ার শরীর কেমন শিথিল হয়ে আসে অপুর বুকের তলায়। সে কিছু বুঝতে না পেরে দু হাঁটুর ওপর ভর করে সোজা হয়।
তারপর সুফিয়ার নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখে শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে কিনা।
লুকিয়ে ওদের কর্মকাণ্ড দেখার জন্য আছিয়া জানালার পর্দাটা একটু ফাঁক করেই প্রথমে জিভ কেটে পালাচ্ছিলো। কিন্তু সুফিয়ার অচেতন দেহের দিকে চোখ পড়তেই চিৎকার করে উঠলো। ‘ওরে কি মাইরে ফেললি? ও অপু! কতা কচ্ছিস না ক্যান?’
সম্বিৎ ফিরে পেতেই অপু লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলে দেয়। তারপর ফিরে এসে আবার সুফিয়ার নাকের কাছে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে দেখে। কেমন ভয় ভয় লাগে তার। ঝুঁকে বুকের উপর কান পাতে সে। মরে-টরে গেল নাকি? তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতে লাগলো। এখন কী যে করবে কিছুই ভাবতে পারছে না সে। ঘটনার আকস্মিকতায় তার মাথা কাজও করছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানার এক পাশে বসে থাকে।
দুই
কাজের চাপে শফি ভুলে গিয়েছিলো যে, অপুর সাথে কথা বলা দরকার। তাকে বোঝাতে হবে যে, প্রেম আর মোহ এক নয়। প্রায় দশ-পনের দিন পর অফিসে কাজের চাপ কমে আসতেই কথাগুলো খোঁচা মারে শফির মাথায়।
অপুর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে অনেকটা খারাপ হয়ে গেছে। চোখের নিচে গাঢ় হয়ে পড়েছে কালচে আবরণ। মনে হয় আজকাল রাতের বেশির ভাগ সময়ই তার অনিদ্রায় কাটে। দিনের বেলা পকেটের পয়সা বাঁচাতে হেঁটেই চলা ফেরা করে হয়তো। যে জন্যে রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে।
এত সব কথা তার এখানে বসে মনে পড়ার কথা না। মনে পড়েছে ভিন্ন একটা কারণে। কিছুক্ষণ আগে তার বন্ধু মিরাজ, যে নিজেই একটা কনসাল্টিং ফার্মের কর্ণধার।
সে জানতে চেয়েছিলো শফির কোনো ভাই আছে কি না, যে এখনো ছাত্র। সে যে অপুর কাছ থেকেই ব্যাপারটা জানতে পেরেছে এতে কোনো ভুল নেই। সেই সঙ্গে সবই মনে পড়ে শফির। অপুর উপর তার কিছুটা রাগ হয়। সে ভাবে, আজই কথা বলতে হবে।
বদমাশটা লুকিয়ে লুকিয়ে চাকরি খুঁজছে!
‘কী শফি সাহেব! এত কি ভাবছেন?’
অভিনেতা আবুল হায়াত সামনে এসে টেবিলে দু হাত রেখে ঝুঁকে পড়েন।
‘ব্যাঙের আবার সর্দি! যার পুরোটা জীবনই কেটে গেল ভাবনা-চিন্তায়, সে নতুন করে ভাববে কি? বসুন।’
হায়াত সাহেব চেয়ারে বসেই একটা সিগারেট ধরিয়ে একগাল ধোঁয়া ছাড়েন।
তারপর চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে বললেন, ‘দিনকাল ভালো যাচ্ছে না!’
‘আরে মিয়া ভাই! আপনারা নাটক-অভিনয়-মঞ্চ নিয়ে তো বেশ আছেন! আপনিই যদি এই কথা বলেন, তো আমরা বলবো কি?’
‘রসিকতা বাদ দিয়ে বলুন, আপনারা কাজ পাচ্ছেন কেমন?’
‘পাচ্ছি কোই! প্রাইভেট কোম্পানিকে সব কাজ দিয়ে দিলে সরকারি অফিসে বসে কি আঙুল চুষবেন?’
‘লক্ষণটা কিন্তু তেমনিই দেখতে পাচ্ছি।’
দরজা ঠেলে পাঞ্জাবি পাজামা পরা মোটা চশমাঅলা এক ভদ্রলোক প্রবেশ করতেই শফি গলা উঁচিয়ে সালাম দিয়ে বললো, ‘আসুন প্রফেসর সাহেব! সামনে বহুব্রিহী নিয়ে বসে আছি।’
প্রফেসর সাহেব বসতে বসতে হায়াত সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যিই তো! এ যে দেখছি বহুব্রিহীর মাস্টার!’ বলে হাহা করে হাসলেন।
তারপর আবার বললেন, ‘তো কেমন আছো ভাই? শহীদদের তালিকা না বানিয়ে যদি রাজাকারদের তালিকা বানাতে, তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেকটা উপকৃত হতো। কেন না, আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই সংযুক্ত ছিলাম। তাদের সংখ্যাটা বিশাল। কাজেই, স্বল্প সংখ্যক রাজাকারের তালিকাটা সহজ।’
‘নাট্যকার যা বলতে চান আমাদের তো তাই মুখস্থ করতে হয়!’
‘থাক ওসব।’
তারপর তিনি শফির দিকে ফিরে বললেন, ‘শফি সাহেব! আমি একটা সুন্দর বাড়ি বানাতে চাই। বুঝলেন? বলে, প্রফেসর সাহেব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললেন, ‘সুন্দর একটা বাড়ি। অল্প খরচে।’
‘তা তো বুঝলাম! কিন্তু…।’
‘কিন্তু কি?’
তিনি মাঝ পথেই শফিকে থামিয়ে দিলেন।
‘বলতে আর দিলেন কোথায়?’ শফি বললো।
‘বলুন! বলুন!’ তিনি যেন তাড়া দিলেন।
‘বাড়ি বানাবেন, এ্যাদ্দিনে কেন? আগে কি করলেন?’
‘আরে ভাই ও কথা বলবেন না!’
তারপর আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ‘ওই হারামজাদা কি শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে একটা দিন! সারাটা জীবন কেবল জ্বালিয়েছে। এখন মেয়েটাকে নিয়ে আছি আরেক বিপদে। জার্মানিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিছুই হলো না। একটা পা বুঝি কেটে বাদই দিয়ে দিতে হবে!’ বলে, মুখটা বিকৃত করে ফেললেন তিনি।
কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে, বুঝি বা মনের ভেতরকার আসন্ন ঝড়টাকে প্রশমিত করলেন। তারপর বললেন, ‘চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। আর কদিন! সরকারি বাসায় তো থাকলাম অনেকদিন। নিজের বাড়িতে থাকতে কেমন লাগে চেষ্টা করে দেখি!’ বলে হাসলেন একবার। যে হাসিতে কয়েক মুহূর্ত আগের যন্ত্রণা কাতর মনটির কোনো প্রক্ষেপ নেই।
শফি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এই অসাধারণ মানুষটির নতুন পরিচয় পেয়ে।
তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা কি তাঁর এই অসামান্য গুণটির পরিচয় পেয়েছে কোনোদিন? পেলেও হয়তো তারা দু একজন। নিজকে প্রশ্ন করে নিজেই উত্তর খুঁজে নেয় শফি। আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে নাস্তিকতার আড়ালে আত্মগোপন করে থাকা একজন নিষ্ঠাবান আস্তিককে।
রাতের বেলা ঘরে ফিরে আসতেই পাপিয়াকে দিয়ে অপুকে ডাকিয়ে নেয় শফি। বেডরুমের দরজায় এসে অপু দেখলো, বিছানায় বসে শফি পান চিবোতে চিবোতে শরীরের উপরিভাগ দোলাচ্ছে। টিভিতে তখন বাংলা সংবাদ হচ্ছে। অপু বুঝতে পারে যে, আজ তাকে অনেক ধরণের কথা শুনতে হবে। কাউকে হেনস্তা করার ইচ্ছে থাকলে তার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে শফি আগে থেকেই এভাবে শরীর দোলায় আর মনেমনে কথা সাজায়।
নিজের উপস্থিতি জানাতে অপু দরজায় দাঁড়িয়ে বললো, ‘ভাইজান! আমাক ডেকেছেন?’
‘বস। রয়ে সয়ে শোন কি বলি!’
শফি টিভির পর্দা থেকে দৃষ্টি সরায় না।
‘বসছি!’ বলে, অপু একটা কুশন টেনে বসে।
কিছুটা বিরতি দিয়ে শফি বলে, ‘যাত্রাবাড়ি কোথায় যাস? কার কাছে?’
সেরেছে! মনে মনে প্রমাদ গোনে সে।
‘মুখে কুলুপ দিয়ে রাখিসনে। কথা ক। যাইস কোহানে?’
‘আছিয়া বু’দের বাসায়।’
‘ওহানে কি?’
‘কিছুই না।’
‘তালি কেন যাইস।’
‘একই বাড়ির মানুষ। তার ওপর চাচাত বোন। খোঁজ-খবর তো করা লাগে!’
‘আচ্ছা আচ্ছা!’
প্রায় না বোঝার মত একটা সূক্ষ্ম হাসি বাঁক খেলো শফির ঠোঁটে। ‘ভালো! খুবই ভালো! আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর রাখা সুন্নত!’
তারপর ফিরে অপুর দিকে তাকায় সে। বলে, ‘আগার গাঁ যে তোগের একটা ভাই, ভাইয়ের বউ আর তাগের মেয়ে ইরিত্রা আছে, বছরে তাগের খোঁজ রেহেছিস ক’দিন? আর যাত্রাবাড়ি মাসে যাইস ক’দিন?’
অপু মাথা নিচু করে বসে থাকে। মনে মনে হেসে বলে, এসব আমারে শুনিয়ে কোনো ফায়দা হবে না।
শফি আবার বলতে থাকে, ‘এ কথা না হয় বাদই দিলাম। গ্রামের বাড়ি বুড়ো মাবাবা আছেন, তাগের দেখতে ক’দিন গেছিস?’
অপু মনেমনে ভাবে যে, এসব কথার কি কোনো জবাব দেওয়ার আছে! এখন উচিত কথা বলতে গেলেই তো ফাঁৎ করে গায়ে আগুন জ্বলে উঠবে! শহরে খাটে বসেবসে অনেক পটপট করা যায়! অন্যকে বেশ সবক শোনানো যায়! কিন্তু মুখে সে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না।
শফি জানে এমন প্রশ্নের কোনো জবাব আপাতত অপুর কাছে নেই। তাই সে জবাব আশা না করেই বলতে শুরু করে, ‘শুনেছি ওহানে আছিয়ার বোন সুফিয়া থাকে। সে ওহানেরই কোনো একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে। তবে স্বীকার করি মেয়েডা দেখতি-শুনতি খারাপ না। যারে ভালো লাগে তারে বারবার দ্যাহার জন্যি মনডা কেমন কেমন করে। মনে হয়, না দেখলি পরাণ যায়! তাক না পালি জীবনডাই অর্থহীন।
কহনো কহনো এমনডা মনে আসতেই পারে। কিন্তু দেখতে ভালো লাগলেই তারে ভালোবাসা কতি হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ভালোলাগাডা ভালোবাসা বা প্রেম কোনো পর্যায়েই পড়ে না। এরে বলতে পারিস মোহ। বরফ খুব ঠাণ্ডায় জইমে যায়।
দেখলে মনে হয় খুবই কঠিন বস্তু। কিন্তু তাপমাত্রা যহন বাইড়ে যায়, তহন কিন্তু বরফ গলতি আরম্ভ করে। মোহ ব্যাপারডাও তেমন। একটু যন্ত্রণার তাপ বা অবিশ্বাসের চাপে ভাইঙে টুকরো হয়ে যায়। এই যেমন ধর, মেয়েডারে তুই ভালোবাসিস বলে মনে মনে বিশ্বাস করিস। কিন্তু যদি শুনিস ওরে কেউ ধরে নিয়ে রেপ কইরেছে তহনও কি তোর ভালোবাসা থাকবে? ওরে আগের মতন ভালোবাসতে পারবি?’
‘এমনডা কহনো হয় নাকি?’
অপু বিস্মিত হয়ে মাথা তোলে।
শফি কেমন যেন বোকা বনে যায়। সে কিছুক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে অপুর মুখের দিকে। বলে, ‘ঠিক বলছিস তো? ভেবে চিন্তে বলিস!’
‘ভেবে চিন্তেই বলেছি।’
অপুর কণ্ঠস্বর কিছুটা জোরালো শোনায়।
‘তালি দ্যাখ, সত্যিকারের প্রেম-ভালবাসা হলি, মেয়েডার যা-ই হোক তুই তারে আগের মতই ভালোবাসতি। তোর বিশ্বাসে ফাঁক থাকতো না। সুতরাং সুফিয়ার প্রতি তোর এডা এক ধরনের মোহ।’
শফি থামলেও অপুর মুখে কোনো কথা যোগায় না। সে চুপ করে থাকলে আগের কথার সূত্র ধরেই শফি বলে, ‘মেয়েডার লেখা-পড়া কদ্দুর? ‘
‘যদ্দুর করেছে না করার মতই।’
‘ভাইবে দ্যাখ, বলতে গেলে মূর্খই। এই মেয়ে বিয়ে করলে সংসার চলবে মানি, কিন্তু জীবন চালানো দায় হয়ে পড়বে। জীবন ধারণ আর জীবন যাপন কিন্তু এক না। আরে, যে মেয়ে পারবে না দুডো ভদ্র ফ্যামিলির সঙ্গে মিশতি, পারবে না আমাগের সঙ্গে খাপ খাওয়াতি, কী করবি এমন মেয়ে বিয়ে কইরে? মানলাম জীবনডা তোর। তা নিয়ে আমাগের ভাবনা নিরর্থক। কিন্তু এডা তো স্বীকার করবি যে, বাচ্চারা তাগের প্রাইমারি শিক্ষাডা পায় মায়ের কাছ থেকেই। কারণ, বাপ তার সন্তানদের বেশি সময় দিতি পারে না। যে কারণে মায়ের প্রভাবডাই বেশি পড়ে। কাজেই, যে মা নিজেই কিছু জানে না, সে তার বাচ্চাগেরে কী শেখাবে? ওরা কি মানুষ হবে? হয়তো বলবি যে, স্কুলেই শিক্ষা পেয়ে
যাবে। কিন্তু স্কুলের আগে যে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড, এডুকেশন, এডা কি একটা মূর্খ মেয়ের কাছ থাইকে আশা করা যায়?’
মেঝের দিকে তাকিয়ে অপু কিছুটা প্রতিবাদের সুরে বললো, ‘সবাই যে শিক্ষিত হবে এমন তো কোনো কথা নেই। অ্যাকাডেমিক শিক্ষাডাই শুধু শিক্ষা নয়, প্রকৃতির কাছেও অনেক কিছু শিখার আছে।’
‘আছে কলাডা!’ শফি রেগে ওঠে। ‘তালি জঙ্গলে চইলে যা! মানুষের তৈরি সমাজে বসে প্রকৃতিরে টানলে চলে না। এহানে সে অচল। দ্যাখ, অ্যাহনো সময় আছে, এসব আজে বাজে চিন্তা ছেইড়ে পড়া-লেখাডা শেষ কর। নিজের পায়ে আগে দাঁড়া।
তহন গোল্লায় যাবার অনেক রাস্তাই পেয়ে যাবি! তবে এডা মনে রাহিস, এহনো আমাগের বাবা-মা বেঁচে আছেন। তাগের সঙ্গে আছে অনাথ ভাতিজা-ভাতিজি। ওগেরে আমরা ছাড়া দ্যাখবার কেউ নেই।’
তারপর হাত নেড়ে বললো, ‘এখন ভাগ। কী কলাম, চিন্তা কইরে দ্যাখ। আর ধানাই পানাই ছাইড়ে ভালো হয়ে যাবার চেষ্টা কর!’
অপু উঠে আসার সময় দেখলো, লুবনা টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে আসছে। তারপর নিজের রুমে যেতে যেতে শুনতে পেলো, লুবনা শফিকে বলছে, ‘উলু বনে যতই মুক্তা ছড়াও, লাভ নেই! কোনো লাভ নেই!’
‘আরে আছে, আছে!’
বিজ্ঞের মত হাসলো শফি। সে ধরেই নিয়েছে যে, অপু তার ভুলটা ধরতে পেরেছে। এবার সুফিয়ার দিক থেকে নিজকে সরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে।
কিন্তু গভীর রাতে অব্যক্ত যন্ত্রণার কষাঘাতে বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদলো অপু। যে কান্না তার একান্তই ব্যক্তিগত। যা শফি কিংবা অন্য কারুর শুনবার-দেখবার অধিকার নেই।
কাঁদতে কাঁদতে সে ভাবছিলো যে, আর দুটো সপ্তাহ আগেও যদি শফি কথাগুলো বলতো, তাহলে তার পক্ষে ফেরা সম্ভব ছিলো। কিন্তু এখন তো আর সে উপায় নেই। যা ঘটার তা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে।
তিন
অপু আর সুফিয়ার বিয়ের খবরটা দিন কয়েকের মধ্যেই এ কান ও কান হয়ে পৌঁছে গেল তাদের গ্রামের বাড়ি। খবরটাকে প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও মুখেমুখে পুরোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। শ্রোতাদের যার সঙ্গেই দিপুর দেখা হয়েছে, সেই একবার করে জানতে চেয়েছে, ‘অপু নাহি বিয়ে করেছে?’
প্রশ্ন শুনে বিস্ময় কাটে না দিপুর। এটা আবার কেমন খবর? এরা কোত্থেকে জানলো? খুব তাড়াতাড়ি নিজকে সামলে নিয়ে দিপু পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘খবরডা দিলো কেডা?’
শ্রোতা খবরের উৎস গোপন রেখে বলে, ‘খবরডা যার কাছ থেকেই পাই, আগে বল কতাডা সত্যি কিনা?’
‘এই শুনলাম! সত্যি-মিথ্যে জানিনে!’
নিরীহ জবাব দিপুর। কিন্তু এতেও সে পার পায় না। সমবয়সীরা টিটকারি দিতে ছাড়ে না। ‘বড় ভাই থাকতি ছোড ভাই বিয়ে কইরে ফেললো! ছি! ছি! শালা মর! কচু গাছে ফাঁসিতে ঝোল!’
কেউ কেউ অপু দিপুর পার্থক্য না বুঝে সোজা দিপুকেই জেরা করে বসে, ‘তুই নাহি সুফিয়াক বিয়ে করিছিস?’
দিপু ভেতরে ভেতরে রাগে পুড়লেও তা বাইরে প্রকাশ করে না। বলে, ‘তা ওরে গিয়েই জিজ্ঞেস করো না!’
প্রথম প্রথম ব্যাপারটাকে এড়িয়ে যেতে চাচ্ছিলো সে। কিন্তু হিতে বিপরীত হলো। সবাই ভাবলো যে, এটা তার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা। শেষে অনেক ভেবেচিন্তে উত্তরের ধরণ পাল্টায় সে। এবার যেই এ ব্যাপারে জানতে চায় তাকেই বলে, ‘অপু বিয়ে করলি কার এমন মাতায় বাড়ি?’
আর কি আশ্চর্য! আচমকাই যেন প্রশ্নটা থেমে গেল।
কথাটার সত্যাসত্য নিয়ে অনেক ভেবেছে দিপু। কিন্তু এটাকে নিছক গুজব বলে উড়িয়ে দেওয়ার মত অকাট্য যুক্তিও দাঁড় করাতে পারেনি। কেননা, এক লাখ এক টাকা দেন-মোহরের কথাটা প্রচার হয়েছে ফলাও করে। যে জন্য সে এটাকে গুজব বলে মানতে পারছে না। তা ছাড়া সুফিয়ার পরিবারের সদস্যরাও হয়তো ব্যাপারটাকে সমর্থন করছে। এ ব্যাপারে তাদের নির্বিকার থাকাটাও একটা প্রধান কারণ।
সপ্তাহ খানেক পর মনিরা তার স্বামী আফজালকে নিয়ে বেড়াতে এলে দিপু তাদের সঙ্গেও অপুর বিয়ে নিয়ে কথা বলে। আফজাল সব শুনে বললো ‘এ আর এমন বিচিত্র কি!’
‘সালাম চাচার ইচ্ছে যে, ওদের বিয়েটা হোক। কিন্তু বাবা-মা, শফি ভাই, আপা এরা কেউ মানতে রাজি নন। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে, এটা একটা রটনা।
যাতে করে অপু জেদের বশেই সুফিয়াকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়?’
আফজাল বিচক্ষণ মানুষ। লোক চরিয়ে খায়। সে হেসে বললো, ‘আমার তো তেমনটা মনে হচ্ছে না।’
দিপু কিছুটা নড়ে চড়ে বললো, ‘আপনার মনে না হওয়ার পেছনে যুক্তিটা কি?’
আফজাল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো, ‘তোমার কি মনে হয় যে, কোনো বাবা-মা তাদের বিয়েরযোগ্য মেয়ের নামে এমন মিথ্যে প্রচার চালাবে? আর তোমার কথা অনুযায়ী এটা রটনা হলে, ভবিষ্যতে মেয়েটার অন্য কোথাও বিয়ের সম্ভাবনাটা নষ্ট হয়ে যাবে না?
কাজেই আমার মতে জেনে শুনে কেউই এমন একটা বোকামি করবে না।’
দিপু কিছুক্ষণ উপর নিচে মাথা দোলায়। তার চেহারায় কেমন একটা পরাজিতের ছাপ ফুটে ওঠে। হঠাৎ করেই সে বললো আবার, ‘একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে স্বীকার না করে উপায় নেই। তবে আরেকটা দিক ভাবলে…।’
‘আমিও তাই মনে করি।’
দিপুর কথায় বাঁধা দিয়ে বলে উঠলো আফজাল। ‘সুতরাং বিয়ের কথাটা যে স্রেফ মিথ্যে কিছু নয়, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
‘বিয়েটা যদি সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে বাবা-মা ভীষণ দুঃখ পবেন। বিশেষ করে সুফিয়াকে মা কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবেন না। আর বউ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না!’
আফজাল মাথা নেড়ে বললো, ‘ঝাল যে পছন্দ করে, চোখের পানি-নাকের পানিকে সে ভয় পায় না! তবে এটা খুবই একপেশে চিন্তা হয়ে যাবে। অপু যদি রাস্তার একটা মেয়েকে নিয়ে সুখী হতে পারে, তাহলে তো মা-বাবার অখুশি হওয়ার কথা নয়! আর যদি পুরোনো ঝগড়া-বিবাদের কথা মনে রেখে মেয়েটাকে দূরে সরিয়ে রাখেন, তাহলে এটা খুব একটা ন্যায় সঙ্গত হবে না। কেননা, দুটো পরিবারের ঝগড়া-ঝাটি, মনোমালিন্য সারাজীবন ধরে থাকে না। দুনিয়া-জোড়াই তো এসব হয়। হচ্ছে। তাই বলে ওটাকে জীবনভর মনের ভেতর লালন করতে হবে? দেখো, একদিন এমন একটা সময় আসবে,যখন দেখা যাবে তিনি নিজ থেকেই ছেলের বউকে মেনে নিয়েছেন।’
দিপুর মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। মাকে সে ভালো মতই চেনে। তিনি যে সুফিয়াকে বউ হিসেবে মেনে নেবেন আর কখনো বউমা বলে ডাক দেবেন, এমনটা চাঁদ-সুরুজ উল্টে গেলেও সম্ভব না। তিনি এমন একজন মহিলা, যিনি মুখ দিয়ে একটা কথা বের করলে খুব ভেবে চিন্তেই বলবেন। সেখানে আর কারো মতামত চলবে না। ভাঙবেন কিন্তু মচকাবেন না। কাজেই আফজালের কথায় সে এক মত হতে পারে না। কিন্তু তা নিয়ে আর তর্কে যেতেও আগ্রহী হয় না।
‘তারপর দীপঙ্কর সাহেব, তোমার খবর-টবর বলো।’
ইচ্ছে করেই যেন আফজাল অপুর প্রসঙ্গটাকে থামিয়ে দিতে ভিন্ন কথার অবতারণা করে। ‘বেকারত্বের বিকল্প কিছু চিন্তা-ভাবনা করেছো, নাকি?’
দিপুর মুখাবয়বে আবছায়া একটা পর্দা নেমে আসে যেন। হতাশ ভঙ্গিতে বললো, ‘কী করবো! আমাকে দিয়ে কিছু হবে-টবে না!’
‘চাকরি-বাকরির কোনো চেষ্টা তদ্বির করছো, নাহ্?’
‘চেষ্টা তো কম করলাম না। কিন্তু তদ্বিরটা অসম্ভব! আমার সে জোর বা ভরসা কোনোটাই নেই।’
‘তাহলে তোমার চাকরি কোনো কালেই হবে না!’
তারপর একটু ঝুঁকে পড়ে আফজাল আবার বললো, ‘ঘুষ ছাড়া আজকাল কোনো কাজ হয়? আমাদের মহামান্য প্রেসিডেন্ট নিজের হাতে ঘুষ-টুশ নেন বলে শুনেছি।’
‘সে তো নিতেই পারে। তার চারদিকে কত্ত মৌমাছি দিন রাত গুনগুন করছে। তাদের পুষতে আলাদা একটা খরচ আছে না!’
দিপুর কণ্ঠে বিরক্তি এবং বিদ্বেষ দুটোই এক সঙ্গে চুইয়ে পড়ে।
চার
আজকাল রাজনৈতিক ব্যাপারে দিপুর প্রচণ্ড অনীহা। কোনো কারণে ওদিকটা আলোচনায় ঢুকে পড়লে প্রায় ক্ষেপেই ওঠে। কোনো দলকেই ছেড়ে কথা বলে না। সবার উপরেই তার একটা না একটা অভিযোগ খাড়ার মত ঝুলছে।
যেমন, যে কোনো দলই ক্ষমতায় গেলে তাদের প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যায়। যাবতীয় সুযোগ সুবিধা তাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য আলাদা করে রাখে। এখানে সাধারণ মানুষের কোনো গুরুত্ব নেই। দলের মানুষ যতই অন্যায় করুক, তাদের রক্ষার জন্য আয়োজন হয় বিশেষ ব্যবস্থার। ন্যায় আর অন্যায় বলে যে দুটো শব্দ অভিধানে আছে, সেটা তাদের মনে কোনো ধরণের প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কথায় বলে না যে, যে যায় লঙ্কা সে হয় হনুমান! আমাদের নেতারা ক্ষমতায় বসলেই হয়ে ওঠেন লোভী শিয়ালের মত। আসলে আমাদের বাংলাদেশে সাধারণ জনতার কষ্টের মূলে এই নেতারাই। তাদের মিথ্যাচার, লোভ, স্বজনপ্রীতি, সবই জনগণের দুর্ভোগের কারণ।
তা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে এত বেশি কাদা ছোঁড়াছুড়ি হয়েছে যে, সেই অবসরে একাত্তরের পরাজিত শক্তিটা নিজেদের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করে নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, যে কোনো সরকারেই তাদের কোনো না কোনো প্রতিনিধি থেকে যায়। আর সুযোগ মত খাঁটি মুক্তিযোদ্ধাদের দেশপ্রেম নিয়ে, একাত্তরে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে কটাক্ষ করে। ইচ্ছাকৃত ভাবে তাদের বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে।
এটা তারা এ জন্যই করতে পারে, কারণ প্রত্যেক দলই দু’একজন রাজাকার নিয়ে তাদের মন্ত্রীসভা গঠন করে। এ না হলে প্যানেল পূর্ণতা পায় না। হায়রে অভাগা দেশ! দিপু অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে না। সমর্থন বলতে দলের একনিষ্ঠ সদস্য বা অন্ধ-সমর্থক নয়। দেশের উন্নতিকল্পে বিভিন্ন দলের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই দলগুলোর কর্মকাণ্ড দেখে তাদের সম্পর্কে মন্তব্য করতেই পছন্দ করে বেশি।
আজকাল আরেক কাঠি এগিয়ে গিয়ে সে বিভিন্ন বিষয়ে লোকজনের সঙ্গে নানা তর্কেও জড়িয়ে যাচ্ছে। যেমন হোসেন আলি পাইক আওয়ামী লিগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও সমর্থক। তার সাথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও একবার তুমুল বিতর্ক হয়ে গেল।
সেদিন হোসেন আলি পাইক কথায় কথায় বলছিলো যে, জয়বাংলা তাদের দলীয় শ্লোগান। আর যায় কোথায়! দিপু উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে, ‘তোমাগের বাবার সম্পত্তি না জয়বাংলা!’
