আল মামুন খান

শেষ বিকেলের আলোয় (সম্পুর্ণ গল্প)

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

সকালবেলাটা কত সুন্দর ছিল!
দুপুরটা ও…
কিন্তু বিকেল বেলাটা যে এমন নিরাশার কালো রঙে রাঙ্গিয়ে তাকে পথহারা করে দিবে কে বুঝেছিল?
সেই আবারও শূন্যে ফিরিয়ে নিয়ে এলো সরফরাজকে।
ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।

মনে পড়ে ১৯৯৮ সাল এর কথা।
কিছু চাওয়ার মৃত্যু… অন্য কিছু পাওয়া!
না পাওয়ার বেদনা এক সময় নতুন ‘না চাইতেই পাওয়াকে’ আকড়ে ধরে জীবনের জটিল সমীকরণকে সরলীকরণে ব্যস্ত।

পাশের রুমে কে যেন গান শুনছে।
আব্দুল জব্বারের অনেক পুরনো গান-

‘এক বুক জ্বালা নিয়ে বন্ধু তুমি
কেন মিছে বয়ে বেড়াও
আমায় যদি তুমি বন্ধু ভাবো
কিছু জ্বালা আমায় দাও’…

কেন জানি চোখে পানি এসে গেল। রুমে একা আছে। রফিক সাহেব নেই। কি কাজে যেন বাহিরে গেছেন। নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করল না। নীরবে ঝরে যাক যত ঝরতে চায়।
অবাক হয়ে দেখলো… এতো আবেগ লুকিয়ে ছিল অশ্রু হয়ে মনের কোটরে! নিজের হৃদয়ের বীটের শব্দ শোনার চেষ্টা করল। কিন্তু সেখানে নিজেকে একবার ও পেল না…

৪২ বছর সময়টা কি অনেক বেশী?
একেবারে কমও না।
এখন আর কোনো কিছুই নতুন ভাবে শুরু করার নেই। ওর সব ক’টা দিকই এখন এক অদৃশ্য সাইনবোর্ডের দ্বারা ঘেরা। সেখানে লিখা আছে- ‘ No Tresspassing’

সবই তো ঠিকভাবে চলছিল।
তবে কিভাবে কি থেকে কি হয়ে গেল?
মনের ভিতরে গুমরে কেঁদে চলা ব্যাথাটা হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়াতে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হল সরফরাজ আহমেদ খানের। এই ৪২ বছরে এখনো সুঠাম দেহের অধিকারী। নিয়মিত ব্যায়াম করেন। শরীরে এখনো তেমন কোনো ব্যাধি বাসা বাধেনি।

শুধু একটা ব্যাধি আছে- সেটাকে কি নাম দেয়া যায়?
‘রোমানা’ কি কোনো ব্যাধির নাম হতে পারে?
জানালা দিয়ে শেষ বিকেলের আলো এসে পড়ছে রুমের ভিতর। ওর নিজের শরীরেও। হৃদয়ের চারপাশকে কষ্ট নামক যে দানোগুলো পেচিয়ে ধরেছে, এই আলো হয়ত সেগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে এসেছে। জানালার স্লাইডিং পার্ট আরো ভালো করে খুলে দিলো। আলোয় ভরে যাক ওর হৃদয়-সারা শরীর। তাতে যদি রোমানার দেয়া কষ্টটা কিছুটা দূর হয়।
ইচ্ছে করে টেনে এনেছিল সরফরাজ এই ‘রোমানা’ নামের কষ্টটাকে।
জানালার শিকে কপাল ঠেকিয়ে অস্তগামী সুর্যের দিকে তাকিয়ে বেশ কিছুদিন আগে ফিরে গেল সে…
… ….

‘ আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ
বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।
শুধু শ্রাবণ সন্ধ্যাটুকু তোমার কাছে চেয়ে নিলাম’- এ পর্যন্ত শুনতেই ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল।

