জুলিয়ান সিদ্দিকী

তিতিক্ষা

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ঘটনার আবর্তে এতটা জড়িয়ে যাবে জানলে কখনোই এ মুখো হতো না রবিউল। কিন্তু এ কথা সে এখন ভাবছে, আসলে না এসেও সে পারছিলো না। কারণ বয়স্ক বন্ধুর কাছে মান খোয়ানোর চাইতে কিছুটা কষ্ট করে হলেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মত কষ্ট করা তার কাছে ঢের সহজ। এখানে না এলে হয়তো বাকি জীবন খোঁটা শুনেই কাটাতে হতো তাকে। পরে কোনো একদিন বেকায়দায় পেলে হাতেম আলি নির্ঘাত বলে বসতো যে, তার কোনো উপকারেই লাগেনি রবিউল।

প্রথমে হাতেম আলির অনুনয়-বিনয় এমনকি দু’একবার ধমক খেয়ে যখন গয়নার সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে পথে নামে রবিউল, তখন কিন্তু এত কিছু ভাববার সময় ছিলো না তার। একটা ঘোরের মধ্যেই সে পথে নেমে এসেছিলো। যাতে তার রওয়ানা হওয়ার বিষয়টি নিজের চোখেই দেখতে পায় হাতেম আলি।

চার-পাঁচদিন আগে হাতেম আলি কিছু একটি নিয়ে প্রথমে রাগারাগি, পরে মারধর করার ফলে গয়না চলে গেছে বাপের বাড়ি। দু’দিন পর হাতেম আলিও গিয়েছিলো শ্বশুরবাড়ি। অনেক কাকুতি-মিনতি করে গয়নার হাত ধরে বলেছিলো, ‘যা হওনের হইছে বউ! এমন আর হইবো না! মাটির দিকে চাইয়া হইলেও আমার লগে চল!’

কিন্তু মন গলেনি গয়নার। সে নাকি বলেছিলো, ‘পরতেক বারই তুমি এমন কথা কইয়া আমারে নিয়া যাও আর তার বাদেই সব ভুইলা যাও!’

হাতেম আলি বলেছিলো, ‘পোলাপানের মুখের দিকে চাওন যায় না!’

গয়নার মনে হাতেম আলির কোনো কথাই রেখাপাত করেনি। বরঞ্চ, উল্টো হাতেম আলিকে বলেছিলো, ‘এইবার আর কাম হইবো না! যারে তুমি দিনরাইত পিডাইতে পারবা, নাকে মুখে গাইল পারতে পারবা, হেমুন বোবা-কালা কাউরে নিকা কইরা আনো! ট্যাকাও পাইবা বেশি! আমি তের বছর সহ্য করছি, আর পারি না!’

হাতেম আলি যাতে আর কোনো অজুহাত খাড়া করতে না পারে, তাই তার মুখের উপরই দরজার কপাট বন্ধ করে দিয়েছিলো গয়না। উপায় না দেখে হাতেম আলি শাশুড়ির পা চেপে ধরেছিলো। কিন্তু তিনি কোনো সাহায্যই করতে পারেননি জামাতাকে। বলেছিলেন, ‘তোমার কাছে মাইয়ারে বিয়া দিছিলাম জোর কইরা, হেই দুঃখে অহনও কান্দি! মাইয়ার সামনে গিয়া খাড়ামু কোন মুখে?’

নিদারুণ অপমান আর ব্যর্থতার গ্লানি কাঁধে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরে এসে শেষ উপায় হিসেবে রবিউলকে চেপে ধরেছিলো হাতেম আলি। কিন্তু রবিউল কী করে জানবে গয়নার মনের কথা? স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়ই তো এমন রাগারাগি কিংবা ঝগড়া-ঝাঁটি হয়। পরে আবার ঠিকও হয়ে যায়। কিন্ত এবার কোন কারণেই বা গয়না এতটা শক্ত হয়েছে, তার বিন্দু-বিসর্গও জানে না সে। তা ছাড়া হাতেম আলিও এবার সব কিছু বলেনি খোলাসা করে। অবশ্য গয়নার নিজের মুখ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে রবিউলের মনে কিছুটা হতাশা আর অনিশ্চয়তা মিলে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে। নিজের অজান্তেই সে বিড়বিড় করে বলে, ‘ভাবি কি সব কথা কইবো?’

নিজকে প্রশ্ন করতে পারলেও নিজ থেকে এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না সে। শেষে বিকল্প ভাবনার কাছেই আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়, ‘না কইলেই কি! আমি তো তার এমন কোনো আপন মানুষ না!’

উঠোনের কোণে কাঁঠাল-ছায়ায় পাটিতে বসে অন্তর্গত ভাবনার জগতে বুঁদ হয়েছিলো রবিউল। কিন্তু সময় ক্ষেপনের সাথে দুটো একটি করে শুকনো কাঁঠালপাতা ঝরে পড়তে পড়তে তার চারদিকে একটি বৃত্তের মত তৈরী হয়েছে। বৃত্তের মাঝে বসে তার মনে হয় যে, শুকনো-ব্যর্থ আর মৃত পাতারা কি তার চতুর্পার্শ্বে দেওয়াল তুলে জানিয়ে দিতে চাচ্ছে আসন্ন পরাজয়ের আগাম বার্তা?

সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়লেও কাউকে সে দ্বিতীয়বার দেখতে পায় না। ভাদ্রমাসের প্রচণ্ড দাবদাহে একটু পরপরই তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। পাশে রাখা পেতলের বদনি থেকে পানি মুখে নিলেও সে শীতলতার পরশ থেকে বঞ্চিত হয়। এ মাসের গরমে অতিষ্ঠ কুকুর পানিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। চামার তার সংগৃহীত কাঁচা চামড়া একদিনের রোদে শুকিয়েই ঘরে তুলতে পারে। তেমনি এক উত্তপ্ত দিনে রবিউল তার গায়ের জামা খুলে গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিয়েছে। প্রচণ্ড তাপ থেকে রক্ষা পেতে গামছাটা ভিজিয়ে চাদরের মত জড়িয়ে রেখেছে গায়ের উপর।

এভাবে অনাহূতের মত বার-বাড়িতে পড়ে থাকার অপমান টের পেলেও সে বোঝে যে, কেন এ বাড়ির মানুষ তার সাথে বৈরী আচরণ করছে। কেন ইচ্ছে করেই দেখা করছে না কেউ। আর এমন ব্যাপারগুলো তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হয়। কেন না, কোনো মেয়ে যদি স্বামীর বাড়িতে অত্যাচারিত আর অপমানিত হয়ে বাপের বাড়ি চলে আসতে বাধ্য হয়, সে মেয়ের স্বামী তো দূরের কথা, স্বামীর আত্মীয়-কুটুম্ব এমন কি বন্ধু-বান্ধবও নির্যাতিতার বাপের বাড়িতে ঠাঁই পাওয়া অনুচিত। সে ক্ষেত্রে হাতেম আলির বন্ধু বা গ্রমের মানুষ হিসেবে রবিউলের সঙ্গে এরা যথেষ্ঠ ভালো আচরণ দেখিয়েছে। ভদ্রতা বা সৌজন্য প্রকাশেও কোনো অংশে পিছিয়ে থাকেনি। প্রথমে গয়নার ভাই ইসমাইল এক গ্লাস শরবত হাতে করে এসে কুশল-বার্তা জিজ্ঞেস করেছে। রবিউলের শরবত খাওয়া হয়ে গেলে বলেছিলো, ‘বেয়াই, যেই গরম পড়ছে, ঘরে বেশিক্ষণ বসতে পারবেন না! চলেন গাছের ছাওয়ায় গিয়া বসি!’

বাইরে কাঁঠাল-ছায়ায় পাটি বিছিয়ে রবিউলের সাথে ইসমাইলও কিছুক্ষণ বসেছিলো। রবিউলের ঘনঘন পিপাসা পেলে সে নিজে গিয়ে পেতলের বদনি ভরে চাপকল থেকে ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসেছে। সাথে একটি বাটিতে করে কিছুটা চিড়া-গুড়। এক সঙ্গে বসে খেয়েছেও। কিন্তু একটু পরই সে উঠে পড়ে বলেছিলো, ‘আমি একটু আসতাছি। আপনে কিন্তু না খাইয়া যাইবেন না!’

তারপর ইসমাইল আর ফিরে আসেনি। তা ছাড়া মাওই তাকে অপেক্ষা করতে বলে নামাজ পড়তে গেছেন। কিন্তু নামাজ পড়তে কতক্ষণ লাগে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই রবিউলের। একাএকা বসে পানি আর চিড়া-গুড় খেতে তার ভালো লাগছিলো না। কিন্তু বসে না থেকেও বা সে করবে কি? এই একটি বাড়ির লোকজন ছাড়া বলতে গেলে বাকি সবাই তার অপরিচিত। এ অসময়ে সে কোথায় যাবে, কার সাথেই বা আলাপ করবে? তা ছাড়াও গ্রামের ভেতর একজন অপরিচিত লোককে ঘুরঘুর করতে দেখলে, সেটা কেউ স্বাভাবিক বলে মেনে না।

ইসমাইলের কাছ থেকে রবিউল যখন জানতে পারলো যে, গয়নাকে এবার বাঁশ দিয়ে পিটিয়েছে হাতেম আলি। তাই এমন একজন অমানুষের ঘরে তার বোনকে আর ফিরে যেতে দেবে না। তখন থেকেই রবিউলের খুব রাগ হতে থাকে হাতেম আলির উপর। বিয়ের এতগুলো বছর পার হয়ে গেল, বাচ্চারা প্রায় বড় হয়ে গেছে সবাই আর তাদের সামনেই কিনা তাদের মাকে পেটায় বাঁশ দিয়ে? এমনটা কোন স্ত্রীই বা সহ্য করবে? আর এ ধরনের ঘটনা দেখলে তাদের সন্তানরাই বা শিখবে কি? তা ছাড়া বউ পেটানো কি পুরুষালী কাজ? এতটাই কি নারাধম হয়ে গেছে হাতেম আলি? অভাব-অনটন কি তাহলে মানুষের মনুষ্যত্ব ও ক্ষয় করে দেয়? রবিউল তো বিয়ের দশ বছরের মধ্যে জনু অর্থাৎ জয়নাবের উপর যে কবার হাত তুলেছে, তাও হাতে গোণা। যেটা ঘটেছে নিতান্তই দূর্ঘটনার বশে। কখনও বা বাধ্য হয়ে।

মানুষ অনেক সময় রাগের বশে হুঁশ-জ্ঞান হারিয়ে বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। সজ্ঞানে মানুষটা কখনোই যা করতে পারতো না বা মুখ দিয়ে প্রকাশ করতে পারতো না, তেমন অবস্থায় দু’একটি চড়-থাপ্পড়ে মানুষটার বাস্তবতা বোধ ফিরে আসে। এমন ধরনের ব্যাপার তাদের জীবনে ঘটেছে মোটে চারবার। তাও হাতেম আলিদের মত বাড়ি থেকে পাড়া, পাড়া থেকে গ্রাম, এমনকি গ্রমের বাইরে ছড়ানোর মত ব্যাপার নয়।

স্ত্রীর গায়ে হাত তুলবার যে যাতনা, তা কেবল বোধ-সম্পন্ন অনুতপ্ত স্বামীরাই বলতে পারে। বউ পেটানোকে যারা নিত্য-নৈমিত্তিক ডাল-ভাতের মত মনে করে, এক অর্থে তাদের ঘৃণা করে রবিউল। হাতেম আলি তার বন্ধু হলে কি হবে, এই একটি দিক দিয়ে বন্ধুকে পছন্দ করে না। সে কথা হাতেম আলিকে জানিয়েছেও অনেকবার। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। হাতেম আলি সে কথা মনে রাখতে পারে না। তাই এবার সে গয়নার কাছ থেকে ফিরে এসে রবিউলের হাত ধরে কেঁদে ফেলেছিলো।

দুই

‘বেয়াই দেহি ঘাড় ফালায় দিছেন!’

একটি নারীকণ্ঠে চমকিত হয়ে ফিরে তাকায় রবিউল।

পাশে দাঁড়িয়ে আছে গয়নার চাচাতো বোন খইয়া। খইয়ার ভালো নাম অবশ্য একটি আছে। খায়রুন নেছা। আদর করে বা সংক্ষেপ করে ডাকতে গিয়ে নামের এমন বিকৃতি ঘটেছে। রবিউলের কাছে নামটা বিকৃত বা তাৎপর্যহীন বলে মনে হয় না। খলসে বা খইলসা মাছের চালু বা আঞ্চলিক নাম খইয়া। তাই সে বলে, ‘খইলসা কহন ভাইস্যা উঠলো?’

নামের মত আকৃতিও সংক্ষিপ্ত খইয়ার। শাড়িতে তাকে কাপড়ের পুটলির মত দেখায়।

খইয়া বললো, ‘পানি যেমন ঘোলা আর গরম করছেন, না ভাইস্যা করমু কি?’

খইয়ার কথায় রীতিমত ঝড়ের আভাস পায় রবিউল। তবুও বলে, ‘বেয়াইনের কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না!’

‘বুঝছেন ঠিকই, অখন বিপদ দেইখ্যা চোখ বুইঞ্জা রইছেন আর কি!’

রবিউল কী বা বলতে পারে? এখন মাথা গরম করে ঝগড়ায় মাতলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। সে খইয়ার সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

খইয়া পাটির এক কোণে হাঁটু গেঁড়ে বসে ফের কথার ছুরি শানায়। ‘একটা কথা কই বেয়াই, মনে কিছু কইরেন না!’

রবিউল হাসিহাসি মুখ নিয়ে খইয়ার কথা ধরতে চেষ্টা করে।

‘আপনেরা পুরুষ হইয়া পয়দা হইছেন দেইখ্যা কি এতটাই বে-শরম হইতে হইবো? নাকি আল্লাতালাই এমন নিলাইজ্যা মাটি দিয়া বানাইছে বুঝি না! কিন্তু তাই বইল্যা কি সইর্ষার দানার মতন লাজ-শরমও থাকবো না?’

রবিউল খইয়ার সুন্দর মুখের বিশ্রি ভাবভঙ্গি আর কথার তিক্ততায় অস্থির হয়ে বলতে বাধ্য হয়, ‘আপনে এমন কইরা কইতাছেন য্যান আমিই হাতেম আলি!’

‘নাম আর সুরত আলাদা হইলেই কি সব আলাদা হয় বেয়াই? হয় না! ওই মানুষটার মুখের উপরে দরজা দিয়া দ্যাওনের পরও কোন মুখে আবার আপনে আইলেন? গয়না কি আপনের ভাত খাইবো, না আপনের লগে ঘর করবো?’

রবিউল কিছুটা ভাবে। খইয়া তাকে যে প্রশ্নের ফাঁদে ফেলেছে, জবাব না দিয়ে তার নিষ্কৃতি নেই। তবুও সে বর্তমান জটিল পরিস্থিতিকে লঘু করার জন্য বলে, ‘বেয়াইন, মানুষ রাগ অইলে বা চেতলে অনেক কিছুই করে, কয়ও! পরে মাথা যখন ঠাণ্ডা হয় সবই ভুইল্যা যায়! এই যেমন আপনে আমারে কতগুলা কথা কইলেন, সবগুলাই রাগের কথা!’

‘আমি রাগের কথা কইতাছি না, কইতাছি বিচারের কথা! ন্যায় অন্যায় বইল্যা কথা আছে না!’

‘তাইলে বেয়াইন আপনে আমার উপরে অবিচার করতাছেন! অন্যায়ও করতাছেন!’

খইয়া হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে হাঁটুর উপর ভর করে সোজা হয়ে বললো, ‘উচিত কথায় মাঙ্গে ব্যাজার! উচিতটা আমার বাপেরেও ছাড়ি না!’

খইয়ার কথায় রবিউল হেসে উঠে একবার চারদিকে চোখ বুলায়। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আর কিছুক্ষণ পরই দৃশ্যমান সবকিছু তলিয়ে যাবে গাঢ় অন্ধকারে। আশপাশের ঘর আর গাছ-গাছালির আড়ালে অনেক কৌতুহলী মুখ। সবাই নারী। বিভিন্ন বয়সের। এরা খইয়ার কণ্ঠের ঝাঁঝালো বাক্যে আকৃষ্ট হয়ে মজা দেখতে এসেছে। এমন একটি সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। উচিত কথার প্যাঁচে পড়ে খইয়া কেমন জব্দ হয়, তা দেখার লোভ সংবরণ করতে পারে না রবিউলও। উপস্থিত সবাই যাতে কথাগুলো শুনতে পায় তাই সে কিছুটা জোরেই বলে, ‘উচিত তো আমিও কইতে পারি বিয়াইন, আপনেও যে দুধের ধোওয়া কলাপাতা না, তাও জানি! তয়, আপনেও শুইনা রাখেন বেয়াইন, পায়েস যত মজা কইরাই পাক করেন না ক্যান, পচলে কিন্তু সবটাই ফালানি যায়!’

খইয়া এতটাই আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছিলো যে, রবিউল কী বোঝাতে চাচ্ছে, তা ভালো মত খেয়াল না করেই বলে উঠলো, ‘আপনে আবার কী উচিত কইবেন, আমি কি চাড়াল-নাপিতের মাইয়া? এমন কিছু করি না যে, মুখ তুইল্যা কেউ কিছু কইতে সাহস পাইবো!’

রবিউল কণ্ঠস্বর পরিবর্তন না করেই বললো, ‘হেই কথা কি ভুইল্যা গেছেন? যেইবার আপনে শ্বশুরবাড়ি থাইক্যা পলাইয়া আইসা পড়ছিলেন? আপনের সোয়ামী কিন্তু আপনেরে নিতে আসে নাই! একমাস বাদে বুঝাইয়া শুনাইয়া আপনেরে নিয়া গেছে আপনের ভাশুরের পোলা আমিনুল। আপনে তো তার ভাতও খান না, তার লগে ঘরও করেন না! তার চাচার লগেই সংসার করতাছেন!’

খইয়া হঠাৎ করেই কোনো জবাব দিতে পারে না। কিছু বলতে চেষ্টা করতে গিয়েও কাশির দমকে তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। সঙ্গেসঙ্গে আড়াল থেকে কারো চাপা হাসির শব্দ ভেসে আসে।

রবিউল বেশ মজা পায়। মনেমনে বলে, এহন তোমার ফটফটানি কই?

খানিক পর ধাতস্ত হয়ে খইয়া বললো, ‘ওইডা আমার ভাশুরের পোলা। আপন মানুষ! আপনে হইলেন গিয়া বিনারা পুরুষ। আপনের লগে এই রাইত বিরাইতে গয়নারে যাইতে দিলে মানুষে কইবো কি?’

‘আমিও গয়নার কম আপন না! তয় আমার লগে তারে নিয়া যাওনের মত না-হক কথা আমি কইতে যামু ক্যান? গয়নার সোয়ামী আছে, ভাই-বইন আছে, তারা কেউ লগে যাইবো!’

রবিউলের কণ্ঠস্বর কিছুটা ঝিমিয়ে আসে যেন। মিয়ানো কণ্ঠে আবার বলে, ‘যেই কাম করলে দশজনে মন্দ কইবো, এমন কাজ করতে যামু ক্যান?’

খইয়া যেন কথা হাতড়ে ফেরে। কিছু বলতেও উৎসাহ হারিয়ে ফেলে যেন। বারবার ঢোক গিলে পূর্বেকার উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। হয়তো বা মনে মনে পালাবার পথ খোঁজে। কিন্তু হঠাৎ করেই বা সে যায় কি করে? তাই আপসের সুরে বলে, ‘বেয়াই, মনে কইরেন না আমি আপনের দুশমন! আমি কিন্তু এত কথা কইলাম কথার কথা। মনে রাইখেন না কিছু!’

রবিউল বললো, ‘আমি কি কমু, আপনে আইসাই তো ঝগড়া শুরু কইরা দিলেন!’

খইয়া সে কথার ধারে কাছেও না গিয়ে বলে, ‘গয়নার লগে আপনের দেখা হইছে?’

‘হইছে।’

‘কি কথা হইলো?’

‘তেমুন কিছু না। কইলো দেরি করতে। আমার লগে নাকি তার অনেক কথা আছে!’

‘তাইলে আপনে বাইরে বইসা আছেন ক্যান? ঘরে গিয়া বসেন!’

‘মাওই মায় নমাজ পড়তাছেন। তা ছাড়া বাইরেই ভালা লাগতাছে। গরম কেমুন পড়ছে দেখতাছেন না? এখন ঘরে ঢুকন মানে জেলখানায় ঢুকন!’

ওদের কথার মাঝখানেই গয়না কুপির আলো হাতে এসে বলে, ‘রবিউল ভাই, কল পাড়ে চলেন। হাত-পাও ধুইয়া লন!’

তারপর খইয়ার দিকে ফিরে বলে, ‘তর কাইজা শ্যাষ হইছে?’

খইয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে গয়নার মুখের দিকে।

গয়না বিরক্ত হয়ে বলে, ‘চোখ পাকাইয়া দেখস কি?’

‘কী আর দেখুম! যার লাইগা চুরি করলাম, হ্যায় কয় চোর!’

কিন্তু গয়না খইয়ার সঙ্গে বিতর্কে না গিয়ে ফের রবিউলকে তাড়া দিয়ে বলে, ‘উঠেন না ক্যান?’

‘আমি তো বেশি দেরি করতে পারমু না! জনুরে কিছু কইয়া আসি নাই!’

গয়না বললো, ‘একলা পুরুষ মাইনষ্যের দিন কি আর রাইত কি! মাইয়া মানুষের না যত রকম বিপদ!’

‘হেই লাইগ্যাই তো রাইত বাইড়া যাওনের আগে আগে বাইত্যে ফিরা যাইতে চাইতাছি!’

‘রাইতে জোনাক আছে, যাইতে পারবেন!’

‘আপনে বুঝতে পারতাছেন না! জনু…’

গয়না রবিউলকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ‘এত পাগল হইছেন ক্যান?’

রবিউল আপন মনে হাসে। কিন্তু কিছু বলে না। গয়নার পিছুপিছু কল-পাড়ের দিকে হাঁটতে থাকে। কলের পাশে এসে গয়না এক হাতে কুপি ধরে অন্য হাতে কল চাপে।

রবিউল বললো, ‘আপনে সইরা খাড়ান ভাবি, আমি নিজেই চাপতে পারমু!’

গয়না হয়তো বিরক্ত হয় বা প্রিয় মানুষের জন্য কিছু করার বাসনায় বলে, ‘এত কথা কইয়েন না তো!’

কলের হাতলে চাপ দিতেই গলগল করে পানি উঠে আসে।

রবিউল কিছু না বলে সে পানিতে হাতমুখ ধোয়। চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দিতেই পানির শীতল পরশের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় তার। ইচ্ছে হয় বেশ কিছুক্ষণ শরীর ভিজিয়ে গোসল করতে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা বিরূপ বলেই হয়তো তার ইচ্ছেটা তত প্রবল হয় না। পা ভিজিয়ে এক হাতে ডলেডলে পরিষ্কার করে।

এরই মাঝে বার কয়েক গয়নার আঁচল খসে পড়লে তা সামলানোর ফাঁকে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হলেও রবিউল মুখ তোলে না।

পাশাপাশি দুটো মানুষ। অথচ কলের হাতলের ভৌতিক শব্দ আর পানির ছপছপ শব্দ ছাড়া ভিন্ন কোনো শব্দ শোনা যায় না। আশপাশের অনেক গ্রাম পল্লী বিদ্যুতায়ণের আওতায় চলে এলেও এ গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ এসে পৌঁছোয়নি। যে কারণে সন্ধ্যার পরপরই ঝুঁপ করে রাত্রির গভীরতা এসে হামলে পড়ে পুরো গ্রামের উপর। ঘন ঝোঁপ-ঝাঁড়ের কাছাকাছি চোখে পড়ে জোনাকীদের উল্লাস। গয়নার হাতে কুপির আলো ধরা থাকলেও গয়নার মুখ দেখতে সংকোচ হয় রবিউলের। সে নিচু হয়ে আস্তে আস্তে পা রগড়ায়।

‘পোলাপানগুলা কি বেশি কান্দাকাটি করতাছে?’

কলের হাতল চাপতে চাপতে গয়না হঠাৎ কথা বলে উঠলো।

রবিউল তেমন নিচু থেকেই বলে, ‘হুঁ!’

‘রান্দা-বাড়া করে কেডা? ময়না?’

