মামুন ম. আজিজ

তারপর হারিয়ে যাব স্বাধীনতায়

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page


(
(আয়ারল্যান্ডের সাথে কষ্টার্জিত এবং অতি মূল্যবান বিজয়ে অভিভূত এবং ব্যাপক আনন্দিত আমি, তাইতো এই গল্পটি  উৎসর্গ করলাম বাংলাদেশ ক্রিকেট টীমকে))

বাবাকে মনে মনে বকতাম। এত সততার মানে কি? দেশের নীতি নির্ধারকদের কোন কর্মকান্ডে স্বচ্ছতাই নেই আর বাবা দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজার করে দিচ্ছেন জীবনের মূল্যবান কাল । স্ত্রী সন্তানের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইচ্ছেই তিনি পূর্ণ করতে পারেন না। দেশের সেবা তিনি কি করবেন। এও কি এক প্রকার ভাওতাবাজী নয়? এও তো সেই ততাকথিত শো আপড দেশপ্রেমীক রাজনৈতিকদেরই ছোট সংস্করন।

তখনও ওসব কথা মনে মনেই ভেবে নিতাম। আর রাগগুলো কেটে ছেটে দূর্বল মায়ের উপর দেখাতাম। কখনও খাওয়াকে উছিলা করে কিংবা কখনও হাত খরচের বাড়তি দুএকটাকা চেয়েও না পাওয়ায়। তখন তো সবে ক্লাশ নাইনে উঠিছি।  অথচ পাকনামির বয়স সে তুলনায় তখনই অনেক বেশী। সিগারেট তো হরহামেশাই চলতো তখন। কলোনীতে বসবাস ছিল। পাশের কলোনীতে শহরের নামকরা গার্লস স্কুল। গেটের সামনের আড্ডায় ধীরে ধীরে অংশীদারিত্ব প্রাপ্ত হয়ে নিজেকে নাইন ক্লাশের নয় মনে হতো দুতিন ধাপ আগ বাড়ানো টগবগে হিরো। আজকাল যাকে ইভ টিজিং নামে অভিহিত করা হচ্ছে সে কাজে তখন চরম তির্প্তী। তখনও ওত রাশ ভারি নামের সাথে আম জনতা পরিচিত হয় নি। আর আমরাও ওটাকে বলতাম ‘চল একটু মজা মাইরা আসি’, এরকম ভাবেই।

বাসার আর্থিক দূর্দশা , মায়ের অযথা বকুনী কিংবা নির্দোষ চোখের জল , বাবার দেশ প্রেমের মহান মন্ত্রধ্বনী , পড়াশোনার চাপ, প্রাইভেট টিউটরের অভাব, ছোট বোনটার নতুন নতুন বায়না এবং সে সবের অপূরন  সর্বোপরি গরীবের গরীবিয়ানার সাতকাহন সহ্য করার ক্ষমতা যত কমতে থাকে ততই ‘মজা মাইরা আসি’ জগতের টান বেড়ে যায়।

