রাবেয়া রব্বানি

গ্রহন লাগা মানুষ………

Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

গ্রহন লাগা মানুষ’

(১)

-হারামজাদা!লুলা অইছছ তবু শরম অইছে না?ইট্টু জিরাইতাম বইছি আর লগে লগে আইয়া ঘেসা দিয়ালছস’

-লুলা তো আমি নিজে অইছি না, আল্লায় বানাইছে। আর সব বেডামানুষ বইলে খেতি নাই? আমি লুলা অইলেও বেডা তো। কথাগুলো সবগুলো দাত বের করে বলল শুক্কুর আলি। তার কথায় মুখ ঝামটা মেরে চুড়িওয়ালি লতিফা তেড়ে উঠে বলল,

-ঊহ!বেডা আইয়া পরছে।যাহ কইলাম এহানতে।লুলা পুরুষের ভাত লইতফার কাছে নাই।লতিফা গজগজ করতে করতে সরে বসল। আধ খোলা খোপা খুলে আবার দ্রুত গতিতে পেচিয়ে আরো উচুতে তুলল যেন উচু খোপাটা তার ক্ষমতা, অনীহা আর শক্তির প্রকাশ।শুক্কুর আলি তবু হাসি হাসি মুখে চেয়ে থাকে তার দিকে, লতিফার ছিপছিপে শরীরে প্যাচানো ছাপা শাড়ী,উচু হয়ে থাকা নাকের ফুল সবই তার কাছে দর্শনীয় লাগছে   । সে হাতে ভর দিয়ে আবার একটু এগিয়ে গিয়ে লতিফার পাশে বসল,

-হ ঠিহই কইছছ কতাডা। ঠ্যাং থাকলে তোর মত চাইরটা বান্দী দিয়া ঠ্যাং টিফাইতাম।কি সুখ অইত ক দেহি।

-লুলার গরে লুলা আমারে হস্তা পাইয়ালছস? তর কতা হুনবাম বইছি?কিছু করনের ক্ষেমতা নাই কতা কইয়া আউশ মিডাছ?দাড়া! আছকা তোরে মাইর খাওয়াইবাম। কথাটা বলে লতিফা উঠে দাঁড়িয়ে দুরে দাঁড়ানো মানুষদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে।শুক্কুর আলি একটা বিকৃত হাসি দিয়ে ঘুরে যায়, রাস্তা ত্থেকে হাতের উপর ভর দিয়ে দ্রুত নামতে থাকে ঘাটের পাড়ের দিকে। মেয়েমানুষের ঠিক নাই এরা কখন কি করে,  এই ভেবে শুক্কুর তাড়াতাড়ি একটা পারাপারের নৌকা ধরতে চায় । তবে মেয়েমানুষের কথায় তার কোন কষ্ট বা কোন লজ্জাই হয় না ইদানিং।ইদানিং এদের আর মানুষই মনে হয় না তার।দুর্ভিক্ষের সময় এক থাল গরম ভাত তা যে ঘরেরই হোক, যে চালেরই হোক বা মরা -কাকর সহই হোক মানুষ তার দিকে যেভাবে এগোয়, শুক্কুর আলিও মেয়েমানুষ দেখলে সেভাবেই এগোয় । জীবনে তার বিয়ে হবে বলেও মনে হয় না আর তাই যেমনভাবেই হোক দেখে হো্‌ক, ছুয়ে হোক, মাঝে মাঝে কুতসিত কথা বলে হোক, যেভাবে যতটা আনন্দ পাওয়া যায় সে তাই ভোগ করতে চায় এখন।

শুক্কুর ঘাটে নেমে  কাছের এক মাঝিকে হাত ইশারায় ডাকল।তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা মাঝি এগিয়ে এল,

-গন্না শুক্কুর যাইবে?তয় টেহা না দিলে নৌকাত নিয়াম না।

-টেহা আছে।শুক্কুর উত্তর দিল।

(২)