বিরক্ত এবং ব্যথিত হল রোমানা।
বারবার বিদ্যুত চলে যাবার জন্য বিরক্তি। আর পছন্দের গানটি পুরোটা শুনতে না পারার জন্য ব্যথা।
বারান্দায় চলে এলো।
এখানেও এখন বিকেল।
কিছুক্ষণ আগে ওদের ‘ব্রেক-আপ’ হয়ে গেল।
ওর আর সরফরাজের ভিতর। দুজনের ভিতর সম্পর্কটা বেশ চলছিল। তবে সম্পর্ক বলতে যা বোঝায় সেটা ওদেরকে দেখলে কেউ বলবে না। সরফরাজ এর বয়সটা একটা বড় বাঁধা। ৪০+ এর একজন পুরুষের সাথে প্রেম করা- শুনতে কেমন যেন লাগে। তবে সেও কি একেবারে খুকী নাকি। ৩২ পেরিয়েছে গতবছর। দুজনের ভিতর একটাই মিল। তা হল দুজনেই ডিভোর্সী। সরফরাজের এক মেয়েকে নিয়ে ওর ওয়াইফ এখন আলাদা থাকে।

আর নিজের অতীতকে রোমানা মনে করতে চাইল না। সাহেদের সাথে ওর মাত্র ৪ বছরের সংসার। দুজনের সম্মতিতেই তারা আলাদা হয়েছে। আসলে ওদের ভিতর রিলেশনের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতা ছিল বেশী। দুই পরিবারের বড়দের সম্মতির ডামাডোলে রোমানার নিজের ইচ্ছেটা চাপা পরে ছিল। সেখান থেকে বের হওয়াটা ওর জন্য খুব টাফ ছিল। বাবা ছিল হার্ট-পেসেন্ট। আর ছোটবেলা থেকে বাবার কথার কখনো অবাধ্য হয় নাই। নিজের জীবনের সব চেয়ে বড় ডিসিশনটাও সে নিজের ইচ্ছাকে দমিয়ে নিয়েছিল।

বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে থেকে হঠাৎ নিজেকে চোখ রাঙাল রোমানা।
কেন সে এগুলো ভাবছে? সাহেদ এখন দূর অতীত। নিকট অতীত সরফরাজ। তবে কি সে সরফরাজকে নিয়ে ভাববে?
নাহ! কাউকে নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ইন ফ্যাক্ট… কিছুই ইচ্ছে করছে না। শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করছে। তাতে কি সমাধান হবে? কার কি লাভ হবে?

কষ্ট তোমার দূর হবে মেয়ে!
কে যেন ওর কানের কাছে বলে। আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখে না। ওর মনের ভ্রম। এখনো সরফরাজময় ওর চারপাশ… সে নিজে… নিজের হৃদয়। ঝলমলে বিকেলের সোনারোদ গাছের পাতা ভেদ করে এক মায়াবী আলোয় রোমানার শরীরকে ধুয়ে দেয়। ওকে শিহরিত করে… ওর সারা শরীরকে উত্তেজিত করে দেয়। সরফরাজের হাতের স্পর্শ যেভাবে ওকে করে দিত- সেভাবে!

বারান্দায় বসে গাছের পাতায় ঝলসে উঠা মায়াবী বিকেলের আলোয় ভর করে সে অনেক দূরে ওর মনের মানুষটার চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ সেই চোখ যে অনেক বদলে গেছে- এক পলকের জন্য রোমানা বিস্মৃত হল! এক বিকেলেই এতো পরিবর্তন হয়ে গেলো? মনের! কেন চোখ বুজে সে সরফরাজকে দেখতে পারছে না। তবে কি তার ভালবাসায় কোনো কমতি রয়ে গেছে? আসলেই কি সে সরফরাজকে ভালবেসেছে?

নাকি এক প্রবল শারীরিক চাহিদা ওকে সরফরাজের কাছে টেনেছিলো? ওদের ডিভোর্সের পর প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেছে। এই দিনগুলোয় সরফরাজকে পেয়ে কি ওর সেই…
নাহ! আর ভাবতে চায় না।

নিজেকে চোখ রাঙ্গালো। একটু কি ছোট মনে হলো নিজেকে? সে আসলে কি চেয়েছিলো এটাতো সে ভালো করেই জানে।
আবার মোবাইল থেকে ফেসবুকে ঢুকল।ওর একাউন্টে গিয়ে দেখে। নাহ। এখনো ওকে আনফ্রেন্ড করে দেয়নি সরফরাজ। ইনবক্স চেক করে। সেখানেও নতুন কিছু নেই। শেষ যে কথাগুলো লিখেছিলো সেগুলোই মুখ ব্যাদান করে ওকে ব্যঙ্গ করলো যেন।