আমার বাবা একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার জীবনে ঐ একটি কাজ করেই তিনি ভেবেছেন জীবনের সব কিছু শেষ। কারন ওনারা যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। যদিও যতই বড় হয়েছি মনে হয়েছে জীবনটা বড় পরাধীন। পরাধীন জীবনে স্বাধীনতার কি মূল্য আমার ভাবনায় তার কোন ধারনাই ছিলনা। একজন মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধপরবতী এই কাহিল দিনাতিপাতের চিত্র দেখে স্বাধীনতার গর্ব বোধ আমার ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছিল। বাবা শেখাতেন সত্য বল, সত্য বল, সত্যর কোন বিকল্প নেই। নাইনে ওঠা পর্যন্ত ছাত্র আমি ভালোই ছিলাম। খুব শখ ছিল একটা সাইকেল হবে আমার। কলোনীর প্রতিটা রাস্তা ভনভন করে ঘুরে বেড়াব। শরীরের সবটুকু শক্তি দিযে প্যাডেল ঘুরাব। তার পর ছেড়ে দেবো প্যাডেল। চাকা তখন গতি জড়তায় এমনেতেই ঘুরতে থাকবে। এগিয়ে যাব। আমি এগিয়ে যাবার স্বপ্নই দেখেছি তখন বারবার। চোখ মুদলেই দেখতাম এগিয়ে যাচ্ছি স্বপ্নে।। আর বাবার সকল কথা আর উপদেশ কেবল যেন পিছিয়ে যাবার। ভীষণ কষ্টকর অপেক্ষার। শখ যখন তাল গাছের মত মাথা চাড়া দিলো আমার কণ্ঠে। বাবা বুঝলেন। ভাবলেন। তারপর আশ্বাস দিলেন। এইটের ফাইনালা পরীক্ষার ১০ এর মধ্যে থাকতে পারলে একটা সাইকেল হবে আমার জন্য। আমি কিন্তু কথা রেখেছিলাম। চতুর্থ পজিশন ছিল। বাড়তি পড়াশুনা করার জন্য প্রিয় যে কাজ ছিল লেকাপড়ার বাইরে সেই কাজ মানে ক্রিকেট খেলা থেকে পুরোপুরি বিরত ছিলাম দুইটা মাস। কলোনীগুলোর মধ্যে নিয়মিত টেপ টেনিস টুর্নামেন্ট হতো। আশেপাশের মহোল্লার থেকেও টিম আসত। আমাদের কলোনীর জুনিয়র টীমে আমি ছিলাম ওপেনিং ব্যাটসম্যান। এই খেলাটা আমি ভালই খেলতাম। এইটে ৪র্থ হতে গিয়ে মহল্লার বড় ভাইদের বিরাগভাজন হতে হলো। আমার অভাবে মহল্লার জুনিয়ার টীম বেশিদূর এগোতে পারলনা এলাকার বিজয় দিবস টেপ টেনিস কাপে।  কিন্তু শেষপর্যন্ত সাইকেলটাও বাবা আমাকে দিতে পারেন নি। নাও করেন নি। আশ্বাস ঠিকই জিইয়ে রেখেছিলেন। তবে তার সেই সত্য বল সত্য বল শিক্ষার সে দিন চির ধরেছিল। বাবাও মিথ্যে বলেছিলেন। মিথ্যে বলেছিলাম আমিও। উনি মিথ্যে বলেছিলেন মিথ্যে আশ্বাসে। আর আমি ? আমি বলেছিলমা , না বাবা কোন সমস্যা নেই, আমার এখন আর অত শখ নেই। বড় হয়েছি না। আমি এখন নাইনে পড়ি। সত্য শিক্ষা , পুস্তকের আর সকল শিক্ষার মত কেবল তাত্ত্বিকই রয়ে গেলো।

তবে একটা  মোটামুটি ভালো মানে ক্রিকেট ব্যাট উনি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। নাইনে পড়ার কালিন সময়েই আমাদের স্কুলের হয়ে নির্মাণ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চান্স পেয়েছিলাম। দলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার এলাকার কোন এক বিদেশী এনজিও কর্তৃক একটা সনদ আর কিছু অর্থ পেয়েছিলেন। সেই টাকা থেকেই ক্রিকেট ব্যাট টা কেনা হয়েছিল।

