কচ্ছপ ও খরগোস
আহমাদ মুকুল
– এইবার আমি পথিমধ্যে ঘুমাইয়া পড়িব না, নিশ্চিত থাকিও। স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে বলিলেন খরগোস মহাশয়। দুইকাপ গরম কাল কফি খাইয়া আসিয়াছে। কোমরে মোবাইল ফোন, এলার্ম সেট করা- এক মিনিট পর পর বাজিয়া উঠিবে।
নিরাসক্ত দৃষ্টিতে খরগোসের প্রস্তুতি দেখিতে দেখিতে অলস পদক্ষেপে দৌড়ের স্থানে যায় কচ্ছপ। মনে মনে ভাবে দৌড়ের শ্রেষ্ঠত্বে তাহার কীবা আসে যায়! সশব্দে বলে-
– যাহা প্রমাণ করিতে চাও, তাহা তো তোমার দায়। আমার কাজ কায়-ক্লেশে শেষ বিন্দুতে পৌঁছানো। তবে ভাই, এইবার অন্ততঃ দেখিও আমার মজুরিটা যাহাতে পাই। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটে আমার কোন আগ্রহ নাই।
গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট হইতে বুড়িগঙ্গা পর্যন্ত দৌড় হইবে।
শুরুর বাঁশি বাজিল। বিদ্যুৎ বেগে চলমান গাড়ির পিছু পিছু ছুটিল দৌড় পুঙ্গব খরগোস। কিছু দূর যাইতেই ট্রাফিকের সিগনাল বাতি। লালবাতি দেখিয়া খরগোস থামিয়া যায়। কান ঝালাপালা করিয়া হর্ন দিতে দিতে মোটর গাড়িসকল তাহাকে অতিক্রম করিয়া দিব্যি চলিয়া যায়। পার্শ্বে হাসপাতাল, সেইদিকেও কাহারো নজর নাই। সবুজ বাতি জ্বলিলে খরগোস যেই অগ্রসর হইতে যায়, ট্রাফিক পুলিশ আসিয়া গর্দানে দুইটি রদ্দা মারে।
– হ্যান্ড সিগনাল দেখিস না, পশু কোথাকার?
থামিয়া থাকা গাড়ির চালকেরা দাঁত কেলাইয়া হাসে, আর মনে মনে ভাবে কোন জঙ্গল হইতে যে এই সকল অর্বাচিনেরা আসে! ইহাদের কারণেই নগরে এত জানজট! সিগনাল বাবুর দিকে তাকাইয়া সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।
এইদিকে সড়কের গতি তারকাদের দ্বারা চাপা খাইবার ভয়ে একটু শান্তিতে চলিবার তরে কচ্ছপ ফুটপাথে উঠিয়া আসে।
আহা হা…ফুটপাথ! কী চমৎকার এই খানকার লোকজনেরা। দুই চারিজন আসিয়া তাহার নাঙ্গা দেহ দেখিয়া গায়ে পোষাক চড়াইয়া দেয়। বিনম্র প্রত্যাখ্যানও শুনে না। অনেকক্ষণ পরে নাদান কচ্ছপ বুঝিতে পারে- ইহারা হকার, তাহাকে ভাবিয়াছে খরিদ্দার। কচ্ছপের পোশাকের প্রয়োজনীয়তা নাই, অধিকন্ত তাহার নিকট কোন কিছু ক্রয় করিবার টাকা-কড়িও নাই। ইহা প্রকাশ করিয়া কচ্ছপ হৃদয়ঙ্গম করে- নিদারুন ভুল হইয়াছে। কেননা ইহাতে সে উক্ত পথে চলিবার অধিকার হারায়, উপরি হিসাবে লাথি-মাইর জোটে।
একজন শুভাকাঙ্খী কানে কানে বলিয়া যায়, তোমার নিকট টাকা-পয়সা নাই, বোধকরি একটা মোবাইলও নাই। ছিনতাইকারীর কবলে পড়িলে তোমার প্রাণনাশের আংশকা আছে! অনেক প্রশ্ন জাগে তাহার মনে। অর্থ থাকিলেই অনর্থ হয় বলিয়া জানিত। অর্থ না থাকিলেও দেখি এইদেশে পথে-প্রান্তরে অকালে প্রাণ যাওয়ার অবস্থা। কাটিয়া পড়িবার পথ খুঁজিতে খুঁজিতে বিনা ক্লেশে তাহার মুক্তি মিলে। কপাট ভাঙ্গা এক রন্ধ্র পথে সে গন্ধযুক্ত জলে নিপতিত হয়।