হোসেন আলি পাইকও ছেড়ে দেওয়ার লোক না। বলে, ‘আমাগের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এই শ্লোগানের মালিক। কাজেই আওয়ামী লিগই এডার অধিকার রাখে।’
দিপু রেগে যায় আরো। ‘শালা, তোমার বঙ্গবন্ধু না জনগণ মালিক? এই ঘিলু নিয়ে পলিটিক্স করো, না? আমাগের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল মন্ত্র হচ্ছে এই জয়বাংলা। ফ্রিডম ফাইটারগের সঞ্জীবনী দাওয়াই। এডা কি তোমার ক্ষেতের কুমড়ো যে, ইচ্ছে হলি ঘরে তুইলে রাখবা, আবার ইচ্ছে হলি বাইরে বার কইরে আনবা?’
তারপর সাবধান করে দেওয়ার ভঙ্গিতে দিপু বলেছিলো, ‘দ্যাখ হোসেন আলি! শেখ মুজিব, জয়বাংলা আর মুক্তিযুদ্ধ, এই তিনডে মিলে আমাগের স্বাধীনতা। এর কোনো একটা বাদ পড়লি অন্য দুডো অর্থহীন। বুঝতে পারিছিস গাধা!’
অপমানে হোসেন আলি পাইকের মুখ লালচে দেখায়। সে বলে, ‘এই, তুই এ্যাত ফাল পারিস ক্যা? গণ্ডগোলের বছর তোর বয়স কত ছিলো, আমি দেহিনি মনে করিস?’
দিপু লাফিয়ে যায় হোসেন আলির সামনে। বলে, ‘এই গণ্ডগোল কিরে? বল স্বাধীনতা যুদ্ধের বছর। গোলাম আযমের মত কতা কইস ক্যান? তুই না স্বাধীনতার পক্ষের দল করিস! তোরে কেউ বুঝোয়ে কয়নি যে, গণ্ডগোল আর মুক্তিযুদ্ধ এক না? তোগের মতন যেই শুয়োরের বাচ্চারা মুক্তিযুদ্ধরে গণ্ডগোল কবি জুতো মেরে দ্যাশ ছাড়া কইরে দেবো! এই স্বাধীন দ্যাশের মাটিতে তোগের জায়গা নেই!’
ওদের তর্ক আর চেঁচামেচিতে বেশ কিছু মানুষ তামাশা দেখার জন্য তাদের ঘিরে ধরেছিলো। সেই ভিড় থেকে কেউ একজন বললো, ‘তালি গোলামরে বাংলাদ্যাশে ঢুকবার দেছে ক্যান? ওরেও তো জুতো মারতি অয়! যারা ঢুকবার দেছে তাগেরেও।’
দিপুর যেন হুঁশ হয়। লোকজনের ভিড় দেখে কিছুটা চুপসে যায় সে। তবুও সে বক্তার উদ্দেশ্যে বলে, ‘গোলামরে সত্যি সত্যি জুতো মারতি না পারলেও এই দ্যাশের মানুষ ঘেন্না করে!’
দিপু বুঝতে পারে, ওরা ধরেই নিয়েছে যে, দুজনে ঝগড়া লেগে গেছে। এ খবর হয়তো আক্কাস শেখের কানেও গিয়ে থাকবে। তিনি ছুটে এলেন। বললেন, ‘তোমরা দুজনে না কত গলাগলি দোস্ত! ঝগড়া লাইগলো কি নিয়ে?’
দিপু বলে, ‘ঝগড়া না চাচা! এমনিই তর্ক বাঁইধে গেল!’
পরে অবশ্য হোসেন আলি তার ভুল স্বীকার করে নিয়ে বলেছিলো, ‘আমি দলবাজি করি ঠিকই। কিন্তু দল আর দ্যাশের মর্ম এ্যাহনো অতডা বুঝিনে। কিন্তু তোর মদ্যি দ্যাশের জন্যি আর দ্যাশের ইতিহাসের জন্যি অনেক মায়া রয়েছে। তুই আমাগের দলে চইলে আয়। যুবলীগের থানা কনভেনার হতি দেরি হবে না। তোর নেতা হবার গুণ-জ্ঞান দুডোই আছে।’
দিপু হেসেছিলো। কোনো জবাব দেয়নি। বর্তমান রাজনীতির নোংরা আর অন্ধকার দিকটা সম্পর্কে বেশ ভালো করেই জানা আছে তার। আজকাল পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়, অমুক দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে অমুক ছাত্রনেতা খুন। আসলে রাজনীতির অন্ধকার দিক থেকে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে ব্যর্থ হয়, সে পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারও হারিয়ে ফেলে।
আফজাল দিপুকে সিগারেট সাধলে সে তা নেয় না। বলে, ‘ছেড়ে দিয়েছি।’
‘সত্যি?’
আফজাল অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে দিপুর দিকে। বলে, ‘এও কি সম্ভব? তুমি না বলতে, মরার সময়ও তোমার হাতে সিগ্রেট থাকবে?’
‘বলেছিলাম। এখনো হয়তো তাই বলতাম। কিন্তু ছেলেরা আমাকে ধূমপান নিবারণী সভার প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দিলো যে!’
‘ও, তাই বলো!’
আফজাল হাসে হা হা করে। ‘আমি তো ভেবেছিলাম প্রেয়সীর বুঝি অপছন্দ!’
‘প্রেয়সী!’
দিপু ঠোঁট বাঁকিয়ে কাঁধ নাচায়। তারপর বলে, ‘ভাবলে বড় দুঃখ হয়, বুঝলেন! এই যে এত ভালো বাসা-বাসি, প্রেম-প্রেম, আপনারাও প্রেম করেই বিয়ে করলেন। কিন্তু এই একটা ব্যাপার আমি আজও বুঝতে পারলাম না। মন থেকে কাউকে এ জীবনে বলতে পারলাম না যে, ভালোবাসি!’
‘হৃদয় তোমার হয়তো বা এক শুষ্ক সাহারা, বুকের তলায় পাষাণ প্রাচীর দিচ্ছে পাহারা!’
অবাক হয়ে যায় দিপু। মনে মনে আফজালের কথাগুলো আওড়ায়। বলে, ‘আপনারও কবিতা আসে?’
‘আরে, এমন কোনো মানুষ নেই, যে জীবনে দু’একটা কবিতা লেখেনি, মুখেমুখে গান বাঁধেনি। কিংবা ধর, খুব গুছিয়ে কোনো একটা কথাকে সুন্দর করে উপস্থাপন করেনি। মনের আবেগ অনুভূতিকে সুন্দর ভাষায় মনোগ্রাহী করে প্রকাশের নামই তো কবিতা না হয় গান। রবীন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত কথাটা পড় নি?’ বলেই আফজাল সিগারেট ঠোঁটে লাগায়।
দিপু তখনই উঠে যায়। সিগারেটের ধোঁয়া নাকে গেলে বহু দিনের অভ্যাসটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারে।
বাচ্চা কোলে উঠোনের পেয়ারা গাছটার নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো মনিরা। দিপুকে দেখতে পেয়েই সে বললো, ‘মুন্নাকে একটু ধর না ভাই! রান্না ঘরে যেতে পারছি না!’
মুন্নাকে দিপুর কোলে গছিয়ে দিয়ে মনিরা চলে যেতেই হঠাৎ বাচ্চাটা দিপুর নাকে কামড় বসিয়ে দেয়। তার নিচের মাড়িতে সাদা বরফের টুকরোর মত ছোট ছোট দুটো দাঁত উঠেছে। আর সেটাই হয়তো সদম্ভে ঘোষণা করতে যেখানে সেখানে দাঁত বসায়।
‘মুন্না!’
ঘর থেকে আফজাল ডাকে তার ছেলেকে।
মুন্না কি বুঝলো কে জানে। আফজালের দিকে তাকিয়ে তার দাঁত দুটো দেখিয়ে নিঃশব্দে হাসে।
তারপর দু ঠোঁট এক করে অনবরত ফেনা ছেড়ে বিচিত্র ভাবে বুব্ বুব্ শব্দ করতে থাকে।
মুন্নার দিকে তাকিয়ে দিপুর মনে হয়, মুন্নারাই জগতে প্রকৃত সুখী। কারণ, এ বয়সটাতে তাদের কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই। নেই কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা। তার যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য সুবিধা-অসুবিধা সবই অন্যের ব্যাপার।
আফজাল আর মনিরা মুন্নাকে নিয়ে পরদিনই চলে গেল। মিজান সাহেব আর আসমা বেগম দুজনেই তাদের থাকতে বললেন, কিন্তু ওরা থাকে না। মেয়েরা এমনই। যখন নিজেদের সংসার হয় তখন আর কোথাও তাদের মন টেকে না। যতক্ষণ আপন গণ্ডি অর্থাৎ নিজ সংসারে না যেতে পারবে ততক্ষণ শান্তি নেই।
তাদের এগিয়ে দেওয়ার জন্য দিপু গিয়েছিলো বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। ফিরে আসার পথে ইউনিয়ন বোর্ডের কাঁচা সড়ক দিয়ে খুব জমকালো পোষাকে আবৃত এক যুবতীকে হেঁটে আসতে দেখলো।
দিপু ভাবলো, এ আবার কাদের মেয়ে? আশ-পাশের কোনো গ্রামের বলেও তো মনে হচ্ছে না। শহুরে বোধ হয়। কোনো আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে এসেছে।
যুবতী হাঁটতে হাঁটতে ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশে দেখছিলো। মনে হচ্ছিলো বহুদিন পর সে তার পরিচিত চারপাশটাকে বুঝে নিতে চাচ্ছে।
দিপু তার আচরণ লক্ষ্য করে কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
হাঁটতে হাঁটতে যুবতী একবার পেছন ফিরে তাকাতেই তাকে চিনে ফেললো দিপু। যুবতী আর কেউ নয়। নতুন খবরের প্রসূতি সুফিয়া। আর তাকে দেখতে পেয়েই মাস ছয়েক আগে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় দিপুর।
পাঁচ
ভাদ্রমাস।
তাল পাকা গরমে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। তার উপর একই বিছানায় দিপুরা শুয়েছিলো তিনজন। মাঝখানে থেকে ঘুমাতে পারছিলো না দিপু। দরজা জানালা হাট করে খোলা। তবু বাতাস নেই একরত্তি। দুপাশে সুরুজ ক্বারির ছেলে হৃদয় আর নান্না খন্দকারের ছেলে পচা-পাগলা মরার মত ঘুমুচ্ছে। পচা-পাগলা নামটা কোনো এক ঘটনা থেকেই জন্ম। কিন্তু সেই ঘটনার কথা দিপু বা হৃদয় জানে না। গ্রামের অন্যান্য ছেলেরা তাকে এ নামেই ডাকে। প্রথম প্রথম নিজের নামের বিকৃতি শুনে খুবই ক্ষেপে উঠতো সে। কিন্তু ধীরেধীরে সেটা মেনেও নিয়েছে। তার অবশ্য ভালো একটা নাম আছে। সেটা হচ্ছে আলুঙ্গীর।
দিপু যদিও অনেক চেষ্টা করেছে দুজনের মাঝখানে থেকে ঘুমোনোর জন্য। কিন্তু সামান্য নড়াচড়া করলেই দুজনের কারো না কারো গায়ে লেগে যাচ্ছিলো। আর ঘামে ভেজা শরীরের স্পর্শে তার অস্বস্তি বাড়ে। এ অবস্থায় দুজনের মাঝখানে নিথর হয়ে পড়ে থাকা অসহ্য। ঘুম-টুম ছুটে পালায় চোখের পাতা থেকে। সে আর বিছানায় পড়ে থাকতে পারে না। উঠে পড়তে বাধ্য হয়।
এ মুহূর্তে তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে হৃদয়ের উপর। কারণ, তার কথামতই তিনজন একত্রে থাকতে যেয়ে এমন অসুবিধাটা পোহাতে হচ্ছে দিপুকে। সে হৃদয়ের প্রস্তাবটায় না করেতে পারেনি। প্রায় একবছর পর চিটাগাং থেকে বাড়ি এসেছে সে। তাই দীর্ঘ দিন পর তিন বন্ধু সারাটা বিকেল একসঙ্গে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর আবার এক জায়গায় জুটেছিলো।
আড্ডায় আড্ডায় রাত বেড়ে যাওয়াতে হৃদয় বলেছিলো, ‘কত্তদিন পর তিনজন একখানে হলাম। আজ রাতটাও না হয় এক সঙ্গেই কাটিয়ে দেই। কি কইস দিপু?’
সেই কথা রাখতে গিয়েই আজ নিজের ঘুমটা নষ্ট হলো দিপুর। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা আর কি!
বিছানা ছেড়ে উঠোনে নেমে আসে দিপু। উপরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। চাঁদ হীন আকাশে অসংখ্য তারার মেলা। দেখতে বেশ লাগে। সালাম মিয়া উঠোনে বসে কুপির আলোয় কোরআন তেলাওয়াত করছেন।
একবার খুক করে কাশি দেয় দিপু। সালাম মিয়ার কণ্ঠের পর্দা খানিকটা উঁচু হয় যেন। পেছন দিকে উঠোনের কোণে বাঁধা সালাম মিয়ার গরু দুটো শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিলো। আর কিছুক্ষণ পরপর ফোঁস করে নাক দিয়ে বাতাস ছাড়ার সময় অদ্ভুত একটা শব্দ করছিলো।
দিপু ধীরেধীরে উঠোনে পায়চারী করতে থাকে। এভাবে একবার উঠোনের উত্তরে যায়। সেখান থেকে এ্যাবাউট টার্ন নিয়ে আবার দক্ষিণে। কিন্তু দক্ষিণ প্রান্ত থেকে একই কায়দায় ফিরে আসার সময় দেখতে পায় রসুই ঘরের জানালায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
অন্ধকারে কখনো কখনো ছায়া বা অন্ধকার কিছুটা ঘন হলে অনেক সময় এমন অনেক কিছুই মনে হয়। কোনো ছায়া-টায়া দেখেও বিভ্রান্তি আসতে পারে। ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়েই সে ফিরে আসে। আবার দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে ফিরে আসার সময় একই রকম মনে হয়। সে কৌতূহলী হয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যায়। না। সত্যিই কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে।
চোর-টোর নয় তো? আরো সতর্ক হয়ে এগোয় সে। মনে মনে ভাবলো, হাতে একটা লাঠি-সোটা থাকলে বেশ হতো। সে এদিক ওদিক সাবধানী দৃষ্টি ফেরায়। কোনো কিছু লাঠির বিকল্প হিসেবে দেখতে পায় কি না। কিন্তু এমন কিছু তার চোখে পড়ে না। চোরেরা অনেক সময় হাতে ছুরি নিয়ে বের হয়। অসাবধান হলে আহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সে পেছন থেকে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত সমেত জাপটে ধরার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যায়। প্রস্তুতির শেষ মুহূর্তে বিস্মিত হয়ে সে আবিষ্কার করে যে, চোর-টোর নয়, সুফিয়া!
এত রাতে মেয়েটা এখানে করছে কি? জানালার ওপাশে বিছানায় কি অপুও জেগে আছে? তার তো জ্বর ছিলো বলে মায়ের কাছে শুনেছে। দিপুর সন্দেহ হয়। আরো কিছুটা এগিয়ে যেতেই মৃদু ফিসফিসানি শুনতে পায়। নৈশালাপে নিমগ্ন দুজনেই।
মা যখন বলেছিলেন দিপুর জ্বর, সে ধারণা করেছিলো, ওটা অপুর ভান। জ্বর-টর কিছু না। এখন দেখছে আসলেও তাই। দিনের বেলা মা আসমা বেগম দিপুর কথায় দুঃখ পেয়ে বলেছিলেন, ‘সে কিরে! জ্বরে ছেলেটার গা পুড়ে যাচ্ছে আর তুই কিনা বলছিস ভান?’
সব মায়েরাই এমন। সন্তানের সামান্য অসুস্থতাকেও অনেক বড় করে দেখেন। এর পেছনে কোনো উদ্দেশ্য বা মতলব আছে কিনা বা এমন ধরণের কিছু থাকতে পারে তা কখনোই ভাবেন না। বিশ্বাসও করতে চান না।
দিপু সুফিয়ার কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললো, ‘এখানে এত রাতে কি?’ আর তখনই জানালা দিয়ে আবছায়া দেখা গেল, অপু চট করে মাথা নামিয়ে শুয়ে পড়েছে।
দিপুর কণ্ঠস্বরে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলো সুফিয়া। সে যেন এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে, দিপু এ সময় এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তাই যেন সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সুফিয়াকে কষে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে হয় দিপুর। একে তো মেয়ে মানুষ, তার ওপর যুবতী। তা ছাড়া ইচ্ছে করলে তার মুখ চেপে ধরে বিগত দিনের আরোপিত মিথ্যা অভিযোগের শোধটা তুলে নিতে পারে। কিন্তু তার পেটে-পড়া দুকলম বিদ্যা তাকে বর্বরোচিত ইচ্ছা থেকে বিরত রাখে। সে যতটুকু সম্ভব গলা উঁচিয়ে বললো, ‘অসভ্য, বেহায়া মেয়ে! রাত দুপুরে এসব করতি তোর লজ্জা করে না? দিনের বেলা তো খুব সতীপনা দেখাস! এহন কি পাড়া জাগাবো? দ্যাহাবো তোর কীর্তি?’
দিপুর কণ্ঠস্বরে জেগে ওঠে হৃদয় আর পচা-পাগলা। উদ্বিগ্ন হয়ে চোখ ডলতে ডলতে ছুটে এসে ওরাও দেখতে পায় সুফিয়াকে।
সুফিয়ার মাথা হেঁট হয়ে এসেছিলো। তারপর ধীরেধীরে সরে গিয়েছিলো। মিশে গিয়েছিলো অন্ধকারে।
ঘরের ভেতর অপুর বিছানার পাশেই মাটিতে পাটি বিছিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন আসমা বেগম। দিপুর কথা কানে যেতেই ঘুম ভেঙে যায় তাঁর। তিনি উঠে বসে দিপুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি হয়েছে রে?’
‘অপুকে জিজ্ঞেস করো।’
‘ওখানে ছিলো কে?’
সুফিয়া।
‘করছিলো কি?’
‘কী আর! আমাদের গোপালের সাথে খোশালাপ করছিলো!’
দিপুর কণ্ঠে ব্যাঙ্গ নৃত্য করে।
‘তাহলে এই?’আসমা বেগম রেগে ওঠেন। ‘হারামজাদা! অসুখের ভান করে সারাদিন আমাকে খাটিয়ে মারবে আর রাতের বেলা ঘুষ-ঘুষ করবে মাগির সাথে! বদমাশ কোথাকার!’
তারপর তাঁর রাগ গিয়ে পড়ে সালাম মিয়ার ওপর। দরজা খুলে তিনি বেরিয়ে আসেন। উঠোনে সালাম মিয়াকে দেখে তাঁর রাগ যেন আরো দ্বিগুণ হয়ে জ্বলে ওঠে। ‘ওই ভণ্ডটা ওখানে করছে কি? রাত-বিরাতে মেয়ে কি করে, কোথায় যায়, খবর রাখে না?’
সালাম মিয়া ব্যাপারটা টের পেয়ে তেলাওয়াতের শব্দ কমিয়ে দিয়েছিলেন।
আসমা বেগম তীব্র রোষে বললেন, ‘খুব তো পরেজগারি হচ্ছে! এদিকে মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে কোরান নিয়ে পাহারায় বসা হয়েছে! আর কি! এমন করে মেয়েটাকে যদি গছানো যায়, তো মন্দ কি! ছি!ছি!ছি! লাজ-শরম কি এভাবেই ধুয়ে ফেলতে হয়?’
সালাম মিয়া সবই শুনলেন। সবই বুঝলেন। কিন্তু কী বা বলবেন তিনি? বলার মত মুখ তো তার নেই। এখন যে তিনি তলে কাঁচা। আর তলে কাঁচা হলে এমনই হয়। কিছু করার বা বলার সৎ সাহস থাকে না।
এই দু শরিকের মধ্যকার ঝগড়া-বিবাদ, মামলা-মকদ্দমা থেমেছে খুব বেশি দিন হয়নি। সেই সময়কার বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতার ফলে দুপক্ষের কারো মধ্যেই এখনো সৌহার্দ্যের জন্ম হয়নি। আর সেই কারণেই আসমা বেগম অপু আর সুফিয়ার মেলামেশা সহ্য করতে পারেন না। একটা ঘৃণা বোধ অন্তরজ্বালা হয়ে সারাক্ষণ তাঁকে দগ্ধ করে।
রাত তিনটার সময় অপুকে ওষুধ খাওয়ানোর কথা। তাই ঝামেলা এড়ানোর জন্যই আসমা বেগম ছেলের কাছাকাছি পাটি বিছিয়ে শুয়েছিলেন। কিন্তু একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য তাঁর মন বিষিয়ে উঠলো অপুর প্রতি। ফলে, সময় মত ওষুধ খাওয়ানোর ব্যাপারটাকে পণ্ডশ্রম বলে মনে করে, পাটি তুলে নিজের বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। ভাবলেন যে, স্বামী মিজান সাহেব ঢাকা থেকে ফিরলেই ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলবেন।
পরদিন সুফিয়াকে আর গ্রামে দেখা যায় না। হয়তো তার বোন আছিয়ার কাছেই আবার ফিরে গেছে।
প্রথমবার যেদিন আছিয়ার সঙ্গে সে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়, তখন মা-বাবা কারো জন্যই কান্নাকটি করেনি। চলে যাওয়ার সময় তার ছিলো না কোনো পিছুটান। সে তো কারো বুক ভরা স্নেহ-মমতা পায়নি। মায়ার বাঁধনে তাকে বেঁধে রাখতে চেষ্টা করেনি কেউ। যে কারণে তার ছোট্ট মনটাতেও ঠাঁই ছিলো না কারো। সৎ-মা এ বাড়িতে তার স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করার সমস্ত পথ কণ্টকাকীর্ণ করে রেখে দিনদিন তাকে করে তুলেছিলো বহির্মুখী। আর তাই হয়তো সে আপন শিকড় আলগা করে নিয়েছিলো তার পরিবেশ থেকে। হয়তো ভিন্ন কোনো একটা পরিবেশ আশা করছিলো নিজের অজান্তেই।
সুফিয়ার যখন তিন কি চার বছর বয়স, তখন তার গর্ভধারিণী শেষ সন্তান জন্ম দেওয়ার দিন কয়েক আগেই মারা গেলেন। কিন্তু সেই মৃত্যুকে গ্রামের কেউ স্বাভাবিক বলে মেনে নিতে পারেন নি। পাড়াময় একটা গুঞ্জন ছিলো যে, সালাম মিয়া তার স্ত্রী কমলাকে নারকেলের শলার ঝাড়ু দিয়ে ঘটনার দিন বেধড়ক পিটুনি দিয়েছিলেন। আর এই পিটুনি খেয়ে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা কমলা জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। কিন্তু তার সে জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। কোনো ডাক্তার বা বৈদ্য ডাকেননি সালাম মিয়া।
নিঃসন্দেহে এটা ঠাণ্ডা মাথায় একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। পরদিন কাফন-গোসলের সময় মেয়েরা কমলার শরীরে বিঁধে থাকা ঝাড়ুর শলাকা খুলেছে আর হায় হায় করেছে। কিন্তু থানায় যাওয়া বা পুলিশে খবর দেওয়ার মত চিন্তা-ভাবনা ছিলো না কারো।
অথচ সালাম মিয়া যৌবনের উশৃঙ্খলতায় উন্মাদ হয়ে একদা পরমতলা গ্রামের জব্বরকে ছুরি দেখিয়ে পাশের গ্রাম বাউটিহারার সুজার মেয়ে সুন্দরী কমলাকে তালাক দেওয়াতে বাধ্য করেছিলেন। তারপর তিনি বিয়ে করেছিলেন কমলাকে। আসমা বেগম বলেন যে, শরিয়তের বিধান অনুযায়ী সালাম-কমলার বিয়ে বৈধ নয় বিধায়, কমলার গর্ভজাত সুফিয়ারা সবাই জারজ সন্তান।
কমলাকে দাফন করে চল্লিশ দিন না পেরোতেই সালাম মিয়া বিয়ে করে বউ নিয়ে এলেন। কিন্তু সেই বউ ভালো না। তার চুরি করার অভ্যাস। চাল-ধান-টাকা-পয়সা গোপনে বাপের বাড়ি পাচার করে দেয়। সেও টিকলো না। মায়া নামের এক কন্যার জন্ম দিয়ে বিতাড়িত হলো। তারপর পনের দিনের মাথায় আবার সাঙ্গা করলেন সালাম মিয়া। সেই থেকেই সুফিয়াদের দুর্দশার শুরু। কারণ, সালাম মিয়ার এবারকার স্ত্রী সাংসারিক অভিজ্ঞতায় বিশেষভাবে সমৃদ্ধ। ইতোপূর্বে ছ’টি সংসার করে বাপের বাড়ি ফেরত এসেছিলেন।
সৎ-মায়েরা তাদের সতীনের সন্তানদের খুব কমই ভালবাসতে পারেন। যদিও কেউ সেটা পারেন পৃথিবীতে তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। সাধারণ সৎ মায়েদের ডাইনি সুলভ ঐতিহ্যের পথ ধরেই সুফিয়াদের উপর পতিত হয় সৎ-মায়ের অশুভ দৃষ্টি। যে জন্যে মায়াকে পালিত কন্যা হিসেবে চলে যেতে হয় ফুপুর কাছে। সৎ-মায়ের বুকে তার জায়গা হয়নি।
নতুন মা কোনো না কোনো ছল-ছুতোয় ঘর থেকে দূরে সরিয়ে রাখতো সুফিয়াকে। খাওয়ার সময় এসে শূন্য হাড়ি দেখে ফিরে যেতো নিঃশব্দে। কারণ, নতুন মায়ের চোখ রাঙানি, মারধর এমন কি দা দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলার ভয় সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরতো তাকে। এমন একদিন এর অন্যথা হয়েছে এ কথা বাড়ির মানুষ তো দূরের কথা, সুফিয়া নিজেই বলতে পারবে কিনা সন্দেহ।
সালাম মিয়া এসবের কিছুই দেখেন না। মেয়ের একটু খোঁজ-খবরও করেন না। টুসটুসে নতুন বউয়ের মিঠে বুলি, সুন্দর চেহারা তাকে করে রেখেছে অন্ধ আর বধির। আত্মজার আত্মার আর্তনাদ তার মর্মে পৌঁছায় না। সুফিয়া এ ঘর ও ঘর ঘুরে চেয়ে-চিন্তে খায়। রাত হলে নিঃশব্দে ঘরের এক কোণে পড়ে থাকে জবুথবু হয়ে। পড়া-লেখা যা হচ্ছে, না হওয়ার মতই। কথায় বলে, মা মরলে বাপ তাওই। সালাম মিয়ার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নতুন করে পরপর দু বছরে জন্ম দিয়েছেন দুটি ছেলে। মায়া বড় হচ্ছে আরেক আশ্রয়ে। সে দিক থেকেও তিনি সম্পূর্ণ দুর্ভাবনা মুক্ত। কিন্তু এখন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে সুফিয়া। নতুন মায়ের চিন্তা হলো আপন নন্দন দ্বয়ের কল্যাণ সাধন।
সুফিয়া বরং ওদের দু ভাইয়ের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এভাবে খেয়ে না খেয়ে নতুন মায়ের চক্ষুশূল হয়ে থাকতে হয়নি সুফিয়াকে। তার বড়বোন আছিয়া হঠাৎ করেই একদিন বাড়ি এলো। বাবার তৃতীয় বিয়ের কারণে অভিমান করে সেই যে গিয়েছিলো মাঝের পাঁচটা বছর আর এ মুখো হয়নি। শেষে নিজ থেকেই অভিমান পর্বটির ইতি টেনে যখন বাপের বাড়ি আসে, সালাম মিয়া তাকে ভাল-মন্দ একটি কথাও জিজ্ঞেস করলেন না। সে ভেবেছিলো এখানে ক’টা দিন থেকে যাবে। শত হলেও এটা তার বাপের বাড়ি। কিন্তু পরিস্থিতি বিরূপ। তার উপর সুফিয়ার দুর্দশা দেখে এক রাতের বেশি দেরি করলো না সে। পরদিন যাওয়ার সময় হাত ধরে সুফিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলো সঙ্গে করে। সেই থেকে সে আছিয়ার সাথেই আছে। সালাম মিয়া হয়তো সেদিন খুশিই হয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন, আপদটা গেল!
