প্রহরী

কেক বাংলাদেশ

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

আমার বন্ধু সুজন, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরার জন্য, নানা বাড়ি থেকে ওর মা’য়ের ভাগে পাওয়া জমিটুকু বিক্রি করে  বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। তাও প্রায় দু’বছর হলো। প্লেনে উঠার আগে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-দোস্ত, আমার  মা ও ভাইবোন দুইটাকে দেখে রাখিস। জানিসতো, আমি চলে যাবার পর ওদের কোনো অভিবাবক থাকলো না। তুই আমার দোস্ত হলেও আছিস, ওদের বড় ভাই হলেও আছিস। তোর উপর ভরসা করেই ও’দেরকে রেখে যাচ্ছি।

আমি কিছু বললাম না। নিরবে শুধু ওর চোখের মাঝে চোখ রেখে, ওর’ই বলা কথা গুলির গভীরতা খোঁজলাম। শুললিত কন্ঠে এয়ারপোর্টের মাইক্রোফোনে ঘোষনা হলো, ইউর এটেনশন প্লীজ……… সুজন নিজের চোখ মুছে  ধীরে ধীরে মিশে গেল ডিপার্টচার লাউঞ্চ’এর দিকে। চলে যাওয়ার পথে সে পিছনে ফিরে না তাকালেও,  আমি পাশে তাকিয়ে দেখলাম তার সদ্য বিধবা মা, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছে অনিশ্চিত অনাগত ভবিষত’এর দিকে। চোখে কোনো পানি নেই। হয়তো এক্ষনি চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়বে মেরাপি’র প্রচন্ড গলিত লাভা। তারই পূর্বপ্রস্তুতি চলছে বুকের ভিতর। আমার ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা। সুজনের ছোট বোন। গত দুইদিন ধরে কেঁধে কেঁধে তার’ও বোধহয় চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। পাহাড়ি গায়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলা নদীর মত সাবিহার  গোলাপী গালের দুই পাশে লেগে আছে লবনাক্ত দাগ। ওড়না দিয়ে মুখটি চেপে, ছলছলে চোখে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কাঁচের দেয়ালে। হয়তো মনে মনে ভাবছে, “ভাইয়াকে যদি আর একটি বার দেখা যেত”।

“সুজন ভাই কবে আসবে?”  হঠাত  পিছন থেকে  প্রশ্নটি শুনে চমকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি, সুমন। সুজনের ১২ বছর বয়সের ছোট ভাই। তার মাথায় ছোট একটি চটি মেরে হাসতে হাসতে বললাম,  তোর জন্য জামা কাপড় কিনতে পারলেই চলে আসবে। সে আমার মুখের দিগে চেয়ে বললো, “আমিতো ভাই’য়ের কাছে জামা কাপড় চাইনি, তবু কেনো ভাইয়া বিদেশে যাচ্ছে”?  আমি সুমনের এই প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে খালাম্মাকে বললাম,

-চলেন খালাম্মা, এইবার যাওয়া যাক।

খালাম্মা খুব কাঁচুমাচু করে বললেন,

-আরেকটু থাকি বাবা, প্লেনটা উঠলেই নাহয় যাই।

আমি তার মনের অবস্থা বুঝলাম-

-সিওর খালাম্মা, কোনো অসুবিধা নেই।

সেদিন এয়ারপোর্ট থেকে খালাম্মা, সাবিহা ও সুমনকে তাদের বাড়িতে নামিয়ে দেবার পর, অনেকদিন আর তাদের কোনো খবর নেওয়া হয়নি। প্রতি সপ্তায় সপ্তায় খবর নিবো বলে সুজনেকে যে ওয়াদা করেছিলাম, আমার পক্ষে তা রাখা সম্ভব হয়নি। একদিন সাবিহা কলেজে যাবার সময় রিক্সা থামিয়ে বললো, ”ভাইয়া বাসায় আসবেন, আম্মা যেতে বলেছেন”। ”আচ্ছা যাবো” বলেই আমি সেইদিন বিকালে অপরাধবোধ নিয়ে সুজনদের বাসায় গেলাম। খালাম্মার অনেক অভিযোগ আর সাবিহা’র অভিমান দেখলাম, সাথে সুমনের অবাধ্যতা। একসময় খালাম্মা সুজনের একটা নাম্বার দিয়ে বললেন, ”এইটা দিয়ে সুজনের সাথে কথা বইলো, নাম্বারটা তোমাকে দিতে বলেছিল।” আমি অনেক খুশি হয়ে নাম্বারটা লিখে সেদিনের মত বিদায় নিলাম।

