রিপন কুমার দে

মুভি রিভিউ: ২০১২ মিথ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

যারা নিয়মিত ছবি দেখেন তারা নিশ্চয়ই জানবেন যে পৃথিবীতে এখন রোনাল্ড এমরিচ পরিচালিত “২০১২-উই ওয়ার ওয়ার্নড” ছবিটি নিয়ে রীতিমত তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ব্যাপক ব্যবসাসফল হয়েছে ছবিটি। যে ছবিটির কাহিনী নিয়ে খোদ নাসাও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিদিন। নাসাবিজ্ঞানীদের কাছে প্রতিদিন শত শত মানুষ জানতে চাচ্ছে ২০১২ সাল আসলেই পৃথিবীর শেষ পরিণতির বছর কিনা?


ছবি: ছবির অফিসিয়াল ব্যানার

ছবিটির কাহিনী নিয়ে কথা বলার আগে চলুন এর ব্যাকগ্রাউন্ড-টি সম্বন্ধে ঘাটাঘাটি করা যাক। প্রাচীন মায়ানিস্টরা তাদের নিউমারালজি ব্যবহার করে প্রায়ই ভবিষ্যৎবানী করত এবং সেগুলি একটি ক্যালেন্ডারে তাদের অদ্ভদ ভাষায় লিপিবদ্ধ করে রাখত। প্রাচীন এই মায়ান ক্যালেন্ডারের তথ্য আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা পাঠোদ্ধার করার পর দেখা যায় সেখানে স্পস্টভাবে উল্লেখ করা আছে যে, ২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বর হবে পৃথিবীর ৫১২৫ বছরের ইতিহাসে শেষ দিন। এই ভবিষ্যৎবানী করতে মিথলজিস্টরা কোন সংখ্যাতত্ত্ব ব্যবহার করেছিল সেটা এখনও জানা যায়নি। তবে মায়ানিস্টরা এর কারন হিসেবে সৌর ঝড়, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের বিপর্যয়, ভূমিকম্প, অগ্নুৎপাত সহ ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে বেছে নিয়েছিল। নস্ট্রাডুমাসও এই ভবিষ্যৎবানীর ব্যাপারে খানিকটা ইংগিত দিয়ে গিয়েছিলেন।

ছবি: মায়ান লং ক্যালেন্ডার

মেইনস্ট্রিম মায়ানিস্টরা আরও দেখেছিল যে ২০১২ সালের পর শুধু পৃথিবীই নয়, সৌরজগতের আরও কিছু গ্রহ বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। মায়ান ক্যালেন্ডারের এই ভবিষ্যৎবাণীকে উপজিব্য করেই রোনাল্ড এমেরিচের “২০১২” ছবিটি বানানো। তাহলে চলুন ছবিটির কাহিনীবিন্যাসে একটু নজর দেওয়া যাক।

২০০৯ সাল। আমেরিকান এক ভুবিজ্ঞানী এড্রিয়েন হেল্মাসলী তার ইন্ডিয়ান বন্ধু সাত্নামের সাথে দেখা করতে যায়। বিজ্ঞানী সাত্নাম তখন তার গবেষনায় দেখেছিল যে একটি বিশাল সৌরবিস্ফোরনের কারনে উৎগত নিউট্রিনোগুলো মাইক্রোওয়েভের মাধ্যমে পৃথিবীর অন্তস্থরের তাপমাত্রা অবিশ্বাস্যভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে।


ছবি: বিশাল সৌরবিস্ফোরনের কারনে উৎগত নিউট্রিনো

এড্রিয়েন তখন এর পরিণতিটি অনুধাবন করার পর বিষয়টি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থমাস উইলসান এবং ওয়াইট হাউসের চীফ ইন স্টাফ-কে অবহিত করেন। পরে প্রেসিডেন্ট জি-৮ সম্মেলনে সব সদস্য রাষ্ট্রকে দুযোর্গটি সম্পর্কে সচেতন করে দেন। জি-৮ সংঘের সব সদস্য রাষ্ট্র তখন সিদ্ধান্ত নিল যে, একটি গোপন প্রজেক্টের মাধ্যেমে তিনটি বিশাল জাহাজ বানানো হবে যেগুলো কমপক্ষে ৪ লাখ মানুষ বহন করতে পারে। এমনকি বাজেট উত্তোলনের জন্য বিত্তশালীদেরও এক বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে টিকেট বিক্রির সুযোগ দেয় তারা।


ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

২০১২ সাল। জ্যাকসন নামে লসএন্জেলেসের একজন লেখক রাশিয়ান বিলিয়নার ইউরির ড্রাইভার হিসেবে পার্টটাইম কাজ করত। তথন জ্যাকসনের সাবেক স্ত্রী কেট এবং তাদের দু’সন্তান নোয়া ও লিলি তার নতুন বয়ফ্রেন্ড, সৌখিন পাইলট, গর্ডনের সাথে থাকত। জ্যাকসন একবার নোয়া এবং লিলিকে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে তাদের সাথে পরিচয় হয় এক সন্ন্যাসী তথ্যবিদের(চার্লি)। চার্লি সেই পার্ক থেকে একটি রেডিও শো নিয়মিত প্রচার করত। সে ২০১২ সালে পৃথিবী ধ্বংসের ব্যাপারটা জানত এবং মনে প্রানে বিশ্বাস করত। সে জাহাজ নির্মানের গোপন প্রজেক্টের ব্যাপারে খোঁজ নিত। এমনকি জাহাজের অবস্থান চিহিত ম্যাপটাও তার কাছে ছিল। ক্যালিফোর্নিয়াতে যখন মাটিতে ফাটল দেখা দিতে শুরু করল, তখন তারা বাড়ি ফিরে গেল এবং পরে জ্যাকসন একটি প্রাইভেট প্লেন ভাড়া করল তার পরিবারকে বাচাঁনোর জন্য।


ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

পরে যখন পুরো শহরটি প্রশান্ত মহাসাগরে তলিয়ে যেতে শুরু করল তখন জ্যাকসন তার পুরো পরিবার এবং গর্ডনকে নিয়ে শহর ছেড়ে আসতে লাগল। পৃথিবীজুড়ে যখন প্রবল ভুমিকম্প হতে শুরু করল তখন তারা ইয়েলোস্টোনে চলে গেল চার্লির ম্যাপটা উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু ইয়েলোস্টোনে তখন ভয়ংকর অগ্নোৎপাত শুরু হয়ে যাওয়ায় তারা কোনভাবে প্রান নিয়ে পালিয়ে আসল। চার্লি, যে কিনা সবসময় পর্দার আড়ালে থেকে বিপযর্য়ের খবর রেডিও শোর মাধ্যমে সবাইকে জানাত, সেও ঐ অগ্নোৎপাতে প্রাণ হারাল।


ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

জাহাজটি চীনে আছে জানতে পেরে জ্যাকসনরা প্রথমে লাসভেগাসে গিয়ে ইউরির সাথে দেখা করল। পরে ইউরি ও তার দু’ছেলে, গার্লফ্রেন্ড তামারা এবং পাইলট সাসা-ও তাদের সাথে যোগ দিল। তারপর তারা সবাই চীনের পথে রওয়ানা দিল। সেখানে পৌছার পর তাদের হাতে টিকেট না থাকায় তারা কোনভাবেই ভিতরে প্রবেশ করতে পারল না। জ্যাকসন লক্ষ্য করল অনেক পশুকে কয়েকটি হেলিকপ্টার করে জাহাজের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর প্রচেষ্টায় তারা একটি পশুবহনকারী হেলিকপ্টারের হাইড্রোলিক চেম্বারে করে গোপনে জাহাজের ভেতরে ঢুকে গেল।