সুফিয়া মাঝে-মধ্যে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। তবে বাপ-মা তাকে আগের মত আর অবহেলা করেন না মোটেই। এখন সে চাকরি করছে। দু চার-পাঁচশ করে টাকাও দিচ্ছে। যে গাছ ভালো ফলন দেয়, গৃহস্থ সে গাছের অযত্ন করেন না। সুফিয়াও ফলন খারাপ দিচ্ছে না। বাপ-মায়ের কাছে এখন সে অনেক মূল্যবান।
ছয়
মিজান সাহেব প্রথমে আমল দিতে চাইলেন না কথাটায়। কিন্তু আসমা বেগম তবুও বললেন, ‘মিথ্যে হলে কি আর ওরা বলে বেড়াচ্ছে? যা রটে, তা বটে! কথাটা উড়িয়ে দিতে চাচ্ছো কেন?’
মিজান সাহেব বললেন, ‘স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানুষ কত কিছুই তো করে!’
‘বিয়ের যোগ্য মেয়ের সম্পর্কে মিথ্যে রটিয়ে তাদের লাভটা কি?’
আসমা বেগমের ধারণা, মা-বাবা সব সময় তাদের মেয়েদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন থাকেন। সুতরাং কথাটা সত্য না হয়ে পারে না।
‘তা, ওরা বলছে কি?’
আসমা বেগম বিরক্ত হয়ে কপাল চাপড়ান। ‘এতক্ষণ কী বললাম তাহলে?’
মিজান সাহেব বুঝতে পারেন না তাঁর স্ত্রী কী বোঝাতে চাইছেন। বললেন, ‘পরিষ্কার করে তো বলছো না কিছু!’
আসমা বেগম ক্ষেপে উঠলেন। ‘পরিষ্কার করে বলবো কি, তোমার মাথা?’
‘চোখা কথা বাদ দিয়ে আসল কথাটা বলো।’
‘বলবো আর কি? তোমার ভাই আর তার বউ পাড়ায় পাড়ায় বলে বেড়াচ্ছে!’
‘কার কথা? কি বলে বেড়াচ্ছে?’
‘তোমার ছোট ছেলের কথা!’মিজান সাহেব বিরক্ত হয়ে ওঠেন। ‘তাতো বুঝলাম। কিন্তু করেছেটা কি?’
‘বিয়ে করেছে বিয়ে! তোমার ভাইয়ের মেয়ে কানিটাকে!’
মিজান সাহেবের কপালে ভাঁজ ফুটে ওঠে। বলেন, ‘সালামের কোন মেয়ের চোখ কানা?’
‘ন্যাকা! এখন কিচ্ছু জানে না। সুফিয়ার কথা বলছি। যেটা গার্মেন্টসে চাকরি করে!’
ছোটবেলা সুফিয়ার বাঁ চোখের উপরের পাতায় একটা ফোঁড়া হয়েছিলো। যে কারণে সে চোখটা বন্ধ করতে পারতো না। পরে ফোঁড়া সেরে গেলেও তার চোখের পাতা কখনো বন্ধ হতো না। ঘুমুলেও সেটা খোলা থাকতো।
মিজান সাহেব বুঝতে পেরে বললেন, ‘ওটা তো এক্কেবারে জাহিল মূর্খ! তোমার ছেলে ডুবলো কি করে?’
‘ডুবেছে কি আর সাধে! যাদু যাদু! যাদু-টোনায় কী না হয়!’
আসমা বেগম আবার কপালে করাঘাত করে বিড়বিড় করে কি যেন বললেন আরো। মিজান সাহেব বুঝতে পারলেন না। বললেন, ‘বদমাশটা বাড়ি আসুক। তারপর টের পাওয়াবো মজাটা!’
‘ওই পর্যন্তই! তোমার দৌঁড় কতটুকু তা জানা আছে আমার!’ বলে, চোখের পানি নাকের পানিতে বুক ভাসালেন আসমা বেগম।
তারপর নিজে নিজেই আবার বলতে লাগলেন, ‘এখন খানকির ছেলের বউ হলি কি করে হারামজাদি! আমার ছেলের পাশে শুতে লজ্জা করে না তোর?’
স্বাভাবিক ভাবেই কথাগুলো সুফিয়ার শুনবার কথা নয়। আর শুনলেও কোনো প্রতি উত্তর করতো কিনা কে জানে! তবে মিজান সাহেব বললেন, ‘এত অস্থির হওয়ার কি আছে? অপু নিজে তো আর বলেনি যে, বিয়েটা সে করেছে!’
‘যদি নাই করে থাকবে, তাহলে ওরা বলে কেন?’
‘বলুক না। তুমিই বা শুনতে যাও কেন!’
‘মিথ্যে শুনলে গা জ্বলে যায়!’
মিজান সাহেব মনে মনে ক্ষুণ্ণ হলেন। ছেলে যদি বিয়ে করতোই, বাপ-মাকে বলতে না পারুক ভাই-বোন কাউকে তো জানাতো! কথাটা বিশ্বাস করতে না পারলেও সন্দেহ মুক্ত হতে পারলেন না তিনি।
স্বামীকে চুপ থাকতে দেখে আসমা বেগম ভাবলেন, উনিও ছেলের দুষ্কর্মের নীরব সমর্থক। তাই এখানে বসে থাকাটা নিরর্থক মনে করে উঠে পড়েন।
অন্দরে এসে এক বৃদ্ধাকে লাঠি ভর করে ঢুকতে দেখলেন। সঙ্গে আরেক প্রৌঢ়া।
এদের দুজনকেই পছন্দ করেন না আসমা বেগম। যে সমস্ত মহিলা বিনা কাজে পাড়াময় ঘুরে বেড়ায়, তাদের পেটে অনেক সংসারের স্পর্শকাতর কথা-বার্তাও থাকে। বিশেষ করে এরা একই সময়ে একখানের কথা অন্যখানে না বলা পর্যন্ত শান্তি পায় না। আর মানুষগুলোও যেমন! ওদের কাছ থেকে কথা শুনবার জন্য মুখিয়ে থাকে। দিপু এদের দুজনের নাম দিয়েছে ক্যাসেট।
দু ক্যাসেট আসমা বেগমের বলার অপেক্ষায় না থেকে নিজেরাই পিড়ি টেনে বসে পড়লেন। এদের মধ্যে তারার মায়ের বয়সটা চিনির মায়ের চেয়ে কিছুটা কম হবে।
দেখতেও বেশ শক্ত-সমর্থ। চিনির মায়ের মুখের সব দাঁত পড়ে গেছে বলে সবাই তার কথা বুঝতে পারে না। মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা। চোখের ভ্রূ এমনকি চোখের পাপড়িতে যে ক’টা চুল আছে তাও সাদা। তাকে দেখলে ডাইনি বুড়ির ধারণাটা আপনিই মনের মধ্যে চলে আসে।
তারার মায়ের বয়স অনুমান করা কঠিন। মাথার পঁচানব্বই ভাগ চুল পাকলেও বাকি পাঁচ ভাগ কাঁচা চুলের জোরেই তিনি বুড়িদের দলে পড়তে নারাজ। নাতি-নাতনি সম্পর্কের কেউ যদি একবার তাকে বুড়ি বললো তো সেরেছে! মুখ দিয়ে যা-তা খিস্তির ঝড় তুলে তার চৌদ্দ গোষ্ঠী নরকে পাঠিয়ে ছাড়েন।
আসমা বেগম ভেতরে ভেতরে রাগ করলেও ব্যাঙ্গ করে বললেন, ‘কী তারার মা, কোন খবরটা আগে শোনাবা?’
তারার মা তার তরমুজের বিচি সদৃশ দাঁত দেখিয়ে হাসলেন। ‘না, এমনি আলাম। ঘোষ পাড়ার নলিনীডার সোয়ামী কাইল মারা গিয়েছে। তারে দেহে যাবার সময় ভাবলাম মা’র সঙ্গেও দ্যাহাডা কইরেই যাই। কি মা, কামডা খারাপ করিছি?’
আসমা বেগম ভালো করেই জানেন যে এরা এমনি এমনি আসেননি। মতলব আরো নিশ্চয়ই আছে। এ তো গেল ভূমিকা। আসল কথায় আসতে ঢের দেরি। তিনি হেসে বললেন, ‘খারাপ হবে ক্যান?’
‘এই তো মা বড় মানষি কতা!’
তরমুজের বিচি দেখিয়ে তারার মা আরেকটু কাছে সরে এসে বললেন, ‘কী আর কবো মা! নলিনীর সোয়ামীডা জমি-জিরেৎ বিককিরি কইরে দিয়ে ইন্ডিয়া গে সম্পদ কেনলো। আর নলিনী দূরের গিরামে যেয়ে ভিক্ষে কইরে টাহা পয়সা জমাচ্ছিলো। ভেইবেছিলো ইন্ডিয়া গে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুইলে বাকি জেবনডা কাডাবে। কিন্তুক এহন? এহন তারে ওহানে জাগা দেবে কিডা? তোর তো সবই গেল! মা বুঝলেন না, বেশি খেতি চালি এমনি অয়!’
‘ইন্ডিয়া ক্যান? এই দেশে তাদের অসুবিধা কি ছিলো?’
‘জানেন না?’
তারার মায়ের দুচোখ বড়বড় হয়। ‘আমাগের মোছলমানের দেশে নাহি তাগের মান-ইজ্জত নেই। জাতও নাহি যায় যায়!’
‘ইন্ডিয়া কি মুসলমান নাই? তাগের জাত-কূল কি সব গিয়েছে?’
‘আমরা কি অত-শত জানি!’ তারার মা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করলেন।
আসমা বেগম ভাবলেন তারার মা বুঝি এবার উঠবে। কিন্তু তিনি কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন, ‘আচ্ছা, একটা কতা যে শুনলাম!’
‘কি কথা?’
সন্দেহের সুরে জানতে চাইলেন আসমা বেগম।
তারপর বললেন,’ তোমরা কোন কতাডা শুনলে?’
‘আপনের ছোড ছাওয়াল অপু নাহি বিয়ে কইরেছে?’
আসমা বেগম যেন আকাশ থেকে পড়েন। ‘এমন কথা শুনলে কোথায়?’
‘যেহানেই শুনি! কতাডা সত্যি কিনা বলেন!’
আসমা বেগম রাগ সামলাতে পারেন না। ‘কী পাগলের কথা! ছেলে বিয়ে করলো কবে?’
‘অপু আর সালামের ছুড়িডা নাহি কোটে যেয়ে বিয়ে কইরেছে?’
এবার সত্যি সত্যিই আসমা বেগম ক্ষেপে যান। বলেন, ‘আমি জানি না!’
‘কতাডা লুকোচ্ছেন ক্যান?’ এতক্ষণে চিনির মা মুখ খোলেন। ‘তালি বিয়ের কতাডা কি একেবারেই মিছে?’
‘তোমরাই তো ভাল জানো! আমারে জিজ্ঞেস করতি আলা ক্যান?’
রাগের মুখে আসমা বেগম শহুরে পরিশীলিত ভাষা ভুলে গেলেন।
‘এডা কি কচ্ছেন?’
বিস্মিত তারার মা আবার বলেন, ‘আমরা শুনিছি বইলেই তো কলাম!’
‘তো কচ্ছো না ক্যান কার কাছে শুনলে?’
‘সালামের বউ কয়েছে।’
‘ওরা তো কবেই? মেয়েডারেও লেলায়ে দিয়েছে পাগলা কুত্তির মতন!’
তারার মা ফোকলা মুখে বললেন, কতাডা মনে হচ্ছে সত্যিই! এ না হলি তো আপনে রাগতেন না!’
আসমা বেগম ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন, এসব মিছে কতা নিয়ে পাড়া বেড়াচ্ছো কোন লাভে? এ ছাড়া তোমাগের কোনো কাজ-কাম নেই?’
তারার মা বললেন, ‘আমরা মিছে কতা নিয়ে ঘুরি না।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ! সব মিছে! আমার ছেলের মুখ থেকে না শুনলে এ মিছেই!’
‘যহন শুনবেন এ সত্যি তহন মুখ দেহাবেন কি কইরে?’
‘আমার ছেইলে চোরের বেটি বিয়ে করলো না গু খেগোর বেটি বিয়ে করলো, তাতে তোমাগের কি? ‘ আরো তেতে ওঠেন আসমা বেগম।
গতিক সুবিধের নয় দেখে দু ক্যাসেট আস্তে -ধীরে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আসমা বেগমের একেক বার মনে হয়, অপুকে যদি হাতের কাছে পেতেন তাহলে তার দু গালে দুটো থাপ্পড় কষিয়ে বলতেন, যারা তোকে দা নিয়ে জবাই করতে আসে, যারা তোর বাপ-ভাইকে খুন করে করে জমি বাড়ি দখলের ষড়যন্ত্র করে, তোদের জন্মের উপর কালি লেপে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে আর তুই কিনা তাদের মেয়েই বিয়ে করলি? আরে মূর্খ! যে মেয়ে তোর সামনে তোর মাকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করে, সেই মেয়েকে তুই বিয়ে করলি কি করে? একবার পেছনের ঘটনা তোর মনে পড়লো না! কী এমন দারু খেয়েছিস, যে জন্য ভুলে গেলি সমস্ত অতীত?
আসমা বেগম হঠাৎ তাঁর চোখের পানি মুছে ফেললেন এক অপার্থিব দৃঢ়তায়। ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমিও যদি বাপের বেটি হই তো এ মেয়েকে কোনোদিন বউ বলে ঘরে তুলবো না! দরকার হলে জুতিয়ে তোকে শুদ্ধো বাড়ির বার করে ছাড়বো। ভাববো, আমার আরেকটা ছেলে মরে গেছে!’
কিন্তু এত যে অভিযোগ, এত যে অভিমানের পাষাণ গলানো কথা, কে শোনে? যার বিরুদ্ধে এত কথার বুদবুদ আলোড়িত হচ্ছে তাঁর মনের ভেতর, সেই অপুই তো এখানে অনুপস্থিত। সে থাকলে খুব সম্ভব একটা কিছু সত্যিই ঘটিয়ে ফেলতেন।
সাত
একজন লেখক যখন একটা গল্প বা উপন্যাস লিখেন, তখন কিন্তু তিনি ভালো করে জানেন না যে, তাঁর রচনা একজন পাঠককে কতটুকু আলোড়িত বা মুগ্ধ করতে পারবে। তিনি এসব না ভেবেই তার মননশীলতা দিয়ে শব্দের পর শব্দ উপমা-উৎপ্রেক্ষা দিয়ে দিয়ে তার আবেগ কল্পনা আর অভিজ্ঞতাকে পরিস্ফুট করে তোলেন সাদা কাগজের বুকে। এক সময় সেটা যখন পূর্ণতা পায় তখন বিভিন্ন পাঠক একই পাত্র থেকে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের অন্বেষণে বিভোর হয়ে থাকেন। কখনো কখনো একটা সাধারণ বাক্যই পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যা লেখকের সেই মুহূর্তের কল্পনাকে বা অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে হয়ে ওঠে প্রকৃত এক শিল্প। তেমনি একটা অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম হচ্ছে বিভূতি ভূষণের পথের পাঁচালী।
দুপুরে খেয়েদেয়ে সেই যে দিপু পথের পাঁচালী হাতে তুলে নিয়েছে, বইয়ের পাতায় বর্ণিত ঘটনার সঙ্গে কখন একাত্ম হয়ে গিয়েছে আর সেই অবসরে কখন ধীরেধীরে সূর্যটা পশ্চিমে হেলে গিয়েছে, মরে এসেছে বাইরের আলো, তার কিছুই লক্ষ্য করেনি।
কি একটা কাজে ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় লুবনা দেখলো, সন্ধ্যার বিবর্ণ আলোতে বসে বসে এক মনে বই পড়ছে দিপু। এত কম আলোয় তাকে বই পড়তে দেখে লুবনার রাগ হয়। সে দিপুকে বললো, ‘এমনিতেই অল্প বয়সে চশমা নিয়েছিস। তার উপর এমন অন্ধকারে পড়লে তো শেষে চশমাতেও কুলোবে না!’
দিপু বই বন্ধ করে হাসে। সত্যিই সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বলে, ‘বইটা পড়তে এত ভালো লাগে যে, কী আর বলবো! ধরলে আর ছাড়তে মনে থাকে না!’
‘এখন পড়তে হবে না!’ বলে, লুবনা আর দাঁড়ায় না।দিপু বইটা রেখে দিয়ে সার্টের প্রান্ত দিয়ে চশমার কাচ মোছে। আসলে এ বইটা সে যতবারই পড়ে শেষটায় আর কিছু মনে করতে পারে না। ইচ্ছে হয় আবার শুরু থেকে পড়ে। এই করে করে বহুবার পড়া হয়ে গেছে বইটা। কিন্তু যতবার পড়েছে প্রতিবারই মনে হয়েছে নতুন।
ভালোলাগার ব্যাপারগুলো হয়তো এমনই। যাতে খুব সহজেই অরুচি বা একঘেয়েমি আসে না।
ফের চশমাটা চোখে লাগিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকায় দিপু। সামনের দেড় তলা বাড়িটার গ্রিল লাগানো বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে এক তরুণী চা অথবা কফি কিছু একটা পান করছে। হাতের কাপটা কিছুক্ষণ পরপর বেশ আয়েশ করে ঠোঁটের সামনে তুলে ধরছিলো। তার ঠিক মাথার কাছেই পেছনের দেওয়ালে একটা দুরন্ত ঘোড়ার রঙিন পোস্টার লাগানো। দৃশ্যটাকে বেশ কাব্যিক মনে হয়। এমন সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পোষা কুকুরটা লাফিয়ে তরুণীর কোলে উঠতেই হাতের কাপটা ছিটকে পড়ে। ভেঙে গেল কাপটা। আর কাপের তরল খানিকটা হয়তো তার শাড়িতে
লাগে। দাঁড়িয়ে ঝাড়তে দেখা যায়। তরুণী একবার মুখ তুলে তাকায়। ব্যাপারটা দিপুর দৃষ্টিগোচর হয়েছে কিনা সেটাই হয়তো নিশ্চিত হতে চায়।
তরুণী বারান্দা থেকে চলে গেলে দিপুর মনোযোগও স্থান বদল করে। এখান থেকে জাতীয় সংসদ ভবনের উপর চৌকোনা মুকুটটা দেখা যাচ্ছে। দিপু সেদিকে তাকিয়ে ভাবে, ওটার রঙ যদি গাঢ় সবুজ হতো আর পেটের গোলাকার শূন্য স্থানটায় তেমনি গাঢ় লাল রঙের হতো তাহলে দেখতে কিন্তু বেশ লাগতো। অবশ্য রাতের বেলা নিয়ন বাতির আলো দিয়েও সেটা করা যায়। জাতীয় সংসদ ভবন আর জাতীয় পতাকার একটা চমৎকার কম্বিনেশন হতে পারতো। কিন্তু এমনটা হয়তো কেউ ভাবছে না।
রাস্তায়-রাস্তায় জ্বলে উঠছে হলদে সোডিয়াম বাতিগুলো। ধীরেধীরে আলোগুলোর তীব্রতা বাড়বে রাত গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। নিয়ন সাইনগুলোও আলো বিকিরণের সাথে সাথে বিভিন্ন পণ্যের প্রচারণার কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষের কি অদ্ভুত আর জটিল বুদ্ধি! পণ্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি হচ্ছে দর্শকের অজান্তেই। এক ধরণের সাইকোলজিক্যাল আগ্রাসন বলতে গেলে।
দূরের কাছের ঘর-বাড়িগুলোর জানালায় প্রতিফলিত আলো দেখে টের পাওয়া যাচ্ছে যে, ঢাকা শহর আশ্রয় নিচ্ছে রাত্রির কোলে।
পাপিয়া এসে ঘরের লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। লুবনা এসে একটা মোড়া টেনে বসে। হাতে তার চিরুনি। আবছা অন্ধকারে খোলা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে নিয়ে কি মনে করে আবার উঠে ঘরে ফিরে যায়। দিপুর চোখে ভাসে রেল লাইনের দিকে অপু আর দুর্গার ছুটে চলা।
কল বেলের মৃদু টুংটাং শব্দ ভেসে আসতেই পাপিয়া দৌঁড়ে চলে যায়। তার কিছুক্ষণ পরেই অপুর কণ্ঠস্বর শুনতে পায় দিপু। আর তখনই ঘরে ঢুকে সে অপুর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায়। এ কি চেহারা হয়েছে তার? গাল-মুখ ভাঙা, কোটরে বসা চোখ! গায়ের রঙ কালো হয়ে এমন দেখাচ্ছে যেন জ্যান্ত একটা পোড়া কাঠের মূর্তি।
দিপুকে দেখে ভাল-মন্দ কিছু বলে না অপু। বাইরের কাপড় পালটিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্যানের তলায় হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে সে। যেন হাজার মাইলের ব্রাজ্য সেরে ফিরে এসেছে এইমাত্র।
‘বাড়ি যাওয়া কি ছেড়েই দিলি?’
অপু দিপুর জিজ্ঞাসায় চমকে উঠে বলে, ‘না তো! ছাড়বো কেন?’
‘তবে যাস না যে?’
‘কখন যে যাই!’
অপুর চোখে মুখে চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে। ‘সময় করে উঠতে পারি না।’
‘ইচ্ছে থাকলে দুই একটা দিন এমনিই বের করা যায়।’
‘যাবো। সময় পেলেই ঠিক একদিন যাবো।’
‘মা যে কান্না-কাটি করেন সে খবর রাখিস?’
‘শুনেছি। পচা-পাগলা একদিন বলেছিলো।’
‘ও আছে কোথায়?’
‘শ্বশুর বাড়ি।’
করে কি?
‘কী আর করবে! শ্বশুর বাড়ি পড়েপড়ে খায় আর ঘুমায়।’
‘ঘর জামাই হয়ে গেল নাকি?’
‘অনেকটা তেমনি।’
দু ভাইয়ের কথা বেশি দূর আগায় না। দিপুর কাছে সময়টা খুবই ভারি আর দীর্ঘ মনে হয়। কিছু করার না থাকলে নিজকে খুবই অসহায় লাগে তার। পথের পাঁচালী হাতে নিলেও মন বসাতে পারে না। মশা খুবই জ্বালাতন করছে। আর মশাগুলোও একেকটা দেখার মত। ঢাকার মশা দেখতে খাসা। কথাটা নিরেট!
রাতে এক সঙ্গে খেতে বসে অপুর বিয়ের প্রসঙ্গ তোলে দিপু। কিন্তু শফি কথাটা শুনেই বলে, ‘বোগাস!’
‘মা তো এ কথা শুনে একবারে কেঁদে-কেটে অস্থির। কি করবো বুঝতে পারছি না!’
‘কেন?’
‘ঘটনার সত্য-মিথ্যা না জেনে কোনো স্টেপ নেওয়া যাবে না।’
‘মা’ক বলিস এসব বাজে কথায় কান না দিতে!’
‘মা বলেছেন, অপু নিজে গিয়ে যেন ঝামেলা মিটিয়ে আসে।’
মুখ নিচু করে খাচ্ছে অপু। কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। তাহলে কি ভেতরে ভেতরে অপরাধ বোধে ভুগছে?
শফি বললো, ‘তোরা কিছু ভাবিসনে। ক’দিন পরেই যাবে। বিয়ে করলিও আমাগের বাঁধা দেওয়াডা অন্যায় হবে।’
অপু হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে বললো, ‘কারা কচ্ছে এসব? আর আপনারাও যেমন! একটা কথা পালি তা নিয়ে বাজার বসাতি পাঁচ মিনিট দেরি হয় না!’
অপুর কথায় কেউ কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না।
শফিকে দিপু বললো, ‘ক’দিন আগে সুফিয়া বাড়ি গিয়েছিলো। তহন…।’
শফি দিপুর কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘নিজেগের ঢাক পিটিয়ে এয়েছে। তাই তো?’
‘সরাসরি না বললিও বলার ধরনে তেমনডাই মনে হয়েছে।’
এ ধরনের আলাপ ভালো লাগছিলো না অপুর। খাওয়া শেষ না করেই সে উঠে যায়।
লুবনা অপুর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী দেখে যে অমন পাগল হল বুঝি না! তোর ভাই এত করে বোঝানোর পরও মেয়েটার পিছু ছাড়েনি!’
‘কী করতে পারি আমরা? সংসার করবে ও। সুখ-দুখ ভাল-মন্দ সবই তার নিজস্ব।’
‘তা তো ঠিকই!’
লুবনা যেন সায় দেয়।
‘ওসব ভেবে কাজ নেই। দিন দুয়েকের মধ্যেই ওক পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসবে।’ বলে, শফি একটা হাত এমন ভাবে দোলায় যে, দেখে মনে হলো সব কথার এখানেই ইতি।
পরদিনই বাড়ি ফিরে আসে দিপু। আসমা বেগম তাঁর ছোট ছেলের প্রতীক্ষায় সময় পার করেন। কিন্তু অপু বাড়ি আসে না।
আট
যে কোনো আনন্দ আর নিশ্চয়তার পেছন পেছন বুঝি কিছু কিছু দুঃখ বেদনাও চলে আসে অগোচরে। তা যদি না-ই হবে, তাহলে চাকরিতে জয়েন করার চারদিনের মাথায় কেন দুর্ঘটনার শিকার হবে অপু? ঘটনাটা এমন আকস্মিক যে, কিছু বুঝবার আগেই ঘটে গেছে।
সেদিন সকালবেলা অফিসে যাওয়ার জন্য একটা কোস্টারে উঠেছিলো অপু। বসার জন্য সিট না পেয়ে সে মহিলাদের সিটে গিয়ে বসে পড়ে। বাসটা পরের স্টপেজে গিয়ে থামতেই দুজন মহিলা উঠলেন। তারা উঠেই অপুকে বলল, ‘মেয়েদের সিটে বসেছেন কেন? আর বলি, আপনাদের কবে আক্কেল হবে শুনি? একটা মিনিবাসে মেয়েদের জন্য মাত্র চারটা সিট, তাও যদি ছেলেরা দখল করে বসে থাকেন তো আমাদের কি হবে একবার ভেবেছেন?’
অগত্যা সরি, সরি বলে মেয়েদের সিট ছেড়ে সে ড্রাইভারের সিটের পেছনে টুল বক্সের ওপরই বসে। তবু এটা দাঁড়িয়ে থেকে ঠেলা-গুঁতো খাওয়ার চেয়ে অনেক গুনে ভালো।
পরের দুটো স্টপেজে মহিলা সিটটা পূর্ণ হয়ে গেল। প্রথম উঠা দুই মহিলা খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামনের দিকে সরে বসেন। বাসও যাত্রীতে যাত্রীতে ঠাসাঠাসি হয়ে উঠলো।
ড্রাইভার মনেমনে বেশ প্রসন্ন হয়ে ওঠে হয়তো। যাত্রী বেশি হলে টুপাইসের পরিমাণও বাড়ে। সে পেছনের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে স্টার্ট নেয়। আর সম্ভবত সর্বোচ্চ গতিতেই গাড়ি চালাতে থাকে। যাত্রীরা সবাই হৈ-হল্লা জুড়ে দেয়। ‘ড্রাইভার সাব! একটু আস্তে গাড়ি চালান!’