সুজনের সাথে মাঝে মাঝেই আমার কথা হয়। দৈনন্দিন কাজের চাপে  নিজেকে যখন খুব একা  লাগে, অথবা এই অবাধ্য মনটা যখন নিজের অজান্তেই চলে যায় প্রশস্থ দুপুরের কোনো এক কৈশোরীক উদ্যানে। তখনি ফোন দেই, আমার সকল ভালমন্দ কাজের এক মাত্র সাক্ষী সুজনকে। কথার মাঝে মাঝে জেনে নেই অনেক কথা।
মনটা আরো বিষন্ন হয়ে যায়, যখন শুনি এতদিনেও সে একটা ভালো চাকুরী পাচ্ছে না। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে লেখাপড়া শেষ করেও, বিদেশের কোনো এক পেট্রোল পাম্পে দাঁড়িয়ে তাকে গাড়ী মুছতে হয়। তখন চোখের সামনে ভেসে উঠে ভার্সিটির উত্তাল দিন গুলির একটি প্রতিবাদি মুখ। কানে ভেসে আসে একটি সিংগারা আর দুই গ্লাস পানি দিয়ে দুপুরের লাঞ্চ করা সুজনের বজ্র কন্ঠে তুমুল শ্লোগান ” তোমার আমার অধিকার …বেঁচে থাকার অধিকার”।

আমাকে অনেকক্ষন চুপ চাপ থাকতে দেখে সুজন ফোনের ওপাড় থেকে প্রশ্ন করে,
-দোস্ত, তুই আছিস তো? কথা বলছিস না কেন?
-হ্যা আছি, তুই বল।
-দোস্ত, মা’য় কেমন আছে রে ? বাসায় ফোন করলে মা’য় শুধু কাঁন্দে। কোনো কথা বলতে পারি না। তুই কিন্তু মা’র খোঁজখবর নিস। সাবিহা আর সুমনকে দেখে রাখিস। আর শোন, আমি যে এখনো ভালো কাজ পাই নাই, আমি যে এখানে কস্টে আছি, এইসব কথা মা’কে বলিস না। এগুলো শুনে মা’য় অযথা চিন্তা করবে।
-ঠিক আছে, তুই এগুলো নিয়ে ভাবিস না। আমিতো আছি  এখানে। তুই মনদিয়ে কাজ কর আর দেখ, একটা ভালো কাজের ব্যবস্থা করতে পারিস কিনা।
-আসলে কি জানিস ? লেখাপড়া করেও বিদ্যাটাকে কোনো কাজে লাগাতে পারলাম না। আগে যদি জানতাম, পেট্রোল পাম্পে  তেল ভরতে হবে আর  প্রচন্ড শীতের মাঝে দাঁড়িয়ে গাড়ী মুছতে হবে, তাহলে বাপের পয়সা নস্ট করে লেখাপড়া শিখতাম না।
-শোন, তুই এগুলো নিয়ে মন খারাপ করছিস কেনো? লেখাপড়া কখনো বৃথা যায় না। ভিতরে যদি আগুন থাকে একদিন না একদিন দেখবি ধুঁয়া বের হবেই।
-তাই যেন হয় দোস্ত, দোয়া করিস।
তারপর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে, “আচ্ছা রাখি রে একটা গাড়ী এসেছে, তেল ভরতে হবে। পরে আবার কথা বলবো” বলেই সুজন ফোনটা কেটে দিলো। এরপর অনেকদিন আর কথা হয়ে উঠে না ওর সাথে।

খালাম্মার সাথে, সাবিহার সাথে,  রাস্তায় মাঝে মাঝেই দেখা হয়। একথা সেকথা বলার পর  বাসায় যেতে বলে। আমি যথারীতি ”আচ্ছা আসবো” বলে বিদায় নেই। কিন্তু আমার আর যাওয়া হয় না। সেদিন বিকালে হঠাত করেই সুজনের ফোন,

-হ্যাঁলো

-হ্যাঁ সুজন, কেমন আছিস তুই?

