শৈলী বাহক

এ মাসের ব্যক্তিত্ব: বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ”

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ফরিদপুর৷ প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক জনপদ৷ ফরায়েজী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজী শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতিধন্য ফরিদপুর৷ নারিকেলবাড়িয়ায় তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা ইংরেজ কর্নেলের কামানের গোলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেলে ফরিদপুরে নতুন করে গড়ে ওঠে স্বাধীকার আন্দোলন৷ তবে একটু ভিন্নমাত্রায়, আরব মুলুক থেকে হজ্ব সেরে শরীয়ত উল্লাহ নামের এক ভদ্রলোক সরাসরি যুদ্ধ বিগ্রহে না গিয়ে তিনি এ এলাকার মুসলমানদেরকে ঈমান আকিদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ করতে লাগলেন৷ এই করে ফরিদপুরের মানুষেরা আস্তে আস্তে এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলে৷ ইতিহাসে এই আন্দোলনই ফরায়েজী আন্দোলন নামে খ্যাত৷ ফরায়েজী আন্দোলনের কল্যাণেই ফরিদপুরের মানুষেরা স্বাধীনতার প্রশ্নে একটু বেশি সচেতন আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেমন, ইমাম, মৌলভি, সূফি, দরবেশ তাঁরা একটু বেশি সম্মান পান৷
ফরিদপুরের এক পল্লীর তেমনি এক সম্মানিত ব্যক্তি মুন্সি মেহেদী হোসেন৷ ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে তাঁর বসতি৷ তিনি এই গায়ের মসজিদের ইমাম৷ ফজরের নামাজের ইমামতি সেরে কিছুক্ষণ মসজিদে বসে দুরুদ পড়ে আকাশ ফর্সা হয়ে এলে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে আপনমনে গায়ের পথ ধরে হাঁটছেন আর ভাবছেন নিজের ভূত ভবিষ্যত্‍ নিয়ে৷ গায়ের মসজিদের ইমাম হিসেবে তিনি এ এলাকায় যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার পাত্র৷ সম্মানও পান সকল শ্রেণির মানুষের কাছে৷ কিন্তু কেবল শ্রদ্ধা আর সম্মান দিয়ে কী জীবন চলে? অথচ একমাত্র ছেলে রব বড় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে৷ আর কয়দিন পরেই তাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে৷ তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি টাকার, এই টাকার যোগান আসবে কোত্থেকে? অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মুন্সি মেহেদী হোসেনের বুক থেকে৷

সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এক স্ত্রী মুকিদুন্নেছা, এক ছেলে মুন্সি আব্দুর রউফ এবং দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মুন্সি মেহেদী হোসেনের সংসার৷ অভাব অনটন সংসারে লেগেই আছে কিন্তু কমতি নেই সুখের৷ প্রতিদিন সকালে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে মুন্সি মেহেদী হোসেন ছেলে রবকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসে যান শ্লেট আর চক নিয়ে৷ পরম মমতায় ছেলে রবকে শ্লেটে লিখে লিখে চিনিয়ে দেন এক একটি বর্ণমালা৷ মুন্সী আব্দুর রউফ ওরফে রবের শিক্ষার হাতেখড়ি বাবার কাছেই৷ কিন্তু লেখাপড়া তাঁর মোটেই ভালো লাগে না৷ যদিও মেধার কমতি নেই তথাপি সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোতেই তাঁর আনন্দ৷ মাঠ ঘাট তাঁর পরিচিত বন্ধু৷ এই দুরন্ত বালক মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে রাঙামাটির মহালছড়ির চিংড়িখাল এলাকায় এক অসম যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান৷ এই অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়৷

