মামুন ম. আজিজ

ছোটগল্প: পুনরাবৃত্তি

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

কথাটা শোনার পর পুলকের মাথায় আকাশ ভেঙে পরার কথা ছিল। হয়তো পড়তোও । কিন্তু এই মুহূর্তে অতটা হুস জ্ঞান তার মধ্যে ছিলনা যাতে ভেঙে পড়া আকাশের ভারে জীবন্ত লাশ হয়ে অনঢ় শিকড় গাড়তে পারে ভূমিতে। । তবুও বুকটা কেঁপে উঠেছিল ঠিকই।
নেশার আসরে যখন মাতাল হবার চূড়ান্ত পায়তারা চলছিল, বাবার ফোনটা এল তখনই । বাবার কণ্ঠে ছিল তেমনই কান্না ঝরানো বেদনা। সেই মাতাল মাতাল অবস্থাতাতেই তাই উঠে হন্তদন্ত হয়ে ছুটেছিল হাসপাতালের দিকে।
পুলক যখন হাসপাতালে পৌঁছালো ওর মা’র ততক্ষণে জ্ঞান ফিরে এসেছে। ডাক্তাররা বাইপাস অপারেশনের জন্যে রেডি হচ্ছিলেন।
পুলকের জন্যে ভীষন অস্থির তখন তার মা। ভাবছিলেন. এটাই উপযুক্ত সময়। আজই তাকে বলতে হবে, অবশ্যই বলতে হবে। সেই মহাসত্য পুলকের জানা উচিৎ । যদি অপারেশন সাকসেফুল না হয়, তাহলে আর বলাই হবেনা। না, বলতেই হবে, ছেলের কাছে যতই ছোট হতে হয় তবুও। এছাড়া উপায় নেই। এক সত্য নিশ্চয় তার ছেলেকে আরেক সত্যের মাঝে এনে হাজির করবেই; ফেরাবে তাকে আঁধার জগতের ঘন ছায়া হতে ।
ভাবছিলেন আর মনে মনে বড় ব্যাকুল হচ্ছিলেন তিনি। স্বামী ব্যাক্তিটি তার পাশে বসে ডান হাতটা ধরে রেখেছিলেন হাতের মুঠোয়। অঝোরে পানির যে ধারা ঝরছিল তার চোখে তাতে স্পষ্ট হচ্ছিল তার গভীর থেকে গভীরতর ভালোবাসা এই নারীটির প্রতি।
টলতে টলতে পুলক ঢুকেছিল। সে দৃশ্যে জোড়াজুড়ি করে থাকা হাতদুখানি কেঁপে উঠেছিল। স্বামী ব্যক্তিটি নিচুস্বরে বললেন, ‘আমি পারলাম না পারুল, আমি পারলাম না।’ পুলকের মা স্বামীকে ইশারায় বাইরে যেতে বললেন। উপস্থিত নার্সটিকেও। পুলক পাশে এসে বসতেই মদের উটকো কটূ গন্ধ মার নাকে যন্ত্রনা দিচ্ছিল এবং তাতে তার আরও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাচ্ছিল – এটাই উপযুক্ত সময়।
ছলছল চোখে মা’র দিকে অসহায়ের মত তাকিয়ে শুনেছিল মা’র সেই কথাগুলো যা শুনলে অন্য সময় অন্য কোন স্থানে তার মাথায় নিশ্চিত আকাশ ভেঙে পড়ত অথবা সেই ভেঙে ফেলত একটা দু’টো আকাশ নিমিষে।
ডাক্তার খবর পাঠিয়েছিল । বলার পর্ব শেষ হলেও মা আরেকটু উপসংহার টানছিলেন। পুলক তখন মা’র দুটো পা জড়িয়ে চেষ্টা করছিল কাঁদার। ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো পুলকের মাকে। চোখের ঈশারায় মার শেষ নির্দেশটা পুণ: বুঝতে কষ্ট হলোনা পুলকের। পরক্ষণেই পুলক বাবার অসহায় আর নোনা জলে ভেজা মুখটির দিকে তাকিয়ে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করল। একই সাথে ঐ লোকটার জন্য সে অনুভব করলো প্রচন্ড এক ভালো লাগার অনুভূতিও।
বাবা পরিচয়ের ঐ লোকটির সামনে ওখানে দাঁড়াতে পারলনা। মাতাল ভাবটা একটু কমে আসছিল। দৌড়ে হাসপাতালের করিডরে গিয়ে নিরিবিলিতে দাঁড়ালো একা একা। মনে তখন তার প্রচন্ড ঝড়ের তান্ডবে বিশাল আকারে ঢেউ আছড়ে পড়ছিল অনবরত। একি শুনল হঠাৎ আজ মায়ের মুখে, ঐ লোকটা তার বাবা নয় । মানুষ হয়েও সাধারণ মানুষের অনেক উর্ধ্বের একজন , যেন একজন সাক্ষাৎ ফেরেস্তা। ঘুনাক্ষরেও তো কখনও বুঝতে দেননি। তবে কেনো আজ বললেন মা ? না  জানলেই কি হতো না ?  এতো বছর তো না জেনেই ছিল। সেই ছিল ভালো। অস্তিত্বহীনতায় ভোগার পরবর্তী সময়ে যে নেশার ডাক শোনার  কথা ছিল সে ডাক তো সুখের পরশে অনেক আগেই শুনে ফেলেছে, সে নেশার রাজ্যও তো তার পুরাতন সঙ্গী। এত কষ্টের চাপ এখন কার আড়ালে লুকিয়ে ঠোকাবে সে? কোন নেশায় ডুবে?