একটা প্রচন্ড রাগ হঠাৎ করে সারা শরীরকে আন্দোলিত করে দিয়ে গেলো। আর স্থির থাকতে পারলো না। সরাসরি আনফ্রেন্ড করে দিলো সরফরাজকে। এরপর মোবাইলটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে বারান্দার শিকগুলো ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
নিঃশব্দ সেই বর্ষণে মাঝে মাঝে কেঁপে ঊঠা… আর শৃঙ্গখলমুক্ত কষ্টগুলো যেন মুক্তো হয়ে ঝরে পরতে লাগলো।
বাহিরে সন্ধ্যা নেমে আসছে…
… …

মতিঝিলে একটা কাজে গিয়েছিল সরফরাজ। সেখান থেকে আরামবাগ কাছে। কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসে ওর নামে একটা পার্শেল এসেছে। ভাবলো নিয়ে ই যাই। ভিতর থেকে একটা সরু গলি আছে। পায়ে হেঁটেই চলে এলো।
অনেক ভীড়। মনে হলো পুরো ঢাকা শহরের সব মানুষই আজ এখানে এসেছে। রং বে রঙের কাপড় পড়া তরুনীর দল… টিন এজার কিছু প্রেমিক (ওদেরকে দেখে এই মুহুর্তে ওর কাছে এরকমই লাগছে)। ক’জন মধ্যবয়ষ্ক রাশভারী পাওয়ারফুল চশমা পরা ভদ্রলোকও আছেন। সবাই লাইনে দাড়িয়ে আছেন। সবার পিছনে গিয়ে সরফরাজ দাঁড়ালো। একটু বিরক্ত হল। ভাবলো, না এলেই হতো।

অনেক পরে তিনজনের পিছনে এলো সে। চার নাম্বারে। এমন সময় এক মহিলা কন্ঠ শুনে ফিরে তাকালো। ত্রিশোর্ধ একজন একেবারে লাইনের সামনের জনকে রিকোয়েষ্ট করছে তার পার্শেলটা আগে নিতে পারবে কিনা। তার খুব তাড়া আছে। কিন্তু সে রাজী হল না। পিছনের দুজনও একই কথা বলে পিছিয়ে এলো। সরফরাজ তখন মেয়েটিকে নিজের জায়গা ছেড়ে দিয়ে একেবারে পিছনে চলে গেলো। মেয়েটি কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগও পেলো না। তার আগেই সরফরাজ লাইনের পিছনে অবস্থান নিয়েছে।

মেয়েটি তার কাজ শেষ হলে লাইনের পাশ ঘেষে চলে যাচ্ছিল। সরফরাজের কাছে এসে থেমে গেলো। দুজনের চার চোখের মিলন হল। হেসে মেয়েটি বললো,

’ হাই! আমি রোমানা। ‘
‘হাই। আমি সরফরাজ।
‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।‘
‘ইটস ওকে।‘
‘আপনাকে তো অনেক দেরী করিয়ে দিলাম’ – বলে লম্বা লাইনের দিকে তাকায় রোমানা। সরফরাজও সেদিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে। বলে,
‘হ্যা, তা অবশ্য দিয়েছেন।‘
‘ আইম স্যরি’
‘ না, না, স্যরির কিছু নেই। আমার এই পার্শেলটা এমন জরুরী নয়। চলুন বের হই।‘
‘হ্যা, চলুন’।

ওরা দু’জন কুরিয়ারের অফিস থেকে বের হল। দুজনের গন্তব্যও একই দিকে। সেই সোনালী ব্যাংকের সামনে দিয়ে হানিফের কাউন্টার পর্যন্ত হেঁটে হেঁটেই গেলো। এরি ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা। মেয়েটিকে বেশ সপ্রতিভ লাগলো সরফরাজের কাছে। রোমানারও বেশ ভালো লাগছিল এই অপরিচিত মানুষটির সঙ্গ। দুজনে পাশাপাশি সীটে করে ঘন্টা খানিক পথ এক সাথে গেলো। এর ভিতরে না জানা কথা জানা হল… মোবাইল নাম্বার বিনিময়… সব কেমন এক ঘোরের ভিতর হয়ে গেলো। আসলে নিয়তি ওদেরকে নিয়ে তার বিশেষ প্ল্যান করে রেখেছিলো দেখেই ওরা এইভাবে পরিচিত হল।