‘না।’ নির্বিকার ভাবে মিথ্যা বলে রবিউল।

গতকাল সকালের দিকে ভাতের ফ্যান ঝড়াতে গিয়ে হাঁড়ি ফেলে দিয়েছে ময়না। ভাতের ফ্যান আর গরম ভাত লেগে তার হাত-পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। সে পোড়া ক্ষতে বাতেনের কাছ থেকে জাম্বাক এনে লাগিয়ে দিয়েছে রবিউল। ময়নার হাত-পা পোড়ার কথা গয়নার কাছে উত্থাপন করে না সে। হয়তো সত্যি কথা না বলে ভুলই করলো। কিন্তু কেন যে কথাটা গোপন করলো, তার কোনো ধরনের ব্যাখ্যা তার জানা নেই। তবুও বলে, ‘রান্দা-বাড়া সব হাতেম ভাইই করে!’

‘মানিকরে কি খাওয়ায়? চাইলের গুড়ি করতে লইছিলাম…’

গয়না কথা শেষ না করেই কি মনে করে থেমে যায়।

মানিক ভাত খেতে পারে না তা নয়। সে ভাত খেতে চায় না। তরকারি বা ডাল মেখে ভাত মুখে দিয়ে দিলে সে হা করে থাকে। চিবোতে চায় না। হয়তো ঝালের ভয় তাকে ভাত খাওয়া থেকে বিরত রাখে। হাতেম আলি পুরুষ হিসেবে কাঠ-খোট্টা বলেই হয়তো গয়নার মত বাবা না! সোনা না! বললেও মানিক উৎসাহ পায় না। শেষে হাতেম আলির ধমক খেয়েই মূলতঃ সে খাওয়া আরম্ভ করেছিলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কান্নাও জুড়ে দিয়েছিলো।

রবিউল সে দৃশ্যটাই দেখেছে। তাই সে গয়নাকে বলতে পারে, ‘দেখছি ধমক-ধামক দিয়া ভাত খাওয়াইতে!’

এ কথা শুনে গয়নার বুক ফেটে যায়। মানিকের ভীত আর অসহায় মুখ কল্পনা করে তার হাত আপনা আপনিই স্থির হয়ে পড়ে। দু’চোখ ভেসে যায় পানিতে।

রবিউল বুঝতে পারে গয়নার মানসিক অবস্থা। তাই সে নিজেই কল চেপে হাত-পা ধোওয়া শেষ করে বলে, ‘চলেন ভাবি!’

রুদ্ধকণ্ঠে গয়না বললো, ‘আপনের হইছে?’

‘হ, হইছে! আপনে আগান!’

কাল দুপুর থেকেই গয়নার মন কেমন অস্থির অস্থির হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে মরছে। মনে হয় সারা শরীরে যেন কেউ মরিচ মাখিয়ে দিয়েছে। গতবার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনে তড়িঘড়ি ছুটে এসেছিলো গয়না। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর বিকেলের দিক থেকেই তার সারা গায়ে আরম্ভ হয়েছিলো মরিচের মত জ্বলুনি। সে সঙ্গে কিছুক্ষণ পরপরই বুক ফেটে আসছিলো কান্না। ইচ্ছে হচ্ছিলো আকাশ-বাতাস ফাটিয়ে চিৎকার করে মাটিতে গড়িয়ে কাঁদতে। কিন্তু সে ভেবেছিলো যে, বাবার মৃত্যুর কারণেই বুঝি তার এমন মনে হচ্ছে। অথচ পরদিন রবিউলই খবর নিয়ে এসেছিলো যে, তার ছোট মেয়ে কুসুম পানিতে ডুবে মারা গেছে।

মায়ের মন সন্তানের অমঙ্গলের কথা বিপদ-আপদের কথা আগে থেকেই বুঝতে পারে। যে দেহের জঠর থেকে রস শুষে নিয়ে একটি ভ্রূণ রূপান্তরিত হয় মানব শিশুতে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর তার খারাপ কিছু হলে জঠরধারী শরীরেই সর্বাগ্রে সংকেত আসে। অনেক সময় বিক্ষিপ্ত থাকার কারণে সে বার্তা মনে পৌঁছুতে পারে না। তখন শরীরের বিভিন্ন স্নায়ূতে অনিয়মিত সংকেত সঞ্চালনের ফলেই মরিচের মত জ্বালা অনুভূত হয়। কিন্তু মাতৃমন বুঝতে পারে না সন্তানের বিপদের ধরন। গয়নার মনও হাতেম আলির দুর্ব্যবহারের কারণে আগে থেকে বিক্ষিপ্ত ছিলো বলে, সে কেবল অনুভবই করতে পারছিলো যে, একদা তার জঠর বাসিনী বিপদগ্রস্ত। কিন্তু সেটা কোন ধরনের বিপদ তা আগাম অনুমানের ক্ষমতা বিধাতা তাকে দেন নাই। এখন যদিও সে বুঝতে পারছে যে, তার কোনো একটি সন্তানের খারাপ কিছু ঘটে গেছে, কিন্তু কী ধরনের খারাপ সেটা তার জানা নেই। সবচেয়ে বড় ভরসা রবিউল। কারণ খারাপ কিছু হলে রবিউল নিশ্চয়ই তাকে বলতো। যেহেতু রবিউল এমন ধরনের কিছু বলেনি, তাহলে তারা ভালই আছে। তার অস্থিরতা হয়তো ভিন্ন কোনো কারণে। তবুও তার চোখ দিয়ে কেবল পানি ঝরতে থাকে। মাঝে মাঝে চোখে আঁচল চেপে ধরে সে। ঘরে ফিরবার পথে বিনবিন করে কিছু বলে। হয়তো বিলাপই করে। রবিউল পেছন থেকে কিছু বুঝতে পারে না।

তিন

গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক বাড়িতে অতিথিকে না খাইয়ে বিদায় না দেওয়ার চল রয়ে গেছে। অতিথি যেমনই হোক, তাকে আপ্যায়ন করাবেই। এই যেমন গয়নার বাপের বাড়ি। রবিউল যতই বলে যে, খাবে না। কে শোনে কার কথা! হাতেম আলির শাশুড়ি অর্থাৎ গয়নার মা পাটি বিছিয়ে রবিউলের জন্য খাবার দিয়ে বললেন, ‘তুমি না খাও, পাতে বইয়া এক লোকমা মুখে দ্যাও!’

মুরুব্বী মানুষের অনুরোধ চক্ষুলজ্জার খাতিরে হলেও অনেক সময় রক্ষা না করে পারা যায় না। তাই রবিউলকে বাধ্য হয়েই পাতে বসতে হয়।

হাতেম আলির শাশুড়ি মেয়েকে বললেন, ‘তুই রবিউলরে বাইড়া খাওয়া! আমি যাইতাছি মজির মায়ের কাছে!’

গয়না বিরক্ত হয়ে বলে, ‘মজির মায়ের কাছে অহন কি কাম?’

‘হ্যার নাকের জিনিস হারাইয়া গেছে। কান্দা-কাটি কইরা উঠানের মাটি সব আউলাইয়া ফালাইতাছে!’

খাবে না বললেও খেতে বসে রবিউল বুঝতে পারে যে, বেশ ক্ষিদে পেয়েছে তার। ভাতের থালা সামনে

নিয়ে পাটির উপর জোড় আসন হয়ে বসে বললো, ‘নাকের জিনিস হারাইলে এমন কি ক্ষতি? দাম তো বেশি না!’

রবিউলের পাতে ভাত তরকারি ঢেলে দিয়ে গয়না বললো, ‘দাম কম বেশি কথা না, এইডা একটা কু-লক্ষণ!’

‘ঠিক বুঝলাম না।’

‘নাকের জিনিস হারাইলে সোয়ামীর আয়ূ কমে। কোনো কোনো বউ বিধবাও হয়!’

গয়নার কথা শুনে রবিউল জোরে হেসে উঠে বলে, ‘নাকের জিনিসের লগে সোয়ামীর আয়ূর কি সমন্দ! যারা নাকে কোনোদিন জিনিসই পিন্দে নাই, তারা কি কইবো?’

গয়না কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘হেইডা আপনে বুঝবেন না!’

‘আমার বুইঝ্যা কামও নাই’ বলে, রবিউল খাওয়া আরম্ভ করে।

খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে রবিউলের পাতে এক চামচ ভাত, কখনো একটু তরকারির ঝোল ঢেলে দিয়ে গয়না বলে, ‘রান্দা কেমুন হইছে?’

‘ভালই!’

তারপর ভাত খেতে খেতে রবিউল খুব সাবধানে তাদের ঝগড়ার প্রসঙ্গ এড়িয়ে এটা ওটা জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ঘুরেফিরে সে ঝগড়ার প্রসঙ্গই উঠে আসতে চায় বারবার। রবিউল চায় না প্রসঙ্গটা এখনই উঠুক। তাই সে বলে, ‘আইজ তো রাইত হইয়া গেল। আমি চইলা গেলে আপনে রাইতটা চিন্তা-ভাবনা করেন। আর আমি যাইয়া কাইল হাতেম ভাইরে পাঠাইয়া দেই। আপনে কিন্তু দেরি কইরেন না!’

গয়না রবিউলের পাতে দুটো ট্যাংরা মাছ তুলে দিয়ে বলে, ‘আমার চিন্তা-ভাবনা শ্যাষ!’

এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে গয়নার নাকের পাটা দুটো কেমন ফুলে উঠলো। ‘আমি ঠিক করছি ময়নার বাপের লগে আর সংসার করমু না! এই তের বচ্ছরে মানুষটা আমারে জ্বালাইতে জ্বালাইতে আঙরা কইরা ফালাইছে!’

রবিউল আস্তে-ধীরে খায়। সে সঙ্গে কিছুটা ভেবে নিয়ে বলে, ‘আপনের এত বচ্ছরের সংসার, হেইডা কি একদিনেই ভাইঙ্গা ফালাইবেন? সংসারডারে গুছাইয়া লইতে কি আপনের কষ্ট হয় নাই?’

গয়না কিছুটা পিছনের দিকে সরে বসে।

তারপর বলে, ‘এই সংসারডায় তো খালি কষ্ট কইরাই গেলাম! কিন্তু কী পাইলাম, কইতে পারেন?’

রবিউলের সে কথা জানবার কথা নয়। কিন্তু গয়না থেমে থাকে না। ‘না পাইলাম ঠিক মতন খাওন-পিন্দন, না পাইলাম অসুখ-বিসুখে অষুধ-পথ্য! কোন আশায় এমন একটা অভাবের ঘরে ফিরা যামু?’

‘ভাবি, আপনে ভাইব্যা দ্যাখেন যে, এমন একটা মানুষের লগে আপনের বিয়া হইবো, এইডাই আপনের নসিবে আছিলো! আর নসিবের লেখন কি কেউ খন্ডাইতে পারে?’

‘আপনে এইডা কি কইলেন? কিসের নসিব আর কপাল?’

গয়না উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। ‘এইসব তার খাসলতের দোষ! বিয়ার সময় বাপ-মা আমারে পাঁচভরি সোনার জিনিস দিয়া দিছিলো, আলিস্যা মানুষটা এক এক কইরা সব নিয়া বেচলো! আইচ্ছা মাইন্যা নিলাম যে, জিনিস বেচনের ট্যাকা আমারে আর পোলাপানরে নিয়াই খাইছে! কিন্তু ব্যবসা করনের লাইগ্যা যেই সত্তুর হাজার ট্যাকা নিয়া দিছিলাম, হেইডি কারে নিয়া শ্যাষ করলো? মানুষ তার কপাল বদল করনের লাইগ্যা নিজেও তো কিছু চেষ্টা করে, নাকি? ঘরে শুইয়া বইসা থাকলে কি নসিব বদলায়, না ব্যবসা হয়? আপনে অনর্থক নসিবরে দুইষ্যেন না!’

গয়না একবার নাক টেনে আঁচলে চোখ মোছে।

রবিউল গয়নার দিকে চোখ তুলে বলে, ‘আপনে কি কন হাতেম ভাই চেষ্টা করে নাই?’

‘হ! এমন চেষ্টাই করছে যে, আমারে পিডাইয়া ট্যাকা আদায় করনের ফন্দি বাইর করছে! মনে করছিলো এইবারও ট্যাকা নিয়া হ্যার হাতে তুইল্যা দিমু আর হ্যায় ফুটানি মারাইবো!’

গয়না এক হাত কোমরে রেখে আরেক হাত নিজের বুকে রেখে ফের বলে, ‘আমার ভাইয়েরা কি ট্যাকার ক্ষেতি করছে, না আমার বাপ ট্যাকার গাছ লাগাইয়া গেছিলো?’

গয়না হাত নেড়ে তার বক্তব্যকে যেন আরো খানিকটা জোরালো করতে চায়। ‘দরকার হইলে ভাইয়েগো লাথি-উষ্ঠা খাইয়া এইখানে পইড়া পচমু! আতুরা-ল্যাঙড়া মানুষের সংসার করমু, তাও ওই ডাকাইতের লগে আর না! ট্যাকা দিয়াই যদি সোয়ামীর ভাত খাইতে হয়, তাইলে এমন বুইড়া আর কুঁইড়া মানুষের লগে ক্যান, আরো ভালা আর জাতের মানুষ নিয়া আমু!’

গয়নার বক্তব্য শুনে অবাক হয় রবিউল। তবুও তার দৃঢ়তায় ফাঁটল ধরাতেই বুঝি বলে, ‘আপনের পোলাপাইন দিনরাইত আপনের লাইগ্যা কান্দাকাটি করতাছে! হ্যাগো লাইগ্যা কষ্ট পাইবেন না?’

‘কিসের কষ্ট?’

গয়নার চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বের হয়। বলে, ‘কইলজা পাষাণ কইরা ফালামু, নয়তো মনের উপরে পাত্থর চাপা দিয়া থুমু!’

তারপরই অকস্মাৎ গয়নার মনে কি হয়, সে নিজের পরনের কাপড় হাঁটুর উপরে তুলে ফেলে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তড়িতাহতের মত রবিউলের মাথা ঝুঁকে পড়ে ভাতের থালার উপর। সে গয়নার চিৎকার শুনতে পায়, ‘দ্যাখেন, ডাকাইতে পিডাইয়া করছে কি! অ্যাহনো রক্ত শুকায় নাই!’

গয়না হয়তো উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ‘এই যে দ্যাখেন পিঠের উপরে!’

তারপরই রবিউল গয়নার ব−াউজের হুক বা বোতাম ছেঁড়ার পটপট শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সে হুক বা বোতাম ছেঁড়ার শব্দ তার কানে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত হওয়া সর্বকালের নিকৃষ্ট মানুষদের সৃষ্ট বোমার শব্দের চাইতেও যেন দ্বিগুণ হয়ে বাজে, ‘দ্যাখেন আমার অবস্থা! এক্কবারে ফালিফালি কইরা ফালাইছে!’

রবিউল অনুভব করতে পারে যে, গয়না ঘুরে তার মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু তখনও রবিউল মাথা তুলতে পারে না। যেন বিশালাকার কোনো গ্লানির পাহাড় কেউ তার মাথায় তুলে দিয়েছে। সে অবস্থাতেই সে শুনতে পায় গয়নার কণ্ঠস্বর, ‘আপনে যে কন, ওই ডাকাইতের পোলাপানের লাইগ্যা আমার কষ্ট লাগবো! ক্যান লাগবো? মানুষ যে চোর ডাকাইতরে মারে, তাগো অবস্থাও তো এমন হয় না!’

যদিও গয়না তার শরীরের অংশ বিশেষ উম্মুক্ত করেছিলো রবিউল দেখবে বলে। নির্যাতনের চিহ্ন কতটা গাঢ় তা নিয়ে মন্তব্য করবে বলে। কিন্তু রবিউল গয়নার শরীরের উম্মুক্ত অংশের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। হয়তো চেষ্টা করলেও পারতো না। তার মনের কোনো এক অংশে দাঁড়িয়ে বিবেক বা মনুষ্যত্ব বোধ তার মাথা ঠেসে ধরেছিলো নিচের দিকে। তার তখন মনে হচ্ছিলো, এমন দৃশ্য দেখা পাপ! যেহেতু গয়না সজ্ঞানে এমনটি করেনি। শত প্রলোভনেও এমন করার মেয়ে সে নয়!

রবিউল অপেক্ষায় ছিলো গয়না কতক্ষণে শান্ত হয়ে আবার তার সামনে বসবে। কিন্তু গয়না রবিউলের সামনে আর বসে না। চোখ মুছতে মুছতে দ্রুত আর আকস্মিক ভাবেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

গয়না বেরিয়ে যাওয়ার পর এক গ্রাস ভাতও মুখে দিতে পারে না রবিউল। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে ভাত নাড়া- চাড়া করে পানির জগ হাতে বাইরে গিয়ে হাত ধুয়ে ফেলে। মুখের ভেতরটা কেমন তিতকুটে মনে হলে সে মুখে পানি নিয়ে কুলকুচা করে কয়েকবার। কিন্তু তার মুখের ভেতরকার স্বাদ বদলায় না। তবু সে ফিরে এসে তেতো মুখেই গয়নার প্রতীক্ষায় বসে থাকে।

চার

রাত বেড়ে যাচ্ছে।

হয়তো রাত বৃদ্ধির সঙ্গেসঙ্গে বাইরে ঝিঁঝিঁ পোকাদের কান্না গাঢ় থেকে আরো গাঢ়তর হচ্ছে। সামনে উচ্ছিষ্ট ভাতের থালা থাকলেও কুপির নরম আলোর দিকে তাকিয়ে মনেমনে হাতেম আলির চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছিলো রবিউল। আর আজকের এই জটিলতায় নিজকে জড়িয়ে ফেলার অপরিণামদর্শিতার জন্য গাল-মন্দ করছিলো অদৃষ্টকে।

এতদিন সে জেনে এসেছে যে, হাতেম আলি সত্যিই একজন ভালো মানুষ। গ্রমের কোনো বিরোধ হাঙ্গামার সাথে এ পর্যন্ত তার নাম কোথাও উচ্চারিত হয়নি। তেমন একজন মানুষ যার বিরুদ্ধে না বলে কারো কুঁটোটাও ধরার অভিযোগ নেই, তেমন মানুষ কী করে এতটা অন্ধকারে তলিয়ে যেতে পারে?

যতদিন ধরে গয়নাকে জানে রবিউল, তার রাগী আর অভিমানী স্বভাবের কথাই জেনে এসেছে। কিন্তু তার যে এতটা সহনশীল আর ধৈর্যশীল একটি মন রয়েছে, সে সংবাদ কখনও হাতেম আলির কাছ থেকে জানা যায়নি। হয়তো বা গয়নার সে শান্ত দিকটি আবিষ্কার করতে পেরেই দিনকে দিন অসৎ আর লোভী হয়ে উঠেছে সে। যদিও হাতেম আলির ঘরে ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই গয়নার, তবুও কোনোভাবে যদি তার মন গলে আর সে ফিরে যায়, তাহলে ভবিষ্যতে অনুরূপ ঘটনা ঘটলে সে নিজেও দায়ী না হয়ে পারবে না। আর এ দায় একবার তার কাঁধে চাপলে গয়নার সামনে সে কখনোই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। তখনই রবিউলের মনে হয় যে, এ বিষয়ে আগে হাতেম আলির সঙ্গে কথা বলা দরকার। সেখানকার খুঁটি পোক্ত না হলে এদিককার খুঁটি হেলানো সম্ভব হবে না।

গয়না হঠাৎ ঘরে এসে বললো, ‘ভাই, আপনের খাওয়াডা আমি নষ্ট কইরা দিলাম! আবার ভাত দেই কয়ডা? খাইয়া মনে হয় আপনের পেট ভরে নাই!’

রবিউল ত্রস্ত-ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘না না বইন, আমার পেট ঠিকই ভরছে! আপনে নতুন কইরা আর ঝামেলা কইরেন না!’

গয়না ফের রবিউলের সামনে বসলে দেখা যায় যে, গয়না তার শাড়ি ব্লাউজ দুইই পাল্টেছে। চুলে চিরুনিও লাগিয়েছে। চুলগুলো পেছনের দিকে টানটান করে বেঁধেছে নতুন খোঁপা। চেহারায় নেই কিছুক্ষণ আগের সে ভয়াল-রূদ্র রূপ। আধ-ঘোমটায় দেখাচ্ছেও বেশ চমৎকার আর পরিপাটি।

রবিউল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে গয়নার মুখের দিকে।

রবিউলের মুগ্ধতা বুঝতে পারে না গয়না। বলে, ‘চিন্তা করেন কি?’

রবিউল বললো, ‘রাইত বাইড়া যাইতাছে। দেরি হইলে গাড়ি পামু না!’

গয়না কেমন আশাহতের মত বলে, ‘আমার সব কথা তো কইতে পারলাম না! রাইতটা থাইক্যা যান! জোনাকে বইয়া সারা রাইত দুইজনে কথা কমু!’

‘থাকতে পারলে তো ভালাই হইতো! কিন্তু জনু যে ঘরে একলা!’

‘রাইত কইরা যাইবেন, এইডা কি ভালা দেখাইবো?’

‘কোনো উপায় নাই বইন! তয় আপনে আরো ভালো মতন ভাইব্যা দ্যাখেন, এতগুলা পোলাপান আপনেরে হারাইয়া এতিম হইয়া যাইবো। মা ছাড়া বাইত্যে হ্যারা কোই থাকবো, কোই ঘুমাইবো? কে হ্যাগো তত্ত্ব-তালাশ করবো?’

গয়না মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। যেন রবিউলের কোনো কথাই তার কানে প্রবেশ করছে না।

গয়নার নিরবতায় রবিউল আবার বলে, ‘তার উপরে আপনে যাইবেন না এইডাই যদি শ্যাষ কথা হয়, তাইলে ঘরে হতাই মা আইবো। হতাই মা ঘরে থাকলে যে পোলাপানের কেমন দুর্দশা হয় কৌকা আর বুইট্যারে দেইখ্যা বুঝতে পারেন না?’

গয়না রবিউলের উচ্ছিষ্ট ভাতের থালা, ভাত-তরকারির হাঁড়ি-পাতিল গুছাতে গুছাতে বলে, ‘অখন আমি নিজে কিছুই ঠিক করতে পারি না। কিছু কইতেও পারি না। মা আছে, ভাইয়েরা আছে, হ্যারা যেমন কইবো আমারও হ্যামনই করতে হইবো!’

কথাগুলো বলে, গয়না তার বড়বড় দু’চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে। কিন্তু অকস্মাৎ রবিউলের যে কি হয়, চোখ দুটো হঠাৎ জ্বালা করে কেমন টলমল করে ওঠে। আর তা দেখেই বুঝি গয়নার বুকের ভেতর চাপা পড়ে থাকা অবশিষ্ট কান্না চোখের বাঁধ উপচিয়ে গড়িয়ে পড়ে।

একবার চোখ মুছে গয়না আস্তে-ধীরে বলতে থাকে, ‘ময়নার বাপের লগে যখন আমার বিয়া ঠিক হইলো, তখন তার বয়স চল্লিশ। আমি কেলাস সিঙ্ েপড়ি। আমার বয়স তখন খুব বেশি হইলেও চৈদ্দ বছর পার হয় নাই। হেই সময় আমারে একবার কেউ জিগায় নাই যে, বিয়া করতে আমার মত আছে কি নাই! নিজেও মুখ ফুইট্যা কইতে পারি নাই যে, এমন মানুষরে আমি বিয়া করতে পারমু না, তার লগে সংসার করতে পারমু না! বিয়ার সময় নিজের ইচ্ছা বইল্যা কিছু আছিলো না। এখনও আছে বইল্যা বুঝতে পারি না। খালি আমি ক্যান, কোনো মাইয়া মানুষের মনের ইচ্ছার দাম আছে বইল্যা মনে হয় না। তারা যারডা খায়, পিন্দে, যার বাইত্যে থাকে, তাগো ইচ্ছাই সব!’

রবিউলের সামনে আশার শেষ প্রদীপটাও প্রায় নিভতে বসেছে দেখে সে বলে উঠলো, ‘হেইডা মানি! তাও আপনে য্যামনে কইবেন হ্যামনে যদি হাতেম ভাই রাজি হয়, আপনের সব কথা মাইন্যা লয়, তাইলে তো আপনের ফিরা যাইতে আপত্তি নাই?’