আফ্রিকান মাগুরের ক্রুদ্ধ নজর ব্যতিত ভালই চলিতে থাকে তাহার আগাইয়া চলা।
এইদিকে ট্রাফিক আইনের চক্করে পড়িয়া চঞ্চল শশক একচূলও আগাইতে সমর্থ হয় নাই। একসময় হঠাৎ দেখে রাস্তায় ব্যাপক আলোড়ন। উর্দি পরিহিতরা এলোমেলো ছুটাছুটি করিতেছে। মুহুর্তে সড়কটি যানমুক্ত করা হয়। তামাশা দেখিতে দেখিতে দৌড়ের কথা ভুলিয়াছে সে আগেই। ভ্যাপু বাজাইয়া চটকদার একটি গাড়িবহর আসে। খরগোস বুঝিতে পারে, ইহার জন্যই তাহা হইলে এত আয়োজন। নিশ্চয়ই বড় কোন নাগরিক! দ্বিতীয় চিন্তা না করিয়া তাঁহাকে অনুসরণ করিবার মন্স্থ করে। মনে মনে ভাবে, তিনি নিশ্চয়ই সকল আইন-কানুন মানিয়া অগ্রসর হইবেন।
খানিক চলিতেই অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করিল, আরে…ইনার জন্য তো কোন আইনই কার্যকর নাই। হাজার হাজার যান আটকাইয়া, রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্সের আর্ত চিৎকার উপেক্ষা করিয়া তাঁহার পথচলা নির্বিঘ্ন করা হইতেছে।
ক্লেদাক্ত মন নিয়া খরগোস মহাজনের গাড়ির পিছু ত্যাগ করিয়া আমজনতার কাতারে ফিরিয়া আসে। ‘রেস’ জয়ের বাসনা তাহার উবিয়া যায়। এই উল্টা দেশে খরগোসেরা কচ্ছপের কাছে পরাজিত হইবে, ইহাই তো স্বাভাবিক।
ঐদিকে কর্দম আবর্জনায় ভাসিতে ভাসিতে কাছিম এক জায়গায় আসিয়া আলোর দেখা পায়। ভাবে বুড়িগঙ্গায়ই আসিয়া পড়িল বুঝি। সচেতন(?) ঢাকাবাসী তো সকল নর্দমার পথ সরাসরি বুড়িগঙ্গাতেই মিশাইয়াছে! হাচড়াইয়া পাচড়াইয়া উঠিয়া দেখে প্রধান সড়ক। দৌড় সমাপনী বিন্দু সন্নিকটেই। মাঝ বরাবর আড়াআড়িভাবে পুরা রাস্তা কাটা, যানবাহন বন্ধ হইয়া আছে। রুদ্ধ যানবাহনের ভীরে এক কোণে গালে হাত দিয়া বসিয়া থাকা খরগোসকে দেখিতে পায়।
কচ্ছপ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়, তাহার স্পন্সর টাকা দিক আর নাই দিক, বহুত উল্টা নিয়ম দেখিয়াছে আজ, আর উল্টা হইতে দিবে না। এইবার সে খরগোসকে বিজয়ী হইতে দিবে।
সাতরাইয়া পরিখা পার হইয়া খরগোসকে পিঠে করিয়া এই পারে লইয়া আসে। বলে-
– আইসো বন্ধু, বাকী পথটুকু এক দৌড়ে পার হও।
খরগোস শান্ত স্বরে বলে, ভ্রাতঃ আমি বিজয়ী হওয়ার বাসনা আগেই ত্যাগ করিয়াছি। মনুষ্যদিগের দিকে তাকাইয়া দেখ। সবাই উল্টা পথে চলিতে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে। তোমার আমার সাধ্য কী, তাহাদের শিক্ষা দেয়? চল, আমরা বুনো জগতে ফিরিয়া যাই।
যেই দিন জানিব, এই দেশে নিয়ম চালু হইয়াছে, সেই দিন আসিয়া মনের সুখে দৌড়াদৌড়ি করিব।
21 Responses to কচ্ছপ ও খরগোস
You must be logged in to post a comment Login