এরপরে রাতের পর রাত মোবাইলে কথা বলা… আপনি থেকে একদিন হঠাত করে তুমিতে চলে আসা… ফেসবুক ফ্রেন্ড হওয়া… এরপরে একদিন ডেট। ঘন্টার পর ঘন্টা অলস সময়গুলো কেটে যেতো কি মধুর আবেশে… ছুটির দিনগুলোকে ঈদের দিনের মতো লাগতো সরফরাজের কাছে। সেই পাটুরিয়াঘাটে চলে যেতো দুজনে শুধুমাত্র একে অন্যকে কাছে পাবে… একটু বেশী সময় দিতে পারবে সে জন্য।

বুড়িগঙ্গায় নৌকা নিয়ে ঘুরতে বের হল একদিন। সেদিন অনেকটা কাছে এসেছিল ছইয়ের ভিতরে। কেমন এক শ্বাসরুদ্ধকর অনুভুতিতে আচ্ছন্ন হয়ে সরফরাজ নিজেকে নিবৃত্ত করেছিল। রোমানা আহত হল। একটু বুঝি রাগও হলো। কিন্তু সরফরাজের রুচির বাহিরে সে যেতে চাইলো না। সেদিনের পর থেকে কিছুটা যেন দুরত্ত তৈরী হল ওদের ভিতরে। অবশ্য রোমানার দিক থেকে। সে একটু আলগা আলগা রইলো ক’দিন।

একদিন বসুন্ধরা সিটিতে নিয়ে গেলো সরফরাজ ওকে। একথা সেকথার পরে ওদের সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে কথা তুললো । সরাসরি বিয়ে করার প্রস্তাব দিলো। কিন্তু রোমানা এড়িয়ে গেলো। সরফরাজ জিজ্ঞেস করলো রোমানা কি ওকে ভালবাসে না। উত্তরে বললো বাসে, কিন্তু এখন এই মুহুর্তে বিয়ে করার ইচ্ছে তার নেই। সাহেদের থেকে ডিটাচড হয়েছে বেশীদিন হয়নি। ওর দেয়া ক্ষত এখনো তাজা রয়েছে ভিতরে ভিতরে। তবে কতদিন সরফরাজকে অপেক্ষা করতে হবে তা জিজ্ঞেস করলে রোমানা এড়িয়ে যায়। বলে ,’আমি জানি না।’ সেদিনের মতো কথা সেখানেই শেষ হয়।

রোমানা বাংলালিঙ্ক এর কাস্টোমার সার্ভিস প্রতিনিধি। প্রতিদিন ৫টা পর্যন্ত অফিস করে। এরপর বাসায় ফিরে সেই একা একা কাটে ওর সময়। সরফরাজ অবশ্য মোবাইলে কথা বলে। নেটে তো দিনের ভিতরে ঘন্টাখানেক পর পর দুজনে চ্যাট করে। তারপরও রোমানার মনে হয় কি যেন পেলো না… কি যেন বাকী রয়ে যায় ওর কাছে। আসলে সরফরাজ আসার পর তাকে সম্পুর্ণভাবে কাছে পেতে চাইছে। কিন্তু সাহেদের প্রতি ওর ঘৃণাটা এখনো রয়ে যাওয়া মানে সেখানে কিছু্টা হলেও ওই ঘৃণ্য মানুষটির প্রতি রোমানার অবচেতন মনে ভালবাসা রয়ে গেছে। একসাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বাস করার ফলে গড়ে উঠা একটা হ্যাবিচুয়াল রিলেশন কি… এই ভালবাসা ? একইসাথে একটা মানুষের প্রতি কি একাধারে ভালবাসা ও ঘৃণা থাকতে পারে?

সরফরাজ রোমানাকে অনেক স্টাডি করেছে এ ক’দিন। পরিচয়ের পর থেকে যখনই সাহেদের প্রসংগ এসেছে, খুব কঠিন ভাষায় সে ওর বিরুদ্ধেই বলেছে শুধু। কিন্তু দুজন মানুষ একসাথে থাকলে কি একজনের কারণেই কোনো সম্পর্ক ভেঙ্গে যেতে পারে? অন্যজনের কি কিছুই করার থাকে না? সাহেদ-রোমানার পারিবারিক বিপর্যয়ে রোমানার কি কোনো হাত ছিলো না? এখন সরফরাজ যা শুনছে সবই রোমানার জবানীতে। আর সে রোমানাকে এখন ভালবাসে। তাই সাহেদকে ওর কাছে একটা খারাপ মানুষ ছাড়া আর কিছুই লাগবে না। তবে যাকে মানুষ ভালবাসে, তার প্রতি প্রচন্ড ঘৃণাও কিন্তু তার প্রতি এক প্রচন্ড সুপ্ত ভালবাসারই বহিঃপ্রকাশ। আর এই কারণেই সরফরাজ সুযোগ থাকা সত্তেও রোমানার আহ্বানে সাড়া দেয়নি… মনের সাড়া না পেয়ে ইতস্তত করেছে… ভদ্রভাবে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রোমানা এটাকে ওর নপুংশকতা ভেবে নেয়নি তো?