বাবাকে হারিয়েছি তো কবেই। সাথে জীবনের সবকিছু হারিয়ে যখন নিঃস্ব পলাতক আসামী। দুটো জিনিস রয়েছে কেবল। সেই ব্যাট আর কিছু উপলব্ধি। যে উপলব্দি যদি বাবার কথা শুনে শুনে সেই সময় হতো তাহলে আজ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের একটা ম্যাচ দেখার জন্য দুই কিলো পথ হেঁটে বড় বাজারে আসতে হতো না। একটা ছোট টিভি। দর্শক শদেড়েকের কমনা। কোন রকমে মুখটা লুকিয়ে এক কোনায় দাড়িয়ে খেলা দেখতে হচ্ছে।  মাথায় গ্রেফতারী হুলিয়া নিয়ে পালিয়ে থাকা এক মানুষ । আমার আবার খেলা। কিন্তু আজকের খেলাটা না দেখে থাকতে পারছিলাম না। জীবনে বাঁচার আর কোন কিছু নেই। এই যত সামান্য চাওয়া পরাজিত জীবনের আমার, তাকে তো মূল্য না দিয়ে পারি। যে নেতার হয়ে এত দিন সকল অপকর্ম করে এসেছি। চরম বিপদে তিনি পুরোপুরি মুখ ফেরান নি। নির্জন নির্ভৃত এই অজোপাড়া গায় লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। এটুকই তার কাছে সর্বোত্তম প্রাপ্তি। জীবনটাকে নষ্ট করে দিয়ে সেই জীবনকে টিকিয়ে রাখার তিনি একটা নিমিত্ত দিয়েছেন। নেতার খামার বাড়ি আছে ওই গ্রামে । সেখানে অনেক ধরনের কাজ। নেতা জনসেবা করছেন। কর্মসংস্থান করছেন। সাথে পুষছেন আমার মত সমাজ চ্যুত বিশ্বাসী কুকুরের পাল। নাম বদলে ওখানেই মাছের ঘেরে কাজ করছি। আমি এখন পলাতক মেছো।  বিনিময়ে শেল্টার পাচ্ছি আর পাচ্ছি তিন বেলা খাবার। নেতার নিজ গ্রাম নয় ওটা। তবে ওখান থেকেও উনি নির্বচন করেন। সেই সূত্রে ওটা ওনার নির্বাচনী এলাকা বলা যেতে পেরে। জয়লাভ ও করেছিলেন একবার। তখন এই গ্রামে জমি দখল করে এই খামার টা করেন। গ্রাম বাসীকে আশ্বাস দেন বিদ্যুৎ এনে দেবেন। সেই মতে বিদ্যুতের অনেকগুলো খুঁটি পর্যন্ত বসানো হয়ে যায় কিন্তু বিদ্যুৎ আর আসেনি। খুঁটিগুলো তপ্ত দুপরে সবুজ ধান ক্ষেতের উপর ছায়া ফেলে নিরবে। এখন তো উনি আর ক্ষমতায়ই নেই। এখন ছোট এক বিরোধী পার্টির সদস্য। বিদ্যুৎ  এনে দেয়ার ওয়াদা এখন আর রাখার কি আছে? দোষ তো যাবে সব সরকারের ঘাড়ে।

দুই কিলোমিটার তাই হাঁটতেই হলো। নেতা শুনলে খুব রাগ করবেন। বের ও করে দিতে পারেন। উনি বলেই দিয়েছেন। যতক্ষন খামারে আছি ততক্ষণ আমি পুলিশের কাছ থেকে নিরাপদ। এখান থেকে বের হলে খবর আছে। কিন্তু নিজ অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে বাংলাদেশেরই খেলা। জীবন মরণ খেলা। হতে পারতো আমি নিজেই হয়তো আজ খেলতাম মিরপুর শেরা বাংলা স্টেডিয়ামে। ওপেনিংটা শুরু হতো আমাকে দিয়েই। কিছু হলো না। হতভাগ্য কপাল আর উপরে ওঠার নেশা আমাকে সব পথ থেকে বিতাড়িত করে এমন উঁচুতেই উঠিয়েছে যেখানে আমি আমার জীবন আমার উপলব্ধি আর আছে ঐ ব্যাটটা। যেটা মুক্তিযোদ্ধা বাবার অর্জিত টাকায় কেনা।

নির্মান স্কুল টুর্নামেন্টে সেবার আমরা একটুর জন্য চ্যাম্পিয়ন হতে পারিনি। তবে রানার আপ হয়েছিলাম। হেরেও আমি হয়েছিলাম ম্যাচ সেরা। ৮০ রান করেছিলাম। আর নিয়েছিলাম দুটো উইকেটও । জীবনের খুব ভালো একটা টার্নিং পয়েন্ট হতে পারত সেটা। কিন্তু কপাল! উদয়ন ক্লাবের কোচ আমার খেলা দেখে সেদিন খেলার পর কাছে ডেকেছিলেন। উদয়ন প্রথম বিভাগ ক্রিকেটে মোটামুটি ভালো দল ছিল। আমাকে ক্লাবে যোগ দিতে বললেন। আমি সময় চেয়ে নিলাম। মা রাজীই হচ্ছিলেন না। রাগ হচ্ছিল । জীবনে কিছুই দিতে পারে না বাব মা আমার। আর নিজ যোগ্যতায় এই সুযোগ পেয়েছি তাও এত না না। মার সেই এক কথা একই গোয়ার্তুমি। বাবা চুপ ছিলেন। একদিন ভাবলেন। তাপর কাছে ডেকে বললেন। এই দেশটা স্বাধীন করেছি তো বাবা তোমাদের জন্যই । তোরাই তো খেলবি। স্বাধীন দেশের নাম ফোটাবে সারা বিশ্বে।