গয়না নিরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে যেন। যে কারণে রবিউলের জিজ্ঞাসা তাকে বিচলিত করে না।

রবিউল তার জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর না পেলে উদ্ভ্রান্তের মত গয়নার একটি হাত চেপে ধরে বলে, ‘ভাবি,আপনে ভাইব্যা দ্যাখেন, একটা ঘর ভাইঙ্গা ফালাইতে বেশি সময় লাগে না। কিন্তু ঘরটা বানাইতে না যত সময় লাগে, গুছাইতে লাগে আরো বেশি দিন! তাই কইতাছিলাম, আপনের গুছাইন্যা ঘর ফালাইয়া নতুন কইরা ঘর-সংসার সাজাইতে গেলে হেই মন আর ধৈর্য আপনের হইবো না!’

কথা শেষ করে গয়নার মুখের দিকে রাজ্যের প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে থাকে রবিউল। কিন্তু গয়না হ্যাঁ কিংবা না কোনোটাই বলে না। এমন কি তার ধরে রাখা হাতটিও ছাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করে না।

বিভ্রান্ত রবিউল গয়নার হাত ছেড়ে দিয়ে আবার বলে, ‘কাইল-পরশু হাতেম ভাইরে নিয়া আমু। আমি কথা দিতাছি, পরে এমন ঘটনা ঘটলে সুপারিশ নিয়া কোনোদিন আমু না!’

তারপরই ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায় সে।

ঘর থেকে বের হয়ে উঠোনে নামলে গয়নাও বেরিয়ে আসে। বলে, ‘কামডা বেশি ভালা করলেন না। রাইতটা থাকলে খুশি হইতাম!’

‘আইজ আর না! আপনেগরে নিয়া যেই বিপদে আছি, তা আগে দূর হউক!’

‘মায়ের লগে দ্যাখা করবেন না?’

‘সময় নাই!’ বলে, রবিউল দ্রুতপায়ে বাড়ির ঢাল বেয়ে পাকা সড়কের সংযোগ রাস্তায় উঠে যায়। একবার কি মনে করে যেন থামে সে। মাথা ঘুরিয়ে হয়তো গয়নাকে দেখে। কিন্তু কিছু না বলেই আবার ঘুরে হাঁটতে থাকে।

পূবাকাশে গোলগাল বড় চাঁদ দেখা যায়। চাঁদের আবছা আলোয় রবিউলকে চলে যেতে দেখে গয়না। মনে হয় তার যাবতীয় স্বপ্ন, সুখ-শান্তি আর আশা-আকাঙ্খা মুঠোবন্দি করে নিয়ে যাচ্ছে মানুষটা। গয়নার একবার ইচ্ছে হয়, চিৎকার করে বলে, ‘রবু ভাই, আমারে সঙ্গে নিয়া যাও!’

কিন্তু তার গোপন ইচ্ছে নিরাশ বুকের অন্ধকার গহ্বরেই খাবি খায়। যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুবরণ করছে তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্খা আর স্বপ্ন-ভালোবাসার রঙিন প্রজাপতিগুলো। নারী হয়ে জন্মানোর যে পাপ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর আতুর ঘর থেকে শিরোধার্য করে সে জীবনের এতটা কন্টকিত পথ অতিক্রম করে এসেছে, সে পথ পরিক্রমার অনিবার্য মাশুল হিসেবেই তার সমস্ত ইচ্ছে আর অনিচ্ছার সাদা-কালো পায়রাগুলোকে গলা টিপে হত্যা করতে হবে।

যখন থেকে সে বুঝতে শিখেছে, তখনই জেনে গেছে এ আপ্তবাক্য। এ সত্য কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়নি বা মমতা দিয়েও বুঝিয়ে দেয়নি। সে শিখেছে তার চার পাশের অবরুদ্ধতা থেকে। অবিশ্বাস আর নির্ভরশীলতার হীনতা থেকে। নারী-পুরুষ সবাই মিলে তাকে বুঝতে বাধ্য করেছে যে, তুমি শুধুই নারী। সে কারণেই তুমি পরাধীনা। যার উপর নির্ভরশীল, তুমি তারই ইচ্ছাধীন।

সে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখনই শুরু হয় তার পাত্র সন্ধানের কাজ। মেয়ের কারণে কখন সমাজের কাছে অপদস্ত হতে হয়, সে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন পিতা। মা তার কণ্যাকে কিশোরী থেকে যুবতী করতে ভয় পান। স্কুলে যাওয়ার পথে পাশ থেকে নানা রকম মন্তব্য শুনে মেয়ের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। মা জানতে পেরে মেয়েকে প্রতিবাদ করা বা মাথা উঁচু করা না শিখিয়ে বলেন, ‘মাটির দিকে চাইয়া চুপচাপ হাঁটবি!’

গ্রমের উঠতি বয়সের ছেলে-ছোকরারা বাড়ির সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ বেসুরো কণ্ঠে রূপবানের গান গেয়ে ওঠে। রাতের বেলা দুশ্চিন্তায় পিতা-মাতার ঘুম হয় না। দিনের বেলা মেয়ের কোনো বিপদ হয় কিনা ভেবে, কাজে মন বসাতে পারেন না জননী। মেয়েটি যতক্ষণ স্কুল থেকে ফিরে না আসে, ততক্ষণ পথের উপর চোখ রেখে দোওয়া ইউনুস পড়তে থাকেন।

নয়তো গয়নার ইচ্ছে ছিলো আরো পড়বে। সে সঙ্গে আরও একটি বাসনা ছিলো হাবিব বি.এস.সিকে ঘিরে। যদিও হাবিব তখন ছাত্র মাত্র। ছুটি-ছাটায় বাড়ি এলে অংক আর বিজ্ঞানের ক্লাস নিতো। তবুও কেমন করে যেন ছাত্রাবস্থাতেই তার নামের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিলো বি.এস.সি কথাটি। হাবিবকে কোনো কথা জানানোর সুযোগ বা বয়স তখন হয়নি গয়নার। তার আগেই তার বিয়ের জন্যে হন্যে হয়ে উঠলেন সবাই। কিন্তু কিশোরী মেয়েটির ছোট্ট মনটির ভেতর যে, কোনো গোপন বাসনার কলি প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিলো, তা জানবার কিংবা খেয়াল করার কথা মনে হয়নি কারো।

কিন্তু হায়, হতদরিদ্র হাতেম আলির সংসারে এসে ছ’মাসের মাথাতেই প্রথমবারের মত ছেঁড়া আর ময়লা কাপড় পরা শুরু হয় তার। আশা এবং চেষ্টা ছিলো যে, হাতেম আলির সংসারের দুর্দশা ঘুঁচিয়ে দেবে। তার বদলে এক সময় সে নিজেই হয়ে উঠলো দুর্দশাগ্রস্ত।

বিয়ের আগে যেমন কেউ জানতে চায়নি যে, হাতেম আলির সঙ্গে সে সংসার করতে পারবে কিনা। বিয়ের পরও কেউ একবার জিজ্ঞেস করেনি যে, হাতেম আলির ঘরে তার দিন কাটছে কেমন?

অভাবের সংসারে হাতেম আলির পাশাপাশি একজন সমর্থ পুরুষের মতই হ্যান্ড-ট্রাক্টর অথবা হালের বলদের অভাবে নিজের হাতে কোদাল দিয়ে জমি কুপিয়ে বা একাএকা লাঙল টেনে জমিকে ফসলের উপযোগী করেছে গয়না। জন-কামলার মজুরী জুটাতে না পেরে স্বামীর সঙ্গে সেঁউতি দিয়ে জমিতে পানি তুলেছে। জমির আগাছা নিড়িয়ে নিয়ম মত সার ছিটিয়ে কীটনাশক দেওয়া থেকেও পিছিয়ে থাকেনি। অথচ তার স্বামী এসব শ্রমের অবদানকে কখনও মূল্যায়ন করেনি। এতটুকু সহানুভূতি জানিয়েও স্বীকৃতি দেয়নি কখনও। সে কি হাতেম আলির সংসারে জীবনভর দিয়েই যাবে? সামান্য প্রতিদান কি আশা করতে পারে না? এ জীবনে কী পেলো সে? না ভাত-কাপড়, না সুখ-শান্তি। না সামান্যতম সোহাগ-ভালোবাসা!

অথচ হাতেম আলির জীবনে চৈত্রের খরাদহে এক টুকরো ছায়ার মত লেগে থাকা বা জড়িয়ে থাকা রবিউলকে তার ভালো লাগে প্রথম থেকেই। তার স্ত্রী জয়নাবও অসম্ভব ভালোবাসে স্বামীকে। কিন্তু জয়নাবের আচরণে তা প্রকাশ পায় না কখনো। যদিও বিয়ে তার মনঃপূত হয়নি, তবুও চেয়েছিলো হাতেম আলিকেই ভালোবাসতে। জয়নাবের মত অতটা না হোক, সিকি পরিমাণ হলেও তো চলতো! কিন্তু সে যে ন্যূনতম ভালোবাসাটুকুও দিতে পারে না হাতেম আলিকে! দিতে পারবে কি, চেষ্টা করেও মানুষটাকে কখনও ভালোবাসতে পারেনি সে। তাই সে চেষ্টাও এখন আর করে না।

হাতেম আলির তাড়নার বলি হতে হতে গয়নার গর্ভ স্ফীত হয়েছে বারংবার। কিন্তু কোন সন্তানটি যে হাতেম আলির বাঞ্ছিত, তা নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। অথচ জন্ম দেওয়ার আগেই অনাগত সন্তানের প্রতি পিতার ভালোবাসা আর স্নেহ দুইই থাকা কর্তব্য। এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে গ্রাম্য-অশিক্ষিত আর বর্বর হাতেম আলির বিকট মুখভঙ্গী ও সে সঙ্গে অশ−ীল ভাষার বাচনিক বিভিষীকা কল্পনা করে শিউড়ে ওঠে সে।

দূরের পথচলতি রবিউলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও পরিষ্কার চাঁদের আলোতে সে কাউকে দেখতে পায় না। হঠাৎ করেই কেন জানি তার কান্না পায়। ইচ্ছে হয় খুব জোরে জোরে চিৎকার করে কাঁদে।

পাঁচ

মেয়েরা যতটা স্বল্প পরিসরে গুছিয়ে রান্না করতে পারে, ছেলেরা হয়তো তার দ্বিগুণ পরিসরেও তেমন সুবিধা করতে পারে না। রান্নার প্রায় শেষের দিকে হাতেম আলি চুলোর ভেতর একই সঙ্গে অনেকগুলো শুকনো পাতা আর খড়কুটো ঠেসে দিলে আগুন নিভে গিয়ে প্রচুর ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়। সে সময় চোখ জ্বালা করে উঠলে মানিকও কেঁদে ওঠে। একই সঙ্গে হাতেম আলির চোখও জ্বালা করছিলো বলে ছেলের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার বদলে বিরক্ত হয়ে ধমক লাগালে, হয়তো ভয় পেয়ে সে আরো জোরে কেঁদে ওঠে।

হাতে-পায়ে পোড়া ক্ষত নিয়ে ঘরে শুয়েছিলো ময়না। রান্নাঘরে তার ছোটো বোন কুলসুম রান্নার কাজে বাবাকে টুকটাক সাহয্য করছিলো। কিন্তু সামলাতে পারছিলো না মানিককে। ছোট ভাইয়ের কান্না শুনে ময়না বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। বাইরে দাঁড়িয়েই সে কুলসুমের উদ্দেশ্যে বলে, ‘কুলসুম, মানিকরে দিয়া যা!’

হাতেম আলি রান্নাঘর থেকে বলে, ‘মানিকরে তুই লইতে পারবি না!’

‘হ্যায় যে কানতাছে!’

‘কান্দুক! তুই ঘরে যা!’

কিন্তু ময়না ঘরে যায় না। মানিক কাঁদলে তার সহ্য হয় না। পৃথিবীতে মনে হয় মানিককেই সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। মানিকও তা অনুভব করতে পারে বলেই ময়নার কণ্ঠস্বর শুনে কান্নার বেগ কমিয়ে দেয়। গুটিগুটি পায়ে রান্নাঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর রান্নাঘরের পৈঠা থেকে নেমে একছুটে চলে আসে বোনের কাছে।

হাতের অসুবিধার কারণে ভাইকে কোলে নিতে না পারলেও ময়না নিচু হয়ে অন্য হাতে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে নেয় মানিককে। ভাইয়ের কান্না থামানোর জন্য ময়না বলে, ‘আমার ভাইডা কান্দে ক্যানরে! তুমি অখন বড় হইয়া গেছ না! তুমি কানবা ক্যান? সারাদিন হাসবা! হাসতেই থাকবা!’ বলে, সে মানিকের পেটে সুড়সুড়ি দেয়।

মানিক কান্না ভুলে হেসে ওঠে।

তারপর মানিকের হাত ধরে ঘরের দিকে যেতে যেতে ময়না আবার বলে, ‘আব্বায় মারছে তোমারে?’

মানিক পুরোপুরি কথা বলতে না পারলেও মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।

মানিককে বিছানায় বসিয়ে ন্যাকড়া দিয়ে পা মুছিয়ে দিতে দিতে ময়না আবার বলে, ‘আব্বাডা পচা! সবতেরে মারে! আমরা আব্বার কাছে আর যামু না!’

মানিক মুখে ডান হাতের আঙ্গুল পুরে বলে, ‘আম্মা!’

ময়না বুঝতে পারে ভাইয়ের মনোভাব। ক’দিন ধরে সে তার মাকে দেখতে পাচ্ছে না। শিশুমন সে শূন্যতা ঠিকই অনুভব করতে পারছে। তাই ময়না বলে, ‘আম্মা যাইবা?’

মানিক আবার মাথা দোলায়।

‘আম্মায় দুদু আনতে গেছে। আব্বারে দুদু দিমু না!’

মানিক পা দোলাতে দোলাতে বলে, ‘আব্বা পচা!’

ভাইয়ের কথা শুনে ময়নার মন খারাপ হয়ে যায়। তার বয়স বার হলে কি হবে, সংসারের সমস্যা, বাবা-মার মধ্যকার সংকট সবই বুঝতে পারে। কিন্তু মুখ ফুটে কখনোই কিছু প্রকাশ করে না। তার মতে বাবাই সব সংকটের মূলে। কাজ-কর্ম না করে বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই শুয়ে বসে থাকে। কাজে যাওয়ার কথা বললেই তার মাথা ঘোরে নয়তো শুরু হয় পেট-কামুড়! এর সবই যে কাজে না যাওয়ার ছুতো, সে ঠিকই বোঝে। অথচ রহিমার বাবার হাঁপানি রোগ হলেও কাজ করতে তার কোনোই অলসতা নেই। যেদিন কাজে যাওয়ার জন্য কেউ ডাকতে আসে না, সেদিন রহিমাকে নিয়ে পড়াতে বসে। বাড়ির উঠোন-বার ঝাঁট দেয়। ঘরের ময়লা কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দেয়। কখনও বা ঘরের খুঁটি বা বেড়া মেরামত করে। নিদেন পক্ষে ঝাড়ুটা নতুন করে বাঁধে। সে তুলনায় তার বাবা হাতেম আলি লোকটা যেন কেমন। বাবা হলেও যেন অন্য বাড়ির মানুষ বলে মনে হয়।

রান্না শেষ হয়ে গেলে হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে ঘরে আসে হাতেম আলি। ছেলেটা হাতের মুঠোয় ময়নার জামার প্রান্ত আঁকড়ে ধরে ঘুমুচ্ছে। মানিকের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতেম আলি। মনেমনে বলে, ক্যান যে মাথাডা এত গরম হইয়া যায়, এই কয়দিনে পোলাপানের চেহারা-সুরত কী হইছে!

ঘুমন্ত মানিকের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মনেমনে প্রতিজ্ঞা করে হাতেম আলি, বাঁইচ্যা থাকলে গয়নার গায়ে আর একটা টোকাও দিমু না! এখন থাইক্যা কাজ-কর্মের চেষ্টা-তদ্বিরও কিছু করতে হইবো। পরক্ষণেই কিছুটা উদ্বিগ্ন ভাবে উঠোনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে। ভাবে, রবু কি কাইল যায় নাই? অখনও তো কোনো খবর-বার্তা নিয়া আইলো না!

সে উদ্বিগ্ন ভাবেই ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটে। মনেমনে ঠিক করে যে, বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেলে, একবার নিজেই যাবে রবিউলের কাছে। গয়না রবিউলকে খুবই মান্য করে। তার কথা ফেলতে পারবে না।

বাবাকে কিছু একটা নিয়ে ভাবতে দেখে ময়না বললো, ‘মানিক ঘুমে থাকতে থাকতে তুমি গোসল সাইরা আসো আব্বা! তুমি আইলে তার বাদে আমি যামু!’

‘না। তর গোসল করতে হইবো না। ঘাও শুকানের আগে পানি লাগলে ডর আছে!’

‘ঘাও শুকাইতে লাগবো একমাস। এই একমাস কি আমি গোসল করতে পারমু না?’

‘এতদিন লাগবো না!’

‘চাচি যে, কইলো!’

‘তর চাচি কিছু জানে না! তর রবু কাকা যেই মলম আইন্যা লাগাইছে, আমি আইজই একটা আইন্যা দিমু। আল্লায় করলে তাড়াতাড়িই ভালা হইয়া যাইবো!’

ময়না শংকিত ভাবে বলে, ‘দাগ যাইবো তো?’

এত কষ্টের ভেতরও মেয়ের কথা শুনে হাসি পায় হাতেম আলির। কিন্তু সে হাসে না। বলে, ‘ঘাও ভালা হইয়া গেলে দাগে করবো কি?’

‘দেখতে খারাপ লাগবো না!’

‘বড় হইলে ঠিক হইয়া যাইবো!’

ময়নার মন তবুও খুঁতখুঁত করে। আজগর নানার মেয়ে জুনি খালার পায়ে একটি দাগ ছিলো। আগুনের পোড়া দাগ। সে দাগ দেখার পর কেউ আর বিয়ের তারিখ নিয়ে ফিরে আসতো না। এভাবে জুনি খালার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিলো। পরে বাচ্চা-কাচ্চা আছে এমন একজনের সাথে বিয়ে হয়েছে।

হাতেম আলি এ ঘটনার কথা জানলেও ময়নার মত এমন বাচ্চা একটি মেয়ের মাথায় এত জটিল একটি ভাবনা আসতে পারে বলে মনে করে না সে। কিন্তু সবারই ভালো করে জানা উচিত যে, এগারো-বার বছরের একটি শিশু এত বেশি শিশু নয়।

‘কুলসুম, কুলসুম!’

হাতেম আলির ডাক শুনে রান্নাঘর থেকে সাড়া দিয়ে কুলসুম বললো, ‘আইতাছি আব্বা!’

কিছুক্ষণ পর একটি ছোটো হাঁড়ি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসে কুলসুম।

হাতেম আলি বললো, ‘তাড়াতাড়ি গাও-গোসল দিয়া আয়, আমি একটু বাইর হমু।’

‘তুমি আগে সাইরা আসো।’ বলে, কুলসুম হাঁড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে।

‘তাইলে মা, ঘরডা ঝাড়ু দিয়া ফালাইস!’

‘আইচ্ছা!’

হাতেম আলি ঘরের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখা গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে পুকুর ঘাটে যায়।

ঘাট একেবারেই জনশূন্য। হাতেম আলি ঘাটের খুঁটিতে লুঙ্গি-গামছা রেখে হেঁটে হেঁটে বুক সমান পানিতে গিয়ে পরপর দুটো ডুব দেয়।

তারপর পরনের লুঙ্গি দিয়েই শরীর হাত-মুখ ডলে-ডলে ময়লা আর ঘাম পরিষ্কার করে। তার মনে হয় যে, এভাবে যদি ডলে-ডলে ভাগ্যটাকেও পরিষ্কার রাখা যেতো, তাহলে তার জীবনের যাবতীয় দুর্গতি আর দুর্ভাগ্যকেও ডলে-ডলে ভাগ্যের শরীর থেকে তুলে ফেলতে পারতো।

এমন সময় তার বড় ভাই কাশেমের স্ত্রী কমলা হাতে করে একটি হাঁড়ি নিয়ে ঘাটে আসে। পানির পাশে শুকনোতে বসে হাঁড়িটাতে কাদা মেখে খড় দিয়ে ডলতে ডলতে নিজে নিজেই বলে, ‘মাইয়া মানুষ যদি নিজের মর্জি মত ঘর ছাইড়া যায়, তাইলে হ্যায় নিজেই মাথা নিচা কইরা ফিরা আসন উচিত। কেউ ফিরাইয়া আনতে গেলে দেমাক বাইড়া যায়!’

কমলাকে পছন্দ করে না হাতেম আলি। খুবই দুষ্টু আর হিংসুটে প্রকৃতির মেয়ে মানুষ সে। রাতের বেলা স্বামী-স্ত্রীতে কী কথা হয় তা শুনবার জন্য ঘরের পেছনে বেড়ায় কান পেতে রাখে। কয়েকবার হাতেনাতে ধরেছেও হাতেম আলি। কিন্তু কমলার স্বভাবের কোনো পরিবর্তন হয়নি।

হাতেম আলির সাড়া না পেয়ে কমলা কণ্ঠস্বর উঁচিয়ে বলে, ‘আমার দ্যাওরা কি কানে তালা দিছে? ও হাতেম ভাই!’

হাতেম আলি কমলার দিকে ফিরলে, সে আবার বলে, ‘আপনের ভাই কইছে, ময়নার মায় আপনের ইচ্ছায়ফিরা না আইলে, কেউ জানি তারে আনতে না যায়!’

‘অ্যাঁ-া-া, গায়ে মানে না আপনে মোড়ল!’

কমলা হাতেম আলি কথা বুঝতে না পেরে বলে, ‘কিছু কইলা?’

‘কাশেম ভাই এই কথা কইলো বুঝি?’

‘কইলো তো।’

কমলা তার হাঁড়িটা পানিতে ধুয়ে, দাঁড়িয়ে বলে, ‘আরো কইলো কি জানো?’

‘কি কইলো?’

‘কইলো, দ্যাশে কি মাইয়ার অভাব? অখনও মুখ দিয়া বাইর করলে তের-চৈদ্দ বছইরা মাইয়াগো বাপভাইয়েরা দৌঁড় পাইড়া আইবো। তোমার বউয়ের দেমাক বেশি। মাইয়া মানুষের বেশি দেমাক ভালা না!’

হাতেম আলি জানে, কমলা গয়নাকে ঈর্ষা করে। কমলার গায়ের রঙ এতটাই খারাপ যে, গয়নার পাশে তাকে গোবর লেপা বেড়ার মতই মনে হয়। তাই সে গয়নার পাশে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, যে রাস্তায় গয়না থাকে কমলা সেদিকেও যায় না। কমলা যেমন গয়নাকে ঈর্ষা করে তেমনি গয়নাও তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কম করে না।

কমলার হাতের কিছু খেতে পারে না গয়না। না জেনে কিছু খেলেও পরে জানতে পারলে বমি করতে আরম্ভ করে দেয়। গয়নার এ ব্যাপারটা কমলাও জানে।

একটি ডুব দিয়ে উঠে হাতেম আলি বললো, ‘এইবার দেমাক ছুটামু! পরতেকবারই কিছু হইলে দৌঁড় পাইড়া বাপের বাড়ি যায় গিয়া। এইবার কয়মাস বাপের বাড়ি থাকতে পারে দেখি!’

কমলা কেমন উজ্জ্বল মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে দেবরের প্রতি।

হাতেম আলি আবার বলে, ‘এইবার গিয়া খালি কমু যে, বাপের বাড়ির ভাত যদ্দিন মজা লাগে তদ্দিন পইড়া থাক! আমি কিছু কইতে আমু না!’

কমলা সঙ্গে সঙ্গেই বলে, ‘লগে আননের কথা কিন্তু স্বীকার হইবা না!’

‘দেখি চিন্তা ভাবনা কইরা!’

হাঁড়িতে পানি ভরে নিয়ে পাড়ে উঠে যায় কমলা।

হাতেম আলি কমলার চলে যাওয়া দেখে আর মনে মনে হাসে। বিড়বিড় করে বলে, ‘তোমরা মনে কইরো না যে, তোমরাই চালাক! তাই বইল্যা আমি কাশেমের মতন রামছাগল না!’

গোসল সেরে হাতেম আলি ফিরে আসতেই কুলসুম তাকে পাশ কাটিয়ে পুকুরের দিকে ছুটে যায়।

‘বেশি পানিতে যাইস না কইলাম!’