কিন্তু কে শোনে কার কথা! ড্রাইভার উদ্ধত ভাবেই বলে, ‘আপনেরা চিল্লায়েন না তো! আমারটা আমারে করবার দেন!’
একই গতিতে গাড়ি ছুটে চলে। কিন্তু টেকনিক্যালের কাছে আরেকটা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা হিনো কোস্টারের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে যায়।
অপু দেখলো তাদের কোস্টারটার সামনের দিকটা অকস্মাৎ ভেতরের দিকে কিছুটা চেপে এলো। সামনের মহিলা আর ড্রাইভার কেমন আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে দুহাত উপরের দিকে তুলে দেয়। আর তখনই অপু ছিটকে পড়ে টুল-বক্সের উপর থেকে। নাকটা ভীষণ জোরে ঠুকে যায় সামনের সিটের সঙ্গে। আর সঙ্গে সঙ্গেই একটা গরম স্রোতের পরশ অনুভব করে। জ্ঞান হারাবার আগে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষের আর্ত চিৎকারের সাথে সাথে নিজেও হুড়োহুড়ি করে নেমে আসে গাড়ি থেকে।
তারপর সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটির উপর।
সামনের গাড়িটার তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। কেবল উইন্ড-শিল্ডটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। কিন্তু অপু যে গাড়িতে ছিলো, সেটার ড্রাইভার আর সামনের দু’মহিলা সাথে সাথেই থেঁতলে যায়। তিনজনই স্পট ডেড। রক্তারক্তি অবস্থা দেখে সবাই কেমন যেন দিশেহারা হয়ে ছুটছে। কমবেশি সবাই আহত। এমন অবস্থায় কে কার দিকে নজর দেয়! অপুও কারো নজরে এলো না। শেষে একজন রিকশা চালক তার অচেতন দেহটা নিজের রিকশায় তুলে কাছের ক্লিনিকের ইমার্জেন্সিতে নিয়ে ফেলে।
অপু যখন নাকে-মুখে প্লাস্টার আর মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় বাসায় ফেরে, লুবনা তাকে দেখেই উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চায়, ‘একি? ব্যান্ডেজ কেন? কী করে এমন হলো তোর?’
অপুর কান্না পাচ্ছিলো ভীষণ। কোনো রকমে কান্নার বেগ সামলে বললো, ‘বেশি কিছু না। একটু কেটে কুটে গেছে!’
‘কী করে হলো?’
‘বাসের ড্রাইভার সামনের আরেকটা বাসের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছে। তিনজন স্পট ডেড! আমি কিভাবে ক্লিনিকে গেছি বলতে পারি না!’
‘ঠিক আছে! এখন চুপ চাপ শুয়ে থাক।’ বলে, লুবনা নিজেই অপুর বিছানায় তিনটে বালিশ দিয়ে উঁচু করে দেয়। ‘এখানে পিঠ ঠেকিয়ে শুয়ে পড়। আমি এক্ষুনি আসছি।’
লুবনা কিছুক্ষণের জন্য বেরিয়ে গিয়ে এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে ফিরে আসে। তারপর গ্লাসটা অপুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, দুধটুকু খেয়ে একটু ঘুমোনোর চেষ্টা কর। আর কিছুর দরকার হলে আমাকে বলিস।’
দুধটুকু পান করে গ্লাস ফেরত দিয়ে অপু শুয়ে পড়ে।
চোখ বন্ধ করতেই তার সমস্ত রাগ আর অভিমান গিয়ে জমে মা আসমা বেগমের উপর। নিশ্চয় তিনি মনে কষ্ট পেয়েছেন! আর সেই কষ্ট অভিশাপ হয়ে আজ তাকে এমন অবস্থায় ফেলেছে! আগামী বিষুদবারে তার বাড়ি যাওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি আর হচ্ছে না। সে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে যে, বেঁচে থাকতে আর বাড়িমুখো হবে না।
আজ তার সোহেলের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিলো বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। কিন্তু এমন অবস্থায় কোনোখানে যাওয়ার চিন্তাটাও অবান্তর। সোহেল তার স্কুলজীবনের বন্ধু। গ্রামের বাড়ি থাকতে ক্লাস ওয়ান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত একসঙ্গেই ছিলো। এখন সে আছিয়ার বাড়ির কাছাকাছি একটা মেসে থাকে আর আছিয়ার ছেলে-মেয়েদের পড়ায়।
বিনিময়ে তিন বেলার খাওয়াটা জোটে। কখনো অবসর পেলে চাকরির খোঁজে এদিক ওদিক ঢুঁ মারে।
আগের দিন কথামত দেখা না করাতে, পরদিন সকাল-সকাল অপুর সঙ্গে দেখা করতে ছুটে আসে সোহেল। কিন্তু ব্যান্ডেজ বাঁধা অপুকে শুয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘কিরে, ব্যান্ডেজ বাধা! এক্সিডেন্ট করেছিলি নাহি?’
‘আর বলিস না!’ কাঁকিয়ে-কুকিয়ে বলে অপু। ‘এবারের মতন জানে বেঁচে গেছি!’
‘কিন্তু হইয়েছে কেমন কইরে?’
‘ওই ড্রাইভার হারামজাদা মনে হয় গাঁজা-টাজা খেয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলো। হঠাৎ আরেকটা গাড়িতে মেরে দিয়েছে!’
‘তালি তো খবরডা ওহানে জানাতি হয়!’
‘না না!’
চাপা স্বরে অপু আঁতকে উঠে বলে, ‘কিচ্ছু জানানো যাবে না!’
‘সুফিয়া যদি জিজ্ঞেস কইরে বসে?’
‘তাকও বলা যাবে না। খবরদার!’
ওরা এতটা নিচুস্বরে কথা বলছিলো যে, পাশে কেউ থাকলেও অস্পষ্ট ফিসফিস ধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেতো না।
সোহেল দাঁড়িয়ে বললো, ‘তালি আপাতত সব প্রোগ্রাম বাতিল। আমি কাল বাড়ি যাচ্ছি। কোনো খবর থাকলে বল।’
‘কোনো খবর বলতি হবে না!’
‘তোগের বাড়ি গেলি আমি চুপ কইরে থাকতে পারবো না!’
অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় সোহেল।
‘তালি মা’ক বলিস, ওরা যেন আমাক ভুইলে যায়।’ বলতে বলতে অপুর দুচোখের কোণায় দু ফোঁটা পানি জমে।
তারপর ওগুলো আকারে বড় হয়ে দুপাশে গড়িয়ে পড়ে।
অপুর চোখে হঠাৎ পানি আসার সঠিক কারণ জানা নেই সোহেলের। তবে সে ভাবলো যে, অপু নিশ্চয় সুফিয়ার কথা ভেবেই কাঁদছে। আর এ জন্য কান্নাটাই স্বাভাবিক। দুর্ঘটনায় তার মৃত্যুও হতে পারতো। আর তেমনটা হলে সুফিয়ার সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হতো না তার।
নিষেধ থাকা সত্ত্বেও সোহেল ভুল করে হঠাৎ অপুর দুর্ঘটনার কথা বলে ফেলে আছিয়ার কাছে। পাশে সুফিয়াও ছিলো। আর এ কথা শুনে দুবোনই মরা কান্না জুড়ে দেয়।
সোহেল কি করবে বুঝে উঠতে পারে না কিছুক্ষণ।
আছিয়া আর সুফিয়া পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
সোহেল বললো, ‘এমন কইরে কান্নাকাটি করলি লোকে কবেডা কি? আপনারা মন শক্ত করেন!’
সোহেলের এ কথা শুনে সুফিয়ার সন্দেহ হয় যে, অপুর সাংঘাতিক কিছু হয়েছে, যেটা সোহেল তাদের কাছে গোপন করছে।
সুফিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘সত্যি কইরে বলেন সোহেল ভাই, ও কেমন আছে?’
‘বললাম তো বেশি ক্ষতি হয়নি। দুচার দিনের মদ্যিই সেইরে উঠবেনে!’
সুফিয়া বিশ্বাস করতে পারে না সোহেলের কথা। বলে, ‘এক্ষুনি ওক দেখতি যাবো!’
‘না। এখন কিছুতেই যাওয়া যাবে না! শফি ভাই ঘরে আছে।’
সোহেল মিথ্যে বলে সুফিয়াকে নিবৃত্ত করতে চায়। কিন্তু সে তা মানতে নারাজ। বলে, ‘তাতে কি? আমি বিধবা হলি তো তাগের কিছু আসবে যাবে না!’
‘তুই বুঝতি পারতিছিস না!’
‘ও আমি কিছু বুঝতি চাইও না! আপনি আমার সঙ্গে চলেন!’
‘আমি আইজ বাড়ি যাবো। তোর সঙ্গে কহন যাই!’
‘না, আজ বাড়ি যাতি হবে না। আমার সঙ্গে চলেন!’
সুফিয়ার জেদের কাছে সোহেলের আপত্তি টেঁকে না। শত হলেও সে ওদেরই নুন-নিমক খায়। তাদের কথা উপেক্ষা করা তার পক্ষে দুঃসাধ্য।
নয়
স্থানীয় প্রেসক্লাবটাকে পাশ কাটিয়ে বেশ কিছু দূর এগিয়ে যায় দিপু।
তারপর পরাণের চায়ের স্টলের সামনে বাঁক নিয়ে গ্রামের রাস্তায় উঠবে এমন সময় পিঠের উপর আচমকা থাপ্পড় খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিকে তাকাতেই দেখে নাসির।
‘কিরে শালা কবি! খুব ভাব নিয়ে হাঁটছিস যে?’
দিপুর পিঠে নাসিরের থাপ্পড়টা বেশ জোরেই লেগেছিলো। জায়গাটা এখনও দপদপ করছে। বললো, ‘অসুরের পাল্লায় পড়লে কি কারো ভাব থাকে?’
নাসির হাসে। ‘লেখা-টেখা ছেড়ে দিলি নাকি?’
বিস্মিত হয়ে দিপু পাল্টা জানতে চায়, ‘তোর হঠাৎ এমনটা মনে হল কেন?’
‘অনেকদিন তোর লেখা দেখি না, তাই বললাম আর কি!’
‘আমাদের এই এলাকায় কাগজই তো মোটে একটা। একজনের লেখা ঘনঘন ছাপলে অন্যদের কি হবে? আর আমার লেখা না বেরুলে কী এমন ক্ষতি?’
‘তুই না কবি?’
‘হ্যাঁ। কবি বটে!’
দিপু হাসে।
তারপর আবার বলে, ‘তুই কি জানিস বাংলাদেশের সব বাঙালিই কবি?’
‘তাতে অসুবিধা কি? তুইও তো তাদেরই একজন।’
নাসির দিপুকে পছন্দ করে খুব। তার লেখা কবিতার ভক্তও। কবিতার প্রতি তার ভালবাসা, কবিতা না লেখা নিয়ে অনুযোগ দিপুর ভালই লাগে। তবে সে জানে, মফস্বল থেকে একজন কবিকে উঠে আসতে হলে বা পাঠক মহলে নিজের পাকা-পোক্ত একটা আসন করে নিতে হলে বহু কাঠ-খড় পোড়াতে হয়। তাই তার কণ্ঠেও আক্ষেপ ফুটে ওঠে, ‘ঢাকা শহরের কোনো কাগজে কবিতা না বোরোলে কেউ কবি হতে পারে না।’
নাসির তেমনি হাসি মুখে বলে, ‘আরে সেগুলো তো ঢাকার কবি। দু চারজন বাদে, বলতে গেলে দালালি আর চামচা গিরি যাদের ভরসা। তাই বলে আমরা মফস্বলের কেউ কবিতা লিখবো না?’
‘ঢাকার কবি মানেই সারা বাংলাদেশের কবি। আমাদেরগুলো কবিতা না হয়ে, হয়ে ওঠে বকবকানি।’
‘তোর স্বভাবটা কবে ভাল হবে বল দেখি? ঢাকার কবিরা কেউ কেউ অহংকারী হলেও কাজের বুয়াকে নিয়ে কাব্য করে, জানিস?’
‘কাজের বুয়ারা কি মানুষ না? তারা কি কবিতার বিষয় হতে পারে না? তুই কি জানিস? নারী শ্রমিকদের বিশাল একটা সংখ্যা দখল করে রেখেছে এই কাজের বুয়ারা! তারা যে সংখ্যায় কত, তার কোনো পরিসংখ্যান আমার জানা নেই।’
‘সবই বুঝি!’ নাসির হাসে।
তারপর আবার বলে, ‘কোনোকোনো কবি নিষিদ্ধ নারীর কাছে গিয়ে মদ গিলে কবিতা লিখে-চেখে ফিরে আসে। পরদিন কাগজে তার কবিতা বেরোয়।’
‘কবির জন্য অনেক কিছুই অনুপান হতে পারে।’
‘যে পুরুষ বেশ্যার কাছে যায়, আমরা জানি সে চরিত্রহীন। দুশ্চরিত্র। একজন দুশ্চরিত্র মানুষের কাছে কোন ভালোটা আশা করতে পারিস?’
‘গোবরে যেমন সার হয়। বিষ্ঠা যেমন মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তেমনি কোনো কোনো কবির মদ-মেয়েমানুষের প্রয়োজন হতেই পারে!’
‘ওটা হলো গিয়ে চোট্টা-বদমাশদের যুক্তি!’
তারপর আবার, ‘আরে, স্বভাব না যায় ম’লে, কয়লার ময়লা না যায় ধু’লে!’ বলে, হাহা শব্দে হেসে উঠে দিপুর হাত ধরে টানে। ‘আয়, পরাণের স্টলে বসি। হয় তুই আমাকে চা পান করাবি, নয় তো আমি। চল!’
পরাণের চা স্টলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দিপু বললো, ‘চায়ের খরচ তোর। বেকাররা কাউকে চা পান করায় বলে আমি শুনিনি।’
নাসির আবার হেসে দিপুর কাঁধে হাত রাখে। তার সব বিষয়ে হাসির ব্যাপারটাকে অস্বাভাবিক বলে মনে হয় দিপুর। একজন সুস্থ মানুষ কখনোই এতটা হাসতে পারে না।
পরাণের স্টলের সামনে পাতা বাঁশের বেঞ্চে বসে দুটো চায়ের কথা বলে নাসির। তারপর দিপুর দিকে ফিরে বলে, ‘এবার বল, লেখালেখি কমিয়ে দিলি কেন?’
‘মোটেও কমাইনি। লিখছি। ধুমসে লিখিছি!’
‘তাহলে নতুন লেখা দেখছি না কেন?’
‘শুধু কবিতাই তো লেখা নয়, আরো অনেক মাধ্যম তো আছে। সেগুলো কি লেখার পর্যায়ে পড়ে না?’
‘কথাটা বর্ণমালায় কাগজে সাজিয়ে নিলেই লেখা। তো লেখার বিষয়টা কি শুনি?’
‘উপন্যাস।’
‘সেরেছে!’ হতাশায় যেন নুয়ে পড়ে নাসির।
পরাণ দু কাপ চা দুজনের সামনে নামিয়ে রাখলে, নাসির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। তারপর আবার বলে, ‘সে তো বিশাল ব্যাপার! নিজের খরচে ছাপাতে গেলেও অনেক টাকার ধাক্কা! তার উপর বেশির ভাগই বিনে পয়সায় বিলাতে হবে!’
দিপু এখনো চায়ের কাপে হাত দেয়নি। গরম চা তার পছন্দ নয়। কিছুক্ষণ ভেবে বললো, ‘চেষ্টা করবো ঢাকার কোনো পত্রিকায় দেওয়া যায় কি না।’
‘ওরেব্বাপস! সে তো বলতে গেলে চাঁদ ধরার মত অবস্থা হে!’
দিপু জানে, ব্যাপারটা অনেকটা সে রকমই। তবে সে বিশ্বাস করে যে, লেগে থাকলে সাফল্য একদিন না একদিন আসবেই। এই কবিতা লেখা নিয়েই তার অভিজ্ঞতার কমতি নেই। একবার সে বেশ কটি কবিতা নিয়ে ইত্তেফাক-এ গিয়েছিলো। তখন সাহিত্য সম্পাদক আল মুজাহিদী। কবিতাগুলো তিনি হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘ভেবো না, সামনের সপ্তাহেই ছেপে দেবো।’ কিন্তু সামনের সপ্তাহ আর কখনোই আসেনি।
যে কারণে ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে দিপুর কবিতা দেখা যায়নি। তবে দুএকটা পত্রিকা তাকে নিরাশ করেনি। কোনো লবিং জ্যাকিং কিছুই না। ডাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। দিন কয়েক পর ছাপা হয়ে গেছে সে কবিতাগুলো। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও সে নিরাশ হবে না।
দিপু বললো, ‘তুই কথাটা মিথ্যে বলিসনি। তবে কি জানিস? পত্রিকায় ছাপা হলে এতে অনেক পাঠকের মতামতটা পাওয়া যায়। লেখাটা নিয়ে দ্বিতীয় বার ভাবনা চিন্তা করার সুযোগ পাওয়া যায়। দুর্বলতাগুলোও চোখে পড়ে।’
নাসিরের চা শেষ হয়ে গেলে কাপ নামিয়ে রেখে বলে, ‘সে সুযোগ তুই পাবি না।’
‘না পাওয়ার কি আছে?’ বলে, ঠাণ্ডা চায়ের কাপ তুলে নেয় দিপু।
‘প্রথম কারণ হচ্ছে, কোনো সম্পাদককে তুই চিনিস না। ঢাকা শহরের প্রথম সারির পত্রিকাগুলোর কেউ তোকে চেনে না। তোর মত ভুঁই-ফোঁড় ঔপন্যাসিকের লেখা কেন তাদের পত্রিকায় ছাপতে যাবেন তারা? পত্রিকার প্রতিটা লাইন দামি। তোর জন্য কে তাদের পত্রিকার পাতা অপচয় করার ঝুঁকিটা নেবেন? তুই উপন্যাসের মত একটা বাজে কাজের পেছনে সময় নষ্ট করিস না। তুই যা ভাবছিস, সেটা ভাবাই সার। কাজের কাজ কিছু হবে না!’
‘তোর কথাটা ঠিক আছে, আবার ঠিক ও নেই।’
‘যেমন?’
নাসিরের চোখ ছোট হয়ে আসে।
দিপু চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, ‘লেখার মান যদি ফিফথ্ বা সিক্সথ গ্রেডের হয়, তাহলে আত্মীয় সম্পাদক কী করতে পারেন?’
‘আজকাল যোগ্যতার বিচার খুব কমই হয়।’
‘হতে পারে। তবে সব পুলিশ, সরকারি আমলা যেমন ঘুষখোর দুর্নীতিবাজ না, তেমনি দু’একজন সম্পাদক ঠিকই পেয়ে যাবো। চেষ্টা করতে তো আর দোষ নেই!’
‘দেখ, পাথরে কপাল ঠুকে। মাঝখান দিয়ে কপাল ফেটে না আবার রক্ত জমে!’
চায়ে চুমুক দিতে দিতে দিপুর মনে হয় যে, নাসির ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে কথা বলতে চায়। হয়তো কিভাবে শুরু করবে সেটাই ঠিক করতে পারছে না। যে জন্যে ভূমিকাটা এত লম্বা করে ফেললো। এভাবে বসে আড্ডা দেওয়ার মত মানুষ না সে।
দিপুর চা ফুরিয়ে গেলে কাপটা পরাণের হাতে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তার কথা যেন অকস্মাৎ ফুরিয়ে গেছে। কি নিয়ে আবার শুরু করবে তেমন কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
নাসিরও হঠাৎ করেই যেন গম্ভীর হয়ে গেছে। ফলে, দুপক্ষের নীরবতায় আবহটা কেমন ভারী আর গুমোট হয়ে উঠতে থাকে।
দিপু দু হাত পেছনের দিকে নিয়ে শরীরটাকে ডানে বামে ঘুরিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। সেটা দেখেই হয়তো নাসির একবার খুক করে কাশে। স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে না সেও। পেশায় সাংবাদিক হলে কি হবে, সহজে প্রসঙ্গ পাল্টাতে পারে না।
‘আসলে কি বলতে আমাকে ধরেছিস বলে ফ্যাল। তোর অমন প্যাঁচা মুখ ভাল্লাগছে না!’ বলে নাসিরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে দিপু।
নাসির একটু নড়ে-চড়ে বসে। গোঁফে তা দেয় কিছুক্ষণ। শেষটায় জোর করেই যেন বলে ফেলে, ‘দীপা তোকে যেতে বলেছে।’
দিপু অবাক হয়ে বলে, ‘ওই পুঁচকে মেয়ে? আমাকে…।’
‘আরে না!’ নাসির বাধা দিয়ে বলে, ‘দীপা ঘোষ।’
‘তাই বল! আমি তো ভেবেছি…। যাক, ওই বা দেখা করতে বলবে কেন?’
‘আমি কি করে বলবো? বিশ্বাস না হয় দ্যাখ।’ বলে, পকেট থেকে ছোট্ট এক টুকরা ভাঁজ করা কাগজ বের করে দিপুর দিকে বাড়িয়ে ধরে নাসির। ‘দুদিন ধরে পকেটে নিয়ে ঘুরছি। তোকে ধরতে পারছি না।’
দিপু চিরকুটটা হাতে নিয়ে পড়ে বললো, ‘সময় পেলে একবার দেখা করবো।’
‘সেটা তোর ব্যাপার!’ বলে, নাসির পরাণের পাওনা মিটিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘আমাকে একবার থানায় যেতে হবে। মনে করে প্রেসক্লাবে আসিস। বুলু ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবো।’
‘আচ্ছা! মনে থাকবে।’
যদিও নাসিরকে কথা দিয়েছিলো যে, সময় পেলে একবার যাবে দিপু। কিন্তু আজ দশদিন পেরিয়ে গেলেও সে দীপা ঘোষের কাছে যায়নি। এই দশদিন কেবল ভেবেছে যে, দীপা ঘোষ কেন হঠাৎ করে তাকে দেখা করতে বলবে? এর মাঝে আবার ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্য নেই তো? অনেক ভেবেও কোনো সুরাহা খুঁজে না পেয়ে বিকেলের দিকে সে গেল দীপার কোয়ার্টারে।
উপজেলা স্টাফ-কোয়ার্টারগুলো বড় সড় না হলেও দুজন মানুষের জন্য যথেষ্ট। বিশেষ করে নির্ঝঞ্ঝাট দম্পতিদের জন্য যাকে বলে আদর্শ আবাস। দীপা বাসাতেই ছিলো। বেশ সাজুগুজু করেছে। হাতে, গলায়, কানে অলঙ্কারের প্রাচুর্য দেখে অবাক হয় দিপু। তার ওপর খোঁপায় জড়ানো বেলফুলের মালা দেখে হুট করে বলে ফেলে,’কোথাও বেরুচ্ছো নাকি?’
‘সেই কপাল করে কি আর জন্মেছি? বসো।’ বলে, দিপুকে বসতে বলে নিজেও বসে দীপা। তারপর উপুড় হয়ে সময় নিয়ে শাড়ির পাড় ঠিক করে। আসলে শাড়ির পাড় ঠিক করা নয়, মনে মনে নিজকে গুছিয়ে নেয় সে।সেই সময়টুকুতে দীপার সিঁথিতে ঘন লাল সিঁদুরের সরু একটা টান দেখা যায়।
উঠবার সময় কাঁধ থেকে আঁচলে বাঁধা চাবির গোছাটা পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়লে সেটা তুলে আবার সোজা হয় দীপা। সে সময় কড়া অথচ মিষ্টি একটা পারফিউমের সুবাস দিপুকে সাময়িক আচ্ছন্ন করে রাখে।
দীপা ডান হাতের সোনার চুড়িগুলো বাঁ হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, ‘নাসিরের কাছে শুনলাম সিগারেট ছেড়ে দিয়েছো নাকি!’
‘সে তো বেশ কিছু দিন হয়ে গেল!’
‘কোন সে ভাগ্যবতী এমন একটা কাজে সফল হলো?’
দিপু হাসে। ‘ভাগ্যবতী নয়, ভাগ্যবান।’
‘কে সে?’
‘আমি নিজেই।’
‘তাহলে মানুষ হয়ে গেছ দেখছি!’
‘অমানুষ ছিলাম কবে?’
দীপা কিছুক্ষণ গাঢ় দৃষ্টিতে যেন পরিমাপ করে দিপুকে।
তারপর বলে, ‘বোধশক্তিহীন মানুষকে কি কেউ মানুষ বলে?’
দিপু কিছু না বলে দীপার ঘামে ভেজা নাকের দিকে তাকিয়ে থাকে।
দীপা অনুমতি চাওয়ার ভঙ্গীতে বললো, ‘চা করে আনি? নাকি এটাও ছেড়ে দিয়েছো?’
‘নাহ্! চেষ্টা করে অবশ্য দেখিনি। তবে চেষ্টা করলে পারতাম কিনা জানি না। কিছু কিছু অভ্যাস আছে, যা মানুষকে চির-দাস করে রাখে।’
দীপা আবার সুবাস ছড়িয়ে উঠে যায়।
মাঝপথে থেমে জিজ্ঞেস করে, ‘সঙ্গে কিছু খাবে?’
‘খাবো না মানে? বলো কি? এতদিন পর কতটা কষ্ট করে এলাম!’
দীপা এগিয়ে আসে। ‘অভদ্র কোথাকার! গেস্টকে কিছু খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে দু একবার না করতে হয়। বুঝলে?’
দিপু হাসে। বলে,’ ভদ্রতা শেখাবে, এমন জনের বড় আকাল!’
দীপা মাথা কাত করে তাকায়। কিন্তু কিছু না বলেই ভেতরের দিকে চলে যায়।
বেশি সময় নেয় না দীপা। অল্প কিছুক্ষণ পরই চা নিয়ে ফিরে আসে। সাথে চিড়া ভাঁজা আর চানাচুর। দিপুর সামনের ছোট্ট টেবিলটাতে নামিয়ে রাখতে রাখতে বলে, ‘তুমি তো আবার ঠাণ্ডা চা পান কর। আগে চিঁড়ে আর চানাচুর নাও। ওগুলো খেতে খেতে তোমার চা জুড়িয়ে জল হয়ে যাবে।’
মুখোমুখি চা নিয়ে বসে দীপা বললো, ‘আচ্ছা, কতদিন পর দেখা হলো বলো তো?’
দিপু ভাবে, এ কেমন ধরনের প্রশ্ন? এসব দিন তারিখ কি কেউ হিসেব রাখে? তারপর মুখে বললো, ‘হিসেব তো নেই!’
‘এ কথাই যে বলবে, তা জানতাম!’
দীপা চোখ বুজে হাসে। হাসবার সময় তার দাঁতে লেগে থাকা লিপস্টিকের রঙ দেখা যায়। ‘আমি ঠিকই জানতাম!’
তারপর আবার বলে, ‘তোমার হিসেব না থাকলেও আমার আছে।’
কৌতূহল জেগে ওঠে দিপুর। বলে, ‘কতদিন হতে পারে?’
‘ফোর-টোয়েনটি ডে’জ। মানে চার’শ বিশ দিন।’
ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায় দিপু। এ কিসের ইঙ্গিত? চার’শ বিশ দিন কি সত্যিই, নাকি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকেই বলা হচ্ছে? এমন কিছু তো সে করেনি যে জন্য দীপা তাকে ও কথা বলতে পারে!
‘কি, ভাবনায় পড়ে গেলে?’
‘না। তেমন কিছু না। বছর মাস হিসেব করলে কি দাঁড়ায়?’
‘তুমিই বের করে নাও!’