বিভিন্নভাবে রোমানা ওকে কাছে ডাকে। চ্যাটে বসে সেক্সের জন্য ইনভাইট করে। মোবাইলেও সেক্স ছাড়া সে কিছুই বোঝে না। একসময় সরফরাজ ‘দেখি কি হয়’ ভাবনায় তাড়িতো হয়ে ইনবক্সে এবং মোবাইলে ওর আহ্বানে সাড়া দিতে থাকে। তার নিজেরও এতে কষ্ট হয়। হাজার হোক সেও তো একজন পুরুষ… কিন্তু রোমানার কাছে সেটা একটা নেশা হয়ে দাড়িয়েছে ততোদিনে। সরফরাজের ভিতর কি চলছে তা সে বুঝতেই চাইলো না। কিংবা সরফরাজ এগুলো পছন্দ করছে কিনা তার কোনোই তোয়াক্কাই করলোনা সে।

আর সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলোতে কাছে এলেই একটু আধটু স্পর্শ করা নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু দুজন সদ্য ডিভোর্সী নর-নারী ভালবেসে একান্তে কাছে এসে কতক্ষণ আর সংযম পালন করতে পারে? তারপরও সরফরাজ অনেক সংযমের পরিচয় দিচ্ছে… দিয়ে এসেছে। ঠিক এভাবেই একদিন সরফরাজের বাসায় ওর রুমমেট তার গ্রামের বাড়ীতে থাকা অবস্থায় রোমানা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে যেতে চাইলে সরফরাজ খুব কঠিন ব্যবহার করে। ক্রদ্ধ ও কামনায় তপ্ত লাল হয়ে উঠা রোমানা সরফরাজকে ভুল বোঝে। ওকে অক্ষম বলে অপমান করে সরফরাজকে মেরে ধরে আচড়ে খামচে ঘৃণায় চলে আসে। হতবাক সরফরাজ স্থাণুর মত বিহ্বল হয়ে থাকে… অনেকসময়।

এরপর…
মোবাইল বন্ধ… নেটে অনুপস্থিত… বাসায় এলে ভদ্রভাবে বলে দেয়া বাসায় নেই… ক’দিন এমন চলতে থাকে।
একদিন অফিসের পরে মুখোমুখি দুজন।
সরাসরি রোমানার জানিয়ে দেয়া একজন অক্ষম মানুষের সাথে আর না…
অনেক কষ্ট নিয়ে মাথা নীচু করে বাসায় চলে আসে সরফরাজ।

… … … বাস্তবে ফিরে আসে সরফরাজ। ভাবে রোমানার রাগ হয়তো বেশিদিন থাকবে না। ফেসবুকে ওদের গ্রুপে ঢুকে দেখতে চায় রোমানার উপস্থিতি। আগেও রাগ হয়েছে। কিন্তু ওর স্ট্যাটাস লুকিয়ে পড়েছে… পরোক্ষভাবে কমেন্ট করেছে… তবে সরফরাজকে বুঝিয়েছে সে আছে। চাইমের সেই গানটির মত ” …অথচ আছি… আমি তোমার কাছাকাছি…” এ টাইপের নস্টালজিক ফিলিং এ ভোগে রোমানা প্রায়ই।

একটু উত্তেজনা বোধ করে সরফরাজ… আশা আর নিরাশার মাঝামাঝি এক উপলব্ধি…
নেটে ঢুকে সরফরাজ। ফেসবুকে লগ অন করে।এরপরই কোথা থেকে এক অদৃশ্য ওয়েভ এসে সরফরাজের হৃদয়টাকে চেপে ধরে… একটা বীট মিস করে… না এখন আর রোমানা ওর ফেসবুক ফ্রেন্ড নেই।
ওর প্রিয়তমা ওকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে!!
… …
আজ চাইলেও অফিসে যেতে পারেনি রোমানা। হরতাল ও অবরোধ চলছে একই সাথে। আসলে কোনটা যে কখন চলে সেদিকে ওর খেয়াল নেই। শুধু ওর কেন? জিজ্ঞেস করলে অনেকেই বলতে পারবেনা যে আজ হরতাল না অবরোধ না হরবোধ? হরতাল এবং অবরোধের ভিতরে পার্থক্য কি কিছু রয়েছে? দু’টোতেই জনজীবনে অশান্তি-পুড়ে মরার নিশ্চয়তা এবং আমাদের নিজেদের ট্যাক্সের টাকায় তিলে তিলে তৈরী হওয়া রাস্ট্রীয় সম্পদ বিনষ্ট হওয়া ১০০% নিশ্চিত করে।