-দোস্ত ভালো আছি,  তুই ভালো আছিস তো?

-জানি না’রে। এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, ভালো আছি না খারাপ আছি সেইটাও ভেবে দেখার মত সময় পাচ্ছি না। কখনো যদি অবসর পাই তাহলে ভেবে দেখবো কেমন আছি। যাকগে বাদ দে, তোর কথা বল।

-হ্যা দোস্ত অনেক ভালো আছি। গত চার মাস হলো একটা ভালো কোম্পানীতে চাকরী পেয়েছি। মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানী, বুঝলি? সারা বিশ্বে ওদের ১৭০’টার মত ব্রাঞ্চ আছে। হেড অফিস আমেরিকাতে।

-বলিস কিরে? এতো অনেক সুখবর।

-হ্যা দোস্ত দোয়া করিস। তাছাড়া বাড়ি গাড়ী এমনকি তিন বেলায় খাওয়াও কোম্পানীর। আল্লাহ’র কাছে অনেক শুকরিয়া দোস্ত। বহুত কস্ট করে চাকরীটা পেয়েছি।

-শুনে খুব ভালো লাগলো রে। দোয়া করি আল্লাহ যেন তোর সহায় থাকেন।

– হ্যাঁ রে,  তোদের দোয়ায় হয়তো চাকরীটা পেয়েছি। আচ্ছা শোন,  আমি এখন একটু ব্যস্ত। তোকে পরে আবার ফোন দিবনে। তুই ভালো থাকিস।

-ঠিক আছে, তুইও ভালো থাকিস। আল্লাহ হাফেজ।

আজ ১৫’ই ডিসেম্বর। অফিস থেকে বের হয়ে খিলগাঁও ঘুরে কারওয়ান বাজারে এসেছি। দুপুরে গিন্নী ফোন করে জানিয়েছে, দেশী মুরগীর বাঁচ্চা আর নতুন আলু নিতে হবে। নতুন আলু দিয়ে দেশী মূরগীর ঝোল আর পাতলা খিচুড়ী রান্না হবে কাল। আমি বোকার মত প্রশ্ন করলাম, ‘কেনো?’ ফোনের ওপাশ থেকে ঝাঁঝাঁলো কন্ঠে ভেসে এলো “তুমি দেখছি আজ কাল সবকিছুই ভুলে যাও। কাল ১৬’ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস, একটু ভালোমন্দ রান্না করতে হবে না? সে কথাও কি তোমাকে মনে করিয়ে দিতে হবে?”

আমি কথা না বলে ফোনটা রেখে দিলাম। আসলেওতো তাই। গিফট কেনার ভয়ে বিবাহ বার্ষিকী কিংবা বউ’এর জন্ম দিনের কথা ভুলে যাওয়া যায়। কিন্তু তাই বলে বিজয় দিবসের মত একটা মহান দিবসের কথা ভুলে যাওয়াটা কি ঠিক? না, না এইটা ঘোর অন্যায়। কিন্তু মনে রেখেই’বা কি হবে?

যে লক্ষ্যকে সামনে রেখে, যে স্বপ্ন নিয়ে এই দেশটাকে স্বাধীন করা হয়েছিল। এই দিনটিকে মনে রেখে, আমরা কি সেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বপ্ন আজো পুরণ করতে পেরেছি? আমরাতো এ’ও জানি না, কী ছিলো সেই সাড়ে সাতকোটি মানুষের স্বপ্ন? তাহলে কেনো বছরের এই একটি দিনে, আমাদেরকে নটংগী’দের মত সং সেজে  দেশপ্রেমিকের অভিনয় করতে হবে? শুধু কি মূরগীর ঝোল দিয়ে খিচুড়ী খাওয়ার জন্যে? নাকি গলি’তে গলি’তে গরু জবাই করে, “এইবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম” অথবা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ শোনার জন্যই আমরা মনে রাখি ১৬’ই ডিসেম্বরকে?   জানি না, হয়তো তাই হবে। মৃত্যুর পরে কোনো মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা হলে, জিজ্ঞাস করে জেনে নিব তাঁদের স্বপ্নের কথা। জীবিতদের জিজ্ঞাস করে লাভ নেই। এত বছরে তারা ভুলে গেছে সেই স্বপ্নের কথা। ৭১’এর স্বপ্ন এখন বৃ্দ্ধ মুক্তিবাহিনীর ঘোলাটে চোখে স্মৃতির ধুঁয়া। দিবালকের তন্দ্রা।

