তৌহিদ উল্লাহ শাকিল

কালো ব্যাচ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

//তৌহিদ উল্লাহ শাকিল//

পবিত্র শহর মদিনায় এসেছি মাত্র কয়েক মাস হল। মদিনা শান্তির শহর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না । চারদিকে পাথুরে পাহাড় ঘেরা ছোট শহর । বিশ্বের প্রাচীন শহর বলে ও এর খ্যাতি আছে। আর মদিনা সর্ব কালে এবং সবসময় বিখ্যাত হয়ে আছে আমাদের প্রিয় নবী রাসুল(সঃ) এর কারনে। তিনি মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় এসে অবস্থান করেন । সেই সময় থেকেই মদিনার নাম সকলে জানে। এরপর রাসুল (সঃ) ইন্তেকালের পর মসজিদে নববীতে উনার রওজা মোবারক দেখতে সারা বছর সারা বিশ্ব থেকে লক্ষ্য লক্ষ্য মুসলমান এখানে আসেন ।

গত কয়েক মাস আগে দেশ থেকে মদিনায় এলাম । একটা হোটেলে চাকুরী করি । মসজিদে নববীর পাশেই অনেক বড় পাঁচতারা হোটেল। সারাদিন হাজীদের গিজগিজ লেগেই আছে। আমি এসেছি রমজানের কিছু দিন আগে পুরো উমরা হাজ্জের মৌসুম । কতদেশের কত বর্ণের কত ভাষা’র মানুষ তা মদিনা না এলে বুঝার উপায় নেই কারো। দিন রাত সারাক্ষণ মদিনা শরীফের আশপাশের হোটেল গুলো ব্যাস্তময় সময় কাটায়। আর এই ব্যাস্তময় সময়ে  যেসব দেশের লোকেরা হোটেল গুলোতে কাজ করে তাদের মধ্যে অধিকাংশই বাংলাদেশী । আমি ও তাদের মাঝে একজন। পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশের বাইরে যে কেউই থাকুক না কেন তার মন দেশের জন্য সারাক্ষণ কাঁদে।

যতক্ষণ কাজের মাঝে ডুবে থাকতাম ততক্ষণ সময়টা বেশ পার হয়ে যেত। বাকী সময়টা যেন থমকে যেত। দেশের কথা , মায়ের মমতার কথা , পাড়ার বন্ধুদের কথা সবসময় মনে হত । এগুলো যেন ছায়ার মত আমার পিছু পিছু  বিচরন করত। আর অবসর পেলেই মনের ভেতরে নাড়া দিত। ধীরে ধীরে সব কিছু ভুলে থাকতে লাগলাম । মেকী হাসি হাসতাম সকলের সাথে । সকলে ভাবত আমি দারুন হাসি খুশী একটা ছেলে। কিন্তু আমি যে ভেতরে ভেতরে পুড়ে মরতাম তার খবর কেউ রাখত না। এই পৃথিবীতে কে কার খবর রাখে। এমন ভাবে সুখে আর দুঃখে দিনগুলো কাটছিল। দেখতে দেখতে একুশে ফ্রেব্রুয়ারী এসে গেল।  দেশের অভ্যাস এবং গন্ধ তখন ও আমার শরীরে। আমার সাথে যারা থাকে সবাই কে বললাম এখানে কি একুশে ফ্রেব্রুয়ারী পালিত হয়? উত্তরে তারা বলল না । এটা সৌদি আরব এখানে আমাদের দেশের কর্মকাণ্ড গুলো পালিত হয় না । তাদের কথা শুনে আমার মাথায় হাত । কি বলে ? একুশে ফ্রেব্রুয়ারী পালন হবে না ।

আমি সকলের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে আলোচনা করলাম । যে ভাবে হোক একুশে ফ্রেব্রুয়ারী পালন করতেই হবে । সকলে মত দিলে ও ভয় পায় বলে জানাল। আমি বললাম ঠিক আছে আমাদের সৌদি বসকে ব্যাপারটা আমি জানাব এবং উনাকে বুঝিয়ে বলব। সবাই বলল যদি কোন ঝামেলা হয় । আমি তাদের অভয় দিলাম । একুশে ফ্রেব্রুয়ারী নিয়ে মনে মনে প্ল্যান করলাম । কিভাবে পালন করব। পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে এলাম যে , শুধু মাত্র আমরা যারা বাংলাদেশী আছি তারাই একুশের প্রথম প্রহরে নিজেদের তৈরি প্রতীকী শহিদ মিনারে পুষ্প অর্পণ করব এবং পরদিন মানে একুশে ফ্রেব্রুয়ারী সারাদিন কালো ব্যাচ লাগিয়ে রাখব আমাদের ইউনিফর্মের উপরে।

