দিনলিপি

দুঃখবহনকারী বন্ধু

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

ভ্রুযুগল কুঁচকে একটি আরেকটির কাছে চলে এসেছে  প্রায়, বিরক্তির চূড়ান্ত পর্যায়, নাহ কবির আর সহ্য করতে পারছে না, তার ইচ্ছে করছে লোকটিকে ধরে নদীর পানিতে চুবাতে। অনেকক্ষন হল লোকটি তাকে আড়চোখে দেখছে। কবিরের মন খারাপ, মন খারাপ হলেই কবির এখানটায় এসে, শহর থেকে দূরে নদীর ধারের এই বেঞ্চীটাতে এসে বসে, যথারীতি আজও এসে বসেছে। সমস্যা হচ্ছে নদীর অপর পাড় থেকে একটি হাড্ডিসাড় অর্ধনগ্ন মাঝবয়েসি লোক সেই তখন থেকে তাকে আড়চোখে দেখে যাচ্ছে। কবির অন্যদিকে তাকালেই লোকটি তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে, কবির স্পষ্ট বুঝতে পারে যে লোকটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কবির চোখ ফেরানো মাত্র লোকটি চোখ ঘুরিয়ে নেয়। কি দেখছে লোকটি, কি দেখার আছে কবিরের মধ্যে, কবির ভেবে পায় না! নাহ কবিরের আর সহ্য হচ্ছে নাহ, আচ্ছা কবির যদি এখন একটি ছোট নৌকা নিয়ে ওই পাড়ে গিয়ে লোকটিকে ইচ্ছামত পেটায় তবে কেমন হয়! অথবা যদি কি উদ্দেশ্যে তাকিয়ে আছে লোকটিকে তাই জিজ্ঞেস করে তবে!

এই যে ভাই শুনছেন? আপনি আমার দিকে অকারনে তাকিয়ে আছেন কেন, আমিতো আপনাকে চিনি না, সমস্যা কি আপনার?

কি উত্তর দেবে লোকটি! দেখেতো মনে হচ্ছে গরীব মানুষ, হয়ত বলবে- আপনার গায়ের জামাটি ভারী সুন্দর তাই দেখছিলাম, দাম কত হবে ভাই জামাটির?

অথবা হয়ত বলবে- স্যার দু-দিন ধরে কিছু খাইনা, কয়টা টাকা দিবেন ভাত খাব।

যদি বলে, যদি বলে- ওই গাড়ি বাড়ি অট্টালিকায় বন্দী তোমার অভিশপ্ত জীবনটা দেখে হাসছি।

না না থাক, তাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। কবির মনে মনে ভাবতে থাকে। ধুর লোকটি কি করে জানবে যে কবিরের আজ মন খারাপ!

লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে বড্ড গরীব, ক্ষুধার্থ, লোকটি এখানে কেন বসে আছে, কবির অবাক হয়। এর কি কোন কাজ নেই, ফ্যামিলি নেই, নাকি তারাও এর মত অনাহারে দিন কাটাচ্ছে! আহা, লোকটি বড় অভাগা, নিজের বাচ্চার মুখে যে পিতা খাবার তুলে দিতে পারে না তার চাইতে অভাগা আর কে আছে, তাই হয়ত লোকটি এখানে এমন চুপচাপ বসে আছে, কিছু করার নেই বলে হয়ত কবিরকে দেখে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে হিংসে করছে। হয়ত ভাবছে কবির বড় সুখি, কবিরের কোন দুঃখ নেই, দামী পোশাক গাড়ি মানিব্যগ ভর্তি টাকা, আর কি চাই, কবির হয়ত এই হাড্ডিসাড় লোকটির চোখে এই মুহুর্তে সবচেয়ে সুখি মানুষ। হাহ, এ আর কি বুঝবে কবিরের দুঃখ! কবির যে এর চেয়েও বড় দূর্ভাগা! আচ্ছা কবির যদি একে কিছু টাকা দিয়ে সাহায্য করে, তবে কেমন হয়।

এই যে ভাই, শুনছেন? আপনার কি টাকার দরকার? এই নিন, আমার অনেক টাকা, আমার দরকার নেই এতো টাকার, আপনার দরকার আপনি রাখুন। আপনি হয়ত খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে বলে বাড়িতেই যাচ্ছেন না, দয়া করে টাকা গুলো রাখুন।

আচ্ছা লোকটি কবিরের টাকা কেন নেবে? লোকটি যদি ভাবে কবির টাকার গরম দেখাচ্ছে। নাহ এভাবে নয়, কবিরকে বুদ্ধি করে দিতে হবে, অনেকটা এরকম-