বিছানায় উপুড় হয়ে বাবুদের মতো গালের ভর দুই হাতে রেখে এ সব ভাবছিল রোমানা। মাথার চুলগুলোকে দু’দিকে বেনি করেছে। শাহেদ এর খুব প্রিয় ছিল ওর এভাবে চুল বাঁধা। কতদিন সে নিজে ওর চুলের এরকম বেণী করে দিয়েছে! উফফ… আবার সাহেদকে মনে পড়ছে! যাকে সবচেয়ে বেশী ঘৃণা করে সে কেন বারবার ওর সামনে চলে আসে?

বিছানার পাশেই রয়েছে প্রিয় কবি মহাদেব সাহার কবিতার বইটি। পড়ছিল ‘চিঠি দিও’ কবিতাটি। হাতে নিয়ে আবার পড়তে শুরু করে। যতবার পড়ে আরো পড়ার ইচ্ছেটা বাড়িয়ে দেয়। দ্বিতীয়বারের মত শুরু করলো-

” করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
খামে ভরে তুলে দিও
আঙ্গুলের মিহিন সেলাই
ভুল বানানেও লিখো প্রিয়,
বেশি হলে কেটে ফেলো তাও,
এটুকু সামান্য দাবি, চিঠি দিও, তোমার শাড়ির মতো
অক্ষরের পাড়-বোনা একখানি চিঠি।
… … …
… … …
সেইসব চুপচাপ কোন দুপুরবেলার গল্প
খুব মেঘ করে এলে কখনো কখনো বড় একা লাগে, তাই লিখো।
করুণা করে হলেও চিঠি দিও,
মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি ! “

… বইটা বন্ধ করে বিছানার উপরে ফেলে রাখে। কি করবে ভেবে পায় না। অফিসে থাকলে যে কোনোভাবে সময়টা পার হয়ে যায়। কিন্তু এই ঘরে থেকে থেকে প্রতিটি মুহুর্তকে বছরসম দীর্ঘ মনে হচ্ছে। বারবার মনে দুটো লাইন ভেসে আসছে… ‘করুণা করে হলেও চিঠি দিও,… মিথ্যা করে হলেও বোলো, ভালবাসি !’

কে করুণা করবে? কে মিথ্যে ভালবাসি বলবে?
সাহেদ না সরফরাজ?
সাহেদের চ্যাপ্টার তো শেষ হয়ে গেছে। কাগজে কলমে… জীবন থেকেও কি গেছে? যদি যায়ই তবে অলস কিংবা শত ব্যস্ততার মাঝেও কেন
আর সরফরাজ!
তাকে কীভাবে নিয়েছে রোমানা? বা নিচ্ছে … নিতে চাইছে?
সে আসলে কার? কাকে ভালবাসে? আদৌ কি ভালবাসে ? ভালবাসা মানে কি শরীরের চাহিদা? যদি তাই না হবে তবে কেন সরফরাজকে সেই নিরিখে বিচার করলো?

নাহ! মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করে,
‘ কেন সরফরাজকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো?’
‘সে আমার ইচ্ছেকে সম্মান দেয় নি।‘
‘সব ইচ্ছে কি ভাল? অসৎ ইচ্ছে থেকে ভদ্র ভাবে সরে যাওয়া কি খারাপ?’
‘তবে কেন কিছুদিন সে ফোনে-ম্যাসেজে সেই অসৎ কাজটি করে আমার নেশাকে জাগিয়ে তুলেছে?’
‘এর জন্যও তুমিই দায়ী… তোমার কষ্ট যাতে না হয় সে জন্য ই হয়তো করেছে।‘
‘আমি তো তাকে ফোর্স করিনি? সে স্বেচ্ছায় এসেছে… করেছে’