গ্রামে সবাই তাকে গন্না শুক্কুর নামেই ডাকে। গ্রহন শব্দটাকে এখানে আঞ্চলিক ভাবে বলা হয় গন্না। চন্দ্রগ্রহনের দোষে মায়ের পেটেই তার পা দৈত্য খেয়ে ফেলেছে বলে স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস তাই ছোট থেকেই তার নাম শুক্কুর থেকে হয় গন্নায় খাওয়া শুক্কুর পরে নাম আরো ছোট হয়ে হয় গন্না শুক্কুর।

শুক্কুর আলি। এক নামে গন্না শুক্কুর, বয়স ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশের মাঝামাঝি। পরনে মলিন পাঞ্জাবি যার আসল রংটা কি ছিল এখন আর বুঝা যায় না ঠিক।একটা লুঙ্গি অভিনব উপায়ে হাটু পর্যন্ত গুটানো যাতে হাতে ভর দিয়ে চলার সময় সামলাতে কষ্ট না হয়।মাথায় একটা গোল টুপি। কুচকুচে কালো দাড়ি গোফে মুখ ঢাকা। সব মলিনতার মধ্যে চকচকে আর কিছুই অবশিষ্ঠ নেই এখন। দীর্ঘদিন হাতে ভর দিয়ে চলতে চলতে তার শারীরিক কাঠামোর মধ্যে হাতের তালু আর কাধের গঠনেরও বেশ কিছু পরিবর্তন হয়েছে, পিঠটা আর সোজা নেই অনেকটা কুজ়ো হয়ে গেছে।

শুক্কুর বসে আছে তার পাশের গ্রামের এক মাজারে। আশেপাশের মানুষ মাজারটাকে জাগ্রত হিসাবে মানে।এখানে শুক্র-শনি বার মানুষের বেশ ভীর থাকে।সে এখানে এসেছে নামাজের পাটি বিক্রি করতে তাদের গ্রামের হাটে এখন আর তার বোনা পাটি চলেনা।হঠাৎ রটে গিয়েছিল তার পাটিতে দোষ আছে আর কেউ কেউ নিলেও দাম ছাড়াই নিয়ে যেত বলত পরে দিব, কেউ বলত দিব না কি করবি?কোন প্রমান থাকত না। বিচার আচারেও তেমন লাভ হত না।তাই একটূ দূর হলেও এখানে আসে সে।এখনেও বেচা তেমন হয় না বল্লেই চলে। মাজারে মানুষের আনাগোনা  কম থাকলে বসে থাকা ছাড়া আর করার কিছুই থাকেনা তার।তখন শুক্কুর আলি ঝিমায় নাহয় পাশে একটা অন্ধ ভিখিরির সাথে একটা কম বয়সি মেয়ে আছে তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে কয়েকবার ইশারাও করেছে শুক্কুর কোন লাভ হয়নাই।মেয়েটি পাশের ছোট চায়ের দোকানের কামলা ছেলেটার সাথে হাসি ঠাট্টা করে,তাই এখন শুধু তাকিয়েই মন ভরে সে।

আজ মাজারে মানুষও কম আর রোদের তেজও বেশি।শুক্কুর বার বার ঢোক গিলছে।একটা প্রাইভেট কার দিয়ে কিছু লোক নামল, তাদের মধ্যে একজন সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লোক যার কোলে একটা দুই তিন বছরের শিশু তার দিকে চোখ যায় শুক্কুরের। সে একটু গুছিয়ে বসে।লোকটা তার পাশ দিয়ে যেতে থাকলে, শুক্কুর এগিয়ে অনেকটা তার সামনে চলে গিয়ে বলল,

-চাছা, একটা নামাজের পাটি নিন যে।খুব ভাল বুনান।মাত্র বিশ টেহা।

লোকটা হাত দিয়ে ইশারা দিয়ে তাকে সরে যেতে বলে।পাশের লোকগুলোও ধমকে উঠে।শুক্কুরের মনের বিষ সবসময়ের মত এবারো মুখে চলে আসে।সে বলতে থাকে,

-টেহা কি আন্নেরার কম আছে। একটা পাডি নিলে কিতা অইব?নমাজ পড়তে তো লাগেই।না কিনলে না কিনবাইন ধমকান কেরে?