দীপা হাসে।
দিপু মনে মনে হিসেব কষে, তিন’শ পঁয়ষট্টি দিন প্লাস পঞ্চান্ন দিন। পঞ্চান্ন দিনে ত্রিশ দিনে মাস ধরে একমাস পঁচিশ দিন। কিন্তু ওসব দিন-ক্ষণ হিসেব করে দীপার লাভটা কি? ও তো এখন পরের স্ত্রী। তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা বিড়ম্বনা ছাড়া কিছুই না। আর ভাঙা সম্পর্ক জোড়া দিতে চাইলে বরং ফাটা দাগটাই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। শুধু শুধু দুঃখ বয়ে বেড়ানো। নাকি পুরোনো সব কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাকে যন্ত্রণায় ফেলতে চায়? এমনটা কি হতে পারে না যে, নিজের কষ্টের পরিমাণ লঘু করতে অন্যকে কষ্ট দেওয়ার প্রচেষ্টা? হ্যাঁ। হতে পারে। খুব হতে পারে! কী না পারে এই মেয়ে!
বোটানিক্যাল গার্ডেনে সন্ধ্যার আলো-আধারিতে একটা ঝোঁপের আড়ালে প্রথম জড়িয়ে ধরেছিল দীপা। সেই সঙ্গে চিৎকার করে লোক জড়ো করার ভয় দেখিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তাকে জিম্মি করে রেখেছিলো। সেদিনের পর থেকে আজকের আগ পর্যন্ত দীপার ধারে কাছে আসেনি সে।
‘কবি সাহেবের স্মৃতি তর্পণ শুরু হয়ে গেল নাকি?’
দীপা হাসে নিঃশব্দে।
‘আমার কোনো স্মৃতি-টৃতি নেই।’
‘আছে আছে!’ বলে দীপা।
তারপর আবার বলে, ‘তার মাঝে আমি অনির্বাণ! তুমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে দুঃস্বপ্নে সেদিন কবিতাটা আমাকে নিয়ে লেখো নি?’
‘কবিতা তাহলে পড়?’ জবাব না দিয়ে পাল্টা জিজ্ঞেস করে দিপু।
‘তোমার সব ক’টা কবিতার পেপার কাটিং আমার কাছে আছে। তবে কি জানো, সেদিন মনে হয় আমার মাথাটা সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিলো!’দিপুর স্মৃতিকে যেন উসকে দিতে চায় সে।
তারপর আবার বলে, ‘তোমাকে অমন গুটিয়ে যেতে দেখে আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গিয়েছিলো। মনে হয়েছিলো তুমি ক্ষমতাহীন, কাপুরুষ একটা! কাপুরুষ না হলে কি এত বড় একটা সুযোগ পেয়েও কেউ অমন করে গুটিয়ে যায়?’
‘সুযোগ পেলে জন্তু-জানোয়াররাই বরং ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেতে মজা পায়। আর চোর-ডাকাত সুযোগ পেলে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। আমি ওই দুটোর কোনোটাই নই।’
‘মানুষ হলেও ধ্যানস্থ ঋষি। কখনো তাকেও জাগতে হয়। কেউ না কেউ তাকে জাগাতে হয়।’ দীপার মুখে সূক্ষ্ম হাসিটা আবার দেখা যায়।
দীপার সহজ-স্বাভাবিক কথা-বার্তায় দিপুও বেশ সহজ হয়ে উঠতে পারে। কিছুক্ষণ আগেকার জড়তাটা আর টের পায় না। তাই সে সহজ কণ্ঠেই বলতে পারে, ‘তোমরা বেশির ভাগ মেয়েরাই এমন, নিজের সর্বনাশ হয়ে যাক তবু জেদটা বজায় রাখতে চাও।’
দীপার চা পান করা হয়ে গেলে শূন্য কাপটা ট্রে-তে নামিয়ে রাখে।
তারপর একটু ঝুঁকে বলে, ‘আমার লাভ-ক্ষতি তুমি বুঝবে কি করে?’ তার চোখে যেন কৌতুক ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
‘পারি বলেই তো বলছি।’
‘একবার শুনি তোমার ক্যালকুলেশান!’
‘ভার্জিন বলতে যা বোঝায় তুমি তা নেই।’
‘তোমার ধারণা ভুল। কারণ, আমি ছিনিয়ে নিয়েছি। আদায় করে নিয়েছি। নিজকে বিকিয়ে তো দেইনি! তা ছাড়া আমাদের সমাজ অজ্ঞাত কিছু নিয়ে মাথা ঘামায় না!’
দীপা তার দুহাতের বড়বড় নখগুলোর ধার পরখ করতে করতে আবার বলে, ‘তবে যাই বলো, প্রত্যেকটা মানুষই কোনো না কোনো সময় আবেগ দিয়ে পরিচালিত হয়। তখন তার চারপাশে কি আছে সেটা তার চোখে পড়ে না।’
তারপরই আবার ‘তখন কতই না বোকা ছিলাম!’ বলে, জোর করেই যেন হেসে উঠলো সে।
‘এখন খুব বুদ্ধিমতী হয়েছো! তাই না?’
‘অনেকটা তাই।’ বলে, হাসে দীপা। কিন্তু তার হাসিটা কেমন যেন নিষ্প্রাণ মনে হয়। সে আবার বলে,’ বুদ্ধি কিছুটা খুলেছে। আর এ জন্যই এখন বুঝতে পারি, তোমার মনে ভালোবাসা ব্যাপারটা গরম কফির উপর জমে থাকা ফেনার মত। কখনোই তলানিকে স্পর্শ করে না। তেমনি তুমিও গভীর ভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারবে না!’
বেশ অস্বস্তিতে পড়ে দিপু। বলে, ‘পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতেই বুঝি আসতে লিখেছিলে?’
‘অনেকটা সে রকম হলেও যৎসামান্য।’
দীপার মুখটা হাসিহাসি থাকলেও আড়ালে কোথাও ছটফট করে আহত পাখি। ডানা ঝাপটায়। কিন্তু পাখির দেখা না মিললেও তার আর্তনাদ বাতাসকে ভারি করে।
‘তোমার বিভীষিকা কবিতাটা কি ওই একই দিনে লিখেছিলে? জানি, জীবনের শুদ্ধতা কোনোভাবে নষ্ট হলে, কেউ কেউ দুঃখ পায়। তবে অনেক সময় দুঃখের চেয়ে অপমানের জ্বালাটা তীব্র হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু দিপু মিয়া! আমাদের সেই ব্যর্থতা আর দুঃখ যন্ত্রণার ফসিলের উপর দাঁড়িয়ে কি পারি না বন্ধু থাকতে? মনে করো না, নাসির যেমন ভালোবেসে তোমার কাঁধে জ্বালা ধরানো থাপ্পড় বসায়, আমি না হয় তোমার মনের উপরই…।’
কথা শেষ না করে দিপুর একটা হাত চেপে ধরে দীপা। ‘আমাদের বন্ধুত্বে বাঁধাটা কোথায়?’
‘অনেক বাধা!’ বলে থামে দিপু। কিন্তু ততক্ষণে দীপার চোখের পানি গালে নেমে এসেছে।
তারপর, ‘তবে, বাধাগুলো ডিঙোনো সম্ভব!’ বলে বাক্যটা সম্পূর্ণ করে দিপু।
দীপা দিপুর ধরে রাখা হাতটার উপর মাথা রেখে হুহু করে কেঁদে ফেলে।
দিপুর বিস্ময় বাড়ে। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে দীপার এ কান্না দুঃখের নয়, স্বস্তির। অস্তিত্বের গভীরে লালিত অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির আনন্দের বহিঃপ্রকাশ, তখন আর বিস্ময় থাকে না।
দীপাকে কিছুক্ষণ কাঁদতে সময় দেয় দিপু। কান্নার ফলে দীপা আবার মনের দিক থেকে ফিরে পাবে তার শুদ্ধতা। ধুয়ে মুছে যাবে যাবতীয় গ্লানি।
তারপর দীপার মাথায় হাত রেখে বলে, ‘দীপা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!’
দিপুর হাত ছেড়ে দিয়ে আঁচলে চোখ মোছে দীপা। বলে, ‘আমার দিকটা একবার ভাবো! প্লিজ!’
দিপু হেসে বললো, ‘আরো এক কাপ করে চা নিয়ে দুজনেই ভাবি! সেটাই ভালো হবে না?’
‘তা অবশ্য ঠিক!’
দীপার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। যে হাসিকে কেবল অতি বর্ষণের পর আকাশের কোলে হেসে উঠা সূর্যের সঙ্গেই তুলনা করা চলে।
দশ
ছেলে-মেয়েরা যতই খারাপ হোক না কেন, তাদের বিপদের সময় বাবা-মা কখনোই মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারেন না। তেমনি সোহেলের কাছে অপুর দুর্ঘটনার খবর পেয়েই মিজান সাহেব ছুটে গিয়েছিলেন ছেলের পাশে। কিন্তু অপুকে যেমনটি দেখবেন বলে ভয় পেয়েছিলেন, তেমনটি দেখতে না পেয়ে বেশ স্বস্তি অনুভব করছিলেন। অপু বেশ সুস্থ হয়ে গেছে। এখন রীতিমত অফিসে যাচ্ছে সে।
প্রশান্ত মনে বাড়ি ফিরে আসমা বেগমের উদ্বিগ্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন মিজান সাহেব। স্ত্রীকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘না না, ঘাবড়াবার মত কিছু ঘটেনি!’ হাসতে হাসতে বলেন, ‘পুরোপুরি ফিট! দেখে এলাম অফিসে যাচ্ছে!’
‘কি?’
মিজান সাহেবের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন আসমা বেগম। ‘অপু অফিসে যাচ্ছে মানে?’
‘হ্যাঁ। কি একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি নিয়েছে।’
‘ও তো এখনো বিএসসি শেষ করেনি। এত কম পড়া-শুনা নিয়ে কী এমন চাকরি করছে জানতে চাওনি?’
‘জিজ্ঞেস করিনি।’
‘বাড়ি আসতে বলোনি?’
‘বলেছি, বলেছি! ক’দিন পরেই আসবে।’
‘কবে থেকেই তো শুনছি আসবে, এলো না তো! কতটা দিন হয়ে গেল, শয়তানটাকে একনজর দেখতেও পাই না!’ বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন আসমা বেগম। তারপর আঁচলে চোখ মুছে আবার জিজ্ঞেস করেন, ‘বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলে?’
‘করেছিলাম।’
‘কী বললো?’
‘পরিষ্কার করে তো বললো না কিছু। শুধু বললো, সময় হলে নাকি জানাবে।’
‘শফি ছিলো? ও কিছু বলেনি?’
‘এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানে বলে মনে হয় না। তবে সে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওদের দুজনকেই দূরে সরানোর চেষ্টা করছে।’
‘অপু কি তা করবে?’ আসমা বেগমের কণ্ঠে অনিশ্চয়তা হোঁচট খেয়ে পড়ে।
মিজান সাহেব বলেন, ‘আরে, করবে করবে! শফি তো তাই বললো।’
আসমা বেগম আর কিছু জিজ্ঞেস করেন না। যা জানবার তা অপু এলে তার কাছ থেকেই জেনে নেবেন। কিন্তু কবে যে অপু বাড়ি আসবে, সেটা সে আর তার খোদা জানে! ভেবে, আসমা বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।
রাতে খাওয়ার পর দিপু কথা বলছিলো মা আসমা বেগমের সাথে। তিনি পানের বাটা সামনে নিয়ে বসে আছেন। একটা পান হাতে নিয়ে তাতে চুন-টুন লাগিয়ে মুখে দেওয়ার জন্য তৈরি করছিলেন।
দিপু হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটিয়ে বলে, ‘আচ্ছা মা, একটা কথা বলবো?’
‘এখন আবার কি বলবি?’ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছেলেকে নিরীক্ষণ করেন তিনি। ‘এতক্ষণ ধরে কথা বলেও তোর আরো জানতে বাকি রইলো কি?’ বলে, তিনি আবার পানের দিকে মনোযোগ দিলেন।
‘খুব ভেবে চিন্তে বলবে কিন্তু!’
আসমা বেগম পান বানানো বন্ধ রেখে আবার ছেলের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকান। কিন্তু কিছু বলেন না।
দিপু বললো, ‘ধরো, অপু সত্যি সত্যিই বিয়ে করলো সুফিয়াকে। কী করবে তখন?’
‘কিছুই না।’ বলে, তিনি ছর্তায় সুপারি কাটেন।
দিপু বুঝতে পারে তিনি রেগে উঠেছেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে সে আবার বলে, ‘বউ হিসেবে ঘরে তুলবে না?’
‘কক্ষনো না!’
‘ভেবে দেখ, ব্যাপারটা সত্যি হলে কিন্তু আমাদের কিছুই করার নেই।’
‘আর থাকে কি করে?’
‘তাহলে বউ তুলতে সমস্যাটা কোথায়?’
‘পুরোনো দিনগুলো কি ভুলে গেছিস?’
‘সমাজে একসঙ্গে বাস করতে গেলে এমন হয়েই থাকে। এসব সারাজীবন মনের ভেতর পুষে রাখাটা কি ঠিক, মা?’
আসমা বেগম দিপুর দিকে ডান হাতের তর্জনী উঁচিয়ে বললেন, ‘জানিস, এখনো আমি দেখতে পাই জানোয়ারের বাচ্চাটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বিশ্রী ভাষায় যা-তা বলছে! ঘটনাটা মনে হলে এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না! এমন অসভ্যকে ঘরের বউ করতে বলছিস? আমাকে কী ভাবিস তোরা?’
পানটাকে খিলি বানিয়ে তিনি আবার বলেন, ‘আমি মরে গেলে যা হবার হোক। দেখার জন্য আমি তখন থাকবো না!’
‘ছেলেকে তো আর ফেলে দিতে পারবে না!’
‘না পারার কি আছে? মনে করবো আমার আরেকটা ছেলে নেই। বাচ্চু, বাবুল, আবু এরা নেই বলে কি আমার দিন চলা থেমে গেছে?’
‘ধরো, যদি সত্যিই দেখা যায়…।’
দিপুকে কথা শেষ করতে দেন না আসমা বেগম। বাঁধা দিয়ে বলেন, ‘একদম চুপ! ভাত খেয়েছিস, এখন যা! তোর আর ওকালতি করতে হবে না, শয়তান!’
মা সত্যিই বড় শক্ত মনের মানুষ! দিপু মনেমনে ভাবে। তাহলে অপুটার হবে কি? হাজার প্রাচুর্যে থাকলেও মনের ভেতর একটা কাঁটা খচখচ করবে না?
মিজান সাহেব আর আসমা বেগম রাত দিন অপুর আসার সম্ভাবনা নিয়ে সময় পার করেন। কিন্তু বেশ কিছুদিন পর ডাকপিয়ন এসে মিজান সাহেবের হাতে একটা হলুদ খাম দিয়ে যায়। তিনি খামটা হাতে নিয়ে প্রেরক আর প্রাপকের নাম দেখেন। অপু তার মা’কে লিখেছে। তিনি বাচ্চুর বড় মেয়ে লাকিকে ডেকে বললেন, ‘তোর দাদির চিঠি। নিয়ে দাদিকে দে।’
আসমা বেগম দুপুরের জন্য চুলোয় ভাত বসিয়ে জ্বাল দিচ্ছিলেন। লাকি এসে বললো, ‘দাদি, তোমার চিঠি।’
‘আমাকে আবার কে চিঠি লিখলো?’
লাকি প্রেরকের নাম দেখে বললো, ‘অপু কাকা।’
আসমা বেগম খুশি হলেও তা প্রকাশ করলেন না। লাকিকে বললেন, ‘তুই ভাতটা দেখিস। আমি দেখি ছাগলটা কি লিখলো!’
আসমা বেগম ঘরে এসে আলমারি থেকে চশমাটা নিয়ে বিছানায় গিয়ে বসলেন। একটা অদ্ভুত ভালোলাগা নিয়ে তিনি খাম ছিঁড়ে চিঠিটা বের করেন। তাঁর মনে হচ্ছে দেড়-দু মাসের অপুকেই বুঝি দু হাতে কোলে তুলে নিয়েছেন। তারপর চিঠির ভাঁজ খুলে পড়তে আরম্ভ করেন।
“মা
আমার ভালোবাসা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা জেনো।
জানি না, তুমি কিংবা অন্যরা কেমন! তবে, আশা করছি পরম করুণাময়ের কৃপা ধন্য হয়ে ভালোই আছ। কিন্তু মা, আমি যে কেমন আছি, কি ভাবে বেঁচে আছি, তা তোমাদের কল্পনাতীত। ইতোপূর্বে কখনোই তোমার কাছে চিঠি লিখবার প্রয়োজন পড়েনি।
তাই হঠাৎ করেই তোমাকে চিঠি লিখতে বসে কী ভাবে যে শুরুটা করবো, ভেবে পাচ্ছি না। তো যাক, ভূমিকার কথা না হয় বাদই দিলাম। আমি দুর্ঘটনার ক’দিন আগেই একটা বিদেশি কোম্পানিতে জয়েন করেছি। ছোট পোস্ট হলেও বেতন খারাপ না। তবে কি জানো মা, দুর্ঘটনার পর থেকে আমার শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য এমন হয়েছে যে, তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তোমার ছোট ছেলে বলে আমাকে চিনতে পারবে কিনা সন্দেহ।
একটা সময় ছিলো, যখন তোমাকে ছেড়ে একটা দিনও কোথাও থাকতে পারতাম না। তাই, তোমার আঁচলের নিচে একটু আশ্রয়ের জন্য, বুকের উত্তাপ নিয়ে পরম নির্ভরতায় ঘুমোবার জন্যে ছুটে আসতাম কোনো দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে। কিন্তু এখন তো আমি সেই সময়টাকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। এখন যদি যোজন যোজন পথ হেঁটেও পেছনে ফিরে যাই, সেই সময়টাকে আর খুঁজে পাবো না। যে মুহূর্তগুলো একবার হারিয়ে গেছে, তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কোনো কিছুর বিনিময়েও না। আমিও আর সেই ছোট্টটি হয়ে তোমার বুকে আশ্রয় নিতে পারবো না। তাই, তোমার আঁচল ছায়ায় শান্তি অন্বেষণও আজ শুধু বাতুলতাই নয়, অর্থহীনও।
বলতে পারো যে, কেন আজ বাড়ি আসি না?
আসলে কি, বাড়ি যেতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। কান্নাকাটি করেও কেন আমার মুখ দেখতে পাও না! সবগুলোর একটিই মাত্র কারণ। আর সেই কারণটা হচ্ছো তুমি।
হ্যাঁ মা! তুমিই! আর তাই বাড়ি যেতে সাহস পাই না। আজ আমি শঙ্কিত। ভীত। সুফিয়াকে ভালোবেসে যে মহাপাপ আমি করেছি, তার প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই বুঝি আজ আমি তোমাদের কাছে মন্দ আর অস্পৃশ্য! শুধু কি তাই? লম্পট-বদমাশ-অকৃতজ্ঞ, ছোটলোক ও চামার বিশেষণেও ভূষিত হয়েছি! স্রষ্টার কাছে ফরিয়াদ করে দেখতে চেয়েছো আমার মরা লাশও।
খুবই আশার কথা সন্দেহ নাই। তবে, ভেবো না যে, তোমাদের দৃষ্টির আড়ালে আছি বলে কিছুই দেখি না বা শুনি না। কোনো না কোনোভাবে সব খবরই পেয়ে যাই। আর সে জন্যেই ভয়টা আমাকে তিলেতিলে গ্রাস করে নিচ্ছে। পাছে তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার আগেই না আবার লাশ হয়ে যাই!
আচ্ছা মা! তোমাদের যদি এতটাই দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে কি অন্তত: মাটির দিকে চেয়ে, আমি ভূমিষ্ঠ-কালের গর্ভ-যাতনার কথা ভেবে হলেও আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারো না?
একজন মা মনে যত কষ্টই পান না কেন, নারী-জীবনে গর্ভ-যাতনা আর প্রসব বেদনার চেয়ে বেশি কোনো যন্ত্রণা আছে বলে আমার জানা নেই। তাই বলছিলাম, নতুন করে আর কী বা কষ্ট তোমাকে দিতে পারি? যে অপরাধ আমি করেছি, তার ক্ষমা নেই জানি! তবুও ক্ষমা করে দিও। তোমাদের ক্ষমা না পেলে আমার মত এমন একটা নরাধম মাটির নিচে গিয়েও শান্তি পাবে না!
মা, আমি সত্যিই ক্ষমা চাচ্ছি। আশীর্বাদ করতে না পার, অন্তত: ক্ষমাটা করে দিও। তোমার মন থেকেই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি কখনোই বলব না যে, সুফিয়া ভালো কি মন্দ। তাকে চাই বা না চাই, এসবের কিছুই বলবো না।
আমার এই ক্ষুদ্র জীবনটাকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি। অনেক সূক্ষ্ম ভাবেও পরিমাপ করেছি। এই জীবনে আমার সব চাওয়া-পাওয়া, ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা, কামনাবাসনার রঙ-বেরঙের ফানুসগুলো যেন চুপসে গেছে। কারণ, ছোটবেলা থেকে আজ অবধি তেমন দামি তো দূরের কথা, সস্তা কিছুর জন্যও তোমাদের কাছে বায়না ধরি নি। আর বায়না ধরলেও তা পূরণে সক্ষম ছিলে না। তাই আজো তেমন কিছু চাইবো না, যা দিতে তোমাদের টাকা-পয়সা খরচ করতে হবে। বিনা পয়সার একটা জিনিসই চাইবো, যা আমার কাছে এখন মহা মূল্যবান! আর তা হচ্ছে ক্ষমা। কেবলই ক্ষমা!
প্রতিদিন, প্রতিটি মানুষের কাছে পৃথিবী যেমন নিত্য-নতুন হয়ে ধরা দেয়, তেমনি আমার কাছে ধরা দেয় ভিন্ন এক পৃথিবী। যা খুবই জরাজীর্ণ, মলিন আর নিষ্ঠুর! যার ফলে,পৃথিবীর যাবতীয় কিছু ধীরেধীরে আমার কাছে হয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট আর অচেনা।
গতকাল যেটা পরিচিত ছিলো, আজ সেটা পরিচিত থাকছে না। ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি সব। সবকিছু! হয়তো সেটাই আমার জন্য ভালো। আমার উপযুক্ত প্রাপ্য। এই তো বেশ! তোমাদের কাছে আমার চাইবার কিংবা তোমাদেরকে দেওয়ার কিছু ছিলো না। আজও নেই। দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপারটা নেই বলেই হয়তো আমার কোনো পিছুটানও নেই।
মা গো! আমি তো তোমাদের কাছে এখন বাসী আর পুরোনো খবরের কাগজের মত। যাকে তোমাদের খুব একটা প্রয়োজন নেই। আমার তো যাবতীয় সাধ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছিই! তাই বাকি যে ক’টা দিন বলতে গেলে দায়ে পড়েই পৃথিবীকে আশ্রয় করে থাকবো, সেই ক’টা দিন আর নাই বা এলাম! আমার পোড়া আর কলুষিত চেহারাটা তোমার খর দৃষ্টির বাইরেই থাকুক। আমিও তেমনটাই চাই। আর তার পরও যদি আমাকে দেখার সাধ তোমার অবশিষ্ট থাকে, তাহলে অবশ্যই বাড়ি আসবো। তবে সে আসাটা হবে একেবারেই। চিরদিনের জন্য। তখন তুমি তোমার সর্ব-নিকৃষ্ট সন্তানটির জন্যে অপেক্ষা কোরো স্বল্প-দামী সাদা মার্কিন আর দু ফোঁটা অশ্রু নিয়ে। খোদা হাফেজ জানিয়ে আজ সমাপ্তি টানছি। তোমারই কু-সন্তান অপূর্ব।”
আসমা বেগম চিঠিটা পড়া শেষ করে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলেন। তারপর প্রচণ্ড রাগে কিংবা দুঃখে চিঠিটা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ছুঁড়ে ফেললেন জানালার বাইরে। উত্তুরে হিমেল হাওয়া চিঠির ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র অংশগুলোকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো করে ফেললো ঘাসের উপর।
মিজান সাহেব চিঠির ভাষ্য জানার জন্যে উঠে এসে আসমা বেগমের চোখে পানি দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ছেলের চিঠি পড়ে অসময়ে কান্নার কী এমন হেতু থাকতে পারে, তা নিয়ে ভাবলেন কিছুক্ষণ। কিন্তু কিছু নির্ণয় করতে না পেরে বললেন, ‘কেঁদে-কেটে কী আর হবে? যা ঘটার তাতো আর থেমে নেই!’
আসমা বেগম কিছু বললেন না। দু চোখে আঁচলটা চেপে ধরলেন শুধু।
এগার
গ্রামের পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না।
বেশ কিছুদিন যাবত লোকজনের মাঝে একটা উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোনো সময়ই দু পক্ষে একটা সংঘর্ষ বেঁধে যেতে পারে। এ অবস্থায় সাধারণ মানুষ সবাই চাচ্ছে নিজকে একটা নিরাপদ অবস্থানে রাখতে। মনের কথাটা কেউ সরাসরি প্রকাশ করতে পারছে না কারো কাছে। কিন্তু দিপু ঠিকই বুঝতে পরছে কোনটা ফাঁকি আর আসল।
দিপুর একটা ব্যাপার আছে যে, সে অনেক কিছুই আগাম অনুমান করতে পারে। ভিলেজ পলিটিক্সে অনেক অলিখিত নিয়মের একটা হচ্ছে কোনো পক্ষকেই নিরাশ না করা। আর এই কাজটা খুবই ধূর্ত আর শয়তান লোক ছাড়া কেউ পারে না। যদিও বা কেউ পারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিজকে গোপন রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে, আত্মরক্ষার তাগিদে বাধ্য হয়েই তাকে একটা না একটা পক্ষাবলম্বন করতে হয়।
দিপু দেখতে সরল-সিধা গোবেচারা মনে হলেও আসলে সে শয়তানি আর ধূর্তামির পথটাকেই বেছে নিয়েছে সাবধানে। কাউকেই সে বুঝতে দিচ্ছে না নিজের উদ্দেশ্য। তার উদ্দেশ্য নিরপেক্ষ থাকা। তা ছাড়া বর্ণচোরা মানুষের জয় সর্বত্রই।
বর্তমানে গ্রামের ভারসাম্য নষ্টের মূলে আছে দুটিমাত্র লোক। একজন কাজেম উদ্দিন, অন্যজন সবুর মিয়া। তাদের শত্রুতা চলে আসছে বংশ পরম্পরায়। মূল ঘটনাটা ঘটে আজ থেকে প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর আগে উনিশ’শ আটাশ-ঊনত্রিশ সালের চৈত্রের কোনো একটা দিন। জমি মাপা-মাপির এক পর্যায়ে কাজেম উদ্দিনের বাপ কফিল উদ্দিন এবং সবুর মিয়ার বাপ কেনু মিয়া দুজনেই তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে হাতাহাতির সম্ভাবনা দেখা দিলে উপস্থিত শরিকরা আর গ্রামের অন্যান্য লোকজন তাদের নিবৃত্ত করে আসন্ন সংঘাত থেকে। কিন্তু কেনু মিয়ার ধারণা তাকে ভাগের দিক থেকে ঠকানো হয়েছে। অন্য শরিকরা যেখানে পুকুর ধারের অংশ সমান পেয়েছে তার অংশে কেন কম পড়বে? এমন বাটোয়ারা তিনি মানতে নারাজ। তার বক্তব্য হচ্ছে, সুঁইয়ের আগা পরিমাণ মাটির অংশও তিনি ছাড়বেন না।
কিন্তু শত্রুতা যতটুকু ছিলো, তার পর থেকে সেটা আরো গভীর পর্যায়ে চলে যেতে আরম্ভ করলো। কারণ, একান্নবর্তী পরিবারে দলিল-দস্তাবেজ নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতো না। তা ছাড়া লেখা-পড়া কম বলে অন্যরা দলিল-দস্তাবেজের জটিল মার-প্যাঁচ বোঝেন না বলে, বংশের বড় ভাইয়ের ওপরই সব দায়-দায়িত্ব দিয়ে নির্ভেজাল থাকতে পছন্দ করেন। সে কারণেই দলিলের খুঁটিনাটি বিষয় জানা আছে কফিল উদ্দিনের। তিনি ভালো করেই জানেন যে, দলিল-মূলে সম্পত্তি ভাগ হলে কেনু মিয়ার প্রায় অর্ধেক জমি এবং এক তৃতীয়াংশ বসত ভিটা ছেড়ে দিতে হবে। তাই তিনি আবারও কেনু মিয়াকে বললেন, ‘যতই লাফ-ফাল দিবি ততই গর্তে পড়বি। কথাডা আরেকবার ভেইবে দেহিস।’
‘আমার ভাবা-ভাবির কোনো কাজ নেই। একটা সুঁইয়ের আগা পরিমাণও যদি পাওনা থাহি সেডাই বুঝিয়ে দাও। লুটে-পুটে খাতি খাতি তোমার জিহ্বা অনেক লম্বা হইয়ে গেছে!’