বাসায় এসে ফ্রেস হয়ে একটা চেয়ার’টেনে বারান্দায় বসলাম। মনমত বাজার পেয়ে, গিন্নী বখশিস হিসাবে এককাপ চা বানিয়ে দিয়ে গেছে। অফিস থেকে বাসায় ফিরলে এক কাপ চা অবশ্য সব সময় পাওয়া যায়। কিন্তু আজ দুধ ও চিনির সাথে মিশানো ভালবাসার মাত্রা’টা একটু বেশি। গরম চা’এর ধুঁয়ার সাথে মিশে উবে যাচ্ছে আমার সমস্তু দিনের ক্লান্তি। ঠিক তখনি একটা ভয়মিশ্রিত লজ্জায় মাথা নত করে  সুমন এসে দাঁড়ালো পাশে,

-ভাইয়া আম্মু আপনাকে আমাদের বাসায় যেতে বলেছেন।

আমি বুঝতে পারলাম সুমনের এই ভয় ও লজ্জার কারণ। গত কয়েকদিন আগে সুমনকে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কয়েকটি ছেলের সাথে সিগারেট টানতে দেখেছিলাম। হঠাত আমাকে দেখেই হাতের সিগারেট’টি লুকিয়ে মুখটা ঘুরিয়ে, রাস্তার দেয়ালের সাথে মিশে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল যে, যাতে আমার নজরে না পড়ে। আমিও তাকে দেখে না দেখার ভান করে চলে গেছি অন্যদিকে। হয়তো সে কথা এখনো সে ভুলতে পারেনি। আমি খুব স্বাভাবিক ভাবেই জানতে চাইলাম,

-কেনো রে, বাসায় কি কোনো অসুবিধা হয়েছে?

মাথা নত করেই সুমন জবাব দিলো,

-আমি বলতে পারব না ভাইয়া, আম্মা শুধু বললেন কি যেন জরুরী কথা আছে।

-ঠিক আছে তুই যা, আমি চা’টা খেয়ে আসছি।

যেতে বলার কথা শুনে সুমন হাপ ছেড়ে বাচঁলো। হেঁটে কিংবা দৌড়াঁয়ে নয়। চোখের পলকেই হাওয়ায় মিশে গেলো। সত্যি বড় অদ্ভুত মানুষের এই অপরাধবোধ।

সুজনদের বাসায় এসে দরজায় টোকা দিতে যাবো, ঠিক এমনি সময় নজর আটকে গেল পাশেই লাগানো কলিংবেল’এর চকচকে বাটনে। যা আগে কখনো ছিল না। ওটা’তে আলতো করে চাপ দিতেই ভিতর থেকে কেউ একজন বলে উঠলো “ওপেন দা ডোর প্লীজ, ওপেন দা ডোর প্লীজ”। অবাক হলেও আমি মনে মনে  বেশ হাসলাম, এ যেন দরজার বাহির থেকে আমি নিজেই বলছি “ওপেন দা ডোর প্লীজ, ওপেন দা ডোর প্লীজ”।

সাবিহা এসে দরজা খুলতেই আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেলো। মনে মনে ভাবলাম, “ব্যপারটা কি? সাবিহার চোখেমূখে এমন লজ্জার ঝিলিকতো আগে কখনো দেখিনি। আমাকে দেখে এমন লজ্জা পাওয়ারইবা কী হলো?” ভিতরে ডুকে বুঝলাম, সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া লেগেছে। পুরানো সোফার জায়গাটা দখল করে নিয়েছে নতুন চকচকে তিনসেট সবুজ ডিভ্যান। দেয়ালের সাথে পাল্লা দিয়ে ঝুলে আছে ৩২ ইঞ্চি এলসিডি।  সিলিং’এর সাথে লাগানো ছোট ছোট অদৃশ্য স্পীকারে ঝড় তুলেছে, কেনি রজারের কান্ট্রি মিউজিক।

জানালার নতূন পর্দা গুলি মৌসুমী বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে হেলেদুলে গাইছে দিনবদলের গান। সুজন সত্যি অনেক ভালো ছেলে। সে জানে মা ও ভাই-বোন’দের কি করে সুখে রাখতে হয়।