সাথের লোকগুলা তেড়ে আসতে চায়। কিন্তু বৃদ্ধ তাদের থামিয়ে শুক্কুরের কাছে এসে তাকে বিশ টাকার একটা নোট ছুড়ে দেয়।শুক্কুর খুশি হয় সে দাম একটু বাড়িয়েই বলেছিল।কিন্তু লোকটা টাকা দিয়েই মাজারের ভিতর চলে যেতে থাকলে শুক্কুর বলে উঠল,

-চাছা পাডিডা নিন যে?লোকটা যেতে যেতে ইশারায় বলল লাগবে না।

শুক্কুর টাকাটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল টাকাটা যে ভিক্ষা তা বেশ সময় লাগছে বুঝতে তার, তারপর কিছু সময় চকচকে বিশটাকার নোটটা পাটিগুলোর পাশেই পড়ে থাকল।হাল্কা বাতাসে পাতলা কাগজের নোটটা একটূ একটূ করে  দূরে সরে যেতে থাকল, আস্তে আস্তে টাকাটা আরো একটু বেশি দুরে চলে গেলো।ঢোক গিলার দুর্দান্ত চেষ্টায়  সে তার খরা জীব শেষবারের মত খুব কষ্ট করে লালায় ভেজাল। তার মনে হল এর পরের বার আর ঢোক গেলা সম্ভব হবে না, সে সামনের চায়ের দোকানটার দিকে তাকালো আর বাতাসের ধাক্কায় কখনো অল্প পেছনে, কখনো ডীগবাজি খাওয়ার মত কখনো গোত্তা খেয়ে দূরে সরতে ব্যস্ত টাকাটাও ভিক্ষা না হয়ে হঠাৎ তার চোখে টাকাই হয়ে উঠল বেশি। শুক্কুর এক হাতে ভর দিয়ে আর এক হাতে একটু এগিয়ে তা খপ করে ধরে ফেলল।

(৩)

শুক্কুর আলি খেতে বসেছে। তার ভাবি নসিমন ভাত বেড়ে দিচ্ছে। সে তার ভাবির দিকে বেশি তাকায় না। না তাকিয়েই বলল,

-আর কট্টি ভাত দিন যে।

-তুমি ভাত ইড্ডু বেশি খাও।ভ্রু কুচকে বলল নসিমন। তার চোখে মুখে বিরক্তি।পাশের গ্রাম থেকে এতটা পথ আসতে আসতে শুক্কুরের খিদে ও মেজাজ দুই চড়া।প্রথমে তার চোয়াল শক্ত হয় তারপর বড় একটা শ্বাস নিয়ে সে হেসে দিয়ে বলল,

-কতা ঠিহি কইছুন।বাহের ক্ষেতের ধান যত ইচ্ছা তত খাইবাম।

-ইড্ডা কেমুন কতা,আমি কি খোডা দিছি? শইল ভারী অইলে আতে ভর দিয়া চলতে পেরেষানি অইব না? নসিমন হাতের খুন্তি উচু করে বলে।তার গলার স্বরও চড়া হয়।কিন্তু শুক্কুরের চেহারা ও কন্ঠ দুটোই আরো শান্ত হল। সে আরো ঠান্ডা গলায় বলল,

-খোডা দেওনেরও আন্নে কেঊনা।

-লুলা লেংরারে ভাত বাইরা খাওয়াই এইডা ভূল অইছে।নসিমনের গলার স্বর এবার বাড়ীর সীমানা পেড়োয়।

-বাইরা খাওয়াইন যাতে বেশি না খাইতাম পারি,।কথাটা বলে শুক্কুর নিজেই একটু এগিয়ে  পাতিল থেকে ভাত নিয়ে নিল।

-কি কলি? তর ভাই আহুক।বিছার কিবা না করে দেখবাম ।এই সংসারে আমি না তুই থাওস।

শুক্কুরের মা আমেনা পুকুরে গোসল করতে গিয়েছিল।সে দূর থেকেই নসিমনের জোড় গলা শুনে দৌড়ে আসল,

