মামুন ম. আজিজ

কালো জলের কষ্ট

কালো জলের কষ্ট
Decrease Font Size Increase Font Size Text Size Print This Page

(বুড়িগঙ্গার তীরে বড় হয়েছি, আজ তার ঘন কালো মৃত জল বড় কষ্ট দেয় , বড় কষ্ট)…


বুড়িগঙ্গার পার ঘেঁষে রাস্তা হয়েছে । পাকা রাস্তা।  পোস্তগোলা হতে একেবারে সেই আমিন বাজার। সেও অনেকদিন হয়ে গেছে। তাতে এই নদীটির কোন লাভই হয়নি। সে ধ্ুকছে। মরে গেছে সে তো সেই আরও আগে। তখন আমার শৈশব কাল। কত দাপিয়েছি। বিকেলে খেলেছি বালু তীরে। ইটের খোঁচায় কত রক্ত ঝরেছে পায়ের পাতায়। তারপর পরিষ্কার পানিতে অন্তত একটা শান্তির চুবানি তো  খেয়েছি। চোখের সামনে বেচারা মরে গেলো। এখনও সেই মৃত নদীর উপর মৃত্যু পরবর্তী নির্যাতন চলছেই। আমি এখনও মৃত নদীর সাথে  টিকে গেছি মায়ায়। মায়া বড় রহস্যময়। তবুও মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে অবসর পেলেই নদীর পারে ভেঙে পরা ঘাটে গিয়ে বসি। এ ঘাট আগে মেরামত হতো। এখন আর হয না। কালো কুচকুচে নোংরা জল দেখলে ওসব সংস্কারের কথা আর কারো মনে আসর কথা নয়। এ ঘাটের পাশে এককালে ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড় ধোপাকানা ছিল। এখন এই জলে ঘুনাক্ষরেও যদি ধোপারা কাপড় কাচে সে কাপড় আর দুগর্ন্ধের ঠেলায় গায়ে চড়াতে হবে না।
এত কালো জলেও মায়াগুলো ঠিকই চোখে ভাসে। কষ্ট হয়। কত ঘটনা পেছনের জীবনে, কত বিকেলে। সূর্যটা ডুবতে নদীর ওপারে। মুগ্ধ চোখে রূপ গিলতাম। নদী কয়েকটা ঢেউ ছড়িয়ে আমার সাথে উচ্ছাসে মিলত। নদীর সাথে আমার যেন কথা হতো সে বিকেল গুলোতে। মনে কষ্ট লাগার মত কত কিছুই তো জীবনে রোজ ঘটত। নদীর কাছে এসে সব বলে দিতাম। দিনের শেষে বিকেলে সে নিঃসঙ্গ নির্জনে আপন বন্ধুর মত স্বচ্ছ জলের সজীব নদী আমার কথাগুলো শুনত।
এক বিকালে বুড়িগঙ্গার সাথে কথা বলছি। সে জবাব দিচ্ছে হাসছে ঢেউ এর মালায়। তখনই তো মেয়েটা নামল গুদারাঘাটে। ২০/২৫ গজ দূরে। সম্ভবত মেয়েটা তাকিয়ে ছিল নৌকাতে থাকতেই । উদাস একটা ছেলে চুপচাপ বসে আছে। তার কৌতূহল জাগতেই পারে। তারপর শুরু হলো আমার কৌতূহল । নদী তাকে আমার কাছে টেনে এনেছে। নদী আমার অকৃত্রিম বন্ধু। আমার সেই অকৃত্রিম বুড়িগঙ্গা আর মৃত। তার জঠরে আজ কোন মাছ নাকি জন্মেনা। কি বিভৎস।
সেই মেয়েটাই আজ আমার বিবাহিত স্ত্রী। একটা দুটো তিনটে …এভাবে কয়েকটা বিকেল চোখাচোখির পর নদীটা একদিন এক সাথেই পার হয়ে ওপারে চলে গেলাম। অপারটা বেশ সবুজ ছিল তখন। এখন আর নেই। এপারে যেমন দখল বানিজ্য হয়ে নদীর তীর বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। এই রাস্তাটা হওয়ায় যা একটা ভেনিস ভেনিস মেকি ভাব আসতে গিয়েও এলোনা আর। আসবে কি করে সব দোষ তো বুড়িগঙ্গার কালো জলের। অথচ সে জল যে আমাদের ই দেয়া উপহার।
…ওপারে যেতে যেতেই বন্ধুত্ব। তার পর প্রেম। বউটা এখন আর ওপারে তার বাবার বাড়ীতে যেতে গেলে নদী পার হতে চায় না। দুদুটো ব্রীজ নদীর উপর। একবার বাধ্য হয়ে নৌকায় উঠেছিল। শাশুড়ী মর মর অবস্থা। কালো জলের পঁচা গন্ধে উল্টো বউটাই বমি টমি করে একাকার । শাশুড়ী সুস্থ হলো কিন্তু বউ এর হলো জন্মের বুড়িগঙ্গা অরুচী ধারে কাাছেও আর আসবেনা। সব ভুলে গেছে সে। কলেজে আসত পড়তে রোজ নদী পেরিয়ে, আমার সাথে এই নদীর জন্যই তো প্রেম হলো। সব সে ভুলে গেছে। অথচ আমি ভুলতে পারি না আমার সেইসব বিকেল যা কেটেছে একান্তে বুড়িগঙ্গার তীরে।
আজও এসেছি। মায়ার টান নিয়ে এসেছে। বউ জানে না। জানলে রাগ করে। সুর্যটা কালো জলে নামতে চায়না বুঝতে পারছি। রেগে আগুন। তবুও তো তাকে নামতেই হয়। কলো জলের মৃত নদীর বুক চিরে দুটো লঞ্চ এগিয়ে চলেছে সদরঘাটের দিকে। অনেকগুলো মানুষ দুটি লঞ্চের ডেকের উপরেই। কতরকম কীর্তি চলছে সেখানে। শেষ বিকেলের এই নিঃসঙ্গ মায়ায় আমি সে সব দেখেই সুখ খুঁজে পাই। ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি ক্ষনিক কালো জলের কষ্ট। তারপর…মুহূর্তে দুটো  লঞ্চের কি যে হলো। প্রচন্ড একটা ধাক্কার শব্দ। আমার শেষ বিকেলের নিঃসঙ্গতা ভেঙে হলো চৌচির। চোখের সামনে দেখছি , এই তো প্রায় ২০০ গজ দূরে। ডানের লঞ্চটা ডুবছে। লোকজনের সে কি গগন বিদারী আর্তনাদ। ঘাট থেকে নেমে ছুটছি নতুন  পাকা রাস্তা ধরে। মনে মনে ভাবছি…একি মৃত নদীর প্রতিশোধ ।

শৈলী.কম- মাতৃভাষা বাংলায় একটি উন্মুক্ত ও স্বাধীন মত প্রকাশের সুবিধা প্রদানকারী প্ল‍্যাটফর্ম এবং ম্যাগাজিন। এখানে ব্লগারদের প্রকাশিত লেখা, মন্তব‍্য, ছবি, অডিও, ভিডিও বা যাবতীয় কার্যকলাপের সম্পূর্ণ দায় শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট প্রকাশকারীর। ধন্যবাদ।


7 Responses to কালো জলের কষ্ট

You must be logged in to post a comment Login