মুহাম্মদ সাঈদ আরমান

সীমানার বৃক্ষ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

এক
জলিল মিঞার মৃত্যুর পর তিন ছেলের যৌথ পরিবারটি বিভক্ত হয়েছে। সহায়-সম্পত্তি বন্টনের সময় বিপত্তি বেঁধেছিল একটা বৃক্ষ আর সোনা বানুকে নিয়ে। বৃক্ষটি সবাই পেতে চাইলেও মা সোনা বানুকে কেউ নিজের ভাগে নিতে চায় নি।
চল্লিশ বছর বয়সী আম বৃক্ষ। বাড়ির ত্রিসীমানায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দূর থেকে দেখা যায়। গ্রামে এত বড় বৃক্ষ দ্বিতীয়টি চোখে পড়ে না। ফল সুমিষ্ট । কৃষক জলিল মিঞা যৌবন কালে রোপন করে ছিল এটি । সোনা বানুর হাতের পরশ পেয়ে বৃক্ষটি বেপরোয়া ভাবে বেড়ে যায়। ফাগুনে প্রথম যে বার মুকুল আসে, জলিল মিঞা সোনা বানুকে বলেছিল;
: ‘বানু, দূর থেকে বৃক্ষটি দেখলে কি মনে হয় জান?
লজ্জাবনত মুখে সোনা বানু জানতে চায়;
: কী ?
: দেখলে মনে হয়, হলুদ শাড়ি প্যাঁচিয়ে, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তুমি আমাকে ডাকছ’।
স্বামীর মুখে এই কথা শোনার পর থেকে সোনা বানু বৃক্ষটির প্রতি যত্নের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। গ্রীষ্ম কালে পুকুর থেকে কলসী করে পানি এনে গোড়ায় ঢালত। বর্ষা কালে বৃক্ষের গোড়ায় গোবর স্তুপ করে রাখতো। বৃক্ষ সোনা বানুকে এর প্রতিদান দিতে ভুল করে নি। মৌসুমে সোনা বানুর আঁচল ভরে মিষ্টি আম দিয়েছে। শুকনা ডাল-পালা দিয়ে রান্নার জ্বালানী জুগিয়েছে।
স্বামীর মৃত্যুর পর সোনা বানু দিনে বৃক্ষের নিচে চাটাই বিছিয়ে শুইয়ে-বসে কাটায়।

মুরুব্বীরা সিদ্ধান্ত দিয়েছিল বৃক্ষ আর মা সোনা বানু সবার। পালাক্রমে তিন বাড়ি থেকে সোনা বানুর অন্ন জোগাতে হবে । বৃক্ষ যতদিন বাঁচবে ফল সমান ভাগে ভাগ হবে। সে দিন থেকে বৃক্ষটি ‘সীমানার বৃক্ষ’ নামে তিন পরিবারে পরিচিত লাভ করে।
বৃক্ষটি বার্ধক্যে উপনীত হলেও ফলন আগের মতই দিচ্ছে। জাতি আমের বৃক্ষ। গ্রাম জুড়ে নাতি-পুতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বৈশাখে রুদ্রের খরতাপের দিনে শিশুদের মিলন মেলা বসে বৃক্ষের নিচে। ঝরে পড়া আম নিয়ে ঝগড়া বাঁধে রোজ। শিশুদের ঝগড়া তিন পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। একেক বার একেক ভাই তেড়ে আসে আর বলে; ‘করাত দল ডেকে এখনই কেটে ফেলবো’। মা সোনা বানু ছেলেদের হাতে-পায়ে ধরে বৃক্ষটি বাঁচিয়ে রেখেছে।

দুই

২৮শে বৈশাখ। দুপুর ১টা। বাড়ির বউ-ঝিরা গৃহস্থালী কাজে ব্যস্ত। বড়জনের ছেলে রমিজ আম পাড়তে বৃক্ষে ওঠে ছিল। মেজ জনের ছেলে বশির রমিজকে নামতে বলে। রমিজ গোঁয়ার। কথা শুনে না। বশির নিচ থেকে ঢিল ছুঁড়ে। রমিজের মাথায় আঘাত লাগে।ফেটে গিয়ে রক্ত ঝরে। রমিজের বাবা শফিক খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে। সাথে গাছ কাটার করাত দল। শফিক উচ্চস্বরে আদেশ দেয়;
: ‘মুলা সহ কেটে ফেলো এই বালাই’
ছোট ভাইয়েরাও ছুটে আসে। বাঁধা দেয় নি কেউ। করাত দল শুরু করে তাদের কাজ।
মা সোনা বানু অসুস্থ। নিজের ঘরে শুইয়ে আছে। ছুটে এসে বাঁধা দেয়ার মত শক্তি তার দেহে নেই। অন্য দিনের মত চেঁচামেচি ও করে নি।

কাটা প্রায়ই শেষ। তদারকি করছে শফিক। বড় বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়েছে বৃক্ষে আগা। ঘরের চালে যেন ডাল-পালার আঘাত না লাগে। গ্রামের ছেলে-বুড়া সবাই দেখতে এসেছে। শফিক মিঞা ক্ষণে ক্ষণে সবাইকে সাবধান করছে। ‘এই দূরে যাও। চাপা পড়ে মরবি’।
করাত দল কোরাসে হেইয়্যা…….. দিয়ে দড়ি টানছে। ফাঁকা জায়গায় ফেলতে হবে প্রকাণ্ড দৈত্য বৃক্ষটি। আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে গ্রামের আদি সাক্ষী বৃক্ষটি মড় মড় করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। কোন বাড়ির চালে আঘাত হানে নি।
শফিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! হাঁক-ডাক নেই। সবার চোখ খুঁজছে তাকে। একটি ডালের নিচে চাপা পড়ে আছে শফিকের নিথর দেহ। বৃক্ষ যেন শফিককে বগলদাবা করে শুইয়ে আছে । সবার বাকরুদ্ধ! সকলের উপস্থিতিতে কিভাবে ঘটল এই অঘটন! শফিকই তো সবাইকে সাবধান করছিল।
কান্নার রোল পড়ে যায় সারা বাড়ি। ভাষা কান্নার রূপ নেয়। বৃক্ষের প্রতি কৌতুহল শোকে পরিণত হয়। বৃক্ষে বসবাসকারী পাখি গুলো পাশে-পাশের বৃক্ষে আশ্রয় নিয়েছে। ওদের মুখেও কোন শব্দ নেই।

সোনা বানুর মেজ ছেলের মেয়ে মরিয়ম এসে উপস্থিতিকে আর একটা খবর দেয়;
: ‘দাদী কথা বলছে না’।
মহিলারা ছুটে যায় সোনা বানুর ঘরে। জাগিয়ে তুলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। সোনা বানুও চলে গেছে না ফেরার দেশে।
প্রবীণরা বলছে; এই বৃক্ষে দুষ্ট জিন বাস করতো। জিনেরা শফিককে মেরেছে। একটি প্রশ্নের উত্তর কেউ বলতে পারছে না। সোনা বানু পুত্র শোকে মরেছে না বৃক্ষের ?

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


3 Responses to সীমানার বৃক্ষ

You must be logged in to post a comment Login