মুন্সি আব্দুর রউফ জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের মে মাসে৷ ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে৷ বাবার কাছেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি৷ মাও ছিলেন সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ৷ বাবা তাঁকে ডাকতেন রব বলে৷ অসম্ভব সাহসী ও মেধাবী রউফের লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিলো না মোটেই৷ অথচ বাবা মায়ের অক্লান্ত চেষ্টা ছিলো তাঁকে পড়াশুনায় মনযোগী করে তুলতে৷ কিন্তু বইয়ের পাঠ তাঁর ভালো লাগত না৷ ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেনের সঙ্গই বরং তাঁর অধিক প্রিয় ছিলো৷ চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেন ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার৷ চাচা যখনই বাড়ি ফিরতেন তখনি তিনি তাঁকে শোনাতেন সৈনিকদের সুশৃঙ্খল ও রোমাঞ্চিত জীবনের গল্প৷ সৈনিকদের লেফট রাইট শব্দ তাঁর কানে মধুর ঝংকার তুলত৷ তাই বাবার চেষ্টা মায়ের চোখ রাঙানো এড়িয়ে বালক রউফ মধুমতি নদীর তীর ধরে ঘুরে বেড়ায়৷ দিনে দিনে প্রিয় সন্তানটির এরকম দুরন্তপনা দেখে তাঁদের উদ্বেগের অন্ত নেই৷ একদিকে আর্থিক অনটন অন্যদিকে ছেলের স্কুলে অমনোযোগিতা দেখে মা মুকিদুন্নেছা একদিন রউফের উপরে রেগে গেলেন৷ মা একদিন তাঁকে পড়তে বসার জন্য বললেন৷ কিন্তু ছেলে রউফ পড়তে না বসে গাছের পাখিদের সাথে মিতালিতে ব্যস্ত, এই দেখে মা ছেলেকে দিলেন বকা৷ ছেলেও অভিমানে ঘর থেকে বের হয়ে দিলেন দৌড়৷ ছেলে ছুটছে, মা-ও পেছন পেছন ছুটছেন ছেলেকে ধরার জন্য৷ ছুটতে ছুটতে একেবারে মধুমতি নদীর কিনারে৷ পাড়ে দাঁড়িয়ে মাকে দৃঢ় স্বরে বললেন, আমাকে ধরতে এলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ব কিন্তু৷ মায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। ছেলের এই জেদী রূপ মা এর আগে দেখেননি কখনো৷ এরপর মা গলার স্বর নরম করে ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন৷ আর কোনদিন তাঁকে তিনি বকাঝকা করেননি৷ এরপর থেকে ছেলেও অবশ্য কিছুটা মনোযোগী হয়েছিলেন লেখাপড়ার প্রতি৷

ভালোই চলছিলো তাঁদের অভাব অনটনের কিন্তু সুখের সংসারটি৷ এই মৃদু মন্দ ছন্দে চলা সংসারে একদিন হঠাত্‍ ঝড়ের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ে৷ মুন্সি আব্দুর রউফের বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন হঠাত্‍ করে মৃত্যুবরণ করেন৷ মুন্সি আব্দুর রউফের বয়স তখন খুবই অল্প৷ মৃত্যু কী বিষয় তখনো সে সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা জন্মেনি৷ আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশিরা যখন কাঁদছিলো তখন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, মা, বাবা কি সত্যিই মারা গেছে? মা কী জবাব দেবেন? দীর্ঘ শোকের ছায়ায় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেবল তিনি কাঁদছিলেন৷ বাবার মৃত্যুর পর এক ছেলে আর দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মা মুকিদুন্নেছা অকূলপাথারে পড়েন৷ নিত্য অভাবের মধ্য দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি৷ বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়ির কাঁথা সেলাই, শিকে তৈরি করার কাজ নেন৷ এমনিভাবে মুকিদুন্নেছা দুঃখের দীর্ঘতম দিনগুলি একটি একটি করে পাড়ি দেন৷ সাথে থাকে ছেলেমেয়েকে বড় মানুষ করার স্বপ্ন৷
মাজারবাবার মৃত্যুর পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আব্দুর রউফের জীবনাচারেও৷ আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে তাঁর দুরন্তপনা৷ লেখাপড়ার প্রতি মনযোগ বাড়ে৷ এর ফলে মেধাবী বলে তাঁর সুনামও হয়৷ গাঁয়ের প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর ভর্তি হন থানা শহরের হাইস্কুলে৷ এই সময় প্রায়ই মায়ের দুঃখ কষ্ট দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন৷ ভাবতেন কী করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা যায়৷ এতটুকুন ছোট ছেলে কী আর করতে পারেন তিনি? তবে চাচার কাছে শুনেছেন সপ্তম শ্রেণী পাশ করতে পারলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন৷ অষ্টম পড়া অবস্থায় এল সেই সুযোগ৷ ১৯৬৩ সালের মে মাসে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ৷

সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েও রউফের মন ছিলো বাড়ির দিকে৷ নিয়মিত মাকে টাকা পাঠাতেন চিঠি লিখতেন৷ ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়ি চলে আসতেন৷ রউফের চাকরি হওয়াতে মায়ের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হলো৷ মায়ের আকাঙ্ক্ষা উজ্জ্বল হলো৷ সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করেন তিনি৷ রউফের বিয়ে দিয়ে সুন্দর এক ফুটফুটে পুত্রবধু ঘরে আনবেন তিনি৷ তার আগে বিয়ে দিবেন ছোট মেয়ে হাজেরার৷ মায়ের মনে পড়ে বড় মেয়ের বিয়ের সময় শাড়ি কিনে দিতে পারেননি বলে দুঃখে কেঁদেছিলেন৷ সেই কৈশোরেই রউফ মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, দেখো মা আমি বড় হয়ে চাকরি করবো৷ তখন অনেক শাড়ি কিনে দেব৷ মা-ও ছেলেকে ঘন ঘন পত্র পাঠাতেন৷ ছেলেকে বাড়ি আসার তাগাদা দিতেন৷ ১৯৭১ সালে রউফ এক চিঠির উত্তরে মাকে লিখেছিলেন, এখন একটু কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না৷ তার জন্য তুমি চিন্তা করো না৷ ছোট বোনের বিয়ে ঠিক করো৷ আমি নতুন শাড়ি নিয়ে বাড়ি আসবো৷ কিন্তু বোনের জন্য নতুন শাড়ি নিয়ে মুন্সি আব্দুর রউফ আর কোনদিনই বাড়ি ফিরে আসেননি৷

তখন ১৯৭১ সাল৷ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন৷ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবীতে গর্জে ওঠেছে সমগ্র বাঙালি৷ আর বাঙালির এই নায্য চাওয়াকে দমিয়ে রাখার জন্য শুরু হচ্ছে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায়৷ পাশাপাশি সতর্ক ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও৷ যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাঁরাও সদা প্রস্তুত৷ ফলে বাড়ি যাওয়া কমে গেছে মুন্সি আব্দুর রউফের৷

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মুন্সি আব্দুর রউফ চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকরিরত ছিলেন৷ তিনি ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক৷ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন৷ তখন সবে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব৷ মাঝে মাঝে গড়ে তোলা হচ্ছে ছোটখাটো প্রতিরোধ৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ৷ শান্ত হ্রদের পাশে আকাশ ছুঁয়ে থাকা মাথা উঁচু মৌন পাহাড়ের সারি৷ এমন নির্জন পরিবেশের জলপথ দিয়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির উপর৷ কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুললো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি৷ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ ছিলেন সেই কোম্পানিরই একজন মুক্তিযোদ্ধা৷

সেদিন, ৮ এপ্রিল ১৯৭১৷ গনগনে মধ্যদুপুরের এক বিশেষ মুহূর্ত৷ সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে৷ নীরব-নির্জন হ্রদের বুক চিরে শান্ত পানিতে অস্থির ঢেউ তুলে এগিয়ে আসতে লাগলো সাতটি স্পিডবোট এবং দুটো লঞ্চ৷ এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য৷ তাদের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র৷ এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের কোম্পানি৷ লক্ষ্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি৷

