কুলদা রায়

একটি উৎসবের গল্প

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কথা :: রোচি লিখেছে, দিদিমা তোমাদের খুব মিস করে। সারাদিন চুপ করে কাজ করে। আর একলা অবসরে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কোন প্লেনের শব্দ হলে বারান্দা থেকে ছোট্ট বিনতু দৌড়ে বের হয়। বলে, অই যে পূর্বা দিদি যায়। প্রজ্ঞা দিদি যায়। মা জানে তার ছেলেও যায়। কেন যায়?
এসব গল্প থাক। একটি উৎসবের কথা বলি। এই উৎসবে আমার ভাইবোন মা সবাই আছে। সবাই থাকে। তাহলে দুঃখ বাদ। উৎসবের কথাই না হয় হোক।

গোফাগুন
………………………………….
কুলদা রায়

মাকে বলব না। কাউকে বলব না। বলা যাবে না।

সকাল থেকেই রোদ উঠেছে। ফুল ফুটেছে। হাতি নাচছে। ঘোড়া নাচছে। আজ অন্য কিছু হবে। ভিন্নতর কিছু হবে।
যে লোকটিকে চিনি তাকে তো চিনিই না। দাদা বলল, চল না, চল না যাই।
দাদা বলছে যাবে। দাদা কিন্তু যাবে না। অথচ যেতে চায়। অধীর হয়ে বলছে, চল না যাই।

লোকটার একদম কাছেই চলে গেলাম। কাঠগোলার ভিতের বসে আছে হাতল ভাঙা চেয়ারে। মাথাটা একটু হেলানো। নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে শব্দ হচ্ছে। ভেবেছিলাম ভয় পাব। পাওয়ারই তো কথা। কিন্তু পেলাম না। দূর থেকে দাদা হাত ইশারা করে বলছে, চলে আয়। ওর কাছে যাসনি। চলে আয়।
ভেবেছিলাম চলে যাব। ফিরে যাব। দাদার হাত ধরে ফিরে যাব। অথচ লোকটার সামনে গিয়ে হাট করে দাঁড়ালাম। হাসি হাসি মুখ।
লোকটা চোখ বন্ধ রেখেই বলল, পেছনে যা। পেছনে চেয়ারে মাথাটা হেলানো। মাঝখানে পাতলা হয়েছে চুল। বলল, চুলকে দে।
চুলকে দিতে দিতে আঙুলের মাথায় উঠে এল খুশকী। আর বেতো তেলের গন্ধ। বলল, অইখানে যা।
-কোথায়?
-অইখানে। চোখ বন্ধই আছে। হাত তুলে দেখাল। স্তরে স্তরে কাঠ সাজানো। তার উপরে একটি কুলুঙ্গি। সেখানে একটি ময়ুরের পালক।

মনে করেছিলাম পারব না। কিন্তু না পেরেতো উপায় নেই। পারতেই হবে। দূর থেকে দাদা হাত নেড়ে নেড়ে বলছে, উঠিস না। উঠিস না। না উঠে পারি? ময়ুরের পালকটা তুলে দাদাকে দেখালাম। নীল আর কালো। মাঝখানে কৃষ্ণের চিহ্ন। দাদা ভয়ে আতংকে হাত জোরে জোরে নাড়িয়ে বলছে, খুব সাবধান। খুব সাবধানে নেমে আয়।
হা হা হা। কত সাবধান আর হওয়া যায়। পাটা হড়কে গেল। পায়ের নীচ থেকে কয়েকটি কাঠ সরে গেছে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল কাঠের স্তুপ। কাঠের সঙ্গে আমি নিজেও। দাদা দৌঁড়ে আসতে চেয়েছে। লোকটা হাত তুলে বলেছে, না। ঠিক চোখ বন্ধ করেই আছে। হাটু ছড়ে গেছে। এক টুকরো কাঠের চেরা হাতের মাংসে ঢুকে গেছে। মাথার পিছনটা ফুলে উঠেছে।
হাত থেকে পালকটা নিয়ে নাকে সুড়সুড়ি নিতে লাগল লোকটা। সুড়সুড়ি লাগছে। পুলকে একটু হেসেও উঠছে। চোখ কিন্তু বন্ধ। হাত তুলে এলোমেলো কাঠগুলো দেখাল।