সারা ঘর হেঁটে বেড়ায় কিছুক্ষণ। আসলে সরফরাজকে আনফ্রেন্ড করে দেবার পর থেকে এক দন্ডও শান্তি পাচ্ছে না। সরফরাজ ওর একটা নেশা হয়ে দাড়িয়েছে। একদিন এ কথা রোমানাকে সে বলেও ছিল, ‘ আমি মনে হয় তোমার একটা নেশায় পরিণত হচ্ছি!’ সে উত্তরে বলেছে, ‘ হলেই বা। ক্ষতি কি? ভালবাসা কি একটা নেশা নয়?
সেই নেশা ছেড়ে রোমানা এখন মনে হয় ‘উইথড্রয়াল সিম্পটমে’ ভুগছে।
আবার একটা প্রচন্ড রাগে সারা শরীর কাঁপতে থাকে।

রাগ নিজের উপর… সরফরাজের উপর… সাহেদের উপর… বাবা-মা সবার উপর। ঘুরে ফিরে শেষে সেই সরফরাজের উপরে গিয়েই স্থির হয়।
না হয় সে ওকে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছে… মোবাইল তো আর বন্ধ করে রাখেনি। নাম্বার কি ওর জানা নেই? বাসার টি এন্ড টিতেও তো ফোন দিতে পারতো? সেই ভোরে একবার নিজের টাইমলাইন এবং গ্রুপে ঘুরে এসেছে। ওর গ্রুপের সব ক’টি পোষ্ট সরফরাজ দেখেছে… কোনোটায় লাইক দিয়েছে… বাকীগুলো নীরবে দেখে গেছে। তবে কোনোটায় আগের মতো কমেন্ট করেনি। অনেকক্ষণ ঝিম মেরে অলস বসে ছিল। যদি ইনবক্সে কোনো ম্যাসেজ আসে। কয়েকবার এলো। আর প্রতিবারই মনের গোপন যায়গাটায় আলো জ্বলে উঠেছিলো… হাজার পাওয়ারের। এই বুঝি এলে মোর দ্বারে… হয়তো সরফরাজ কিছু লিখেছে… আগের মতো। কিন্তু প্রতিবারই নিরাশার ঘন কালো আঁধারে ডুবে গিয়ে আরো হতাশ হয়েছে। মোবাইলে কল এলেও একই চিন্তায় আশান্বিত হয়ে হতাশার গভীরে নিমজ্জিত হয়েছে।
এভাবে এখন পর্যন্ত চলছে…

একবার ভাবে সে কি ওকে ফোন করবে? কিন্তু সেটও পারছে না। যদি ওর ফোন রিসিভ না করে? যদি আরো ভদ্রভাবে ওকে না করে দেয়… নিষেধ করে দেয়? তবে এই যে আশাটুকু বেঁচে আছে তার অপমৃত্যু হবে।
একজন মানুষের আশা মরে গেলে আর কিছু থাকে?
এমন সময় মোবাইলে রিং বেজে উঠে।
মনটা প্রথমে কোমল হয়ে পরবর্তিতে আরো কঠিন হয়ে যায়… বাজতে থাকুক… সে যার ফোন আশা করছে সেটা তো আর না!
আবারও ভাবে একজন মানুষের আশা মরে গেলে আর কি থাকে… … … ?
… …
বেশ কয়েকবার রোমানাকে ফোন করল।
ফোন ধরছে না। গতকাল কয়েক দফা চেষ্টা করেছে। কোনো রিপ্লাই না পেয়ে একটু কষ্ট পেলেও দমে গেলো না। তবে এর পরে আর চেষ্টা করলো না।
সরফরাজ বুঝে গেছে রোমানার হৃদয় থেকে সে মুছে গেছে। যেভাবে রাস্তায় রোমানা ওকে পেয়েছিল- সেই রাস্তায়ই আবার সরফরাজকে ফেলে চলে গেলো। কিছুদিন কাছে থেকে গেলো… কিছু সুখ-স্মৃতি নিয়ে যেতে পারছে এই যা প্রাপ্তি।