বুঝেছিলাম বাবার হয়তো বাড়তি কিছু অর্থ ব্যয় বাড়বে আমার জন্য। কিন্তু তখন তো আমি সে সব শুনবো না। সবার বাবা এত টাকা কামায় আমার বাবা কেনো পারে না। তিনি স্বাধীন করলেন দেশটা। তার এই তার ফল। আমি ওসব মানবো কেনো। আমি তখন ভীষন স্বার্থপর। হাতখরচের টাকা বাড়িযে দিতে বললাম। বললাম ক্রিকেটের প্রাকটিসে যেতে হয় । পড়াশোনার জন্যও প্রাইভেট না পড়লে হবে না।  সবাই পড়ছে , আমি না পড়লে ওদের মত ফল কি ভাবে আসবে। তখন একটুও কিন্তু বুঝতে চেষ্টা করিনি সরকারী অফিফের সামান্য ক্লার্ক আমার বাবা। তিনি সত্য বলার মন্ত্রে দীক্ষিত। যে বেতন আমাদের সরকার সরকারী কর্মচারীদের দেন তাতে সত্য বলার দীক্ষা নিলেই জীবন শেষ। আগামী চৌদ্দ পুরুষ আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না। দেশের জন্য যুদ্ধ করে দেশটাকে স্বাধীন করলেন। বিনিময়ে কি পেলেন? এমন একটা চাকুরী যে চাকুরীর টাকায নুন আনতে পানতা ফুরায়। আমার জন্য বাড়তি খরচ মেটাতে উনি সন্ধ্যার পরে একটা ওষুধের দোকানে সেলসম্যান এর কাজ নেন। সেটা অবশ্য আমি জেনেছিলাম আরও অনেকদিন পরে। ততদিনে জীবনে উল্টো চারন যা ঘটার ঘটেই গেছে।

সবই চলছিল। ক্রিকেট খেলাও। সেটা মনোযোগ সহকারে ভালমতই।  আমার খেলায় মুগ্ধ হয়ে উদয়ন ক্লাব তাদের টীমে প্রথম ডিভিশন লীগেই আমাকে এই বয়সে খেলাবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। একমাস পরেই আমার সেই মাহেন্দ্র ক্ষণ আসবে। এসএসসি পাশ করে ফেলেছি  তখন। পড়াশুনার একটু ক্ষতি হলেও খেলোয়াড় হবার বাসনায় সেটা আমি মেনে নিয়েছিলাম। বাবাও স্বপ্ন দেখছেন আমি বড় খেলোয়াড় হব। মা কেবল মানতে নারাজ। এসএসসিতে শুধু ফার্স্ট ডিভিশন মার খুব একটা পছন্দ হলো না।

পাড়ার আড্ডাটা থেকে এতকিছুর মাঝেও কিন্তু মুখ ফেরানো হয় নি। খেলাধূলা করি বলে আমার কদর এলাকার ছোট বড় সবার কাছেই একটু বেশী। আড্ডার আমি মধ্যমণি। সেই আড্ডায় চরম কাল হবে কে জানতো।