আমার মনের সিদ্ধান্ত আমি আমার সাথের সকল কে জানালাম । তাতে তারা সকলে সায় দিল । কিন্তু তারা জানত না তাদের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি তে  কি অপেক্ষা করছে। সকলের সম্মতি ক্রমে আমি আমাদের “মুদির এ আম”(সৌদি ভাষায় জেনারেল ম্যানেজার কে বলে। )কে বিষয় টা জানালাম। তিনি প্রথমে জানতে চাইলেন ভাষা দিবস কি এবং কি জন্য।

আমি তাকে সংক্ষেপে আমাদের বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস জানালাম। তিনি বললেন এর আগে তো অনেক বাংলাদেশী এখানে কাজ করে গেছে কেউ তো এটা পালন করেনি । তুমি কেন চাও ?

আমি তাকে বললাম কেউ করেনি বলে যে আমরা করব না । তা তো না। আপনাকে বলার উদ্দেশ্য হল আমাদের এই ব্যাপারটা নিয়ে অন্য কেউ যাতে কিছু না বলতে না পারে। অবশেষে তিনি যা বললেন আমি অবাক হয়ে গেলাম তা শুনে-

” তিনি বললেন তোমাদের ভাষার উপর একটা প্রতিবেদন আমি সম্প্রতি পড়েছি । আর সেখান থেকে জানতে পেরেছি অনেক কিছু । আর আজ তোমার মুখ থেকে শুনে আর ও জানলাম। আসলে সত্যি ভাষার জন্য আর কোন দেশ এমন সংগ্রাম করেছে কিনা আমার জানা নেই। তোমার দেশ এবং ভাষার প্রতি টান আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি চাই তুমি তোমার ভাষা দিবস পালন কর । “

এরচেয়ে বেশী খুশি মানুষ কিভাবে হতে পারে তা আমার জানা ছিল না । আমাদের থাকার ছয় তালা বিল্ডিং এর ছাদে প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হল । সবাই সাধ্যমত খাটছে। এমন সময় মনে পড়ে গেল স্কুল আর কলেজ জীবনের কথা। স্কুলে এবং কলেজে শহীদ মিনার সাজানোর দায়িত্ত ছিল সবসময় আমার । রাতের পর রাত জেগে শব্দ আর অক্ষর আর্ট করে দিত বন্ধু পিপলু। ফুলের জোগান দিত জয়াশিষ । জয়াশিষের বাবা থানার সেকেন্ড অফিসার ছিলেন। তাই অনায়াসে থানার ফুল বাগানের ফুলে আমাদের স্কুলের শহীদ মিনার ফুলে ফুলে সেজে উঠত। আজ মদিনা শহরে এক ছয় তলা বাড়ীর ছাদে অনেকটা নিরবে নিভৃতে গড়ে উঠছে শহীদ মিনার । বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে যারা নিজেদের জীবন দিয়ে রক্ষা করে গেছে আমাদের ভাষা তাদের জন্য শহীদ মিনার বানিয়ে একটু শ্রদ্ধা তো আমাদের জানাতেই হয়।

দেখতে দেখতে একুশে ফেব্রুয়ারি এসে গেল । একুশের প্রথম প্রহরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালাম প্রতীকী শহীদ মিনারে সকল ভাষা শহীদ দেরকে। সকলের সাথে আমাদের সৌদি জি এম তিনি ও ছিলেন । আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর দৃশ্য তিনি তার সদ্য কেনা হ্যান্ডি ক্যামেরা দিয়ে ভিডিও করলেন । আমাদের সাথে তিনি ও ফুল দিলেন । এরপর তিনি তার আবাস স্থলে চলে গেলেন । আমরা যে যার কক্ষে ঘুমাতে চলে গেলাম । আমরা জানতাম না আমাদের কর্মকাণ্ড কেউ পর্যবেক্ষণ করছে। আমরা সকালে উঠে ছাদে গিয়ে দেখি কে বা কারা আমাদের প্রতিকী শহিদ মিনার এবং ফুল গুলো কে এদিকে সেদিকে ফেলে দিয়েছে । শহীদ মিনার কে ভেঙ্গে ফেলে রেখেছে। সাধারনত আমার এবং অন্য সকল বন্ধুদের মেজাজ অনেক খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কারা এই কাজ করেছে তা জানতে পারলাম না ।