আমরা দুভাই মিলে কাঠগুলো সাজাচ্ছি। হাতে পায়ে মাথায় ব্যথা করছে। তবু বলছি, সত্যি দাদা। আমার ব্যথা লাগেনি। সত্যি লাগেনি। মা ঘাস বেটে লাগিয়ে দিলেই হবে। দাদার চোখ জ্বলছে। সত্যি সত্যি ব্যথা লাগতে পারে না।

কাঠ গোলার পিছনে একটি পুকুর। পাড়ে গোটা কয়েক তালগাছ। তাল পেকেছে। অমৌসুমী তাল। জলে পড়ার শব্দ হলে দাদা বলে, আবার পড়েছে। শুনতে পেলি। ছোট বোনটি বলে- কী পড়েছে রে দাদা?
মা বলে, ঘুমো। ঘুমোতো তোরা। সকালে অনেক কাজ।
আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কি কাজ আছে আমাদের। ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন দেখি, পুকুর ভরা তাল ভাসছে। আমি আর দাদা সব চেয়ে পাকা মিষ্টি আর বড় তালদুটো তুলে আনছি। মা ভাজছে তালের পিঠে।

লোকটি হাত তুলে পুকুরটি দেখাল।
পুকুরে জল টলটল করছে। খাড়া পাড়। অনেক গভীর। তাল ভাসছে। দাদা বলল, যাসনি। তুই যাসনি।
আমি যাব। না যেয়ে পারি? যেতেই তো এখানে এসেছি।
কাঠগুলো সাজিয়ে রাখছে দাদা। আর মাথা নাড়ছে। আমি নেমে যাচ্ছি খাড়া পাড় বেয়ে। পাড় থেকে জলে। জলের গভীরে। তালগুলো ভেসে আছে। মিষ্টি। পাকা। আর বড়। মা পিঠে বানাবে।

জল লেগে পা জ্বলছে। হাত জ্বলছে। সাঁতরে সাঁতরে তালগুলো পাড়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। লোকটি চোখ বুজে আছে। আর হাত দিয়ে দেখিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে- অইটে। আরও অইটে।
বুক ভারী হয়ে যাচ্ছে। ঘন ঘন পড়ছে শ্বাস। পায়ের সঙ্গে জড়িয়ে পেঁচিয়ে গেছে পদ্মফুলের ডাঁটা। ছাড়াতে পারছি না। ডুবে যাচ্ছি নিচের দিকে। তলিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের মধ্যে। হারিয়ে যাচ্ছি মহাশূন্যের ভিতরে।

……………………………………………………………………………….
ছোট বোনটি দৌড়ে এল। তালদুটো লুফে নেওয়ার কথা। একটুও তাকালও না। ভয়ে টলটলে মুখটি শুকিয়ে গেছে। বলল, দাদা, মাকে খুঁজে পাচ্ছি না। মা কোথায়?
দাদার প্যান্ট থেকে তখনো টপটপ করে জল পড়ছে। চুল ভিজে। বলল, কেন কি হয়েছে মায়ের?
-মাতো ছিলই সকাল থেকে। এখন খুঁজে পাচ্ছি না। দাদা, কি হবে?