লক্ষ্যের দিকে তীব্রগতিতে ছুটে আসছে দুটি স্পিড বোট এবং দুটি লঞ্চ৷ এগুলোতে রয়েছে ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার আর অনেক মেশিনগান ও অনেক রাইফেল৷ অন্যদিকে এই জলপথ পাহারা দিচ্ছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে কোম্পানিটি, সেই কোম্পানিটি মাত্র কয়েকদিন আগে পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করে আসা৷

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করল আক্রমণ৷ স্পিড বোট থেকে ক্রমাগত চালাতে লাগল মেশিনগানের গুলি আর লঞ্চ দুটো থেকে ছুটে আসছে অবিরাম তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল৷ মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগল গুলির পর গুলি৷ গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল৷ পানির ভেতর অদ্ভূত আলোড়ন উঠল৷ শব্দগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়ি খেয়ে এক মহাধ্বণিযজ্ঞের সূচনা করল৷ শীতল সবুজে হঠাত্‍ যেন লেগে গেল শব্দের আগুন৷ পাকিস্তানি বাহিনীর একটাই উদ্দেশ্য, রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা৷ আক্রমণের আশংকা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আগেই ছিল৷ তাঁদের লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র নেই বললেই চলে৷ কিন্তু মনের ভেতর দেশের জন্য জমানো আছে অসীম সাহস, তেজ ও দৃপ্ত অঙ্গীকার৷ দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশকে বর্বরদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য৷ মুক্তিযোদ্ধারা খুব দ্রুতই পজিশন নিয়ে নিল পরিখায়৷ কিন্তু শত্রুপক্ষের গোলাগুলির তীব্রতা এত বেশি ছিলো যে, ভেঙে যেতে লাগল প্রতিরোধ ব্যবস্থা৷ শত্রুদের মর্টার চিহ্নিত করে ফেলল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান৷ আর তাই তীব্র গুলিবর্ষণে ভেঙে পড়ল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা৷

যুদ্ধের এই পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন যে, এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলেই মারা পড়বেন৷ তিনি তখন কৌশলগত কারণেই পশ্চাদপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেন৷ এই সিদ্ধান্তের কথা সৈন্যদের জানানো মাত্র সৈন্যরা যে যেভাবে পারে পিছু হটতে লাগল৷ মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন, শত্রু এগিয়ে এসেছে খুব কাছে আর এভাবে সকলে একযোগে পিছু হটতে চাইলে একযোগে সকলেই মারা পড়বে৷ কাভার দেওয়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে৷ যেই ভাবা সেই কাজ৷ তিনি পিছু হটলেন না৷ কাভার দেওয়ার জন্য নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন মুন্সি আব্দুর রউফ স্বয়ং৷ অসম্ভব সাহসে, দৃঢ়চিত্তে মেশিনগানটি উঁচুতে তুলে ফেললেন৷ অনবরত গুলি করতে লাগলেন পাকিস্তানি স্পিড বোটগুলোকে লক্ষ্য করে৷ প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গেই তিনি কাজে লাগালেন পাকিস্তান রাইফেলসে কাজ করার অভিজ্ঞতা৷ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তিনি যোগই দিয়েছেন দেশকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে৷ পাকিস্তানি হানাদারদের তিনি পথ ছেড়ে দিতে রাজি নন৷ শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে একাই লড়তে লাগলেন এই অকুতোভয় বীর৷

ল্যান্স নায়েক আব্দুর রউফ এক একটা স্পিড বোটকে লক্ষ্য স্থির করে মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকেন৷ তাঁর প্রচণ্ড গুলিবৃষ্টিতে থমকে গেল শত্রুরা৷ তারা প্রত্যাশাও করেনি এমন পাল্টা আক্রমণ হতে পারে৷ রউফের গুলি খেয়ে একের পর এক শত্রুসেনা লুটিয়ে পড়তে লাগল৷ একটি একটি করে সাতটি স্পিড বোটই ডুবে গেল৷ এমন পর্যায়ে শত্রু সেনারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো৷ পিছু হটতে হটতে দুটো লঞ্চই চলে গেল রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দুরত্বে৷ হানাদার বাহিনী এবার তাদের লঞ্চ থেকে শুরু করল মর্টারের গোলা বর্ষণ৷ তারা লক্ষ্য স্থির করল, যেভাবেই হোক থামিয়ে দিতে হবে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানটাকে৷