মেয়েকে সাবধান করলেও হাতেম আলি ঝুপ করে একটি শব্দ শুনতে পায়। কুলসুম হয়তো পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছে।

ছয়

দূর থেকে রবিউলকে ছাতা মাথায় আসতে দেখে মুখ কালো করে দাওয়ায় বসেছিলো জয়নাব। কিন্তু তার মুখের ভাবটা ঠিকভাবে ফুটে ওঠে না কখনোই। তবু চেষ্টা করে অন্তত গম্ভীর হয়ে থাকতে।

রবিউল ছাতাটা বন্ধ করে দরজার চৌকাঠে ঝুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘উত্তর দিক দিয়া আসমান ম্যাঘে ম্যাঘে এক্কবারে কালা হইয়া গেছে! কহন জানি বান-বাতাস শুরু হয়, আমারে তাড়াতাড়ি ভাত খাইতে দে!’

রবিউলের কথার জবাব না দিয়ে জয়নাব অন্যদিকে মুখ ফিরালে, রবিউল ফের সামনে গিয়ে বলে, ‘ঝরি শুরু হইতে বুঝি আর দেরি নাই!’

জয়নাব হঠাৎ হেসে উঠলে তার মুখের মেঘও সরে যায়। স্বামীর সঙ্গে রাগ করে মুখ ভার করে রাখবে কোন অছিলায়? তেমন সুযোগ কি রবিউল দেয়, না দিতে পারে?

রবিউল জানে, জয়নাব আবার বাপের বাড়ি যাওয়ার বায়না ধরবে। তাই আগে আগেই সে বলে, ‘বউ, তুই বাপের বাড়ি যাওনের নাম নিলেই আমার ক্ষিদা বাইড়া যায়। মনে হয়, তুই না থাকলে আমি না খাইয়াই মইরা যামু!’

জয়নাব কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রবিউলের মুখের দিকে। তারপর হঠাৎ বলে, ‘জন-কামলা নিয়া জমি-ক্ষেতি করতে পারো আর দুইডা ভাত রাইন্দা খাইতে পারবা না!’

‘অনেক চেষ্টা করছি! তাও এইবার সত্যিই রান্দন শিখমু! তুই আরো কয়ডা দিন পরে যা। ময়নার মায় ফিরা আইলেই তরে নিয়া যামু!’

জয়নাব এবার সত্যি সত্যিই অবাক হয়ে বলে, ‘ময়নার মায় আইলে তোমার কি সুবিধা হইবো?’

‘তুই যেই কয়দিন তগো বাইত্যে থাকবি, হেই কয়দিন আমি হ্যাগো ঘরে খামু।’

‘তাইলে তো হইছেই!’ বলে, জয়নাব ঠোঁট উল্টায়।

‘ক্যান, অসুবিধা কি?’

‘কমলারে তো চিন নাই! তার মুখ যহন খুলবো, তহন টের পাইবা যে, কয় ভাপে ধান সিদ্ধ হয়!’

রবিউল বুঝতে না পেরে হা করে তাকিয়ে থাকে।

তা দেখে জয়নাব আবার বলে, ‘কমলার কথা হুনলে কুত্তায়ও ঘেউ-ঘেউ বন্ধ কইরা দেয়!’

রবিউল বুঝতে পারে না জয়নাবের কথা। বলে, ‘পরিষ্কার কইরা ক!’

‘কমলা কথা বানাইয়া বানাইয়া পুরা গ্যারাম ছাইয়া ফালাইবো। পরে তোমরা তিনজনের কেউই আর গ্যারামে মুখ দ্যাখাইতে পারবা না!’

রবিউল বলে, ‘কি কথা বানাইবো?’

‘হেইডা তুমি বুঝবা না। ব্যবস্থা যা করনের আমিই করতাছি!’

‘তুই আবার কি ব্যবস্থা করবি?’

রবিউলের কণ্ঠে তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে।

‘খালেক মামুর মাইয়া ফিরোজাবুরে আইন্যা দিয়া যাই। যেই কয়দিন আমি থাকমু না, হেই কয়দিন তোমার

রান্ধন-বাড়নের কাম হইয়া যাইবো!’

‘হ, হ্যায় আইবো না তর বাইন্দালি করতে! রবিউলের কণ্ঠে যেন রাজ্যের তাচ্ছিল্য ফুটে উঠলো। ‘তা ছাড়া, হ্যায় হইলো গিয়া মাথা খারাপ মানুষ! কহন কি করবো তার কোনো ইস্টিশন আছে?’

জয়নাব অভয় দেয়ার ভঙ্গিতে রবিউলের কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ফিরোজাবু তো অখন ভালো হইয়া গেছে!’

‘কিন্তু…’

রবিউলের মনে নতুন করে ভাবনা চেপে বসে। জয়নাব তাকে যতই ভালোবাসুক, যতই বিশ্বাস করুক, সত্যি কথা শুনলে তারও মন ঠিক থাকবে না। শত হলেও মেয়ে মানুষ। স্বামীর গোপন বিষয় জানতে পারলে কিছুটা হলেও সমস্যার সৃষ্টি করবে।

বছর পাঁচেক আগে, আসমা বেগমের বাতের সমস্যার কারণে আধপাগল ফিরোজাকে কয়েক দিনের জন্য বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আধপাগল হলেও সংসারের যাবতীয় কাজে কোনো সমস্যা হতো না। তাই তখন ফিরোজাই পুরোটা সংসার আগলাচ্ছিলো।

একদিন খুব সকালের দিকে ঘর ঝাঁট দিতে আসে ফিরোজা। তার কিছুক্ষণ আগেই বাইরে থেকে এসে আবার শুয়েছিলো রবিউল। ঘরের ভেতরকার আবছা আলোয় রবিউলের চোখ খোলা কি বন্ধ বোঝা যায় না। ফিরোজা ঝাঁড়ু হাতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে। হয়তো বা বুঝতে চেষ্টা করে যে, রবিউল ঘুমে না জাগরণে।

তারপরই হঠাৎ কি মনে করে হাত থেকে ঝাড়ুটা মেঝেতে ফেলে দিয়ে একহাত ব্লাউজের নিচে আর অন্যহাত পেটিকোটের নিচে ঢুকিয়ে দিয়ে বিচিত্র রকমের একটি শব্দ করতে লাগলো। বিস্মিত এবং ভীত রবিউল বিছানায় উঠে বসলে ফিরোজা লজ্জা পেয়ে পালিয়ে যাবার কথা থাকলেও উল্টো এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। কিন্তু সে সময় আসমা বেগম ফিরোজাকে ডাকতে আরম্ভ করলে রবিউল তাকে বলেছিলো, ‘অখন তুমি যাও!’

ফিরোজা রবিউলের কথায় কি বুঝেছিলো কে জানে! তখনকার মত শান্তভাবে বেরিয়ে গেলেও রাতের বেলা খাওয়া-দাওয়ার পর সে পুকুর থেকে গোসল করে আসে। অতি যত্নে চুলে তেল দিয়ে আঁচড়িয়ে রঙিন ফিতে দিয়ে বেণি বাঁধে। আসমা বেগম পাগলীর কাণ্ড-কারখানা অবাক হয়ে দেখেন। এক সময় তিনি জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারেন না। ‘তুই অত সাজা-গুজা করতাছস ক্যান?’

দু’বেণির প্রান্ত মাথার পেছন দিকে ঘুরিয়ে বাঁধতে বাঁধতে ফিরোজা বলেছিলো, ‘কাইল বিয়ানে দূর্গারে ফালায় দিবো। এইবার ত দেখনের সুযুগ পাইলাম না! রবু আমার লগে যাইবো আর আইবো, বেশি দেরি হইবো না!’

আসমা বেগম মাথা খারাপ ফিরোজাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। কিংবা তার কাজ-কর্ম স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। যে কারণে রবিউলকে তার সঙ্গে যেতে দিলেন না। বললেন, ‘রাইতের কালে এক গ্যারাম ছাইড়া আরেক গ্যারামে গিয়া দূর্গা দ্যাখনের কাম নাই!’

ফিরোজা একবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো রবিউলের দিকে। হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলো যে, মায়ের কারণেই আজকের অভিসার পণ্ড হয়ে গেল!

তারপর হঠাৎ দুপদাপ পা ফেলে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছিলো সে। পরদিন অনেকেই দেখতে পেলো যে, গ্রমের পুরোনো বটগাছের ডালে বসে পা ঝুলিয়ে গান গাইছে ফিরোজা। ফিরোজার সে পাগলামী সেরেছে এক বছরও হয়নি। ফের যদি ফিরোজা এমন কিছু করে? অবশ্য এখন তার বয়সও বেড়েছে। কিন্তু রবিউল জানে না যে, একজন নারীর বয়স কত হলে তার শরীরের চাহিদা শূন্য হয়ে যায়।

জয়নাব রবিউলকে একহাতে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘আরে, কার ধ্যানে মজলা?’

রবিউল হেসে বলে, ‘ফিরোজাবু’র ধ্যানে। তার পাগলামী সারছে এক বছরও পুরা হয় নাই!’

‘হেই চিন্তা তোমার করতে হইবো না! আগে আমরা কথা কইয়া দেখি!’

‘তুই কথা কইস, আমি যাইতে পারমু না!’

জয়নাব উঠে পড়ে বলে, ‘তোমার যাইতে হইবো না! অখন হাত মুখ ধুইতে যাও!’

সাত

রবিউলের ইচ্ছে ছিলো খাওয়ার পর গয়নার ব্যাপারটা নিয়ে আলাপ করবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখায় না জয়নাব। বলে, ‘সমস্যা হাতেম ভাই আর তার বউয়ের! আমরা পেরেশান হওনের কামডা কি?’

‘পেরেশানের কাম নাই?’

রবিউল কিছুটা মনক্ষুন্ন হলেও তা প্রকাশ করে না।

‘না, নাই!’

জয়নাবের এমনতর রূঢ় জবাবে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে।

তা দেখেই হয়তো জয়নাব ফের বলে, ‘কথায় কয়, গরিব হইয়া তো দ্যাখো নাই, শুটকির ভর্তা ক্যামন ঝাল!’

জীবনের প্রথম একটি নতুন কথা শুনে রবিউল সত্যিই বিস্ময়াভিভূত। মনেমনে কথাগুলোকে কয়েকবার আউড়ায়। কিন্তু মর্মোদ্ধার করতে পারে না।

জয়নাব ভাবলো রবিউলের মন খারাপ হয়ে গেছে। তাই সে বলে, ‘মনে কষ্ট পাওনের মতন কিছু কই নাই!’

তারপর রবিউলের পাশে আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে হাতের আঙ্গুল ফোটাতে ফোটাতে জয়নাব আবার বলে, ‘গয়না মাইয়া মানুষ হইলেও একজন মা! তার মনে ক্যামন কষ্ট থাকলে পোলাপান ফালাইয়া এতদিন থাকতে পারে, তা কি ভাইব্যা দ্যাখছো?’

‘দেখছি!’

‘বুঝবা না! হেই মন এখনো তোমার হয় নাই। বাপ যদি হইতে পারতা তাও কিছুডা হইলেও বুঝতে পারতা!’

সুযোগ বুঝে জয়নাব রবিউলের কলজে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেয়। বিয়ের চারবছর পার হয়ে গেলেও এখনো জয়নাবের কোল খালিই রয়ে গেছে। তার ধারণা, এ অক্ষমতা রবিউলের। কিন্তু রবিউল জানে তার সামর্থ্য। শুধু জানে না জয়নাবের অবস্থা কি। এ পর্যন্ত সে ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হয়নি। রাজি হয়নি নিজকে পরীক্ষা করাতে।

‘নসিবে থাকলে আসবে!’

জয়নাবের নিজের মুখের কথা। তবুও মাঝে-মধ্যে ইচ্ছে করেই যেন বল্লমের ঘাই মারে রবিউলকে। তার মন খারাপ হয়ে যায়।

তারপর ‘আমি ফিরোজাবু’র কাছে গেলাম!’ বলে, সে মাথায় ঘোমটা টেনে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই ফিরে এসে দরজায় মুখ বাড়িয়ে বলে,’কোনোখানে যাইয়ো না জানি! হাতেম ভাই আবার আইবো কইয়া গেছে!’

জয়নাবের কাজে-কর্মে তেমন একটা বাধা দেয় না রবিউল। কারণ, সে যাই করুক না কেন, তার সবই সংসারের জন্য। প্রথম প্রথম বাধা-নিষেধ দিয়ে পরে নিজকেই পস্তাতে হয়েছে। মাঝে মাঝে সে অবাক হয়ে ভাবে, সংসারে কার প্রতাপ বেশি? তার নিজের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে, জয়নাবই তাকে শাসন করে বেশির ভাগ। অবশ্য তাতে ভালোই হয়, খারাপ তেমন একটা হয় না বলতে গেলে।

যে রাস্তায় লোকজনের যাতায়াত কম, সে রাস্তায় এবং এর ওর বাড়ির রান্নাঘরের পেছনের পথ ধরে জয়নাব খুব স্বল্প সময়ের ভেতরই পৌঁছে যায় খালেক মামুর বাড়ি।

খালেক মামু দূরসম্পর্কে জয়নাবের মা ফজিলা বেগমের ভাই আবার শাশুড়ি আসমা বেগমেরও ভাই। সে সূত্রে রবিউল আর জয়নাব দু’জন খালাতো ভাই বোন। যে কারণে খালেক মামুর বাড়িতে দু’জনেরই অধিকার সমান। আর এ অধিকারের বলেই জয়নাব ফিরোজার সাথে কথা বলতে এসেছে। এর মূল কারণ অবশ্য হচ্ছে যে, এবার সে ঠিক করেছে, যে করে হোক আজকালের মধ্যে তাকে বাপের বাড়ি বালুকান্দি পৌঁছুতেই হবে। মিজান কবিরাজের অষুধ খেয়ে অনেক বন্ধ্যা মেয়ে নাকি ভালো ফল পেয়েছে।

গাছ-গাছড়ার অষুধ তেমন খারাপ কিছু না। শহরের হাসপাতালের ডাক্তার সে পুরুষই হোক আর নারীই হোক তাদের কাছে পরীক্ষা করানোর মাঝে আনেক খারাপ ব্যাপার বা কোনো কোনো সময় ঠকে যাওয়ার মতও ব্যাপার থাকে। যা সরল মনের রবিউলকে বোঝানো জয়নাবের সাধ্যের বাইরে। তা ছাড়া, যে মেয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেই রাজি হয়নি, সে যাচ্ছে কবিরাজের কাছে। এমন কথা রবিউল শুনতে পেলে অবশ্যই হাসবে। সুযোগ মত তিতা কথা বলতেও ছাড়বে না। হয়তো বলা যায় না রেগেও যেতে পারে। যাতে দু’কূলই রক্ষা পায় সে ব্যবস্থাই সে করতে চাচ্ছে। রবিউলকে কিছুদিন একা থাকতে হবে। কবিরাজের অষুধ খাওয়ার পর পরবর্তী মাসিক চক্র শেষ না হওয়া পর্যন্ত স্বামী-সঙ্গ নিষিদ্ধ। সে কারণে রবিউল পাশে থাকলে তার অষুধ খাওয়ার পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে পারে।

এরই মাঝে হাতেম আলি রবিউলের সঙ্গে দেখা করতে আসার পথে জয়নাবকে দেখলো প্রায় লুকিয়ে লুকিয়ে সে কোথাও যেন যাচ্ছে। কিন্তু কেন সে অমন ভাবে যাচ্ছে রহস্যটা ধরতে পারে না।

‘রবিউল আইছস?’

দরজায় দাঁড়িয়ে হাতেম আলি হাঁক দিলে ঘর থেকে রবিউল বললো, ‘খালি ঘর, সিধা ঢুইক্যা পড়!’

মাঝারি আকৃতির একটি কাঠের ঢেলানীতে পা গুটিয়ে বসেছিলো রবিউল। হাতেম আলি পাশে বসতে বসতে বললো, ‘তুই একবার গেলে দেখতি আমার পোলাপানের কী দূর্গতি!’

কোনো ভণিতা না করে সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে রবিউল। বলে, ‘দুর্গতি তো তুমিই ঘটাইলা!’

‘আমি ঘটাইলাম?’

হাতেম আলি কেমন আহত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে।

তারপর আবার বলে, ‘তর মনগড়া মতন একটা কথা কইলেই হইবো?’

‘মনগড়া হইবো ক্যান? ভাবিরে যদি তুমি এমন যন্ত্রণাডা না করতা, তাইলে না হয় এমন কিছু একটা কইতে পারতা!’

হাতেম আলি নড়েচড়ে বসে বলে, ‘তুই যে কেবল একটা কথাই সব সময় কস, তার মুখ দিয়া যেইসব অবাচ্য বাইর হয়, তা কি তুই নিজের কানে হুনস নাই?’

‘তাইলে মূর্খ কইছে কারে?’

‘হ্যায় না কেলাস সিক্স তক পড়ছে, মূর্খ হইলো ক্যামনে?’

হাতেম আলির কথা শুনে না হেসে পারে না রবিউল। ‘তোমার শ্বশুরের কোনো পোলাপানই ইস্কুলের সীমা পার হইতে পারে নাই। তা ছাড়া হেই বাড়ির কারো মইধ্যে শিক্ষা-দীক্ষার বীজ আছে বইল্যা মনে হয় না। তাও আবার তোমারে বলি, এই বয়সে এত মাথা গরম করা ঠিক হয় নাই!’

‘তুই কি কইতে চাস আমি মুখ বন্ধ কইরা রাখমু? হ্যায় আমার মরা বাপ-মায়ের নাম তুইল্যা খারাপ কথা কইলেও কস হ্যারে কোলে নিয়া বইস্যা থাকমু?’

‘অখন তোমার যে বয়স, এই বয়সে মানুষ ভারী হইতে হয়! মন-মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে হয়! এই যে, ভাবি কইলো তোমার মতন ডাকাইতের ঘরে আর আইবো না! আর তা যদি সত্যি সত্যিই হয়, তোমার পোলাপানের কী উপায় হইবো একবার ভাইব্যা দেখছো?’

হাতেম আলি প্রায় ভেঙে পড়ার মত বললো, ‘গয়না এই কথা কইলো?’

‘কইলে কি খুব বেশি অন্যায্য কিছু কইছে?’

‘তর মতে গয়না সব ন্যায্য কথাই কয়!’

হাতেম আলি মুখ বিকৃত করে ফেলে।

‘বিয়ার সময় তোমার বউ বাপের বাড়ি থাইক্যা যেই গয়নাগাটি সোনার জিনিস পিন্দা আইছিলো, তারপরে তোমারে ব্যবসার পুঞ্জি হিসাবে নগদ আইন্যা দিছে সত্তুর হাজার, তার হিসাব কি দিতে পারবা?’

‘এত বছর পরে এই হিসাব ক্যামনে দিমু!’ হাতেম আলির কণ্ঠে হতাশা ঝরে পড়ে।

‘তাইলে এখন যদি তোমাগো দুইজনের মইধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়, তাইলে ভাবির কাবিনের আশি হাজার, পরের বারের সত্তুর হাজার আর পাঁচ ভরি সোনার জিনিস কি ফেরত দিতে পারবা? বিচার শালিসে কি এর অর্ধেকও তুমি দিতে বাধ্য না?’

হাতেম আলি শুকনো মুখে বলে, ‘বিচার-শালিসের রায় মানতে ত হইবোই!’

‘কিন্তু দিবা ক্যামনে?’

রবিউলের উত্তর প্রত্যাশী দৃষ্টির সামনে হাতেম আলি আরো চুপসে গিয়ে বলে, ‘হেই চিন্তাই তো করতাছি!’

‘চিন্তা-ভাবনায় সময় নষ্ট কইরা লাভ নাই! এখনকার মানুষ খুবই খারাপ! দেশের আইনও দিনদিন কঠিন হইতাছে। কেউ যদি ভাবিরে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়া কোর্টে নাইলে থানায় গিয়া দরখাস্ত দেওয়ায়, তাইলে তোমার বয়স এক রাইতেই আশি হইবো!’

হাতেম আলি কিছুক্ষণ রবিউলের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তারপর ঢোক গিলে বলে, ‘অহন আমারে একটা বুদ্ধি দে!’

রবিউল এক পা নামিয়ে বলে, ‘য্যামনে পারো ভাবিরে ঘরে ফিরাইয়া আনো!’

হাতেম আলি ইতস্তত করে বলে, ‘ফিরাইয়া আনতে তো যামু, হ্যাগো মতিগতি ক্যামন দেখলি? আমারে না আবার মাইর-ধইর করে!’

রবিউল বিস্মিত হয়ে বলে, ‘এমন কাজ ক্যান করবো?’

‘তর ভাবি যখন আমার উপরে হাত তুলতে পারছে, তাইলে মানুষ দিয়া আমারে মাইরও খাওয়াইতে পারে!’

হাতেম আলির ভীতি দেখে আর কথা-বার্তা শুনে না হেসে পারে না রবিউল। বলে, ‘দুর্বল মানুষও মাইর খাইতে খাইতে একদিন ফিরা ধরে!’

কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে হাতেম আলি বলে, ‘আমি যে কী করমু চোখে-মুখে পথ দেখতাছি না!’

‘অখন একটা পথই আছে আর তা হইলো ভাবি ফিরা আওনের পর মাইর-ধইর বকাবাদ্য করতে পারবা না। পোলাপান বড় হইতাছে। তাগো সামনে যদি তোমরা এমন কর, তাইলে তারা শিখবো কি? তা ছাড়া কোনো কাজে-কামে না গিয়া ঘরে শুইয়া বইসা থাকলে সংসারের ঝগড়া মিটবো না কোনোদিন!’

হাতেম আলি মাথা দুলিয়ে বলে, ‘তর সব কথাই ঠিক আছে। তাইলে তুইও আমার লগে চল!’

রবিউল আৎকে উঠে বলে, ‘আমি আর সাহস পাইতাছি না, তুমি অন্য কাউরে নিয়া যাও!’

‘ভাই, তুই আমার বয়সে ছোডো, তাও তর দুইডা হাত ধইরা কইতাছি!’

হাতেম আলি সত্যি সত্যিই রবিউলের দু’হাত মুঠো বন্দি করে ফেলে। ‘তরে ছাড়া গেলে, গয়নারে আনতে পারমু না!’

রবিউল কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বুঝতাছ না ক্যান? ঘর-বাড়ি ফালাইয়া আমি ক্যামনে যামু? দুই বছর ধইরা বাপের বাড়ি যাইতে পারে নাই জনু। তারে মনে কয় কাইল বালুকান্দি নিয়া যাইতে হইবো!’

হাতেম আলি অস্থির হয়ে বলে, ‘দরকার হইলে এক দুইদিন নাইম্যা যাই, তাও তুই না করিস না!’

রবিউল হাতেম আলিকে আগেই কথা দেয় না। বলে, ‘জনু আইসা কি কয় দেখি।’

জয়নাবের প্রসঙ্গ উঠতেই হাতেম আলি বললো, ‘তর বউরে দেখলাম হোসেন আলির পাক ঘরের পিছন দিয়া বার হইতে!’

‘যাইতাছে ফিরোজাবু’র কাছে। তারে ঘরে দিয়া হ্যায় বাপের বাড়ি যাইবো!’

হাতেম আলি আশ্চর্য হয়ে বলে, ‘ফিরোজার না মাথা খারাপ!’

‘হেই কথাডাই তো জনুরে বুঝাইতে পারলাম না!’

হাতেম আলি চিন্তিত ভাবে বললো, ‘দেখিস, পরে না আবার কোনো কেলেঙ্কারী হয়!’

রবিউল হেসে বললো, ‘কেলেঙ্কারী হইলে তার দায় জনুর। নয়তো ফিরোজাবু আর খালেক মামুর!’

দায় এড়িয়ে যাওয়ার কথা রবিউল বললেও হাতেম আলি তা মেনে নিতে পারে না। বলে, ‘তাও তো, তুই, ফিরোজা গ্যারামের দশজনের বাইরের কেউ না। ইচ্ছা করলেই যা খুশি করন যায় না!’

‘ফিরোজাবু আমার ঘরে আইসা থাকলে কথা কি গোপন থাকবো? জনু ফিরা আওনের সময় কি আরো দুইচাইর-পাঁচজনরে কইতে কইতে আইবো না? এর থাইক্যাই সমাজ খবর পাইয়া যাইবো আর তারা যদি খারাপ মনে করে, তাইলে রাইত হওনের আগেই আমারে নয়তো খালেক মামুরে নিষেধ করবো!’