কফিল উদ্দিনের সহ্য হয় না কেনু মিয়ার কথা। বললেন,’আইজ রাত্তিরেই সব ফয়সালা হয়ে যাবেনে। তহন কিন্তু মানুষের হাতে পায়ে ধরে যেন কান্নাকাটি না করিস!’
কেনু মিয়া কথাটাকে তলিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেন না। তার মতে, যত প্যাঁচের মূলে এই কফিল উদ্দিন।
এ বংশের একমাত্র উচ্চশিক্ষিত লোক কফিল উদ্দিন। পেশায় একটি হাই স্কুলের শিক্ষক। তার চাচাতো ভাইদের মধ্যে অন্য কেউ পড়াশোনা করে না। কেবল মিজান আর সালাম স্কুলে যায়। বাড়িতে যারা মুরুব্বি ছিলেন তাঁরাও জমি সংক্রান্ত জটিলতায় নির্ভর করতেন শিক্ষিত কফিল উদ্দিনের উপর। তা ছাড়া বিরাট সংসারের আয়-ব্যয়, কেনা-বেচা সমস্ত হিসেব থাকতো তার কাছেই। বংশের প্রথম পুরুষ আজিজ উদ্দিন শিক্ষিত নাতির বুঝ-পরামর্শ মতই সব কাজ করতেন। আর সেই অবসরে সেখানেই ধীরেধীরে জন্ম নেয় একটি স্বার্থপরতার কীট।
কেনু মিয়ার পিতা রেনু মিয়া আজিজ উদ্দিনের জীবদ্দশায় মারা গেলে তিনি তাঁর যাবতীয় সম্পদ নাতিদের নামে দানপত্র দলিল করে দিলেন। ছেলে-মেয়েদের নামে কিছু দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলেন না। এমন কি এটাও ভাবলেন না যে, তাঁর ছেলেরা যদি আরো সন্তান জন্ম দেয়, তাহলে নবাগতদের কি হবে? সম্পদ ভাগ করে দিয়ে তিনি তার অন্তিম সময়ে নাতিদের কাছে ডেকে বলে গেলেন যে, তাদের যদি আরো ভাই জন্ম নেয়, তাহলে তাকে যেন সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা না হয়।
কিন্তু একটা গোপন ব্যাপার ছিলো। আর সেটা হয়েছিলো কফিল উদ্দিনের মুসাবিদায়। যে কারণে ভালো জমি খারাপ জমির একটা পার্থক্য হয়ে গেল। তার নিজের ভাগে পড়ে গেল সব ভালো আর উর্বর জমিগুলো। বাকি ভাল-মন্দ মিলিয়ে অন্যরা। তবে যৌথ-সংসারের আয়ে যে জমিগুলো তিনি তার স্ত্রীর নামে কিনেছিলেন, সেগুলোর কথা চেপে গেলেন দাদা আজিজ উদ্দিনের কাছে। তা ছাড়া বিশ্বাসী নাতির চাতুরী বা শঠতা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল ছিলেন না। অন্যরাও ব্যাপারটা তলিয়ে দেখেননি। ভেবেছিলেন শিক্ষিত ভাই-পো কি আর তাদের ঠকাবে? এমন বিশ্বাসটাই তাদের ভবিষ্যতের জন্যও বয়ে এনেছিলো বিরূপ ফলাফল। আজিজ উদ্দিনের মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই কেনু মিয়া আর কফিল উদ্দিন বিশ্বাসহীনতার দরুন পরস্পর মনের দিক থেকে ধাবিত হচ্ছিলেন বিপরীত দিকে। একান্নবর্তী না থেকে পৃথক হওয়ার সুযোগ খুঁজছিলেন কফিল উদ্দিন। আর কেনু মিয়ার গোঁয়ার্তুমির ফলে সুযোগটা হাতছাড়া করলেন না তিনি।
রাতের বেলা বাড়ির সমস্ত পুরুষ এসে জড়ো হলেন বাংলা ঘরে। কফিল উদ্দিনের বাবা দলিল উদ্দিন অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি।
কেনু মিয়া নিজে নিজেই গজগজ করে বলতে লাগলেন, ‘শরীর খারাপ না ঘোড়ার ডিম! বাপ সামনে থাকলে তো মিছে কতা কওয়া যাবে না। তাই চালাকি করে বাপকে আসতি দেয়নি।’
কফিল উদ্দিন তার নির্ধারিত চেয়ারে বসে বললেন, ‘সব শরিক হাজির আছে?’
‘আছে! আছে!’
কেনু মিয়ার আগ্রহটাই সবার চাইতে বেশি বোঝা যাচ্ছে। তিনি তাড়া দিয়ে বলেন, ‘রাত বাড়তিছে। শুধু শুধু সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।’
কফিল উদ্দিন কেনু মিয়ার দিকে একবার তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘চাচারা, আপনারা এখানে সবাই হাজির আছেন। আমার চাচাত ভাইয়েরাও সবাই হাজির আছে। একটা কথা কি আমাগের সবার জানা আছে যে, দাদা কেন তানির সম্পত্তি ছেলেগের নামে না দিয়ে নাতিগের নামে দিয়েছেন?’
‘জানি! জানি!’
বশির উদ্দিন, যাকে সবাই জুনির বাপ বলে ডাকে, তিনি বললেন, ‘ভাতিজা সবাই জানলেও তুমি আরেকবার বুঝোয়ে কও দিনি!’
কফিল উদ্দিন অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সময় নিয়ে, বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে চাচাদের বোঝালেন সেই কারণটা। যার সারাংশ হচ্ছে- ব্রিটিশ সরকার আমলে আমাদের সম্পত্তির ওয়ারিশ আইনে বলা আছে যে, বাবার জীবদ্দশায় যদি তার ছেলে কোনো ওয়ারিশ রেখে মারা যান আর সেই মৃত ছেলের বাবা যদি তার পিতৃহীন নাতিকে লিখিত ভাবে কোনো সম্পত্তি দান করে না যান, তাহলে সেই পিতৃহীন বালক কোনো সম্পদের ওয়ারিশ বা উত্তরাধিকারী বিবেচিত হবে না। যেহেতু বালকের পিতা পৈত্রিক সম্পত্তির মালিক হয়ে মৃত্যু বরণ করেননি, সেহেতু বালকের ভাগ্যে কোনো সম্পত্তি নেই।
সবাই একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ব্যাপারটা সবাই এখন বুঝতে পেরেছে।
‘তালি আপনারা মন দিয়ে শোনেন আমি কি বলি।’
‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, বল!’
সকলের সম্মতি পাওয়ার পর কফিল উদ্দিন বলতে লাগলেন, ‘আমার ভাই কেনু মিয়ার ধারনা যে, সংসারের বছরে যে আয় তা দিয়ে সবার ভরণ-পোষণ, আত্মীয়-স্বজনের নানা খরচের পর যে টাকাটা বাঁইচে যায়, তা জমিয়ে নাকি শ্বশুর বাড়িতে কাজেমের মায়ের নামে সম্পত্তি কইরেছি। এমন কি আমার শ্বশুরের টাকায় উত্তর পাড়ায় যে দেড়-বিঘা জমি কিনেছি, কেনুর মতে সেডাও নাহি সংসার থেকে চুরি করা টাকা! এ কথা কেনু অন্য পাড়ার মানুষগের কাছেও বইলে বেড়াচ্ছে।’
‘চাচারা! আপনারা সবাই এখানে আছেন! আপনাগের কাছে আমার আবদার এই যে, কেনুর ভাগ বুঝিয়ে দেওয়ার পর দয়া করে আমার ভাগটাও বুঝোয়ে দেবেন। জমি যখন ভাগই হবে, তা’লি আমার চুলোও আলাদা কইরে দেন। আপানারা কি বলেন?’
বশির উদ্দিন বললেন, ‘ভাতিজা, সঙ্গে সঙ্গে আমাগেরটাও বুঝোয়ে দ্যাও। অনেক বছর তো একই চুলোর রান্না খালাম! আর কত? আমাগের সংসারও তো বড় হচ্ছে!’
কথাটা যে তিনি অভিমানাহত হয়েই বললেন, সেটা বুঝতে কারোই অসুবিধা হয়নি।
কফিল উদ্দিন বললেন, ‘চাচা! আপনার কষ্টটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাগের ভিতর যে এমন হিংসা আর সন্দেহ চইলে আসবে তা কেডা জানতো? আর এক পাতে থাহা যাবেনানে। দাদা বেঁইচে থাকতিও কেনুডা এমন কইরেছে। সংসারে নানা রহম ঝামেলা পাকায়েছে। সাদিম মাঝির মেয়েক নিয়ে কেলেঙ্কারি কইরে সমাজের বিচারে জুতোর বাড়ি খেয়ে আমাগের উঁচু মাথা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। আপনারা জানেন না যে, দাদা প্রথম দিকে কেনুক কিছুই দিতি চাননি। আমি বলে কয়েই কিছু পাওয়ার ব্যবস্থা কইরে দিয়েছি। নইলে আজ তার জায়গা কোথায় হতো? যার জন্যি চুরি করলাম, দাদার পায়ে ধরলাম, আজ সেই আমাক কচ্ছে চোর!’
সেই রাতেই আজিজ উদ্দিনের সমূদয় সম্পত্তি দান-কবলা দলিল অনুযায়ী সাত ভাগে ভাগ করে দেওয়া হলো। সংসারের টাকা-পয়সা ধান-চাল ভাগ হয়ে গেল মাথাপিছু। আর কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল নতুন নতুন ঘর উঠছে। সাথে একটা করে নতুন রান্নাঘর। সে এক দেখার মত দৃশ্য বটে!
সকালবেলা প্রত্যেকটা চুলোয় আগুন জ্বলে উঠলে চারদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। কিন্তু পারস্পরিক শান্তি আর বজায় রাখা সম্ভব হলো না। বছর না ঘুরতেই কেনু মিয়া নতুন আরেক সমস্যা নিয়ে পাড়া মাতিয়ে তুললেন। তাকে নাকি সম্পত্তির ভাগ কম দেওয়া হয়েছে। কফিল উদ্দিন চালাকি করে নিজের ভাগে ভালো জমিগুলো আর বেশি জমি রেখেছেন।
এ কান ও কান, এ মুখ সেই মুখ হয়ে কথাগুলো ঘুরতে ঘুরতে কফিল উদ্দিনের কানেও আসে। একদিন তিনি কেনু মিয়াকে ডেকে বললেন, ‘তুই মানুষের কাছে এসব কি বইলে বেড়াচ্ছিস? তোক নাহি ভাগে কম দিয়েছি?’
‘কমই তো দিয়েছেন। পুকুর পাড়ে আমার জায়গা মাপে কম হচ্ছে। বাড়ির অংশটাও কম। তার উপর বড় মুড়ার জমি মাত্র বিশ শতাংশ।’
‘তোক ঠকাইনি। বেশি চালাকি করলি তোর নিজের গলাতেই রশি লাগবে!’
‘লাগলে লাগবে। আমি দাদার দলিল বরাবর আমার হিস্যা বুইঝে নিতি চাই!’
‘আরে ছাগল!’ কফিল উদ্দিন কেনুর গোঁয়ার্তুমিতে রেগে উঠলেন। ‘য্যাম্বা আছিস অ্যাম্বাই থাক। শুধু শুধু কেন ঝামেলা পাকাচ্ছিস?’
‘সুঁই পরিমাণ জায়গার দাবিও ছাড়বোনানে! আপনার নামে আমি শালিস বসাবো!’
‘পাগলামি করিস না!’
‘পাগলামি কে করতিছে শালিসেই বোঝা যাবে!’
কফিল উদ্দিনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ‘বেশ! তুই যদি পারিস শালিস বসা। তোর সেই শালিস আমি মানি না!’
শুরু হয় আরেক সংঘাত। কেনু মিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে, কফিল উদ্দিনের জালিয়াতি ফাঁস হয়ে যাবে ভেবে উনি শালিস মানতে চাচ্ছেন না। আর তাই পাকাপোক্ত হিসাব করার উদ্দেশ্যে পাঁচ গ্রামের প্রধানদের ডাকিয়ে শালিস বসালেন কেনু মিয়া।
এবারও যথা নিয়মে সব শরিকরা সমবেত হয় কফিল উদ্দিনের বৈঠক খানায়। কফিল উদ্দিন হাতে করে নিয়ে আসেন আজিজ উদ্দিনের দানপত্র দলিল। সভায় উপস্থিত ভিন্ন গ্রামের প্রধানদেরও তিনি শ্রদ্ধার পাত্র। তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন শিক্ষিত হয়ে। শিক্ষক হয়ে। তিনি প্রধানদের হাতে দলিলটা দিয়ে কেনু মিয়ার নির্দিষ্ট অংশটা দেখিয়ে বললেন, ‘আপনারা কেনুর অংশগুলো কোহানে কি পরিমাণে আছে পইড়ে নেন। এডা আপনাগের জেনে রাহা দরকার।’
সবচেয়ে বর্ষীয়ান শুদ্দোধন সরকার বললেন, ‘কেনু বাবাজি, তুমি কি বলার জন্যি আমাগের ডেইকেছ একটু খোলাসা কইরে কও দিনি!’
কেনু মিয়া সভার অনুমতি নিয়ে বয়ান করে গেলেন এক সুদীর্ঘ বঞ্চনা আর প্রতারণার কালো ইতিহাস।
সব শুনে সরকার সাহেব বাকি চার প্রধানকে বললেন, ‘তোমরা কেনুক বলো যে, দলিল অনুযায়ী সে তার সম্পত্তি দাবী কইরেছে। এখন যদি দলিল অনুযায়ী তার প্রাপ্য নির্ধারণ করে দেই, তালি সে মানবে কি না? তবে, আমার পরামর্শ হতিছে এই যে, কেনু মিয়া য্যাম্বা আছো অ্যাম্বাই মাইনে লাও!’
কেনু মিয়া সম্মত না হলে, সরকার সাহেব উপস্থিত সবাইকে বললেন, ‘আপনারা শুনেছেন তো কেনু কি বললো?’
সবাই বললো, ‘শুনিছি!’
সরকার সাহেব বললেন, ‘কেনু মিয়া! তুমি ঠাণ্ডা মাথায় কচ্ছো তো?’
‘আমার মাতা ঠাণ্ডাই আছে!’
‘তালি কফিল, তুমি এবারতটা অ্যাহন পইড়ে শোনাও দেহি। আমরা সামনের সপ্তাহে কেনুর জমি-বাড়ি সব মাপজোক কইরে খুঁটি গেঁড়ে দিয়ে যাবানি।’
কেনু মিয়া সোৎসাহে বলল, ‘সেডাই ভাল হবি!’
কফিল উদ্দিন দলিলের একটা পৃষ্ঠা চোখের সামনে মেলে ধরে বললেন, ‘আমরা মূল ভাগীদার হচ্ছি সাতটা। সবাই সমান সাত ভাগ করে বাড়ি, জমি আর পুকুরের অংশ ভোগ-দখল করছি। এর মাঝে বসত বাড়ি সবাই ভোগ-দখল করতিছি বিশ শতাংশ করে। দানপত্র কবলা দলিল অনুযায়ী কেনুর অংশ হতিছে পনের শতাংশ। বাকি পাঁচ শতাংশের দখল ছেড়ে দিতি হবে। পুষ্কুনির তিন পাড়ে কেনুর দখলে আছে বার শতাংশ। দানপত্রে তাক পুকুর পাড়ের অংশ দেওয়া হয়নি। বাড়ির লাগোয়া পঞ্চাশ শতাংশের জমিতে কেনুর ভাগ আছে মাত্র দশ শতাংশ।’
এভাবে যখন দেখা গেল বেশ কিছু জমিতে কেনুর কোনো অধিকার নেই। হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বিরাট একটা অংশ। এই বঞ্চনাকে মেনে নিতে পারেন না কেনু মিয়া। এ জন্য তিনি দায়ী করেন কফিল উদ্দিনকে। সেই থেকে একটা ঘৃণার বিষ বাষ্পে তিনি ঘামতে থাকেন। সুযোগ খোঁজেন কফিল উদ্দিনকে হেনস্তা করার জন্য। ফলে, কফিল উদ্দিন মারা গেলে কেনু মিয়া বাড়ি থাকা সত্ত্বেও সেই জানাজাতে অংশ নেননি। আর এই দুঃখ বোধটা গেঁথেছিলো কফিল উদ্দিনের ছেলে কাজেম উদ্দিনের মনে। সুযোগ পেলেই কেনু মিয়া বা তার ছেলে সবুর মিয়ার ক্ষতি করার চেষ্টা করেন কাজেম। সেই অর্থে মামলা-মকদ্দমায় জড়িয়ে সবুরকে বেশ কিছুদিন জেলও খাটিয়ে এনেছেন।
জেল খেটে আসার পর সবুর মিয়া সুযোগের অপেক্ষায় থাকে আর দিন গোনে। এভাবে একদিন বেশ ভাল একটা সুযোগ চলে আসে সবুর মিয়ার সামনে।
বছর কয়েক আগে একই গ্রামের আক্কাস শেখ কাজেম উদ্দিনের মাধ্যমে একটা পুরোনো ট্রাক বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু সেই ট্রাক বিক্রির টাকা কাজেম উদ্দিন ঠিকমত দেননি আক্কাস শেখকে। ভেঙে ভেঙে টাকা দিয়েছিলেন। অর্ধেকের মত টাকা দেওয়া হলে কাজেম উদ্দিন বলেছিলেন টাকা দেওয়া শেষ। বাকি টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য শালিসী বৈঠক ডেকেও কোনো সমাধান হয়নি। কাজেম উদ্দিন সে শালিসের রায় মানেননি।
এরপর আক্কাস শেখ বেশ কিছুদিন পর গ্রামের লোকজনকে একতাবদ্ধ করে কাজেম উদ্দিনকে একদিন রাস্তা-ঘাটে অপমান করেন। সবুর মিয়া এ খবর পেয়ে ভিড়ে যায় আক্কাস শেখের দলে।
এবার আক্কাস শেখ আর সবুর মিয়া একজোট হয়ে কাজেম উদ্দিনকে অপমান করেই ক্ষান্ত দেয় না। তাকে লাঠি-সোঠা নিয়ে ধাওয়া করে নিয়ে ফেলে পাশের একটা ডোবায়। তিনি আত্ম-রক্ষার জন্য চিৎকার করে লোকজনের সাহায্য কামনা করলেন। কিন্তু গ্রামের লোকজন প্রকৃতপক্ষে কাজেম উদ্দিনকে ভালবাসেনি বা শ্রদ্ধা করেনি। প্রকাশ্যে তাকে ভয় পেয়েছে ঠিকই। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে পুষে রেখেছে ঘৃণা। তাই সময় মত না পৌঁছে ওরা কিছুটা দেরিতে পৌঁছে। তারাও হাতে লাঠি-সোঠা, বল-ম-টেটা নিয়ে গেলেও ততক্ষণে যা ঘটার ঘটে গেছে। কাজেম উদ্দিন নোংরা পানিতে ডুব দিয়ে উঠে দেখলেন তার পক্ষে লোকজন এগিয়ে আসছে। কিন্তু তিনি যখন ঘটনার বর্ণনা দিতে গেলেন দেখা গেল গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। একটা অস্পষ্ট ফ্যাস-ফ্যাসে শব্দ বেরিয়ে আসছে। উপস্থিত লোকজন তার কথা বুঝতে পারে না। ঘটনার তদন্ত করতে থানা থেকে দারোগা এলেন। তিনিও কথা বুঝতে না পেরে তাদের ঘিরে থাকা লোকজনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা এর কথা কিছু বুঝতে পারেন?’
কাজেম উদ্দিনের দুর্দশা দেখে তার পক্ষের-বিপক্ষের লোকজন হেসে ওঠে।
দারোগা বিরক্ত হন। কিন্তু একটা জিনিস খুব ধীরে হলেও পরিষ্কার হয়ে ফুটে উঠলো যে, দারোগা চলে যাওয়ার পর, গ্রামের মানুষ দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। কেউ বুঝে, কেউ না বুঝে। কেউ বা কাজেম উদ্দিনের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ভিড়েছে তার প্রতি।
তবে, দু দলের মানুষই দিপুকে ভেড়াতে চায় নিজেদের দলে। কিন্তু, সে পরিষ্কার করে কাউকে কথা না দিলেও মন কাজেম উদ্দিনের প্রতি নরম হয় না। সে মনে মনে আক্কাস শেখকেই সমর্থন করে। এ নিয়ে ভেবে ভেবে তার ঘুম হয় না। বাবা মিজান সাহেব দিপুকে বলেন, ‘আমাদের এসব দলাদলিতে কাজ নেই।’
দলাদলিতে যে কাজ নেই, কথাটা খুবই সত্যি। কিন্তু দিপুর মনে অন্য কথা পাক খায় বানের স্রোতের মত। কাজেম উদ্দিন তার সহানুভূতি পাবে না। সালাম মিয়ার সাথে তাদের যে কারণে লাঠা-লাঠির মত ঘটনা ঘটেছিলো, তা অবশ্য ততটা বেগবান হতো না। এই লোকটাই গোপনে অর্থ আর পরামর্শ দিয়ে মকদ্দমা দায়ের করিয়েছিলো।
দিপু সেই কথাগুলো মনে করে বলে, ‘আমি দলাদলিতে নেই। কিন্তু ভুলে যাইনি যে, আমি যাতে পরীক্ষা দিতে না পারি, সে জন্যে আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার সময় আপনার ভাইকে কু-পরামর্শ দিয়ে আমার পেছনে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছিলো এই লোকটাই!’
‘সে সব তো কতদিন আগের কথা। এখন এগুলো টেনে কি হবে?’
‘আমি যদি ম্যাট্রিকটা পাশ করতে না পারতাম?’
‘সব খারাপ মনে রাখতে নেই বাপ! অপরাধীকে আল্লাই শাস্তি দেন!’
‘আল্লা হচ্ছেন গরীব আর দুর্বলের সান্ত্বনা। যারা অপরাধ করে তারা তো এটা মনে রাখে না। আচ্ছা বাবা! আপনি কি ভুলে গেছেন যে, পাওনা টাকা চাইতে গেলে কাজেম উদ্দিন আপনাকে ভিক্ষুক বলতো?’
মিজান সাহেব চুপ করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকেন।
‘আপনাকে একবার পকেট থেকে দশ টাকার একটা বান্ডিল দেখিয়ে কী বলেছিলো? বলেনি, আমার কাছে হাজার হাজার টাকা আছে, আপনাকে এক পাই-পয়সাও দেবো না। তার বাপ কফিল মাস্টার আপনাকে কলেজে ভর্তি হতে না দিয়ে টেইলারিং শিখতে বলেছিলেন। এর পেছনে কি ছিলো? চাচাতো ভাই শিক্ষায় যাতে তাকে ছাড়িয়ে যেতে না পারে। তাই না বাবা?’
‘এসব পুরোনো কথা ভুলে যা!’
মিজান সাহেবের কণ্ঠে বিরক্তি গোপন থাকে না।
‘যারা কোনোদিন আমাদের অমঙ্গল ছাড়া ভালো চায়নি, তাদের জন্য কিসের সহানুভূতি? কিসের দয়া?’
মিজান সাহেব বিরক্ত হলেও সেদিন উত্তেজিত ছেলেকে শান্ত করতে বলেছিলেন, ‘আল্লার কাছে অন্যায়ের কোনো প্রশ্রয় নেই। তিনি ঠিকই সুবিচার করেন। মাজলুমকে ঠকান না।’
দিপু সেদিন শান্ত না হলেও পিতার সামনে চুপ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মনের জ্বালা ঠিকই লালন করেছে ভেতরে ভেতরে। আর তাই কোনো পক্ষকেই বুঝতে দেয়নি নিজের অভিসন্ধি।
জুমার নামাজের দিন মসজিদ থেকে নামাজ শেষে বোরোবার পথেই আক্কাস শেখ দিপুকে ধরলেন। ‘দীপঙ্কর, তুমি অ্যাহোন অবসর তো?’
দিপু বললো, ‘হ্যাঁ চাচা। বলতি গেলে অ্যাহোন দীর্ঘ অবসর!’
‘কিছুক্ষণ আমাক সময় দিতি পারবা? একটা আলাপ ছিলো।’
দিপু বুঝতে পারে যে আক্কাস শেখ কি নিয়ে কথা বলতে চান। কিন্তু আক্কাস শেখকে বুঝতে না দিয়ে বললো, ‘কোন ব্যাপারে? বলেন না!’
‘বাড়ি চল। নিরিবিলি বসেই কবোনে!’
দিপু আক্কাস শেখের পাশাপাশি হাঁটে।
‘দীপঙ্কর!’ আক্কাস শেখ একবার ঘাড় ফিরিয়ে দিপুকে দেখেন।
‘জী চাচা!’
‘একটা কতা শুনলাম। তা কি ঠিক?’
‘কোন কথাডা?’
‘তোমরা জ্ঞাতি-গোষ্ঠী মিলে নাহি আমার বিরুদ্ধে এক জোট হয়েছ?’
দিপু হাসে। ‘বলেন কি চাচা? এক জোট না হয়ে উপায় আছে? আপনি পথে-ঘাটে আমাগের অপমান করবেন, মারবেন, তা তো হতি দেওয়া যায় না!’
‘তা তো বুঝলাম!’ বললেন আক্কাস শেখ।’ কিন্তু তোমার কি মনে আছে তোমার চাচা সালাম মিয়া একবার শালিস ডেকেছিলো?’
‘মনে থাকবে না কেন? এডা তো মাত্র সেদিনের ঘটনা!’
‘সেই শালিসি দরবারে কাজেমের বউ তোমার বাবার বিরুদ্ধে মিছে সাক্ষী দিয়েছিলো। ওরা জোট হয়ে তোমার বাবাক মিথ্যুক বানাতি চেয়েছিলো না?’
‘ওরা কি আর কম চেষ্টা কইরেছে?’
তারপর দিপু আবার বলে, ‘সালাম চাচা তো তার আর মতির বুদ্ধিতে আমাগের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ কইরে দিতি চেয়েছিলো।’
‘তখন যদি সবুর আর আমরা মিলে তোমাগের সামাল না দিতাম, অবস্থাডা কী হতো একবার ভেইবে দেহিছো? শুনিছি মতিডাও ভিড়েছে কাজেমের দলে।’
‘আমিও এমন একটা কথা শুনেছি।’
‘মতি তোমার বাবার সামনে তোমার মাথা ফাটাতি চায়নি?’
‘উদ্দেশ্যডা তো এমনিই ছিলো।’
আক্কাস শেখ মনে মনে খুশি হয়ে উঠলেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি দিপুকে ডেকেছেন তা বুঝি পূরণ হতে চললো। দিপুকে কোনোভাবে কাজেমের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে পারলেই তিনি সফল। তাই শেষ অস্ত্রটা চালিয়ে আবার বললেন, ‘তুমি যে একবার আমার কাছে কেঁদে-কেটে নালিশ দিয়েছিলে, সেডা কিন্তু আমি ভুলিনি। তোমার চাচা মামলা জেতার জন্যি তার মেয়াক দিয়ে রেপ কেস করাতি চেয়েছিলো। আমার কাছে সেই ব্যাপারে পরামর্শ চাতি এলে ধমক দিয়ে বদমাশ বুড়োডারে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম।
আমরা তো জানি, তুমি কি ধরনের ছেলে! তোমার চরিত্রে কালি মাখিয়ে দেবার অপচেষ্টা, তা কি কাজেম আর মতির বুদ্ধিতে হয়নি?’
