কবির কবিতা, কবিতার কবি
নাস্তিকদের একটা বাক্য সূচিবায়ূ আছে, কোন কিছুর সর্বোচ্চতা প্রকাশে তাকে ঈশ্বরের সাথে তুলনা করেন। আমিও সেই দলে অন্তত এই ক্ষেত্রে। কবিও ঈশ্বর। কবিতার ঈশ্বর। নজরুলের ভাষায় কবিতা আর দেবতা সুন্দরের প্রকাশ। ঈশ্বরকে চেনা যায় তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আর কবিকে চেনা যায় কবিতার মধ্য দিয়ে। নিজেকে প্রকাশ করার জন্য ঈশ্বর যেমন কবিতার আশ্রয় নিয়েছেন তেমনি কবিও কবিতার মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রকাশ করেন।
একজন কবির স্বত্ত্বা দুটো। প্রথমত মানুষের গুনাবলী নিয়ে সে একজন মানুষ এবং দ্বিতীয়ত সে একজন কবি। কোন কিছু লিখলেই কবিতা হয় না, যখন কোন লেখা নিজস্ব ভাবমূর্তিতে মহাজাগতিক কালোত্তীর্ণ হয় তখনই সেটা কবিতা। কবি জানেন একটা কবিতা লেখা কত শক্ত। গর্ভে সন্তান ধারনের পরই প্রসব ব্যথার তীব্রতা বুঝা যায়। অন্যথায় এটা কোন ভাবেই বুঝানো সম্ভব নয়।
রবীন্দ্রনাথ যখন বলেন তাঁর না লেখা গুলোই মূলত লেখা তখন আর্শ্চয হই। ভাবনার সারশূন্যতায় নজরুল যখন বাকরুদ্ধ হন তখনই বুঝতে পারি একটা কবিতার জন্য কবির দরদের গভীরতা। জাগতিক চিন্তার বাইরে কবিতা নিয়ে কবির চিন্তাশক্তি কতটা প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন।
কবিতা হতে হবে শাশ্বত। কবিতা রক্ত ঝরাতে জানে। কবিতা বিপ্লব ঘটাতে পারে, পারে বিদ্রোহ করতে। আর এজন্যই পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি কবিতার প্রয়োজন ফুরোইনি। কোরআনের বানী, বেদের শ্লোক সবইতো কবিতা।
চলমান জীবনের দৃশ্যমানতার বাইরে সবকিছুরই শুধু দৃশ্যতার বাইরেও অন্যরকম নিগূঢ় কিছু তত্ত্ব আছে। ভাবনার রাজ্যে স্বভাব কবি লালন সেই তত্ত্বের সন্ধান করেছেন। এ জন্যই তার এক একটি সহজ সরল কথা দার্শনিক মতবাদ। কবিকেও সাধক হতে হয়। অলৌকিকের লৌকিক দর্শনের সাধক। সাধারণের চোখে যা শুধুই আঁধার সেই আঁধার কেটে আলোর পথ তৈরী করার দায়িত্ব কবির।
এইভাবে, কবি শুধু নিছক শব্দের কারিগর নয়। কবি দার্শনিকও। কবির কবিতা অল্পতেই পাঠককে বিশালত্বের ধারনার অনুভূতি জাগায়। পাঠক যা চিরকাল এক রকম দেখে এসেছে তা নতুন ভাবে উপস্থাপন করে কবির কবিতা। এ জন্যই কবিকে শুধু কবিতার পঙতি শেষ করার দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি নিলেই চলবে না। কবির কবিতাই এমন ভাবের উদয় হতে হবে যেন সূর্য অস্ত যাওয়ার মুহূর্তে আকাশে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে।
লালনের মতো কবিও কিন্তু ভাবের ঘরে চুরি করে। কোন একটা কবিতা লেখার পূর্বে কবির কবিতা প্রথমে কবির ভাবের ঘরে চুরি করে। কোন একটা কবিতা লেখার পূর্বে কবির কবিতা প্রথমে কবির ভাবের ঘরে হানা দেয়। আর তখনি কবি সেই ভাবকে ভাষার জালে আবদ্ধ করেন। যার ভাষার বুনন যতো ভাল তাঁর কবিতার শৈল্পিক গুন ততো সমৃদ্ধ। সুতরাং ভাষার দখল না থাকলে কবি কখনও ভাবের ঘরের পাকা চোর হতে পারবে না।
5 Responses to কবির কবিতা, কবিতার কবি
You must be logged in to post a comment Login