শূন্যসালের দশটি কবিতা
১. সমস্ত বেদনাশ্রু
সময়ের স্রোতে গা ভাসিয়ে সারসের মতো
সবাই চলে গেছে সাগর-সঙ্গমে,
স্বপ্নহারা শুধু আমিই পড়ে আছি বরফরাতে একা।
সনির্বন্ধ চোখের দৃষ্টি সখ্য পায় না কোথাও;
স্ববান্ধব বুকের যাতনা কেবল সন্ত্রস্ত রাখে আমায়।
স্বতীত্ব লুট হওয়া শেষে আমি কোনো সন্তপ্ত কুমারীর সাধ;
সমাজের কাছে একঘরে— মৃত্যুর সম্ভাব্য কুটুম।
সময়ের কষাঘাত এই অন্তর্ভেদী আয়ুষ্কালের ভিতর
সলিল-সমাধির ইতিহাস রচনা করে যায়
সমস্ত বেদনাশ্রু।
১৯ এপ্রিল ২০০০
২. প্রতারণার ফাঁদ
নীরবে প্রতারণার জাল বিছিয়ে চলে গেছো আড়ালে কখন
পাই নি টের
যখন নড়বার বিন্দুমাত্র যো নেই
খোলা নেই কোনো পথ
বুঝলাম
তোমার মায়াবী চাতুরতা
সত্যিই ঈর্ষণীয়
নাহয় মানুষ ব্যবহার করে মোক্ষম অস্ত্রবিদ্যা
শত্রুর জন্য
আমিও কী শত্রু ছিলাম
অলখে পেতে গেছো মৃত্যুফাঁদ
অই ফাঁদে আটকে পড়া আমি এক অসহায় শিকার
২৭ এপ্রিল ২০০০
৩. এ কোন পাপের ঋণ
নিয়তির বাগানে যেন আমি এক ঘাসফড়িং;
উড়ে বেড়ালাম কত— গুণে গেলাম
সূর্যের বয়স
ফুলের কলঙ্ক কপালে বেঁধে গেলাম মেঘের ওপারে—
চাঁদের বুড়ির চোখেও বিষাদের নীরবিন্দু,
ঘুরেই চলছে হাতে প্রায়শ্চিত্তের চড়কা
পাথরে পাথর ঘষে আগুন ধরালাম নিজের দেহে
তবু শেষ হয় নি দেনা—– ঘিরে ধরেছে কেবলই
অমাবস্যা রাতের রিপু
বাস্তু থেকে উদ্বাস্তু হলাম
পথের খোঁজে হারালাম পথ…
তবে এ কোন পাপের ঋণ শোধ করে যাবো রক্তে
এক রক্তখেকো দেবতার কাছে?
১৭ মে ২০০০
৪. যেদিন ওঠে আসবে শঙ্খনীল
দু:সহ বেদনার তীরে যেদিন ওঠে আসবে শঙ্খনীল
কোনোকালের শেষ বিপ্লবের চোখরঙা ভোরে,
রূপকথার মধুচন্দ্রিমায়
গাঁজাখোরের মতো বুঁদ হয়ে
রঙে রঙে ছবি আঁকবে যৌবনা প্রজাপতি।
শব্দভুক চিল উড়বে না আকাশে— বৃষ্টির পালকে আর
কালোক্রোধের বজ্র ধরাবে না জল্লাদাগুন;
দু বাহু বাড়ায়ে উড়ে যাবে মেঘে মেঘে বাঙলার মানচিত্রের রং,
বর্ণখেকো দানবের চোখ ঘেঁষে পঙ্গপালের মতো
নি:শেষ হবে কুক্ষিগত বৃত্তাধীনতা— সমস্ত অপশক্তি।
শঙ্খনীল ওঠে আসবে যেদিন
এক পুনরুত্থানের মতো স্বকীয় মহিমায়,
মাতৃস্নেহের ছায়ায় বসে শুনবো সমুদ্রের সুকান্ত গর্জন
চারদিকে
ধ্বনিত হবে শান্তি… শান্তি… শান্তি…
১৫ জুন ২০০০
৫. চতুষ্কোণ
চতুষ্কোণ সময়ের বেলেল্লা চোরাবালির ব্যাপ্তি
মঙ্গলদীপ নিভিয়ে দেয় ক্রমাগত
ক্রমিক সমানুপাতী পূণ্য শূন্যতা পাপের মতন;
বাড়ন্ত সূর্যের ভিতর নববধূরাত নগ্ন হয়ে