‘বাবারও তাই ধারণা।’
‘মেয়েডার নাম সুরাইয়া না সুফিয়া? কি যেন ছেলো?’
আক্কাস শেখ দিপুর দিকে তাকান।
দিপু তাকে মনে করিয়ে দিতে বলে, ‘ওর নাম সুফিয়া।’
‘ওক দিয়েই কেসটা করাতি চেয়েছিলো। ও অ্যাহোন তোমাগের বউ, তাই না?’
দিপু জবাব দেয় না।
‘তুমি যাই বলো, সালাম মিয়াও কাজেমের দলে। তুমি আর সবুর যদি ঠিক থাকতি পারো, তালি বিশ বছরের যাবতীয় শোধ তুইলে ছাড়বো। আইজ সকালবেলা মতি নাহি সবুরের বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে এয়েছে।’
‘আমি ঘুমোয়ে ছিলাম। পরে শুনিছি।’
‘আইজ সন্ধ্যার পর গ্রামের সবাক নিয়ে বসতিছি। দেখি কি করা যায়। তুমিও আসতিছো তো?’
‘মনে হয় পারবো না। বাবার শরীরটা বেশি ভালো না।’
‘আমি তো বলতিছি না সব কাজ ফেইলে আসবা। সময় সুযোগ মতই আইসো।’
‘আচ্ছা, চেষ্টা করবোনে।’
ততক্ষণে আক্কাস শেখের বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছে তারা। দিপু বলল, ‘তালি আমি আসি অ্যাহোন।’
‘বাড়ি চল! চা-মুড়ি খেয়ে যাবা।’
‘না চাচা! অন্য একদিন হবেনে।’
‘আচ্ছা, আইসো।’
বাড়ি ফিরতেই কাজেম উদ্দিনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় দিপুর।
‘আবার ষড়যন্ত্র শুরু কইরেছে হারামজাদাডা!’
অভিযোগ দিয়েই তিনি কথা আরম্ভ করলেন। ‘তুই নিজের চোখেই তো সব দেখতি পাচ্ছিস! আইজ আমার গায়ে হাত তুইলেছে। কাল ধরবে অমুক কে। এরপর ধরবে তোক। এডা কি সহ্য করা যায়?’
‘সহ্য না করে উপায় কি? আমাগের কাছ থেকে সাহস না পালি কি এসব হচ্ছে?’
‘ওই সবুর হারামজাদাডা হচ্ছে এ সবের গোড়া! তাক আগে শায়েস্তা করতি হবেনে। তারপর আক্কাস। আমাগের বাড়িতে যে এত হাঙ্গামা আর লাঠালাঠি হচ্ছে সবই হচ্ছে সবুর আর আক্কাসের বুদ্ধিতে। তোর তো অজানা নেই কিছু!’
‘শুধু আমি কেন, গ্রামের সবাই জানে!’
‘সন্ধ্যায় আসিস। এই ব্যাপারে কতা কবোনে! আসবি তো?’
‘চেষ্টা করবো।’
মনেমনে হাসে দিপু। ভাবে, মানুষ কত না নির্লজ্জ! নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য কত সুন্দর করেই না মনের ক্লেদ-নোংরা লুকিয়ে রাখে।
বার
প্রায় একবছর পর বাড়ি আসে অপু।
কিন্তু আগের সময়গুলোতে যেমন একটা খুশি খুশি ভাব আর পরম নির্ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো সারাটা ক্ষণ, এবার তেমন কিছুই মনে হয় না। সে যে এতদিন পর বাড়ি এসেছে, এটা যেন কারো মনে কোনো প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করে না প্রথম। এমন অবস্থায় তার মনের ভেতরকার সকল উৎসাহ আর উদ্দীপনা মুহূর্তেই যেন থিতিয়ে আসে। কিছুক্ষণ পরপরই তার কেবল মনে হতে লাগলো যে, চোরের মত, একজন অনাহূতের মত সে প্রবেশ করেছে এ বাড়ির আঙিনায়। কেউ যেন তাকে চেনে না। এখানে কোনো অধিকার নেই তার।
আসমা বেগম অপুকে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন অভিভূতের মত। এই কি তার ছেলে? যে ছিলো মা-অন্ত প্রাণ। চৌদ্দ-পনের বছর পর্যন্ত যে মায়ের কাছটি ছাড়া ঘুমুতে পারতো না, সে কিনা বলতে গেলে আজ একটা বছর পার করে দিয়ে এসেছে মায়ের কাছে! এই কি নাড়ীর টান? স্মরণের পথ বেয়ে তিনি চলে যান দূর অতীতে।
অপুর তখন পাঁচবছর। মিজান সাহেব চাকরি সূত্রে সপরিবারে থাকেন শহরে। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। অবসর নিয়ে গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়াতে প্রায় প্রতি মাসেই তিনি গ্রামের বাড়ি যেতেন। তাই আসমা বেগমও সেই সুবাদে গ্রামের বাড়ি এসেছিলেন দুদিনের জন্য। সঙ্গে কাউকে আনেননি। ভেবেছিলেন মোটে তো দুটো দিন, ছেলে-মেয়েদের তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু বাড়ি আসার পর দিনই দেখতে পেলেন অপু চলে এসেছে।
ছোট্ট অপুকে গ্রামের বাড়ি দেখতে পেয়ে আসমা বেগমের সারা শরীর কাঁপতে আরম্ভ করেছিলো। তিনি অবাক হয়ে ভাবেন, অতটুকু ছেলে, যে পথ-ঘাট চেনে না। হারিয়েও যেতে পারতো। কিংবা পড়তে পারতো ছেলে-ধরার খপ্পরে। বিস্ময়াভিভূত জননী জানতে চান, ‘তুই কার সঙ্গে এলি? কে নিয়ে এলো?’
‘একা একা।’
‘কীভাবে এলি তুই?’
‘ফুলবাড়িয়া গিয়ে বাসে চড়লাম। একটা লোক আমাদের ঢাকার বাসায় গেছিলো। লোকটা আমাকে চিনেছিলো। বাবার নাম গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করেছে। আমার নামও জানতে চেয়েছিলো। বলিনি।’
‘তোর বাবার নাম, গ্রামের নাম বলতে পেরেছিলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘লোকটাকে চিনিস?’
‘চিনি।’
‘কে? তার নাম কি?’
‘জানি না। বাসায় একবার গেছলো।’
সেই অপু আজ কত বড় হয়ে গেছে। তার সেই কোমল মনটা বড় হতে হতে পাষাণ হয়ে যেতে পারলো? কিন্তু কেন? আসমা বেগমের কণ্ঠনালীতে একটা যন্ত্রণার দলা মোচড় দিয়ে ওঠে। পানিতে ভরে যেতে চায় দু’চোখ। তবুও উদ্গত কান্নাকে তিনি চেপে রাখেন।
‘কেমন আছো?’ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে অপু।
আসমা বেগমের অভিমান বুকের ওপর আরো ভারি হয়ে চেপে বসে যেন। ধরা
গলায় বলেন, ‘এ্যাদ্দিন পর এসে জানতে চাচ্ছিস? নাকি দেখতে এসেছিস বুড়িটা কয় দিন বাঁচবে?’
আসমা বেগম চোখের পানি ধরে রাখতে না পেরে আঁচল দিয়ে চোখ চেপে ধরেন।
‘এসো এসো।’ বলে, অপু আসমা বেগমের একটা হাত ধরে টেনে ঘরে ঢোকে। তারপর হাতের পলি ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করে লাকির হাতে দিয়ে বলে, ‘মিষ্টি আনলাম তোগের জন্যি।’
আসমা বেগম ঘরে আসতেই অপু বললো, ‘বাবা কনে? দেখছি না যে?’
‘মনিরাকে দেখতে গেছে।’
‘মনিরা এসেছিলো?’
‘অনেক আগে এসেছিলো।’
তারপর কথা আর এগোয় না। অপুর উৎসাহ নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আগেই। তাই বৃথা বাক-প্রতিমা সাজানো তার পক্ষে কষ্টকর। সে ঘরের কোণে চুপচাপ বসে থাকে। তার মনে হচ্ছিলো যে, বাড়ি আসাটা তার একদম ঠিক হয়নি। চলে যেতে ইচ্ছে করছে।
এসব ভাবতে ভাবতে তার চোখ পড়ে দিপু বাড়ি ঢুকছে। সে উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘দিপু ভাই! ভালো আছো?’
অপুকে দেখে দিপুর মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলো, একটামাত্র মানুষ অপু অথচ তার কারণে কী একটা অশান্তি বিরাজ করছে দুটো পরিবারের মধ্যে। বলে, ‘ভালো থাকতি দিলি আর কোথায়?’
‘তোমাগের ভালো থাকায় কী অসুবিধা করলাম?’
‘লুকিয়ে বিয়ে করে একটা অশান্তি লাগিয়ে রাখিসনি?’
‘আমি কেন অশান্তি লাগাতে যাবো?’
‘তুই কি বলতে চাস, বিয়ে করিসনি?’
‘না করলে কি লোকে বলে?’ অপু নিঃশব্দে হাসতে লাগলো।
দিপু আবার বলে,’ ঠিক করে ক, বিয়ে করেছিস কিনা?’
‘করেছি তো!’ আগের মতই হাসতে হাসতে বলে অপু।
এমন করে বলার কারণে কথাটা বিশ্বাস হতে চায় না দিপুর। কেমন যেন হেয়ালী বলে মনে হয়।
রাতে খাওয়ার পালা চুকে যেতেই আসমা বেগম পানের বাটা নিয়ে বিছানায় বসেন। অপু তাঁর এক পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে বললো, ‘কবে যে তোমার পাশে ঘুমোতাম, আজ আর মনেই পড়ে না!’
অনেকদিন পর অপু বাড়ি আসাতে আসমা বেগম খুবই খুশি হয়েছেন। কিন্তু সে খুশির উচ্ছ্বাস তিনি আচরণে প্রকাশ করতে চান না। অপুর কথা শুনে বললেন, ‘এত বড় হয়ে তোর লজ্জা করলো না এখানে শুতে?’
‘মা-বাবার চোখে তাঁদের ছেলে-মেয়ে কখনো বড় হয়?’
‘হবে না কেন?’
‘পাল্টা প্রশ্নে তিনি থামিয়ে দেন অপুকে।’
‘তাহলে থাক ওসব!’ বললো অপু। ‘আমাকে একটু পান দিও তো! অনেক দিন হয় পান খাই না।’
আসমা বেগম হ্যাঁ না কিছু বলেন না।
অপু তেমনি শুয়ে থেকে বলতে লাগলো, ‘আজ তোমাদের মতের বাইরে গিয়ে বিয়ে করলাম বলে, এ বাড়িতে আমার কোনো কদর নেই। মনে হয় বাইরের কোনো মুসাফির এসেছি! রাতটা পোহালেই বিদায় নিতে হবে।’
আসমা বেগম বুঝতে পারেন যে, কথাগুলো তার একটা কৌশল। কোনোভাবে মা বাবার মনে একটু ঠাঁই করে নেওয়া যায় কিনা তারই ফন্দি। তিনি একটুও রাগ করেন না।
অপু বেশ ভালো করেই জানে, কেন মায়ের এই নির্লিপ্ততা। তবুও আবার বলে, ‘এতই যদি দোষের কাজ করে থাকি, তাহলে কি ক্ষমা করে দিতে পারো না?’
আসমা বেগম আর নীরব থাকতে পারেন না। ফুঁসে উঠে বলেন, ‘কিসের ক্ষমা? কোন অপরাধে?’
‘বিয়ে যে করলাম!’
‘বিয়ের সাথে ক্ষমার কি সম্পর্ক?’
‘তাহলে সুফিয়াকে স্বীকৃতি দিচ্ছো?’
‘সেই আশার গুড়ে মাটি!’
‘তোমরা যদি স্বীকৃতি না দাও, বউকে সসম্মানে ঘরে তুলে না নাও, তাহলে লোকে বলবে কি?’
শেষের দিকে রেগে উঠতে চেয়েও নিজকে সামলে নেয় অপু। এখন কোনো রকম রাগ দেখালে সব পণ্ড হয়ে যেতে পারে।
‘লোকে কি কম বলেছে? না বলা বন্ধ করেছে? আমাদের বাদ দিয়ে যেভাবে বিয়ে করতে পেরেছিস সেভাবেই ব্যবস্থা করে নে। আমাকে টানছিস কেন?’
‘তোমরা ছাড়া কী করে সম্ভব?’
‘বিয়েটা যেভাবে হয়েছিলো!’
‘তখন তো ভেবেছিলাম মেনে নেবে।’
‘এখন কি মেনে নিয়েছি?’
‘ইচ্ছে করলেই কিন্তু পারো।’
‘সে ইচ্ছে আমার নেই!’
অপু বুঝতে পারে, আসমা বেগম সহজে গলবার পাত্রী নন। তাই সুর পালটিয়ে বলে, ‘সুফিয়াকেও তো মাপ করে দিতে পার।’
‘ওই শয়তানের বাচ্চাটা মাপ চেয়েছে কবে?’
আসমা বেগম এবার সত্যিই রেগে ওঠেন। ‘ওর বাপ-মা তো একদিন এসে বললো না যে, যা হওয়ার হয়েছে, এখন থেকে সব ভুলে গিয়ে মিলেমিশে থাকতে চেষ্টা করবো!’
অপু বুঝতে পারে যে, মা এক বর্ণও ভুল বলেন নি। কিন্তু মানুষের ভেতরকার অহংবোধই কখনো কখনো মানুষকে অনেক কিছু থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। এ ক্ষেত্রে তিনি তাঁর বৃত্ত থেকে সরতে চাইবেন না এক বিন্দু। কিন্তু আশা করবেন অন্যরা তাদের বৃত্ত ভেঙে তাঁর কাছে নতজানু হোক। তিনি ছেলের মা বলেই কি তাঁর অহংকারটা একটু বেশি?
‘তাই বলে তোমার ছেলেকে ফেলে দিতে পারবে?’
আসমা বেগমের রাগ যেন আরেকটু উসকে ওঠে। ‘এমন ছেলে থাকার চাইতে না থাকাটাই অনেক মঙ্গল। বাবা-মায়ের মনে কষ্ট দেওয়ার, সমাজে তাদের মুখ ছোট করার কেউ থাকবে না।’
আসমা বেগমের কথাগুলো তীরের মত হয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে দিচ্ছিলো অপুর হৃদয়কে। কিন্তু সহ্য করতে না পারলেও প্রতিবাদ করার সাহস তার হয় না। তাই নিষ্ঠুর জননীর মন গলানোর সাধনা বাদ দিয়ে অন্য কথা পাড়ে। বলে, ‘মনিরা আপা আমার কথা বলেছে?’
‘বলেছে।’
অপু আগ্রহী হয়ে বলে, ‘কি বললো?’
‘বলেছে, তোকে পেলে জুতিয়ে ঠিক করবে।’
অপুর আগ্রহ সবটুকুই যেন মরে যায়। সে অনুভবের বরফ শীতল পানিতে জমাট হয়ে ভাবে যে, সুফিয়াকে বিয়ে করে কি খুব জঘন্য অপরাধ করে ফেলেছে? এর পরিমাণ কতটুকু হতে পারে? কিছু দিয়ে কি এর পরিমাপ সম্ভব? বেশ কিছুক্ষণ পর নিজকে কিছুটা সহজ করে বলে, ‘দিপুর চাকরি-বাকরির কিছু হলো?’
‘নাহ।’ আসমা বেগমের একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে।
‘চেষ্টা-তদ্বির কিছু করে না?’
‘মনে হয় না!’
‘তাহলে করে কি?’
‘কী আর করবে! সারারাত বাতির তেল পুড়িয়ে বসে বসে কী হাবিজাবি লেখে আর সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়, ওর কাজ-কারবার আমি ঠিক বুঝতে পারি না!’
অপুর মনে হয় মিজান সাহেবের সন্তানদের মাঝে দিপুই মহাসুখে আছে। যার কোনো সমস্যা, ঝুট-ঝামেলা বা কোনো দায়ভার নেই। এমন কি কারো জন্য একটু ভাবনাও নেই। হাতে অফুরন্ত সময় নিয়ে কাটায় আনন্দময় দিবস আর নিশ্চিন্ত ঘুমের রজনী।
তের
দেশের পরিস্থিতি খুবই নাজুক। যে কোনো সময় একটা খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে থাকা স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মানুষের ধারণা দিনকে দিন পাল্টে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছুই করতে পারছে না। তাই ওরা গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ঐক্যজোট। এরই মাঝে দেশ-ব্যাপে হরতাল ডেকেছে বাইশ-দলীয় ঐক্যজোট। দুদিন পরই হরতাল এবং তা সফল করার জন্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নানা তৎপরতা।
দিপুদের মফস্বল এলাকাতেও ঢেউ লেগেছে এসব তৎপরতার। চারদিকে মাইকিং, মিছিল, মিটিং, পোষ্টারিং, দেওয়ালে দেওয়ালে চিকা মারা চলছে সমানে। কোনোকোনো দেওয়ালে লেখা আছে, “এক দফা এক দাবী, এরশাদ তুই কবে যাবি।” কোথাও আবার লেখা হয়েছে “গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক।” কোথাও পুরো দেওয়াল জুড়ে লিখে রেখেছে, “এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে।” আবার কোথাও মন্ত্রের উদ্দীপনায় উদ্ভাসিত হয়ে আছে, “বিপ্লব স্পন্দিত বুকে, মনে হয় আমিই মুজিব।” কথাটা যেই দলের পক্ষেই লেখা হোক না কেন, মনে হয় যেন এক ধরণের শক্তি যোগায়। পড়লে শরীরের সব কটি পশম দাঁড়িয়ে যায়।
হরতাল কর্মসূচি বানচাল করার জন্যে সরকারি তরফ থেকে বিভিন্ন নেতা-উপনেতা, ছাত্র-নেতাদের ধরে ধরে জেলে ঢোকাচ্ছে। সন্দেহজনক লোকজনও বাদ যাচ্ছে না।
দিপুর কাছে এসব হরতাল-টরতাল ভালো লাগে না। বিশেষ করে তার জরুরি কাজগুলোর সময়ই হরতাল, ঘর্মঘট ইত্যাদি আরম্ভ হয়। ফলে, মনেমনে রাজনৈতিক দলগুলোর মুণ্ডপাত করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।
সন্ধ্যার পর নাসিরের জন্য সে অপেক্ষা করছিলো প্রেসক্লাবের সামনে। এমন সময় একটা মশাল মিছিল এগিয়ে আসে বিশাল জনস্রোত নিয়ে। মিছিলকে সব সময়ই এড়িয়ে চলে দিপু। তাই সে পেছনে সরে এসে একটা নিরাপদ জায়গায় দাঁড়ায়। কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই কয়েকটা বোমা ফাটার মত শব্দ হয়। মিছিলের লোকজন হাতের মশাল ফেলে যে যেদিক পারে ছুটতে থাকে। এরই মাঝে গুলির শব্দে চমকে ওঠে সে। সম্ভবত পুলিশ! চোখ ভীষণ জ্বালা করে উঠে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। দুচোখ বেয়ে পানি পড়তে থাকে দরদর করে। তাহলে কি কাঁদুনে গ্যাস? তাও এই রকম একটা মফস্বল অঞ্চলে?
এ ধরণের অভিজ্ঞতা তার জীবনে এইই প্রথম। সে আড়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো কী করবে এখন? এখানে থাকাটা কতটুকু নিরাপদ? এমন সময় গাড়ির হেডলাইটের আলোতে আবছা ভাবে দেখা গেল, একটা ছেলে কি যেন ছুঁড়ে মারছে। সেগুলো দিপুর সামনে এসে বুম বুম শব্দে আগুন ছড়ায়।
এখানে থাকলে প্রাণটাও চলে যেতে পারে। এ কথা মনে হতেই,ঝেড়ে দৌঁড় লাগালো দিপু। পকেটে রুমালও নেই যে, চোখ মুছবে। অন্ধের মত কতক্ষণ ছোটা যায়? অকস্মাৎ কিছু একটাতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায় সে। কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর আগেই দুদিক থেকে দুজন কনস্টেবল জাপটে ধরে তাকে।
তারপর কিল ঘুষি-লাথি মারতে মারতে তাকে নিয়ে তোলে গাড়িতে। সেখানে আরো কয়েকজন তরুণের উপস্থিতি অনুভব করে সে। এখানে সে একা নয় ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু কেউ কথা বললো না বা কিছু জিজ্ঞেস করলো না।
গাড়িটা চলতে আরম্ভ করলে দিপু বুঝতে পারে যে, ওটা থানা হাজতের দিকেই যাচ্ছে। নিজের এমন দুর্দশা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গেছে সে।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থানা হাজতে লোক রাখার জায়গা হচ্ছে না দেখে সব হাজতিকে আরেকটা ট্রাকে তুলে জেল হাজতে নিয়ে রাখা হল। সেখানে গেলেও তাদের খুব একটা সুবিধা হয় না। কিছুক্ষণ পরপর নতুন নতুন লোক আসছিলো। দিপুর মনে হয় এরা কোনো যুবক বা তরুণকে হরতাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাইরে থাকতে দেবে না।
দিপুর জীবনে আরেকটা নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে হাজতবাস। ইতোপূর্বে হাজতে আসার মত কোনো অপরাধ করেনি সে। কিন্তু আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছিলো আসামী হিসেবে। সেবার সালাম মিয়া, মতি আর কাজেম উদ্দিনের পরামর্শে ফৌজদারি আদালতে এক’শ সাত-ধারা মতে একটি মকদ্দমা দায়ের করেছিলেন। দিপুর সঙ্গে আসামী হয়েছিলো সবুর মিয়াও। অবশ্য সেদিনই সেই মকদ্দমা শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এর জন্য দিপু আর সবুর মিয়াকে একটি মুচলেকায় সই দিতে হয়েছিলো কেবল।
দুদিন ধরে জেল হাজতে বাস করতে হচ্ছে দিপুকে। বলতে গেলে পুরোটা সময় বসে থেকেই কাটছে। একটু শুয়ে ঘুমোবার অবস্থা নেই। আর কোনোভাবে ঘুমোবার চেষ্টা করলেও মশার অত্যাচার এবং দুর্গন্ধে টেঁকা মুশকিল। তার অবস্থাটা কেবল একজনই বুঝতে পেরেছে। সে হচ্ছে সুরুজ। বিশিষ্ট ছাত্রনেতা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে তাকেও বেশ কয়েকবার হাজতবাস করতে হয়েছে। একবার ডিটেনশনের আসামী হয়ে তিনমাস জেলও খেটেছে। তার সঙ্গেই বেশ খাতির হয়ে গেছে দিপুর।
সুরুজ দিপুকে দেখে প্রথমেই বলেছিলো, ‘আজকের আগে কখনো সরকারের জামাই হননি, না?’
প্রত্যুত্তরে শুধু মাথা নেড়েছিলো দিপু।
একগাল হেসে সুরুজ বলেছিলো, ‘আমি আপনাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম!’
দিপুর ভীষণ খারাপ লাগছিলো। মানস পর্দায় বারবার ভেসে উঠছিলো বাবা-মা’র চিন্তাক্লিষ্ট মুখ। কিছুক্ষণ পর সুরুজ হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার কী মত?’
‘মানে?’ চমকে উঠে দিপু পাল্টা প্রশ্ন করে।
‘এই যে, স্বৈরাচারী সরকার আমাদের আন্দোলনকে বুটের নিচে পিষতে চাচ্ছে, তাতে কি আদৌ সরকার আর তার চামচারা সফল হবে?’
‘কী করে?’
প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকায় দিপু। কিন্তু সুরুজ কিছু না বললে, সে আবার বলে, ‘সাধারণ মানুষ যখন মাঠে নেমে আসে তখনই তো পরিবর্তনটা ঘটে! আর তখনই সেটার নাম হয়ে যায় বিপ্লব। জনতাই সরকার নিয়ন্ত্রণ করবে। তা না হয়ে যদি সরকারই চায় জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে, তখন তো অবধারিত ভাবে চলে আসে বিপ্লবের কথা। আর ইতিহাসের বিপ্লবগুলোও ঠিক এই পথ ধরেই এগিয়েছিলো।’
‘আমরাও এগিয়ে যাবো। কিন্তু সরকার এটা বোঝে না কেন?’
দিপু হাসে। কিন্তু কিছু বলে না।
সুরুজ বলল, ‘চুপ মেরে আছেন যে?’
‘কী বলবো? কোনো সরকারই তো এই কথাটা বুঝতে চায় না। আপনার দল যদি ক্ষমতায় যায়, তখন আপনারাও চাইবেন খুব লম্বা একটা সময় ক্ষমতায় থাকতে। ক্ষমতার স্বাদ কেউ একবার পেলে, তা আর হারাতে চায় না। আপনি হলে কি করতেন?’
সুরুজ কি বলবে ভেবে পায় না। এ প্রশ্নের যেনতেন জবাব দিলেও সেটা হবে হাস্যকর। তাই সে চুপ থাকাটাই নিরাপদ মনে করে।
সুরুজকে চুপ থাকতে দেখে দিপু আবার বলে, ‘সদ্যজাত বাংলাদেশের দিকে তাকান। কী দেখছেন? সেখানে শাসনের ধরণ পাল্টাচ্ছে। শাসকের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্করণ তৈরি হচ্ছে। অন্যান্য দলগুলো নিজেদের পিঠ বাঁচাতে চলে যাচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ডে। সরকার বিরোধী মন্তব্যেও রক্ষীবাহিনীরা ধরে নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করে। সমাজের সম্মানী লোকদের হেনস্তা করে প্রকাশ্যে। সংবাদপত্র তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে যেয়ে সরকারের কালা-কানুনের শিকার হয়। মন্ত্রী-পরিষদ গঠন করা হয় সরকার প্রধানের আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে। আর তখন থেকেই প্রতিটি সরকার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। বর্তমান সরকার অতীতের সব সরকারের দুর্নীতিকে ম্লান করে দিয়েছে, এই যা পার্থক্য!’
সুরুজ হাসে। তবে দিপুর প্রতি তার সমীহ বরং বাড়েই, কমে না। বলে, ‘সত্যি কথা কি করে বলি! আমাদের দেশের রাজনীতিতে এতটা স্বচ্ছতা নেই যে, বুক ফুলিয়ে সত্যি কথাটা বলতে পারি। আর তা করতে গেলে নিজের জিভেই কামড় পড়বে!’
‘সুতরাং গলাবাজি করছেন নিজেদের স্বার্থে।’ দিপু এবার সরাসরি আক্রমণ করে সুরুজকে।
‘আপনারও মনে থাকার কথা যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুস সাত্তার বায়তুল মোকাররমের মিটিঙে বলেছিলেন, কিভাবে তাঁর কাছ থেকে সামরিকজান্তা ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিলো। একই মিটিঙে একজন নেতা বর্তমান স্বৈরাচারী শাসককে গরুচোর পর্যন্ত বলেছিলেন। অথচ কিছুদিন পর ক্ষমতার টোপ গিলে তিনিই স্বৈরাচার সরকারের মন্ত্রী হয়ে বসেছেন।’
সুরুজ বললো, ‘মিটিঙে আমিও ছিলাম। সাত দলের আরেক নেতা, তিনিও মন্ত্রিত্বের লোভে পড়ে ঐক্যজোট থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে তার কর্মকাণ্ড তো আরেক ইতিহাস!’
‘তাই আমি বলতে চাই যে, আপনারা সবাই ক্ষমতার লোভে রাজপথে লম্ফ-ঝম্প করছেন। স্বার্থ যখন হাসিল হবে না, তখন নিজের দলের পিঠে ছুরি মেরে ভিড়ে যাবেন আরেক দলে!’
‘স্বীকার করার মত বুকের পাটা আমার নেই। তবে আপনাকে যদি দলে পেতাম, তাহলে আমরা আরো কিছুটা শক্তিশালী হয়ে যেতাম সন্দেহ নাই!’