সকলে কর্মক্ষেত্রে যাবার আগে ইউনিফর্মের উপর কালো ব্যাচ লাগালাম এবং বাংলায় লেখা মহান একুশে ফেব্রুয়ারী সফল হোক এই ব্যাচ লাগালাম । যে যার নির্দিষ্ট কাজে গিয়ে কোন প্রকার ঝামেলা ছাড়াই কাজ করতে লাগলাম । আমারা যেখানে কাজ করি সেখানে বাংলাদেশী ছাড়া ও মিশরীয় , হিন্দী , শ্রীলঙ্কান, সুদানী এবং পাকিস্তানের শ্রমিকরা কাজ করে। আমাদের এক গ্রুপের সুপারভাইজার পাকিস্তানী। সে তার গ্রুপের বাংলাদেশীদের বুকে কালো ব্যাচ দেখে জিজ্ঞেস করল কি হয়েছে?

‘তোমরা কালো ব্যাচ পড়েছ কেন। “জবাবে সেই দলের মিজান ভাই বলল ,

আজ মহান ভাষা দিবস। ১৯৫২ সালে তোমাদের তৎকালীন সরকার আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা মেনে না নেয়ায় আমাদের দেশের ছাত্র জনতা এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে । সেই সময় তোমাদের সরকার আমাদের মিছিলে গুলি করে নিরীহ অনেক বাংলাদেশী কে নিরমম ভাবে হত্যা করে। আর সেই কারনে প্রতি বছর শহীদদের প্রতি সন্মান এবং আমাদের ভাষার প্রতি সন্মান দেখিয়ে আমরা এই দিবস  পালন করি এবং বুকে কাল ব্যাচ ধারন করে সেই ঘটনার নিন্দা জানাই। একসাথে শোক প্রকাশ করি।

মিজানের কথা শুনে পাকিস্তানী বেশ ক্ষেপে গেল । সে বলতে লাগল কবে কি হয়েছে তা নিয়ে এখন এসব না করলে ভাল। তারপর সে অফিসে রিপোর্ট করে । কিন্তু সেখানে আমরা আগে বলে রাখায় সে সুবিধা করতে পারেনি ।তারপর কয়েক জন ঊর্ধ্বতন পাকিস্তানীকে সঙ্গে নিয়ে সে নানা ভাবে আমাদের কে বিদ্রূপ করতে থাকে । প্রথম দিকে আমরা সবাই চুপচাপ থাকি । কিন্তু বেলা বাড়তে বাড়তে সে নানা রকম ভাবে বাংলাদেশী দের এবং আমাদের ভাষাকে গালি দিতে থাকে । এছাড়া তার গ্রুপে প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কঠিন এবং পরিশ্রমের কাজ দিতে থাকে।

এক পর্যায়ে নানা বাকবিন্ডতার মাঝে আমাদের মিজান ভাই এবং রুবেল নামক এক কর্মচারীকে সে গলা ধাক্কা দিয়ে কাজ থেকে বের করে দেয় । আমরা ঘটনা শুনে তাৎক্ষনিক ভাবে গিয়ে সেই পাকিস্তানী কে পাকড়াও করি । দেখতে দেখতে সেখানে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় । বাকবিন্ডতার এক পর্যায়ে সে অকথ্য ভাষায় আমাদের দেশকে গালি দিতে থাকে । আমরা নাকি তাদের গোলাম আর নানা কথা ।আমাদের এক বন্ধু মুরাদের কালো ব্যাচটি সে ছুড়ে ফেলে দেয় ।  আমাদের মাঝের কয়েকজন তরুন পাকিস্তানীর সেই আচরন  সহ্য করতে পারে না । অবশেষে সেখানে অবস্থিত পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশের মাঝে বেশ ঝামেলা বেঁধে যায় এবং মারামারি শুরু হয় । পাকিস্তানীরা আসলেই আমাদের শত্রু তারা পূর্বে যেমন আমাদের মিত্র ছিল না আগামীতে ও হতে পারবেনা।এখন বুঝতে পারি কারা আমাদের শহীদ মিনার ভেঙেছে , কারন সেই ভিলায় তারা ও থাকে  ।