বড় ঠাকুরমার রান্নাঘরে তখন পায়েস রান্না হচ্ছে। কাঁচা মুছি পাটালির গন্ধ। গরু দুটোকে সুন্দর করে স্নান করানো হয়ছে। গলায় ঝোলানো হয়েছে শেফালি ফুলের মালা। বড় ঠাকুরমার গলায় সোনার বিছে হার। কপালের অনেক চুল সাদা হয়ে এসেছে।
গরুটার কপালে তেল সিঁদুর পরানো হল। বাছুরটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। আজ বড় আনন্দের দিন।
রান্না ঘর থেকে লাল পেড়ে শাড়ি পরে কে একজন বৌমানুষ পায়েসের হাড়িটা ধরে নিয়ে এল। গোবর লেপা গোয়াল ঘরে কলা পাতা বিছানো হয়েছে। কলাপাতায় পায়েস ঢেলে দিল। ঠাকুরমা উলুধ্বনি দিল।
জ্বেলে দিল দুইটি প্রদীপ। সুগন্ধী ধুপ। বেজে উঠল শাঁখ।
দাদা বলল, পায়েস। পায়েস রে।
ছোট বোনটি খিন খিন করে বলছে, মা কোথায়, দাদা?

বড় ঠাকুরমা মাটিতে পড়ে প্রণাম করছে। বিড় বিড় করে বলছে, হে গোমাতা, তুমি কল্পতরু। কামধেনু। জগন্মাতা। আজ এই ফাগুনের দিনে তোমাকে উৎসর্গ করছি শ্রেষ্ঠ অন্ন। তুমি গ্রহণ করো মা। আমাদের ধন্য করো হে জননী।

আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি সারা উঠোন ভরে আমাদের মাকে। খুঁজছি ঘরে। বাইরে। বাগানে। ঘাটে। পথে। সবখানে। বাছুরটি পায়েসে মুখ দিয়েই লাফিয়ে উঠল। দৌড়ে গেল উঠোনের এক কোণে। ওখানে একটি মরিচবাটি ফুলগাছ । তার কচি পাতা মুখে পুরে দিল।
আর মা গরুটি পায়েস নয়- কলাপাতিটি মহা আনন্দে খেতে খেতে ডাক দিল- হাম্বা।

বড় ঠাকুরমা কলাপাতাসমেত পায়েসটুকু নিয়ে বাছুরটির পিছনে পিছনে ছুটছে। মুখের সামনে ধরছে। বলছে, খাও দেবতা। বিমুখ করো না। খেয়ে নাও। বাছুরটি লাফিয়ে লাফিয়ে দৌঁড়ে দৌঁড়ে ছুটে ছুটে উঠোনময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। একপাশে জেগে উঠেছে একটি সফেদা গাছ। তার ডালটির পাতা চিবুতে লাগল। তার কানে মুখে চোখের পাতায় লেগেছে নতুন ধানের নতুন গুড়ের সুপক্ক পায়েস। এই অতি সুস্বাদু পায়েস বড় ঠাকুরমা ওর গায়ে পিঠে মাখিয়ে দিল । সবাই হৈ হৈ করে উঠেছে। বলছে, জয়- গোফাগুনের জয়।
বৌ মানুষটি গরুটির প্রসাদ করে দেওয়া পায়েস কলাপাতা থেকে অনেক যত্নে তুলে নিয়েছে একটি থালায়। গভীর মায়ায় দাঁড়াল উঠোনের মাঝখানে। এইখানে জড়ো হয়েছে কয়েকটি শিশু, বালক বালিকা এবং কিশোর ও কিশোরী। সবাই হাত পেতে নিল। ছোট বোনটির হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে অনেকটাই পড়ে গেছে মাটিতে। কান্না কান্না গলায় শুধু বলে উঠল, মা।

তার মাথার আঁচল খুলে গেল। যত্ন করে আচড়ানো চুল। সিঁথিতে সিঁদুর। বড় বড় করে তাকাল আমাদের দিকে। গভীর চোখ। জ্যোৎস্নার চেয়ে সুন্দর। স্নেহময়। সজল। সঘন।

এই আমাদের মা।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to একটি উৎসবের গল্প

You must be logged in to post a comment Login