হঠাৎ সশব্দে লোহার ভারি গেট খুলে তিনজন টগবগে তরুণকে ভেতরের দিকে ঠেলে দেয় সেন্ট্রি। নবাগতদের মাঝে নাসিরকে দেখতে পেয়ে অকস্মাৎ খুশি হয়ে ওঠে দিপু। সে সুরুজকে বললো, ‘ওই যে, তিন জনের মাঝে লম্বা-চওড়া মানুষটা হচ্ছে নাসির। সাংবাদিক।’
সুরুজ বললো, ‘আলাপ আছে।’
দিপুর পাশে থেবড়ে বসে নাসির বললো, ‘তোর কপাল খারাপ হলো কখন?’
‘পরশু সন্ধ্যায়।’
নাসির সুরুজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘সুরুজ, আপনি?’
‘একই দিনে।’
‘ব্যাটারা কেন যে আমাদের ধরেছে বুঝলাম না। আপনার না হয় একটা পলিটিক্যাল আইডেন্টিটি আছে। আমরা?’
দিপু বললো, ‘দশ চক্রে ভগবান ভূত!’
পুরো সেলের ভেতর একটা হাসির বন্যা বয়ে যায়।
‘তাহলে আমরা ছাড়া পাচ্ছি কখন?’
‘হরতাল শেষ হলে।’
‘তার মানে আজও হচ্ছে না।’
‘ কেন? আজ নয় কেন?’
‘আজ তো হরতাল চলছেই।’
‘আজই। সন্ধ্যা ছ’টায় আটচল্লিশ ঘণ্টা শেষ হয়ে যাচ্ছে।’
‘আটটা ন’টার দিকেই বেরিয়ে যেতে পারবো।’
দিপুর মনে হচ্ছিলো যে, অনন্ত কাল ধরে সে বন্দি হয়ে আছে এখানে।
তিনদিন হতে চললো, দিপু বাড়ি ফিরছে না। মিজান সাহেব আর আসমা বেগম দুজনেই নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে বাড়ির দাওয়ায় বসে ছিলেন। এক মিনিটের জন্য তাঁরা ঘুমুতে পারেন নি। দিপু কখনো না বলে কোথাও যায় না। কিন্তু এবারই সে কোথাও গিয়ে কোনো কাজে আটকা পড়ে গেছে। কিন্তু আসমা বেগম তা মানতে চাচ্ছেন না।
দিপুর কোনো একটা বিপদ নিশ্চয়ই হয়েছে! কারো কাছে কিছু জিজ্ঞেস করবেন তেমন কাউকেই মনে করতে পারছেন না। লোকজনের কাছে খবর পেয়েছেন, হরতালের কারণে অনেক ধরপাকড় হয়েছে। তাঁর মনে শঙ্কা জাগে যে, দিপু আবার তেমন কোনো পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লো না তো?
দিপুর খারাপ কিছু হলে তাঁরা দুজনেই কেমন যেন হয়ে যান। বিশেষ করে মিজান সাহেব অস্থির হয়ে পড়েন বেশি। এমনিতেই তিনি উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিছু হলেই তাঁর মাথা ঘুরে ওঠে। তখন তাঁকে নিয়েই হয় আরেক বিপদ।
দিপুটা জন্মের পর থেকেই বেড়ে উঠছে ঝুঁকির মধ্য দিয়ে। একবার তিন মাস বয়সে সে নয় দিন অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে ছিলো। স্বামী-স্ত্রী দুজনে পালা করে দিনরাত পাহারা দিয়েছেন ছেলেকে। সেই ছেলে টুকটুক করে আজ জীবনের একটা সময়ে এসে পৌঁছেছে, যেখানে তাঁরা তাকে বেশিক্ষণ কাছে পান না। দিনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে দেয় বাইরে বাইরে। কিছু জিজ্ঞেস করলেও পরিষ্কার করে কিছু বলে না।
তাঁরা বুঝতে পারেন ছেলের মনের কষ্ট। পাশ-টাশ করে বসে আছে অথচ ভালো কিছু একটা হচ্ছে না। তবুও তার বিশ্বাস, একটা কিছু অবশ্যই হবে। দুদিন আগ আর পর। তার বয়সী অন্যদের কিছু কিছু কথা জানেন, যারা নেশা করে করে মরণের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। সেই তুলনায় দিপু এমন কিছু করছে না।
মিজান সাহেব মাঝেমাঝে আসমা বেগমের সঙ্গে মজা করে বলতেন, ‘তোমার ছেলে লেখক হতে চায়। তবে ভালো দিকটা হচ্ছে লেখার নেশা। এই নেশা একবার যাকে পেয়ে বসবে, পৃথিবীর অন্য কোনো নেশায় সে আসক্ত হবে না!’
আসমা বেগম তখন মনেমনে বলতেন, তাহলে এতেই যেন সে বুঁদ হয়ে থাকে। ছেলের কোনো সংবাদ না পেয়ে আসমা বেগমের মনের ভেতর একটা ভয় খুব ধীরেধীরে মাথা তোলে। কিন্তু সেটা কিছুতেই স্বামীকে বলতে পারেন না। সালাম মিয়া লোকটা খুব ভালো নয়। গ্রামের অবস্থাও তেমনি খারাপ। তিনি অশুভ কিছু ভাবতে চান না। তবুও সেটা মনের ভেতর উঁকি-ঝুঁকি মারে।
সবুর মিয়া দিপুর এ খবর পেয়ে মিজান সাহেবকে পরামর্শ দেয় যে, সালাম মিয়া আর কাজেম মিলে দিপুকে কোথাও আটকে রেখেছে। হয়তো মেরে গুম-টুমও করে ফেলতে পারে। তাই সময় থাকতে থানায় একটা জিডি করে রাখা ভালো।
কিন্তু আসমা বেগম সবুরের কথায় সায় দিতে পারেন না। তাঁর মন বলে, এত খারাপ কিছু ঘটবে না। দিপুর একটা গুণ তাঁরা ভালো করেই জানেন যে, ঘটনার আগেই দিপু তার কিছুটা আঁচ করতে পারে। আর এমন একটা ভয়াবহ ব্যাপার ঘটে যাবে দিপু এ সম্পর্কে তাঁদের কোনো ইঙ্গিত করবে না, এমনটা তো হতেই পারে না!
সবুর মিয়া তার ধারণার কথা দুজনকেই পইপই করে বোঝাতে চায়। কিন্তু তাঁদের কারো কাছে সমর্থন পায় না।
রাত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে মিজান সাহেব আর আসমা বেগমের মনে সবুর মিয়ার ধারণাটা বদ্ধমূল হওয়ার জন্য তোড়জোড় আরম্ভ করে দেয়। দুজনেই বসে বসে চোখের পানিতে বুক ভাসান। এভাবে কেঁদে কেঁদে তাঁদের মনে দিপুর অন্তর্ধানের ব্যাপারটা সবুরের ধারণার সঙ্গে মিলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়, ঠিক তখনই ভেসে আসে দিপুর ভরাট কণ্ঠস্বর। ‘মা!’
দুজনেই চমকে তাকান পরস্পরের দিকে এবং একই সঙ্গে উঠোনে নেমে আসেন উদভ্রান্তের মত।
চৌদ্দ
গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই কেন জানি অপুর মনে হচ্ছিলো যে, মা-বাবা, ভাই-বোন কারো কাছেই তার কোনো রকম গুরুত্ব নেই। কেমন যেন পরপর হয়ে গেছে সবাই। মনে হয় অনেক অনেক দূরের মানুষ। এমন কি বাচ্চুর ছেলে-মেয়েগুলোও যেন তাকে নিয়ে আড়ালে হাসাহাসি করে।
কারো মনে আজ তার স্থান নেই। সেখান থেকে সে নির্বাসিত। সুফিয়াকে বিয়ে করে সে কী এমন অন্যায়টা করে ফেলেছে যে, তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে সবার মন থেকে? যে জননী তাকে সবার থেকে ভিন্ন চোখে দেখতেন। সবার ছোট বলে আদর করে তাকে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ দিয়েছেন। সেই মা আজ কত দূরের মানুষ হয়ে গেছেন! আপন গর্ভজাত সন্তানের জন্যে কোনো টান অনুভব করেন না। মানুষ যে কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে আর কত সহজে ছিঁড়ে ফেলতে পারে রক্তের সম্পর্ক, সেটা সে নিজের জীবনেই অনুধাবন করতে পারছে।
ইদানীং শফি আর লুবনাও তাকে ভালো চোখে দেখছে না। ভান করছে তার সম্পর্কে কিছুই জানে না। অপু ভাবে, কেবল একটি মেয়ের কারণেই কি এত কিছু? দিনরাত ভেবেও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না সে। বিশেষ করে মা আসমা বেগমের অনমনীয় মনোভাব তাকে আরো বেশি দুর্বল করে দিয়েছে। মনের এ টানা পোড়েনে, দিনদিন অসহ্য মনোবেদনার দহনে নিঃশেষ হতে হতে সে নিজকে ঠেলে দিচ্ছিলো আসন্ন ধ্বংসের মুখে। জীবনের বিশোষিত বিষের যন্ত্রণায় সে হয়ে পড়ছিলো কোণঠাসা।
এমন একটি ধিক্কৃত আর অর্থহীন জীবনের গ্লানি কী করে সে বয়ে বেড়াবে? এ থেকে মুক্তির একটাই মাত্র পথ খোলা আছে। আর তা হচ্ছে নিজকে শেষ করে দেওয়া। পৃথিবীর সব দেনা-পাওনা মিটিয়ে দিয়ে নিজকে মিশিয়ে দেবে পঞ্চভূতে। আর তাই সে সুফিয়ার সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে তৈরি হচ্ছিলো খুব ধীরেধীরে।
দুটো পরিচিত ওষুধের দোকান থেকে প্রতিদিন দুটো করে চারটা সিডাক্সিন কিনে অফিসে তার ড্রয়ারে একটা কৌটায় জমাতে আরম্ভ করে। আর এও ঠিক করে রাখে যে, ট্যাবলেট জমতে জমতে কৌটাটা যেদিন পূর্ণ হয়ে যাবে, কোনো ভালো হোটেলে গিয়ে উঠবে। সারা রাত ইচ্ছে মত স্ফূর্তি করে, ভোর হওয়ার কিছুক্ষণ আগে সবগুলো ট্যাবলেট একসাথে গুঁড়ো করে একটা গ্লাসে পানিতে গুলিয়ে ঘন সাবুর মত গিলে ফেলবে।
ওষুধের তীব্রতার কারণে কেউ টের পাওয়ার আগেই চুকে যাবে জীবনের ল্যাঠা। মরণটাও হবে একেবারে রাজকীয়। কম করে হলেও দেশের প্রথম শ্রেণীর দৈনিকগুলোর প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ হবে। ঠিকানা ভুল দেওয়ার ফলে, হোটেল কর্তৃপক্ষ তার লাশটাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে পারবে না। এক সময় সেই লাশ বেওয়ারিশ হয়ে চলে যাবে হাসপাতালের মর্গে।
তারপর এ হাত ও হাত করে কোনো একটি পত্রিকা পৌঁছে যাবে আসমা বেগম আর মিজান সাহেবের হাতে। দুজনেই খবরটা পড়ে আশ্বস্ত হবেন এই ভেবে যে, কুলাঙ্গারটা আর পৃথিবীতে নেই। বিপর্যস্ত হয়ে ছেড়ে গেছে পৃথিবীর যাবতীয় অধিকার! তখন কি ওঁরা কাঁদবেন? ভাবে অপু। হয়ত কাঁদবেন। তবে,দুঃখে হয়তো নয়, স্বস্তিতে! কারণ, এমন ছেলের কোনো প্রয়োজন ছিলো না তাঁদের।
পরিকল্পনা মত একদিন গোপন জায়গায় লুকোনো কৌটোটার ধারণ ক্ষমতা কমে আসে। ফার্মেসির দুজনেই দেখছে যে, অপু প্রতিদিন চারটা করে সিডাক্সিন ট্যাবলেট খাচ্ছে। আর ওষুধের প্রভাবে দিনদিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার স্বাস্থ্য। তাকে তারা ভালোবাসে বলেই সিদ্ধান্ত নেয় যে,কেউ তাকে আর একটাও সিডাক্সিন দেবে না।
ফার্মেসি থেকে ব্যর্থ হয়ে এলেও অপু মন খারাপ করে না। তার কাজ হয়ে গেছে। ছুটির পর অফিসের ড্রয়ার খুলে ওষুধের কৌটাটা পকেটে করে ঘরে নিয়ে আসে। অনেক রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে কৌটার মুখ খুলে বিছানার উপর উপুড় করে ধরে। তারপর এক এক করে গুণে দেখে যে, মোট এক’শ চব্বিশটা ট্যাবলেট। একটা মানুষ মরার জন্য এর অর্ধেকও প্রয়োজন নেই। সেই তুলনায় এক’শ চব্বিশ বিশাল একটা সংখ্যা।
অন্ধকারে শুয়ে তার মনে পড়ে সুফিয়ার কথা। সুফিয়ার দিকে তাকালে তার মনটা কেমন যেন পাখির পালকের মত নরম আর ফুরফুরে হয়ে আসতো। মনে হতো, সুফিয়া আছে বলেই সে জীবনের সব প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে স্বল্প শিক্ষিত হয়েও চাকরি নামক একটা সোনার হরিণ আয়ত্ত করতে পেরেছিলো। কিন্তু তার চারপাশের মানুষগুলো তাদের মনের ক্লেদাক্ত রক্ষণশীলতার প্রাচীর ডিঙাতে পারলো না বলে, তাকেও পৃথিবীতে স্বাভাবিক ভাবে বাস করতে দিলো না। আচ্ছা, সে মারা গেলে কি সুফিয়া খুব কষ্ট পাবে? নাকি কয়েকটা দিন কেঁদে-কেটে নতুন করে আবার জীবন শুরু করবে?
আসলে জীবনটা এমনই হওয়া উচিত! একটা মৃত মানুষের জন্য মেয়েদের সারাজীবন বিধবা হয়ে কাটিয়ে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। ঝড়ে ঘর ভেঙে যায়। বন্যায় জমির ফসল তলিয়ে যায়। আগুনে সর্বস্ব পুড়ে গিয়ে ছাই হয়ে যায়। তাই বলে কি মানুষ নতুন করে ঘর তোলে না? নতুন করে জমিতে ফসল ফলায় না? আবার শূন্য থেকে জীবন শুরু করে না? তাহলে সুফিয়া কেন নিজকে নষ্ট করবে? তারও উচিত হবে নতুন করে জীবনটা আরম্ভ করা। কারণ, মানুষের জীবনে বেশ কয়েকবারই ভালোবাসা-প্রেম আসতে পারে। আর তা ফিরিয়ে দেওয়াটা নিঃসন্দেহে বোকামি ছাড়া আর কিছু না।
সুফিয়ার জন্য ভীষণ মায়া হতে লাগলো অপুর। বেচারি জানে না তার জন্য কী ভয়াবহ এক দুঃসংবাদ অপেক্ষা করছে। এখনো হয়তো সে স্বপ্নের ঘোরে আছে। যে স্বপ্ন এতদিন আবর্তিত ছিলো তাকে ঘিরেই। অথচ সে সব লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যাবে আর একটা দিন পরেই।
বেতন পেয়ে পরদিন গোপন জায়গা থেকে ট্যাবলেটের কৌটাটা বের করে কোটের পকেটে রাখে অপু। জামা-জুতো পরে গায়ে পারফিউম স্প্রে করে কোট গায়ে চড়ায়। নাস্তার টেবিলে তখনো শফি আর লুবনা বসে। শফি খবরের কাগজে নাক গুঁজে আছে। লুবনা চায়ে চুমুক দিতে দিতে পা দোলাচ্ছিলো।
অপু বেরিয়ে এসে তাদের উদ্দেশ্যে বলে, আজ আর ফিরবো না।’
শফি চশমার ওপর দিয়ে দৃষ্টি মেলে বললো, ‘ঢাকার বাইরে যাচ্ছিস?’
‘অনেকটা সে রকমই।’
‘কোথায়?’
‘এখনো ঠিক হয়নি।’
লুবনা বললো, ‘নাস্তা করে যা!’
‘সময় নেই ভাবি!’
‘আমি হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি!’
ভ্রূ নাচিয়ে বলে লুবনা।
ইঙ্গিত বুঝতে পারলেও চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে আসে অপু।
মোড়ের দোকান থেকে এক প্যাকেট বেনসন আর একটা ম্যাচ কিনে একটা সিগারেট ধরায়। প্রথমে কাশির দমকে সিগারেটটা ফেলে দিতে হয়। মুখের ভেতরটা কেমন তেতো হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ হাঁটার পর আরেকটা সিগারেট ধরায়। এবার তেমন খারাপ লাগছে না। কাল থেকে যে একটা অস্থিরতা আর নার্ভাসনেস তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, সেটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে। সে বুঝতে পারে যে, মানুষ বিনা কারণেই সিগারেট বা মদে আসক্ত হয় না।
অফিসে ঢুকে নিজের চেয়ারে বসে সে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে গলগল করে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছাড়ে। এই সেকশনের সবাই সিগারেটে আসক্ত। একমাত্র অপুই আলাদা ছিলো। সে আড় চোখে সহকর্মীদের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে।
তারপর উঠে গিয়ে টেলিফোন গাইড দেখে গুলশানের একটা অভিজাত গেস্ট-হাউসের ঠিকানায় ফোন করে। ম্যানেজারের সাথে কথা বলে, নিরিবিলি একটা রুম বুক করায়। ফিরে এসে আবার নিজের জায়গায় বসে। কায়দা করে সিগারেট টানে। শূন্যে মুখ ভর্তি ধোঁয়া ছেড়ে শিল্পচর্চা করে।
অপুর সিগারেটে আসক্তি নেই। এ কথা সবাই জানে। এমন কি এমডি সাহেবও তাকে এ জন্যে বিশেষ স্নেহ করেন। অথচ সহকর্মীরা তার হাতেই কিনা দেখতে পাচ্ছে জ্বলন্ত সিগারেট। সবাই অবাক হয়ে দেখছিলো। শেষঅব্দি একজন বলেই ফেললো, ‘কী অপূর্ব অপু সাহেবের কাজ! দিনে তারা দেখছি না তো?’
‘হতে পারে!’ অপু হাসে।
তারপর আবার বলে, ‘কেউ কেউ শখ করেও দিনে তারা দেখতে পছন্দ করে!’
‘তাহলে ভালো মুডেই আছেন!’ আরেকজন টিপ্পনী কাটার ভঙ্গিতে বলে।
অপু কিছু বলে না। কাজে মন বসাতে পারছে না। অবশ্য খুব জরুরি কোনো কাজ তার হাতে নেইও। তাই ঢিলে-ঢালা ভাবে কাজ করছিলো।
লাঞ্চ আওয়ারের ঠিক আগেই সুফিয়া ফোন করে অফিসে। জানায়, ‘ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। এই মাত্র ফিরেছি!’
‘কেন হঠাৎ করে আজ, খারাপ কিছু?’
‘না। দারুণ একটা খবর আছে! চারটায় ক্রিসেন্টলেক ব্রিজটার কাছে চলে আসবে!’
‘খবরটা কি?’
প্রবল আগ্রহে জিজ্ঞেস করে অপু।
‘চারটায়, ক্রিসেন্টলেক!’
লাইন কেটে দেয় সুফিয়া।
অপু ভাবে, আজই তো শেষ দিন। খবর জেনে কী আর হবে? চারটার আগেই অফিস থেকে বেরিয়ে আসে সে। সুফিয়ার কথা মত জিয়ার মাজারে যাওয়ার জন্য তৈরি করা ভাসমান ব্রিজটার উপর গিয়ে রেলিঙে বসে থাকে। কিন্তু এভাবে বসে থাকতে তার ভালো লাগছিলো না। মনের ভেতর অসহ্য একটা দাপানি। তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে সমস্ত জগত। সিগারেটের ধোঁয়া বিষের মত মনে হয়।
শীতকাল বলে দিনের পরিধি ছোট। বেলা চারটার আগে থেকেই কমতে থাকে সূর্যের তেজ। লেকের উত্তর পাশে ছোট-খাট একটা জটলা তার চোখে পড়ে। কয়েকজন উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ে প্রবল
আগ্রহে কিছু একটা দেখছে। সে এগিয়ে যায় আরো খানিকটা।
ভিড়ের মাঝখানে ঝাঁকড়া চুলঅলা, দীর্ঘ শশ্রূমণ্ডিত এক বৃদ্ধ মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন। হাতে একতারা। তাঁর চার পাশের ছেলে-মেয়েরা কিছু একটার জন্য তাঁকে অনুরোধ করছে। অপু অনুমান করার আগেই বৃদ্ধ গান ধরলেন। চড়া অথচ ভরাট কণ্ঠ।
“সকাল বেলা গড়লে যারে
ভাঙলে বিকেল বেলা;
আমি তো বুঝি না বিধি
কেমন তোমার খেলা।…
কত যে আগুনে পুড়ে
হয়েছিলাম খাঁটি;
কত না যাতনা সয়ে
হয়েছিলাম মাটি।…
সেই মাটি লয়ে আবার
করছ তুমি খেলা।
আমি তো বুঝি না বিধি
কেমন তোমার খেলা।…
একবার যারে গড়লে তুমি
ভেঙে গড়লে তারে
ভাঙন-গড়ন একটা মানুষ
কত সইতে পারে?…
যেই খেলাতে ডুবে গেল
আমার আশার ভেলা।
থামাও এবার দারুণ বিধি
তোমার নিঠুর খেলা…।”
যৌবন আর তারুণ্যের উদ্দীপনায় দলটা সুরের মূর্ছনায় শরীর দোলাচ্ছিলো মহানন্দে। কিন্তু তাদের অদূরে বসে থাকা অপুর মরমে গিয়ে আঘাত করে গানের বাণী। তার মনে হচ্ছিলো যে, গানের বাণী বুঝি তার কথা ভেবেই রচিত হয়েছে। কেমন মিলে যাচ্ছে তার জীবনের সঙ্গে! শুনতে ভালো লাগছিলো খুব। কিন্তু সেই ভালোলাগা যে কখন অশ্রু হয়ে গড়াতে আরম্ভ করেছিলো টের পায়নি। হঠাৎ পিঠের উপর মৃদু চাপ পড়তেই সম্বিত ফিরে পায়। আর মুখের উপর ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা ভাব টের পেতেই হাত দিয়ে ডলে। এ যে পানি! তারই চোখের ধারা। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে সে ঘাড় ফেরায়।
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে সুফিয়া।
‘কখন এলে?’
‘ঘড়ি দেখ।’
‘সাড়ে চারটা।’
‘দশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। গান শুনছিলে দেখে ডিস্টার্ব করিনি।’
অপু জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে সে মুগ্ধ হতে গিয়েও পারে না। বুকটা কেমন যেন হাহাকার করে ওঠে। সুফিয়ার সাজ-সজ্জা আর চেহারার ঔজ্জ্বল্যর সঙ্গে মিশে থাকা কমনীয়তা যেন তাকে আরো মোহিনীয় করে তুলেছে। এর পেছনে কোনো মানসিক প্রভাব কাজ করছে কিনা তা নিয়ে ভাবে না অপু। তার কেবলই মনে হচ্ছিলো যে, আগামীকাল থেকেই সুফিয়ার নামটা উঠে যাবে বিধবাদের তালিকায়।
কিন্তু পরক্ষণেই মনকে শক্ত করে ভাবে, তাতে কি? মেয়ে মানুষ! খুব সহজেই দুঃখটা সামলে উঠতে পারবে।
তারপর পকেটে হাত দিয়ে কৌটার স্পর্শ নিয়ে বললো, ‘কি খাবে?’
বাচ্চা মেয়েদের মত উচ্ছল হয়ে ওঠে সুফিয়া। বলে, ‘ফুচকা!’
সুফিয়ার এ উচ্ছ্বাস অপুকে আরো দুর্বল করে দেয়। এমন একটা সরল-প্রাণ মেয়েকে কী করে সে ভাসিয়ে দেবে অনন্ত দুঃখের সাগরে? ও তো জানে না, আগামীকাল কী ভয়ানক একটা সংবাদ গিয়ে হাজির হচ্ছে তার কাছে!
না। এসব ভাবনা আর নয়। ভেতরে ভেতরে গা ঝাড়া দিয়ে শক্ত হয় অপু।
সুফিয়ার একটা হাত ধরে চটপটির দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে, ‘কী এমন দারুণ খবর শোনাবে, বললে না?’
‘এখনই বলতে হবে?’ বলে, ড্যাব-ড্যাবে দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সুফিয়া।
‘হ্যাঁ, এখনি! গো ধরে অপু।’
সুফিয়া হাসিহাসি মুখ করে হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একবার নিচু করে। আঁচলের প্রান্ত তুলে হাতের আঙ্গুলে জড়ায়। তারপর সেটা খুলে গায়ে ভালোমতো জড়িয়ে নিতে নিতে বলে, ‘বিয়ে করে সংসার পাতার পর স্ত্রীর কাছে স্বামীর দ্বিতীয় প্রত্যাশা যা থাকে।’
‘মানে?’
অপু কথাটার গভীরে যায় না। যে কারণে বুঝতেও পারে না।
‘বুঝতে পারছো না কি বলতে চাচ্ছি?’
অপু মাথা নাড়ে।
‘মানে হচ্ছে সন্তান!’
‘সন্তান? কার সন্তান?’
‘বলদ!’ বলে হেসে ফেলে সুফিয়া। সেই সঙ্গে তার মুখটাও আরক্ত হয়ে ওঠে।
অপুর মাথায় যেন কিছুই ঢোকে না। কেমন নির্বোধের মত তাকিয়ে থাকে।
সুফিয়া বিরক্ত হয়ে বলে, ‘কিচ্ছু বোঝে না! মাথা ভর্তি কেবল গোবর!’ শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে ফিসফিস করে বলেই ফেলে, ‘তুমি বাবা হবে!’
‘অ্যাঁ?’ বিস্ময়ের ধাক্কায় প্রথমে যেন বোবা হয়ে যায় অপু।
তারপর হঠাৎ খুশিতে বাগবাগ হয়ে বললো, ‘বলো কি!’
তার ইচ্ছে হয় সুফিয়াকে কোলে নিয়ে উড়ে যেতে। ইচ্ছে হয় অক্টোপাসের শক্তিতে জড়িয়ে ধরে দশমীতে দুর্গার সামনে ধুলো-খেলার মত মাটিতে গড়াগড়ি খেতে।
‘এই সরো!’ ধাক্কা দিয়ে অপুকে মাটিতে ফেলে দেয় সুফিয়া।
আকস্মিক আনন্দে স্থান-কাল ভুলে গিয়ে সুফিয়াকে জড়িয়ে ধরেছিলো অপু। ঘটনাটা লক্ষ্য করে কয়েকটা দুষ্টু ছেলে একসঙ্গে হাত তালি দিয়ে ওঠে। তাদেরই কেউ আরেকটু আগ বাড়িয়ে মুখে দু-আঙুল পুরে সিটি বাজায়। কিন্তু এসবের কিছুই পাত্তা দেয় না অপু।
তুমি বাবা হবে!
তিনটি শব্দ!
মাত্র তিন শব্দে সৃষ্ট একটি বাক্য কর্ণগোচর হতেই কেমন মুহূর্তে বদলে যায় অপুর পৃথিবী। মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষে কোষে কেবল একটিই ধ্বনি। আর সেই ধ্বনির অনুরণনে তার একমাস ধরে শানানো পরিকল্পনা এলোমেলো হয়ে যায়। অন্তর্গত বেদনা আর হতাশার গগনচুম্বী ইমারত যেন ভেঙে পড়ে ঝুরঝুর করে। সেই সঙ্গে একাকার হয়ে যায় তার অতীত আর ভবিষ্যৎ। তার সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে কেবল বর্তমানটাই। সে ভুলে যায় তার যাবতীয় কষ্টের কথা। এমন কি কোটের পকেটে রাখা এক’শ চব্বিশটা সিডাক্সিনের কথাও। যেগুলো এখন নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে কৌটার ভেতর।
*****
9 Responses to উপন্যাস: বিপর্যস্ত বিপর্যয়
You must be logged in to post a comment Login