সরফরাজের ইনবক্সে রোমানার ভালো-মন্দ… সাদা-কালো … আনন্দ-বেদনার কিছু শেয়ার রয়ে গেছে। এগুলোকে রেখে আর কি হবে! মোবাইলে সেভ করা কিছু ম্যাসেজও আছে। কয়েকটা ম্যাসেজ আবার পড়তে ইচ্ছে হল। এ যেন ফাঁসির আসামীর শেষ ইচ্ছে!
রোমানা লিখেছে-
“ প্রিয় বাঘ! ভাল আছ? অনেক ধার তোমার নখে। সারা শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। সারা মন ব্যাথা হয়ে গেছে। তোমার কম্পিউটারের সামনের চেয়ারটাতে বসো। তোমার সামনে দাঁড়িয়ে তোমাকে আজকে বুকে নেই। এসো…ঐ যন্ত্রনাকে সাক্ষী রেখে আমি তোমাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছি।তোমার সব যন্ত্রণা আমার প্রাপ্য।

“সেদিন যখন তোমাকে বুকে নিয়েছিলাম, তুমি আমার পাশে বসা ছিলে। আমি শুয়ে ছিলাম এবং আমি বলেছিলাম আমার ঠান্ডা লাগছে। সেক্স দরকার বলি নাই…”

“ আমি তোমার হার্টবীট শুনে তোমাকে বিশ্বাস করেছি। অন্তরের সাপোর্ট না পেলে মুখের কথায় আমি বিশ্বাস করি না। জীবন-মৃত্যুকে এক জেনে পথে নেমেছি। হাসি মুখে মরতে চাই…”

“ আমার কথা মনে পড়লে এক কোপে একটা কচু গাছ কেটো। অপারগ হয়ে যা কিছু নির্দয় ব্যবহার করি তার জন্য মাফ করো। কখন মরে যাই। আবার যদি মাফ চাওয়ার সুযোগ না পাই…”

মোবাইলটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো সরফরাজ। একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা ওর মতো পোড় খাওয়া মানুষকে এভাবে হেলিয়ে দিবে!? হৃদয়ের ভিতরে শুধু’ “মাফ করো… কখন মরে যাই” শব্দগুলো পাক খেতে থাকে।
হৃদয়ে পাক খায়?
আসলে আমরা একটা ভুল ধারণা করি সবাই-সবসময়। হৃদয় যদি হার্টকেই বোঝায় তবে হার্টের কাজ হলো রক্ত পাম্প করা। শরীরের দুষিত রক্তকে পরিশুদ্ধ করে সেগুলোকে ধমনী ও শিরা দিয়ে প্রবাহিত করতে করতেই হার্টের শ্বাস ফেলার সময় থাকেনা। সে আবার প্রেম-ভালবাসা ইত্যকার আবেগগুলোকে কীভাবে ধারণ করতে পারে? এটা আসলে ব্রেইনের কাজ। সব কিছু ব্রেইনে পাক খেতে থাকে।

ফেসবুকের একাউন্টে ঢুকে ইনবক্সের রোমানার সাথে সকল কনভারসেশন ডিলিট করে দিলো…
মোবাইলের সকল ম্যাসেজ গুলো ও…
রোমানার দুটো নাম্বারও সীম থেকে মুছে দিলো…
একেবারে সেই আরামবাগের কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সার্ভিসে ঢোকার আগের অবস্থায় ফিরে এলো!
আসলেই কি ফিরে যেতে পেরেছে?
হৃদয় বা ব্রেইন যাই বলিনা কেন সেখান থেকে এতো সহজেই যদি সব কিছু ডিলিট করা যেতো?
এরপর রোমানাকে একেবারে ব্লক করে দিলো!!!

এক মধ্যাহ্নে রোমানার নামের একটা অধ্যায় ওর জীবনে শুরু হয়েছিল… আজ এক শেষ বিকেলে এসে সেটার সমাপ্তি ঘটলো। ওর আলো আলোয় ভরা চারিদিকে মাঝখানে কিছুটা অন্ধকার উঁকি দিয়ে গেলো। তবে এই আবীর রাঙা বিকেলের আলোটা কেন জানি হৃদয়টাকে রাঙ্গাতে ব্যর্থ হল। বারান্দার গ্রিল ভেদ করে সোনালী আলো ওর সারা দেহকে রাঙানোর চেষ্টা করে কিছুটা যেন পুষিয়ে দিতে চাইছে।

সরফরাজের মোবাইলটা বেজে উঠেছে… ডিসপ্লেতে ভেসে উঠা নাম্বারটা কেমন পরিচিত লাগছে। কিন্তু সেভ করা না থাকায় সে রিসিভ করলো না।
অপরিচিত কারো নাম্বার সরফরাজ রিসিভ করে না।।

(শেষ)

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


2 Responses to শেষ বিকেলের আলোয় (সম্পুর্ণ গল্প)

You must be logged in to post a comment Login