একের পর এক ক্রমাগত মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না৷ শত্রুর একটি মর্টারের গোলা হঠাত্‍ এসে পড়ে তার বাঙ্কারে৷ মৃত্যুশেলে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তাঁর সমস্ত শরীর৷ থেমে গেলেন তিনি৷ হাত থেকে পাশে ছিটকে পড়ল মেশিনগান৷ ততক্ষণে তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা সবাই পৌঁছে যেতে পেরেছে নিরাপদ দুরত্বে৷ প্রকৃত বন্ধুর মতো একটি মাত্র মেশিনগান দিয়ে একই সঙ্গে শত্রুদের ঘায়েল করলেন এবং সহযোদ্ধাদের রক্ষা করলেন৷

তিনি বাংলার শোণিতাক্ত সূর্যের সঙ্গে মিশে গেলেন৷ মায়ের বুক খালি হলো, বোনের জন্য বিয়ের শাড়ি নেওয়া হলো না, অথচ নিজের বুকের আলো দিয়ে উজ্জ্বল করলেন তিনি স্বাধীনতার পথ৷ হয়ে গেলেন অমর, বীর, শহীদ, বীরশ্রেষ্ঠ৷

১৬ ডিস্বেমর ১৯৭১৷ দেশ স্বাধীন হলো৷ অনেকেই যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে এলেন৷ মুকিদুন্নেছার একমাত্র ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ঘরে ফিরলেন না৷ ছেলে হারানোতে তাঁর কোন কষ্ট নেই৷ বরং গর্ব করে বলেন, ‘শেয়াল-কুকুরের মতো পালিয়ে না মরে দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে বীরের মতো লড়াই করে মৃত্যু বরণ করেছে আমার ছেলে৷’ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের জন্মস্থান ফরিদপুরের সালামতপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে রউফনগর৷ এ গ্রামেই ১৭ নভেম্বর ২০০৭ ইং তারিখে স্থাপন করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর৷ ৬২ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে ফরিদপুর জেলা পরিষদ এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ করছে৷ বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দেওয়া ৫২ শতাংশ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদের মাধ্যমে এলাকাবাসীর দেওয়া ৪৮ শতাংশ, মোট এক একর জায়গায় চলছে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর নির্মাণের কাজ৷

চির রুদ্রের প্রতীক এই বীরকে সমাহিত করা হয়েছিলো রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে৷ ১৯৯৬ সালে রাঙামাটিবাসী প্রথম জানতে পারে, এ চিরসবুজ পাহাড়ের মাঝেই ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ৷ ঐ সময় দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক আদিবাসী বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল শনাক্ত করেন৷ শনাক্ত করার পর তাঁর সমাধিস্থলটি সরকার নতুনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে৷

সংক্ষিপ্ত জীবনী :

নাম : মুন্সি আব্দুর রউফ
জন্ম : ১ মে, ১৯৪৩৷
জন্মস্থান : ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে৷
পিতা : মুন্সি মেহেদী হোসেন৷
মা : মোছাঃ মুকিদুন্নেছা৷
কর্মস্থল : ই পি আর ( ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস)৷
যোগদান : ৮ মে ১৯৬৩ সাল৷
পদবী : ল্যান্স নায়েক৷
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১ নং সেক্টর৷
মৃত্যু : ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল৷
সমাধি স্থল : রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রিয় শহীদ মিনারের পাশে

সূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
বীরশ্রেষ্ঠ; রচনা: চন্দন চৌধুরী৷

লেখক : এহসান হাবীব

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to এ মাসের ব্যক্তিত্ব: বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ”

You must be logged in to post a comment Login