খালাম্মা একটি ট্রেতে করে কিছু নাস্তা নিয়ে রুমে ঢুকলেন,

-একি বাবা তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো কেন? বসো, ঐ খানটায় ঐ নতূন সোফাটায় বসো। তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে, তাই ডেকেছি।

আমি নরম ডিভ্যানে বসতে বসতে বললাম,

-অসুবিধা নেই খালাম্মা, আপনি বলুন।

-শোনো বাবা, সুজনের আব্বা নেই। সুজনও দেশের বাইরে। সংসারের সব কিছু একা আমাকেই সামলাতে হচ্ছে। তুমি হলে আমার ছেলের মত। তাই কথা গুলো তোমাকে বলছি। সাবিহার জন্য একটা ভালো সমন্ধ এসেছে। ছেলে বিদেশে থাকে। তার আব্বা-আম্মা আজ সাবিহাকে দেখতে আসবে। আমি চাই, সে সময় তুমিও একটু থাকবে।

-বলেন কী খালাম্মা, এতো অনেক সুখবর, অবশ্যই আমি থাকবো। সুজনকে কি ব্যাপারটা জানিয়েছেন?

-হ্যাঁ বাবা, জানিয়েছি। ও বলেছে, ছেলে ভালো হলে ওর কোনো অমত নেই।

-তাহলেতো ভালই। মেহমানরা কখন আসবে?

-ঘন্টা খানেকের ভিতর চলে আসবে বলেছে।

সেইদিন সাবিহাকে তার হবু শ্বশুরশাশুড়ির খুব পছন্দ হয়ে গেলো। খাওয়া-দাওয়া সেরে খোশগল্প করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরার পথে দেখি, মহল্লার ছেলেরা রাত জেগে ক্লাব সাজাচ্ছে। ভোর হলেই শুরু হবে বিজয়’এর আনন্দ। সময়ের বিকৃ্ত দাবীতে নতূন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ফুল ভলিয়্যুমে শুনছে হিন্দী গান। চারিদিকে উত্সব মুখর রাত। ওদেরকে দেখে আমি খুব বিপন্নবোধ করি। অস্তিত্ব সংকটে ভোগী। খুব দ্রুত পালটে যাচ্ছে এই চিরচেনা বাংলাদেশ’টার রং। কবি রুদ্রকে আমার খুব বলতে ইচ্ছে করে, তুমি শোনতে কি পাও, বাতাসে লাশের গন্ধ নয় বাংলার উত্তরাধীকার’দের অবক্ষয়?

আজ বিজয় দিবসের পরের দিন। অফিস থেকে গাড়ী পাঠালেও গাড়ীতে উঠতে ইচ্ছে হলো না। সকালের ঝিরি ঝিরি হিমেল হাওয়ায় এক অন্য রকম ভালো লাগার শিহরনে ডুবে আছে মন। এমন রমনীয় সকালটাকে গাড়ীর বন্ধ রুমে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হৃদয়হীনতার সামিল। তাই গাড়ী বিদায় দিয়ে রিক্সায় চেপে বসে যেতে যেতে দেখলাম, বিজয় দিবসের আমেজ একদিনেই শেষ হয়ে গেছে। গতকাল অলিগলিতে যেখানে ছিল পাড়ার উঠতি বয়সের ছেলেদের নাচা-নাচি। সেখানে আজ নেড়ি কুকুরের হাড্ডী নিয়ে কামড়া কামড়ি। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’ আর ‘নতূন বাংলাদেশ’ মিলেমিশে হারিয়ে গেছে দূর্গন্ধময় বাতাসের কুন্ডুলীগর্ভে। চারিদেকে কান পাতলেই শোনা যায় ছালহীন হায়েনার লালাক্ত হাসি, নেড়ী কুকুরের কুউ কুউ কান্না।

অফিসে এসেই সুজনের কথা মনে পরে গেলো। সাবিহার বিয়ের ব্যাপারে তার সাথে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। ছেলের বাপ মা তেমন কিছু চায়নি। শুধু আগামী দুই বছর বিদেশে ছেলের লেখা-পড়ার খরচটা চালিয়ে যেতে হবে। এই ব্যাপারে সুজন রাজি হলেই বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে যাবে। আমি অফিসের টেলিফোন থেকে সুজনকে ডায়াল করতেই, দরজা ঠেলে জিরাফের মত মাথা ঢুকিয়ে হাফিজ জানতে চায়,

-ছার, ছা দিমু?