ইভ টিজিং মানে সেই মজা মারতে মারতে আমাদের আড্ডা দলের সিনিয়র সদস্য আরমান ভাই এক দারোগার মেয়ের প্রেমেই পড়ে গেলো। এক তরফা প্রেম। মেয়েটা পড়ত ক্লাস নাইনে। মেয়েটার ক্লাসের দুএকটা পরিচিত ছেলেকে দিয়ে প্রথমে ওফার দেন আরমান ভাই । মেয়ের উত্তর না। আমরাও কম যাই না। আরমান ভাই হাসিখুশি মানুষ। মানুষ হিসেবেও ভালো। কলোনী পাড়ার আমাদের সম বয়সী সব পোলাপান ঐ মেয়েরে দেখলেই ভাবী বলে ডাক দেই। মেয়েটা একদনি দুদিন সহ্য করে। তৃতীয় দিন তার বড় এক ভাইকে সাথে করে আসা যাওয়া শুরু করে। উৎসাহি কয়েকজন আমাদেরই সাথের ছেলেটাকে একা পেলো একদিন। তখনও ছুটি হয়নি। বাইরে সে অপেক্ষা করছিল। উৎসাহি ক’জনের মধ্যে নিতাই আর আদিল লেখাপড়া করা ছেলে না। শুনতাম তারা এই বয়সেই রাজনীতি করে। এলাকার নেতা গোছের বড় ভাইদের সাথে তাদের ভালো সখ্যতা। আমরাও বিষয়টা এনজয় করতাম। নেতা গোছের ভাইদের সাথে সখ্যতার এক যোগসূত্র অন্তত  এই দুজন। কিন্তু তখন কি আর জানি এই দুজন কত বড় মাস্তান হযে উঠেছিল ততদিন। এলাকার ফেন্সি ব্যবসাতেও তাদের হাত ছিল। আরমান ভাইয়ার কথিত প্রেমিকার সেই বডিগার্ড ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে জনা গেলো সে মেয়েটার কাজিন। কিন্তু তারপরই এক কথায় দু’কথায় নিতাই তার গায়ে হাত উঠালো। সেই তো হলো শুরু। ছেলেটা তার এলাকার থেকে পোলাপান নিয়ে আসল আমাদের সকলকে মারবে বলে। যে কজনকে পেলো মারলোও। আমার খেলা ছিল। না হলে আমিও মার খেতাম হয়তো কিংবা দিতাম। আমাদের এলাকা গরম হয়ে উঠল। আরমান ভাইয়ের মত শান্ত ছেলেও ক্ষ্যাপে গেলো। না ক্ষ্যাপে কিত উপায় । সেদিনই জানলাম আরমান ভাইয়ের ছোট চাচা এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার অন্যতম সহচর। রক্ত তো গরম হবেই।

বডিগার্ডের সামনেই মেয়ের ওড়না ধরে টান দিলো আরমান। মেয়ে কাঁদল সেদিন অনেকক্ষণ। বডি গার্ড গজগজ করতে করতে কাঁদুনে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলো ঠিকই। কিন্তু এবার বিষয়টি মেয়েটির বাবার কানে দিয়ে দিলো। আরমান ভাই সহ অনেকের নামে নারী নির্যাতনের কেস দিলো। আমার নামও সেখানে ছিল। ঐ ঘটনার তিনদিন পরই আমার ১ম ডিভিশনের ১ম খেলা। কেসের খবর জানার পর আমি প্রাথমিক পর্যায়ে ক্লাবে গিয়েই ঢু মারলাম। বাবা মা তখনও বোধহয় জানতেন না। কিন্তু ভয়ংকর ঘটনা যে বাকী ছিল এর পর আরও সেটা কে ভেবেছিল।

কেসের খবর শুনে নিতাই , আদিল , আরমান ভাইদের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। লাঠি সোটা , রাম দা এসব নিয়ে মেয়েটার সেই বডিগার্ড কাজিনরে খুঁজতে শুরু করে। পেয়েও যায়। তবে একা ছিলনা। ওরাও ছিলো দুজন। হুলুস্থুল মারামারি না হবার ই কথা। এরা মার শুরু করার সাথে সাথে বডি গার্ড কাজিনের সাথের জন দৌড়ে পালায়। কিন্তু মেয়েটার সেই বডিগার্ড কাজিন শিকার হয় রাগে উত্তপ্ত নিতাই আদিল আর অনান্যদের আক্রোশের। ছেলেটা বাঁচেনি। হাসপাতালের বেডে সেদিন রাতেই মারা যায়। ছেলেটাকে হাসপাতালে নেবার আগে প্রাথমিক ভাবে নেয়া হয় যে ডিসপেন্সারিতে সেখানেই বাবা সন্ধ্যার পর বসতেন। ওখানেই খবর পান এই অপকর্ম আমাদের। কিন্তু আমি যে তখন ক্লাবে লুকিয়ে সে তিনি কিভাবে জানবেন।

দারোগার ভাতিজা খুন। পুরো এলাকা তোলপাড় হয়ে গেলো। কিন্তু প্রভাবশালীর নেতার ছত্রছায়া ছিল নিতাই আদিল এদের। ওদের সাথে আমর নামও ছিল । নারী নির্যাতন তারপর একটা খুন। একদম পাকাপোক্ত হয়ে গেলো অন্ধকার যুগের প্রাইমারি কোর্স। পুরা পাস করলাম। ক্লাব থেকেও বিদায় নিতে হলো।

