নেঁকড়ে
বছর পাঁচেক আগের কোন এক শীতের নিঃস্ত্বেজ দুপুরে আমার মা আমাকে একজন মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনান। গল্পটি শুনে আমি বেশ রোমাঞ্ছিত হই, চোখ জলে ঝ্বাপছা হয়ে আসে, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যায় সেই মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। তারপর অনেকটা সময় কেটে যায়, গল্পটির কথা আর মনে থাকে না। কিছুদিন আগে গ্রামের বাড়ি গিয়ে দেখতে পেলাম প্রতিটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে জীবিত এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে। গাড়িতে করে যাওয়ার সময় আমি সড়কগুলোর নাম পড়ে পড়ে এগুচ্ছি, এমন সময় একটি ফলকে আমার দৃষ্টি আটকায়, সাদা মোজাইক করা ফলকটিতে কালো কালির বড় বড় অক্ষরে লেখা “শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন সড়ক”। আর তখনই মায়ের বলা সেই গল্পটির কথা মনে পড়ে। গল্পটি মায়ের কাছে যেমন শুনে ছিলাম ঠিক সেইরকম করে এখানে তুলে দেয়া এখন আর সম্ভব নয়। এই পাঁচ বছরে স্মিতৃর বাক্সে অনেক নতুন পণ্য ঢুকাতে হয়েছে, বেরিয়েও গেছে অনেক পণ্য। তবুও চেষ্টা করছি —
আব্দুল বাতেন একজন মধ্যবিত্ত কৃষক। খুব একটা অভাবী মানুষ নন তিনি, অথবা সারা দেশে যখন অভাব, বাংলাদেশের অপর নাম যখন দারিদ্রতা; সেই সময় হয়তোবা তিনি এই দারিদ্রের মাঝে থেকেই ছিলেন স্বাচ্ছ্ন্দ্য। বেশ চলে যাচ্ছিলো তার জীবন, দারিদ্রতায়-স্বাচ্ছন্দ্যে। ১৯৭১, উঠতি যৌবন কালে আব্দুল বাতেন। ২৬ মার্চের পর কেটেগেছে আরোও দু মাস, আব্দুল বাতেন তখনও একজন কৃষক। অপরদিকে তখন রণাঙ্গনে বাঙলাদেশ নামের স্বপ্নটি হামাগুড়ি দিয়ে চলতে শুরু করেছে। তার বেড়ে উঠার জন্য আরোও কয়েকটি বলিষ্ঠ হাতের প্রয়োজন ছিলো, আব্দুল বাতেন তার হাত বাড়িয়ে দেন। যুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। আগস্ট ১৭, গাজীপুরের জয়দেবপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে দুই বোঝা জ্বালানি কাঠ নিয়ে একজন মধ্যবয়ষ্কা নারী ট্রেনে চড়েন শ্রীপুর আসার উদ্দেশ্যে। ট্রেনের ঝাকুনিতে এক সময় তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। কিছুটা হৈচৈ এর শব্দে তার ঘুম ভাঙ্গে, চোখ মেলে তিনি দেখতে পান হুড়মুড় করে নেমে পড়ছে ট্রেনের সব যাত্রী। কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই পাঁচ জন খাঁকি পোশাক পড়া আর্মি উঠে পড়ে বগিতে, সাথে হাত-পা বাঁধা এক বাঙালি যুবক। ইতোমধ্যে ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। যুবকটির দিকে তাকিয়ে আঁৎকে উঠেন সেই নারী, আর যুবকটি অসহায়ের মত চেয়ে থাকে তার দিকে। পাঁচজন আর্মির একজন মহিলাটিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে গর্জন করে উঠে -“বোল, কিধার হে তেরা মুক্তি”। নিরুত্তর থাকে যুবক, এতে রাইফেলের একটি গুঁতো পরে তার পেটে। পুনরায় একই প্রশ্ন উত্তরে নিরবতা, এবার চামড়ার বুটের একটি লাথি উড়ে আসে যুবকের বুক বরাবর। তারপর আর কোন প্রশ্ন করা হইনি তাকে। পাঁচজন আর্মি ধীরে ধীরে পাঁচটি নেঁকড়ের রূপ ধারণ করে। যুবকের হাতের বাঁধন খুলে চিৎ করে শুইয়ে দেয়া হয় ট্রেনের মেঝেতে। রাইফেলের বাটের আঘাতে একে একে হাতের দশটি আঙুল চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয় তারা। তারপর পা, পায়ের পাতা, হাটু, কুণোই………। নেঁকড়েগুলো এবার পাঁজরে চেপে বসে, একজন একজন করে লাফাতে থাকে পাঁজরে। যুবকের নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসে। তবুও নেঁকড়েগুলোর সাধ মেটে না, তারা যুবকের দেহের ভেতর “মুক্তি” খোঁজে। একটি বেয়োনেটকে তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও প্রবেশ করানো হয় যুবকের উদরে। তারপর বেয়োনেটে প্যাঁচিয়ে নাড়ী-ভুড়ী গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেঁকড়েগুলো “মুক্তি” খোঁজে। রক্তে ভেসে যায় ট্রেনের মেঝে, চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ে বাংলার মাটিতে, আব্দুল বাতেন রক্ত দিয়ে শুদ্ধ করেন বাংলাকে। একজন আব্দুল বাতেন স্বাধীনতার জন্য শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন হন। এভাবেই জন্ম হয় ইতিহাস, তারপর মহাকালের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়, অথবা একাকার করে দেয়া হয়!
8 Responses to নেঁকড়ে
You must be logged in to post a comment Login