আমি দাঁত কটমট করে বললাম,

-এইটা কি প্রতিদিন জিজ্ঞাস করতে হয় নাকি? তোকে না একদিন বলেছি, অফিসে আসার সাথে সাথেই এক কাপ চা দিয়ে যাবি।

সকাল সকাল ধমক খেয়ে হাফিজ মাথা নত করে জবাব দেয়

-ছার, আপনেতো ছা বেশি খান না। কাপের ছা কাপৈ ঠান্ডা হইয়া যায়। বড় ছারে কইছে ছিনির দাম অনেক বাইড়া গেছে, হেইল্লিগ্যা জিগাইলাম।

-থাক তোকে আর চিনির দাম নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই এক কাপ চা নিয়ে আয় আর শোন, সাথে এক গ্লাস পানি নিয়ে আসিস।

-জে আইচ্ছা।

হাফিজ চলে যেতেই আমি সুজনকে ডায়াল করলাম,

-হ্যালো সুজন ?

-হ্যা দোস্ত, বল।

-কিরে কেমন আছিস তুই?

-ভালো রে, তুই কেমন আছিস?

-হ্যা আমিও ভালো আছি। শোন, আমি গত পরশু তোদের বাসায় গিয়েছিলাম। সাবিহাকে দেখতে এসেছিল, তুই কি কিছু জানিস এই সব ব্যাপারে?

-হ্যা জানি। মা কয়েক দিন আগে ফোন করেছিলো।

– ওদের তো সাবিহাকে পছন্দ হয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, ওরা আগামী দুই বছরের জন্য  বিদেশে ছেলের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নিতে আবদার করছে।

আমি ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ পেলাম না, শুধু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া।

-কিরে চুপ করে আছিস কেনো? কিছু একটা বল। তুই রাজি হলে ওরা বলেছে দিন তারিখ পাকা করে ফেলবে। ছেলের ছবি দেখলাম, দেখতে শুনতে ভালোই মনে হলো। এখন তোর উপরই নির্ভর করছে সব। হ্যালো…হ্যালো…… সুজন তুই কি আমার কথা শোনতে পাচ্ছিস?

-হ্যা, আমি শুনছি।

-কি হয়েছে তোর? এমন ভাব’লেশ হীন হয়ে আছিস কেনো?

-না তেমন কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি।

-শোন, তোর ন্যাকামী শোনার সময় নেই। আমি অফিস থেকে ফোন করেছি, কি হয়েছে তোর, সত্যি করে বল আমাকে।

– দোস্ত একটা প্রবলেমে পরে গেছি আমি।

-কি প্রবলেম?

-তুইতো জানিস, অন্যায়কে সারা জীবন ঘৃ্না করে এসেছি। ছাত্র জীবনটাই কেটেছে ন্যায়ের স্বপক্ষে লড়াই করে। সেই আমাকেই যদি দুইটা পয়সার জন্য অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে চলতে হয়, তাহলে আর নিজের অস্তিত্ব থাকলো কোথায়, বল?

–আহ, কি হয়েছে খুলে বল তো? আমি তোর কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না।

– শোন, গতকাল ১৬’ই ডিসেম্বর ছিল, আমাদের বিজয় দিবস। তুইতো জানিস, আমি যে কোম্পানীতে কাজ করি সেইটা হলো একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানী। এখানে ইন্ডিয়ান, বাংগালী, পাকিস্তানী সহ বিশ্বের অনেক দেশের লোক একসাথে কাজ করে। কম্পানীর নিয়ম হলো, প্রত্যেক দেশের বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে কোম্পানীর পক্ষ থেকে একটা অনুস্ঠানের আয়োজন করা হয়।