হাতেম আলি রবিউলের যুক্তি উপেক্ষা করে না। পরে বলে, ‘তাইলে আমার বিষয়ডা কি ঠিক হইলো?’

‘জনু আইলেই ঠিক করমু!’

হাতেম আলি উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘তাইলে কি ঠিক করলি পরে আমারে জানাইস!’

হাতেম আলি নিশ্চিত হয়ে ফিরে গেলেও রবিউল চিন্তামুক্ত থাকতে পারে না। কারণ সাত-আট বছর আগে এমনি একটি ঘটনা ঘটলে রবিউলকে গয়না বলেছিলো যে, সে ফিরে এলে লাভ বা সুবিধা হবে ময়নার বাবার। কিন্তু রবিউলের কি লাভ?

এমন কথার কোনো জবাব না থাকলেও রবিউল চুপ থাকেনি সেদিন। বলেছিলো, ‘মানুষ কেবল লাভের আশায়ই সব কাজ করে না! কোনো কোনো কাজ বিনা স্বার্থে বা বিনা লাভেও তারে করতে হয়। আর মানুষ বইলাই সে এমন ধরনের কাজ করতে পারে। লাভের মইধ্যে এইই যে, একটা সংসার ভাঙনের হাত থাইক্যা রক্ষা পাইলো!’

গয়না বলেছিলো, ‘আমি এত বড় মনের মানুষ হইতে পারি নাই! আমার লাভ-লোকসানের হিসাবের দরকার আছে। বিনা লাভে একটা জেলখানার মতন সংসারে গিয়া ঢুকমু ক্যান? যেইখানে দিনরাইত বলদের মতন ঘানি টাইন্যা যাওন! কী পামু আমি? ওই বুইড়ার কাছে না পাইলাম আদর-সোহাগ, না পাইলাম মানুষের ইজ্জত! আপনে মানুষটা আরো কিছু শক্ত মনের হইলে কবেই আমার সব অভাব মিটাইয়া লইতাম!’

রবিউল গয়নার কথা বুঝবে না, এমন শক্ত আর কঠিন কথা বলেনি সেদিন। তবুও রবিউল গয়নার ইঙ্গিতে সাড়া দিতে পারেনি। আর কেন পারেনি তা আজও রহস্য হয়ে আছে। আবার হাতেম আলিকে সঙ্গে নিয়ে গেলে গয়না হয়তো সে একই কথা বলে খোঁটা দেবে। তিরস্কার করবে তার সাহস নিয়ে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন অনেক কিছুই আছে, যা নষ্ট করতে বা দুমড়াতে-মোচড়াতে কখনোই ইচ্ছে হয় না। আবার কিছু কিছু জিনিস আছে যা দেখলেই দুমড়ানো-মোচড়ানো থেকে শুরু করে ভেঙে-চুড়ে, ছিঁড়ে-ফেঁড়ে ফাতা-ফাতা করতে ইচ্ছে হয়। গয়না রবিউলের কাছে তেমন কিছুর মত নয়।

আট

খালেক মামু বাড়িতেই ছিলেন। উঠোনে একটি জলচৌকিতে বসে গায়ে রোদ লাগাচ্ছিলেন। জয়নাবের পায়ের শব্দে অন্ধ খালেক মামু হঠাৎ সচকিত হয়ে বললেন, ‘ক্যাডারে?’

জয়নাব খালেক মামুর পাশে গিয়ে বললো, ‘মামু, আমি জয়নাব!’

‘ভালা আছস মা?’

‘হ মামু।’

‘রবু কথা কয় না ক্যান?’

‘আমি একলাই আইছি মামু!’

খালেক মামু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মাইয়া মানুষ একলা চলা ফিরা করন ঠিক না। পরে সংসার করনের মন থাকে না!’

সম্পূর্ণ নতুন এবং আজগুবী একটি কথা শুনে জয়নাব হঠাৎ কি করবে বুঝতে পারছিলো না। সে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

খালেক মামু বুঝতে পারেন যে জয়নাব এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তিনি বললেন, ‘রৈদে বেশিক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিস না। ঘরে যা!’

‘মামি কোই?’ বলে, জয়নাব উঠোন থেকে গিয়ে ঘরে ঢুকলো।

বড় লাল রঙের কাঁথায় সাদা আর হলুদ সূতো মিশিয়ে ফুল তুলছিলো ফিরোজা। ‘কেমন আছ ফিরোজাবু?’ বলে জয়নাব কাঁথার উপর বসতেই ফিরোজা তাকে ঠেলে তুলে দেয়।

জয়নাব বিস্মিত হয়ে বলে, ‘আমি আইলাম তোমার খোঁজ-খবর করতে আর তুমি আমারে সরাইয়া দিলা?’

ফিরোজা উঠে জয়নাবকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘নারে বইন, যেই কাঁথায় সূঁইয়ের কাজ চলে হেই ক্যাঁথার উপরে বইতে নাই!’

‘কী হয় বইলে?’

‘মাঞ্জা বিষ করে!’

ফিরোজার কথা শুনে জয়নাব মুখে হাত চাপা দিয়ে হেসে উঠলো।

তা দেখে ফিরোজা বললো, ‘তুই হাসতাছস ক্যান?’

জয়নাব হাসি থামিয়ে বললো, ‘তাইলে সিলাইন্যা ক্যাঁথা গায়ে দিলে তো পুরা শইল বিষ করনের কথা!’

‘আমি কি জানি, মুরুব্বীরা কয় দেইখ্যা আমি কইলাম!’

‘তাইলে তুমিও মুরুব্বী হইয়া গ্যাছো?’

ফিরোজা রাগ দেখিয়ে বলে, ‘ওই ছেড়ি, বেশি ফাজিল কথা কইবি না! আয়, আমার লগে আইয়া বয়!’

ফিরোজা কাঁথাটাকে ভাঁজ করে একপাশে সরিয়ে পাটির উপর বসে।

জয়নাব পাটিতে বসে ফিরোজার দু’হাঁটুতে হাত রেখে বলে, ‘তুমি কেমন আছ বুবু?’

ফিরোজার একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে। বলে, ‘কেমন আর থাকুম! বাপ-ভাইয়ের কান্দে বোঝা হওনের মতন পোড়া কপাল আর নাই!’

সকালের দিকে ফালুর বউ মাজেদার সাথে খুব ঝগড়া হয়েছে ফিরোজার। মাজেদা তাকে বাপ-ভাইয়ের কাঁধের বোঝা বলেছে। তখন থেকেই তার মন খারাপ।

জয়নাব সকালের ঘটনার কথা জানে না। কিন্তু কোনো কারণে যে, ফিরোজার মন ভালো নেই সেটা বুঝতে পেরে সে বলে, ‘তোমার কি মন খারাপ বুবু?’

‘এই ছাড়া আমি আর কি করতে পারি ক? যাগোরডা খাই-পিন্দি, এর লাইগ্যা যদি আমারে খোঁটা শুনতে হয়, তাইলে কি হ্যাগোরে আমি পিডাইতে পারমু? না ভাত-কাপড়ের মায়া ছাইড়া কোনোদিকে চইলা যাইতে পারমু?’

কথার পিঠে কথা আসে বলেই জয়নাব বলে ফেলে, ‘খাওয়াইয়া পিন্দাইয়া যদি খোঁটাই দিতে পারে, তো এমন ভাত-কাপড়ের মায়া ক্যান করবা?’

তখনই হঠাৎ উঠোন থেকে মাজেদার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, ‘ভাত-কাপড়ের মায়া ছাড়লে তুই নিয়া পালবি নাকি হ্যারে?’

জয়নাব বুঝতে পারেনি যে, মাজেদা আঁড়ি পেতে কথা শুনতে পারে। প্রথমটায় হকচকিয়ে গেলেও কথা শুনে তার গায়ে আগুন ধরে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি পালন লাগবো ক্যান, ফিরোজাবু’র কি কেউ নাই? নাকি বাপ-মায়ের ঘরে হ্যায় পয়দা হয় নাই? তুমি এই কথা কওনের কে? দুইদিনের বৈরাগনী না, ভাতেরে কয় পরসাদ!’

‘দুইদিনের বৈরাগনী হমু ক্যান, বিয়া বইয়া আই নাই?’

‘বিয়া বইয়া আইছো দেইখ্যাই দুই দিনের বৈরাগনী! নাভির নিচের কুটুম্ব! তিন কথা কইলে যে পথের ফকিন্নি, তার আবার বড় কথা!’

মাজেদা আরো দ্বিগুণ তেজে বলে, ‘তিন কথা কইয়া বিদায় দ্যাওনের দিন কুত্তায় খাইছে, দুনিয়া অখন অত সোজা না!’

ফিরোজা জয়নাবের মুখে হাত চাপা দিয়ে থামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু জয়নাব থামে না। সে বলে, ‘এই সংসারে ফালু ভাইয়ের যেটুক হক, ফিরোজাবু’রও সমান হক। তুমি মনে কইরো না যে ফিরোজাবু তোমার বাপেরডা খায়-পিন্দে!’

জয়নাবের কথা শুনে মাজেদার গলার স্বর আরো চড়া হয়। বেজায় শ্লেষের সঙ্গে বলে, ‘জমিদার হইলে আলাদা খায় না ক্যান?’

‘ফিরোজাবু আলাদা হইলে তোমরা দুইজনে ভিক্ষায় নামতে হইবো! অখন যা জমি আছে সবই ফিরোজাবু’র!’

এ কথা শুনে মাজেদা হঠাৎ থ হয়ে যায়। সে সুযোগে জয়নাব চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তোমার উচিত ফিরোজাবু’র পাও ধুইয়া পানি খাওন!’

‘কী, আমারে তুই এত বড় কথা কইলি?’

মাজেদা আবার সরব হয়ে ওঠে। ‘বাঞ্জা, অলক্ষইন্যা মাইয়া! আমার বাইত্যে আইয়া আমারেই ধমক দেয়!’

‘বাড়ি তোমারে কেউ লেইখ্যা দেয় নাই। তোমারে অখন তালাক দিলে তুমি এই বাড়ির কেউ না!’

জয়নাবের সাথে কথায় না পেরে মাটিতে বসে বিলাপ শুরু করে মাজেদা। ঠিক তখনই কোত্থেকে যেন ছুটে আসেন মামি। কোমরে দু’হাত রেখে উঠোনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমি কই ঘটনা কি?’

মাজেদা বিলাপ করতে করতে যা বলে, তার কিছুটা বুঝতে পারেন আর বাকিটা তিনি অনুমান করে নেন। তবে এর মূলে যে জয়নাব আর ফিরোজা তা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পারেন। তিনি জয়নাবের দিকে ফিরে বললেন, ‘তুই কোন কামে আইছিলি?’

‘ফিরোজাবুরে আমাগ বাইত্যে নিয়া যাইতে!’

‘ক্যান?’

‘বুবুরে ঘরে দিয়া মনে করছিলাম বালুকান্দি যামু!’

‘থাকবি কয়দিন?’

‘পোনরো-বিশদিনের কম না!’

মামি কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে খানিকটা এগিয়ে এসে ফিরোজাকে বললেন, ‘জয়নাবের কথা হুনছস?’

‘হুনলাম তো!’

‘তর কি মত?’

‘আমি না থাকলেই ভালা হইবো! তোমার পোলার বউয়ের কামুড় আর সহ্য হয় না!’

তারপরই অকস্মাৎ চোখে আঁচল চাপা দিয়ে ফিরোজা বিনবিন করে বললো, ‘মরতে যদি না ডরাইতাম তাইলে কবেই বিষ খাইয়া মরতাম!’

মাজেদা হঠাৎ কান্না থামিয়ে বলে উঠলো, ‘তাইলে তুই মরস না ক্যান নাগিনী!’

মামি মাজেদার দিকে ফিরে বললেন, ‘বউ, তুই ঘরে যা! আইজ ফালুর লগে আমার বুঝ আছে। সম্পদ ভাগ কইরা যার যার মতন আলাদা কইরা দিমু। কাইজা ফসাদের কাম নাই!’

মাজেদা কিছু বলতে যেন ভুলে যায়। কিন্তু ফণা তোলা সাপিনীর মত তাকিয়ে থাকে ফিরোজার দিকে। ফিরোজা কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না।

মামি বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে ফিরোজার মাথায় বুকে ফু দিয়ে দেন।

তারপর অদর করে বলেন, ‘রবুরে মন্দ-সন্দ কইস না! ঝগড়া-ফসাদ করিস না! ঘর-ছাইড়া এহানে ওহানে ঘুইরা বেড়াইস না! আর পরতেক দিন একবার গিয়া তরে দেইখ্যা আমু!’

এখানকার মত একটি বিরুদ্ধ পরিবেশে বাস করে ক্রমশ হাঁপিয়ে উঠেছিলো ফিরোজা। জয়নাবের আহ্বান আর মায়ের সম্মতি যেন তাকে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু খোলা বাতাসের পথ করে দেয়। বিপুল উৎসাহে সে তার কাপড়-চোপড় পুটলি বাঁধতে থাকলে জয়নাব বলে, ‘এইসব পুরান ত্যানা-ছ্যাঁচা ফালাও তো! কিছু নিতে হইবো না তোমার!’

ফিরোজা অবাক হয়ে বলে, ‘তাইলে আমি কি পিন্দুম?’

‘নতুন অনেক আছে, কয়ডা পিনবা তুমি?’

ফিরোজা হাসে। ‘তর চাইয়া আমার শইল মোটা বেশি না!’

মামি বললেন, ‘কে কইছে মোটা? এক রকমই!’

মাজেদা ফোড়ন দেওয়ার মত বলে, ‘যাও, পরের বাইত্যে বাইন্দালি কর গিয়া!’

ফিরোজা মাজেদার কথায় রাগ করে না। বলে, ‘তর তিতা কথার চাইয়া তাও অনেক ভালা!’

ফিরোজা আর জয়নাব একই সাথে উঠোনে নামলে মামি বললেন, ‘ফিরোজা, তর বাপের দোয়া নিয়া যা!’

উঠোনে বসে থাকা খালেক মামু সবই শুনতে পেয়েছেন। কিন্তু কোনো প্রসঙ্গে কিছু বলেন নি। ফিরোজা কাছে গিয়ে বাবার পায়ে হাত দিতেই তিনি নূরকে বললেন, ‘রবু খুব ভালা পোলা! এমন কিছু করিস না যেন আমার অসম্মান হয়!’

ফিরোজা বললো, ‘আব্বা, আপনে আমারে খালি দোয়া কইরা দেন, কোনো কষ্ট জানি আর পাইতে না হয়!’

‘মারে, জয়নাবরে দুখ দিস না। মনে যত কষ্টই হউক, কারো কাছে কইস না! জয়নাব তর বইন, মনে রাখিস!’

তারপর তিনি জয়নাবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘মা জয়নাব, ফিরোজারে যা কইলাম তরেও একই কথা কইলাম মনে করিস!’

বিদায় নেয়ার পর পথে নেমে জয়নাব বললো, ‘বুবু, তুমি আর এই খাটাস বাইত্যে আইবা না। বাকি জীবন আমাগো লগেই থাকবা!’

ফিরোজা জয়নাবের দিকে একবার ফিরে তাকায়।

তারপর বলে, ‘রবু কি আমারে জাগা দিবো?’

‘ক্যান দিবো না?’

‘রবু আমারে অনেক ডরায়।’

‘তোমারে ডরানের কি আছে?’

‘আছে, অনেক কিছুই আছে!’ বলে, হাসে ফিরোজা।

তারপর আবার বলে, ‘যদি মাথা খারাপ হইয়া হ্যার গলা টিপ্যা ধরি? যদি কই আমারে বিয়া করতে হইবো!’

জয়নাব হেসে উঠে বলে, ‘এমন কথা কইছিলা নাকি?’

‘তাইলে কইতাছি কি?’

জয়নাব বিস্মিত হয়ে বলে, ‘হাচা?’

‘রবু একবার পাঞ্জাবি পিন্দা আমাগো বাইত্যে গেছিলো। লাল রঙের পাঞ্জাবি। হেইদিন কেমন কইরা জানি আমার মাথাডা ঠিক আছিলো। রবুর একটা হাত ধইরা আস্তে কইরা কইলাম, তুই আমারে বিয়া করবি? এই কথা হুইন্যা রবু এমন এক দৌঁড় মারলো, মনে হইলো তারে পাগলা কুত্তায় দৌঁড়ানি দিছে! হেইদিনের পর থাইক্যা হ্যায় আমাগো বাইত্যে আর যায় নাই!’

জয়নাব হাসতে হাসতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মত অবস্থা হয়। বলে, ‘আইজ যদি তোমারে দেইখ্যা আবার দৌঁড় দেয়?’

ফিরোজাও হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘এইবার দৌঁড় দিতে দিতে দিমু না! ধইরা কমু, আমারে বিয়া না করলে তর কান দুইডা কাইট্যা দিমু!’

জয়নাব আরো হাসে।

ফিরোজা বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এত হাসিস না মাগি! কপালে তাইলে কান্দন আছে তর!’

‘ক্যান রবুরে নিয়া যাইবা?’

ফিরোজা হাসে। মুখে একটি দুষ্টু দুষ্টু ভাবও ফুটে ওঠে। বলে, ‘বিয়া কি জিনিস জীবনে তো বুঝলাম না! দুই একবার কি চুরি করনের চেষ্টা করমু না!’

জয়নাব তেমনি হাসতে হাসতে বলে, ‘চুরি করলে ধরা পইরো না জানি! হাত-পাও ভাইঙ্গা মটকায় ভইরা থুমু!’

হাসতে হাসতে জয়নাবের চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। মনে মনে সে শঙ্কিত হয়ে পড়ে, ফিরোজাবু’র মাথা কি পুরাপুরি সারছে?

জয়নাব চোখ মুছলে ফিরোজা বললো, ‘কইছিলাম না কানবি?’

জয়নাব আবারও হাসতে থাকে।

নয়

হাতেম আলি চলে গেলে তাদের ব্যাপারটা নিয়েই ভাবছিলো রবিউল। খোলা জানালা পথে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তেই সে দেখতে পায় ফিরোজা আর জয়নাব আসছে। কোনো একটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে দু’জনেই হাসছে।

বহুদিন পর ফিরোজাকে দেখলো রবিউল। আগের চেয়ে অনেক ভালো দেখাচ্ছে। মুটিয়েছেও কিছুটা। তবে তার পান খাওয়া লাল দুটো ঠোঁট সবার আগে নজরে আসে।

ওদের দেখতে পেয়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে রবিউল। মুগ্ধ চোখে সে দু’জনকেই দেখে। যেন দুই সখি। ফিরোজার বয়স বেশি হলেও সৌন্দর্যের কিছুই হারায়নি বলতে গেলে। আসলে সোনা যতই পুরোনো হোক না কেন, তার রঙ কখনওই ফিকে হয়ে যায় না। বয়সের তুলনায় ফিরোজার চেয়ে জয়নাবের স্থূলত্বই চোখে পড়ে বেশি। যদিও জয়নাবের বয়স ফিরোজার প্রায় অর্ধেক, তবুও আকৃতিগত ভাবে দু’জনকে একই মনে হয়।

এতক্ষণ রবিউলকে খেয়াল করেনি জয়নাব। কিন্তু তাকে দেখতে পেয়েই হাঁটার ভঙ্গি কেমন রাজেন্দ্রানীর মত হয়ে উঠলো। তার এমন আকস্মিক পরিবর্তনের হেতু রবিউলের বোধগম্য হয় না। আরো কাছাকাছি হয়ে জয়নাব বললো, ‘কার কথা ঠিক হইলো?’

রবিউল প্রশ্নের আগামাথা কিছুই বুঝতে পারে না।

জয়নাব কেমন বিজয়িনীর মত বলে উঠলো, ‘তুমি না কইছিলা বুবু আইবো না? অখন সারা জীবনের লাইগ্যাই নিয়া আইলাম!’

রবিউল কেমন চোখ পিট পিট করে তাকায়।

ফিরোজা এগিয়ে এসে রবিউলের চুলের মুঠি ধরে বললো, ‘বউয়ের কথা বুঝতে পারতাছো না, না? আর আমি পাগল থাকলেই বুঝি তোমার সুবিধা হয়?’

তারপর চুল ছেড়ে দিয়ে রবিউলকে প্রায় জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কেমন আছস তুই? এই কয় বছরের মইদ্যে বুবুরে তো একবারও দেখতে গেলি না! না কি মনে করছিলি পাগল অইলে মানুষ আর মানুষ থাকে না?’

রবিউল কিছুটা আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো, ‘তোমার কাজ-কারবারের কি ঠিক ঠিকানা আছে?’

রবিউলকে ছেড়ে দিয়ে ফিরোজা বলে, ‘আমি তো ভালো হইয়া গেছি পরায় এক বছর!’

‘তাও তোমারে ক্যান জানি ডর লাগে!’

ফিরোজা রবিউলের দু’হাত চেপে ধরে বলে, ‘এইবার সব ডর ভাঙ্গাইয়া দিমু!’

রবিউল কি বলবে, তেমন কোনো কথা খুঁজে পায় না। তার আগেই ফিরোজা আবার বলে, ‘তার আগে তুই জয়নাবের সামনে কথা দে, আমারে রাখবি কিনা? একবারেই আইয়া পড়ছি কইলাম!’

‘তুমি থাকলে তো আমাগই লাভ! জনুরে একলা ঘরে পইড়া পইড়া আর কানতে হইবো না!’

জয়নাব ফিরোজাকে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে, ‘ঘরে চল বুবু, বেলা বেশি নাই!’

ফিরোজা জয়নাবের কাণ্ড দেখে বললো, ‘তুই এত অস্থির হইছস ক্যান?’

জয়নাবের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, ‘দুই বছর ধইরা বাপের বাড়ি যাই না! অহন যাও একটা সুযুগ হইছে, তা হারাইলে আর কোনোকালেই যাওন হইবো না!’

ফিরোজা ঘরে প্রবেশ করে বলে, ‘তাইলে ঘর পাহারায় আনছস আমারে?’

‘না বুবু, মানুষটা নিজে রান্দন জানে না! কি খাইবো, কোই খাইবো? হ্যার খাওনের অসুবিধা হয় দেইখ্যাই তো কোনো দিক যাইতে পারি না!’

ফিরোজা ফের রহস্যময়ীর মত হাসে। বলে, ‘তাইলে তো মাজেদা ঠিকই কইছে!’

‘ছি বুবু!’

এমন সময় রবিউল ঘরে ঢুকে জয়নাবের কথাটা শুনতে পেয়ে বলে, ‘কি নিয়া এমন ছিছি অইতাছে?’

জয়নাব অভিযোগের সুরে বললো, ‘দ্যাহ না, বুবু কি সব হাবিজাবি কইতাছে!’

তারপর সে ফিরোজাকে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলে, ‘তুমি না আমাগো বুবু! আদর দিয়া, ভালোবাসা দিয়া তোমার আঞ্চল দিয়া আমাগোরে ঢাইক্যা রাখবা!’

কথা শুনে ফিরোজার চোখ ভিজে আসে। সে জয়নাবের কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘কথাডা তর মনের তো, নাকি পরে আবার মাজেদা হইয়া যাস?’

জয়নাব ফিরোজার বুক থেকে মাথা তুলে বললো, ‘বুবু, একটা কথা মনে রাইখ্যো, আমার নাম কিন্তু শুরু হইছে জয় দিয়া! তোমার লাইগ্যা আমার কিছুতেই আপত্তি নাই!’

ফিরোজা বললো, ‘রবু সাক্ষী রইলো কইলাম!’

জয়নাব হাসে। হাসতে হাসতে বলে, ‘হ্যায় তো আমাগো দুইজনেরই সাক্ষী!’

তারপর রবিউলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বুবু থাকলো! তোমার কারণে বুবুর কাছে য্যান আমার শরম পাইতে না হয়! বুবুর জানি কোনো কষ্ট না হয়! অখন তুমি আমারে গাড়িতে তুইল্যা দিয়া আইবা!’

‘কিন্তু…’

‘আর কিন্তু কইরো না! আমার কইলাম কান্দন আইতাছে!’

‘বুবু এইমাত্র আইলো, আর তুই…’

‘আমি জানি তুমি হাতেম ভাইরে নিয়া এদিক ওদিক দৌঁড় পারবা। কিন্তু আইজ-কাইলের ভিতর না যাইতে পারলে আমার আর কোনোদিনই যাওনের কাম নাই!’