-কি অইছে? আমেনার কন্ঠে উৎকন্ঠা।

অগ্রাহায়ন মাসের চলন্ত বাতাসে তার বৃদ্বা ভেজা শরীর একটু একটূ কাপছে। নসিমন তার ফিরিস্তি গাইতে থাকে। আমেনা তার ছেলের বউ আর শুক্কুর দুইজনকেই চিনে। সে ধপ করে বসে পড়ে ঘরের পীড়ায়। অনেকদিন ধরেই নসিমন আলাদা হওয়ার জন্য সাদেক কে উস্কাচ্ছে কিন্তু আমেনা নসিমনের হাত পা দুইয়ে চলছিল। কিন্তু আজ নসিমন ছুতো পেয়ে গেলো বোধহয় বলে মনে হয় আমেনার। ভিটেটা তার স্বামিরই করা, ধানী জমি গুলাও। কিন্তু স্বামি মারা যায় ছেলে দুটো ছোট থাকতেই। বিধবা আমেনা সংসারের সচ্ছলতা ধরে রাখতে পারেনি।কিছু ধানী জমি ছাড়া যা সম্পত্তি ছিল তা অনেক আগেই বিক্রি করে দিয়ে দুই ছেলেকে আলাদা ব্যবসা দিয়ে দিয়েছিলো সে। সাদেকই একটু কুলিয়ে উঠতে পেরেছে।শুক্কুর তার মাছের ব্যবসার পুরোটাই ডুবিয়েছে অনেক আগেই।এখন কয়েক ভিগা জমি থেকে শুধু যে ধান আসে তা দিয়ে বছরও পেড়োয় না বাকি সব খরচ সাদেককেই বহন করতে হয়।শুক্কুর ঘরে বসে বসে যে পাটি বুনে তাও হাটবারে তেমন বিক্রি হয়না। পুরোটা সংসার একরকম সাদেকই টানে।সাদেক তার মার ব্যাপারে দুর্বল হলেও শুক্কুরকে সহ্য করতে পারেনা ইদানিং।শুক্কুরও যেন সেই তালে ভাইকে ক্ষেপিয়ে মজা পায় আর সাদেকও উত্তেজিত হয়ে তাকে লাঠিপেটা করে। আজ মনে হয় তেমনই একটা দিন ভেবে আমেনার বুক মোচড় দিয়ে উঠল।

নসিমন শুক্কুরকে গালাগাল করে ছেলে নিয়ে তার ঘরে চলে যায়।আমেনা আধ ভেজা শরীর নিয়ে উঠি উঠি করেও উঠেনা। তার মনে হয় তার শরীরটা যেন অনেক ভারী। জন্মপঙ্গু শুক্কুরকে জন্ম দেওয়ার পরও কখনো তার মনে হয়নি সে সন্তান প্রসব করেছে। পঙ্গু সন্তানের দুঃচিন্তার ভারী বোধ তাকে আজও অন্তঃসত্তা করে রেখেছে। তাছাড়া শুক্কুরের পঙ্গুত্বের জন্য সে নিজেকেই দায়ী মনে করে। চন্দ্রগ্রহনের রাতে শুকুরের বাপ সখ করে একটা হাস এনেছিল। তখন শুক্কুর পেটে, সে দোনামোনা করেও হাসটা কেটে ফেলেছিল।তাই দেওএর নজরে পড়ে শুক্কুরের আজ এই দশা বলে গ্রামের সবার ধারনা।আমেনাও নিজেকেই দায়ী ভাবে তাই। এবং শুক্কুরের চিন্তায় সে আজও অভ্যস্ত  হতে পারেনি  বরং একটি অচল শিশুর প্রতি একটি মায়ের যেমন অনুভুতি থাকে আমেনার বুক এখনও শুকুরের চিন্তায় তেমন ধড়ফড় করে। কিন্তু শুক্কুরকে দেখলে মনে হয় তার কোন চিন্তাই নাই।দিন দিন সে আরো বেপড়োয়া হয়ে উঠেছে ,বহুদিন হয়ে গেলো তাকে কষ্ট পেতে দেখেনি আমেনা। তবে কিশোর বয়সে সে এমন ছিলনা ,তখন সপ্ন দেখতো শুক্কুর। দুপুরের পর তার মার সাথে বসে গীত গাইত সে, বাবার কথা জানতে চাইত ,কেউ বকাঝকা দিলে লজ্জা পেত, লুকিয়ে কাদত।মাঝে মাঝে বলত, মা তুই দোয়া করিস যে আমি ব্যবসা কইরা অনেক বড়লোক অইবাম।

ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পরেছে আমেনা। হঠাত ছেলের ডাকে ফিরে তাকাল সে,

-অই মা ভিজা শইল্লে বইয়া রইছস কেরে?