– বলিস কিরে, এতো দেখছি অনেক ভালো কোম্পানী।

-হ্যা দোস্ত, কোম্পানীটা অনেক ভালো। বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষে সারাদিন বাবুর্চী দিয়ে বাংলাদেশের সমস্ত স্পেশাল মেন্যু রান্না করা হলো। বিকালে আমি ব্যাংকোয়েট হল’এ প্রজেক্টরের মাধ্যমে ৭১’এর ডকুমেন্টারী দেখালাম। দেখলাম অনেক বিদেশীরা আগ্রহ নিয়ে অনেক কিছু জানতে চাইছে। কোম্পানীতে আমরা যারা বাংলাদেশী ছিলাম, তাদের মাঝ থেকে কয়েক জন মিলে গাইড দিয়ে বিদেশীদের নিয়ে গেলাম ৭১’এর বাংলার আনাচে কানাচে। তারা শিহরে উঠতে লাগলো পাকিদের নৃশংসতা দেখে। এমন সময় কেউ একজন স্পীকারে ঘোষনা দিলো, কোম্পানীর জি.এম. সাহেব এখন বাংলাদেশের বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে কেক কাটবেন।

সব স্টা্ফ’রা গিয়ে জড়ো হলো কেকের চারিপাশে। আমার কাছে মনে হলো, সাজানো গোল টেবিলের উপর বাংলার পতাকা সাদৃশ্য ৩৮ পাউন্ডের কেকটি যেন কেক নয়। এ-যেনো টেবিলের উপর শুয়ে আছে, কলাপাতা রঙ এর শাড়ীর সাথে লাল ব্লাউজ পরিহিতা আমার মা। তার’ই সামনে জি.এম. সাহেব কেক কাটার একটা ছুরি হাতে নিয়ে মুচকি মুচকি হাসছেন। সেই হাসিতে আমি দিব্য চোখে দেখতে পেলাম ইয়াহিয়া, টিক্কাখান, ভুট্টো আর গোলাম আজমের কেলানো দাঁত। একের ভিতর অনেক হয়ে তারা যেন এক্ষুনি ছু্রি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে দিবে আমার মা’য়ের বুক। তাই আমি বাঁধা দিলাম। জি.এম. এর হাত থেকে ছুরিটা থাবা দিয়ে নিয়ে বললাম, “জি. এম. কে দিয়ে কেক কাটানো যাবে না। আমাদের বিজয়ের কেক আমরা নিজেরাই কাটবো’’। আমার কথা কেউ শুনলো না। সবাই আমাকে জোর করে থামিয়ে দিয়ে বললো, “প্রতিবছর কম্পানীর জি, এম’কে দিয়েই কেক কাটানো হয়” এইটাই নাকি কোম্পানীর নিয়ম। আমি এই নিয়ম মানি না। একজন পাকিস্তানী জি, এম’এর বদলে একজন সোমালিয়ান ক্লিনারকে দিয়ে কেক কাটালেও আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমার এই কথায় কেউ কান দিলো না। এমনকি আমার বাংগালী ভাইয়েরাও আমার মনের কথা বুঝলো না।

-তারপর?

-তারপর আমি দেখলাম, আমার চোখের সামনেই ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী এক পাকিস্তানী জি.এম. চকচকে ছুরি দিয়ে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে আমার লাল-সবুজের পতাকা। আর পাশে গোল হয়ে দাঁড়ানো সারা বিশ্ব হাতে তালি দিয়ে উল্লাসে দেখছে সেই দৃশ্য। তাদের উল্লাস আমার কানে ভেসে আসতে লাগলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর্তচীত্কার হয়ে। সেই চীত্কার, সেই আর্তনাদ আমাকে উন্মাদ করে দিলো। আমি দৌড়াঁয়ে গিয়ে সমস্ত কেক’এ থুঁ থুঁ ছিটিয়ে দিয়ে বললাম, “এই সেই হানাদার, এই সেই নর-জল্লাদ। যারা আমার ত্রিশ লক্ষ নিরীহ ভাইবোনের রক্ত দিয়ে গোসল করেছে। এই জল্লাদের কাটা কেক খেয়ে আমরা আমাদের স্বাধীনতার অপমান করতে পারি না”।