ফিরোজা রবিউলের পিঠে হাত রেখে বললো, ‘বউরে কান্দাইতে নাই! তুই তারে দিয়া তাড়াতাড়ি আইয়া পড়িস!’

ফিরোজাকে আশ্বস্ত করতেই যেন জয়নাব বলে, ‘বেশিক্ষণ লাগে না বুবু! বাস থাইক্যা নাইম্যা আমারে রিকশা কইরা দিলেই হইবো!’

‘এতদিন পরে যাবি, একলা গেলে মানুষে কইবো কি?’

জয়নাব হাসে। ‘বাইত্যে যাইয়া কিছু কমু না! অন্যরা মনে করবো আমি রাগ কইরা গেছি!’

তারপর স্বর নিচু করে আবার বলে, ‘রাগ কইরা না গেলে বাপের বাইত্যে বেশিদিন থাকন যায় না!’

ফিরোজা শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বলে, ‘তুই কত বিটিশ লো!’

জয়নাব রবিউলকে তাড়া দিয়ে বলে, ‘তুমি একটা রিকশা ঠিক কর না, আমি ততক্ষণে বুবুরে সব দেখাইয়া বুঝাইয়া দিয়া যাই!’

‘তুই সাজতে দেরি হইবো না?’

‘সাজমু না!’

রবিউল রিকশার সন্ধানে বেরিয়ে গেলে, ফিরোজাকে সঙ্গে নিয়ে জয়নাব তাকে রসুই ঘর দেখায়। কথার ফাঁকে ফাঁকে একটি গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে চিনি গুলিয়ে শরবত বানায়।

তারপর ফিরোজার হাতে দিয়ে বলে, ‘শরবতটা খাও বুবু! আমার বাইত্যে তুমি আইজই পরথম আইলা!’

ফিরোজা কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘তাইলে যে, আমিও পান-মিষ্টি আনন লাগে!’

‘কী যে কও না বুবু! তুমিইতো আমার পান-মিষ্টি!’

ফিরোজা জয়নাবের মুখের কাছে গ্লাসটা তুলে ধরে বলে, ‘তাইলে তুই এক চুমুক খাইয়া দে।’

জয়নাব আপত্তি জানিয়ে বলে, ‘না, তুমি খাও!’

‘তাইলে খামু না কইলাম!’

কপট রোষে গ্লাস রেখে দেওয়ার ভয় দেখায় ফিরোজা।

‘আইচ্ছা, তুমি আগে খাও, আমি পরে খামু!’

‘না, তুই আগে মুখে দে!’

‘জয়নাব এক চুমুক শরবত মুখে নিলে ফিরোজা বলে, ‘আরেক চুমুক!’

জয়নাব বাধ্য হয়ে তাই করে।

ফিরোজা বাকি শরবতটুকু নিঃশেষ করে গ্লাসটা জায়গা মত রেখে দিলে জয়নাব তার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে ধান- চাল-গমের মটকা দেখায়। কোথায় তেল-নুন মশলাপাতি রাখা আছে, কোথায় কোন ধরনের বীজ রাখা আছে, সবই দেখিয়ে দেয়। সবশেষে কাঁঠাল কাঠের আলমারি খুলে বিভিন্ন রঙের শাড়ি-ব্লাউজ-পেটিকোট দেখায়। কোনদিকের কাপড়গুলো নতুন আর কোনদিকের কাপড়গুলো পুরোনো তাও দেখায়।

তারপর ফিরোজার জন্য বেছে বেছে দুটো করে ঘরে পরার শাড়ি বের করে। সঙ্গে মানানসই রঙের ব্লাউজ- পেটিকোট। জয়নাব অন্তর্বাস পরতে না পারলেও বেশ ক’টিই আছে। ফিরোজাকে দেখিয়ে বলে, ‘তোমার যেইটা দরকার নিবা। মনে কর নতুন যা কিছু সবই তোমার!’

ঘরের ভেতর ঝাঁপের দু’দিকে দুটো খাট পাতা। জয়নাব ফিরোজাকে খাট দুটো দেখিয়ে বললো, ‘তুমি এইদিকেই ঘুমাইও। যদিও তোমার ভাই ইচ্ছা কইরা এদিকে আইবো না, তাও যদি মনে কর দরজার ছিটকিনি লাগাইয়া দিও!’

ফিরোজা জয়নাবের কথা শুনে হাসে।

তারপর বলে, ‘রবু আমার ভাই! তার লগে আমি ঘুমাইলে অসুবিধা কি?’

জয়নাব বোকার মত হেসে বলে, ‘তোমার তো অসুবিধা নাই, তয় আমার আছে!’

ফিরোজা জয়নাবের মুখ তুলে বলে, ‘খুইলা ক দেহি, ব্যাপারডা কি?’

‘তুমি না হয় বুড়ি! কিন্তু তোমার ভাই তো আর তোমার মতন না! মাথা গরম হইলে আমার কাছে দৌঁড় পাইড়া যাইবো। তখন আর ওষুধ খাওনের সুযোগ থাকবো না!’

‘রবুরে কস নাই?’

‘আগে তো নিজেরে পরীক্ষা করাইতে রাজি হই নাই! অখন অষুধ খাইতে বাপের বাড়ি যাইতাছি, এই কথা কোন মুখে কমু?’

‘তাইলে তো কিছু দিন বাছতে হইবো!’

‘আঠারো দিন!’

ফিরোজা জয়নাবকে বলে, ‘তুই নিচ্চিন্তি থাক! আমি বুঝাইয়া রাখমু!’

রবিউল রিকশা নিয়ে এসে হাঁক-ডাক আরম্ভ করে দিলে জয়নাব নিচু স্বরে বলে, ‘তোমার ভাইয়েরে সামনে বইসা ভাত খাওয়াইও! বিয়ান বেলা ঘুম ভাঙলে এক গেলাস পানি দিও! ঘুমাইয়া থাকলে ডাক দিয়া জাগাইয়ো না!’

রবিউল বাইরে থেকে ফের তাড়া দিয়ে বলে, ‘তর হইলো?’

জয়নাব ঘরের ভেতর থেকে সাড়া দিয়ে বলে, ‘হ, হইছে!’

তারপর ফিরোজাকে ছুঁয়ে ফের বলে, ‘দোয়া কইরো বুবু!’

জয়নাব বাইরে গিয়ে রিকশায় উঠলে রবিউল পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, ‘ট্যাকা-পয়সা লগে কিছু নিছস?’

জয়নাব অবাক হয়ে তাকায়। ‘ট্যাকার কাম কি?’

‘পাগল আর কারে কয়!’ বলে, একশ টাকার একটি নোট জয়নাবের আঁচলে বেঁধে দেয় রবিউল।

দশ

বেলা প্রায় ডুবুডুবু। এমন সময় তড়িঘড়ি ফিরে আসে রবিউল। আকাশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। ঘন হয়ে কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। এখন ভাদ্র মাস। এমন অসময়ে আকাশ কালো হওয়াটা কখনো দেখেছে বা শুনেছে বলে মনে হয় না তার। ঘনঘন মেঘভারাক্রান্ত আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে চিন্তাক্লিষ্ট মুখে পথ চলে সে।

ফিরোজা কেমন ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। রবিউল এখনও আসছে না।

আকাশে মেঘের তোড়জোর দেখতে পেয়ে আগে থেকেই দোয়া ইউনুস পড়তে অরম্ভ করেছে সে। হঠাৎ রবিউলকে দেখতে পেয়ে হাফ ছেড়ে ফিরোজা বললো, ‘তুই আইছস ভাই? আসমানে ম্যাঘ জমতে দেখলে আমার কইলজায় পানি থাকে না! মায় তখন আমারে কাঁথা দিয়া জাবড়াইয়া ধইরা রাখে! অখন ঝড়-তুফান শুরু হইলে কোই যামু?’

বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে থাকে ফিরোজা।

রবিউল এগিয়ে এসে বললো, ‘আর কোনো ডর নাই! চল তড়াতড়ি কিছু ডাইল-ভাত রান্দনের কাম কইরা ফালাই!’

ফিরোজা কান্না ভুলে যায়। বলে, ‘আসমান কালা হইতাছে দেইখ্যাই রান্দনের কাজ সাইরা ফালাইছি!’

‘আমি হাত-পাও ধুইয়া আইতাছি। তুমি হ্যারিকেনডা বাইর কইরা রাইখো!’

‘আমিও হাত-পাও ধুমু!’ বলে, ফিরোজাও বাইরে বেরিয়ে আসে।

হাত-পা ধোওয়া হয়ে গেলে ফিরোজা আগে আগে দৌঁড়ে ঘরে চলে আসে। আর তা দেখে হেসে কূল পায় না রবিউল।

তারপর ঘরে এসে নিজেই হ্যারিকেন বের করে চিমনি মুছতে বসে।

ফিরোজা বলে, ‘বেশি কইরা ত্যাল ভইরা রাখিস! রাইতের কাল কওন যায় না!’

রবিউল আলো জ্বালিয়ে নিরাপদ জায়গায় রেখে আকাশের অবস্থা দেখার জন্য বাইরে বেরিয়ে আসে। আর তখনই হঠাৎ ধূলো উড়িয়ে বাতাস ছোটে।

ফিরোজা কেঁদে উঠে বলে, ‘ঘরে আইস্যা পড়! আল্লারে! লা ইলাহা ইল্লা আন্তা…’

ধূলার কারণে চোখ মেলতে পারে না রবিউল। কোনোমতে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে ঘরে উঠে দরজায় খিল দেয়।

তারপর পরনের লুঙ্গির প্রান্ত তুলে চোখ-মুখ মোছে।

ফিরোজা চোখ বন্ধ করে সম্মোহিতের মত ক্রমাগত দোয়া পড়ে চলেছে। তার ভয়ার্ত চেহারা দেখে রবিউলের ভয় হয়, পাছে না আবার নতুন করে কোনো অঘটন ঘটে যায়। সে ফিরোজার একটি হাত ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলে, ‘বুবু! ঝড় তো শুরু হয় নাই, এমনেই বাতাস ছুটছে!’

কিন্তু ফিরোজা চোখ খোলে না। একই ভাবে দোয়া পড়তে থাকে।

রবিউল ভেতরে ভেতরে অসহায় হয়ে পড়ে।

এমন সময় বাইরে অকস্মাৎ বজ্রপাত হলে ফিরোজা কেবল ‘আল্লাগো!’ বলতে পারে। তারপরই যেন ভেঙেচুড়ে পড়ে

যায় মেঝেতে।

অচৈতন্য ফিরোজাকে নিয়ে এখন কী বা করতে পারে রবিউল? তবুও বিভ্রান্ত না হয়ে সে ফিরোজাকে কোনোরকমে টেনে ছেঁচড়ে বিছানায় নিয়ে তোলে। তারপর ফিরোজার চোখে-মুখে পানির ঝাঁপটা দেয়। ততক্ষণে টিনের চালে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে।

দু’চারবার পানির ছিঁটা দিতেই ফিরোজা চোখ মেলে তাকায়। কিন্তু প্রবল বৃষ্টির শব্দ পেয়ে ভূতগ্রস্থের মত রবিউলকে জাপটে ধরে। বাতাসের শোঁ-শোঁ শব্দ টিনের চালে দ্বিগুণিত হয়ে প্রতিহত হতে থাকলে ফিরোজার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। ফিরোজার অবস্থা দেখে রবিউলের কান্না পায়। অবুঝ শিশুর মত এই নারীকে সে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে? হঠাৎ তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে জয়নাবের উপর। কেন যে সে ফিরোজাকে নিয়ে আসতে গেল! তা ছাড়া একা থাকলে তার কী এমন অসুবিধা হতো? সামান্য খাওয়ার কষ্টই তো! প্রতিদিন কত মানুষই তো না খেয়ে থাকছে। সে তুলনায় দু’এক বেলার খাওয়ার কষ্ট নিতান্তই নগণ্য।

সে ফিরোজাকে বললো, ‘বুবু, আমারে ছাড়ো! তোমারে কাঁথা দিয়া ঢাইক্যা দিতাছি!’

কিন্তু ফিরোজার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। সে জোর করে ফিরোজার হাতের বেষ্টনী থেকে নিজকে ছাড়ালে ফিরোজা হাতের তালু দিয়ে দু’কান চেপে ধরে।

রবিউল একটি কাঁথা নামিয়ে এনে তা দিয়ে ফিরোজার নাকে-মুখে পুরো শরীর ঢেকে দিলেও কাঁপুনি বন্ধ না হয়ে বরং বাড়তে থাকে। সে কাঁথার উপর দিয়ে ফিরোজাকে জাপটে ধরে রাখে। সে সাথে ফিরোজার কারণে আসন্ন বিপদের আশঙ্কায় তার চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে। একদিকে প্রকৃতির ভয়ে কাঁপে ফিরোজা। অন্যদিকে তারই বিপদাশঙ্কায় কাঁপে রবিউল।

এক সময় ঝড় থামে। সে সাথে থামে রবিউলের বুকের কাঁপুনিও। কিন্তু ফিরোজার কোনো সাড়া-শব্দ না পেয়ে কাঁথার প্রান্ত তুলে রবিউল আবিষ্কার করে যে, অঘোরে ঘুমাচ্ছে ফিরোজা।

সে ফিরোজাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। দরজা খুলে একবার বাইরে উঁকি দেয়। কিন্তু ঠাহর করতে পারে না কিছুই। হ্যারিকেনের আলো হাতে সে বাইরে বেরিয়ে আসে। উঠোনের এখানে ওখানে পানি জমে আছে। বাড়ির নামার দিকের মরিচের জমিগুলোতে হয়তো আরো বেশি পানি জমেছে। সময় মত পানি না সরালে চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। সবার আগে উঠোনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি সরানোর জন্য নালা কেটে দিতে হবে। নয়তো আবার বৃষ্টি হলে কোনোখান দিয়ে বাড়ির মাটি ধ্বসে যেতে পারে।

আকাশ এখনও ভারী আর গুমোট মনে হয়। যে কোনো সময় আবার বৃষ্টি আরম্ভ হতে পারে। তার আগেই রাতের খাওয়া আর নালা কাটার কাজগুলো সারতে হবে।

রবিউল ঘরে এসে ফিরোজাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে।

ঘুম ভাঙতেই কেমন অবাক চোখে রবিউলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে ফিরোজা।

ফিরোজার অবাক দৃষ্টি লক্ষ্য করে রবিউল জিজ্ঞেস করে, ‘কি দ্যাহো বুবু?’

‘তুই রবিউল না?’

‘হ! আমারে চিনতে পারতাছো না?’

‘কহন আইলি?’

রবিউল বুঝতে পরে যে, ফিরোজার ঘুম পুরোপুরি ভাঙেনি। হ্যারিকেনটা উঁচিয়ে ফিরোজার মুখে আলো ফেলে বলে, ‘ঝড়-বাদল অনেকক্ষণ হয় থাইম্যা গেছে!’

ফিরোজা কাঁথা সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে। একবার শব্দ করে হাই তুলে বলে, ‘মনে করছিলাম আমাগো বাইত্যেই আছি!’

তারপর দু’হাত পেছনে নিয়ে এলোমেলো চুলগুলো টেনে খোঁপা বাঁধে। সে সময় তার গলায় আর বুকে বিন্দুবিন্দু ঘাম চিক চিক করতে দেখে রবিউল।

গায়ে আঁচল জড়িয়ে ফিরোজা বিছানা থেকে নেমে বলে, ‘তুই ভাত খাইছস?’

রবিউল খোলা দরজা পথে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘তোমারে ফালাইয়া ভাত খামু এইডা ক্যামন কথা কইলা?’

ফিরোজা শরীর টেনে টেনে এগিয়ে আসে। বলে, ‘তুই বাইরে কি দেখস?’

‘তুমি ভাত বাড়ো! আমি উঠানের পানিগুলা ছাইড়া দিয়া আইতাছি!’

ফিরোজা রবিউলের পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বাতিডা একটু ধর, আমি বাইরে যামু!’

রবিউল হ্যারিকেন হাতে দরজার সামনে দাঁড়ালে ফিরোজা বদনি হাতে করে সামনের অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর ফিরোজাকে ফিরে আসতে দেখে রবিউল হ্যারিকেনটাকে দরজার পাশে রেখে কোদাল হাতে উঠোনে জমে থাকা পানি সরানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

ফিরোজা উঠোনে দাঁড়িয়ে অন্ধকারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রবিউলের কাজ পর্যবেক্ষণ করে। তার মনে হয় হ্যারিকেনটা হাতে নিয়ে রবিউলের পাশে দাঁড়ালে তার কাজের সুবিধা হবে। এই ভেবে সে হ্যারিকেন নিয়ে রবিউলের সামনে দাঁড়ালে রবিউল উচ্ছ্বাস প্রকাশে কার্পণ্য করে না। বলে, ‘এতক্ষণে সব পরিষ্কার হইছে!’

ফিরোজা রবিউলের উচ্ছ্বাসকে পাত্তা না দিয়ে বলে, ‘তাড়াতাড়ি কাজ শেষ কর দেহি, আমার জবর ক্ষিদা পাইছে!’

‘তাইলে তুমি ঘরে গিয়া ভাত বাড়! আমি অক্ষনই আইতাছি!’

ফিরোজা কিছুক্ষণ দেরি করে হ্যারিকেন নিয়ে ঘরে চলে যায়। অন্ধকারে কাজ করতে রবিউলের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না।

ফিরোজা ভাত বেড়ে রবিউলের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার জন্য এটা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। এ পর্যন্ত কারো জন্য ভাত বেড়ে অপেক্ষা করার কোনো প্রয়োজন পড়েনি তার। এমনকি জীবনের এতটা সময় পার করে দিয়ে এসেছে, অথচ কখনও কারো জন্য প্রতীক্ষার ক্ষণ তার জীবনে আসেনি। তাই এখন সামনে ভাত নিয়ে রবিউলের জন্য অপেক্ষা করার ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অদ্ভূত এক আনন্দের উৎস হয়ে দাঁড়ায়।

রবিউল খেতে বসে হঠাৎ ফিরোজার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো, ‘বুবু, তোমার মুখটা ফুলাফুলা লাগে ক্যান?’

‘এইডা কিছু না!’ ফিরোজা হাসে। ‘ডরাইলে আমার এমন হয়!’

রবিউল অবাক না হয়ে পারে না। তার মন অজানা আশঙ্কায় ফের দুরুদুরু করে।

ফিরোজার রান্না খুব একটা খারাপ না হলেও তেমন ভালো লাগে না। তবে খাওয়া চলে। কোনো একটি মসলার উপাদান কম হয়েছে মনে হয়। কিন্তু সে অভাবটা সে ধরতে পারে না। এ রান্নার তুলনায় জয়নাবের রান্না তার কাছে অমৃত বলে মনে হয়। কোথাও গেলেও সে অন্যের হাতের রান্না খেয়ে তৃপ্তি পায় না। যে কারণে অন্যের বাড়িতে পেট পুরে খেয়ে এলেও নিজের ঘরে না খেলে তার খাওয়ার অতৃপ্তি দূর হয় না। এ নিয়ে জয়নাবের অনুযোগের শেষ নেই। সাথে কিছুটা গর্ব আর আনন্দও তাকে আন্দোলিত করে হয়তো। রবিউল সেটা বুঝতে পারে। কিন্তু এখন রান্না সম্পর্কে ফিরোজাকে সে কিছুই বলে না। তবে ফিরোজা হয়তো বুঝতে পারে রান্না খুব একটা ভালো হয়নি। বলে, ‘রান্দা ভালা হয় নাই?’

‘হইছে। খুবই চমৎকার! তয় জনুর কাছে আরো ভালা রান্দন শিখতে পারবা!’

ফিরোজা নিজের পাতের ভাত মাখাতে মাখাতে বলে, ‘বুঝতে পারছি তেমন ভালা হয় নাই! তয় কয়দিন পরে ঠিক হইয়া যাইবো। আমি তো রান্দন শিখছি বেশি দিন হয় নাই! তা ছাড়া তরকারিতে রশুন দিতে পারি নাই। কই আছে তাও খুঁইজা পাই নাই!’

রবিউলের কাছে মনে হচ্ছিলো তরকারিতে কোনো একটি জিনিস নেই। এখন সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বললো, ‘কাইল খুঁইজ্যা দেখমুনে! নাইলে হাটের থাইক্যা আইন্যা দিমু!’

খাওয়ার পরপরই প্রচণ্ড ঘুম পায় রবিউলের। সে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। বলে, ‘আমার অনেক ঘুম পাইছে বুবু! তুমি ঘুমানের আগে তোমার দিকের সিটকিনি লাগাইয়া দিও!’

‘আইচ্ছা, তুই ঘুমা! আমার শুইতে দেরি আছে!’

ফিরোজার থালা-বাটি গোছানোর কাজ শেষ হওয়ার আগেই রবিউলের নাক ডাকার মিহি শব্দ শোনা যায়। ঘুমুতে যাওয়ার আগে জয়নাবের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ায় ফিরোজা। সমস্ত চুলকে তিন ভাগ করে একটির উপর আরেকটা দিয়ে বেণি পাঁকায়। গলায় বুকে জয়নাবের সুগন্ধী পাউডারের কৌটা থেকে পাউডার লাগায়। আয়নার গায়ে লাগানো লাল টিপ থেকে একটি নিয়ে কপালের মাঝখানে লাগিয়ে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের মুখ দেখে। পুরো মুখ দেখা যায় না। তবে তাকে অসুন্দর মনে হয় না। টিপটা আলতো করে খুলে আবার আয়নার গায়ে বসিয়ে দিয়ে বিছানা ঝাড়ে। পরিপাটি হলেও তৎক্ষনাৎ বিছানায় এলিয়ে পড়ে না সে। হ্যারিকেনটা রবিউলের খাটের পাশে রেখে ফিওে এসে বিছানায় বসে ফিরোজা।

তারপর একই ভাবে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে শুয়ে পড়লেও অনেকটা সময় তার ঘুম আসে না। টিনের চালে টিপটিপ করে আবার বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে। ঝাঁপের ওপাশে হ্যারিকেন জ্বললেও এপাশের অন্ধকার খুবই গাঢ় মনে হয়। মনে হয় চোখ বন্ধ করলেই অন্ধকার এসে তাকে গ্রাস করে নেবে। তার কেমন ভয়ভয় করে। একাএকা সে কখনোই ঘুমাতে পারে না। এতদিন ঘুমিয়েছে মায়ের সঙ্গে। আজ তাই একা শুয়ে কেমন অসহায় বোধ করে। বাইরে কোলাব্যাঙ অথবা সোনাব্যাঙের অনবরত ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙ ডাক তার ভয়কে ত্রাসে পরিণত করে। সে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। নিজের ছায়া দেখে নিজেই চমকে ওঠে। ঝাঁপের দরজায় দাঁড়িয়ে উঁকি মেওে রবিউলকে দেখে। কেমন কুঁকড়ে-মুকরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে মানুষটা। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ দীর্ঘ আর ভারী বলে মনে হয়।

খাটের পাশে হ্যারিকেনের দিকে চোখ পড়লে আলোটা হঠাৎ করেই যেন তীব্রতর হয়ে তার চোখের মণিতে আঘাত করে। আলোটাকে পছন্দ করতে পারে না সে। এগিয়ে গিয়ে সলতেটা নামিয়ে আলোর আঁচ কমিয়ে দেয়। আরো খানিকটা কমাতে চাইলে আলোটা হঠাৎ করেই নিভে যায় আর সঙ্গেসঙ্গেই যেন সমস্ত অন্ধকার এসে একযোগে হামলে পড়ে তার উপর। খানিকটা পর অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে সে এগিয়ে যায় রবিউলের বিছানার দিকে। অসাবধানে হঠাৎ রবিউলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ার মত হলে সে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কিন্তু রবিউলের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দের উঠানামায় কোনো হেরফের হয় বলে মনে হয় না।

শ্বাস বন্ধ করে খুবই সাবধানে রবিউলের বিছানায় উঠে পাশে শুয়ে পড়ে ফিরোজা আর তারই সঙ্গে সঙ্গে কেমন অপার্থিব এক প্রশান্তি যেন ঘিরে ধরে তাকে। এতকাল যে অব্যক্ত যন্ত্রণা আর নিদারুন অস্থিরতায় সে বিদ্ধ হয়েছে রাতের পর রাত, তার কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত থেকেছে আরো দীর্ঘ সময়। কিন্তু সে পারেনি দূর্জ্ঞেয় সে রহস্যের জাল ছিন্ন করতে। কারো কাছে সে অনুভূতির কথা ব্যক্ত করবে এমন কাউকে সে পায়নি। অথচ রবিউলের পাশে শোওয়ার পর আপনা আপনিই যেন খুলে গেল সে রহস্যের রুদ্ধ দ্বার।

বৃষ্টির রাত বলে কিছুটা শীতশীত বোধ হয় ফিরোজার। পায়ের কাছ থেকে কাঁথাটা টেনে কোমর অবধি টেনে দেয় আর তখনই তার কেন জানি মনে হয় যে, রবিউলেরও শীতশীত বোধ হচ্ছে। কাঁথার একাংশ রবিউলের গায়ের উপর দিতেই সে আরো গুটিয়ে এসে মুখ গোঁজে ফিরোজার বুকে।

রবিউলের জন্য ভীষন মায়া হয় ফিরোজার। অস্তিত্বের ভেতর থেকে যেন তার জন্য জেগে ওঠে আরো নিবিড় মমতা। আর সে মমতা থেকেই হয়তো বুকের সঙ্গে রবিউলকে জড়িয়ে নিতে তার দ্বিধা হয় না। ঠিক তখনই রবিউল ঘুমের ঘোরে জয়নাবের বুকের মিষ্টি আর পাগল করা গন্ধটা পায়। কি ঘুম, কি জাগরণে সে বিড়বিড় করে বলে, ‘জনু! জয়নব!’