চারদিকে ছড়ায় প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসগীতির বুদ্বুদ—
চকিতে চাক্ষুস চোখে দেখা দেয়
স্নায়ুবিক সত্যতার রূপ— ঈশ্বরের এপিটাফ।
৩ জুলাই ২০০০
৬. পাজরহীন মরুবাসর
যে জন ভেঙে গেছে বুকের পাজর অবলীলায়—
মৃত স্বপ্নবাসর— বিষবৃক্ষের কাটার উৎপাতে
মরণোম্মুখ এই নাগরিক জীবন।
দৈবাৎ সুখপাখি
কবেকার স্মৃতির তৃণলতা এনে কখন বুনেছিল
জীর্ণ থুত্থুরে বাসা,
আটপৌরে দ্যোতনাহীন হাওয়ার হল্কায়
পুড়ে ছাই বর্ণমালাহীন আদিমে—
শুধু বুকে ভর করে চলা সরীসৃপের মতো
সময়ের সম্বিৎ—- পাজরহীন মরুবাসর।
১১ জুলাই ২০০০
৭. কবুতর
কোত্থেকে খড়কুটো এনে ঢাকতে চায় হৃদয়ের সুক্ষ্ম ফাটল
বিধ্বস্ত ঝড়ের রাতে ওড়ে যাওয়া কবুতরদের সংসারে
বড়ো বিপন্ন সময়ের কোনো অসতর্ক মুহূর্তে
বেঁচে থাকবার শেষ ব্যাকুল চেষ্টার টানে;
হয়তোবা গতজন্মের কবুতর প্রাণের রেশটুকু রয়ে গেছে
এই দেহখাঁচার ভিতর,
বারবার ফাটল ঢেকে তাই ভয়ঙ্করের হাত ধরে একদিন
জীবন সাজাতে চায়
মৃতস্বপ্ন জাগরিত করবার ধূসর চেষ্টায়
কম্পিত হাতের কারুকাজে দু:খের নকশিকাঁথায়।
২৮ জুলাই ২০০০
৮. স্মৃতি সংক্রান্ত
(কবিবন্ধু শৈবাল কায়েসের প্রতি উৎসর্গীকৃত)
স্মৃতিরা ক্রমশ ডেকে আনে দেহে কবন্ধ অন্ধকার;
কিছুই করার নেই আর
যখন ঘুমহীন বিষণ্ন রাতে হয় মরণযন্ত্রণা,
আনমনা
সমব্যথী পেঁচা ডুকরে কেঁদে ওঠে চাঁদের বুক চিরে—
হৃদয়ের বন্দরে শুধু কষ্টরাই ভিড়ে।
স্মৃতির সংসারে ওড়ে বিষ ও বিনাশ;
মুমূর্ষুর প্রাণে রয়ে যায় তাই দু:খের দীর্ঘশ্বাস।
৩১ জুলাই ২০০০
৯. নিরীক্ষা
চৈত্রের আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হওয়া
আরও একধাপ মৃত্যুর কাছে যাওয়া;
মৃত্যু ও জীবন যেখানে লীন
সেখানেই ভালোবাসা ফোটে অমলিন।
২ নভেম্বর ২০০০
১০. সোনা নয়তো অঙ্গার
কামারের হাতুড়ির নীচে আকৃতির অপেক্ষায় লাল হওয়া লৌহজীবন;
চিতার আগুন না জ্বললে বুকে— হয় না কিছুই— অনড় পড়ে থাকে
বাস্তবের আয়তন। পুড়ে পুড়ে সোনা খাঁটি হয়;
পাখি উড়ে উড়ে বুঝে যায় একদিন আলোর মাহাত্ম্য যত।
দূরে যাও শালিখ, এসো মাংসভুক শকুন আর চিল;
প্রাণটুকু রেখে নিয়ে যাও বাহ্যিক বড়াই— নিষ্পেষিত আঁধার
যতটা গুমবিদ্যা জানে, তারও অধিক তুমি শাশ্বত অগ্নি;
অগ্নিকে ভালোবেসে আমি খাদহীন সোনা হতে চাই,
নয়তো অঙ্গার।
১০ ডিসেম্বর ২০০০
42 Responses to শূন্যসালের দশটি কবিতা
You must be logged in to post a comment Login