একটিবার যদি বলতে পারত এই বাবা নামরে লোকটিকে -কেনো, কেনো তুমি মানুষ নও, কেন তুমি ফেরেস্তা, কেনো? মা নিষেধ করেছেন। মা বলেছেন এই কষ্টটা দেয়ার পাপটুকু না করাটাই ওনার প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। পুলক না জানুক – উনি তেমনই চেয়েছেন সব সময়। তবে মা কেন তাকে বলতে গেলো। এখন যে মনে মনে আরেকজন মানুষ কে, একজন শত্র“কে খুঁজে পাবার তাড়না প্রচন্ড, সে তার জন্মদাতা পিতা ।
মুহূর্তে হালকা হ্যাঙ্গ ওভারে থাকা পুলক বুঝে ফেলেছিল , মা’র এই ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা তাকে ফেরানোর।
ঐ যে ফেরেস্তার মতো লোকটা, যাকে বাবা বলে চিনেছে এতকাল, তার আজকের নব পরিচয়ের দূরত্বটাই তাকে বুক পেতে ফেরাতে চাইছে সকল আঁধার পথ থেকে। কষ্টে পুলকের বুক ফেটে যাচ্ছিল। আঁধার ছায়া তাকে গিলে ফেলেছে অনেকদূর পর্যন্ত। আসলেই কি সেখান থেকে মুক্তি এত সহজে হবে?  না হলে এই ফেরেস্তার মতো লোকটির ত্যাগ, আদর্শ সব হবে বৃথা। না, পুলক ভেবে নিল এটাই একমাত্র উপায়। ফিরতে হবেই।
দেরী করল না , মুহূর্তে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কল করল প্রেরণা নামের মেয়েটিকে। এ মেয়েটাই হতে পারবে তার এই মুহূর্তের প্রকৃত প্রেরণা। এই মুহূর্তে সে বুঝতে পারে মেয়েটার প্রতি তার চরম অপমান। বুঝতে পারে মেয়েটার চরম বেদনা আর কষ্ট। চোখে ভাসে মেয়েটার সেই নির্ভেজাল চোখের কান্না। সাথে সাথে দেখে ফেলে যেন দূর ভবিষ্যত।
পরশু প্রেরণার বিয়ে, খবরটাও সে ঠিকই পেয়েছিল। মন চিৎকার করে উঠল , না না…।
ফোন ধরল অন্য একটা মেয়ে ।
‘ও! দুলাভাই, আজকেও…’বলেই ফোনটা প্রেরণার হাতে ধরিয়ে দিল।
কণ্ঠ একটু একটু কাঁপছিল পুলকের। হলুদের মন্ডপে বসার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল প্রেরণা, ঘরের কোনে গিয়ে ফোন কানে লাগিয়ে বলল,
‘হ্যালো , কে?’
‘কেমন আছো প্রেরণা?’
সে কণ্ঠ কাঁপা কাঁপা হলেও প্রেরণার চিনতে একটুও কষ্ট হলোনা। হওয়ারও কথানা। কিন্তু চিনেই বলে উঠল,
‘ ফোন করেছ কেনো? বিয়ের কার্ড পাওনি। লজ্জা করলোনা । হলুদে নুনের ছিটা দিতে ফোন  করেছ।’
‘ না প্রেরণা শোন, তোমাকে আমিই বিয়ে করব। আমিই..’
‘ ফোন রাখ, আর কত মাতলামী করবে, কত বোতল গিলেছ আজ? ছিঃ, ছিঃ, দয়া করে আমাকে আর ফোন দেবেন না মিঃ পুলক, যদি না শোনেন এই নম্বর আমি বদলে ফেলব।’
‘ না, আমি …আমি সত্যি বলছি। আমি ভুল করেছি। তোমাকেই বিয়ে করতে হবে, হ্যাঁ তোমাকেই আমার প্রয়োজন , ভীষন প্রয়োজন।’
‘ বাহ্! তোমার হাতের পুতুল, যখন ইচ্ছে খেলবে, যখন ইচ্ছে ছুড়ে ফেলবে, আবার তুলবে আবার ফেলবে, কি পেয়েছ তুমি, কি ভাব নিজেকে?’
‘ প্রেরণা তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমার সন্তান তোমার পেটে । আমি স্বীকার করছি। ক্ষমা করে দাও। দাও একটা সুযোগ, একটা। ’
‘তুমি স্বীকার করলেও আমি করিনা। একটা লম্পট, মাতাল, প্রতারক, মিথ্যুক কখনই আমার সন্তানের বাবা হতে পারেনা, কখনই না।’
‘ তুমি অন্য একজন কে ঠকাবে…?’
‘ মোটেও না, সজলকে আমি সব জানিয়েই বিয়ে করছি। ইনফেক্ট ওই আমাকে অ্যাবরশনটা করতে দেয়নি। ও মানুষ না , ও একটা ফেরেস্তা। …
প্রচন্ড ভুমিকম্প পুলকের মনে। চোখ দিয়ে  পাহাড়ী ঝর্ণার মতো অবিরত ঝরতেই থাকলো পানি। অনাগত দিনের আরেক পুলকের জন্মাশংকায় কেঁপে উঠল দেহের সকল নার্ভ। ভাবল, তার প্রকৃত বাবাও নিশ্চয় তার মতোই কোন লস্পট ছিল, এ হীন পুরুষানুক্রম চলতে দেয়া যায়না।
সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল- ‘না, আরেক পুলকের পুনরাবৃত্তি হতে পারেনা!’

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


13 Responses to ছোটগল্প: পুনরাবৃত্তি

You must be logged in to post a comment Login