কিন্তু ফিরোজা ফিরোজাই। সে চায় রবিউল জানুক সে জয়নাব নয়। তাই রবিউলের কানের কাছে মুখ রেখে ফিস ফিস করে বলে, ‘আমি ফিরোজা!’

রবিউলের চোখ থেকে হঠাৎ ঘুম উধাও হয়ে যায়। স্বাভাবিক বিবেক বোধ আর সংকোচ থেকে তড়িতাহতের মত নিজকে ফিরোজার বন্ধন থেকে বিযুক্ত করতে চাইলে তাকে আরো নিবিড় ভাবে আঁকড়ে ধরে ফিরোজা বলে, ‘জয়নাব কইছে না আমারে কষ্ট না দিতে?’

রবিউলের মনে পড়ে যে, অনেকদিন আগে এক কাকভোরে দূর্দমনীয় শরিরী আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো ফিরোজা। পরে অভিসারের পরিকল্পনা নিয়ে ফিরেও গিয়েছিলো। কিন্তু সময়মত সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো তার স্বাভাবিক চেতনাবোধ। বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো মস্তিষ্ক। কিন্তু এর পরও হয়তো সে চাওয়াটুকু থেকে গিয়েছিলো তার অবচেতনে। তাই রবিউল চায় না তার অবিবেচনা প্রসূত ব্যর্থতা আর স্বপ্ন-ভঙ্গের দায়ভার ফিরোজা একাই বয়ে বেড়াক, কিংবা তা সামলানোর বেদনা সহ্য করার মাশুল দিতে গিয়ে ফের পাগল হয়ে যাক।

এগার

ঘরে কি বিয়ান বেলাই চান্দ নাইম্যা আইছে?

রবিউল কবি বা সাহিত্যিক নয়। নিতান্তই সাধারণ এক কৃষক-সন্তান। বিদ্যার জোর বেশি না থাকলেও বিদ্যা বা জ্ঞানার্জনের প্রতি রয়েছে বিপুল আগ্রহ। তবে কবিতা এমনই একটি অদ্ভূত ব্যাপার যে, একজন নিরক্ষর বা অন্ধ মানুষও অকস্মাৎ কবি হয়ে উঠতে পারে।

ঘুম থেকে জেগে রবিউল যখন বিছানায় উঠে বসলো, তখনই ফুল তোলা একটি কাচের গ্লাসে করে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে ফিরোজা। আর তাকে দেখে প্রথমেই চাঁদের কথাটা মনে আসে রবিউলের।

সাধারণ মানুষের চাঁদ নিয়ে আদিখ্যেতা থাকে না। তাই তার প্রেমিকার চাইতে চাঁদও সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। রবিউল তেমন শ্রেণীর মানুষ হলেও ফিরোজার এখনকার সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনা করার জন্য ভিন্ন কিছুর কথা ভাবতে পারলো না। তাই হঠাৎ করে ফিরোজাকে দেখে প্রথমেই তার মনে এসেছে চাঁদের কথা।

ফিরোজা এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী। তার উপর ভোরে কখন উঠে গোসল করেছে কে জানে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে আছে সারা পিঠে। পরনে জয়নাবের একটি নীল সূতির শাড়ি। সাথে একই রঙের ব্লাউজ। মনে হচ্ছিলো এখনি সে ডানা মেলে উড়াল দেবে। রবিউল মুগ্ধ চোখে ফিরোজার সৌন্দর্যে থমকে যায়।

মানুষ যখন সুখী আর পরিতৃপ্ত থাকে, তখন তাকে ঘিরে আলাদা একটি জ্যোতি ক্রমাগত পাক খেতে থাকে। হয়তো সে জ্যোতির প্রভাবেই সে দিনদিন আরো প্রশান্ত আর দীপ্তিময় হয়ে উঠতে থাকে। ফিরোজাও এখন তেমনি একটি জ্যোতির্বলয়ের মধ্যমণি হয়ে ভাসছে।

ফিরোজার হাত থেকে পানির গ্লাস নিতে নিতে রবিউল বলে, ‘তোমারে দেইখ্যা মনে হইতাছে আমার ঘরে চান্দ নাইম্যা আইছে!’

ফিরোজা মিষ্টি করে হেসে মাথা দোলায়। ইচ্ছে হয় রবিউলকে আদর করে। কিন্তু দিনের আলোতে অনেক সমস্যা। এমন সুন্দর কথা এ পর্যন্ত কেউ তাকে বলেনি। রবিউলের কথা শুনে তার মন এতটাই উদ্বেলিত হয় যে, মনে হয় সে বুঝি আবার পাগল হয়ে যাবে। কেন এত সুন্দর করে কথা বলছে রবিউল? মাজেদা আর ফালুর কথা শুনতে শুনতে তার মনে বিশ্বাস এসে গিয়েছিলো যে, পৃথিবীর যাবতীয় কথা এমনই বিরস আর তিক্ত। কথা যে, এত মিষ্টি হতে পারে, কথা শুনতে যে এত ভালো লাগে, এও এখনই সে জানলো। তবুও কেন জানি এ কথা শুনে তার মন ভরে না। আরো কিছু একটা শুনতে যেন মন উম্মুখ হয়ে আছে। তাই হয়তো সে কেমন বিবশ চোখে রবিউলের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে।

ফিরোজার দৃষ্টি লক্ষ্য করে রবিউল বলে, ‘কী দ্যাখতাছো?’

‘আর কিছু মনে হয় না?’

রবিউল দু’ঢোক পানি গিলে বলে, ‘আর কি মনে হইবো?’

‘মনে হয় না জয়নাব এমন, আমি হ্যামন?’

‘তাতো মনে হয়ই!’ বলে, রবিউল হাসে।

এই হচ্ছে চিরন্তন নারী। যে সর্বদা নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। কী করে সে অন্যের চোখে শ্রেষ্ঠ হয়ে উঠবে, সে প্রতিযোগীতায় যার জীবনের অনেকটা প্রাণশক্তি ফুরিয়ে যায়। যে কারণে দ্বন্দ্ব চলে, সতীনে সতীনে। দ্বন্দ্ব মাতা-কন্যায়, জায়ে-জায়ে, কখনও জায়ে-ননদে, শাশুড়ি-পুত্রবধূতে। এখনও রবিউলের কাছে কে শ্রেষ্ঠ, জয়নাব না ফিরোজা? তারই যেন একটি সূক্ষ্ণ সীমারেখায় দুলতে থাকে ফিরোজার জিজ্ঞাসা। আর অনাদিকাল থেকেই দুষ্টু পুরুষ অন্যের চোখে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানের ছায়াযুদ্ধে আত্মবিস্মৃত নারীকে বুদ্ধু বানিয়ে এসেছে। নির্বোধ নারী নির্দ্বিধায় তা মেনেও নিয়েছে। সব যুগে তাই সকল নারী মিথ্যাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে এসেছে। যে কারণে নিরেট সত্যটা তারা স্বাভাবিক চিত্তে কখনোই মেনে নিতে পারে না।

‘ক না একটু হুনি!’

ফিরোজা রবিউলের পাশে বিছানায় বসে পড়ে।

‘হুনতে চাও?’ রবিউলের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি।

‘হুননের লাইগ্যা আমি পাগল-পাগল হইয়া রইছি!’

ফিরোজা যেন সহস্র রঙে ঝলমল করে ওঠে।

কিন্তু রবিউল ভাবনায় পড়ে যায়। কী যে এখন সে ফিরোজাকে বলবে মাথায় আসছে না কিছুই। তবুও সে ভেবে চিন্তে বলে, ‘জনু যদি হয় চোখের কাজল, তাইলে তুমি কপালের টিপ। তুমি যদি হও গলার হার, জনু তাইলে নাকফুল!’

ফিরোজা কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকে।

তারপর বলে, ‘কথাডা কি দাঁড়াইলো?’

রবিউল গ্লাসটা ফিরোজার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, ‘একটু ভাইব্যা দ্যাহো!’

ফিরোজার মন খারাপ না হলেও কিছুটা হতাশ না হয়ে পারে না। দু’হাতের তালুতে গ্লাসটা চেপে ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে রবিউলের দিকে ফিরে বলে, ‘দুইডার কোনোডা না হইলেও তো চলে!’

‘চলে। আবার চলেও না!’

ফিরোজা কেমন সন্দেহ মাখা দৃষ্টি নিয়ে তাকায় রবিউলের দিকে। বলে, ‘বুঝলাম না!’

‘কাজল পিন্দলে ভালো লাগে। লগে কপালে একটা টিপ হইলে আরো ভালো।! নাকফুল সবসময় নাকে থাকলেও ওইডার কথা কেউ জিগায় না। গলায় একদিন হার পিন্দলেও ওইডার কথাই সবে কয়!’

ফিরোজা কেমন স্থানুর মত হয়ে গভীর ভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবে। তবুও রবিউলের কথা তার কাছে কেমন হেয়ালী বলে মনে হয়। হঠাৎ সে রবিউলের হাত ছূঁয়ে বলে, ‘কোনোদিন যদি এই বাড়ি থাইক্যা আমারে কাইন্দা বাপের বাড়ি ফিরা যাইতে হয়, তাইলে বিষ খাইয়া মরমু!’

তারপরই হঠাৎ উঠে যায় সে।

ফিরোজার কথা শুনে রবিউল একবার বিষম খায়। বলে, ‘বুবু!’

ফিরোজা ঝাঁপের দরজার কাছে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। তার মুখ কেমন থমথম করে।

রবিউল বলে, ‘নাকফুল ফকিন্নির নাকেও থাকে! কিন্তু গলার হার পিন্দনের কপাল কয়জনের হয় ভাইব্যা দেখছো?’

ফিরোজার মুখ সহসা উজ্জ্বল হয়ে উঠবার সঙ্গে সঙ্গে তার চারপাশে কিছুক্ষণ আগেকার সে জ্যোতির্বলয় ফিরে আসে যেন। সে সঙ্গে কেমন ঢেউয়ের মত ছন্দময় গতিতে ফিরোজা ঝাঁপের ওদিকে আড়াল হয়ে যায়।

মুগ্ধ রবিউল ভাবে যে, এতদিন সে একভাবে জয়নাবের দিকেই ঝুঁকে ছিলো। ফিরোজা এসে যেন তাকে নিক্তির কাঁটার মত সোজা ও স্বাভাবিক হতে সহযোগীতা করলো। এ না হলে বোধ হয় সে কখনোই বুঝতে পারতো না যে, জয়নাব তাকে কতটুকু অধিকার করে রেখেছিলো আর কত গভীর ভাবেই না সে জয়নাবে নিমজ্জিত হয়েছিলো। ফিরোজা এসে যেন তাকে জয়নাবের হৃদয়ের কারা প্রকোষ্ঠ থেকে উদ্ধার করে আলো বাতাসের সংস্পর্শে এনে স্বাভাবিক জীবনের সন্ধান দিল।

ভাবতে ভাবতেই রবিউল বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। পাক-ঘরের মাটির চুলা থেকে এক চিমটি ছাই নিয়ে দাঁত ঘঁষতে ঘঁষতে পুকুরের দিকে যায়। কিন্তু অর্ধেক পথে গিয়ে তার মনে পড়ে যে, লুঙ্গি-গামছা সঙ্গে করে আনা হয়নি। বাড়ির দিকে ফিরে আসতে গিয়েও আর না ফিরে পুকুরের দিকেই যায়। গোসল সেরে সে ভেজা কাপড়েই ফিরে এসে দরজায় দাঁড়ায়। ‘বুবু, গামছা আর লুঙ্গিডা দ্যাও দেহি!’

ফিরোজা গামছা আর লুঙ্গি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘লুঙ্গিডা এমনেই চিপ্যা থুইয়া দে! পরে সাবান দিয়া ধুইয়া দিমু!’

ফিরোজার কথাটা রবিউলের কাছে একবারেই আনকোরা মনে হয়। বিস্মিত ভাবে একবার মুখ তুলে তাকালেও কিছু বলে না সে।

ফিরোজা হয়তো রবিউলের এই আকস্মিক পরিবর্তনটা খেয়াল করে না। ঘুরে ঘরের ভেতর আড়াল হয়ে যায়।

রবিউল বিয়ের এতগুলো দিন পার করে দিলেও জয়নাবের মুখে কখনও এমন ধরনের কথা শুনতে পায়নি। তা ছাড়া নিজের কাপড় নিজেই ধূয়ে আসছে সব সময়। কেউ যে তার কাপড় ধূয়ে দিতে পারে বা তার কাপড় ধূয়ে দেওয়ার মত হতে পারে, এ ভাবনাটাই তার মনে কখনো উদয় হয়নি।

একবার ধান কাটার সময় কাস্তের টান লেগে তার হাত কেটে গিয়েছিলো। তখন জয়নাব তার মুখে মাখাভাত তুলে দিলেও কখনও বলেনি যে, লুঙ্গিটা ঘাটে ফেলে আসতে বা রেখে দিতে। যা পরে ইচ্ছে করলেই ধূয়ে দিতে পারতো সে।

রবিউল ফিরোজার কথায় খুশি হলেও কথা মত কাজ করে না। সে নিজেই লুঙ্গিটা সাবান দিয়ে ভালোমত ধূয়ে রোদে ছড়িয়ে দিয়ে ঘরে আসে। ‘বুবু, দুইডা মুড়ি দ্যাও দেখি!’

ঠিক তখনই বাইরে হাতেম আলির কণ্ঠস্বর শোনা যায়।

রবিউল ঘর থেকেই বলে, ‘ক্যাডা, হাতেম ভাই?’

হাতেম আলি ঘরে প্রবেশ করতেই রবিউল বলে, ‘এত বিয়ানে কি মনে কইরা?’

‘তুই অখনও তৈয়ার হস নাই?’ হাতেম আলির চোখ দুটো কেমন বড় বড় মনে হয়।

রবিউল হাতেম আলির কথা বুঝতে পারে না। বলে, ‘তৈয়ার হই নাই মানে?’

‘নূরপুর যাইতে হইবো না! দেরি হইলে কি গাড়ি পামু?’

রবিউল চুপ করে থাকে। সে ভেবে পায় না যে, হাতেম আলির সঙ্গে এমন কথা কখন হলো।

ফিরোজা একটি থালায় করে গুড়-মুড়ি নিয়ে রবিউলের দিকে এগিয়ে এলে হাতেম আলি চমকে উঠে বলে, ‘ফিরোজা কহন আইলি?’

ফিরোজা থতমত হয়ে বলে, ‘কাইল। জয়নব এত কইরা ধরলো…’

ফিরোজার পিঠময় ভেজা চুল দেখতে পেয়ে হাতেম আলি আবার বলে, ‘তর চুল ভিজা দ্যাহা যায়, গোসল করছস নাহি?’

রবিউল কেমন বোকার মত হা করে তাকিয়ে থাকে ফিরোজার মুখের দিকে। ফিরোজার কথা বানাতে দেরি হয় না। বলে, ‘গোসল না কইরা কি শইল্যে ক্যাঁদা মাইখ্যা রবুরে খাইতে দিমু, কন? আর বাড়িও মাশাল্লা এমন যে, এহান দিয়া পিছল তো ওহান দিয়া খানা-খন্দ! এমন বাইত্যে আইয়াও তো বেইজ্জত হইতে হয়!’

হাতেম আলির চেহারা দেখে মনে হয় কথাগুলো ঠিক বিশ্বাস হয়নি তার। কেমন কাঁটা-কাঁটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফিরোজার মুখের দিকে।

হাতেম আলির অদ্ভূত দৃষ্টির সম্মুখে ফিরোজার কেমন ভয়ভয় করে। সে রবিউলের সামনে থালা রেখে দ্রুত আড়ালে চলে যায়।

রবিউল থালা থেকে মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে হাতেম আলিকে বলে, ‘মুড়ি খাও!’

হাতেম আলি মুড়ি নেওয়ার বদলে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘তর কি যাওনের ইচ্ছা নাই?’

রবিউল মিটমিট করে হাসে। বলে, ‘কহন যাইতে চাও?’

হাতেম আলি অস্থিরভাবে বলে, ‘কইছিলাম তো অখনই!’

‘তোমার বুদ্ধিও দেহি বুড়া হইয়া গেছে লাগে!’

তারপরই সে ফিরোজাকে ডাকে। ‘বুবু, বুবু!’

ফিরোজা ঝাঁপের দরজায় মুখ বাড়ায়, ‘কি কইবি?’

রবিউল হাতেম আলিকে দেখিয়ে বলে, ‘হুনো বুইড়ার কথা! হ্যার বউ রাগ হইয়া গেছে বাপের বাড়ি! আমরা গিয়া ওই বাইত্যে কহন খাইতে পাই, নাকি খাওনই না দেয়, তার কি ঠিক আছে? নিজের বাইত্যে খাইয়া যাওন ভালা হইবো না?’

ফিরোজা বলে, ‘এমন তো নাও হইতে পারে!’

ফিরোজাকে সমর্থন করতেই যেন জিহ্বায় ঠোঁট ভিজিয়ে হাসে হাতেম আলি।

রবিউল বললো, ‘তাইলে বুবু চাইরডা ভাত বসাইয়া দ্যাও! আমরা একলগে খাইয়াই বাইর হমু!’

ফিরোজার ভাই ফালুর সঙ্গে হাতেম আলির সম্পর্ক বেশ ভালোই বলতে গেলে। রবিউলের ঘরে ফিরোজার অবস্থানটা ভালো মনে মেনে নিতে পারে না সে। যদিও বলতে গেলে সারাটা বছর কোনো না কোনো ভাবে রবিউলের সাহায্য ছাড়া তার কোনো সপ্তাহ চলে না। তবুও রবিউলকে সে কম ঈর্ষা করে না। রবিউলের বিভিন্নমুখী সৌভাগ্যের কারণে তাকে কিছুটা ঘৃণাও করে। কিন্তু অর্থ-বিত্তের দিক দিয়ে প্রায় পঙ্গু বলেই স্বার্থহানির ভয়ে মনোভাব প্রকাশ করতে পারে না হাতেম আলি। ভেতরে ভেতরে তাই ফিরোজার বিষয়টা ফালুর সাথে আলাপ না করে সে শান্তি পাচ্ছে না। কিছুটা ব্যস্ততার সঙ্গেই উঠে পড়ে সে বললো, ‘তুই তাইলে তৈয়ার হ। একটা কাজ সাইরা আমি অখনই আইতাছি!’

রবিউল বললো, ‘তুমি যেহানেই যাও, আমার লগে দুই মুঠ ভাত খাইও!’

‘পরে হইবোনে!’

হাতেম আলি বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই ফিরোজা এসে বললো, ‘মানুষটারে বেশি সুবিধার মনে হইতাছে না। কেমন জানি মাজেদার মত মনে হইলো!’

ফিরোজার কথা রবিউল আমলে না এনে বললো, ‘তুমি এমন ভালা একটা মানুষরে কার লগে জোড়া দিতাছ?’

‘তাও, চোখ দুইডা জানি কেমন!’

রবিউল ফিরোজাকে আশ্বস্ত করতে বলে, ‘গরিব আর অভাবী মানুষ মনেমনে হিংসা করন আর গাইল পারনের বেশি কিছু করতে পারে না। হাতেম ভাইরে নিয়া তুমি আজাইরা চিন্তা কইরো না!’

তবুও ফিরোজা কিছুটা শঙ্কিত চিত্তেই রান্না ঘরে এসে ঢোকে।

বার

রবিউলের ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় উড়ে এসেও ফালুর দেখা পায় না হাতেম আলি।

মাজেদার কাছে জানতে পারলো যে, সে গেছে গোবিন্দ মুচির কাছে। ‘ফালুর আইতে কি দেরি হইবো?’

‘মনে হয় না!’ মাজেদা জলচৌকি এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘কিছুক্ষণ বইসা দেখেন!’

হাতেম আলি জলচৌকি টেনে বসতেই মাজেদা বললো, ‘একটা কথা হুনলাম, ঘটনা কি সত্য?’

হাতেম আলি অবাক হয়ে তাকায় মাজেদার দিকে।

তারপর বলে, ‘কোন ঘটনা?’

‘ময়নার মায় নাকি আর আইবো না?’

‘কার কাছে হুনলা?’

মাজেদা মুখ টিপে বলে, ‘যার কাছেই হুনি, কথাডা সত্য না মিছা?’

হাতেম আলি সরাসরি জবাব না দিয়ে বললো, ‘মানুষ চেতলে কত কিছুই কয়! সব সময় সব কথা ধরলে কি চলে?’

নিজের ব্যাপার অন্যের মুখে শুনতে ভালো লাগে না হাতেম আলির। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে সে মাজেদাকে বললো, ‘ফিরোজারে দেখলাম রবুর ঘরে! পিন্দনে নয়া কাপড়, মাথার চুল ভিজা! বিয়া হইছে নাহি?’

মাজেদা হাস্যোজ্জ্বল মুখে জানায়, ‘কাইল জয়নাব আইয়া নিয়া গেছে! রবুর লগে ফিরোজার অখন বিয়া না হইলেও কয়দিন পরে ঠিকই হওন লাগবো!’

হাতেম আলি তবুও কথাটাকে নিয়ে প্যাঁচায়। বলে, ‘রবুর বউ বাইত্যে নাই, একই ঘরে ফিরোজা আর রবু। ব্যাপারডা জানি ক্যামন! নাইলে ফিরোজা বিয়ান বেলা গোসল করলো ক্যান? রবুর ভিজা লুঙ্গিও দেখলাম রৈদে ছড়াইন্যা!’

‘কত কারণেই গোসলের কাম লাগতে পারে! আপনে যা সন্দ করতাছেন তা আমার বিশ্বাস হয় না! ফিরোজা এই জাতের মাইয়া না! তারে আমি পছন্দ না করলেও যা হওনের না তা কই ক্যামনে?’

‘তয় যাই কও ভাবি, কামডা তোমাগো ঠিক হয় নাই!’

‘ঠিকই হইছে! আমি খুশি হইছি!’ মাজেদা হাসে।

তারপর আবার বলে, ‘আপদ বিদায় হইছে!’

‘কিন্তু গ্যারামের মানুষে কি কইবো?’

মাজেদাকে উস্কে দিতে চেষ্টা করে হাতেম আলি। ‘তারা কি দশজনের বাইরে?’

কিন্তু মাজেদা ঠোঁট উল্টিয়ে বলে, ‘দশজনে কইবো কি? বেশি হইলে শাইল্যাস কইরা হ্যাগো বিয়া দিবো। তহন ফিরোজার সম্পদের মালিক হইবো রবু। দশজনে কি ওই সম্পদ আমাগরে দিয়া যাইতে পারবো?’

‘বিয়া হইলে তোমার খুশি হওনের কি আছে?’

‘আছে, আছে!’

মাজেদার মুখ ঝলমল করে ওঠে।

তারপর সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘জয়নাবের অনেক দেমাক হইছে! আমারে কয় পাগলনীর পাও ধুইয়া পানি খাইতে! হ্যাগো বিয়া হইলে আমি দূরের থাইক্যা দুই সতীনের কামড়া-কামড়ি আর চুলাচুলি দেখমু!’