একদিন সান্তাম বন্ধু এড্রিয়েনকে ফোন করে জানাল যে, একটি ভয়াবহ সুনামী পুরো ইন্ডিয়াকে প্রাস করে নিচ্ছে এবং সেই সুনামীটি ক্রমান্বয়ে জাহাজের অবস্থানের দিকে ধেয়ে আসছে। কথাটি শুনামাত্রই এনুজার (জাহাজটির কমান্ডার ইন চীফ) জাহাজের মুল ফটকটি বন্ধ করতে নির্দেশ দিল। তখন বাইরে লাখ লাখ মানুষ অপেক্ষা করছিল জাহাজটির ভিতরে প্রবেশ করার আশায়। এড্রিয়েন তখন জাহাজের ভিতরে সবাইকে বুঝাতে সমর্থ হল যে তার ইন্ডিয়ান বন্ধুর গবেষনালব্ধ ফলাফল আজ না জানা থাকলে তাদেরকেও করুন মৃত্যুবরন করতে হত। পরে ক্যাপ্টেন মানবিক দিকটি বিবেচনা করে জাহাজের মুল ফটকটি খুলে দিতে কর্মচারীদের আদেশ দিল। তখন ধস্তাধস্বির সময় গর্ডন নিহত হল এবং তার দেহের কারনে একটি গেট বন্ধ না হওয়াতে জাহাজের ইন্জিন চালু হচ্ছিল না। তখন সুনামীটি তীব্রবেগে জাহাজের দিকে ধেয়ে আসছিল। পরে জ্যাকসন এবং নোয়া একত্রে অনেকক্ষন কাজ করে গেটটা বন্ধ করতে সমর্থ হল। জাহাজটিও তখন চলতে শুরু করল। পরে জাহাজটি অল্পের জন্য মাউন্ট এভারেস্টের সাথে সংঘর্ষ হাত থেকে রক্ষা পায়।


ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

যখন সুনামীর তান্ডবলীলা কমে আসতে শুরু করল তখন স্যাটেলাইটের ছবিতে দেখা গেল যে, আফ্রিকা মহাদেশ আবার নতুন করে গজে উঠতে শুরু করেছে এবং তখন আফ্রিকার ড্রাকেন্সবার্গ পর্বতটি পৃথিবীর উচ্চতম স্থান হিসেবে দেখা গেল। পরে জাহাজ তিনটি “গুড হউপ”বন্দরে গিয়ে ভীড়ল। পরে জ্যাকসন, তার পরিবারের সাথে আবার বনিবনা করে ফেলল। আর এড্রিয়েন “লায়য়া” নামের একটি মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলল।

শেষে পরিবর্তিত আফ্রিকা এবং এশিয়ার মানচিত্র সম্বলিত পৃথিবীর ছবি দেথিয়ে ছবিটির সমাপ্তি দেখানো হয়।


ছবিসূত্র: ইন্টারনেট

ছবিটির স্পেশাল এফেক্ট ছিল অত্যন্ত আকষর্নীয়। বিশেষ করে শহর ধ্বংসের যে ফুটেজগুলো তৈরি করা হয়েছে এককথায় সেগুলি ছিল চোখধাঁধানো। সাউন্ড এডিটিংয়েও ছবিটির উৎকর্ষতা গতানুগতিক ছবিগুলো থেকে আলাদা। কাহিনীবিন্যাসে গতিময়তাএ সবাইকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখবে নিসন্দেহে। প্রায় তিন ঘন্টার এই শ্বাসরুদ্ধকর ছবিটি দেখতে কেউই একঘেয়ে অনুভব করবেন বলে মনে হয়না।

ছবিটির লিংক

ছবিটির কাহিনীতে বা মায়ানিস্টের ক্যালেন্ডারে যাই লিখা থাকুক না কেন আধুনিক মহাকাশবিজ্ঞানীরা কিন্তু এই ভবিষ্যৎবানী ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন। নাসার বিজ্ঞানীরাও পৃথিবী ধ্বংসের আশু কোন সম্ভাবনাই নাই বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। তারপরও সন্দেহবাতিক মানুষদের সন্দেহ তাতে কোনভাবেই দুর হচ্ছে না। অনেকে এখন থেকেই দিনগুনা শুরু করে দিয়েছেন। দেখাই যাক তাহলে ২০১২ সালের ২১শে ডিসেম্বর আসলেই পৃথিবীর শেষ পরিণতির দিন কিনা?

তথ্যসূত্র:
১) মায়ানিক তথ্যপুঞ্জি
২) ২০১২ ফিনমিনা
৩) মায়ার লং ক্যালেন্ডার

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


You must be logged in to post a comment Login