এই শুনছ? একটি কাজ করে দিতে পারবে? আমার গাড়িটা স্টার্ট নিচ্ছে না, একটু ধাক্কা দাও দেখি, পয়সা পাবে।

হাহ, এভাবে দিলে হয়ত লোকটি কিছু ভাব্বে না, কবির মনে মনে খুশি হয়।

এমনিভাবে অনেক কথা ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যায়, কবিরের হঠাত খেয়াল হয় লোকটি তার দিকে তাকাচ্ছে না অনেকক্ষন, তাকে একেবারেই খেয়াল করছে না আর লোকটি বরং কবির নিজেই অনেকক্ষন যাবত লোকটির দিকে তাকিয়ে আছে, কবির খানিকটা বিব্রত বোধ করে, তার এই কান্ডজ্ঞানহীনতা দেখে না জানি লোকটা কি ভাবছে! কবির আর একটি ব্যাপার ভেবে অবাক হয়, বিরক্তি অথবা রাগ অথবা আজ সকালের ঘটনায় যে তার মন খারাপ হয়েছিল, তার কোনটাই আর কবিরের মধ্যে নেই। হঠাত করেই কবিরের নিজেকে একটি পাখির পালকের মত হালকা মনে হয়, আনন্দে তার মনটা ভরে উঠে। কিসের এত আনন্দ সন্তুষ্টি সে জানেনা! লোকটিকে তার বড় আপন মনে হয়, কবিরের প্রচন্ড ইচ্ছে করছে লোকটির সাথে কথা বলতে। লোকটিকে জড়িয়ে ধরে ধন্যবাদ জানাতে। কবির একবারও ভাবছে না যে এই কাঁদামাটি যুক্ত লোকটিকে জড়িয়ে ধরলে তার এতদামী কম্পলিট স্যুটটির কি হবে, কবিরের নিজেকে বড় স্বাধীন বলে মনে হচ্ছে। কবির নিজের মনে একা একাই হাসে।

আরে আরে লোকটি যে উঠে দাড়িয়েছে, চলে যাবে নাকি! কবিরের যে কিছুই বলা হল না! তবে কি লোকটিকে কবিরের কিছুই বলা হবে নাহ! কবিরতো আগেও বহুবার এখানে এসেছে। কই আগেতো কখনও একে এখানে কবির দেখতে পায়নি! তবে যদি আর কোনদিন দেখতে না পায়! আরে লোকটি যে সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে। কি করবে কবির? ডাকবে? শুনতে পাবে এত দূর থেকে লোকটি! কাউকে জিজ্ঞেস করবে নাকি এর বাড়ি কোথায়? না না, তা কি করে হয়! কবিরের মত একজন বিশিষ্ট ব্যাক্তি খোজ করছে এমন আর্ধনগ্ন হতদরিদ্র একজন মানুষের। ছি ছি কবির এসব কি ভাবছে, কবিরতো স্বাধীন, ধনী-গরীবের উর্ধে, কবিরের কাছেতো টাকা-পয়সার কোন দাম নেই, তার কাছে যে এখন ধনী-গরীব সব সমান।

দেখতে দেখতে লোকটি চোখের আড়াল হয়ে গেলো কবিরের, কবির কিছুই করতে পারল না! আচ্ছা লোকটির মুখ বড্ড বেশি শুকনো আর মলিন হয়ে গেল শেষদিকটায়, কেন? কবির ভাবে। কই সেই আগ্রহটাতো আর দেখতে পেল না কবির লোকটির চোখে মুখে, যে আগ্রহ নিয়ে লোকটি বারবার কবিরের দিকে তাকাচ্ছিল! সেটা হিংসে হোক আর যাই হোক সেটাতো আর দেখতে পেল না! তবে কি, তবে কি সে তার হৃদয়ের অবশিষ্ট পবিত্র হাসিটুকু দিয়ে কবিরের হৃদয়ের ক্ষত নিঙড়ানো দুঃখটুকু নিয়ে গেল? কবির অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।

সূর্য ডুবতে শুরু করেছে, কবিরকে আবার ফিরতে হবে শত ব্যাস্ততার এই ইট-পাথরের শহরের নকল সব মানুষের ভিড়ে। কবির উঠে দাঁড়ায়, শেষ বারের মত লোকটির চলে যাওয়া পথটির দিকে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই ফিসফিস করে বলে-

হে আমার দুঃখবহনকারী বন্ধু, আমি তোমাকে কখনই ভুলতে পারবোনা, ভুলব না…।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to দুঃখবহনকারী বন্ধু

You must be logged in to post a comment Login