মাজেদার এখানে সুবিধা করতে না পেরে উঠে পড়ে হাতেম আলি। এখানে বসে মাজেদার কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার। বিরক্তি গোপন করে সে বললো, ‘অনেকক্ষণ তো বইলাম, ফালুর আইতে মনে কয় আরো দেরি আছে। আমি তাইলে যাই!’

মাজেদা পেছন থেকে বলে, ‘আপনের ভাই আইলে কিছু কমু?’

‘না, থাউক!’

হাতেম আলি ফের দ্রুত পা চালিয়ে রাস্তায় নামে। মনেমনে রবিউলের উদ্দেশ্যে বলে, ‘আগে বউডারে ফিরা পাই, তার বাদে তোমারে আমি সম্পদের মালিক হওয়াইতাছি! ট্যাকার গরমে তুমি আমারে বুইড়া কও!’

বিরস আর ব্যর্থ হয়ে রবিউলের কাছে ফিরে এলেও মনের ভেতরকার ঈর্ষা আর পাপ বোধের কারণে সকালের মত সহজ হতে পারে না হাতেম আলি। কেমন একটা অস্বস্তি তাকে চোখ তুলে তাকাতে বাধা দেয়।

রবিউল ফিরোজাকে ভাত দিতে বললেও হাতেম আলি বলে, ‘তুই খাইয়া ওঠ, আমার ক্ষিদা নাই!’

‘আরে ভাই বও তো!’

রবিউল তাকে টেনে পাশে বসায়।

ভাত মুখে দিয়ে খেতে পারে না হাতেম আলি। খাবার তার মুখে বিস্বাদ লাগে। তবুও আস্তে আস্তে মুখের ভিতর খাবার নাড়াচাড়া করে। মনেমনে ফিরোজার প্রাপ্য সম্পদের হিসেব কষে বর্তমান বাজার দর হিসেবে মোটামুটি একটি অংক নির্ধারণ করতেই তার হেচকি ওঠে।

ফিরোজা পানির গ্লাস এগিয়ে দিলে হাতেম আলি পানি মুখে দেয়। পানি গেলার পর হেচকি বন্ধ হলেও সে আর খেতে পারে না। পেটের ভেতরটা কেমন যেন গুলিয়ে উঠতে থাকে।

ব্যস্ত মহাসড়কে বাস-ট্রাক-ট্যাক্সির অভাব নেই। গাড়িগুলো ক্রমাগত মাটি কাঁপিয়ে, দাপিয়ে, কখনও বা বিকট শব্দে হর্ন বাজিয়ে আসছে যাচ্ছে। কিন্তু ঘন্টা খানেক সময় পেরিয়ে গেলেও ওরা বাসে উঠতে পারে না। পারে না হাতের ইশারা করে কোনো বাস থামাতে।

রবিউল বিরক্ত হয়ে বলে, ‘আইজ মনে কয় গাড়ি পামু না!’

হাতেম আলি মুখে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলে, ‘এত অস্থির হইলি ক্যান?’

‘ম্যাঘ-বাদলের দিন, কোন সময় আবার বিষ্টি নামবো, তখন ভিজ্যা চুবচুব হওন ছাড়া উপায় থাকবো না!’

‘একটা কামে রওয়ানা করছি, এমন ফড়ফড় করলে হয়? অতক্ষণ যহন দেরি করতে পারছস, আর কিছুক্ষণ দেখি!’

হাতেম আলির কথা না ফুরাতেই একটি লোকাল বাস আসতে দেখা যায়। রবিউল বললো, ‘এইডা না থামলে আমি আর দেরি করমু না!’

হাতেম আলি কেমন ঘোলা চোখে তাকায় রবিউলের দিকে। আর ঠিক তখনই অবাক করে দিয়ে বাসটা তাদের সামনে এসে থেমে যায়। ওরা রাস্তার নামায় দাঁড়িয়ে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলো। বাস থামতেই ঢাল বেয়ে তারা সড়কে উঠে আসে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই বাসে উঠতে পারে না। বাসের হেলপার এক হাত উঁচিয়ে তাদের সামনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রাখে।

বাস থেকে এক দঙ্গল নারী-পুরুষ আর শিশু-কিশোর নামে। পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মাত্র তিনজন। দলটা দেখে হাতেম আলি বললো, ‘বৈরাতী মনে কয়!’

কিন্তু রবিউল হাতেম আলির কথা খেয়াল করে না। নূরপুর গেলে আসন্ন অপমান আর মানসিক যন্ত্রণার আশঙ্কায় কিছুটা চাপের মুখে আছে সে।

গয়না বা তাদের পরিবারের লোকজন কি কি সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বা কোন ধরনের কথায় বিপক্ষকে না চটিয়ে কাজ উদ্ধার করে মানেমানে ফিরে আসতে পারবে, তার হিসেব নিকেশেই সে মশগুল হয়েছিলো।

অতগুলো যাত্রী নেমে গেলেও বাসে উঠার পর তারা বসার জন্য খালি আসন পায় না। উপরের দিকের রড ধরে দাঁড়িয়েই থাকতে হয়।

হাতেম আলির দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছিলো না। পা দুটো কেমন যেন ঝিমঝিম করছে। একটি পেট-মোটা বস্তা দেখে সে হাত দিয়ে উপর থেকে চেপেচুপে আপন মনেই বলে, ‘বস্তার ভিতরে কি আছে?’

বস্তার পাশেই আসনে বসে থাকা একজন বললো, ‘তুষ!’

হাতেম আলি অনুমান করে যে, এই লোকটাই হয়তো বস্তার মালিক। বললো, ‘বসা যাইবো?’

লোকটা বললো, ‘মনে চাইলে বন!’

তুষের বস্তার উপর বসে হাতেম আলি পা দুটো সামনের দিকে মেলে দেয়। কিছুক্ষণ পর পায়ের ঝিমঝিম ভাবটা আর থাকে না। কিন্তু বেশিক্ষণ তার বসার সুযোগ হয় না। দুটো স্টেশন পার হলে পরের স্টেশনে বস্তা নিয়ে নেমে যায় লোকটা। কিন্তু তার আগেই সদ্য শূন্য হওয়া আসনে অন্য একজন বসে পড়ে।

আসনে বসতে না পারলেও বেশি মন খারাপ করে না হাতেম আলি। সামনের তিনটা স্টেশন পার হলেই শহিদনগর স্টেশন। সেখান থেকেই যেতে হবে নূরপুর। তবে বেশ কয়জন যাত্রী দু’স্টেশনের মাঝামাঝি জায়গায় নেমে গেলে ওরা দু’জনই বসার জন্য জায়গা পেয়ে যায়।

কন্ডাক্টর হাতেম আলির কাছে ভাড়া চাইলে সে রবিউলকে দেখিয়ে দেয়।

রবিউল ভাড়া পরিশোধ করে হাতেম আলিকে বলে, ‘যাইতাছি তোমার কাজে, ভাড়া তো দ্যাওনের কথা তুমি!’

‘আমি ভাড়া দিতে পারলে আর তরে আনছি ক্যান?’ বলে, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে হাসে হাতেম আলি।

‘পরের মাথায় নুন রাইখ্যা আর কতদিন?’

‘যদ্দিন চলে!’

‘তার বাদে?’

হাতেম আলি হাত নেড়ে বলে, ‘পরেরডা পরে!’

শহিদনগর স্টেশনে ওরা নেমে পড়লে কয়েকজন রিকশা নিয়ে এগিয়ে আসে। হাতেম আলি বললো, ‘আমরা হাঁইট্যা যামু!’

একজন বুড়ো মত লোক বললো, ‘আপনেরা সবতে হাঁইট্যা গেলে আমরা কী খাইয়া বাঁচমু?’

রবিউল বুড়োর রিকশায় চড়ে বললো, ‘নূরপুর হানিফ ফকিরের বাড়ি।’

হাতেম আলি রবিউলের পাশে বসে বলে, ‘ইট্টুহানি পথ, রিকশায় উডনের দরকার আছে? ফাও কামে পয়সা নষ্ট!’

রবিউলের ইচ্ছে হয় বলে যে, এত হিসাবি হইয়াও ক্যান তোমার দুর্দশা যায় না? কিন্তু তা না বলে বললো, ‘ট্যাকা-পয়সা তো নষ্ট করনের লাইগ্যাই। যে যত পয়সা নষ্ট করে, পয়সা-পাতি তারেই তত পছন্দ করে!’

হাতেম আলি রবিউলের কথার মর্মোদ্ধারে মন দিতে পারে না। কারণ সামনেই দেখা যাচ্ছে, খইয়া আসছে।

তাদের দেখতে পেয়ে খইয়া বললো, ‘যান, দুই আসামীরেই বাইন্ধা থুইবো!’

রবিউল বললো, ‘আপনে কি রশি আনতে যাইতাছেন?’

খইয়া রবিউলের কথা শুনে হাসে। রিকশা তাকে পেরিয়ে অনেকটা চলে এসেছে। হয়তো সে কারণেও সে আর কিছু বলতে পারে না।

হানিফ ফকিরের বাড়ির কাছাকাছি রিকশা থামলে হাতেম আলি বললো, ‘তুই আগাইয়া যা, আমি পরে আইতাছি!’

রবিউল হেসে বলে, ‘তুমি কি চাও সব মাইর আমার উপরেই পড়ুক?’

হাতেম আলি কিছু না বলে মাথা নিচু করে একদিকে হাঁটে।

রবিউল বললো, ‘কাছাকাছিই থাইক্যো!’

‘আমি সামনেই আছি!’ বলে, হাতেম আলি একটি খোলা জায়গা দেখায়।

তের

বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই উঠোনে গয়নার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় রবিউলের। কলস নিয়ে হয়তো পানি আনতেই যাচ্ছিলো কলের দিকে। দৃশ্যটা দেখে তার খনার বচন মনে পড়ে। ভরার চাইয়া শুন্য ভালা, যদি ভরতে যায়। তার চাইয়া আরো ভালা, পাছে ডাকলে মায়।

গয়নার মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। সে থমকে দাঁড়িয়ে বললো, ‘কেমুন আছেন?’

‘ভালা! আপনে ক্যামন?’

‘আপনে ঘরে যাইয়া বসেন, আমি কলসটা ভইরা আইতাছি!’

ঘরে গিয়ে বসতে বললেও রবিউল ঘরে প্রবেশ করে না। দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকে।

কিছুক্ষণ পর গয়না ফিরে এলে রবিউল আবার বলে, ‘কেমুন আছেন, তাতো কইলেন না ভাবি!’

গয়না পেছনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকবার আগে বলে, ‘ঘরে যাইয়া বসেন। যা কওনের আইয়া কইতাছি!’

খালি ঘরে একা একা বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হয় না। কাচের গ্লাস হাতে গয়না এগিয়ে এসে বলে, ‘আগে শরবত খাইয়া মাথা ঠাণ্ডা করেন! কথা শুইন্যা দৌঁড় দ্যাওনের ইচ্ছাও হইতে পারে!’

রবিউল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে বলে, ‘আর কাউরে যে দেখি না!’

‘না দেখলেও সময় মতন সবতেই আইসা পড়বো! আপনে কি খবর নিয়া আইলেন তা কেউ হুনবো না, এইডা কি হয়?’

রবিউল শরবতটুকু নিঃশেষ করে বলে, ‘আর এক গেলাস হইবো না?’

গয়না চোখ পাকিয়ে বলে, ‘খোদার কাছে শুকুর করেন!’

রবিউল কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কারণ তার আগেই গয়না বলে ওঠে, ‘একলা যে আইয়েন নাই, জানি! কিন্তু হ্যারে কোই থুইয়া আইলেন?’

‘হ্যায় তো ডরাইতাছে!’

গয়নার মুখে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে। বলে, ‘ডরের কাম করছে, তো ডরাইবো না? কাম করনের আগে তো উদ্দিশ থাকে না!’

তারপর রবিউলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো, ‘গ্যালাশটা দেন!’

রবিউল গ্লাস এগিয়ে দিলে গয়না দ্রুত পদক্ষেপে তা নিয়ে রেখে আসে। অন্যদিনের তুলনায় তাকে আজ বেশ হাসি-খুশি দেখায়। সে সঙ্গে কথাও বলছে পরিষ্কার আর উচ্চ কণ্ঠে।

কারো মনে যদি ষোলোআনা আত্মবিশ্বাস বজায় থাকে, তাহলে কথাবার্তা বলতে তাকে ভাবতে হয় না। আত্মবিশ্বাসী মানুষের কাজ-কর্ম, ধ্যান-ধারণা সবই থাকে গোছানো আর পরিপাটি। গয়নাকে আজ তেমনিই আত্মবিশ্বাসী আর সাহসী মনে হচ্ছে।

আঁচলে হাত মুছতে মুছতে গয়না রবিউলের সামনে প্রত্যয়ী ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়।

তারপর বলে, ‘কি খবর আনছেন? আগে কন!’

রবিউল বিস্মিত হয়ে বলে, ‘খবর তো আপনের কাছে!’

গয়না কোনো কথা না বলে শক্ত মুখে তাকিয়ে থাকে রবিউলের দিকে। রবিউল তা দেখে বিচলিত না হয়ে পারে না। বলে, ‘হেই দিন কইয়া গেলাম না যে, আপনেরা দুইজনে কথা কইয়া সব ঠিক করবেন?’

কথা শুনে গয়না কিছুটা জোরে হেসে উঠলে রবিউল তিক্ত কণ্ঠে বলে, ‘হাসনের কথা কইলাম বুঝি?’

‘হাসনের কথা না তো কি? আপনের মতন সবতেই তো আর এমন সহজ-সরল না!’

রবিউলের পছন্দ হয় না গয়নার কথা। বলে, ‘সহজ-সরল হইলে আপনেগ এমন ভ্যাজাল কামে আইতাম না!’

‘পাও ধইরা আনলে কি না আইসা পারা যায়?’

‘ওইডা কোনো কথা না! হাতেম ভাইয়ের লগে যদি আপনের সংসার করতে ইচ্ছা না হয় তো করবেন না! হেই হক আপনের আছে! আমি কওনের কে? তাও যদি কথার মইধ্যে মিলমিশ হইয়া যায়, তাইলে কি ওইডাই ভালা না?’

গয়নার চোখ-মুখ কেমন লালচে হয়ে ওঠে। বলে, ‘তাইলে আবার ক্যান আইছেন প্যাঁচাল পাড়তে?’

গয়না রেগে যায়। আর রেগে গেলে তার কোনো হুঁশ-জ্ঞান থাকে না। কিন্তু তখন তার মতামত হয় বলিষ্ঠ। ‘শুনেন রবু ভাই, আমি এত কথা বুঝি না! যদি আবার হেই ঘরে আমারে ফিরা যাইতে হয়, তাইলে আমার লগে মুখ খারাপ আর মাইরপিট করন যাইবো না! ভাত কাপড়ের কষ্ট দেওন যাইবো না! তা ছাড়া কোনো ছুতায় বাপের বাড়ি থাইক্যা একটা কুটাও আর নিতে পারমু না! আমি ওই মানুষটার কারণে নিজের মানুষের কাছে অনেক ছোডো হইছি! এর পরে যদি আবার আমারে ফিরতেই হয়, তাইলে আমি ক্যামন আছি? কি খাই? ক্যামন পিন্দি? হেইডা দেখনের লাইগ্যা আপনে পোনরো দিনে না পারেন, মাসে একবার হইলেও খোঁজ নিবেন! এই না হইলে আমি আর ফিরা যামু না!’

রবিউল ব্যস্তভাবে বলে উঠলো, ‘কইলাম তো হেই হক আপনের আছে!’

গয়না বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলে, ‘আমার কথা এখনও শ্যাষ হয় নাই!’

‘আইচ্ছা কন!’

‘আমি যদি আর ফিরা যাইতে না চাই, নয়তো তার ঘরে গিয়া আবার অশান্তিতে পইড়া বাপের বাইত্যে ফিরা আইতে হয়, তাইলে আমার পাঁচ ভরি সোনার জিনিস, ব্যবসা করতে যেই সত্তুর হাজার ট্যাকা ক্যাশ নিয়া দিছিলাম আর আমার কাবিনের আশি হাজার মিলাইয়া এক মুঠে দেড় লক্ষ ট্যাকা বুঝাইয়া দিতে হইবো!’

রবিউল গয়নার কথা শুনে ভাবে, হাতেম ভাই এই কথা হুনলে এমনেই ঘরবাড়ি ছাইড়া পলাইতে চাইবো।

রবিউলকে চুপ থাকতে দেখে গয়না বললো, ‘কথা কন না ক্যান?’

রবিউল গয়নার ক্রুদ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে চুপসানো কণ্ঠে বলে, ‘হাতেম ভাই গরিব মানুষ! এত ট্যাকা কী কইরা জোগাড় করবো?’

‘বাড়ি-ঘর বেচবো। গ্যারামে গ্যারামে হাঁইট্যা ভিক্ষা করবো! তাও যদি আমার হক বুঝাইয়া দিতে না পারে, তাইলে আপনে আমারে বিয়া করতে হইবো!’

গয়না এমনিই হুমকি দিচ্ছে ভেবে রবিউল বললো, ‘কি পাগলের কথা! মানুষে হুনলে কইবো কি?’

গয়না রবিউলের কথায় টলে না। বলে, ‘মানুষের কাজই হইলো পরের গিবত করন। আপনে আমারে আইজ কথা দিতেই হইবো!’

রবিউল হতচকিত হয়ে আমতা আমতা করে বললো, ‘এইডা পরে দেখা যাইবোনে!’

‘না-আ-আ!’

গয়নার উচ্চকিত কণ্ঠস্বর আশপাশেও ছড়িয়ে যায়। ‘পরে কোনো কিছুই ঠিক থাকে না! আপনে ময়নার বাপেরে ডাকেন!’

রবিউল উঠে বলে, ‘ওইডাই ভালা হইবো!’

হাতেম আলি বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে রাস্তার পাশে ঘাসের উপর থেবড়ে বসেছিলো। রবিউলকে দেখতে পেয়ে পড়িমড়ি ছুটে এসে বলে, ‘অবস্থা কি?’

রবিউল চিন্তিত ভাবে বললো, ‘বেশি সুবিধার মনে হইলো না! ভাবি যা কয়, ভাইব্যা-চিন্তা জবাব দিও!’

হাতেম আলির মুখের ছায়া দীর্ঘ হয়। অনিশ্চয়তার সুরে বলে, ‘তুই কি করতে কস?’

‘উল্টা-পাল্টা কিছু কইরা বিগড়াইয়া দিলে, বউ তালাক দিয়া পাঁচ ভরি সোনা আর দেড়লক্ষ ট্যাকা ফেরত দিয়া যাইতে হইবো!’

রবিউলের কথা শুনে হাতেম আলির চিমসানো মুখে হাসি ফুটে ওঠে। যা কান্না বললেও ভুল হবে না। সে পাঁচ-ছ দিনের না কামানো গাল চুলকে বলে, ‘এইবার খুঁটি জবর পোক্ত লাগে!’

হাতেম আলিকে ঘরে পাঠিয়ে দিয়ে রবিউল বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলে ভেতর থেকে গয়না বললো, ‘রবু ভাই, আপনেও আয়েন!’

ঘরের ভেতর গয়নার আশেপাশে বেশ ক’জন নারী-পুরুষ দেখা যায়। হাতেম আলি কেমন ফ্যালফ্যাল করে গয়নার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।

রবিউল হাতেম আলির পাশে গিয়ে বসলে গয়না তার কাছে বলা কথাগুলোই কিছু কিছু হাতেম আলির কাছে পূণর্ব্যাক্ত করে। কিন্তু অকস্মাৎ সে কেমন অচেনা নারীর মত বলে উঠলো, ‘তুমি যদি আমার শইল্যে আর কোনোদিন হাত উডাও, কোনো কারণে বকাবাজি কর, তো তোমারে আমি তালাক দিমু! আমার সব জিনিস আর কাবিনের ট্যাকা-পয়সা যা পাওনা হই সব পাই-পয়সা হিসাব কইরা ফেরত দিয়া দিবা! নাইলে রবিউল আমারে বিয়া করতে হইবো!’

হাতেম আলি চমকে উঠে প্রচণ্ড ঘৃণাভরে ফিরে তাকায় রবিউলের দিকে। যেন গয়নার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে তাকে পথে বসাতে চাচ্ছে সে।

বিস্মিত রবিউল হাতেম আলির ঘৃণা মিশ্রিত দৃষ্টির সামনে মাথা তুলতে পারে না। মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুলে মাটির মেঝেতে আঁকি-বুকি কাটে।

হাতেম আলি গয়নার দিকে ফিরে বললো, ‘দ্যাখ বউ, পোলাপানের কষ্ট দেইখ্যা এমনেই আমার মাথা ঠিক নাই! তুই মাথাডা ইট্টু ঠাণ্ডা কর!’

গয়না হাত নেড়ে বলে, ‘তেরটা বচ্ছর আমার মাথা গরম আছিলো বইল্যা নিজের দিকে চোখ তুইল্যা চাইতে পারি নাই! আমি যে একজন মানুষ, নাকি কারো ঘরের বিছানাপাতি-হান্ডি-পাতিলের মতন তার কিছুই এতদিন বুঝতে পারি নাই! অখন মাথা ঠাণ্ডা আছে বইলাই নিজের কথা, দুঃখ-কষ্টের কথা চিন্তা-ভাবনা করনের সময় পাইছি! আগের মতন মিডা কথায় আমারে ভুলাইতে পারবা না! তোমরা দুই জনেই আইজ এই মানুষগুলার সামনে কথা দিতে হইবো! কিছু কিছু কথা আর কাজের সাক্ষী থাকনেরও দরকার আছে!’

উপস্থিত সবার সামনে ওরা দু’জন যেন মাথার উপর পাহাড় নিয়ে বসে আছে। যে কারণে তাদের উঁচু মাথা ধীরে ধীরে নিচের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে।

রবিউল ভেবেছিলো, বিয়ের কথা বলে গয়না হয়তো তাকে হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু তা যে নিছক হুমকি-ধমকি নয়, উপস্থিত মানুষগুলোর সামনে তার পূণর্ব্যক্ততা হয়তো তাই প্রমাণ করে।

ওদের চুপ থাকতে দেখে একজন প্রবীন পুরুষ বললেন, ‘বাবারা, হ-না কিছু বলেন! একটা মাইয়া সারাজীবনই মুখ বন্ধ কইরা রাখতে পারে না! অখন মুখ যখন খোলাইছেন, আপনেরাও চুপ কইরা থাকতে পারবেন না!’

রবিউল একবার গয়না একবার হাতেম আলির দিকে তাকায়। কিন্তু কী বলবে সে? ঘটনার আকস্মিকতায় যেন স্থবির হয়ে পড়েছে তার চিন্তা-ভাবনা আর বাকশক্তি।

হাতেম আলির দু’চোখ বেয়ে হঠাৎ পানি পড়তে থাকে। আর তা দেখেই যেন গয়না প্রবল রোষে চিৎকার করে উঠে বলে, ‘তোমরা পরের ধনের লোভী পুরুষরা আমাগো চোখের পানিরে কোনোদিন কিছু মনে কর নাই! দিনরাইত কাইন্দা চোখের পানি শুকাইয়া গ্যাছে! অত্যাচার সহ্য করতে করতে কইলজা পাষাণ হইয়া গ্যাছে!’

কেউ কিছু বুঝে উঠবার আগেই হাতেম আলি হঠাৎ উদ্ভ্রান্তের মত ছুটে গিয়ে গয়নার দু’হাঁটু নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে, ‘আমারে আর জবাই করিস না বউ! তুই ছাড়া আমার আর কে আছে? পোলাপানগুলারে তুই এতিম করিস না!’

কিন্তু গয়নার মাঝে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। মনে হয়, সে যেন পাথর অথবা কাঠের তৈরী কোনো অসামান্য ভাস্কর্য। যে নিশ্চল ভাবে একই অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে আবহমান কাল ধরে।

——সমাপ্ত——-

রচনা কাল :

আরম্ভ – সেপ্টেম্বর, ২০০৬।

সমাপ্ত -জানুয়ারি, ২০০৭।

আল-মাজমাহ, সৌদি আরাবিয়া।

juliansiddiqi@gmail.com

একটু কথা: দীর্ঘদিন আগে ভিন্ন একটি ব্লগে প্রকাশিত এবং ঈষৎ পরিবর্তন করে শৈলীতে পোষ্ট করা হলো।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


10 Responses to তিতিক্ষা

You must be logged in to post a comment Login