আমার কথা শুনে টেবিলের চারিপাশে জড়ো হওয়া উল্লাসিত বিশ্ব স্তম্ভিত হয়ে গেলো। পাকিস্তানী জি.এম. রক্ত চোখে কি জানি বিড়বিড় করতে করতে আমাকে দেখলো। রাগে ক্ষোভে উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর কাঁপতে থাকে। সবাইকে দেখলাম ব্যাকংকোয়েট হল থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ ৭১’এর অগ্নিঝরা দিনগুলি প্রখর হয়ে জ্বালিয়ে দিতে চায় আমার দুই চোখ। আমি আর কিছু দেখতে পাই না। সামনে শুধুই লেলিহান শিখা।

-বলিস কিরে? এত কস্ট করার পর ভালো একটা চাকরী পেলি, আর তুই কিনা সেই চাকরীটাকে………। তোর কি একবারও খালাম্মা সাবিহা, সুমনের কথা মনে হলো না? তাছাড়া সাবিহার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। এই সময় পাগলামী করাটা কি ঠিক হলো তোর?

-দোস্ত, আমাকে কোনো প্রশ্ন করিস না। আমি আমার সংসারের জন্য ত্রিশলক্ষ শহিদের রক্ত খেতে পারবো না। দু’বেলা দু’মুঠো খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার জন্য আর কতো আপোষ করবো বল? আপোষ করছি বলেইতো মুজাহিদের মত কুত্তার ছাও বলে, “এই দেশে কোনো মুক্তিযুদ্ধ হয়নি”। আপোষ করছি বলেইতো নিজামী গং’রা সংসদে বসে। আপোষ করছি বলেইতো রাজাকার’রা মুক্তিযোদ্ধার পিঠে লাথি মারে। আর কতোটা আপোষ করতে বলিস, বল? আপোষ করতে করতে আর কতটা বিকায়ে দিবো নিজেকে বলতে পারিস? বলতে পারিস, কতোটা আপোষ করলে জাতি হয় নির্লজ্জ? একটা কথা জেনে রাখিস, প্রতিবাদ করতে পারি বলেই মনে হয় আজও বেঁচে আছি। যেদিন প্রতিবাদ করতে পারবো না, সেদিন ধরে নিস,  আমি নই। আমার দেহটা শুধু নড়েচড়ে।

– আহা অমন করে বলছিস কেন? তোকে’তো আমি জানি। কিন্তু আমি ভাবছি খালাম্মার কথা। সারা জীবন কস্ট করেছেন তিনি। কিছু দিন হলো সবে মাত্র সুখে্র মুখ দেখতে শুরু করেছেন। সাবিহাকেও দেখলাম ছেলে্র ছবি দেখে মোটামুটি সে খুসি’ই হয়েছে। ঠিক এই মূহুর্তে এমন একটা কান্ড ঘটে গেলো। বাসায় শুনলে খালাম্মার অবস্থাটা কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস।

এক অসহনীয় যন্ত্রনায় কুঁকড়ে যাচ্ছে আমার সমস্ত অনুভুতি। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে ট্রে হাতে খালাম্মার হাসি মাখা সুখি মূখ। লজ্জা মিশানো নতুন স্বপ্নে বিভোর সাবিহার লাজুক দুটি চোখ। তবু চীত্কার করে বলতে ইচ্ছে করছে, শোনো হে ত্রিশ লক্ষ বীরসেনানি, তোমাদের রক্তকে আমরা বৃথা যেতে দেইনি। চেয়ে দেখো, আজও সুজনরা গেরিলা যুদ্ধ করে যাচ্ছে তোমাদের পথে।

অনেকক্ষন ধরেই ওপাশ থেকে ইথারে লম্বা নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শুনতে পেলাম না। হৃদয়ে্র কান দিয়ে বুঝে নিলাম সুজনের নিরব কান্নার আওয়াজ। রত্নপ্রভা উন্নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা গুমোট পাহাড়কে ধাক্কা দিয়ে জানতে চাইলাম “সুজন, তুই কি আমার কথা শুনছিস?”

আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেলেও, প্রতিউত্তরে পেলাম আরেটি প্রশ্ন। যার উত্তর আমার জানা নেই। লাল রক্তের বিনিময়ে যারা জয় করেছিল সবুজকে, তারাও পারবে কিনা জানি না এর উত্তর দিতে। বিক্ষুব্ধ কন্ঠে সুজন শুধালো,

-দোস্ত, আমার চাকরী’টা থাকবে তো?

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


8 Responses to কেক বাংলাদেশ

You must be logged in to post a comment Login