মনে মনে উদ্ভিগ্ন হলেও মুখ ঝামটা মেরে বলল আমেনা, পিছামাড়া কি করবাম? পেডে থাকত দেউ যে তোর পাও না খাইয়া আমারে খাইয়াল্‌ল না কেরে ইড্ডা বুঝলাম না?

শুক্কুর খেক খেক করে হাসে।লুঙ্গির প্যাচ থেকে একটা বিড়ি বের করে হাতে ভর দিয়ে এগিয়ে চুলার নিভু নিভু কয়লায় ধরে রাখল কিছুক্ষন জ্বলে উঠল নিকোটিন সরঞ্জাম। আমেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল,

-রোজ রোজ বিড়ি খাছ টেহা পাছ কই?

শুক্কুর আরাম করে ধোয়া ছাড়ল কিছু বলল না।

(৪)

-তুমিই বুঝি গন্না শুক্কুর?আগন্তুকের কথায় ফিরে তাকাল শুক্কুর

-হ, আমিই। কেরে কি দরহার?

-দেহি তোমার পাওটা?

-আন্নে কইত্তে আইছুন?পাও দেইক্ষা কি করবাইন?শুক্করের কন্ঠে বিস্ময়।

-একটা প্রস্তাব নিয়া আইছি।বলে থেমে লোকটি সার্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে শুক্কুরের দিকে ধরে বলল,

-আরে মিয়া টাস্কি খাইয়া চাইয়া রইছ কে?বিয়ার প্রস্তাব আনি নাই। লউ সিগারেট খাও একটা।

শুক্কুর সিগারেট নিল না। লোকটা একের উপর অপরিচিত তার উপর তার ভাষা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে সে ভিনদেশি আবার তার পা দেখতে চাওয়া সব মিলিয়ে সে একটু দ্বিধাগ্রস্থ। লোকটি সিগারেটটি পাটিগুলোর ওপর রেখে নিজের সিগারেটটাতে কয়েকটা টান দিয়ে কাশতে থাকল তারপর গলা খাকড়ি দিয়ে বলল,

– এইভাবে কয়দিন আর। বেচাকিনা অয় নাকি?আমার লগে শহরে চল ভাল কামাইবা। কষ্ট ও কম লাগব  গাড়ী দিমু খালি বইয়া থাকবা হাত দিয়া চালাইবা দিনে আমারে কত দিবা এইডা পরে ঠীক করমুনে।অই মিয়া এমনে চাইয়া রইছ কে? ভিক্ষা করবা শহরে গিয়া?এইডা ভালা ব্যাবসা।

শুক্কুর কিছু বলল না। সব সময়ের মত মনের বিষ মুখে আসছে না তার।লোকটি আবার বলল,

দোয়া কালাম কিছু জানো?

শুক্কুর তবুও কিছু বলল না।তার হাত এলোমেলো দাড়ি একত্র করতে ব্যাস্ত।তার চোখ সামনের ভিখিরির মেয়েটির মেয়েটার দিকে।লোকটি শুক্কুরের চোখ অনুসরন করে মেয়েটিকে দেখে হাসল তারপর উঠতে উঠতে বলল,

-মাগনা শো দেহ?সামনের ওই যে চায়ের দোকানটাতেই স্বপন ভাইয়েরে দরকার কইলেই অইব ।আমি আর এক সপ্তাহ আছি।মন লইলে আইও।

শুক্কুর লোকটির চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ,তারপর সিগারেটটা হাতে নেয়,নাকে নিয়ে গন্ধ শুকে দেখে।মনে মন বলে,

সিগারেট আর বিড়ির ফারাক মেলা।সে দ্রত দোকানটাতে গিয়ে দোকানিকে বলল,

-ইট্টু আগুন দিবাইন?