হোটেল কতৃপক্ষ উপায়ন্তর না দেখে পুলিশ ডেকে আনল। সৌদির আইন অনুযায়ী দোষী এবং নির্দোষী উভয় পক্ষকে জেলে রাখা হবে । ঘটনা সামান্য হলে উভয় পক্ষ উভয়ের কাছে (সামা) ক্ষমা চাইতে হবে তারপর এদেরকে মুক্ত করা হবে । অন্যথায় কাউকেই মুক্ত করা হবে না। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটা ছিল ভিন্ন । আমাদেরকে আদালতে (মহাকুমায়) যেতে হল।

উভয় পক্ষের শুনানী হল। পাকিস্তানীদের জন্য সৌদির আলাদা সহমর্মিতা আছে । কিন্তু আমাদের জন্য ততটা নয় । আমি ছাড়া আর ও চার জন । আমি আমার সাথীদের অভয় দিলাম । তোমরা সবাই আমার কথা বলবে আমি সব নিজের উপর নেব । কারন এর জন্য আমি দায়ী । তারা সকলে চুপ করে রইল ।

সেদিন ছিল সোম বার । ২০০৪ সালের মার্চ মাস। আদালতে আমাদের কে উঠানো হল। প্রথমে পাকিস্তানীর জবানবন্দী নিল আদালত। তারপর আমাদের। বিশেষ করে আমার । সেই সময়ে এখনকার মত নেট এবং সংবাদ মাধ্যম চালু ছিল না । চালু থাকলে এই খবর হয়তো কোন দৈনিক পত্রিকায় ছাপা হত। আমাদের অফিসের জি এম আমাদের পক্ষে কথা বললেন । সকল শুনানীর শেষে ঝামেলার জন্য আমার এবং সেই পাকিস্তানীর দুই সপ্তাহের জেল হল। পাকিস্তানী কে আমাদের ভাষা নিয়ে যাতে ভবিষ্যতে উস্কানি মুলক কথা না বলে সে জন্য সতর্ক করে দেওয়া হল । সেই সাথে উভয়, উভয় কে ক্ষমা করে দেবার শর্ত হল। কোর্টের মাঝে দুজন মিলে গেলে জেল মাফ করা হবে বলে বলা হল। আমি মাফ চাইব না জেল খাটতে রাজি । সমস্যা হল পাকিস্তানীকে নিয়ে । সে তার পরিবার নিয়ে থাকে তার জেল হলে অনেক সমস্যা।

কিছুক্ষণের মধ্য পাকিস্তানীর এক ছেলে বয়স সাত আট বছর হবে , ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে আমার নিকটে এসে বলতে লাগল

-আঙ্কেল । ত্যুম মেরা বাবুজি কো সামা কর। নাহি তো বাবুজি কো অন্দর যানা পরেগা।হাম অর মেরা মাম্মি কেছে একেলা রেহেগা।

ছোট বাচ্চার ক্রন্দন রত মুখ দেখে আমি সব ভুলে গেলাম। আর ভাবলাম এই ছেলেটির মনে যেন বাংলাদেশীদের জন্য ঘৃণা না থাকে , সে যেন বুজতে পারে বাংলাদেশীরা ক্ষমাশীল। তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেই পাকিস্তানীর গলায় মিললাম।

কোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়ে সবাই লিমুজিনে উঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি এমন সময় সেই বাচ্চাটি দৌড়ে এল ।

-চাচ্চু ত্যুম বহুত আচ্ছা হো।

আমি কিছু বললাম না শুধু তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম এবং কি মনে করে পকেট থেকে কালো ব্যাচ টা খুলে বাচ্চার বুকে আটকিয়ে দিলাম। বাচ্চা ব্যাচ পেয়ে দারুন খুশী হয়ে তার বাবা মায়ের দিকে দৌড় শুরু করল। আর আমি এবং আমার বন্ধুরা তখন মদীনা শহরের রাস্তায় লিমুজিনে করে গৃহে ফিরছি অন্য রকম সুখ নিয়ে ।   

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to কালো ব্যাচ

You must be logged in to post a comment Login