বাবার ধারেকাছেই ঘেষা গেলো না। উনি বিশ্বাস করতেই নারাজ । আরমান ভাইয়ের ছোট চাচা বাবাকে বললেন আমি ছিলাম না। বাবাকে স্বাক্ষী দিতে বললেন , বললেন কোর্টে গিয়ে বলতে সেদিন খুনের সময় আমি গ্রামের বাড়ীতে গিয়েছিলাম বাবার সাথে। আমার মত উদীয়মান খেলোয়াড়কে ওনারা মিথ্যে মামলায় সাজা পেতে দেবেন না। কিন্তু বাবার একই কথা আমি নির্দোষ হলে আমার কোন সাজাই হবে না। এটা স্বাধীন দেশ। সত্যর জয় সর্বদা হয়। সত্যর জয়ে মিথ্যে লাগে না।

কিন্তু বাবা কি জানেন সত্যকে মিথ্যে গ্রাস করেছে বহু আগেই। তারপর দারোগাকে নেতা ম্যানেজ করে ফেলেন টাকা ও বিনিময়ে। কেস এর মোড় ঘুরিয়ে দেয়া হয়। অপঘাতে মৃত্যু হিসেবে দেখানো হয়। সব মিটে গেলো। সবচেয়ে আশ্চর্য জনরক বিষয় হলো সেই মেয়েটাই আজ আরমান ভাইয়ের বউ। আর আমার হলো কাল। ক্রিকেট খেলা প্রায় ডুবেত বসেছে। উদয়ন ক্লাব আমাকে নাও করেনি। কিন্তু সে রকমই ভাব। অন্য ক্লাব থেকে অফার আসবে ভাবছিলাম। বাবা এ ঘটনার পর কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। উনি গর্ব করে বলতেন দেখেছিস, সত্যর হয় ঠিকই হয়। আমি হাসতাম। উনি যদি জানতেন মিথ্যে দিয়ে কিভাবে সত্যকে জয়ী করা হযেছে তাহলে কি করতেন, আমি জানি। উনি তখনও বলতে সত্যর জয় সর্বদা হয়। স্বাধীনতা আমাদের মুক্তি দেবেই দেবে। কিন্তু তারপর জেলে জেতেই হলো। নিতাইয়ের সাথে ছিলাম। ফেন্সিডিল নিয়ে ধরা খেলো সে । আমি হলাম ফেন্সিডিল ব্যবসার সহযোগী। হায় কপাল!

নেতা ঠিকই জামিনে ছাড়িয়ে আনলেন। কিন্তু বাবার জিদের কাছ থেকে আর ছাড়া পেলাম না। খুব ভেঙে পড়লেন। আমাকে ছেলে হিসেবে ভাবতে তার ঘৃণা বোধ হতে লাগল। স্বাধীন দেশের কলংক বলে আমাকে উনি দুরে ঠেলে দিতে চাইলেন। আমি রেগে একদিন বলেই ফেললাম, কি যে ঘোড়ার ডিমের স্বাধীনতা এনেছিলে তোমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

কিন্তু তারপর আমার সেই মানসিক দুর্বিসহ দিনগুলোতে ধীরে ধীরে আমি জড়িযে পড়লাম সেই বড় নেতার নানান রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। বাবাও মুক্তিযোদ্ধা আর আমার নেতাও । এখন বুঝি যুদ্ধ অনেকেই করে। কিন্তু যুদ্ধের পরে প্রাপ্ত স্বাধীনতাটা তারাই স্বার্থে ব্যবহার করে যারা শয়তানের দ্বিতীয় রূপ। আমার বাবা মানুষ ছিলেন।