(৫)

আমেনা চুলার সামনে বসে খড়ি ভাংছে। তার দক্ষ হাত মটমট করে ভেঙ্গে চলছে খড়ি। শুক্কুর এইমাত্র বাড়িতে ঢুকলো পিঠে একটা ব্যাগ তাতে নামাজের পাটি আর হাতে একটা সস্তার ক্রীম রোল।সে আমেনার কাছে এসে বলল,

-নে মা রুটী খা। আর আমারে ভাত দে।

আমেনা জিনিসটা হাতে নিয়ে খুশি হয়ে বলল,

-থাউক আমি খাইয়াম না সাদেহের পোলারে দিয়াম। টেহা পাস কই?তুই যট্টি পাডি লইয়া যাছ অট্টিই ফিরত আনছ তয় খরছা করছ কিবায়?

-থো তর সাদেকের পোলা খাইলে খা নাইলে আমারে দেলা আমি খাইয়াম।বলে হাত থেকে কেড়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি চিবোতে থাকে,টাকা কই পেল আই ব্যাপারে কিছুই বলল না। আমেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার মধ্যে মায়া দয়া আর কিছুই বাকি নাই।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-তুই মানুষরে ভালা পাস না। মানুষ তরে ভালা পাইব কিবায়?এহনো সংসার হইছে না আমি মইরাও কবরে তরপাইবাম। বলে সে চোখের কোণ শাড়ির আচলে মুছল।শুক্কুর হেসে বলল,

তর চক্ষে এহনও পানি আইয়ে মা।আমার আইয়ে না কেরে? আর সংসার অইতেও পারে, টেহা অইলেই সংসার অইব। মাইয়া মানুষ টেহার লালচি। সে দাত বের করে হাসল।শুক্কুরের হাসি বিকৃত কিন্ত্য তার মা বুঝতে পারে না। মার চোখে সন্তানের হাসি সব সময়ই সহজ ও সুন্দর।

পেছন থেকে টর্চ ফেলে ফেলে সাদেক আসছে। সে তার মা ও ভাইকে একসাথে দেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে হঠাৎ ঘুরে দাড়িয়ে শুক্কুরকে বলল,

-তুই বলে সোলেমানের মাইয়ারে খারাপ কতা কইছস?

-না মিছা কতা, ওইডা একটা নডী।

-আর তুই সাধু অইয়া পরছছ। তোর আতে কি? তুই প্রত্যেকদিনই বিড়ী খাছ নসিমন কইল?

শুক্কুর হাসল।হেসে হেসে বলল

-আতে রুডি।আর বিড়ি খাই ,হ।

-টেহা পাছ কই?সংসারে তো একটা পয়সাও দেস না।

শুক্কুর আলি মুখের বাকি রুটিটা চিবোয় না পানি দিয়ে গিলে ফেলে।তারপর মুখটা আরো হাসি হাসি করে বলল,

-টেহা যে কট্টি পাই তা দিয়া এই সংসারের কুনো উপগার অইব না।

-মিছাকতা। আমার খরচায় খাইয়া পইড়া নিজের কামাই দিয়া ফুর্তি করছ।মাখন রূডী খাছ?হারামজাদা।

আমেনা ভাতের ঢাকনা খুলে নাড়া দিল।সে এমন ভাব করছে যেন ছেলেদের কথা শুনতে পাচ্ছে না।হঠাৎ প্রসংগ এড়াতে সাদেককে জিজ্ঞেস করে,

-সাদেক তুই ভাত খাবি এহন?

-তোর পুলারে খাওয়া।এমুন একটা দুইডা সংসারে থাকলে সংসারও লুলা অইয়া যাইব।সাদেকের চিৎকারে ঘর থেকে নসিমন ও তার ছেলেও বের হয়ে আসে, ছেলেটি ভয়ে তার মার শাড়ী ধরে আছে।

-তুমি হুদাই পেছাল পারতাছ।এইতান কামাই না আর আমার আতখরছা কিছু লাগে না। শুক্কুর এবার একটু রাগ করেই বলল,

-এহ্‌ পরের উপর খাইয়া আবার নিজের আতখরচ। হাত দুইড্ডা কাইট্টা লাইয়াম তাইলে আতখরছাও থাকবো না।হারামজাদা বিড়ি খায় ।আরো কিছু তিক্ত কথা বলে সাদেক ঘরের দিকে যেতে থাকে। নসিমন বারান্দার বাশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনছে আর মুখে আচল দিয়ে হাসছে। নসিমনের হাসি দেখে শুক্কুরের চোখ হঠাৎ জ্বলে উঠল। তার মনে বিষ জমতে থাকল, ঠোটে আবার সেই বিকৃত হাসিটা চলে আসল। সে নসিমনের দিকে চেয়ে একটু জোরেই বলল,

-ভাবি আরো হাসুইন।আন্নের কফাল আন্নের জামাইর ফাও আছে তাই হাতখরছার লগে ফায়ের খরছাও আছে। পা খরছা করতে নডি বাইতও যাওন লাগে।আন্নের জামাই নডিবাড়ির পিয়ারির কাষ্টমার।কথাটা বলে শুক্কুর খ্যাক খ্যাক করে হাসে।সাদেক ঘুরে দাঁড়ায় তার চোয়াল শক্ত হতে থাকে সে চিৎকার করে তার ক্ষমতা প্রকাশ করতে চায়,

– শুওরের বাচ্চা খাড়া তুই।

সাদেক ঘর থেকে বাশের লাঠিটা নিয়ে আসল ।শরীরের শক্তি দিয়ে পেটাতে থাকে শুক্কুরকে।প্রথমদিকে চুপ করে থাকলেও পরে ব্যাথায় চিতকার করতে থাকে সে।আমেনা তার ছেলেকে বাচানোর চেষ্টা করে কয়েকবার সাদেকের সাথে সে পেরে উঠে না তাই নসিমনের হাত পা ধরতে থাকে,

– আমার পোলারে বাছাও মা সাদেক অরে আজ মাইরালবো।

ভাতের পাতিল উপচিয়ে ভাত পড়তে থাকে।পানি পড়ে নিভে যায় উনুন।নসিমন তার শাশুরির কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। সে তার ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারে না কিছুতেই শুক্কুরের কথা তার কানে প্রতিধ্বনিত হতেই থাকছে কিন্তু কোন অর্থ খুজে পাচ্ছে না সে।আমেনা আবার গিয়ে সাদেকের পায়ে পড়ে কাদতে থাকে হুড়োহুড়িতে আমেনার গায়েও আঘাত লাগে।তারপর হুশ ফিরে সাদেকের। ছুড়ে ফেলে বাশট সাদেকের মায়ের দিকে ফিরে বলল,

-তুই এহানে কেরে? পোলার লেইজ্ঞা দরদের দিন শেষ।হুদা ভাত দিবি খাইত। আমার কামাই অর গলাত দিয়া যেমুন নামে না। সাদেক তার পায়ের স্যান্ডেলে অতিরিক্ত আওয়াজ করে আবার  বাড়ী থেকে বের হয়ে গেলো।

শুক্কুরের মুখ দিয়ে লালা পড়চ্ছে ।সে তার পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে তা মুছে ফেলতে চাচ্ছে।

(৬)

কাদতে কাদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল আমেনা তাই ঘাড় ঘুমের ভারী চোখ খুলতে কষ্ট হচ্ছে তার। শুক্কুর আর একবার ডাকল,

-অই মা। শুক্কুর পিঠে ব্যাগ আর কাধে পুটলি নিয়ে তৈ্রি। আমেনা ঘোলা চোখে দেখল তাকে ।ভাজ পড়া চামড়ায় আরো ভাজ ফেলল আমেনার বিস্ময়।এত সকালে তো শুক্কুর বেরোয় না।সে তার ছেলের কাছে এসে বসল, তার পিঠে হাত দিল। সে শরীর ঝারা দিয়ে তা সরিয়ে দিয়ে বলল,

-মা তুই থাক এহানেই তুই ফারতিনা।

-কি ফারতাম না, কই যাস?