এই যে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকাপ ২০১১ এর দ্বিতীয় ম্যাচ টি আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলছে। এই যে উৎফুল্লতা জনগনের মাজে। আপামর জনগণ এক আশায় উজ্জীবিত । সে আশা আয়ারল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জয়। এই তো চেযেছিলেন আমার বাবা। এই তো স্বাধীনতার ফল।  খুব একটা ভালো রান করতে পারে নি বাংলাদেশ। মাত্র ২০৫ রানে ৪৯.২ ওভারে অলআউট হযে গেছে বাংলাদেশ। টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করতে নামে বাংলাদেশ। শুরুটা চরম হলেও শেষে কি যেন হয়ে গেলো। কখন যে জীবনে কি হয়ে যায় কেউ জানে না। জেল থেকে বের হবার পর নেতার রাজনৈতিকি কর্মকান্ডে বেশী করে জড়িয়ে গেলাম। অনেক দিন পেরিযে গেলো। ক্রিকেট শেষ হলো। পড়ালেখাও। তারপর ইলেকশনের আগে এক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডে জড়িত হলো আমার নাম। সেই তো উত্থান।

বাবা মারা গেছেন। শেষ দেখাটা দেখা হযনি। মা ছোট বোনটাকে নিয়ে গ্রামে গিয়ে থাকছেন। আমার টাকা উনি নেন না। বাবার নিষেধ আছে । সব হারালাম। তবে বাবার সেই সত্য সাধন মনে হয় বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমাতে ভর করতে চাইছিল। এবং ভর করেছেও বোধহয়।

আজতো স্বাধীনতার প্রেম একটু বেশী। বাংলাদেশ খেলায় ফিরে এসেছে দারুন ভাবে। আয়ারল্যান্ড ১৭৭ রান ৮ উইকেটে। জয় এল বলে। সাকিব খুব ভালো অধিনায়কত্ব করছে। আমার নামটাও থাকতে পারত ওদেরই পাশে। ভেবে পুলকিত হই। কল্পনার সূতো অনেক দূর যেতে চেয়েও অদৃশ্য বেড়ির টানে থমকে যায়। সে বেড়ি সে শিকল আমার পরাজিত জীবনের পরাধীনতা। স্বাধীনতা আমার কাছে অস্তমিত সূর্য্ আজ বুঝি স্বাধীনতার কি মূল্য।  পুরো দেশের জনতা দোআ করছে জাতীয় দলের জন্য। সে দোআ কাজে লেগে গেলো  ১৭৮ রানে অলআউট হযে গেলো আয়ার ল্যান্ড। এতো বেশী আনন্দ হচ্ছে বলে বুঝানো যাবে না। আজ মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি বাবার সেই স্বাধীনতার মর্ম। সারা দেশের সকল মানুষ আনন্দে আত্মহারা। টিভিতে দেখাচ্ছে। বেশীক্ষণ এখানে থাকা ঠিক হবে না। টপ টেররের লিস্টে আমার নাম। আমি ফেরারী আসামী। মৃত্যুদন্ডের  ফরমান ঝুলছে আমার নামে। কিন্তু আমিও ভালো হতে চাই। মুক্তি চাই। স্বাধীনতা চাই। স্বাীধন দেশে স্বাধীন ছেলেরা খেলে জয আনছে। সোনার ছেলেদের সোনার জয়। আমি সোনা হতে পারতাম হয়ে গেলাম আলকাতরা অন্ধ কূপের। এ দেশে না আমার বাবা স্বাধীন করেছিলো। তবে কেনো কুচক্রি নেতারা সে স্বাধীনতা কুক্ষিগত করবে। আর না। কিন্তু কি করার আছে। গ্রামের সেই খামার বাড়ির দিকে হাঁটতে শুর করি আর ভাবি কোথায় আমার সেই ব্যাটটা। সাথেই এনেছিলাম মনে পড়ছে।

ব্যাটাটা পেলাম আমার থাকার ঘরে। ওটা হাতে উঁচিয়ে ভাবলাম আর না। আমিও স্বাধীন হব। হারিয়ে যাব সব নষ্ট থেকে। কেবল থাকবে আমি আর আমার বাবার দেয়া এই ব্যাট। কিন্তু হারিয়ে যাব কোথায়। কোন স্বাধীনতায় খুঁজে পাব মুক্তি,  সে কি কেবল মৃত্যু নামক কোন ভিন্ন স্বাধীনতায়? চারপাশের এই সব স্বাধীনতা আজ যে হয়ে গেছে কুক্ষিগত।

২৬/২/২০১১

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


6 Responses to তারপর হারিয়ে যাব স্বাধীনতায়

You must be logged in to post a comment Login