-ভিক্ষা করবাম।

আমেনা ফ্যালফ্যালে চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে।তার বয়স্ক ঘোলা চোখ লবনাক্ত পানি জড়ো করতে থাকে দ্রুত ,

-ইড্ডা কি কছ?তর বাহে একজন ইমাম আছিল তরারে পাছ অয়াক্ত নামাজ শিহাইলাম ভিক্ষা করনের বাউ কইরালছস?তুই ফারতি না বাপ।যাইস না।তোর দুইড্ডা ফায় পড়ি।

-ফায়ে পড়বি কিবায় মা আমার ফাউই নাই। শক্কুর ঘুরে রওয়ানা দিল।

-তোর আল্লা রসুলের দোহাই। আমেনা শুক্কুরকে জড়িয়ে ধরতে চায়।শক্কুর ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিতে দিতে বলল,

-দুরো! নতুননি কুন? আমি আগে থেইক্কাই ভিক্ষা করি।

হাতে ভর দিয়ে গন্নায় খাওয়া শুক্কুর নেমে যাচ্ছে বাড়ির সিমানা থেকে ক্ষেতের আল বরাবর। সে হাসি হাসি মুখে একবার ফিরে তাকাল তার মার দিকে ।অগ্রাহায়নের হাল্কা কুয়াশায় দূর থেকে তার চোখের পানি আমেনা দেখতে পেল না।

শুক্কুর ক্ষেত ছেড়ে রাস্তায় উঠে আসল। ভোরের কনকনে শীত তার শীর্ন শরীরটাকে বেশ কাপিয়ে তুলছে ।দূর থেকে হাল্কা শোনা যাচ্ছে আমেনার বিলাপ তবু সে তাকাল না আর।তার হঠাৎ মনে পড়ল অনেক অনেক দিন আগের একটি দৃশ্য।দিনটি ছিল শুক্রবার।সেদিন তার বাবা তাদের দুই ভাইকে দেওয়ানশরীফ পীরের দরবারে নিয়ে গিয়েছিল। শুক্রবারে সেখানে প্রচুর ভীর হত।একসময় সাত আট বছরের শুক্কুরকে এক জায়গায় বসিয়ে অযু করতে গিয়েছিল তার বাবা আর সাদেক। ফিরে এসে দেখে শুক্কুরের সামনে কিছু পয়সা ছড়ানো ছিটানো।তখন তার বাবা শুক্কুরকে কোলে নিয়ে কেদে ফেলেছিল।শুক্কুরকে আনেক শক্ত করে ই বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বার বার বলছিল,

– আমার ছেরা ফইর মিছকিন নি কুন? ইড্ডা আমার পোলা। নবীর উম্মত।আমার ছেরা ভিক্ষা করে না।নবীর উম্মতরা ভিক্ষা করে না।

শুক্কুর একটু থেমে তার চোখ মুছে আবার চলতে শুরু করল।আমেনার বিলাপ এখন আর শোনা যাচ্ছে না।হাতের তালুতে ভর দিয়ে রাস্তায় চলার কষ্ট এড়াতে সে মোটা কাপড়ের পট্টীটা বেধে নেয়, তারপর দ্রুত চলতে থাকে।এখন আর তার শীত লাগছে না।ভর দিয়ে চলার প্রচুর পরিশ্রম তৈ্রি করছে অতিরিক্ত তাপ।পিঠের ব্যাগে রাখা থালা আর টুকটাক হাল্কা জিনিস মিলে অদ্ভুত শব্দ করছে। শব্দটা শুক্কুরের মনোযোগে আসেনা সব কিছু ছাপিয়ে তার বাবার বলা সেই কথাটাই বার বার কানে বাজছে,

“আমার ছেরা ভিক্ষা করে না”।

………………………………………………………………………………………………………………………………

দ্রঃগল্পটি ময়মনসিংহের ভাষায় লেখা।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


16 Responses to গ্রহন লাগা মানুষ………

You must be logged in to post a comment Login